#সংগোপনে
#ধারাবাহিক_পর্ব_৩১
#অচিন_পাখি_কলমে_ভাগ্যলক্ষ্মী_দাস
আগের পর্বের পর————-
কাজের মধ্যে একবার ডুবে যেতে পারলেই হল, কুহেলির আর বাকি কিচ্ছু মনে থাকে না। আজকেও প্রায় দিন দশেক পরে অফিসে পা দিয়েই যেন বাকি সব ভুলে গেল। কোথায় কালকের এত মন খারাপ! যেন কিছু হয়েইনি! রুহি প্রতিবারের মতই এবারও কুহেলিকে এতদিন পর দেখে খুব খুশি হল। একমাত্র এই মেয়েটার ব্যবহারেই ওর বিয়ের জন্য কোনও পরিবর্তন আসেনি। আগেও যেমন ছিল, এখনও ঠিক তেমনই আছে, আর এই কারণেই কুহেলির ওর প্রতি টানটা আরও বেড়ে গেছে। না হলে অফিসের বাকি সবার মধ্যেই একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করেছে কুহেলি। সবাই যেন ওকে একটু বেশিই সমীহ করছে, যদিও সেটা শুধুমাত্রই লোক দেখানো, মনে মনে কম বেশি সবাই ওকে যেন একটু অপছন্দ করে। কারোর ধারণা ও বেশ কায়দা করে আলেখকে ফাঁসিয়ে নিয়েছে, আবার কারোর ধারণা বিড়ালের ভাগ্যে শিকে ছিড়েছে। তবে কুহেলি সেসবে পাত্তাই দেয়না, সবাইকে খুশি করে চলা সম্ভব নয়, আর তার থেকে বড় কথা সে তো কোনও অন্যায় করেনি। কুহেলি রুহির জন্য একটা সুন্দর উলেন স্কার্ফ এনেছে, সেটা ওকে দিতেই রুহির মুখটা হাসিতে ভরে উঠল।
তুমি এটা আমার জন্য এনেছ?
তাই তো মনে হচ্ছে, কেন? পছন্দ হয়নি বুঝি?
কি যে বলো না দি, এত সুন্দর স্কার্ফ টা পছন্দ না হওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু তুমি যে মনে করে আমার জন্য গিফট এনেছ, আমি তাতেই খুব খুশি। আচ্ছা দি, কেমন ঘুরলে তোমরা? দারুন জায়গা বলো?
সব পরে শুনবে, এখন কাজে মন দাও। কাজ ফেলে গল্প করা আমি পছন্দ করি না, ভুলে যাওনি নিশ্চয়ই!
সে আর বলতে!
দুজনেই হেসে কাজে মন দিল, এই কয়েকদিনে কাজ বেশ খানিকটা এগিয়েছে। কুহেলির সবটা দেখে নিতে লাঞ্চ ব্রেক হয়ে গেল, এখন আলেখ আর কুহেলি একসাথেই লাঞ্চ করে। আজও ওরা আলেখের কেবিনে বসে লাঞ্চ করছিল, কুহেলিকে আবার স্বাভাবিক দেখে আলেখের বেশ ভালোলাগছিল। একবার ইচ্ছে হল জিজ্ঞেস করে কাল কি হয়েছিল, কিন্তু করল না। কি দরকার! যাই হয়ে থাকুক না কেন, কুহেলি যে সেটাকে মন থেকে সরিয়ে দিয়েছে এটা তো বোঝাই যাচ্ছে। আর কি চাই! টুক টাক কথা বলতে বলতে লাঞ্চ করছিল ওরা, হঠাৎ একটা ঝোড়ো হাওয়ার মতো কেবিনে ঢুকে এল রিতু। আর ওর পিছন পিছন ব্যস্ত হয়ে ঢুকল অঙ্কিত, বেচারার মুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট।
স্যার, সরি স্যার। আমি অনেক চেষ্টা করেছি ওনাকে আটকানোর, কিন্তু উনি কোনও কথাই শুনলেন না। আমি বলেছি আপনি উইদাউট অ্যাপয়েন্টমেন্টে কারোর সাথে দেখা করেন না, কিন্তু উনি কোনও কথাই শুনতে চাইছেন না।
রিতু ঠোঁট দুটোকে ফুলিয়ে একটু আদুরে গলায় বলল,
কিরে! তোর সাথে দেখা করতে হলে এখন আমাকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে হবে?
আলেখ একটু হেসে অঙ্কিত কে বলল,
ডোন্ট ওয়ারি অঙ্কিত, শি ইজ মাই ফ্রেন্ড। আর শুধু তুমি কেন, ওকে আটকানোর মত ক্ষমতা মনে হয় না এই বিশ্ব সংসারে কারোর আছে।
অঙ্কিত যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। অনুমতি নিয়ে চলে যেতেই আলেখ রিতুকে বলল,
বস, হঠাৎ অফিসে?
রিতু ঠিক আলেখের পাশে গিয়ে বসে বলল,
কেন? আমি আমার আলুর সাথে দেখা করতে আসতে পারি না?
অফকোর্স পারিস, বাট দেখলি তো এভাবে না জানিয়ে এসে বেচারা অঙ্কিতের কি হাল করেছিস!
আরে ছাড় তো ওসব, তুই বল আফটার অফিস তুই কি করছিস?
কেন?
বল না।
কিছু না।
গ্রেট, তাহলে তোর অফিসের পর আমরা শপিংয়ে যাব। কুহেলি তুমিও যাবে কিন্তু।
এতক্ষণে যেন দুজনের হুশ হয়েছে যে কুহেলিও ওখানেই আছে। না হলে এতক্ষণ তো কুহেলির নিজেকে অদৃশ্য মনে হচ্ছিল। কালকের সেই রাগ আর খারাপ লাগাটা হঠাৎ করেই যেন ফিরে এল। এমনিতেই অফিসে কোনও কারণ ছাড়া পরিচিত কারো আসাটা কুহেলির পছন্দ নয়। এটা কাজের জায়গা, বন্ধু বান্ধবদের নিয়ে আড্ডা দেওয়ার জন্য আরও অনেক জায়গা আছে। কুহেলির তো এটা ভেবেই অবাক লাগছে যে আলেখের মত একজন মানুষ এটা কীকরে মেনে নিচ্ছে! কুহেলি অনেক কষ্টে নিজের রাগটাকে সংযত করে একটু হেসে বলল,
সরি রাত্রি, আমার একটু কাজ পেন্ডিং আছে। শেষ করতে লেট হবে, আর তাছাড়াও আমার একজনের সঙ্গে দেখা করার কথা আছে।
আলেখ একটু জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে কুহেলির দিকে তাকিয়ে বলল,
কার সঙ্গে? আমাকে বলনি তো।
কুহেলি শীতল দৃষ্টিতে আলেখের দিকে তাকিয়ে বলল,
ভুলে গিয়েছিলাম, মিস্টার আগরওয়ালের সঙ্গে একটা মিটিং আছে।
নিশীথের নামটা শুনে আলেখের মুখের হাসিটা মুহুর্তের মধ্যে মিলিয়ে গেল। কুহেলি নিশীথের সঙ্গে দেখা করতে যাবে! আর এটা সে ওকে বলতে ভুলে গিয়েছিল! বুকের বাদিকটায় হঠাৎ একটা মৃদু যন্ত্রণা অনুভব করল আলেখ। কুহেলি ওকে না বলে নিশীথের সঙ্গে দেখা করতে যাবে এটা যেন কিছুতেই মানতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু কুহেলিরও বা কি দোষ! আলেখকে আগে থেকে বলার প্রশ্ন আসছে কোথা থেকে! সে তো নিজেই জানত না নিশীথের সঙ্গে দেখা করতে যাবে! এখন রাগের মাথায় হঠাৎ বলে ফেলেছে, কেন যে বলেছে নিজেও জানে না, আদৌ এই মুহূর্তে নিশীথ শহরে আছে কিনা সেটাই তো জানে না! আলেখ একটু গম্ভীর ভাবেই বলল,
কিসের মিটিং? আমি জানিনা তো, আর মিটিং হলে সেটা অফিসে হবে, বাইরে কেন?
