#সংগোপনে
#ধারাবাহিক_পর্ব_৫৮
#অচিন_পাখি_কলমে_ভাগ্যলক্ষ্মী_দাস
আগের পর্বের পর————-
রাত্রি সেই কখন থেকে পায়চারি করেই চলেছে, একবার এদিক থেকে ওদিকে যাচ্ছে তো আরেকবার ওদিক থেকে এদিকে আসছে। নিশীথ চুপচাপ বসে ছিল, এইভাবে রাত্রিকে ক্রমাগত পায়চারি করতে দেখে বলল,
সকালের ওয়ার্কআউট টা কি এখানেই সেরে ফেলছেন?
রাত্রি একটু চমকে উঠে বলল,
হ্যা? কিছু বললেন?
বললাম, এত পায়চারি না করে একটু বসুন।
রাত্রি নিশীথের প্রথম কথাটাও শুনেছিল তবে একটু ভাবনার জালে মগ্ন থাকায় অতটা বুঝতে পারেনি। নিশীথ ফোনে কিছু একটা করছে মাথা নিচু করে, রাত্রি গিয়ে নিশীথের পাশে বসল।
ডক্টর ব্রাউন আপনার পরিচিত?
নিশীথ ফোন থেকে মাথা না তুলেই উত্তর দিল,
হ্যা, আমার ড্যাডের ফ্রেন্ড।
ওহ।
রাত্রি চুপ করে গেল, আর কিছু বলল না। নিশীথ এখনও সেই ফোনের দিকেই তাকিয়ে আছে, কি যেন একটা করেই চলেছে। রাত্রির একটু খারাপ লাগল, একবারও নিশীথ ওর দিকে তাকালো না, তবে এখন এইসব নিয়ে মন খারাপ করার সময় নয়। রুমের বন্ধ দরজা টার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, কি হচ্ছে ভিতরে কে জানে! ভিতরে অবশ্য এখন পিন পতন নীরবতা বিরাজ করছে। অশ্রুসিক্ত আবেগী মুহূর্ত গুলো পেরিয়ে এখন তিনটে মানুষ মুখোমুখি বসেছে, যেন কোনও অন্তিম বিচার সভা। নভতেজ বাবু কুহেলির দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে বলার চেষ্টা করলেন,
কুহেলি বেটা, তুমিও রাগ করেছ বুঝি?
কুহেলি কোনও কথা বলল না, চোখের জল গুলোকে অনেক কষ্টে দমিয়ে রেখেছে। আবার যে কখন নির্লজ্জের মত ঝরে পড়বে কে জানে! নভতেজ বাবু একটু ম্লান হেসে আবার বললেন,
এত রাগ করেছিস তোরা দুজনে?
এবার আলেখ মুখ খুলল, নিজের তপ্ত জলের ধারা গুলোকে সংযত করে নিয়েছে সে। আলেখ কথা বলল বটে তবে উত্তর দিতে নয়, পাল্টা একটা প্রশ্ন করতে।
তুমি আমাদের জানাওনি কেন ড্যাড?
নভতেজ বাবু খুব সহজ ভাবেই উত্তর দিলেন,
কুহেলি বলেনি তোকে? ও তো জানে, আমি কেন তোদের বলিনি। আমার মেয়েটা এত বুদ্ধিমতী আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম। বোকার মত ডায়েরিটা ওখানেই রেখে এসেছিলাম।
ড্যাড প্লিজ, তুমি কীকরে ভাবতে পারলে এটা? এত বড় একটা ডিসিশন তুমি এমনিই নিয়ে নিলে?
এই যে কষ্ট টা পাচ্ছিস এটাই তো চাই নি আমি আলেখ।
আর তুমি যেটা করতে চেয়েছিলে তাতে আমাদের কষ্ট হত না?
