সংগোপনে’ পর্ব-৩৩

0
1817

#সংগোপনে
#ধারাবাহিক_পর্ব_৩৩
#অচিন_পাখি_কলমে_ভাগ্যলক্ষ্মী_দাস

আগের পর্বের পর————-

হোয়াই ডোন্ট ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড দ্যাট আই লাভ ইউ।

কথাটা শোনার পরেও কুহেলি বুঝতে পারল না ও ঠিক শুনেছে নাকি ভুল কিছু শুনল! আলেখ কি বলল এইমাত্র! কিন্তু ভাবনা গুলোকে গুছিয়ে নেওয়ার সময় টুকুও পেল না কুহেলি। আলেখ আবার বলতে শুরু করল, আজ যেন মনের মধ্যে জমে থাকা সব অনুভূতির আত্মপ্রকাশের দিন।

ইয়েস, আই লাভ ইউ, আই লাভ ইউ, আই লাভ ইউ।

প্রত্যেকবারই আলেখের গলার উত্তেজনার তীব্রতা যেন আগের থেকে বৃদ্ধি পেল। কুহেলি একভাবে চেয়ে আছে আলেখের দিকে। আলেখও কিছুক্ষণ কুহেলির গভীর চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে থেকে বলতে শুরু করল,

আমি জানি না কবে কখন কিভাবে তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি, শুধু এটাই জানি যে আমি তোমাকে ভালোবাসি, খুব ভালোবাসি নিজের জীবনের থেকেও বেশি ভালোবাসি।

এতদিন মনের গহীনে যে কথাটাকে রেখে দিয়েছিল সযত্নে, তাদের আজ এইভাবে প্রকাশ করতে হবে হয়তো আলেখ নিজেও ভাবেনি। কিন্তু কেন যেন আর সংযত করতে পারল না নিজেকে। আলেখ যেন এবার ধীরে ধীরে একটু শান্ত হয়ে এল ঠিক যেমন করে বহুদিনের ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি হঠাৎ একদিন জেগে উঠে অগ্নুদগারের পর আবার শান্ত হয়ে আসে। আলেখ কুহেলির কাধ দুটো ছেড়ে একটু সরে দাড়াল, কুহেলি তখনও যেন একটা ঘোরের মধ্যেই রয়েছে। ঠিক কি হচ্ছে সেটা বোঝার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে কিন্তু এলোমেলো ভাবনা গুলো যেন কিছুতেই ওর হাতের নাগালে আসতে চাইছে না। আলেখ কিছুক্ষণ কুহেলির গভীর চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে থেকে যেন ওর মনের প্রতিচ্ছবি টা দেখার চেষ্টা করল, কিন্তু সেখানে একরাশ বিস্ময় ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেল না। কুহেলি চুপচাপ সেইভাবেই দাড়িয়ে রইল আর আলেখ কুহেলির দিকে পিছন ফিরে আবার বলতে শুরু করল।

জানি এমনটা হওয়ার কথা ছিল না, আমি নিজেই বলেছিলাম কোনও বন্ধনে আমি আবদ্ধ হতে চাই না। কিন্তু তোমাকে একদিন বলেছিলাম মনে আছে, কখনও প্ল্যান করে ভালোবাসা যায় না। কখন কার মনে কার প্রতি ভালোবাসা জন্ম নেবে কেউ বলতে পারেনা। আমিও নিজের জীবনের একটা সম্পূর্ণ অন্যরকম ছবি এঁকে রেখেছিলাম, যেখানে আজকের এই দিনটার কোনও উল্লেখ ছিল না। কিন্তু হঠাৎ কখন যেন সব হিসাব ওলট পালট হয়ে গেল বুঝতে পারিনি। ঠিক কবে কখন কিভাবে তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি সেটা আমি সত্যিই জানি না। হয়তো অনেক আগেই আমার মনের কোনও একটা কোনায় জন্ম নিয়েছিল ভালোবাসা। সময়ের সাথে সাথে ধীরে ধীরে তারা আমার সমগ্র মনটাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। জানো তোমাকে যখনই দেখতাম তখনই একটা অজানা আকর্ষন অনুভব করতাম। হয়তো আমাদের বিয়ের আগে থেকেই, কিন্তু তখন বুঝতে পারিনি। তারপর তুমি আমার জীবন সঙ্গিনী হয়ে প্রবেশ করলে আমার জীবনে। প্রতিটা দিনের সঙ্গে সেই আকর্ষণটা আরও তীব্র হয়েছে। নিজের অনুভূতি গুলোকে তখনও ঠিক চিনে উঠতে পারিনি, ফাইনালি জুরিখের সেই রাতে আমি বুঝতে পেরেছিলাম। তোমার দুঃখ তোমার কষ্ট তোমার চোখের প্রতিটা জল যেন আমার অন্তরটা ছিন্ন ভিন্ন করে দিচ্ছিল। আমার স্বীকার করতে কোনও বাধা নেই, সেদিন যদি দেবার্ঘ্যর সাথে হঠাৎ দেখা না হত আমি হয়তো এত সহজে অনুভব করতে পারতাম না তুমি আমার কতটা জুড়ে আছ। সেদিন নিজের অনুভূতি গুলোকে কিছুতেই সংযত করতে পারিনি আমি, ভালোবাসার আহ্বান উপেক্ষা করা সেদিন আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। সেদিন আমি উপলব্ধি করেছিলাম আমি কখন যেন নিজের অজান্তেই ভালোবেসে ফেলেছি তোমাকে। আমি জানি কুহেলি তুমি হয়তো এখনও আমাকে বন্ধুর থেকে বেশি কিছু ভাবতে পারোনি। আর তাতে তোমার কোনও দোষ নেই, এইরকমই তো কথা ছিল। আমরা তো এই শর্তের ভিত্তিতেই গড়ে তুলেছিলাম আমাদের সম্পর্কটা। আমিই হ……..

