সংগোপনে’ পর্ব-৪৬

0
1278

#সংগোপনে
#ধারাবাহিক_পর্ব_৪৬
#অচিন_পাখি_কলমে_ভাগ্যলক্ষ্মী_দাস

আগের পর্বের পর————-

স্টপ দ্য কার।

রাত্রি এতটাই জোরে চেঁচিয়ে উঠল যে নিশীথ চমকে ওর দিকে তাকাতে বাধ্য হল। কিন্তু তাই বলে গাড়ি থামায় নি, কারণ রাত্রি কোনও কথাই এখন সজ্ঞানে বলছে না। রাত্রির চোখ দুটো কেমন যেন লাল হয়ে উঠেছে, রাগ দুঃখ কষ্ট অভিমান সব মিলেমিশে একটা অদ্ভুত দৃষ্টির সৃষ্টি করেছে। নেশার ঘোরে রাত্রি কি করছে নিজেও জানে না, নিশীথ এখনও গাড়ি থামায় নি দেখে রাত্রি আরও জোরে চিৎকার করে বলল,

আই সেইড স্টপ দ্য কার।

নিশীথ এবার বাধ্য হয়ে বলল,

মিস রাত্রি, প্লিজ কাম ডাউন। আপনি এখ…..

কিন্তু নিশীথের পুরো কথা শেষ হওয়ার আগেই রাত্রি আবার চেঁচিয়ে উঠল,

আমি গাড়িটা থামাতে বলেছি।

নিশীথ এবার গাড়িটা থামাতে বাধ্য হল কারণ রাত্রি ভিষন উত্তেজিত হয়ে উঠেছে, ওর চোখের দিকে তাকালে মনে হচ্ছে যেন অগ্নিদৃষ্টি তে এক্ষুনি সব কিছু ছারখার করে দেবে। গাড়িটা থামার সঙ্গে সঙ্গে রাত্রি দরজা খুলে বাইরে নেমে পড়ল, নিশীথ বাধা দেওয়ার সুযোগ টুকুও পেল না। নিশীথ গাড়ি থেকে নেমে দেখল রাত্রি বেসামাল পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। নিশীথ দ্রুত পদক্ষেপে রাত্রির কাছে এসে বলল,

মিস রাত্রি আপনি কি করছেন? চলুন গাড়িতে, এভাবে হেঁটে কোথায় যাচ্ছেন? ইউ আর নট ইন ইওর রাইট স্টেট।

তাতে আপ..আপনার কি? আমি যে..যেখানে ইচ্ছে সেখানে যাব। আপনি চলে যান এ.. এখান থেকে, জাস্ট লিভ।

নিশীথ বুঝতে পারছে রাত্রির মনের মধ্যে জমা কষ্ট রাগ আর তার সঙ্গে মাদকের নেশা মিলিত হয়ে একটা ভয়ংকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। অনেক টা রাত হয়েছে, নির্জন রাস্তায় এভাবে বাইরে দাড়িয়ে থাকা তাও আবার এমন হিমেল রাতে যে মোটেও নিরাপদ নয় সেটা নিশীথ বুঝতে পারলেও রাত্রির এই মুহূর্তে বোঝার সাধ্য নেই। ঠান্ডা হাওয়া যেন সুচের মত বিধছে, নিশীথ তো তবু স্যুট পরে আছে কিন্তু রাত্রির অফ শোল্ডার লং ড্রেসটা মোটেই এই আবহাওয়ার পক্ষে অনুকূল নয়। ইভেন্ট হল আর গাড়ি, দুটোই এয়ার কন্ডিশনড হওয়ার দরুন এতক্ষণ বাইরের শীতলতা ওদের স্পর্শ করতে পারেনি কিন্তু এখন যেন শীতল হাওয়ার প্রতিটা কণা ক্ষণে ক্ষণে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিয়ে যাচ্ছে। নিশীথের বেশ ঠাণ্ডা লাগছে কিন্তু এই মুহূর্তে সে নিজেকে নিয়ে ভাবছে না, সামনে দাড়ানো শীতল বাতাসের স্পর্শে কেঁপে ওঠা রাত্রির দিকেই এখন তার সম্পূর্ণ মনোযোগ। নিশীথ একটু বিরক্ত হল, মেয়েদের এই তথা কথিত ফ্যাশন রক্ষা করতে গিয়ে বাকি সব কিছুকে তুচ্ছ করে দেওয়ার স্বভাব টা ওর একেবারেই পছন্দ নয়। হ্যা, এটা সেও মানে যে এই ধরনের অনুষ্ঠানে কেউই ঠিক গরম পোশাক পরে আসে না, সে নিজেও পরেনি কিন্তু তাই বলে সঙ্গে যে রাখেনি তা নয়। গাড়িতেই ওর উলেন ওভারকোট টা রয়েছে কিন্তু এই মেয়েরা পরা তো অনেক পরের কথা সঙ্গে পর্যন্ত রাখে না। নিশীথ রাত্রির একটা হাত ধরে আবার গাড়ির দিকে নিয়ে যেতে লাগল, আর রাত্রি টলমল পায়ে এগোতে এগোতে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতেই বলতে লাগল,