হত, কিন্তু কম হত। আমাকে এইভাবে দেখে যে কষ্টটা পাচ্ছিস সেটা তো পেতে হত না।
কুহেলি এতক্ষণ শুধুই শুনছিল, কিন্তু এবার আর চুপ করে থাকতে পারল না।
এটা তোমার ভুল ধারণা ড্যাড, আমি মানছি তুমি আমাদের কথা ভেবেই এইরকম একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলে কিন্তু আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি ড্যাড তোমার সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। তুমি একবারের জন্যও কি ভেবে দেখেছিলে, যদি……
কথাটা আর শেষ করতে পারল না কুহেলি, আসন্ন ওই অসম্ভব দুরূহ মুহূর্ত টার কথা সে ভাবতেও চায় না। নভতেজ বাবু কিছু বলতে পারছেন না, কীই বা বলবেন তিনি! সত্যিই তো, আজ যেন মনে হচ্ছে ছেলে মেয়ে দুটো কে কষ্ট দিতে না চাওয়ার অভিলাষ থেকেই যেন আরও বেশি করে কষ্ট দিয়ে ফেলেছেন। চোখের কোণে দু ফোঁটা জল যেন চিকচিক করে উঠল, গলাটাও কেমন যেন বুজে আসছে। ধরা গলায় বললেন,
বুড়ো টাকে একটু ক্ষমা করতে পারবি না তোরা? এভাবে রাগ করেই থাকবি তোরা? সময় যে বড় কম আমার হাতে।
এই একটা কথা যেন আলেখ আর কুহেলির অন্তরটা ছিন্ন ভিন্ন করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। কুহেলি যেন নিজের যন্ত্রণা টা আড়াল করার জন্য কপট রাগের আড়ালে মুড়ে নিল নিজের শব্দ গুলোকে।
আর একবারও যদি তোমার মুখে এই কথা শুনি তাহলে আমি সত্যি সত্যি আর কোনদিনও তোমার সাথে কথা বলব না। আর তোমার জুনিয়র শর্মা কেও বলে দেব যেন তোমার সঙ্গে একটাও কথা না বলে।
নভতেজ বাবু একটু আলগা হাসলেন, মেয়েটা তাকে কেমন ধমকাতে চাইছে, কিন্তু সেটাও ঠিক মত পারছে না, অন্তরের তীব্র বেদনা গুলো হাজার আড়াল পেরিয়ে ঠিক নিজের অস্তিত্বের জানান দিয়ে যাচ্ছে। প্রথম টায় নভতেজ বাবু কুহেলির কথা গুলো অতটা খেয়াল করেননি, কিন্তু পরই মুহূর্তেই মনে হল,
কি বলল কুহেলি? জুনিয়র শর্মা…. মানে!
নভতেজ বাবু বিস্মিত চোখে তাকালেন কুহেলির দিকে, কিছুটা যেন উত্তেজিতও। কুহেলির ঠোঁটে তখন বিচরণ করছে একটা স্মিত হাসি, সে জানে এই একটা কথা মুহূর্তে সব বিষাদ কে দূরে সরিয়ে দিতে পারে। নভতেজ বাবু কুহেলির দিকে কিছুক্ষন চেয়ে থাকার পর দৃষ্টি সরিয়ে আলেখের ওপর ফেরালেন। আলেখের মুখেও এত কষ্টের মধ্যেও খেলছে এক টুকরো আলতো হাসি। নভতেজ বাবু বুঝতে পারলেন কিন্তু এখনও যেন ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না। চোখ দুটো আচমকাই জলে ভরে উঠল, না এই অশ্রু বেদনার নয় কষ্টের নয় দুঃখের নয়। এই নোনা জল গুলো আজ আনন্দের জোয়ার নিয়ে নেমে এসেছে। নভতেজ বাবুর শীর্ণ রোগাক্লিষ্ট মুখটা খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল, ঠোঁটের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত জুড়ে ছড়িয়ে গেল স্ফীত হাসির উচ্ছ্বাস। আনন্দে যেন আত্নহারা হয়ে যেতে চাইছেন তিনি, আনন্দাশ্রুতে সিক্ত গলায় তিনি বলে উঠলেন,
তোরা সত্যি বলছিস? আলেখ তুই বাবা হতে চলেছিস? কুহেলি, বেটা, তুমি…. তুমি সত্যিই….