আলেখের বাকি কথাটুকু অসম্পূর্ণই রয়ে গেল, হঠাৎ কুহেলি ছুটে এসে পিছন থেকেই জড়িয়ে ধরল আলেখকে। নিজেকে যেন মিশিয়ে নিতে চাইল আলেখের সঙ্গে। এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিল আলেখের প্রতিটা কথা, প্রথমটায় যেন সবটাই একটা স্বপ্নের মত মনে হচ্ছিল। নিজের কানে শুনেও যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না, আলেখ সত্যিই ওকে ভালোবাসে! কিন্তু ধীরে ধীরে আলেখের প্রতিটা কথা যেন এক এক করে ওর মনের সব দ্বিধা সব দ্বন্দ্ব সব সংশয় দূর করে দিল। আলেখও ওকে ভালোবাসে, শুধু ওর মনের আঙিনাতেই ভালোবাসার চরণ পড়েনি। ওর ভালোবাসারা শুধুই ওর মনের গহীনে আবদ্ধ হয়ে থাকবে না। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেনি কুহেলি, ঠিক যেমন ওর সুপ্ত অনুভূতিরা বাঁধভাঙা স্রোতের মত দুচোখ বেয়ে নেমে এসেছে শ্রাবণের ধারার মত, কুহেলিও তেমনই উত্তাল ঢেউয়ের মত আছড়ে পড়ল আলেখের প্রশস্ত পিঠে। দুহাতের বাঁধনে শক্ত করে বেধে নিতে চাইছে যেন নিজের সঙ্গে, উষ্ণ জলের ধারা গুলো যেন সব বাধা ভেঙে দিয়ে উন্মুক্ত করে দিয়েছে ওর মনের দুয়ার। কুহেলি কান্না ভেজা গলায় কিছুটা অভিমানের সুর মিশিয়ে বলল,

তুমি আগে কেন বলোনি? কেন এত কষ্ট দিলে আমাকে? আমিও যে তোমায় ভালোবেসে ফেলেছি। খুব খুব খুব ভালোবাসি তোমাকে আমি। কবে কখন কেন কিভাবে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আমারও জানা নেই, আমি জানতেও চাই না। আমি শুধু এটা জানি আমার মনের বন্ধ দরজা গুলো খুলে কখন যেন তুমি আমার সুপ্ত অনুভূতি গুলোকে আবার জাগিয়ে তুলেছ।

এইকথা গুলো শোনার জন্য আলেখ প্রস্তুত ছিল না। একটা ক্ষীণ আশার আলো দেখতে পেলেও কুহেলির মনে যে ওর জন্য এতটা ভালোবাসা রয়েছে সেটা হয়তো আশা করেনি। আলেখ সযত্নে কুহেলির হাতের বাধন কিছুটা আলগা করে ঘুরে দাড়াল ওর দিকে। কুহেলির চোখে এখনও বর্ষণ অব্যাহত, আলেখ আলতো করে ওর দুহাতের মাঝে তুলে ধরল কুহেলির মুখখানা। কুহেলি আকুল চোখে তাকিয়ে আছে আলেখের চোখের দিকে। আলেখের মুখে একটা অদ্ভুত তৃপ্তির ছাপ ফুটে উঠেছে, যেন জগতের সব সুখ আজ ধরা দিয়েছে ওর দুই হাতের মাঝে। আলতো ঠোঁটের পরশে আলেখ মুছিয়ে দিল ওর চোখের অভিমানী জলগুলো, গভীর আবেশে কুহেলির চোখ দুটো বুজে এল। আলেখ গভীর একটা ভালোবাসার পরশ একে দিল কুহেলির কপালে, ধীরে ধীরে তার উষ্ণ ঠোঁট জোড়া ছুঁয়ে গেল কুহেলির রক্তিম হয়ে আসা গাল দুটো। কুহেলির সারা শরীরে যেন একটা তীব্র শিহরন ছড়িয়ে পড়তে লাগল, দ্রুত হল শিরা উপশিরায় ধাবমান রক্তের প্রবাহ। আলেখ নিজেও যেন আবার সেই দুর্দমনীয় আকর্ষণের টানে ভেসে চলেছে কোনও এক অজানায়। ঈষৎ কম্পমান গোলাপী ঠোঁট দুটো যেন কোনও এক অজানা শক্তিতে আলেখকে আকর্ষিত করছে নিজের দিকে। সেই আকর্ষণ উপেক্ষা করার মত সাধ্য বা ইচ্ছে কোনোটাই ওর নেই। আলেখ সেই অমোঘ টানের স্রোতে গা ভাসিয়ে এগিয়ে যেতে লাগল কুহেলির ঠোঁটের দিকে। একসময় সব দূরত্ব মুছে গিয়ে এক হল দুটো তৃষ্ণার্ত অধর। না, এই তৃষ্ণা কামের নয়, ভালোবাসার। দুটো মন যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যেতে লাগল, যেন বহুযুগের কাঙ্খিত প্রাপ্তির সুখে মত্ত হয়ে ওরা হারিয়ে যেতে চাইছে কোনও সুদূর অজানায়। প্রগাঢ় চুম্বনের সঙ্গে যেন আরও গভীর হচ্ছে দুটো মনের অদৃশ্য সেই বাঁধন। একসময় আলেখ কুহেলির ঠোঁটের পরশ নিজের ঠোঁটে জড়িয়ে তাকাল ওর মুখের দিকে। কুহেলি এখনও চোখ দুটো বন্ধ করেই রেখেছে, আলেখ দুহাতের বাঁধনে জড়িয়ে নিল কুহেলিকে নিজের বুকের মাঝে। গভীর আবেশ জড়ানো সুরে আলেখ বলল,

আই লাভ ইউ কুহেলি, আই লাভ ইউ সো মাচ।

কুহেলি চোখ দুটো বন্ধ করেই আলেখের প্রশস্ত বুকে পরম শান্তিতে মাথা রেখে দুহাতে জড়িয়ে নিল নিজের সঙ্গে। সেইভাবেই বলল,

আই লাভ ইউ টু আলেখ, ভিষন ভালোবাসি তোমাকে।

সময় যেন ওখানেই থমকে গেল ওদের জন্য, আলেখ কুহেলিকে বুকের মাঝে জড়িয়ে রেখেই বলল,

সারা জীবন এইভাবেই আমার কাছে থাকবে তো কুহেলি? কোনদিনও ছেড়ে যাবে না তো?