কুহেলি বেশ বুঝতে পারল, ব্যাপারটা আলেখের পছন্দ হয়নি। মনে মনে যেন অদ্ভুত একটা খুশি অনুভব করল। কুহেলি খুব সহজ ভাবেই উত্তর দিল,
অফিসে বসে নিশ্চয়ই পার্সোনাল মিটিং করা যায় না! ওনার জন্য যে গিফট টা এনেছি সেটাই দেব। এটা একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার তাই অকারণে অফিসে নিজের ব্যক্তিগত লাইফ টাকে টেনে আনিনি।
কথাটা বলে কুহেলি একবার রাত্রির দিকে তাকাল। সে বেচারি কিছুই বুঝতে পারছে না, আর আলেখ সেদিকে লক্ষ্য করল না। ওর মনে এখন উথাল পাথাল চলছে, কুহেলি নিশীথ কে বন্ধুর বেশি কিছু ভাবে না এটা জানা সত্বেও কেন যেন ওকে হারিয়ে ফেলার একটা ভয় হচ্ছে। আলেখ খুব শান্ত স্বরে বলল,
কখন যাবে?
এই তো, অফিসের কাজ গুলো শেষ করেই যাব।
ও, কোথায়?
কুহেলিকে একটু মিথ্যের আশ্রয় নিতেই হল, কি করবে! বলে যখন ফেলেছে তখন তো আর পিছিয়ে আসা যায় না।
প্লেস টা এখনও জানাননি উনি, বলেছেন পরে জানিয়ে দেবেন।
আলেখের মুখে যেন অন্ধকারের ছায়া ঘনাল। কুহেলি সেটা বুঝতে পেরে মনে মনে যেন একটু খুশিই হল। খাওয়া কিছুক্ষণ হল হয়ে গিয়েছিল, কুহেলি উঠে দাড়িয়ে একবার রাত্রির দিকে তাকিয়ে একটা অদ্ভুত হাসি ঠোঁটের কোণে এনে বলল,
ওকে, আমি এবার আসছি। অনেক কাজ পড়ে রয়েছে, তোমরা বসে গল্প কর।
রিতু বলল,
তুমি সত্যিই যেতে পারবে না?
না গো, সরি।
ইটস ওকে, তুমি গেলে আরও বেশি ভাললাগত। বাট নো প্রবলেম, নেক্সট টাইম।
কুহেলি একটু হাসল, একটু খারাপও লাগছে, আসলে এভাবে মিথ্যে কথা বলা ওর স্বভাব নয়। তাছাড়া রাত্রি মেয়েটা খারাপ নয়, কিন্তু ওই যে, কিসের যে একটা বাধা! একটু হেসে কুহেলি চলে যাচ্ছিল, আলেখ ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
ওয়েট কুহেলি, আমার কিছু কথা আছে তোমার সঙ্গে। একটু বসো।
কুহেলি কেবিন থেকে বেরোলো না, কিন্তু বসলও না। আলেখ এবার রিতুকে বলল,
রিতু, আফটার ফাইভ আমি ফ্রী। কাজ শেষ হলে আমি তোকে কল করে নেব, এখন তুই আয়। বুঝতেই পারছিস, কাজের প্রেসার এখন একটু বেশিই। লাঞ্চ টাইমও শেষ হয়ে এসেছে প্রায়।
অফকোর্স, আমি এমনিতেও এখন একটু স্যালোঁতে যাব। অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা আছে, টাইম হয়েই এসেছে প্রায়। তুই তাহলে কল করে নিস, বাই আলু, বাই কুহেলি।
রিতু চলে যাওয়ার পর কুহেলি খুব সহজ ভাবেই বলল,
বলো কি বলবে?
আলেখ একটু ওর কাছে এগিয়ে এসে শান্ত স্বরে বলল,
মিস্টার আগরওয়ালকে গিফটটা কি আজকে দেওয়া খুব জরুরী ছিল? নেক্সট যেদিন উনি মিটিংএ আসতেন সেদিন দিলেও তো হত।
কুহেলি বুঝল আলেখ কিছুতেই চাইছে না ও নিশীথের সঙ্গে দেখা করতে যাক। একটা যেন চাপা কষ্টের ছাপ ফুটে উঠেছে ওর চোখ দুটোয়। কুহেলির হঠাৎ খুব খারাপ লাগল, আলেখের চোখে ফুটে ওঠা কষ্ট গুলো যেন ওর মনেও অনুভব করল। কিন্তু পরক্ষণেই সামলে নিল নিজেকে, কষ্ট তো ওরও হচ্ছে, কারনটা যদিও এখনও ওর কাছে অজানাই রয়ে গেছে কিন্তু তাই বলে ওর কষ্ট, রাগ, খারাপ লাগা এগুলো তো আর মিথ্যে হয়ে যায় না! তাই আলেখেরও হয়তো এটুকু কষ্ট পাওয়াই উচিৎ মনে করে কুহেলি আবার সেই স্বাভাবিক সুরেই বলল,
না, সেটা ভালো দেখায় না। উনি আমার বন্ধু, সেটা আমার পার্সোনাল লাইফ। আর এই অফিসের গণ্ডির মধ্যে ওনার সঙ্গে আমার সম্পর্ক প্রফেশনাল। উনি একটা অফিসিয়াল মিটিং করতে আসবেন আর আমি ওনাকে হঠাৎ একটা গিফট দেব, সেটা একটু অড হয়ে যায় না কি?