কথা গুলো যেন কিছুতেই সম্পূর্ণ করতে পারছেন না তিনি, খুশির তোড়ে যেন তার সব ভাষারাও কেমন এলোমেলো হয়ে পড়েছে। কুহেলি আর আলেখ দুজনেই একসঙ্গে এগিয়ে গিয়ে নভতেজ বাবুর পাশে বসল। আলেখ বলল,
এটা সত্যি ড্যাড, আমরা তোমাকে সেদিনই জানাতে চেয়েছিলাম যেদিন আমরা এই শ্রেষ্ঠ সংবাদ টা পেয়েছিলাম কিন্তু তোমার এই স্বেচ্ছায় নেওয়া অজ্ঞাতবাস আর সেটা হতে দেয়নি। ড্যাড, আমাদের ছোট্ট পরিবার সম্পূর্ণ হতে চলেছে।
নভতেজ বাবু বুঝতে পারছেন না তিনি এত খুশি কোথায় রাখবেন। তার আলেখ, তার সেই ছোট্ট আলেখ আজ বাবা হতে চলেছে! কুহেলির কোল আলো করে একটা ছোট্ট আলেখ না হলে একটা ছোট্ট কুহেলি আসতে চলেছে। এটাই তো চেয়েছিলেন তিনি, আজ যেন নিজেকে সম্পূর্ণ মনে হচ্ছে নভতেজ বাবুর। খুশির আবেগে দু হাতে জড়িয়ে ধরলেন তার আলেখ আর কুহেলি কে। দুচোখের উষ্ণ জলে যেন সুখের বন্যা নেমেছে আজ, কি এক পরম প্রশান্তি তে ভরে উঠেছে তার মন। কিন্তু এ জগতে সুখ দুঃখ কোনোটাই স্থায়ী নয়, এই আছে এই নেই। নোনা জল গুলোর সুখানুভূতিও যেন বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না, বিষন্নতার ছোয়ায় যেন জ্বালা করতে লাগল চোখ দুটো। এই তো, এক মুহুর্ত আগেও যেখানে বিরাজ করছিল অসীম প্রশান্তি এখন সেখানে ছেয়ে আছে শুধুই একরাশ হাহাকার। এ জীবনের শ্রেষ্ঠ সুখ আর হয়তো পাওয়া হবে না তার, হাতে যে আর মাত্র গুটি কয়েক দিন বাকি তার। নভতেজ বাবুর অন্তরটা এক বিরাট শূন্যতায় ভরে উঠল, এমনিতেই জেনে বুঝে নিজের প্রিয়জনের মায়া কাটিয়ে বিদায় নেওয়া যে ঠিক কতখানি কষ্টের সেটা যে নিজে না অনুভব করেছে সে বুঝবে না, আর এখন তো যেন কষ্ট টা আরও দ্বিগুণ হয়ে চেপে বসেছে তার বুকের ওপরে। কিছুটা নিজের স্বার্থেও এই অজ্ঞাতবাসের পথটা বেছে নিয়েছিলেন তিনি। পরিবারের মোহ টা কাটিয়ে উঠতে চেয়েছিলেন তিনি, যাতে তাদের ছেড়ে যাওয়ার কষ্ট টা কিছুটা হলেও কম হয়, কিন্তু আজ এ কি হল! সেই মোহ টা যে আরও বেশি করে ঘিরে ধরতে চাইছে তাকে। পরিপূর্ণ এই সংসার ছেড়ে যেতে মন চাইছে না যে। নভতেজ বাবু ওদের অলক্ষ্যেই একটু সামলে নিলেন নিজেকে, ছেলে মেয়ে দুটো বড্ড ভালোবাসে তাকে। ওদের সামনে যদি এখন দুর্বল হয়ে পড়েন তাহলে কি করে চলবে, মুখে একটা প্রশস্ত হাসি এনে বললেন,
এতো বড় একটা সুখবর তোরা আমাকে এত দেরীতে বলছিস? এসেই আগে তোরা আমার ওপর রাগ দেখাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লি।
এতকিছুর মধ্যেও যেন হঠাৎ করেই একটা খুশির দমকা হাওয়া বয়ে গেল। নভতেজ বাবু সযত্নে নিজের কষ্ট গুলোকে মনের অতল গভীরে লুকিয়ে রাখলেন। সবটা জানা সত্ত্বেও মেতে উঠলেন খুশিতে, উত্তেজিত হয়ে বললেন,
ইশ, আমারই দোষ, এই অবস্থায় কুহেলি কে এতোটা জার্নি করতে হল।
কুহেলি কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু নভতেজ বাবু আর সেই সুযোগই দিলেন না। একনাগাড়ে তিনি বলে চললেন,