কুহেলি ওর হাতের বাধন আরও একটু দৃঢ় করে বলল,

কোনদিনও না, তুমি চাইলেও না।

আলেখ হেসে কুহেলির মাথায় নিজের চিবুক টা রেখে বলল,

আমি যদি কোনদিনও উন্মাদও হয়ে যাই তাও তোমাকে ছাড়ার কথা ভাবতে পারব না।

কুহেলি যেন আলেখের প্রতিটা স্পন্দন অনুভব করতে পারছে, এক অদ্ভুত প্রশান্তিতে ভরে উঠল ওর মনটা। ঘড়ির কাটার হিসেব আর কে রাখে এমন সময়ে! ওরাও রাখেনি, ঠিক কতক্ষন যে ওরা এইভাবে একে অন্যের বাহুডোরে আবদ্ধ হয়ে ছিল জানা নেই। একসময় আলেখ কুহেলিকে ছেড়ে ওর হাত দুটো ধরে বলল,

আজ আমি সত্যিই খুব খুশি।

কুহেলি আলেখের হাতদুটো শক্ত করে ধরে আলতো হেসে বলল,

আমার থেকে বেশি হয়তো নও, আজকের দিনটা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ দিন। আমার জন্মদিনের শ্রেষ্ঠ উপহার তুমি আমায় দিয়েছ আজকে।

আলেখ একটা দুষ্টু হাসি ওর ঠোঁটের কোণায় এনে বলল,

কোনটা? এটা?

বলে আবার কুহেলির ঠোঁট জোড়ার দিকে এগোতে গেলে কুহেলির উজ্জ্বল কপোলে যেন লাজুকতার রাঙা আবিরের ছোয়া লাগল। আলেখকে একটা মৃদু ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে পালিয়ে আসতে গেল কিন্তু আলেখের বলিষ্ঠ হাতের মাঝে ধরা পড়ে গেল। আলেখ কুহেলির একটা হাত ধরে একটানে ওর কাছে টেনে এনে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরল। দুটো হাত কুহেলির পেটের কাছে রেখে যেন একটা অভেদ্য বৃত্ত তৈরী করল। কুহেলির উন্মুক্ত কাধে চিবুক টা আলতো করে রেখে খুব নীচু স্বরে বলল,

উহু, এত সহজ নয়। একবার যখন আমার ভালোবাসার বাঁধনে বাধা পড়েছ তখন আর মুক্তি নেই।

কুহেলি ওর একটা হাত আলেখের হাত দুটোর ওপরে রেখে বলল,

মুক্তি চাইছে কে?

আলেখ আলতো করে ঠোঁট দুটো স্পর্শ করল কুহেলির কাধে। তার সারা শরীর জুড়ে যেন আবার সেই শিহরণ বয়ে গেল। আলেখের উষ্ণ নিঃশ্বাসের স্পর্শ যেন কুহেলির হৃদস্পন্দনের গতি আবার অস্বাভাবিক করে তুলতে লাগল। এমন একটা মুহূর্তে অযাচিত বাধা রূপে দরজার ওপারে বিহানের গলা শোনা গেল।

ভাইয়া? ভাবি? আর ইউ দেয়ার?

আলেখ একটা বিরক্তি সূচক শব্দ করে বলল,

উফ্, কি অসম্ভব ব্যাড টাইমিং।

কুহেলি একটু হেসে বলল,

ছাড়ো, বিহান ডাকছে তো।

আলেখ ওর হাতের বাঁধনটা আরও একটু শক্ত করে বলল,

ডাকুক।

কুহেলি নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বলল,

আহ্, কি হচ্ছে টা কি? আরে ছাড়ো, দরজাটা খুলতে হবে তো নাকি?

আলেখ কুহেলিকে ছাড়ার কোনরকম আগ্রহই দেখাল না। এবার বিহানের গলার সঙ্গে দরজায় টোকাও পড়ল।

ভাইয়া? ভাইয়া? ভাবি? দরজাটা খোলো।

আলেখ সেই একভাবেই দাড়িয়ে রইল। কুহেলি সাড়া দিয়ে বলল,

আসছি বিহান।

তারপর আলেখের হাত দুটো ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বলল,

আরে ছাড়ো, কি হল? ছাড়ো, বিহান কখন থেকে ডাকছে।

আলেখ অনিচ্ছা সত্ত্বেও ওর হাতের বাঁধনটা একটু আলগা করতেই কুহেলি একছুটে গিয়ে দরজাটা খুলে দিল। বিহান কিছু একটা বলতে বলতে ভিতরে ঢুকতে গিয়েও থেমে গেল, একবার কুহেলি আর একবার আলেখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল,

সরি, ভুল টাইমে ডিস্টার্ব করে ফেললাম বাট দোষ টা আমার না। মামু ডাকছে তোমাদের দুজনকে, নীচে সবাই খুঁজছে তোমাদের।

কুহেলি হেসে বলল,

ডিস্টার্ব কেন করবে? আমরা এক্ষুনি আসছি।

বিহান একটু দুষ্টুমি ভরা হাসি দিয়ে বলল,

নীচে আসার আগে মেকাপ টা একটু ঠিক করে নিও।

বলে আলেখের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে নিজেই দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে চলে গেল। কুহেলি একটু অবাক হল, এমন অদ্ভুত ভাবে হাসল কেন বিহান! আর মেকাপে কি হল আবার! ওয়াটার প্রুফ আই লাইনারও কি আজকাল স্মাজ হয়ে যাচ্ছে নাকি? কুহেলি সোজা আয়নার সামনে গিয়ে দাড়াল, আর নিজের প্রতিচ্ছবির দিকে তাকাতেই লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করল। ইশ, এইভাবে ও বিহানের সামনে দাড়িয়ে ছিল! আই লাইনার ঠিকই আছে কিন্তু লিপস্টিক টা ঘেঁটে গেছে, বা বলা ভালো প্রায় মুছেই গেছে। কুহেলি লজ্জায় দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলল, ছি ছি, কি যা তা ব্যাপার। আলেখ একটু এগিয়ে এসে কুহেলির পিছনে দাঁড়িয়ে ওর দুটো কাধে হাত রেখে বলল,

কি হল?

কুহেলি মুখ ঢেকেই দুদিকে মাথা নাড়তে লাগল, আলেখের দিকে তাকাতেও অসম্ভব লজ্জা পাচ্ছে।

আরে কি হল, এমন করছ কেন?

কুহেলি আস্তে আস্তে হাত দুটো সরিয়ে আবার আয়নায় তাকাল, পিছনে দাড়ানো আলেখের প্রতিবিম্ব টার দিকে তাকাতেই আরেকদফা লজ্জা এসে ভর করল। এইরকম বিচ্ছিরি পরিস্থিতিতে এর আগে কখনও পড়েনি। ইশ, কোনও মানে হয়! কুহেলি আলেখের দিকে না তাকিয়ে বলল,

মুখটা ধুয়ে এস।

আলেখ ব্যাপারটা আন্দাজ করতে পারল, একটু দুষ্টুমি করার লোভ সামলাতে পারল না। না বোঝার ভান করে বলল,

কেন? হঠাৎ মুখ ধুতে যাব কেন?