ছা… ছাড়ুন আমাকে… হাউ… হাউ ডেয়ার ইউ? লিভ মি… আই… আই সেইড… লিভ মি।

নিশীথ সে কথায় কান না দিয়ে রাত্রিকে এনে গাড়ির কাছে দাড় করিয়ে বেশ গম্ভীর গলায় বলল,

মিস রাত্রি প্লিজ, এখন না বুঝে এমন কিছু করবেন না যাতে পরে আপনার নিজেরই আফসোস হয়।

নিশীথের শীতল ব্যবহার যেন রাত্রির রাগ টাকে আরও বহুগুণ বাড়িয়ে দিল। এক ঝটকায় নিজের হাত টা নিশীথের হাতের মধ্যে থেকে মুক্ত করে নিয়ে বলল,

আফসোস? আরও আফসোস হওয়ার বাকি আছে? আমার… আম… আমার সব ফি….

রাত্রির কথা গুলো জড়িয়ে আসতে লাগল, নিশীথের এভাবে রাত্রিকে দেখতে ভালো লাগছে না। রাত্রির কষ্টের কারণ যে সে নিজেই সেটা আলাদা করে বলার প্রয়োজন পড়ে না আর ঠিক সেই কারণেই নিশীথের মন একটা অদ্ভুত খারাপ লাগায় ভরে উঠছে। নিশীথ ওর গাড়ি থেকে নিজের উলেন ওভারকোট টা এনে রাত্রির গায়ে জড়িয়ে দিতে গেলেই রাত্রি বেসামাল পায়ে কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে একটা হাত নিষেধের ভঙ্গিতে তুলে বলল,

স্টপ ইট, একদম না…. আপনার এই লোক দেখানো কনসার্ন আপ… আপনার নিজের কাছেই রা… রাখুন।

নিশীথ তাও এগিয়ে এসে একটু জোর করেই ওভারকোট টা ভালো করে রাত্রির গায়ে জড়িয়ে দিল। রাত্রি বাধা দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়েও বিশেষ লাভ করতে পারেনি। নিশীথ বলল,

আপনি এখন যা বলছেন যা করছেন তার কোনোটাই সজ্ঞানে করছেন না, নিজেও জানেন না কি বলছেন। হয়তো পরে নিজের কাজের জন্য নিজেই আফসোস করবেন, তাই বলছি প্লিজ গাড়িতে উঠুন। রাত হয়েছে, আপনার এখন বাড়িতে পৌঁছানোটা একান্ত প্রয়োজন, এখানে এভাবে বেশিক্ষণ দাড়িয়ে থাকা টা সেফ নয়।

রাত্রির মুখ থেকে হঠাৎ করে সব রাগ বিরক্তি ঘৃণা কোথায় যেন উধাও হয়ে গেল, ধীরে ধীরে তার ভাসা ভাসা চোখ দুটোয় ফুটে উঠল একটা অব্যক্ত কষ্টের ছাপ। রক্তিম বর্ন নেশাচ্ছন্ন চোখের কোণে জমতে লাগল বাষ্প, একসময় জমতে থাকা বাষ্প গুলো নিশব্দ উষ্ণ স্রোতের রূপ নিল। রাত্রির চোখের নোনা জল গুলো কিভাবে যেন নিশীথের অন্তরেও একটা অদ্ভুত অজানা জ্বালার সৃষ্টি করল। রাত্রি হঠাৎ কাদতে কাদতে হাটু মুড়ে বসে পড়ল, তার নিশব্দ কান্না গুলো হঠাৎ যেন সশব্দে নিজেদের সমস্ত কষ্ট চিৎকার করে উজাড় করে দিতে চাইছে। রাত্রির এতদিনের বহু কষ্টে দমিয়ে রাখা অনুভূতি গুলো যেন তাদের অস্তিত্বের দাবী জানাতে আজ শব্দের রূপ নিয়েছে।

কেন? কেন? কেন? আমি তো…. আমি তো নিজের মন টা কে বুঝিয়েই নিয়েছিলাম। আমার সব অনুভূতিগুলো কে মন থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলাম, তবে কেন? হোয়াই?