কথাটা একেবারেই ফেলে দেওয়ার মত নয়, কিন্তু আলেখের মন কিছুতেই এটা মেনে নিতে পারছে না যে কুহেলি নিশীথের সঙ্গে একা দেখা করতে যাবে। একটু হতাশ গলায় বলল,
হুম, ঠিকই বলেছ। তুমি যদি আগে বলতে তাহলে আমিও যেতে পারতাম।
কুহেলি একটু তির্যক হেসে বলল,
তার কোনও দরকার নেই, আর তাছাড়া তোমার বেস্টফ্রেন্ড রিতু এতদিন পর এসেছে। ওকে সময় দাও, আমার কথা না ভাবলেও চলবে।
শেষ কথাগুলোর সঙ্গে যেন না চাইতেই একটু অভিমানের সুর মিশে গেল। কুহেলি কথাগুলো বলে আর দাড়াল না, কেবিন থেকে বেরিয়ে নিজের ডেস্কের দিকে এগিয়ে গেল। তবে দুজনের কেউই সেভাবে কাজে মন বসাতে পারল না, দুজনের মনে দুটো ভিন্ন চিন্তা ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে। আলেখের মনে ঘুরছে এনগেজমেন্টের দিন নিশীথের বলা শেষ কথা গুলো,
‘লাইফ যদি আবার কোনোদিন আমাকে দ্বিতীয় সুযোগ দেয় আমি কিন্তু সেটা হাতছাড়া করার মত মানুষ নই। আই থিঙ্ক আপনি বুঝতে পেরেছেন আমি কি বলতে চাইছি, সুতরাং নিজেদের এই বোঝাপড়ার সম্পর্কটাকে এতটাই মজবুত করে গড়ে তুলুন যাতে অন্য কেউ কোনও সুযোগ না পায়।’
আলেখের মনে একটা অজানা ভয় কাজ করতে লাগল। এখনও তো সে কুহেলির মনে নিজের জন্য আলাদা কোনও জায়গা তৈরি করে নিতে পারেনি। যদি…..পরক্ষণেই আলেখ যেন নিজেকেই ধিক্কার দিয়ে উঠল।
এসব কি ভাবছি আমি! কুহেলির প্রতি আমার সম্পূর্ণ বিশ্বাস আছে, ও কোনদিনও আমাদের সম্পর্কের অসন্মান করবে না। আমি অযথাই এতকিছু ভাবছি, নাহ, এত বেশি ভাবাটা বোধহয় ঠিক হচ্ছে না।
মনে মনে যেন নিজেকে শান্ত করার একটা ব্যর্থ প্রয়াস চালালো। কুহেলির প্রতি ওর বিশ্বাসের অভাব নেই ঠিকই, কিন্তু তাও একটা অস্বস্তি যেন থেকেই গেল। আর কুহেলি…. সে তো পড়েছে মহা সমস্যায়, আলেখকে একবার যখন বলেছে তখন পিছিয়ে আসার কোনও প্রশ্নই নেই। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এখন নিশীথের সঙ্গে কিভাবে কথা বলবে! আর কিই বা বলবে? সদ্য ওদের বন্ধুত্তটা একটু সহজ হয়েছে, কিন্তু এখনও তেমন পর্যায়ে পৌঁছায়নি যেখানে দাড়িয়ে যখন ইচ্ছে তখন নিশীথ কে ফোন করতে পারে। আর তাছাড়াও নিশীথ ব্যস্ত মানুষ, এখন শহরে নাই থাকতে পারে, তখন কি হবে? ভাবতে ভাবতে কুহেলির মাথা যন্ত্রণা শুরু হয়ে গেল, এইজন্য মিথ্যের আশ্রয় নেওয়া ওর একদম পছন্দ নয়। আপাত দৃষ্টিতে সব ঠিক আছে মনে হলেও আসলে সবটাই যেন ধীরে ধীরে মিথ্যের জালে জড়িয়ে কেমন তালগোল পাকিয়ে যায়। কিন্তু এখন অত ভেবে লাভ নেই, এমনিতেও গিফটটা দিতে হবে, অফিসে তো আর সত্যিই দেওয়া যাবে না, তার থেকে এইই ভালো। ফোনটা হাতে নিয়ে নিজের সিট ছেড়ে উঠে বাইরে চলে এল কুহেলি, নম্বরটা ডায়াল করে কানে লাগানোর কিছুক্ষণের মধ্যেই ওপাশ থেকে নিশীথের বিস্ময় জড়ানো আওয়াজ ভেসে এলো।
আমি কি স্বপ্ন দেখছি নাকি? মিসেস কুহেলি আলেখ শর্মা আমাকে ফোন করেছেন!!
কুহেলি অল্প একটু হেসে বলল,
এত লম্বা নাম নেওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই মিস্টার আগরওয়াল, শুধু কুহেলি বললেই হবে।
ইয়েস, আই রিমেম্বার, আমাকে কুহেলি বলার পারমিশন দিলেও আপনি নিজে এখনও সেই মিস্টার আগরওয়ালেই স্টিক করে আছেন।
আমি ওটাতেই বেশি কম্ফর্টেবল।
বেশ, বলুন আজ হঠাৎ কি মনে করে?
কুহেলি একটু ইতস্তত করে বলল,
আসলে একটু দরকার ছিল।
সেতো বুঝতেই পারছি, এবং সেটা যে বেশ গুরুত্বপূর্ণ সেটাও বুঝতে পারছি। না হলে আপনি নিজে আমাকে ফোন করতেন না, বলুন ডিলের কোন পার্ট টায় কি প্রবলেম আছে।
কুহেলি ব্যস্ত হয়ে বলল,
না না, ডিলের কোথাও কোনও প্রবলেম নেই। আসলে দরকার টা প্রফেসনাল নয়, পার্সোনাল।
নিশীথ একটু থেমে বলল,
আমি ঠিক শুনলাম কিনা বুঝতে পারছি না, আপনার আমার সঙ্গে পার্সোনাল দরকার আছে!
হুম। যদি আপনার খুব অসুবিধা না হয়, তাহলে একটু দেখা করতে পারবেন আজকে?
অসুবিধা!! কিসের অসুবিধা? আপনি এই প্রথম নিজে থেকে আমার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছেন, আর আমার অসুবিধা থাকবে? আই হ্যাভ নো প্রবলেম, বলুন কোথায় কখন আসতে হবে?
কুহেলি একটু ভেবে স্কাইটাচ শপিং মলের ক্যাফে সেন্ট্রালের কথা বলে দিল। ওঙ্কার ভিলা থেকে ওটাই কাছে হবে, নিশীথের গিফট টা তো আর নিয়ে আসেনি। আগে ওটা ওঙ্কার ভিলা থেকে নিতে হবে তারপর ওখানে যেতে হবে। সবদিক হিসেব করে নিশীথকে সাড়ে ছটায় আসতে বলে দিল। কথা শেষ করে যেন একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিল কুহেলি, এবার ঝটপট বাকি কাজ গুলো গুছিয়ে নিতে হবে। এদিকে আলেখ ঠিক মত আর কাজে মন বসাতেই পারল না, মন অশান্ত থাকলে যা হয় আর কি। পাঁচটা বাজতে চলল প্রায়, একবার ভাবল রিতুকে বারন করে দেবে কিন্তু পরক্ষণেই কুহেলির বলা কথাটা মনে পড়ল। সত্যিই রিতু কত বছর পরে এসেছে, আর ওর জন্যই এসেছে, নাহলে এখন রিতুর ইন্ডিয়ায় আসার অন্য কোনও কারণ নেই। এত ব্যস্ততার মধ্যেও সময় করে এসেছে মেয়েটা, ওকে সময় দেওয়া উচিৎ। কথাটা মনে হতেই হঠাৎ আলেখের মনে একটা অন্য ভাবনা উকি দিল, কানে যেন ফিরে ফিরে আসতে লাগল কুহেলির বলা কথাগুলো।