কুহেলি কি বলবে! আয়নার মধ্যে দিয়েই আলেখের দিকে তাকিয়ে একটু ইতস্তত করে বলল,

এম..এমনি.. যাও না…

আলেখ ওর ডানহাতের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে নিজের ঠোঁট টা একটু মুছে বলল,

এইজন্য? এর জন্য মুখ ধোয়ার কি দরকার? তুমি মুছে দাও।

কুহেলি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষন। এই মানুষটা তো ভারী অদ্ভুত! এখনও ইয়ার্কি করছে! সব জেনেও ইচ্ছে করে ওকে জ্বালাতন করছে। কুহেলি আলেখের দিক থেকে চোখ সরিয়ে বলল,

আমি পারব না।

আলেখ ওর কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল,

কেন শুনি? লিপস্টিক টা তো তোমারই।

কুহেলি লজ্জায় যেন কুকড়ে গেল। মানুষটা এরকম অদ্ভুত কেন? যখন তখন ওকে এইরকম বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলে দেয়! কুহেলি একটু মৃদু ধাক্কা দিয়ে আলেখকে সরিয়ে দিল। আলেখ কুহেলির লাজে রাঙা হয়ে যাওয়া মুখটা দেখে হাসতে হাসতে ওয়াশরুমে চলে গেল। কুহেলি যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল, নিজের হৃদযন্ত্রের গতির অস্বাভাবিকতা অনুভব করে নিজের মনেই বলে উঠল,

কোনদিন হার্টফেল না হয়ে যায়!

কুহেলির ঠোঁটে লাজুকতার ছোয়া মেশানো একটা স্মিত হাসি খেলে গেল। হালকা গোলাপী লিপস্টিকটা আলতো করে বুলিয়ে নিল ঠোঁটে। নিজের দিকে তাকিয়েই হঠাৎ ঠোঁটের হাসিটা আরও কিছুটা প্রশস্ত হল। মনে যেন খুশির বাঁধ ভেঙেছে আজ, নতুন নতুন রঙের ছোয়ায় যেন চারপাশটা রঙিন হয়ে উঠেছে। জীবনে আবার যে কখনও কাউকে ভালোবাসবে এটা যেন ওর স্বপ্নেরও অতীত ছিল। আর সেই ভালোবাসা একদিন পূর্ণতা পাবে, এমন মধুর মুহুর্ত ওর জীবনে আসবে এসব যেন এখনও স্বপ্নের মতই মনে হচ্ছে। হয়তো এখন সে ঘুমের অতল গভীরে ডুব দিয়ে স্বপ্নের কাল্পনিক জগতে বিচরণ করছে। হয়তো একটু পরেই ঘুম ভাঙ্গার সঙ্গে সঙ্গেই ভেঙে যাবে এই সুন্দর স্বপ্ন টাও। কিন্তু না, কাধে আলেখের ছোয়া যেন বলতে চাইল এটা স্বপ্ন নয় বাস্তব।

চল, এবার নীচে যাওয়া উচিৎ।

আলেখের কথায় যেন কুহেলি ঘোর কাটিয়ে উঠে দাড়াল। আলতো হেসে দরজার দিকে এগোতে গেলে আলেখ ওর একটা হাত ধরে থামিয়ে দিল। কুহেলি ঘুরে বলল,

কি হল?

আলেখ একটু গম্ভীর হয়ে বলল,

তুমি নিশীথ আগরওয়ালের থেকে একটু দূরেই থেকো।

কুহেলি একটু হেসে বলল,

কেন? বিশ্বাস নেই আমার ওপর?

নিজের থেকেও বেশি।

তাহলে?

আই ডোন্ট নো, বাট তুমি ওনার সাথে প্রয়োজন ছাড়া কথা বলবেনা, আই ডোন্ট লাইক হিম।

কুহেলি এবার আলেখের দিকে একটু এগিয়ে এসে সামান্য হেসে বলল,

হঠাৎ করে এত রাগ কেন ওনার ওপরে? তুমি তো সবই জানো। আর মিস্টার আগরওয়ালও যে কথার খেলাপ করার মত মানুষ নন, এটা তুমি আমার থেকেও বেশি ভালো করে জানো। তাহলে সমস্যা টা কোথায়?

ইয়েস আই নো, আমি সবই জানি। আর এটাও জানি মিস্টার আগরওয়াল একবার কাউকে কোনও কথা দিলে সেটার অন্যথা করেন না, বাট স্টিল আই ডোন্ট লাইক হিম।

কুহেলির ভালোই লাগছে, আলেখের এই ঈর্ষান্বিত রূপটা বেশ উপভোগ করছে। কুহেলি ওর হাসিটা বজায় রেখেই বলল,

বাট হি ইজ মাই ফ্রেন্ড। এমনিতেও অফিসিয়াল আলোচনা ছাড়া আমাদের আর তেমন সময়টাই বা কোথায়? মাঝে মধ্যে সামান্য একটু যা কথা হয়, সবই তো জানো।

আচ্ছা! ফ্রেন্ড! তাহলে রিতুও তো আমার ফ্রেন্ড, আর শুধু ফ্রেন্ড নয় বেস্টফ্রেন্ড সেই ছোট্টবেলা থেকে। তুমিও তো জানোই এটা, তাহলে ওকে আমার সঙ্গে দেখে তুমি জেলাস ফিল কর কেন?

কুহেলির সব ভাষা যেন হারিয়ে গেল, অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল আলেখের দিকে। মানে, আলেখ সবটাই জানত! সব বুঝতে পেরেছিল! তারপরেও…. সব জেনেশুনে ইচ্ছে করে ওকে ঈর্ষান্বিত করানোর জন্যই এইসব করত! কুহেলির ভারী রাগ হল, না না, অভিমান হল। এমন কেউ করে! কুহেলি অভিমানী সুরেই বলল,

তুমি সব জেনেও ইচ্ছে করেই সব করেছ তাই না?