নিশীথের হঠাৎ নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছে, রাত্রি এভাবে কষ্ট পাক সেটা সে কোনোদিনই চায়নি। আর সেই কারণেই রাত্রির মনে কোনও অনুভূতি জন্ম নেওয়ার আগেই সরে আসতে চেয়েছিল। ভেবেছিল ক্ষণিকের মোহ অনুভূতির রূপ নেওয়ার আগেই শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু রাত্রির মনের কোণে যা জন্ম নিয়েছিল সেটা যে কোনোদিনই সেই ক্ষণিকের মোহ ছিল না, তার থেকেও অনেক বেশি কিছু ছিল সেটা আজ নিশীথ বুঝতে পারছে। এটা তো সে চায়নি, কাউকে সবটা দিয়ে ভালোবাসার পরেও যখন সেটা অসম্পূর্ণই থেকে যায় তার কষ্ট নিশীথ খুব ভালো করে বোঝে। সেই কষ্ট যাতে রাত্রিকে অনুভব করতে না হয় সেই কারণেই তো সেদিন আর রাত্রির সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক টুকুও গড়ে তোলার সুযোগ দেয়নি। কিন্তু আজ রাত্রিকে এইভাবে দেখে বুঝতে পারছে তার প্রচেষ্টা সম্পূর্ণ বিফল হয়েছে, সে যে কষ্টের অনুভূতি গুলো থেকে রাত্রিকে দূরে রাখতে চেয়েছিল আজ সেই কষ্ট গুলোই রাত্রির মনের আকাশে কালো মেঘের মত ছেয়ে আছে। আর সেই মনখারাপের নিকষ কালো আঁধার যেন নিশীথের মনটাকেও ধীরে ধীরে গ্রাস করে ফেলছে। রাত্রি যেন আজ বহুদিনের জমানো সব কষ্ট গুলোকে উজাড় করে দিতে চাইছে। দুচোখের অবিরাম বারি বর্ষণের সাথে বয়ে চলেছে তার মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা অব্যক্ত বেদনার স্রোত।

আমি… আমি ভেবেছিলাম আপনার থেকে দূরে চলে গেলেই বোধহয়… বোধহয় নিজের মনটাকে আবার সামলে নিতে পারব। চেষ্টা করেছি…. আমি… আমি চেষ্টা করেছি… আরও বেশি করে নিজেকে কাজের মধ্যে… কাজের মধ্যে ডুবিয়ে দিয়ে আপনাকে ভুলতে চেয়েছি। নিজের মনকে নিজেই জোর… জোর করে বুঝিয়েছি…. হ্যা, আমি ভুলে গেছি আপনাকে। কিন্তু নিজেকে জোর করে বোঝালেও সত্যি টা…. সত্যি টা বদলে যায় না। আমার মনের গভীরে…. কখন… কখন যেন আপনি নিজের জন্য জায়গা করে নিয়েছিলেন। আমি … আমি যতই নিজেকে বোঝাতাম…. আমার মনে আপনার জন্য যেটা আছে সেটা… সেটা শুধুই রেসপেক্ট। অন্যকিছু নয়….. অন্য… অন্য কিছু হতে পারে না… কিন্তু আমি জানি সেগুলো সব মিথ্যে। নিজেকে শান্তনা দেওয়ার একটা ব্যর্থ প্রয়াস ছাড়া আর কিছু না… কিছু না। সত্যি টা জানলেও আমি অ্যাকসেপ্ট করতে চাই নি… আই …আই ডোন্ট নো আমি কীকরে আপনাকে…. আপ…আপনাকে ভালোবাসলাম… আই ডোন্ট নো।

নিশীথ যেন একটা স্থির মূর্তির মত দাড়িয়ে রয়েছে, এই পরিস্থিতি টা এড়ানোর জন্যই সে চেষ্টা করেছিল কিন্তু…. ওই যে, জীবন আমাদের ইচ্ছে অনুযায়ী চলে না, জীবন যেভাবে আমাদের চালনা করতে চায় আমাদের সেভাবেই চলতে হয়। রাত্রি একভাবে বলে চলেছে, আজ যেন সবটা বলে হালকা হতে চাইছে সে।