‘তোমার বেস্টফ্রেন্ড রিতু এতদিন পর এসেছে। ওকে সময় দাও, আমার কথা না ভাবলেও চলবে।’
কথা গুলোয় কি একটু অভিমান মিশে ছিল! হঠাৎ করেই যেন আলেখের চিন্তার একটা নতুন দিক খুলে গেল। একটু ভাবতেই খেয়াল হল, ঠিক কালকে থেকেই, না আরও ভালো করে বলতে গেলে রিতু আসার পর থেকেই যেন কুহেলির মধ্যে একটা পরিবর্তন এসেছে। আজকেও তো সব ঠিকই ছিল, রিতু আসার পরেই যেন কুহেলির ব্যবহারে আবার একটা পরিবর্তন এসেছে। তবে কি…. আলেখের মনে একটা আশঙ্কা দেখা দিল, উঁহু, এটাকে আশঙ্কা কোনোমতেই বলা চলে না। আলেখের কাছে এটা যেন আশার আলো, আর এই আলোর ক্ষীণ সংকেত পেয়েই যেন ওর মনটা খুশিতে ভরে উঠল। কুহেলি ওকে নিয়ে জেলাস ফিল করছে! রিতুর আলেখের সঙ্গে এত খোলামেলা আচরণে কুহেলি খুশি হতে পারছে না, আর সেই কারণেই কি ওর কালকে মন খারাপ ছিল! নিজের অজান্তেই আলেখের ঠোঁটে একটা হাসি ফুটে উঠল, খুশি হওয়ারই কথা বটে। কুহেলির মনে নিশ্চয়ই ওর জন্য আলাদা অনুভুতি আছে, নাহলে রিতুকে দেখে এভাবে অদ্ভুত আচরণ করত না। হয়তো কুহেলি নিজেও জানে না ওর মনের কোণে অজান্তেই কিছু বিশেষ অনুভূতিরা জায়গা করে নিয়েছে। আলেখ একবার উঠে দরজাটা একটু ফাঁক করে কুহেলির দিকে তাকিয়ে আপনমনে বলল,
তোমার মনেও তাহলে আমার জন্য ভালোবাসারা জন্ম নিচ্ছে কুহেলি, এখনও তুমি হয়তো তাদের চিনতে পারোনি। নো প্রবলেম, আমি তোমাকে সাহায্য করব তোমার মনের অনুভূতি গুলোকে চিনে নিতে। নিজের ভালোবাসাকে উপলব্ধি করেই তুমি আমার ভালোবাসাকেও অনুভব করতে পারবে।
আলেখ বেশ খুশি মনে নিজের ব্যাগটা গুছিয়ে রিতুকে ফোনটা করেই বেরিয়ে পড়ল। ইচ্ছে করেই কুহেলিকে বলে বেরোল না, এত সুন্দর সুযোগ কাজে না লাগানো টা নিতান্ত বোকামি হবে। আলেখের কাছে এ যেন মেঘ না চাইতেই জল, স্বয়ং ব্রহ্মাস্ত্র ওর হাতে এসে পড়েছে, সেটা প্রয়োগ করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। আলেখ দেখতে না পেলেও ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ ব্যর্থ হল না, আলেখের এভাবে ওকে কিছু না বলে অফিস থেকে বেরিয়ে যাওয়ায় কুহেলির মনের রাগটা যেন দ্বিগুণ হয়ে উঠল। হাতের কাজ গুলো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গুছিয়ে বেরিয়ে পড়ল। বর্ষাকাল প্রায় শেষের দিকে তবে এখনও যখন তখন বৃষ্টি নামে, আজও আকাশের মুখটা ভার, যেকোনো সময় বৃষ্টি শুরু হয়ে যেতে পারে। ঠিক যেন কুহেলির মন টার মত, ওর মনের আকাশটাও মনখারাপের মেঘে ছেয়ে আছে। ওঙ্কার ভিলায় পৌঁছে নিশীথের জন্য আনা গিফটটা নিয়ে কুহেলি যখন স্কাইটাচ শপিং মলের ক্যাফে সেন্ট্রালে পৌঁছাল, তখনও সাড়ে ছটা বাজতে দশ মিনিট বাকি। মনখারাপের সঙ্গে রাগটা মিশে যেন একটা অদ্ভুত দমবন্ধ করা পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে ওর মনের মধ্যে। এই মুহূর্তে কারোর সঙ্গে কথা বলার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই ওর, কিন্তু কিছু করার নেই। নিশীথ কে বলা হয়ে গেছে, এখন আর কিছু করার নেই, ঠিক সাড়ে ছটার সময় নিশীথ এল। কুহেলিকে দেখে একটু হেসে বলল,
আমার কিন্তু এখন আপনাকে সামনা সামনি দেখে তবে ফাইনালি বিশ্বাস হল যে দিস ইজ নট এ ড্রিম।
কুহেলি অল্প একটু হাসল শুধু। নিশীথ ওর উল্টো দিকের চেয়ারটায় বসল, একজন ওয়েটার অলরেডি এসে ওদের অর্ডারের অপেক্ষা করছে। নিশীথ দুটো কফি অর্ডার করে দিয়ে বলল,
বলুন, কি দরকার? যার জন্য আপনি নিজে আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইলেন।
কুহেলি একটু ইতস্তত করতে লাগল, কি বলবে! তেমন কোনও বিশেষ দরকার তো নয়। ওর ব্যাগ থেকে একটা বক্স বের করে নিশীথের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
তেমন বিশেষ কিছু নয়, এটা আপনাকে দেওয়ার ছিল। অফিসে দেওয়াটা ঠিক হত না মনে করে আপনাকে এখানে ডাকলাম।
নিশীথ একটু অবাক হয়ে বলল,
এটা কি?
কুহেলি সামান্য হেসে বলল,
একটা ছোট্ট গিফট।
গিফট!
হুম, জানেন নিশ্চয়ই আমরা সুইটজারল্যান্ড গিয়েছিলাম। আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধব সবার জন্যই কিছু না কিছু এনেছি, এটা আপনার জন্য। তেমন বিশেষ কিছু না, আপনার কাছে হয়তো একদমই সাধারণ।
নিশীথের মুখটা বিস্ময়ে ভরে উঠল, ওর যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না।
আপনি আমার জন্য গিফট এনেছেন! সত্যি?
এটা কি মিথ্যে মনে হচ্ছে?
না তা নয়, কিন্তু ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না।
বিশ্বাস না হওয়ার তো কিছু নেই। আমি আমার সব বন্ধুদের জন্যই কিছু না কিছু এনেছি, আপনিও তো আমার বন্ধু।
আপনি সত্যি সত্যি আমাকে নিজের বন্ধু ভাবেন!
মিথ্যে মিথ্যে কাউকে বন্ধু ভাবা যায় বলে তো মনে হয় না।
নিশীথের বেশ কিছুক্ষণ লাগল ওর অবাক ভাবটা কাটাতে। তারপর একটু হেসে বলল,
আপনি জানেন আমি রেখে ঢেকে কথা বলা পছন্দ করি না। সত্যি বলতে আমি এতদিন ভাবতাম আপনি হয়তো এমনিই, শুধু মুখে বলার জন্যই আমার বন্ধুত্ব টা স্বীকার করেছিলেন। কিন্তু আজ দেখছি….