আলেখ এতক্ষণ মিটিমিটি হাসছিল, কিন্তু কুহেলির গলায় অভিমানের সুরটা বুঝতে পেরেই হাসিটা মিলিয়ে এলো। একটু থেমে বলল,

না মানে… আমি তো.. আসলে…

কথাটা শেষ হল না, কুহেলি তার আগেই মুখ ঘুরিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আলেখ বুঝল কুহেলির সত্যিই খারাপ লেগেছে। আলেখও ওর পিছন পিছন নীচে নেমে এল, বাকি সময়টা কুহেলি বাকিদের সঙ্গেই কাটিয়ে দিল একবারের জন্যও আলেখের দিকে ফিরেও তাকাল না। আলেখ বেশ কয়েকবার ওর সাথে কথা বলার চেষ্টা করলেও লাভ হয়নি, ঠিক কোনও না কোনও উপায়ে কুহেলি এড়িয়ে গেছে। এইসব কিছু আরও একজন লক্ষ্য করল, নিশীথ। একটা পাশে দাড়িয়ে সিংঘানিয়া মিলসের কর্ণধার মিস্টার সিংঘানিয়ার সঙ্গে কথা বলছিল। তখন হঠাৎ কুহেলিকে উপরে যেতে দেখা থেকে শুরু করে এখন আলেখ আর কুহেলির মধ্যে সবার নজর এড়িয়ে চলতে থাকা মিষ্টি মান অভিমানের পালা পর্যন্ত কোনও কিছুই তার নজর এড়ায়নি। এক চিলতে হাসির রেখা ওর ঠোঁটের কোণায় ফুটে উঠল, ভালো করে লক্ষ্য করলে বোঝা যায় ওই সামান্য হাসিটার আড়ালে একটা গভীর বেদনার আভাস যেন উকি দিয়ে গেল। নিজের ডান হাতের ব্রেসলেট টার দিকে একবার তাকিয়ে আপনমনে বলল,

অবশেষে আপনার জীবনে আবার বসন্ত এল, দুঃখের বিষয় সেই বসন্তের আগমনের কারনটা আমি হতে পারলাম না। সব ভালোবাসারা হয়তো পূর্ণতা পাওয়ার জন্য সৃষ্টি হয় না। আমার ভালোবাসারাও না হয় শুধু আমার মনেই থাকল। আপনার জীবন টা ভরে উঠুক ভালোবাসায়। আমি জানি মিস্টার শর্মা আপনাকে খুব ভালোবাসেন। হয়তো উনি নিজেও যখন বুঝতে পারেননি আমি তখন থেকেই জানি ওনার মনে আপনার প্রতি একটা সীমাহীন ভালোবাসার সম্ভার রয়েছে। সুখী হোন আপনারা।

নিশীথ নিজের ভাবনার জগতে যেন হারিয়ে গিয়েছিল, হঠাৎ একটা ধাক্কা অনুভূত হতেই চমকে তাকিয়ে দেখল একটি মেয়ে হাতে একটা সফট ড্রিঙ্কসের গ্লাস নিয়ে কটমট করে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। হাতের গ্লাসটা প্রায় খালি, আর তার কারণ গ্লাসের ড্রিঙ্কসের অর্ধেকের বেশি নিশীথের স্যুটে পড়েছে আর কিছুটা ওই মেয়েটার ড্রেসে। নিশীথ কিছু বলার আগে মেয়েটি বলল,

চোখ দুটো কি ডেকরেশনের জন্য সাজিয়ে রেখেছেন?

নিশীথ যেন একটু অবাক হল, ওর সঙ্গে এভাবে কথা বলার সাহস কেউ পায় না। আর এখানে তো ওর কোনও দোষ নেই, উল্টে নিশীথ ইচ্ছে করলেই দুকথা শুনিয়ে দিতে পারে। কিন্তু নিশীথ সেসব না করে খুব সংক্ষেপে বলল,

সেটা বোধহয় আপনার নিজের একটু চেক করা প্রয়োজন।

এতে মেয়েটি রেগে গিয়ে বলল,

কি? কি বললেন আপনি? শুনুন আপনি এরকম মাঝখানে দাড়িয়ে থাকলে সেটা কি আমার দোষ?

নিশীথ একটু আশেপাশে তাকিয়ে শান্ত ভাবে বলল,

আজকাল মাঝখান আর সাইডের ডেফিনেশন টা চেঞ্জ হয়ে গেছে মনে হচ্ছে। সরি আমার জানা ছিল না, আমি ভাবছিলাম আমি একটা সাইডে দাড়িয়ে আছি।

মেয়েটি এইরকম উত্তর শুনে অসম্ভব রেগে গিয়ে বলল,

আপনি তো ভিষন ইরিটেটিং পারসন! একে তো আমার ড্রেসটার বারোটা বাজিয়ে দিলেন আর তারপরেও এইভাবে কথা বলছেন?

নিশীথ ওর স্যুট টা একটু ঝেড়ে বলল,

ড্রিঙ্কসের নাইন্টি পার্সেন্ট আমার কোটের ভাগ্যে জুটেছে, বাট আমি কি আপনাকে কিছু বলেছি?

শুনুন…

আপনি শুনুন, অনেকক্ষণ ধরে বলছেন। নিজে দেখে চলছিলেন না, তাই এই দুর্ঘটনা টা ঘটালেন, আমার স্যুট টারও অবস্থা কাহিল করে দিলেন। তার উপর দোষটাও আমার উপরেই চাপাচ্ছেন, আপনার মনে হয় না এটা একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে!

আপনি জানেন কাকে কি বলছেন?