হাউ ফানি… তাই না? আমার লাইফে ফার্স্ট…. ফার্স্ট লাভ, প্ৰ… প্রথম প্রেম। শুনতে কত ভালো লাগে তাই না এই শব্দ গুলো? কিন… কিন্তু এই শব্দ গুলো আমার লাইফের সব থেকে পেইনফুল ওয়ার্ড। আমি.. রাত.. রাত্রি অহুজা… যার সঙ্গে একবার দেখা করার জন্য কত জন… কত জন অপেক্ষা করে থাকে সেই আমি কিনা… আমি ভালোবাসলাম… নিজ…নিজের অজান্তেই… কাকে! না আপনাকে… দ্য নিশীথ আগরওয়াল কে। যার…যার মন বলতে কিচ্ছু নেই… কিচ্ছু নেই, যার কাছে ফিলিংস বলতে কিছু নেই, যার কাছে.. যার কাছে অন্যের ফিলিংসেরও কোনও…কোনও দাম নেই।

নিশীথ জানে রাত্রি যা বলছে ঠিকই বলছে, অন্য সবার কাছে নিশীথ আগরওয়ালের এই চিত্র টাই পরিচিত। নিশীথ সবার সামনে যেভাবে নিজেকে উপস্থাপন করে তাতে যে কেউ এটাই ভাববে। তাতে নিশীথের কিছু এসে যায় না, বরং সে নিজে ইচ্ছে করেই এইরকম একটা ব্যক্তিত্ব সবার সামনে তুলে ধরেছে। কিন্তু আজ যেন রাত্রির কথা গুলো মনের কোনও একটা কোণায় আঘাত হানছে, ইচ্ছে করছে রাত্রিকে এক্ষুনি সবটা বুঝিয়ে বলতে। বলতে ইচ্ছে করছে সে তাকে কষ্ট দিতে চায়নি, তার মনেও অনুভূতি আছে কিন্তু তাদের স্পন্দনে যে অন্য কারোর নাম লেখা। কিন্তু নিশীথ পারল না, বহু চেষ্টা করেও নিজের বাইরের আবরণ ভেদ করে তার প্রকৃত সত্তা টাকে মেলে ধরতে পারল না। রাত্রির কষ্টটা নিশীথ অনুভব করতে পারছে, সে নিজেও এই কষ্টের সম্মুখীন হয়েছে। নিশীথ হাঁটু মুড়ে রাত্রির সামনে বসল, রাত্রির চোখে তখনও অঝোর ধারায় ঝরছে অকাল বর্ষণ। নিশীথ একটু ইতস্তত করে দুহাত দিয়ে রাত্রির কাধ দুটো ধরে মৃদু স্বরে ডাকল,

রাত্রি।

রাত্রি হঠাৎ নিশীথের হাত দুটো এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে অতর্কিতে ওর কোটের কলারটা চেপে ধরে বলতে লাগল,

কেন? কেন করলে এটা? বলো, আনসার মি।

হঠাৎ যেন রাত্রির বেদনা ক্লিষ্ট চোখ দুটোয় ক্রোধানল ঝলসে উঠল, কখন যে আপনি থেকে তুমিতে নেমে এসেছে সেটাও খেয়াল করেনি। নিশীথও রাত্রির এই রূপ আগে কখনও দেখেনি, বিস্ময়ে বিহ্বল হয়ে চেয়ে রইল রাত্রির দিকে। আর রাত্রি… সে তখন বহু বছরের ঘুমিয়ে থাকা আগ্নেয়গিরির মত হঠাৎ জেগে উঠে মনের মধ্যে জমিয়ে রাখা সব রাগ ক্ষোভ দুঃখ মান অভিমান যেন উগরে দিতে চাইছে।

ভালই তো ছিলাম…. তোমাকে… তোমাকে একটুও পছন্দ করতাম না আমি.. আই… আই জাস্ট…. হেট ইউ। তাহলে কেন? কে বলেছিল ওভাবে সেদিন আমার হয়ে কথা বলতে? কে.. কে বলেছিল? সেদিন আমার সম্ভ্রম রক্ষার দায়িত্ব নিতে… কে বলেছিল? দায় … তাই না? দায় পালন কর….করছিলে? তোমার ফল্ট ছিল মনে করেছিলে… তাই… তাই নিজের…নিজের গিল্ট কম করছিলে… তাই না? কিন্তু কেন? হোয়াই? আমার মনটা তো আর…তো..তোমার মত ফিলিংস লেস নয়। আমার এই… স্টুপিড মনটা তোমার দায়… দায় পালন টাকে একটু বেশি কিছু ভাবতে… ভাবতে চেয়েছিল।