কথাটা শেষ না করেই নিশীথ বক্সটা খুলল, একটা পার্সোনালাইজড সিলভার ব্রেসলেট। ব্রেসলেটের ঠিক মাঝখানে নিশীথের নামের আদ্যক্ষর দুটো খুব সুন্দর কারুকার্য করে লেখা, ‘এন.এ’। নিশীথ ব্রেসলেট টা হাতে নিয়ে বলল,
বিউটিফুল, আর কি বলছিলেন? এটা বিশেষ কিছু নয়! আমার কাছে নিতান্তই সাধারণ! ইউ আর রং, এটা আমার কাছে খুবই স্পেশাল, বিকজ এটা আপনি আমাকে দিয়েছেন।
নিশীথ তখনই ব্রেসলেট টা পরে নিল, কুহেলির খুব ভালোলাগলো। নিশীথ ওর হাতটা একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে একটু হেসে বলল,
তবে কুহেলি, গিফটের সঙ্গে সঙ্গে বেশ ভালোভাবেই আপনি আমাকে একেবারে পাকাপাকি রিজেকশন লেটারটাও ধরিয়ে দিলেন।
কথাটা কুহেলি ঠিক বুঝতে পারল না, একটু অবাক হয়ে বলল,
মানে! ঠিক বুঝতে পারলাম না।
নিশীথ হেসে ওর ব্রেসলেটের ওপর লেখা ওর নামের আদ্যক্ষর দুটোর দিকে ইঙ্গিত করে বলল,
এই যে, ‘এন.এ’ .. নট অ্যাপ্লিকেবল।
কুহেলি হঠাৎ হেসে ফেলল, প্রাণখোলা সেই হাসি দেখে নিশীথের মনে একটা অদ্ভুত সুন্দর আনন্দের ছোয়া লাগল। ভালোবাসা যে সবসময় পাওয়ার নাম নয় এটা সে জানলেও তার প্রকৃত অর্থ টা যেন আজ উপলব্ধি করতে পারল। নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে খুশি দেখলে যে এতোটা আনন্দ অনুভব করা যায়, এটা জানা ছিল না। নিশীথ যেন আজ বুঝতে পারল, না পাওয়ার মধ্যে দিয়েও অনেকসময় সব পাওয়া হয়ে যায়। নিশীথের চোখে যখন আনন্দের প্রতিফলন ঘটছে তখন কিছুটা দূরে একজোড়া চোখে ফুটে উঠছে রাগ কষ্ট অভিমানের সম্মিলিত এক অভিব্যক্তি। ঠিকই ধরেছেন, আলেখ আর রিতু গোটা শহরের মধ্যে এই মলটাই বেছে নিয়েছিল। যদিও এটা খুব অস্বাভাবিক কিছু নয়, এমনিতেই স্কাইটাচ শহরের নামকরা শপিং মল, আর তাছাড়া এটা ওদের বাড়ির কাছেও। ক্যাফে সেন্ট্রাল গ্রাউন্ড ফ্লোরে, ফার্স্ট ফ্লোরের একটা শপ থেকে বেরিয়ে অন্যদিকে যাওয়ার সময় হঠাৎ আলেখের চোখ পড়ে যায় ক্যাফে সেন্ট্রালের স্বচ্ছ কাচের ওয়ালের ওপারে বসে থাকা কুহেলির দিকে। নিশীথের সঙ্গে বসে গল্পে ব্যস্ত, প্রাণখোলা সেই হাসিটা দেখে আজ যেন বড্ড কষ্ট হল। কোথায় ভেবেছিল এই সুযোগে কুহেলির মনের অনুভূতি গুলোকে জাগিয়ে তুলবে আর সেখানে এখন নিজের মনেই সব তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। একটু পরেই নিশীথ আর কুহেলি দুজনেই বেরিয়ে গেল। রিতু অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছিল, আলেখ যে ওর সঙ্গে নেই সেটা খেয়াল করেনি। পরে খেয়াল হতেই পিছন ফিরে দেখল আলেখ একভাবে গ্রাউন্ড ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা দেখছে। চোখ মুখ কেমন যেন পাল্টে গেছে, সেই ছোট থেকে চেনে সে আলেখকে। কিছু যে একটা হয়েছে সেটা বুঝতে পেরেছে, একটু আগেও তো বেশ হাসি খুশিই ছিল। হঠাৎ কি এমন দেখল! ওর পাশে গিয়ে দাড়িয়ে ওর দৃষ্টি অনুসরণ করেও তেমন কিছু দেখতে পেল না। এন্ট্রেন্সের দিকে ওভাবে কেন তাকিয়ে আছে ঠিক বুঝতে পারল না। কীকরে বুঝবে! কুহেলি আর নিশীথ তো ততক্ষণে বেরিয়ে গেছে। রাত্রি একবার আলেখের দিকে তাকাল, বেশ সিরিয়াস দেখাচ্ছে, প্রশ্ন করে লাভ নেই জানে তাও একটু হালকা ভাবেই বলল,
ওয়ে, কি দেখছিস ওভাবে?
আলেখ চমকে পাশে তাকাল, যেন ভুলেই গিয়েছিল এখানে সে রাত্রির সঙ্গে এসেছে।
নাথিং, তোর শপিং হলো?
উহু, এখনও তো এথনিক সেকশনে যাওয়াই হয়নি।
আলেখ খুব ক্লান্ত গলায় অনুরোধের সুরে বলল,
পরে গেলে হয় না?
রাত্রি বুঝল কোনও কারণে আলেখের মন ভালো নেই, হাসি মুখে বলল,
অফকোর্স হয়। এমনিতেও সব শপিং একদিনে করে নিলে বাকি দিনগুলোয় কি করব!
আলেখ অল্প একটু হাসল, রাত্রি যে ওর কথা ভেবেই এমনটা বলল সেটা আলাদা করে বলে দিতে হয় না। ওরা দুজন বেরিয়ে রওনা দিল ওঙ্কার ভিলার উদ্দেশ্যে। খুব বেশিক্ষণ লাগল না পৌঁছাতে, আলেখ বারবার রিতুকে আসতে বলল কিন্তু সে রাজি হল না। তার নাকি এখন ত্বক পরিচর্যা করার সময়, আলেখ আর বিশেষ কথা না বাড়িয়ে চলে গেল। নিজের ঘরে ঢুকে দেখল কুহেলি সদ্য ফ্রেশ হয়ে বেরিয়েছে, আলেখ ওর স্বাভাবিক হাসিটা বজায় রেখেই বলল,
কখন এলে?
কুহেলির মুড টা বেশ ভালই ছিল, খুব সহজ ভাবেই উত্তর দিল,
এইতো, একটু আগেই।
ও।
আর কিছু বলার মত খুঁজে পেল না আলেখ। বলতে চায় অনেক কিছুই কিন্তু সবসময় কথারা ভাষা পায় না। কুহেলি ওর ল্যাপটপ টা বের করতে করতে বলল,
তোমাদের এত তাড়াতাড়ি হয়ে গেল?
হুম।
আলেখ ছোট্ট করে উত্তর দিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। কুহেলি সেদিকে একটু তাকিয়ে যেন আলেখের মনটা বোঝার চেষ্টা করল। তবে খুব একটা লাভ হল না, আসলে নিজের মনেই তো বিভ্রান্তির শেষ নেই! কি করছে কেন করছে এসব কিছুর উত্তর যেন একসাথে জট পাকিয়ে গেছে। নিজের মনের খবর ঠিকমত না জানলে আর অন্যের মনের কথা কীকরে বুঝবে! আলেখ ওয়াশরুমে ঢুকে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে শাওয়ারের তলায় দাড়িয়ে রইল। ঠান্ডা জলের স্পর্শে অশান্ত মনটা যেন ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে এল। বাইরে বেরিয়ে দেখল কুহেলি একমনে কাজ করছে, একটু হাসল সেদিকে তাকিয়ে। কেন যে অযথাই উল্টোপাল্টা চিন্তা গুলো মাথায় আসে! আসলে মনটা বড্ড অবুঝ। কিন্তু এখন আর অবুঝ হলে চলবে না, এই সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না। আলেখের আজ আর কাজ করতে ইচ্ছে করল না, তাছাড়া এই কয়েকদিনে নভতেজ বাবু কাজ অনেকটা এগিয়ে রেখেছেন। কুহেলি বেডের নিজের সাইডে বসে কাজ করছিল, আলেখ সোফায় বসেই নিজের কাজ করে তাই কুহেলি বেডে বসে। আলেখ ইচ্ছে করেই আজ বেডে বসল, কুহেলি এখনও অবশ্য সেটা খেয়াল করেনি। একমনে কিছু একটা করছে, আলেখ কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখেই কুহেলির পাশে বসে একবার ল্যাপটপের স্ক্রীনে চোখ বোলাল, নতুন প্রজেক্টের ড্রাফট নিয়ে বসেছে। আলেখ নিজের ধারণা টাকে নিশ্চিত করার জন্য বলল,
জানো কুহেলি রিতুও না তোমার মত, সারাটা মল ঘুরে বেড়িয়ে এত শপিং করল, যে শেষে ব্যাগ গুলো ক্যারি করার জন্য আরও একজনকে ডাকার পরিস্থিতি হয়ে পড়েছিল।
কুহেলি এতক্ষণ লক্ষ্যই করেনি কখন আলেখ ওর পাশে এসে বসেছে। প্রথমটায় একটু চমকে উঠল, কিন্তু একটু পরেই কথাগুলো শুনে যেন আবার সেই রাগটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে লাগল। কিছু না বলে শুধু একটা শুকনো হাসি ফিরিয়ে দিল আলেখকে। কুহেলির পাল্টে যাওয়া অভিব্যক্তি নজর এড়াল না আলেখের। ঠোঁটের কোনের হাসিটা আরও একটু প্রশস্ত হল, ওর অনুমান একদম সঠিক। কুহেলিকে আরও কিছু একটু বলতে যাচ্ছিল আলেখ কিন্তু তার আগেই প্রভাত এসে জানাল নভতেজ বাবু আলেখকে একবার ডাকছেন। আলেখ উঠে চলে গেলে কুহেলি বন্ধ দরজাটার দিকে একবার তাকিয়ে বিরক্তি সহকারে ল্যাপটপ টা বন্ধ করে সরিয়ে রাখল। এই অদ্ভুত পরিস্থিতি ওর একেবারেই ভালোলাগছে না, একটা আশঙ্কা উকি দিচ্ছে মনে কিন্তু সেটা কিছুতেই বিশ্বাস করতে চাইছে না। এইসব উটকো পরিস্থিতি গুলো কেন যে বারবার ওর জীবনেই হানা দেয় কে জানে! ওদিকে আলেখ নভতেজ বাবুর ঘরে ঢুকতেই তিনি সবিশেষ উত্তেজিত হয়ে বললেন,
আয় বোস, বল আগামী পরশুর জন্য কি প্ল্যান করলি?