নিশীথ এতক্ষণ মেয়েটার দিকে ভালো করে তাকায়নি, এবার একটু তাকিয়ে দেখল। ছিপছিপে গড়নের সুগঠনের অধিকারিনী মেয়েটিকে একবাক্যে দারুন সুন্দরী বলা চলে। ডার্ক ব্লু রঙের ওয়ান সাইডেড বডিহাগিং ড্রেসে অপূর্ব সুন্দরী লাগছে। কিন্তু তার মুখের অভিব্যক্তি আর তার আচরণ দেখে নিশীথের মনে হল শুধু রূপেই সুন্দরী, বাকিটা আর না বলাই ভাল। কিন্তু মেয়েটাকে কোথায় যেন দেখেছে, কিন্তু মনে করতে পারছে না। একটু ভেবে বলল,

বাই দ্য ওয়ে, আই থিঙ্ক আমি আপনাকে আগে কোথাও দেখেছি।

মেয়েটি একটা তাচ্ছিল্যের হাসি ছুড়ে দিয়ে বলল,

হাহ, নাইস ট্রিক বাট ভিষন পুরনো হয়ে গেছে। নেক্সট টাইম নতুন কিছু ট্রাই করবেন, না হলে যে কেউ ধরে ফেলবে।

নিশীথের এবার রাগ হল, মেয়েটা সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। আর এতক্ষণে মেয়েটাকে চিনতেও পেরেছে, আর তাতে রাগটা আরও বেড়ে গেল। নিশীথ বেশ গম্ভীর গলায় বলল,

লুক, আপনি জানেন না আপনি কার সঙ্গে কথা বলছেন। জানলে আর এইসব অবান্তর কথা বলতেন না।

মেয়েটা আবারও একটা তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটিয়ে বলল,

কেন? আপনি কি ইন্ডিয়ার প্রাইম মিনিস্টার নাকি! যে আপনাকে চিনতে হবে?

নিশীথ একটু বিরক্ত হয়ে বলল,

সেই সৌভাগ্য আমার হয়নি, তবে যেটুকু পরিচয় আছে সেটুকুই যথেষ্ট। আই অ্যাম নিশীথ আগরওয়াল, সি ই ও অফ্ আগরওয়াল অ্যান্ড সন্স।

মেয়েটি যেন একটু থমকাল, নামটা যেন চেনা চেনা মনে হল কিন্তু ঠিক মনে করতে পারল না। নিশীথ ওর মনের ভাবটা বুঝতে পেরে বলল,

নো প্রব্লেম মিস রাত্রি অহুজা, এক্ষুনি আপনি আমাকে চিনতে পারবেন। সৌন্দর্য্য ফ্যাশন হাউস এই নামটা নিশ্চয়ই চিনতে পারছেন, ওটা আমার কোম্পানিরই একটা অংশ। আমার নিউ প্রজেক্ট দি ইন্ডিয়ান ব্রাইড এটাও নিশ্চয়ই আপনার চেনা।

রাত্রির যেন চারপাশটা হঠাৎ অন্ধকার মনে হল, এই মুহূর্তে ওর তো এখানে থাকার কথা নয়। লন্ডনের টপ ফ্যাশন হাউস গুলোর মধ্যে একটা এই সৌন্দর্য্য ফ্যাশন হাউস। আর ওদের আপকামিং প্রজেক্ট দি ইন্ডিয়ান ব্রাইডের জন্য রাত্রিকে ওরা বেছে নিয়েছিল ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হিসেবে। কনট্র্যাক্ট অনুযায়ী ওদের শ্যুট শুরু হয়ে যাওয়ার কথা কিন্তু রাত্রি একরকম জোর করেই শ্যুটের ডেট পিছিয়ে দিয়েছে। এই নিশীথ আগরওয়ালকে চোখে না দেখলেও নাম শুনেছিল তাই চেনা চেনা লাগছিল নামটা। নিশীথের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা কিছুটা এক, রাত্রিকে সামনাসামনি না দেখলেও ছবি আর ভিডিও দেখে নিজেই পছন্দ করেছিল ওকে। তাই একটু সময় লাগলেও চিনতে অসুবিধা হয়নি। খবর পেয়েছিল রাত্রি শ্যুট পিছিয়ে দিয়েছে কিন্তু কারনটা জানায়নি, এখন এইভাবে এখানে দেখে ভিতরের বিরক্তি আর রাগ দুটোই যেন একসঙ্গে জেগে উঠল।

সো, মিস অহুজা, শ্যুট পিছিয়ে দিয়ে আপনি এখানে হলিডে এনজয় করছেন?

রাত্রি যেন বলার মত কিছুই খুঁজে পেল না, বেশ নার্ভাস লাগছে। কিন্তু সেটা বুঝতে না দিয়ে বলল,

লিসেন, অফিসিয়াল কথা বলার জন্য এটা উপযুক্ত সময় নয়। এখানে আমি আমার ফ্রেন্ডের পার্টি অ্যাটেন্ড করতে এসেছি। তাই এখন এসব আলোচনা না করাটাই মনে হয় শ্রেয়।

কথাটা বলে রাত্রি এক মুহুর্তও সেখানে দাড়াল না, বলতে গেলে পালিয়ে বাঁচল। নিশীথ অনেক কষ্টে ওর রাগটা সংবরণ করল, একবার মনে হল আজই রাত্রির কনট্র্যাক্ট টা ক্যানসেল করে দেয়। এরকম অ্যারোগেন্ট মেয়ে কে সহ্য করা সম্ভব নয়, নিজের ইচ্ছে মত শ্যুট পিছিয়ে দিয়ে এখানে পার্টি এঞ্জয় করছে! কিন্তু রাত্রি এইমুহুর্তের সেরা মডেল, আর তাছাড়াও ওর প্রজেক্টের জন্য ঠিক যেমন ফেস সে খুঁজছিল রাত্রি একদম উপযুক্ত। তাই কনট্র্যাক্ট বাতিলের চিন্তাটা বাদ দিতে হল, কিন্তু এই মেয়েকে যে এড়িয়ে চলতে হবে এটা সে মনে মনে ঠিক করে নিল। পার্টি শেষ হতে বেশ রাত হল, একে একে সব অভ্যাগতরা বিদায় নেওয়ার পর যে যার ঘরের দিকে এগোল, রাত্রিও ফিরে গেল ওর বাংলোয়। আলেখ আর কুহেলিও নিজেদের ঘরে ফিরে এল, কুহেলি এখনও কথা বলছে না আলেখের সঙ্গে। আলেখ ঘরে ঢুকেই একবার কুহেলির সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করল কিন্তু কুহেলি যেন শুনতেই পায়নি এমন একটা ভাব করে একসেট নাইট ড্রেস নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। আলেখ বেচারা আর কীকরে, হাতের রিস্টওয়াচ টা খুলে জায়গা মতো রেখে একসেট ট্রাউজার আর টিশার্ট বের করে কুহেলির বেরোনোর অপেক্ষা করতে লাগল। কুহেলি পোশাক টা বদলে ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসে চুলটা খুলতে লাগল। আলেখ একবার ওর দিকে তাকিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল, কুহেলি ওর দিকে আড়চোখে তাকিয়ে আবার চুল খোলায় মন দিল, এত সহজে সে কথা বলবে না। আলেখ ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে দেখল কুহেলি ইতিমধ্যে শুয়ে পড়েছে, চোখ দুটো বন্ধ করে রাখলেও এখনও যে ঘুমায়নি সেটা বুঝতে অসুবিধা হয় না। আলেখ বেডের নিজের দিকে উঠে বসল, কিন্তু শুলো না। হালকা করে ডেকে বলল,

