সংগোপনে’ পর্ব-৮

0
1901

আগামীকাল আমি বেশ একটু ব্যস্ত থাকব তাই আগামীকাল যে পর্ব দেওয়ার কথা ছিল সেটা আজ রাতেই দিয়ে দিলাম।

#সংগোপনে
#ধারাবাহিক_পর্ব_৮
#অচিন_পাখি_কলমে_ভাগ্যলক্ষ্মী_দাস

আগের পর্বের পর………………

দেখতে দেখতে তিনটে মাস যেন ঝড়ের বেগে পেরিয়ে গেল, কুহেলির ব্যস্ততা এখন তুঙ্গে। অবশ্য শুধু কুহেলি নয়, অফিসের সবাই ব্যস্ত, আর একমাসের মধ্যে নতুন প্রোডাক্ট লঞ্চ হবে। ওঙ্কার গ্রুপস আর আগরওয়াল অ্যান্ড সন্স এর জয়েন্ট ভেঞ্চার এখন ইন্ডাস্ট্রির হট টপিক। সবার নজর এইদিকেই, আর প্রধান দায়িত্ব টা কুহেলির হওয়ায় ওর চাপটা সব থেকে বেশি। কোথা থেকে যে দিন গুলো পেরিয়ে যাচ্ছে টেরই পাচ্ছে না, তবে এত ব্যস্ততার মধ্যেও দেবার্ঘ্যর সঙ্গে সম্পর্কটা অনেক গভীর হয়েছে। প্রত্যেকদিন রাতে ঘুমানোর আগে একবার কথা না বললে যেন দুজনের কারোরই ঘুম আসে না, মাঝে মধ্যেই সময় পেলে ছুটির দিন গুলোতে একটু একসাথে সময় কাটানো, দুটো কথা বলা। মুখে না বললেও দুজনেই যে দুজনের মনে একটা আলাদা জায়গা তৈরি করে নিয়েছে সেটা ওরা দুজনেই জানে। কুহেলি তো মাঝেমধ্যেই অবাক হয়ে যায়, এটা ভেবে যে ওর পূর্ব পরিকল্পিত জীবন চিত্রের কোথাও তো এই প্রেম বা ভালোবাসার উল্লেখ টুকুও ছিল না, মনের দরজাটা সেই শুরু থেকেই বন্ধ করে রেখেছিল। আর আজ…. প্রেম হয়তো এমনই হয়, যখন তার আসার সময় হয় তখন সে নিজে হাতে সব বন্ধ দরজা খুলে খুঁজে নেয় নিজের পথ। ওদের ভালোবাসাটা কিন্তু শব্দে প্রকাশ করার প্রয়োজন হয় নি কখনও, অনেক সময় মনের গহীন থেকে উঠে আসা অনুচ্চারিত শব্দেরা সূক্ষ্ম অনুভূতি গুলোকে নিঃশব্দে পৌঁছে দেয় তার গন্তব্যে। কর্ম ব্যস্ততা আর সদ্য অঙ্কুরিত প্রেম নিয়ে বেশ ভালই কাটছিল দিনগুলো, তবে এরমধ্যেও একটা ব্যাপার কুহেলিকে মাঝে মধ্যেই বেশ ভাবিয়ে তোলে। গত তিনমাস ধরে রোজ দিনের কোনও একটা সময় একটা অচেনা নম্বর থেকে কুহেলির ফোনে মেসেজ আসে, না কোনও অশালীন বা অপ্রীতিকর মেসেজ নয়। খুবই সাধারণ মেসেজ, কখনও “গুডমর্নিং”, তো কখনও “গুডনাইট”, আবার কখনও “ডোন্ট ওয়ার্ক টু মাচ”, এই ধরনের সব মেসেজ। যেদিন থেকে এই মেসেজ গুলো আসা শুরু হয়েছে তারপর থেকে একদিনও এমন যায়নি যেদিন মেসেজ আসেনি, ঠিক একটাই মেসেজ, তার বেশি নয়। আর কোনও নির্দিষ্ট সময় নেই, এক এক দিন এক এক সময় আসে, যেন খুব সন্তর্পনে কেউ নিজের অস্তিত্ব টুকু জানান দিয়ে যায়। কুহেলি প্রথমে ব্যাপারটাকে অতটা গুরুত্ব দেয়নি, কিন্তু যখন ব্যাপারটা নিয়মিত হয়ে দাড়াল তখন একটু অস্বস্তিতে পড়ল। ট্রু কলারে কোনও ইনফরমেশন পাওয়া যায়নি, প্রাইভেট নম্বর। প্রথমে ব্যাপারটা দেবার্ঘ্যকে জানায়নি, পরে অবশ্য জানিয়েছিল, কিন্তু সেও কোনও কিনারা করতে পারেনি। আর সেটা হওয়াই স্বাভাবিক, যে প্রাইভেট নম্বর ব্যবহার করে, সে নিশ্চয়ই কোনও সাধারণ ব্যক্তি নয়, তার পরিচয় এত সহজে যে জানা যাবে না সেটা বলাই বাহুল্য। দেবার্ঘ্য অবশ্য বলেছিল একটা পুলিশ কমপ্লেন করতে কিন্তু কুহেলি রাজি হয়নি, শুধু শুধু ঝামেলা বাড়াতে চায়নি। মাঝে বার দুয়েক মেসেজের রিপ্লাই দিয়ে জানার চেষ্টা করেছে ব্যক্তিটি কে, কিন্তু প্রতিউত্তর পায়নি, এমনকি কয়েকবার ফোন করার চেষ্টা করে দেখেছে কিন্তু যতবারই কল করেছে ততবারই একই যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়েছে,
“দ্য নম্বর ইউ হ্যাভ ডায়াল্ড, ইজ নট রিচেবল অ্যাট দ্য মোমেন্ট”
শেষে চেষ্টা করাটাই বন্ধ করে দিয়েছে। বিশেষ পাত্তা দেয়না এখন ওদিকে, একটা মেসেজই তো, আসছে আসুক, কোনও ক্ষতি তো করছে না। কিন্তু সম্প্রতি কুহেলি অন্য একটা বিষয় নিয়ে একটু চিন্তায় আছে। শৈলজা দেবীর শরীরটা কদিন ধরে খুব একটা ভালো যাচ্ছে না, চৈতালী দেবী ওকে কিছু না বললেও ভিডিও কলে দেখেই কুহেলি বুঝতে পেরেছিল। পরে আলাদা করে জিজ্ঞেস করতেই চৈতালী দেবী বলেছিলেন ইদানিং একটু ভুগছেন শৈলজা দেবী, তবে সঙ্গে এও বলেছেন যে চিন্তার তেমন কোনও কারণ নেই। কুহেলি বোঝে, ওর যাতে চিন্তা না হয় সেকারণে চৈতালী দেবী সবটা ওকে খুলে বলেন না। কিন্তু কুহেলিরও জানার রাস্তা আছে, মান্তু দি, মানে শৈলজা দেবীর সর্বক্ষণের আয়া, ওকে ফোন করে বলে রেখেছে তেমন কিছু হলেই ওকে খবর দিতে। আজ সকাল থেকেই কাজে কেন যেন মন বসছে না, এরকম আগে কখনও হয়নি, নিজের কাজ নিয়ে কুহেলি অত্যন্ত সাবধানী। কাজের ক্ষেত্রে কোনরকম গাফিলতি ও পছন্দ করে না, কিন্তু আজ অনেক চেষ্টা করেও কিছুতেই কাজে মন দিতে পারছে না। একসময় নিজের উপরেই রাগ হয়ে গেল, কত কাজ পড়ে রয়েছে অথচ সেদিকে কিছুতেই মন দিতে পারছে না। উঠে গিয়ে ওয়াশরুম থেকে চোখে মুখে একটু জল দিয়ে এল, কিন্তু তাতে কোনও কাজ হল না, কোথাও যেন কিছু একটা গন্ডগোল হচ্ছে, কিছু যেন একটা ঠিক নেই। নিজের চেয়ারটায় বসতেই পাশ থেকে রুহি বলল,