যাক সে যা হয়েছে সে তো হয়েই গেছে, আমি এখন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়ি যেতে চাই। আলেখ তুই তো ডক্টর লুইস কে দেখলি ওনাকে বলিস তো আমার সাথে একবার দেখা করতে আমি অ্যাস সুন অ্যাস পসিবল এখান থেকে বেরোতে চাই। কত কিছু করার আছে বলতো, আমি নিজে দাড়িয়ে থেকে আমাদের জুনিয়র মেম্বারের রুম সাজাব। যাতে আমাকে না পেলেও আমার ছোয়াটা যেন তার কাছে পৌঁছায়।
শেষের কথাটা তিনি অবশ্যই নিজের মনের মাঝেই বললেন। আলেখ আর কুহেলি দুজনেই যেন হতভম্ব হয়ে পড়েছে, কোথায় গেল সেই একমুহুর্ত আগেও বিরাজ করা তীব্র যন্ত্রণা দায়ক পরিবেশ? এখন এই মুহূর্তে দাড়িয়ে যেন মনে হচ্ছে সবটাই একটা ভয়ঙ্কর কোনও দুঃস্বপ্ন ছিল যেটা নিদ্রার অবসানের সঙ্গেই হারিয়ে গেছে চিরতরে। কিন্তু সত্যি টা যে এভাবে বদলে যায় না সেটা ওরাও জানে, বদলায় শুধু পরিস্থিতি। হাজার কষ্টের মাঝেও মানুষ ক্ষীণ তম আনন্দের রেশ টুকু নিয়েই মেতে উঠতে চায়, ঠিক যেমন এই মুহূর্তে নভতেজ বাবু মেতে উঠেছেন। আনন্দ খুশি উচ্ছ্বাস এই অনুভূতি গুলোর একটা অদ্ভুত সুন্দর ক্ষমতা আছে, একজনের মনের গভীর থেকে অন্যজনের মনে ছড়িয়ে পড়তে এদের বিশেষ সময় লাগে না। এক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম কিছু ঘটল না, নভতেজ বাবুর মনের নির্মল আনন্দ টুকু আলেখ আর কুহেলির মনেও ছড়িয়ে গেল। সত্যিটা তারাও জানে কিন্তু এই মুহূর্তে এই খুশির জোয়ারে গা ভাসাতে বড্ড ইচ্ছে করছে তাদেরও। তারা জানে সেই নির্মম সত্য টা আজ না হোক কাল আঘাত হানবেই তাদের জীবনে কিন্তু তার আগে যতটুকু সময় নিয়তির কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া যায় সেই সময়টুকুতে শুধুই থাকবে আনন্দ আর উচ্ছ্বাসের জোয়ার। নভতেজ বাবু ফিরে যেতে চাইছেন শুনে আলেখের থেকে বেশি খুশি আর কেউ হয়নি তবুও সব কিছুর উর্ধ্বে এখন তাঁর চিকিৎসা, তাকে অবহেলা করা কোনোমতেই সম্ভব নয়। আলেখ একটু উদ্বিগ্ন হয়ে বলল,
তোমার বাড়িতে তুমি যাবে না তো আর কে যাবে ড্যাড? কিন্তু এখন নয়, আগে তুমি পুরোপুরি সুস্থ হও তারপরে আমরা সবাই ফিরব।
নভতেজ বাবু মনে মনে একটু হাসলেন, “সুস্থ” এই শব্দটার আর তার জীবনে মনে হয়না কোনও স্থান আছে। হ্যা, ক্ষণিকের অতিথি হয়ে এই শব্দটা তার জীবনে এখন এসেছে ঠিকই কিন্তু তার সঙ্গে সে নিজের মেয়াদ টাও পূর্ব নির্ধারণ করেই এসেছে। নভতেজ বাবু ঠোঁটের কোণায় এক চিলতে হাসি এনে একটু ঠাট্টার সুরে বললেন,
ওরে, তোরা কি মনে করেছিস রে? আমি এখানে তোদের সবার অলক্ষ্যে বসে শুধু দিন গুনছি? চিকিৎসা কি আমি করাইনি নাকি রে? এখানে কি আমি হাওয়া খাচ্ছি? চিকিৎসার কোনও অভাব রাখিনি আমি, আমার কথা বিশ্বাস না হলে ডক্টর উইলিয়ামস কে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারিস।
নভতেজ বাবুর এই সহজ স্বাভাবিক সেই প্রাণখোলা আচরণটা যেন আলেখ আর কুহেলির মনের আকাশেও সেই মন খারাপি মেঘ গুলোকে আর জমতে দিচ্ছে না। আলেখ আরও কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই ঘরে সেই নার্সটি প্রবেশ করল।
স্যার, পেশেন্ট কে এখন একটু রেস্ট করতে হবে, আপনারা যদি কাইন্ডলি একটু…..