কুহেলি, তুমি একবার আমার কথাটা শোনো।

কুহেলি কিছু না বলে যেমন শুয়েছিল তেমনই রইল। আলেখ আবার বলল,

কুহেলি আমি জানি তুমি জেগে আছ, প্লিজ একবার আমার কথাটা শোনো, আমি ইচ্ছে করে করিনি।

কুহেলি এবার উঠে বসে বলল,

আচ্ছা! ইচ্ছে করে করোনি? সব জানা সত্ত্বেও তুমি যেগুলো করেছ সেটাকে ইচ্ছে করে করাই বলে।

হ্যা.. কিন্তু আমি… আমি জাস্ট এটা কনফার্ম করতে চাইছিলাম যে তোমার মনে আমার জন্য কোনও স্পেশাল ফিলিংস আছে কিনা।

বাহ্, তাহলে তো আমিও তোমার ফিলিংস গুলো কনফার্ম করার জন্য মিস্টার আগরওয়ালের সঙ্গে একটু বেশিই মেলামেশা করতে পারতাম!

নিশীথের নাম শুনেই আলেখের মাথাটা আবার গরম হয়ে গেল, একটু রেগেই বলল,

কুহেলি দুটো সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার, রিতু আমার চাইল্ডহুড ফ্রেন্ড, শি ইজ মাই বেস্ট ফ্রেন্ড। আর সেখানে মিস্টার আগরওয়ালকে তুমি কতদিন চেনো?

বন্ধুত্বের হিসেবে সময় টা খুব একটা গুরুত্তপূর্ণ নয়, স্বল্প আলাপেও অনেক গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়।

হোয়াট ডু ইউ মিন? এই অল্প সময়ে ওই নিশীথ আগরওয়ালের সঙ্গে তোমার বন্ধুত্ত্ব এতটাই গভীর হয়ে গেছে!

দ্যাটজ নট দ্য পয়েন্ট। কার সাথে কার বন্ধুত্ত্ব কতটা গভীর সেটা নিয়ে আলোচনা করার কোনও প্রয়োজন আছে বলে তো মনে হয় না। মূল কথা হল তুমি সব জেনেও ইচ্ছে করে আমাকে কষ্ট দিয়েছ।

দ্যাটজ নট রাইট কুহেলি, আমি তো বললাম আমি জাস্ট তোমার ফিলিংস গুলো কনফার্ম করছিলাম।

আমাকে জিজ্ঞেস করে কি কনফার্ম করা যেত না? তুমি তো বুঝতেই পেরেছিলে আমি রাত্রির সঙ্গে তোমাকে দেখে কষ্ট পাচ্ছিলাম। কারণটাও নিশ্চয়ই আন্দাজ করতে পেরেছিলে, তা সত্ত্বেও তুমি…..

কুহেলি কথাটা আর শেষ করল না, একটা তীক্ষ্ম অভিমানী দৃষ্টি আলেখের দিকে ছুড়ে দিয়ে আবার পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। আলেখ মাথাটা একটু ঠাণ্ডা করে বলল,

সরি কুহেলি, আমি সত্যি বলছি আমি ইচ্ছে করে… মানে এতকিছু ভেবে দেখিনি।

কুহেলি কিছু বলল না, চুপচাপ শুয়ে রইল। আলেখ কুহেলির দিকে একটু সরে এসে অনুনয়ের সুরে বলল,

কুহেলি, প্লিজ ডোন্ট ডু দিস টু মি। আমি মানছি আমার ভুল হয়েছে, আমি সত্যিই বুঝতে পারিনি তোমার এতটা খারাপ লাগবে।

কুহেলির ঠোঁটে একটা আলতো হাসি ছড়িয়ে গেল, অবশ্যই আলেখের অলক্ষ্যে। হ্যা, আলেখের উপর তখন সত্যিই রাগ হয়েছিল, রাগ না বলে অভিমান বলাটা বেশি সমীচিন হবে। আর কেন হবে না! একেতো বেচারি একটা চরম দ্বিধা দ্বন্দ্বের দোলাচলে পড়ে অস্থির হয়ে উঠেছিল, সেখানে যদি কেউ এমনটা করে.. রাগ থুড়ি অভিমান হওয়াটাই তো স্বাভাবিক। তবে ভালোবাসার আকাশে অভিমানের মেঘ ক্ষণস্থায়ী, ঠিক যেন শরতের মেঘ, এই আছে এই নেই। কুহেলির মনেও এখন আর অভিমানের ছিটে ফোটাও নেই, বরং বেশ উপভোগ করছে পরিস্থিতিটা। আলেখ আরও বেশ কয়েকবার সরি বলার পরে কুহেলি আর থাকতে পারল না, হাসতে হাসতে উঠে বসল। কুহেলিকে ওভাবে হাসতে দেখে আলেখ প্রথমটায় একটু হকচকিয়ে গেল। সে তো ভেবেছিল কুহেলি বোধহয় সাংঘাতিক রাগ করেছে কিন্তু এখন দেখছে গোটা ব্যাপারটাই উল্টো। কুহেলি হেসেই চলেছে, আলেখের মুখটা দেখে যেন আরও বেশি হাসি পাচ্ছে। আলেখ ওর অবাক ভাবটা কাটিয়ে বলল,

তুমি এতক্ষণ শুধু শুধু আমাকে এইভাবে ভয় পাওয়ালে?

কুহেলি ওর হাসিটা একটু থামিয়ে বলল,

শুধু শুধু কেন হতে যাবে? আমার সত্যিই খারাপ লেগেছিল, রাগও হয়েছিল।

সে তো দেখতেই পাচ্ছি, এত রাগ হয়েছিল যে হাসিই থামাতে পারছনা।

কুহেলি হাসতে হাসতেই বলল,

শুধু তুমিই মজা করতে পার বুঝি! আমি পারি না?

আলেখ একটা দুষ্টু হাসি ঠোঁটে এনে বলল,

খুব মজা হচ্ছে তাই না!