দি তোমার ফোন বাজছিল।

কুহেলি ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল, মান্তু দির মিসড কল। সঙ্গে সঙ্গে মনটা কেমন খচ করে উঠল, দ্রুত হাতে কলব্যাক করল। প্রথম বার ফুল রিং হয়ে গেলেও কেউ রিসিভ করল না, মনের মধ্যের অস্বস্তি টা বাড়তে লাগল, দ্বিতীয় বার কয়েকবার রিং হওয়ার পরেই কলটা রিসিভ হল। কুহেলি ব্যস্ত হয়ে প্রশ্ন করল,

মান্তু দি, ঠাম্মু ঠিক আছে তো?

উত্তর যেটা এল তাতে কুহেলির কথা বন্ধ হয়ে গেল, ফোনের অপর প্রান্ত থেকে আরও অনেক কথা ভেসে আসছে কিন্তু তার কোনোটাই ওর কানে ঢুকল না। কিছুক্ষণ শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল, চোখের কোল দুটো কেমন যেন ভিজে ভিজে ঠেকছে, রুহি ব্যাপারটা লক্ষ্য করে ঘাবড়ে গেল, কুহেলির কাছে এসে ওর কাধ দুটো ধরে বলল,

দি, কি হল? তুমি এরকম করছ কেন? কার ফোন ছিল? সব ঠিক আছে তো? দি? দি?