নার্সের কথা শেষ হওয়ার আগেই নভতেজ বাবু বললেন,
ডোন্ট ওয়ারি সিস্টার আই অ্যাম অ্যাবসলিউটলি ফাইন।
কিন্তু কুহেলি বলে উঠল,
সেটা তোমার থেকে ওনারা বেশি ভালো বুঝবেন, তুমি চুপচাপ এখন রেস্ট করবে। আমরা আবার পরে আসব, তোমাকে বাড়ি নিয়ে যেতে হবে তো।
শাসন করছ?
কেন করতে পারি না?
নিশ্চয়ই পারো।
তাহলে চুপচাপ এখন শুয়ে রেস্ট করো, আমরা আসছি।
আলেখ আর কুহেলির নিজেকে এখন অনেকটাই হালকা মনে হচ্ছে, এমন নয় যে তারা জানে না অদূর ভবিষ্যৎ টা এখনও সেই একই আছে। নির্মম নিষ্ঠুর নিয়তি আজ হোক বা কাল তার লিখন সত্যি করতে কেড়ে নিয়ে যাবে ওদের এই খুশি, কিন্তু তাও কেন যেন মনের জমাট কষ্ট টা আজ আর অতটা ভারী মনে হচ্ছে না। ওরা বাইরে বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গেই রাত্রি যেন ঝাঁপিয়ে পড়ল, বেচারি সত্যিই বড্ড উৎকন্ঠিত ছিল।
কি হল কুহেলি কথা হল? আঙ্কেল কেমন আছে এখন? তোমাদের দেখে কি বলল? আলেখ তুই আঙ্কেলের সামনে কাদিস নি তো? কি হল তোরা কিছু বলছিস না কেন?
প্রশ্ন গুলো আলেখ আর কুহেলিকে উদ্দেশ্য করে করা হলেও উত্তরটা এলো নিশীথের কাছ থেকে। সেও ওদের দেখে উঠে দাঁড়িয়েছিল কিন্তু কিছু বলে ওঠার আগেই রাত্রি তার প্রশ্নের বান ছোড়া শুরু করে দিয়েছে।
আপনি বলার সুযোগ দিলে তো ওনারা কিছু বলবেন।
রাত্রি একটু থামল এটা শুনে, কুহেলি একটু হেসে বলল,
চিন্তা করো না রাত্রি, আপাতত সব ঠিক আছে। পরে তোমাকে সবটা বলব কিন্তু এখন আমাদের একটু ডক্টরের সাথে কথা বলা প্রয়োজন।
ওরা চারজনেই আবার ফিরে এলো ডক্টর লুইসের কেবিনে, কিন্তু একটু অপেক্ষা করতে হল কারন উনি তখন কেবিনে ছিলেন না। ডক্টর লুইস ওনার রাউন্ড সেরে এসে ওদের কেবিনের সামনে দেখে বললেন,
আপনারা অনেকক্ষণ ওয়েট করছেন নিশ্চয়ই?
আলেখ একটু স্মিত হাসি ফুটিয়ে তুলে বলল,
এটুকু ওয়েট করা তেমন কিছু নয়, ডক্টর আমাদের আপনার সঙ্গে ড্যাড কে নিয়ে কিছু কথা ছিল।
ওহ শিওর, প্লিজ কাম ইন।
ওরা সবাই ডক্টর লুইসের কেবিনে ঢুকল, আলেখ আর নিশীথ দুজনে ডক্টর লুইসের সামনে বসল আর কুহেলিকে নিয়ে রাত্রি কেবিনের একটা পাশে রাখা একটা সোফায় বসল। কুহেলির নিজেকে কেমন যেন একটু দুর্বল মনে হচ্ছে, আসলে সকাল থেকে শুধু ঐ একটু জুস ছাড়া কিছুই তো পেটে পড়েনি তার উপর মানসিক চাপ তো আছেই। কুহেলি মুখে না বললেও রাত্রি ঠিকই বুঝতে পেরেছিল কুহেলির হয়তো কোনও সমস্যা হচ্ছে তাই ওকে আলেখের সঙ্গে না বসিয়ে নিজের সঙ্গে এখানে সোফায় বসিয়েছে। কুহেলিও আর আপত্তি করেনি, কারণ শরীরটা সত্যিই বড্ড দুর্বল লাগছে। আলেখ সরাসরি ডক্টর লুইস কে নভতেজ বাবুর বাড়ি ফেরার ইচ্ছের কথা জানিয়ে জিজ্ঞেস করল,
ডক্টর ড্যাড তো বাড়ি যেতে চাইছে কিন্তু এখন কি সেটা সম্ভব? মানে ওনার ট্রিটমেন্ট….