হুম, হচ্ছে তো, আমার সত্যিই খারাপ লেগেছিল তার জন্য এইটুকু প্রতিশোধ তো নিতেই পারি, তাই না?

আলেখ হঠাৎ কুহেলির একটা হাত ধরে একটানে ওকে নিজের বুকের ওপর এনে ফেলল। এমন অতর্কিত আক্রমণের জন্য কুহেলি মোটেই প্রস্তুত ছিল না। আচমকা টানে নিজের ভারসাম্য বজায় রাখতে না পেরে আলেখের বুকের ওপর এমন ভাবে পড়ল যে আলেখও কুহেলিকে নিয়েই পড়ে গেল। কুহেলির সুদীর্ঘ চুলগুলো এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। আলেখ আলতো হাতে চুলগুলো কানের পিছনে সরিয়ে দিয়ে বলল,

এবার আমি যদি একটু প্রতিশোধ নিতে চাই তাহলে?

কুহেলির কান দুটো যেন গরম হয়ে এল, ফর্সা গাল দুটোয় লালচে আভা তার অস্তিত্ব জাহির করতে লাগল। সেই কড়া অথচ মিষ্টি ঘ্রাণটা আবারও যেন অবশ করে ফেলছে ওর গোটা শরীর মন। নিঃশ্বাস যেন ঘন হয়ে এল, নিজের হৃদস্পন্দনের শব্দ যেন সজোরে আঘাত করছে ওর শ্রবনেন্দ্রিয়ে। আর যেন নিজেকে ধরে রাখতে পারছে না, গভীর আবেশে বুজে আসা চোখে পরম লজ্জায় মুখ লুকাল আলেখের প্রশস্ত বুকে, আলেখের দুহাতের বাঁধনে যেন হারিয়ে যেতে চাইল। আলেখও নিজের বুকে কুহেলির উষ্ণ ছোয়ায় যেন উত্তাল হয়ে উঠল। বাঁধন ছেড়ার নেশায় যেন উন্মত্ত হয়ে উঠতে চাইছে মনের সব অনুভূতিগুলো। দুহাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল কুহেলিকে, উত্তেজনায় যেন তিরতির করে কাপছে ওর সর্বাঙ্গ। আলেখ আলতো করে কুহেলিকে শুইয়ে দিল, চোখ দুটো এখনও বন্ধই রয়েছে। অপলক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল লজ্জায় লাল হয়ে যাওয়া মুখটার দিকে। কুহেলির একটা হাত স্পর্শ করতেই আলেখ অনুভব করল ওর হাত দুটো অসম্ভব ঠান্ডা, হালকা এসির মধ্যেও কপালে জমেছে দু এক ফোঁটা শ্বেদবিন্দু। একটা স্মিত হাসির রেখা ফুটে উঠল ঠোঁটে, আলেখ বুঝল কুহেলি প্রস্তুত নয়। ঘন কেশরাশির মধ্যে আলতো করে আঙ্গুল চালিয়ে কুহেলির কপালে একটা গভীর ভালবাসার পরশ ছুঁইয়ে নীচু স্বরে গুডনাইট বলে নিজের জায়গায় সরে এসে শুয়ে পড়ল। কুহেলি আরও কিছুক্ষণ সেইভাবেই রইল, সবটা যেন একটা সুখস্বপ্নের মত মনে হচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ পরে ধীরে ধীরে কুহেলির চোখের পলক দুটো যেন দীর্ঘ আলিঙ্গনের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে উন্মীলিত হল। পাশে শুয়ে থাকা আলেখের চোখে তখন ঘুমের পরশ লেগেছে, প্রশান্ত মনে অনন্য খুশির সম্ভার নিয়ে সে পাড়ি দিয়েছে ঘুমের দেশের সমধুর কোনও স্বপ্নপুরীতে। মায়াবী নীলচে আলোয় ঘুমন্ত আলেখের মুখখানার দিকে তাকিয়ে আনন্দ বিস্ময় আর অন্তহীন ভালোবাসার এক মিলিত অনুভূতির হিন্দোলে যেন কুহেলির হৃদয় আন্দোলিত হতে লাগল। মানুষটা না বলতেই এতকিছু কীকরে বুঝে যায়! নিজের ভালোবাসার মানুষ টাকে সবটুকু উজাড় করে দিয়ে ভালোবাসতে সবাই চায়। কোনও এক মাহেন্দ্রক্ষণে সেই ভালোবাসার মানুষের কাছে নিজের সর্বস্ব সঁপে দেওয়ার স্বপ্ন প্রতিটা নারী হৃদয়ের গহীনে সযত্নে লালিত হয়। সেই মুহূর্তটা সব নারীর জীবনেই বিশেষ এক মুহুর্ত, কুহেলিও তার ব্যতিক্রম নয়। বহুদিনের কাঙ্খিত সেই মধুর মিলনের মুহূর্তটাকে অবিস্মরণীয় করে তোলার আকাঙ্খা পুরুষের চেয়ে নারীর কোনও অংশে কম নয়। ধীরে ধীরে তারা গড়ে তোলে নিজের মনটাকে সেই কাঙ্খিত মুহুর্তের জন্য, কুহেলিরও সেই সময় টুকুর প্রয়োজন। ভিন্ন সময়ে ভিন্ন পরিস্থিতির আবর্তে পড়ে কুহেলি নিজের মনটাকে প্রস্তুত করার সেই অবসর টুকু কোনদিনও পায়নি। কুহেলির ভাষাহীন সেই অন্তরের অভিব্যক্তি যেন আলেখ বুঝে নিয়েছে কোনও এক অলীক উপায়ে। কুহেলির মনে আলেখের প্রতি শ্রদ্ধার সম্ভার আরও একটু বৃদ্ধি পেল। কুহেলি আপন মনে বলল,

আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি তুমি, তোমার ভালোবাসায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে আমার জীবন। এভাবেই ভালোবেসে পাশে থেকো…. সারাটা জীবন।

ক্রমশ_____________

© স্বত্ব সংরক্ষিত

আজ আমি কিছুই বলছি না…যা বলার আপনারাই বলবেন। আমি শুধু আপনাদের সুন্দর সুন্দর কমেন্টের অপেক্ষায় বসে থাকব। তাই নিজের মূল্যবান মতামত জানাতে ভুলবেন না যেন। দেখা হবে আগামী পর্বে ততদিন পর্যন্ত পড়তে থাকুন ভালো থাকুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here