কুহেলি যেন কিছুই শুনতে পায়নি, হঠাৎ রুহির হাত দুটো ছাড়িয়ে সোজা ছুটে গেল আলেখের কেবিনের দিকে। ওকে এইভাবে ছুটে যেতে দেখে অফিসের বাকিরাও চমকে গেল, আজ পর্যন্ত কেউ কোনদিনও কুহেলিকে এইরকম আচরণ করতে দেখেনি। কুহেলি সটান কোনরকম নক না করেই আলেখের কেবিনে ঢুকে পড়ল, আলেখ অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে একটা ফাইল দেখছিল, কুহেলিকে আচমকা এইভাবে নক না করেই কেবিনে ঢুকতে দেখে অবাক হয়ে গেল। তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে কুহেলির কাছ থেকে এহেন আচরণ সে কস্মিনকালেও আশা করেনি। কিন্তু সেটা ক্ষণিকের জন্য, কারণ কুহেলির চেহারায় উদ্বিগ্নতার ছাপ সুস্পষ্ট। আলেখ ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল,

মিস বাসু, আর ইউ অলরাইট? আপনাকে এরকম দেখাচ্ছে কেন?

কুহেলি এই কথার কোনো জবাব দিল না, সোজা বলল,

আমাকে এক্ষুনি বাড়ি যেতে হবে স্যার, প্লিজ।

আলেখ বুঝতে পারল খুব গুরুতর কিছু একটা ঘটেছে, সে কুহেলিকে একটু শান্ত করার চেষ্টা করে বলল,

আপনি আগে বসুন, তারপর বলুন কি হয়েছে। হঠাৎ বাড়ি যেতে হবে কেন?

বসার টাইম নেই স্যার, প্লিজ আই রিকোয়েস্ট ইউ। আমি জানি এইমুহুর্তে ছুটি চাওয়া যায় না, ইটস নট রাইট বাট স্যার আমার কিছু করার নেই, আমাকে যেতেই হবে।

মিস বাসু প্লিজ আপনি আগে একটু শান্ত হোন, আমাকে একটু খুলে বলুন কি হয়েছে। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

আমার ঠাম্মু, মানে আমার গ্র্যান্ড মাদার, ওনার, ওনার….

কুহেলির কথা আটকে গেল, চোখের জল গুলো যেন আর ধরে রাখতে পারছে না, অনেক কষ্টে কথাটা শেষ করল।

ওনার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে, আই হ্যাভ টু গো স্যার, প্লিজ।

মিস বাসু, আই ক্যান আন্ডারস্ট্যান্ড। আপনি নিশ্চয়ই যাবেন, কিন্তু আগে নিজেকে একটু শান্ত করুন, নাহলে এভাবে এতোটা রাস্তা যাবেন কীকরে?

কুহেলি নিজেকে একটু শান্ত করার চেষ্টা করল, আলেখকে ধন্যবাদ জানিয়ে চলে আসছিল কিন্তু আলেখ পিছন থেকে ডাকল।

মিস বাসু, আপনি এখন বেরোলে কিন্তু খুব একটা লাভ হবে না, কলকাতার নেক্সট ফ্লাইট বিকেলের আগে নেই।

কথাটা শুনে কুহেলি ছট্ফট্ করে উঠল, একমুহুর্তও অপেক্ষা করার মত ক্ষমতা ওর নেই। বিকেল হতে এখনও প্রায় ঘণ্টা তিনেক, বড্ড অসহায় লাগছে নিজেকে। আলেখ কুহেলিকে একটা চেয়ারে বসিয়ে একগ্লাস জল দিয়ে বলল,

আগে জলটা খান, অকারণ প্যানিক করবেন না। আমি আপনার অবস্থাটা বুঝতে পারছি কিন্তু বিকেল পর্যন্ত আপনাকে অপেক্ষা করতেই হবে। আমার মতে আপনি এখন আপনার ফ্ল্যাটে চলে যান, যদি কিছু লাগেজ নেওয়ার প্রয়োজন হয় সেটা গুছিয়ে নিন। আমি অঙ্কিত কে বলছি আপনার টিকিট বুক করে দিতে।

কুহেলি একটু শান্ত হয়েছে, আলেখের কথা শুনে ব্যস্ত হয়ে বলল,

না স্যার, আমার কিছু নেওয়ার প্রয়োজন নেই। আর আমি টিকিট বুক করে নিচ্ছি, আপনি আমাকে যাওয়ার পারমিশন দিয়েছেন এটাই অনেক। থ্যাঙ্ক ইউ স্যার।