আলেখ আকাশ থেকে পড়ল, পরশু আবার এমন কি আছে! যার জন্য আলাদা করে প্ল্যান করতে হবে?
কিসের প্ল্যান? কি আছে পরশু?
নভতেজ বাবু আরও বেশি অবাক হয়ে বললেন,
তুই সত্যিই জানিস না পরশু কি!!
না।
এবার নভতেজ বাবু একটু বিরক্ত হয়ে বললেন,
অপদার্থ কোথাকার, নিজের স্ত্রীয়ের বার্থডে মনে নেই তোর?
আলেখ চমকে উঠল, পরশু কুহেলির জন্মদিন! এটা সত্যিই জানা ছিল না, আসলে কোনোদিন জানার চেষ্টাও করেনি, মাথাতেই আসেনি কখনও। একটু ইতস্তত করে বলল,
আসলে… সেভা…
কথাটা শেষ হল না, নভতেজ বাবু আবার ধমকে উঠলেন।
থাক, অনেক করেছিস। আর কিছু বলতে হবে না। ভাগ্যিস তোর ভরসায় বসে থাকিনি। শোন এবার, পরশুদিন আমি একটা পার্টির আয়োজন করেছি। কুহেলির প্রথম বার্থ ডে এইবাড়িতে, স্পেশাল হতেই হবে। তবে আমি ইচ্ছে করেই মিডিয়াকে ইনভলভ করিনি, অযথা ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ নেই।
হুম, এটা ঠিক করেছ। তা তুমি যে মোটামুটি সব কিছুই করে রেখেছ বুঝতেই পারছি আমার জন্য কি বাকি আছে বলো।
কিছুই বাকি নেই, শুধু কালকে অফিসে গিয়ে পরশু দিনটা ডে অফ্ করে দিবি। আর সবাইকে ইনভাইটও করবি।
কিন্তু ড্যাড, অফিস অফ্ করার কি দরকার! কুহেলি শুধু যাবে না তাহলেই তো হবে। এখন হঠাৎ একটা ডে অফ্ দেওয়াটা ঠিক হবে না।
বলছিস?
ইয়েস ড্যাড।
ওকে, তাহলে তাই কর। আচ্ছা আজকেই কুহেলিকে কিছু বলার দরকার নেই, আমি কালকে ব্রেকফাস্ট টেবিলে সবাইকে একসাথে বলব, রাত্রিকেও আসতে বলে দিয়েছি।
ওকে। আচ্ছা কোলকাতায় মা আর ঠাম্মুকে জানানো হয়েছে?
হুম, ওনাদের তো সবার আগেই জানিয়েছিলাম কিন্তু ওনারা আসতে পারবেন না। আমি ওনাদেরকেও আপাতত কুহেলিকে কিছু বলতে বারন করেছি। একেবারে কালকেই জানতে পারবে, ইচ্ছে ছিল সারপ্রাইজ পার্টি দেব কিন্তু কুহেলিকে না জানিয়ে বাড়িতে এত আয়োজন করা যাবে না।
হুম, সেটাও ঠিক।
আচ্ছা যা এবার, দেখি আমার কিছু পরিচিত বন্ধু বান্ধবদের এখনও ইনভাইট করা হয়নি।
বাকি সময়টা নির্বিঘ্নেই পেরিয়ে গেল, ডিনারে কিছু টুকটাক কথা আর তারপরেই নিদ্রাদেবীর কোলে আত্মসমর্পণ। সকালটাও অন্যদিনের মতই শুরু হল, কুহেলি আর আলেখ একেবারে অফিসের জন্য তৈরি হয়ে ব্রেকফাস্ট টেবিলে এল। নভতেজ বাবু ইতিমধ্যেই উপস্থিত আর সঙ্গে রাত্রিও। ওকে দেখা মাত্রই না চাইতেও কুহেলির মনে আবার সেই সংমিশ্রিত অনুভুতি গুলোর আনাগোনা শুরু হল। আলেখ যেন সেটা কিছুটা আন্দাজ করেই ইচ্ছে করে কুহেলির পাশে না বসে রাত্রির পাশে বসল। আপাত দৃষ্টিতে এমন কিছুই নয়, কিন্তু এই সামান্য ঘটনাতেই কুহেলির পুরো মেজাজটাই বিগড়ে গেল। না চাইতেও গভীর চোখ দুটোয় ওর মনের অভিব্যক্তির ছায়া পড়ল, আর সেটা আলেখের নজর এড়াল না। তবে এই মনখারাপের মেঘ আজ আর বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না, নভতেজ বাবু আগামীকালের পার্টির কথা বলতেই কুহেলির মন থেকে বাকি সব কিছু উধাও হয়ে গিয়ে একরাশ লজ্জার আগমন ঘটল, সঙ্গে কিছুটা অস্বস্তিও। একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল,
ড্যাড এসবের কি দরকার! এভাবে বার্থ ডে পার্টি… তাছাড়া…
কুহেলিকে কথা শেষ করতে না দিয়েই নভতেজ বাবু বললেন,
কি দরকার সেটা আমি বুঝব, ওটা তোমায় ভাবতে হবে না। আর হ্যা, কালকে কিন্তু তুমি অফিসে যেতে পারবে না।
কিন্তু ড্যাড অনেক কাজ রয়েছে।
সেসব আলেখ বুঝে নেবে, তুমি কালকে যাচ্ছ না। এটাই ফাইনাল।
কুহেলি আর কিছু বলতে পারল না, একটু অদ্ভুত লাগলেও বেশ ভালই লাগছে। রাত্রি তো রীতিমত লিস্ট করে ফেলল, কি কি শপিং করবে, কোথায় কোথায় গেলে বেস্ট ড্রেস গুলো পাওয়া যাবে। এককথায় রাত্রি যেন সব থেকে বেশি উৎসাহিত, ব্রেকফাস্ট সেরে ওরা তিনজনেই একসাথে বেরোল। কুহেলি আর আলেখ গাড়ির কাছে পৌঁছলে রাত্রি বলল,
কুহেলি আজ কিন্তু কোনও বাহানা শুনব না, তোমাকে আমার সঙ্গে শপিংয়ে যেতেই হবে, আর আলু তুইও যাবি কিন্তু।
কুহেলি বারন করার একটু ক্ষীণ প্রচেষ্টা করল বটে কিন্তু তাতে কোনও লাভ হল না। রাত্রি কিছুই শুনল না, ওর বক্তব্য,
কাম অন কুহেলি, ইটস ইওর বার্থডে। বেশ জমিয়ে শপিং না করলে চলবে! আলুর পকেট পুরো ফাঁকা না করে আজ আর ছাড়ছি না।