রাত্রির দুচোখের অশ্রু বর্ষণ এখনও অব্যাহত, নেশায় আচ্ছন্ন হয়ে কি করছে কেন করছে নিজেও বুঝতে পারছে না। এর পরিণাম কি হতে পারে, সেটা নিয়েও এই মুহূর্তে তার কোনও মাথা ব্যথা নেই। এখন শুধু সে সবটা উজাড় করে দিতে চায়, মনের মধ্যে আর কিছু সে চেপে রাখতে চায় না। নিশীথ আর একটাও কথা বলেনি, বলার মত কিই বা আছে তার, আর এই মুহূর্তে রাত্রিকে কিছু বললেও বিশেষ লাভ হবে না, তাই নির্বাক শ্রোতা হয়ে শুধু শুনে যেতে লাগল।

তোমার… তোমার ঐ রুড বিহেভিয়ার আমি মেনে নিয়েছিলাম। সেটাই তো ভালো ছিল.. তোমার জন্য তখন… তখন আমার মনে কিচ্ছু ছিল না… নাথিং। কেন তাহলে আমার সঙ্গে ভালো বিহেভ করলে? কেন আমার মনে থাকা তোমার ইমেজ টাকে চেঞ্জ করতে বাধ্য করলে? কে.. কেন? আর তারপর.. হঠাৎ করেই আবার… আবার সেই পুরনো ব্যবহারে ফিরে গেলে.. এক.. এক নিমেষে। যেন.. যেন কখনো কিছু পাল্টায় নি, এত নির্লিপ্ত… কেন? কেন? কেন?

শেষের দিকের কথা গুলো বলার সময় ধীরে ধীরে রাত্রির দুচোখের আগুন যেন আবার নিভে এলো, আবারও একরাশ কষ্টেরা ভিড় করল দুচোখের পাতায়। দুহাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরে রাখা নিশীথের কোটের কলার টা ধীরে ধীরে ছেড়ে দিল। নিশীথ কি বলবে কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না, আজ এই মুহূর্তে সে সম্পূর্ণ সুত্রহীন। এতোটা অসহায় এর আগে নিজেকে কখনও মনে হয়নি, রাত্রির কষ্টে তার নিজেরও যে একটা অজানা কষ্ট মনের কোনায় উকি দিয়ে যাচ্ছে সেটা বুঝতে পারছে। চাইছে এই মুহুর্তেই রাত্রির কষ্ট গুলো দূর করে দিতে কিন্তু সে নিরুপায়, রাত্রি যা চায় সেটা নিশীথের পক্ষে তাকে দেওয়া সম্ভব নয়। রাত্রি কান্না ভেজা গলায় আকুল সুরে বলে উঠল,

কি দোষ ছিল আমার? নিজের অজান্তেই তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম। এটাই…. এটাই কি আমার দোষ ছিল? আমি তো… আমি তো কখনও জোর করে তোমাকে পেতে চাইনি, আমার ভালোবাসার প্রত্যুত্তরে ভালোবাসা না হয় নাই দিতে কিন্তু এতোটা কষ্ট এতোটা অপমান এতোটা অবহেলা কেন দিলে? সেদিন তোমার কাছে আমি…. আমি বন্ধুত্ত্বের হাত বাড়িয়ে দিতে গিয়েছিলাম। বন্ধুত্বের থেকেও আরও বেশি কিছুর আশা ছিল না… এমনটা আমি বলতে পারব না। তবে নিখাদ বন্ধুত্ত্ব দিয়েই শুরু করতে চেয়েছিলাম আমাদের নতুন সম্পর্কটা। কিন্তু তুমি সেটুকুও তো আমায় দিলে না, অযাচিত অবাঞ্ছিত দায়ের মত এড়িয়ে গেলে। ভালোবাসতে না পারলেও বন্ধুত্ব টুকুও কি আমায় দিতে পারতে না? আমি এতটাই মূল্যহীন তোমার কাছে?

রাত্রির প্রতিটা কথায় একই সঙ্গে বাজছে বেদনা আর অভিমানের সংঘবদ্ধ ঝঙ্কার। নিশীথের মনেও কষ্টেরা ভিড় করে আসছে, এই পরিস্থিতিতে কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে ওর। মনে প্রাণে চাইছে রাত্রিকে সবটা বুঝিয়ে বলতে, ওর কষ্ট কম করতে কিন্তু কিছুতেই পারছে না। আর যদি বলতে পারতও রাত্রি কি এই মুহূর্তে বুঝতে পারত? নিশীথের মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা যন্ত্রণার অনুভূতিগুলোকে কি রাত্রি বুঝতে পারত? নিশীথের সব কথারা যেন আজ মৌনতার চাদরে নিজেদের আচ্ছাদিত করে নিয়েছে। হঠাৎ রাত্রি ওর হিমেল হাওয়ায় শীতল হয়ে আসা হাত দুটো নিশীথের গালে ছোয়াল। চমকে উঠল নিশীথ, রাত্রির চোখের তারায় ফুটে উঠেছে ভালোবাসার করুন আর্তি। রাত্রি করুন সুরে বলল,

আমি কি এতটাই অযোগ্য? আমাকে কি একটুও ভালোবাসা যায় না?