আলেখের কথার মাঝখানেই ডক্টর লুইস বললেন, শুধু বললেন না, বেশ অবাক হয়েই বললেন, বা বলা ভাল প্রশ্ন করলেন।
মিস্টার শর্মা বাড়ি যেতে চাইছেন? আমি তো নিজেই এই দুদিন আগেও ওনাকে বলেছিলাম আপনাদের সাথে যোগাযোগ করতে কিন্তু বারবার উনি এড়িয়ে গেছেন। ওনাকে দেখে মনে হত যেন আদৌ ওনার কোনও বাড়ি বা ফ্যামিলি কিছুই নেই, আর আজ উনি নিজে যেতে চাইছেন?
ইয়েস ডক্টর, আসলে সিচুয়েশন টাই মাঝে মাঝে এমন হয়ে পড়ে যে মানুষ কি করছে কেন করছে নিজেও ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। আচ্ছা ডক্টর আমরা কি ড্যাড কে নিয়ে যেতে পারব মানে বাকি ট্রিটমেন্ট টা কি বাড়িতে থেকে করানো সম্ভব?
ডক্টর লুইস একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন, তাদের পেশায় এই একটা ভীষন বাজে মুহূর্ত, অনিচ্ছা সত্ত্বেও নির্মম সত্যটা তাদেরকেই বলতে হয়। একটু থেমে ডক্টর লুইস বললেন,
দেখুন মিস্টার শর্মা আমি অযথা আপনাকে কোনও হোপ দিতে চাই না। ওনার যতটুকু ট্রিটমেন্ট হওয়া পসিবল ছিল সবটাই করা হয়েছে। এক মাস আগে একটা সার্জারিও করা হয়েছে যার জন্য উনি এখন ঠিকমত খেতে পারছেন না হলে আগে তো খাওয়া প্রায় বন্ধই হয়ে গিয়েছিল।
এতটুকু শুনেই যেন কুহেলির বিদ্যুতের ঝলকের মত মনে পড়ে গেল, সে নিজেও লক্ষ্য করেছিল নভতেজ বাবুর খাওয়া যেন অনেকটাই কমে গিয়েছিল কিন্তু কোনও না কোনও কারণে আর সেদিকে নজর দিতে পারেনি। নিজের ওপরে হঠাৎ খুব রাগ হতে লাগল কুহেলির, তখন যদি ভালো করে লক্ষ্য করত তাহলে হয়তো আজকের এই দিনটা আসত না। নাহ, তার ব্যাধি টা যে কমে যেত তা নয় কিন্তু এই লুকোচুরির খেলাটা তো চলত না। প্রত্যেকটা মানুষ আজ এতোটা কষ্ট হয়তো পেত না, কিন্তু এই হয়তো গুলোর আমাদের জীবনে কোনও গুরুত্ব নেই। আসলে এই হয়তোর ওপর নির্ভর করে কিছুই হয় না, শব্দটা শুধুই আমাদের নির্বোধ মনটাকে শ্বান্তনা দেওয়ার একটা ছুতো মাত্র। কুহেলির ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে ডক্টর লুইস আবার বলতে শুরু করলেন।
সার্জারির পরেও যতটা ট্রিটমেন্ট করা সম্ভব আমরা সবটাই করেছি, বাট দেয়ার ইজ এ লিমিট। আমাদের ক্ষমতারও একটা সীমা আছে, তার বাইরে আমাদেরও আর কিছু করার নেই। কেমো থেরাপি টা চলছে কিন্তু সেটার মেয়াদও সীমিত। আমি নিজেই ওনাকে বলেছিলাম এই শেষ দিন কটা নিজের ফ্যামিলির সঙ্গে কাটাতে বাট উনি তো যেন ঠিক করেই নিয়েছিলেন যে বাকি দিন গুলো ওই রুম নম্বর ওয়ান ওয়ান নাইনেই কাটিয়ে দেবেন। তবে আজ শুনে ভালো লাগছে উনি ডিসিশন চেঞ্জ করেছেন। আই নো ইটস এ ভেরি ডিফিকাল্ট সিচুয়েশন ফর ইউ অ্যান্ড ইওর ফ্যামিলি বাট দিস ইজ দ্য ট্রুথ অ্যান্ড ইউ হ্যাভ টু অ্যাকসেপ্ট ইট। ওনার হাতে আর খুব বেশি সময় নেই, বাকি যে কটা দিন আছেন একসাথে আনন্দের মধ্যে থাকুন।