কুহেলি না হেসে পারল না, শেষে ঠিক হল অফিস আওয়ার শেষ হলে রাত্রি অফিসে যাবে আর সেখান থেকেই একসঙ্গে ওরা মিশন শপিংয়ের উদ্দেশ্যে রওনা হবে। অফিসে পৌঁছে আলেখ প্রথমেই সবাইকে আগামীকালের পার্টির ইনভিটেশন দিল। কেউ খুশি হল আর কেউ মুখ বেকাল, তবে বাইরে সবাই দারুন খুশির ভাবটাই ধরে রাখল। যাক গে সেসব, এখন এইসব বেকার কথায় সময় নষ্ট করে লাভ নেই। রাত্রি ঠিক পাঁচটার সময়ই অফিসে চলে এল, আর ওরা তিনজনে রওনা হল ওদের মিশন শপিংয়ের উদ্দেশ্যে। এখানে কিন্তু আবার একটু সমস্যা হল, না তেমন কিছু নয়। হয়েছে কি, রাত্রি হঠাৎ করেই বলা নেই কওয়া নেই সোজা আলেখের পাশের প্যাসেঞ্জার সিটটায় উঠে বসে পড়ল। কুহেলির একটুও ভালোলাগলো না ব্যাপারটা কিন্তু কিছু করার নেই তাই চুপচাপ পিছনের সিটে উঠে বসল। রাত্রি প্রথমেই একটা ফ্যাশন হাউস থেকে কুহেলি আর ওর জন্য দুটো ড্রেস নিল। তারপর ম্যাচিং জুয়েলারী, শ্যুজ, তাছাড়াও আরও কত কি যে কিনল তার ঠিক নেই। কুহেলি সারাটা সময় রাত্রির সঙ্গে ছিল ঠিকই তবে ঠিক যেন খুশিমনে থাকতে পারছে না। কারণ, রাত্রি যেটাই কিনছে না কেন আলেখের পছন্দে, মানে আলেখকে না দেখিয়ে বা ওর মত না নিয়ে কিছুই কিনছে না। আর আলেখও যেন সাগ্রহে অংশ নিচ্ছে, কুহেলির যেন মাঝে মাঝে নিজেকে কাবাব মে হাড্ডির মত মনে হচ্ছে। আর আলেখ… সে এর সবটাই লক্ষ্য করেছে আর মনে মনে খুশি হয়েছে। ইচ্ছে করেই রাত্রির সঙ্গে আরও বেশি মন দিয়েছে শপিংয়ে, তার ফলও হয়েছে মোক্ষম। কুহেলি বাড়ি ফিরে ফ্রেশ হয়েই ফোনটা হাতে নিয়ে সোজা ছাদে হাজির হল। রাত্রিকে কেন্দ্র করে আলেখের প্রতি তৈরি হওয়া এই বিকট অনুভূতি গুলোর যথেচ্ছ আনাগোনার একটা ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। এভাবে চলতে দেওয়া যায় না, ওর মনের কোণে উদিত হওয়া সংশয় টাকে মিথ্যে প্রমাণ করা দরকার। কিন্তু ওর নিজের দ্বারা যে এটা সম্ভব নয়, সেটাও বেশ ভালো করেই জানে। এখন একমাত্র ভরসা স্মৃতি, ওর সবথেকে প্রিয় বান্ধবী, স্কুল লাইফ থেকেই এইসব বিষয়ে স্মৃতির অগাধ জ্ঞান। বেশি না ভেবে ফোনটা করেই ফেলল, খুব বেশি সময় লাগল না রিসিভ হতে।
হেই কুহু, কি ব্যাপার! তুই হঠাৎ ফোন করলি যে! এ যে প্রায় অসম্ভব ঘটনা।
তাহলে ফোনটা রেখে দিই?
আরে ইয়ার আমি তো মজা করছিলাম, রাগ করছিস কেন? বল কেমন আছিস?
ভালো, তুই আমার বিয়েতে এলি না কেন?
আউট অফ কান্ট্রি ছিলাম রে, বলেছিলাম তো তোকে। হঠাৎ করেই অফার টা এলো আর দ্যাট ওয়াস সাচ আ বিগ ডীল। সরি ইয়ার।
ইটস ওকে, তবে ফোন তো করতে পারতিস। নিজেই ফোন করিস না আবার আমাকে কথা শোনাস!
আচ্ছা সরি, আমার ভুল। এবার বল কি কেস?
কুহেলি একটু থতমত খেয়ে বলল,
কিসের কেস?
এই শোন, বেশি এদিক ওদিকের কথা বলে সময় নষ্ট করে লাভ নেই বুঝলি তো! তুই ফোন করেছিস মনেই কিছু না কিছু ব্যাপার আছে। এবার ভনিতা না করে সোজা মেইন পয়েন্টে আয় তো।
কুহেলি কি বলবে ঠিক বুঝতে পারল না, এসব কথা বলতেও কেমন যেন লাগে। শেষে নিজেকে উহ্য রেখেই বলতে শুরু করল।
শোন না, বলছি.. আমার এক ফ্রেন্ড আছে…
কে?
তুই চিনিস না, আমার অফিস কলিগ। আগে কথাটা তো শোন পুরো, মাঝখানে কথা বলিস না।
বেশ, বল।
হুম, তো ঐ ফ্রেন্ডের কিছুদিন হল বিয়ে হয়েছে বুঝলি তো। বিয়েটা ঠিক স্বাভাবিক নয়..
মানে? অস্বাভাবিক বিয়ে আবার কেমন হয়?
কুহেলি যতটা সম্ভব আসল কথা গোপন রেখেই মোটামুটি বিয়েটা ঠিক কেমন পরিস্থিতিতে হয়েছিল সেটা বুঝিয়ে বলল।
এই হল ব্যাপার, এইজন্যেই বললাম ঠিক স্বাভাবিক নয়… এবার সমস্যা হচ্ছে ঐ ফ্রেন্ড টার…
স্মৃতি আবার মাঝখানে কুহেলিকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
এই শোন, তুই এই সর্বনাম থেকে সরে আয় তো। বড্ড বিরক্ত লাগছে, সোজাসুজি বল।
কুহেলি অবাক হয়ে বলল,
মানে!
মানে তোর এই ইম্যাজিনারি অফিস কলিগ কাম ফ্রেন্ড টিকে বিদায় দিয়ে সোজাসুজি গল্পটা বল। কেসটা যে তোর নিজের সেটা বুঝতে আমার বাকি নেই। শুধু শুধু এত কষ্ট করিস না, কোনোদিনই মিথ্যেটা আয়ত্ত করতে পারিসনি তুই। আর তাছাড়াও এই ট্রিক টা না বস্তা পচা হয়ে গেছে, যে কেউ বুঝে নেবে।
কুহেলি যেন একটু স্বস্তি পেল, এত ঘুরিয়ে কথা বলতে ওরও বেশ অসুবিধাই হচ্ছিল। স্মৃতি যখন বুঝেই গেছে, তখন আর ঘুরিয়ে নাক দেখানোর কোনও মানে হয় না। কুহেলি যতটা ওকে জানানো সম্ভব ততটাই খুলে বলল স্মৃতিকে, পুরোটা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে স্মৃতি অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। কুহেলি এই হাসির কারণ বুঝে পেল না, ওর বলে সব তালগোল পাকিয়ে একটা অদ্ভুত অবস্থা আর স্মৃতি কিনা হাসছে!
এই হাসছিস কেন? এত হাসির কি হল?