রাত্রি তৃষ্ণার্ত ব্যাকুল হৃদয়া প্রণয়ীনির মত অগ্রসর হতে লাগল নিশীথের দিকে। নিশীথ রাত্রির চোখে ফুটে ওঠা ব্যাকুলতার মধ্যে দিয়ে আসন্ন ঝড়ের ইঙ্গিত দেখতে পেল। একটা তুমুল ঝড় ধেয়ে আসছে ওর দিকে, ওর মনটাকে তছনছ করে দিতে। কিন্তু পূর্বাভাস পেয়েও নিশীথ সেই ঝড়ের আগমন রুখতে পারল না। একসময় রাত্রির ক্রমবর্ধমান উষ্ণ অধর যুগল স্পর্শ করল নিশীথের অস্পৃষ্ট ওষ্ঠ দ্বয়ে। হ্যা, শুনতে কিছুটা অবাস্তব মনে হলেও এটাই নিশীথের জীবনে কোনও নারীর প্রথম স্পর্শ। নিশীথের সমগ্র সত্তা জুড়ে একটা সম্পূর্ণ নতুন অনুভূতির শিহরণ বয়ে গেল যার নাম সে জানে না। সেই আসন্ন ঝড় যেন হঠাৎ দুর্দম গতিতে এসে আছড়ে পড়ল নিশীথের হৃদয়ে, তোলপাড় হয়ে যেতে লাগল সব সুপ্ত অনুভূতি। অল্পক্ষণের সেই অধর মিলাপ যেন অনেক কিছু বলে যেতে চাইল, কিন্তু দুটো ভগ্ন হৃদয় তার কতটা বুঝতে পারল সেটা তো সময় বলবে। নিশীথ ঘটনার আকস্মিকতায় পাথরের মূর্তির মত একভাবে স্থির হয়ে রইল আর রাত্রি…. রঙিন পানীয়ের নেশার ঘোরেই হোক আর নিজের মনের অন্তরস্থলে জমে থাকা অনুভূতি গুলোর আত্মপ্রকাশের ভারমুক্ত অনুভবের জন্যই হোক ধীরে ধীরে সে ঢলে পড়ল নিশীথের বুকে। নিশীথ কিছুক্ষণ সেভাবেই ওই নির্জন জনশূন্য রাস্তার ধারে একভাবে বসে রইল। কতক্ষন বসে ছিল বলা যায় না, এলোমেলো হয়ে যাওয়া ভাবনা গুলোকে বোধহয় একত্রিত করতে চাইছিল। একটু আগেই ঠিক কি ঘটে গেল সেটা আদৌ সত্যি না কোনও অদ্ভুত অলীক স্বপ্ন সেটা বোঝার চেষ্টা করছিল হয়তো। কিন্তু নিশীথের চিন্তার জাল ছিড়ল একটা সশব্দ আলোক স্ফুরনে। নিশীথ চমকে নিকষ কালো আকাশের দিকে তাকাল, সেখানে মিটি মিটি জ্বলতে থাকা তারার মাঝে এখন ফুটছে হাজার আলোর রোশনাই। বারোটা বাজে, সবাই স্বাগত জানাচ্ছে নতুন বছর কে। একটা নতুন বছরের প্রারম্ভ, পুরনো বছরের সঙ্গে পুরনো অতীত কে পিছনে ফেলে নতুন ভবিষ্যৎ গড়ার আহ্বান। নিশীথ কিছুক্ষণ সেই রঙিন আলোর দিকে তাকিয়ে থেকে নিজের বুকের ওপর থাকা রাত্রির মুখটার দিকে তাকাল। আজ সত্যিই সে কিছুই স্থির করতে পারছে না, উচিৎ অনুচিৎ, ভালো মন্দ সব যেন কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। নিশীথ দুহাতে রাত্রিকে কোলে তুলে প্যাসেঞ্জার সিটে বসিয়ে সিট বেল্ট লাগিয়ে দিল। নিজে ড্রাইভিং সিটে বসে একটুক্ষণ চোখ দুটো বন্ধ করে যেন নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করল। তারপর একবার ঘুমন্ত রাত্রির মুখের দিকে তাকিয়ে আবার এগোল গন্তব্যের দিকে। ফাঁকা রাস্তায় বেশিক্ষণ লাগল না পৌঁছাতে, রাত্রির বাংলোতে তে পৌঁছে নিশীথ আবার রাত্রিকে কোলে তুলে নিয়ে এগিয়ে গেল মূল দরজার দিকে। বাড়ির সর্বক্ষণের দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা মুরু রাত্রিকে এই অবস্থায় দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল। সে নিশীথ কে চেনে না তাই একটা শঙ্কিত জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে নিশীথের দিকে তাকিয়ে বলল,

ছোটি মেমসাবের কি হয়েছে? আর আপনি…..