আলেখ বা কুহেলি যে এটা আন্দাজ করতে পারেনি এমন নয় কিন্তু তাও এত বড় নির্মম সত্যিটা শুনে যেন বুকের ভিতরে আবার সেই অদৃশ্য রক্ত ক্ষরণ টা শুরু হয়ে গেল। ডক্টর লুইস বলে চলেছেন,
কিছু মেডিসিন আছে যেগুলো ওনার কষ্ট গুলো যতটা সম্ভব রিডিউস করার কাজ করে সেগুলো কন্টিনিউ করতে হবে। যত গুলো দিন ওনার লাইফে আরও অ্যাড করা সম্ভব সেটাই আমরা করেছি।
আলেখ নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে, মনটাকে অনেকটাই শক্ত করে নিয়েছে। এখানে আসার আগেই যেন মনের কোনও একটা কোনায় এটা শোনার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেছিল কিন্তু তারপরেও একটা অবক্ত্য যন্ত্রণায় ভিতরটা শেষ হয়ে যাচ্ছে। নিশীথ একবার আলেখের দিকে তাকিয়ে বুঝল তার পক্ষে এখন একটা শব্দও বলার চেষ্টা করা কতটা কষ্টকর। নিশীথ নিজেই একটা খুবই প্রয়োজনীয় কিন্তু নির্মম প্রশ্নটা করল, যেটা হয়তো হাজার চেষ্টা করলেও আলেখ বা কুহেলি করতে পারত না।
ডক্টর, ওনার হাতে আর ঠিক কতদিন সময় আছে?
ডক্টর লুইস একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
এটা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়, ছয় মাসও হতে পারে আবার এক বছরও হতে পারে।
নিশীথ একবার কুহেলির দিকে তাকাল, সোফায় বসে আছে একটা নির্জীব পুতুলের মত আর আলেখকে দেখে তো মনে হচ্ছে যেন কেউ ওর প্রাণশক্তি টাই কেড়ে নিয়েছে। তবুও যেন দুজনেই নিজেকে গুছিয়ে নিতে চাইছে, যেন নিজের সাথেই লড়াই করছে। নভতেজ বাবুকে ডিসচার্জ করানোর জন্য বাকি কি কি করণীয় তার সবটুকুই নিশীথ নিজেই জেনে নিল। কিছুক্ষণ পরে ওরা ফিরে এল নিশীথের ড্রীম নেষ্টে, খাওয়ার ইচ্ছে ওদের কারোরই ছিল না কিন্তু প্রত্যেকেই নিজের জন্য নয় অন্যজনের জন্য ঠিক খেয়ে নিল। কুহেলির শরীরটা এমনিতেই একটু দুর্বল মনে হচ্ছিল তার ওপর এত মানসিক চাপ যেন ওর শরীরটা আর বইতে পারছিল না। তাও কুহেলি তেমন বিশ্রাম নিতে চাইছিল না, কিন্তু আলেখের কথায় একরকম বাধ্য হয়েই শুতে হল। ক্লান্তি তো আর কারো বারন শোনে না, কুহেলির দৈহিক আর মানসিক দুটো ক্লান্তিই যেন নিমেষে ঘুম হয়ে নেমে এলো। আলেখের কিছু ভালোলাগছিল না, ঘোর অনিচ্ছা সত্বেও সে এই নিষ্ঠুর নিয়তিকে মানতে বাধ্য, তাই এখন থেকেই যেন সেই দুঃস্বপ্নের মত দিনটার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে লাগল। এরপরে কেটে গেছে আরও দুটো দিন, সব ব্যবস্থা করতে কিঞ্চিৎ সময় তো লাগেই। তবে আলেখ বা কুহেলি কে এতটুকু কোনও চিন্তার অবকাশ দেয়নি নিশীথ, ওরা দুজন শুধু দিনের বেশিরভাগ সময়টাই নভতেজ বাবুর সঙ্গে কাটিয়েছে, রাত্রিও ছিল ওদের সঙ্গে, আর বাকি সব ব্যবস্থা নিশীথ করেছে। কাল ওরা নভতেজ বাবুকে নিয়ে ফিরে যাবে ওদের ওঙ্কার ভিলায়, যেখানে নভতেজ বাবুর কথা মত ওনার অনেক কাজ বাকি। সেই ব্যবস্থাও নিশীথই করেছে, একটা প্রাইভেট প্লেনে ওরা রওনা হবে আগামীকাল। আজ আবার ডিনারের পর আলেখ আর নিশীথ বসে আছে পাশাপাশি তবে আজ আর হাতে বিয়ারের বোতল নেই। বেশ কিছুক্ষনের নীরবতার পর আলেখ বলল,