স্মৃতি অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে বলল,
কুহু, ইউ আর সাচ আ ডাম্বো ইয়ার।
কুহেলির এবার রাগ হল, আর সেটাকে লুকানোর কোনরকম চেষ্টা না করে বলল,
তুই বলবি?
বলছি বলছি, আরে তুই এত সহজ ব্যাপারটা কীকরে বুঝতে পারছিস না সেটাই আমার বোধগম্য হচ্ছে না। ইটস লাভ ডার্লিং, ইটস লাভ, ইউ আর ইন লাভ!
কুহেলির যেন নিজের কানকে বিশ্বাস হল না। এই আশঙ্কা টাই উকি দিচ্ছিল ওর মনের কোণে, কিন্তু এটা কীকরে সম্ভব!
শেষের কথাটা বেশ জোরেই বলল কুহেলি, স্মৃতি সেটা শুনে এবার একটু সিরিয়াস হয়েই বলল,
কেন সম্ভব নয় কুহু? তোর প্রিভিয়াস রিলেশনের জন্য? বাট এটা কোনও কারণ নয় কুহু, তুই জোর করে মনের দরজা বন্ধ করে রাখলেও ভালোবাসাকে আটকানো যায় না। তাকে কোনও শাসন কোনও নিয়মের গণ্ডিতে বেঁধে রাখা যায় না, সে আপন খেয়ালে বিচরণ করে। তার আসার সময় হলে হাজারটা বন্ধ দরজার বাধাও তুচ্ছ হয়ে যায়। সত্যিটা স্বীকার কর কুহু, ইউ লাভ হিম, এভাবে নিজের অনুভুতি গুলোকে আটকে রাখিস না।
স্মৃতি আরও অনেক কথা বলল, কিন্তু সেসব কুহেলির কর্নগোচর হল না। কোনরকমে পরে কথা বলবে বলে লাইনটা ডিসকানেক্ট করে ফোনটা রেখে দিল টেবিলের ওপর। কানে স্মৃতির বলা একটা কথাই বারবার ফিরে ফিরে আসছে, ‘সত্যিটা স্বীকার কর কুহু, ইউ লাভ হিম’। আলেখের প্রতি যে ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়েছে, সেটা বুঝতে অসুবিধা হয়নি। মনের কোণে জেগে ওঠা অচেনা অনুভূতি গুলোকেও মাঝে মাঝে বড্ড চেনা মনে হত। কিন্তু মনের গহীনে লুকিয়ে থাকা একটা ভয় যেন তাদের স্বীকার করতে বাধা দিত। কিসের ভয়! হারিয়ে ফেলার ভয়, অপূর্ণতার ভয়। প্রথম প্রেমের অপূর্ণতা থেকেই ধীরে ধীরে জন্ম নিয়েছিল এই ভয়। তাই বন্ধ করে নিয়েছিল নিজের মনের দরজাটা, ভেবেছিল আর কোনদিনও ভালোবাসার অনুভূতিগুলোকে প্রবেশ করতে দেবে না ওর মনে। কিন্তু ওর সব হিসেব সব নিয়ম ভেঙে আবারও নিভৃত চরণে ভালোবাসা প্রবেশ করেছে ওর জীবনে। হ্যা, আজ আর স্বীকার না করে উপায় নেই, মনের অনুভূতি গুলোকে শত চেষ্টা করেও কিছুতেই দমিয়ে রাখতে পারছে না কুহেলি। সে ভালোবাসে আলেখকে, কখন যেন মনের গভীরে সংগোপনে রচিত হয়েছে জীবনের এই নতুন অধ্যায়। ভালোবাসার অনুভূতি মানুষের মনে একটা খুশির আমেজ নিয়ে আসে, কিন্তু কুহেলি ওর ভালোবাসার অনুভূতি গুলোকে উপলব্ধি করার পরেও খুশি হতে পারল না। নিজের অজান্তেই সে ভালোবেসে ফেলেছে আলেখকে, কিন্তু এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না। নিজেকে কেমন যেন অপরাধী মনে হল, হাজার টা চিন্তা ভিড় করে এল ওর মনে। আলেখ কোনও বন্ধনে জড়াতে চায় না বলেই তো শর্তের ভিত্তিতে গড়ে তুলেছিল এই সম্পর্কটা। সে নিজেও তো তাই চাইত, তাই তো সব জেনেই জড়িয়েছিল এই সম্পর্কে। কিন্তু ছক ভাঙ্গা ভালোবাসা গুলো হঠাৎ সব কিছু কেমন উলটপালট করে দিল। আলেখের মনে যে কুহেলির জন্য তেমন কোনো অনুভূতি নেই, এটা ভাবতেও যেন কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু এরকমই কথা ছিল, আলেখের তো কোনও দোষ নেই। হয়তো দোষটা ওর ভাগ্যের, ভালোবাসা হয়তো ওর জন্য নয়। প্রথম ভালোবাসা পরিস্থিতির চাপে অপূর্ণই রয়ে গিয়েছিল আর এখন… এবার হয়তো ওর ভালোবাসাটা ওর মনের মধ্যেই থেকে যাবে, প্রকাশ করার সুযোগ টুকুও হয়তো পাবেনা। কুহেলির অজান্তেই ওর চোখ বেয়ে দুফোঁটা নোনা জল গড়িয়ে পড়ল। নিয়তির কি নিষ্ঠুর পরিহাস! দুটো মানুষ.. তারা নিজেদের ভালোবাসার কথা বুঝতে পেরেও যেন কাঙ্খিত পরিণতির দিকে এগোতে পারছে না। এইজন্যই হয়তো বলে মনের অনুভূতিগুলোকে কখনও বেঁধে রাখতে নেই। তবে ভালোবাসা কখনও চিরকাল চাপা থাকে না, শত চেষ্টাতেও তাকে লুকিয়ে রাখা যায় না, একদিন না একদিন ঠিক তার প্রকাশ ঘটে। আলেখ আর কুহেলির মনের গহীনে থাকা ভালোবাসারও একদিন প্রকাশ ঘটবে। এখন শুধু অপেক্ষা সেই সঠিক সময়টার, যেদিন ওরা দুজনেই সব শর্তের বাধা পেরিয়ে অনুভব করতে পারবে পরস্পরের হৃদয়ে জন্ম নেওয়া সেই অসীম ভালোবাসার গভীরতা।
ক্রমশ__________
ভেবেছিলাম আজকের পর্ব টা একটু বিশেষ করার চেষ্টা করব। চেষ্টা করেছি… কিছুটা হয়তো করতে পেরেছি কিন্তু আমি যতটা ভেবেছিলাম ততটা পারলাম না। আসলে এই সময় কাটার সঙ্গে দৌড়ে পেরে উঠলাম না। আশা করছি আগামী পর্ব টা সেই বিশেষ পর্ব রূপে আপনাদের কাছে তুলে ধরতে পারব। পাশে থাকবেন কিন্তু। তবে আজকের পর্বটাও কিন্তু কিছুটা বিশেষই। অবশেষে কুহেলি নিজের মনের কথাটা বুঝতে পেরেছে এটা কি কম কথা! তবে ওরা কবে নিজেদের মনে কথাটা প্রকাশ করবে সেটাই এখন দেখার। বলে দিলেই তো পারে, শুধু শুধু নিজের মনেই আগে থেকেই সবটা ভেবে নিয়ে কষ্ট পাচ্ছে। কি যে করি না এদের নিয়ে! যাই হোক… কেমন লাগল আজকের পর্ব অবশ্যই জানাবেন কিন্তু। প্রতিবারের মত এবারও অপেক্ষায় থাকব। আজ তবে আসি। দেখা হবে আগামী পর্বে ততদিন পর্যন্ত পড়তে থাকুন ভালো থাকুন।