নিশীথ সংক্ষেপে নিজের পরিচয় দিয়ে বলল,

ওর তেমন কিছু হয়নি, আপনি আমাকে একটু ওর রুমটা দেখিয়ে দেবেন?

মুরু নিশীথ কে রাত্রির রুমে নিয়ে এল, নিশীথ রাত্রিকে কোলে করেই ওর রুমে নিয়ে এসে আলতো করে বিছানায় শুইয়ে দিল। তারপর মুরুর দিকে তাকিয়ে বলল,

কালকে সকালে ওনার যখন ঘুম ভাঙ্গবে আগে এক গ্লাস লেবু জল দেবেন, একটু বেশি করে লেবু দেবেন।

মুরু নীরবে শুধু মাথা নাড়ল। নিশীথ রাত্রির ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকাল, আজ রাত্রি নেশার আছন্নতায় কি করেছে কি বলেছে তার কোনোটাই জানে না। হয়তো কাল যখন ঘুম ভাঙ্গবে তখন আজকের কোনও কথাই তার মনে থাকবে না। নিশীথের অন্তর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস যেন আপনা থেকেই বেরিয়ে এল, আর দাড়াল না নিশীথ, দ্রুতপদে সেখান থেকে বেরিয়ে গেল। আজ আবার যে গোটা রাতটাই বিনিদ্র যাপন করতে হবে বেশ বুঝতে পারছে সে। রাত প্রায় দেড়টা বাজে, কুহেলি আর আলেখ এই সবে মাত্র ফিরেছে। ফ্রেশ হয়ে ক্লান্ত শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দিতেই যেন ঘুমে চোখ দুটো বুজে আসতে চাইল আলেখের। কিন্তু সে ঘুমালো না কারণ পার্টিতে অনেকক্ষণ ধরেই কুহেলিকে খুব অন্যমনস্ক হয়ে যেতে দেখেছে সে। তখন আর জিজ্ঞেস করা হয়নি, কিন্তু কারণটা না জানতে পারলেও তার শান্তি হবে না। কুহেলি ফ্রেশ হয়ে একটা হালকা নাইট স্যুট পরে আলেখের পাশে এসে বসতেই আলেখ বলল,

কুহেলি, তোমাকে একটা কথা অনেকক্ষণ ধরে জিজ্ঞেস করব ভাবছিলাম কিন্তু অত শোরগোলের মধ্যে আর হয়ে ওঠেনি।

কুহেলি ওর ফোনটা হাতে নিয়ে কিছু একটা ভাবতে ভাবতেই একটু অন্য মনষ্ক ভাবেই উত্তর দিল।

হ্যা, বলো না।

আগে এদিকে তাকাও।

কুহেলি যেন প্রথমটায় শুনতেই পেল না। আলেখ ওর হাত থেকে ফোনটা নিয়ে রেখে দিতেই কুহেলি বলল,

কি হল?

সেটাই তো আমি জানতে চাইছি, কি হল? মানে কি হয়েছে? সেই পার্টি থেকেই দেখছি তুমি খুব অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছ। আর হঠাৎ করে রিতুও বা আগে চলে এলো কেন?

কুহেলি একটু থেমে আলেখ কে সবটা বলল, মানে যতটা সে আন্দাজ করতে পেরেছে। শুনে আলেখ যথেষ্ট অবাক হয়ে বলল,

কি বলছ তুমি! রিতু… আর মিস্টার আগরওয়ালকে ভালোবাসে!

আমার তাই মনে হয়।

কিন্তু… তোমার তো ভুলও হতে পারে।

হুম, সে হতেই পারে কিন্তু আমার মনে হয় না এক্ষেত্রে আমার কোনও ভুল হচ্ছে।

কিন্তু কুহেলি, রিতু তো মিস্টার আগরওয়াল কে তো পছন্দই করে না তাহলে এটা কীকরে সম্ভব? আর মিস্টার আগরওয়ালকে দেখেছ তো… তোমার মনে হয় ওনার মনে রিতুর জন্য কোনও ফিলিংস আছে?