থ্যাঙ্ক ইউ নিশীথ।
নিশীথ কিছু একটা বলার জন্য সবে ঠোঁট দুটো হয়তো একটু ফাঁক করেছিল কিন্তু আলেখ তার আগেই বলে উঠল,
আমি জানি আপনি থ্যাঙ্কস শোনার জন্য এগুলো করেননি, আই নো দ্যাট কিন্তু তাও আজ আমাকে থ্যাঙ্কস বলতে দিন। আপনি এত নিঃস্বার্থ ভাবে আমাদের জন্য যতটা করেছেন হয়তো কেউই করত না। আমাদের মধ্যের সম্পর্কটাও তো ঠিক তেমন ছিল না যেখানে দাড়িয়ে এতটা করা যায়। সামান্য বিজনেস রিলেটেড রিলেশন আমাদের আর তারপরে তো….. থাক সে কথা। আজ আমার নিজের ওপর খুব রাগ হচ্ছে জানেন তো, একটা বেসলেস কারণের জন্য আপনাকে অ্যাভয়েড করার চেষ্টা করতাম। আমারই ভুল, এইরকম আরও কত ভুল করেছি কে জানে! হয়তো এই ভুল গুলোরই শাস্তি পাচ্ছি আমি।
নিশীথ এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিল কিন্তু এবার আর না বলে পারল না।
এই ভুল ধারণা গুলো লাইফটা কে অযথা কমপ্লিকেটেড করে তোলে জানেন তো। এইসব ভাবা বন্ধ করুন, কোনও ভুল করেননি আপনি, সেদিনই বলেছিলাম আপনাকে আজ আবার বলছি অন্তত আমার বিষয়ে আপনি ভুল কিছুই করেননি। কোনরকম শ্বান্তনা আমি আপনাকে দেব না কারণ আমি জানি সেগুলো নিরর্থক। যে পরিস্থিতির মধ্যে আপনি আছেন সেখানে কোনও সিম্প্যাথি বা ইমম্প্যাথি কোনোটারই জায়গা নেই। তাও বলব, কষ্ট মুছে দিতে পারবেন না কিন্তু সেগুলো কে আপাতত দূরে সরিয়ে তো রাখতে পারবেন, অন্তত আগামী কয়েকটা মাস।
নিশীথ আর বেশি কিছু বলল না, সে জানে প্রয়োজনের অতিরিক্ত কথায় কোনও লাভ হয় না। আলেখও আর কিছু বলল না, চুপচাপ উঠে গেস্ট রুমে এসে ঘুমন্ত কুহেলিকে নিজের বুকের মাঝে নিয়ে শুয়ে পড়ল। এটাই তো এখন ওর আশ্রয়, ওর অশান্ত মনটাকে শান্ত করার একটা নিবিড় প্রশান্তির ঠিকানা। আলেখ কুহেলি আর নভতেজ বাবু এখন বসে আছেন একটা ছোট্ট উড়োজাহাজের গর্ভে। এই তো, মিনিট পনের আগেই হিথরো এয়ারপোর্ট ছেড়ে বিমান টা পাড়ি জমিয়েছে সুদূর ভারতবর্ষের দিকে। নিশীথ আর রাত্রি দুজনেই আসতে চেয়েছিল কিন্তু আলেখ রাজি হয়নি। এমনিতেই ওরা দুজনেই নিজেদের সাধ্য মত অনেকটা করেছে আর তাদের কষ্ট দিতে চায় না সে। বাকি পথ টুকু তাকে আর কুহেলিকে একে অপরের হাত ধরেই পেরোতে হবে, হোক সে পথ যতই বন্ধুর।
ক্রমশ___________
© স্বত্ব সংরক্ষিত
নভতেজ বাবু ফিরছেন তার ঘরে, কিন্তু তারপর? কেমন লাগল আজকের পর্ব, জানাবেন কিন্তু, জানেনই তো প্রতীক্ষায় থাকি আমি। আজ তবে আসি দেখা হবে আগামী পর্বে ততদিন পর্যন্ত পড়তে থাকুন ভালো থাকুন।