আমি মিস্টার আগরওয়ালের কথা বলছি না আলেখ, ওনার কথা আমি জানি না। কিন্তু রাত্রি যে ওনাকে ভালোবাসে এতে আমার কোনও সন্দেহ নেই।

বাট এটা কেমন ইম্পসিবল মনে হচ্ছে না?

কেন? ইম্পসিবল মনে হবে কেন?

ওদের কি কোনও দিক দিয়ে কোনও মিল আছে? তুমিই বলো না, কেমন অদ্ভুত শোনাচ্ছে না!

যেটা অসম্ভব মনে হয় সেটাই সেটাই কিন্তু হঠাৎ একদিন সম্ভব হয়ে যায়। বেশি দূরে যেতে হবে না আমাদের কথাটাই ভাব না, কেউ ভাবতে পেরেছিল আমাদের বিয়ে হতে পারে! অন্য কারোর কথা বাদ দাও আমরা নিজেরাই কি ভাবতে পেরেছিলাম?

হুম, তাও ঠিক। আচ্ছা, রিতু ঠিকঠাক বাড়ি পৌঁছেছে তো?

মানে? রাত্রিকে মিস্টার আগরওয়াল নিজে পৌঁছে দিয়েছেন, ঠিক মত পৌঁছাবে না কেন?

না মানে, এমনিই বলছিলাম আর কি।

হুম, তবে একটা খবর না পেলে না ভালো লাগছে না জানো তো।

তাহলে একটা ফোন করো।

আমিও ভাবছিলাম, কিন্তু রাত্রিকে ফোন করে লাভ হবে না ও তো নিজের হুশেই নেই আর মিস্টার আগওরয়াল কে এখন ফোন করা টা ঠিক হবে না।

কেন?

তুমি কি বলো তো? রাত কটা বাজে দেখেছ? ঘড়ির দিকে একবার তাকাও, দুটো পেরিয়ে গেছে। এখন কাউকে ফোন করার সময়?

হুম, ভুলে গিয়েছিলাম। আচ্ছা শোনো না, আমার না খুব ঘুম পাচ্ছে।

তো ঘুমাও।

ডেইলি রুটিন টা বাকি রেখেই ঘুমিয়ে পড়ব?

তুমি কি গো? দেখছ এমন একটা পরিস্থিতি, রাত্রির ব্যাপারটা না জানা পর্যন্ত আমার ভালোলাগছে না আর তুমি পড়েছ তোমার…… উফফ।

আরে বাবা, রিতু ঠিক না থাকলে মিস্টার আগরওয়াল তোমাকে জানতেন তো। কিছু জানান নি যখন তখন রিতু ঠিক আছে, তাই এত চিন্তা করো না।

কুহেলি ভাবল, কথাটা একেবারে অযৌক্তিক নয়, তেমন কিছু হলে তো নিশীথ ওকে জানাতোই। কিন্তু তাও রাত্রির সাথে কথা না বলা পর্যন্ত ওর ভালো লাগছে না। নিজের মনেই অনেক কিছু ভাবছিল কুহেলি হঠাৎ আলেখ চট করে কুহেলির ঠোঁটে নিজের ঠোঁট জোড়া ছুঁইয়ে দিয়ে বলল,

গুড নাইট অ্যান্ড হ্যাপি নিউ ইয়ার মাই লাভ।

কুহেলি হা করে তাকিয়ে আছে দেখে আলেখ হেসে বলল,

তুমি যে আজ দেবে না বুঝতেই পারছিলাম তাই নিজের পাওনা টা নিজেই নিয়ে নিলাম। বছরের প্রথম দিনটাই যদি মিস যেত তাহলে সারা বছর কি হত কে জানে! এত বড় রিস্ক আমি নিতে পারিনি, সরি।

কুহেলি হেসে ফেলল, আলেখের চুল গুলো ঘেঁটে দিয়ে বলল,

পাগল একটা।

ক্রমশ___________

© স্বত্ব সংরক্ষিত

আজকের পর্ব টা কেমন লাগল জানাতে ভুলবেন না যেন। অপেক্ষা করে থাকব কিন্তু। আর হ্যা, কি হতে চলেছে এরপর? কি মনে হয়? কোন দিকে এগোবে নিশীথ আর রাত্রির জীবন? নিজেদের মতামত জানাতে ভুলবেন না কিন্তু। আজ তবে আসি দেখা হবে আগামী পর্বে ততদিন পর্যন্ত পড়তে থাকুন ভালো থাকুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here