মিস বাসু, এখন এই ফর্মালিটি গুলোর কোনও প্রয়োজন নেই, আপনি ফ্ল্যাটে না যেতে চাইলে ইটস ওকে। আপনি নিজের ডেস্কে বসে রেস্ট করুন, আর হ্যা টিকিটের চিন্তা আপনাকে করতে হবে না, আমি অঙ্কিত কে বলে দিচ্ছি।

কুহেলি একটু আপত্তি করতে যাচ্ছিল কিন্তু আলেখ ওকে থামিয়ে দিল। কুহেলি আর কিছু না বলে নিজের ডেস্কে এসে বসল, চারিদিকে সবাই একটা কৌতূহলী দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। রুহি আবার ওর কাছে এসে জিজ্ঞেস করল,

দি, কি হয়েছে?

কুহেলি সবটা রুহিকে বলল, রুহি শুনে বলল,

তুমি যাও দি, এদিকের চিন্তা করতে হবে না, আমি যতটা পারব ম্যানেজ করে নেব।

কুহেলি কিছু বলল না, ওর এখন কথা বলতে ভালো লাগছে না। শুধু মনে হচ্ছে ঘড়ির কাটা গুলো এত ধীরে কেন চলছে। ওদিকে কি হচ্ছে কে জানে! মান্তু দিকে আরো একবার ফোন করল, কিন্তু বিশেষ কিছু জানতে পারল না। চৈতালী দেবী শৈলজা দেবীকে নিয়ে নার্সিংহোমে চলে গেছেন, মান্তু দি বাড়িতেই আছে তাই বাকি খবর সে জানে না। চৈতালী দেবীকে ফোন করার চেষ্টা করেছে কিন্তু কল কানেক্ট হচ্ছে না, কুহেলির অসম্ভব চিন্তা হচ্ছে। রুহি সেই থেকে কুহেলির সঙ্গেই বসে আছে, কিন্তু কুহেলি কথা বলছে না, দুহাত দিয়ে মুখটা ঢেকে টেবিলে কনুই ভর করে বসে আছে। কিছুক্ষণ পর অঙ্কিত এসে কুহেলিকে বলল,

কুহেলি, তোমার টিকিট টা আমি মেল করে দিয়েছি। সাড়ে তিনটেয় ফ্লাইট, আর হ্যা, স্যার তোমাকে একটু ডাকছেন।

কুহেলি উঠে আলেখের কেবিনের সামনে এসে নক করল, ভিতর থেকে আলেখ কাম ইন বললে কুহেলি কেবিনে ঢুকল।

আমায় ডেকেছিলেন স্যার?

হ্যা, বসুন।

কুহেলি বসার পরে আলেখ বলতে শুরু করল,

টিকিটটা পেয়েছেন?

হ্যা স্যার।

গুড, আমি অঙ্কিত কে বলে দিয়েছি ও আপনাকে এয়ারপোর্ট পৌঁছে দিয়ে আসবে।

কুহেলি ব্যস্ত হয়ে বলল,

ইটস ওকে স্যার, তার কোনও দরকার নেই, আমি ক্যাব বুক করে নেব।

সব কথায় আপত্তি না জানালেই নয় মিস বাসু?

আলেখের মুখে ওর সেই সবসময় লেগে থাকা হাসিটা এখন আর নেই, কেমন যেন থমথমে হয়ে আছে মুখটা। কুহেলি আর কিছু বলার সাহস পেল না, আলেখ আবার বলল,

আপনি আগে বাড়ি যান, দেখুন পরিস্থিতি কেমন, আর হ্যা, ফেরার জন্য তাড়াহুড়ো করার কোনও দরকার নেই। যখন আপনার মনে হবে সব ঠিক আছে তখন ফিরবেন।

কুহেলি যত দেখছে ততই অবাক হয়ে যাচ্ছে। এরকম একজন বস পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার, ওর অনেক বন্ধুদের কাছ থেকে শুনেছে তাদের বসেদের কথা, কতরকম হ্যারাসমেন্ট ফেস করতে হয় ওদের কিন্তু কুহেলি এদিক দিয়ে সত্যিই খুব ভাগ্যবতী। সেই শুরুর দিন থেকে আলেখের কাছ থেকে সহযোগিতাই পেয়ে এসেছে। আরো দুচারটে কথা বলার পর কুহেলি বেরিয়ে এল, লাঞ্চ ব্রেক হয়ে গেছে, কুহেলির একেবারেই খেতে ইচ্ছে করছিল না কিন্তু রুহির জোরাজুরিতে অল্প একটু খেতে হল। আড়াইটে নাগাদ অঙ্কিত এসে বলল,

চল কুহেলি, রাস্তায় জ্যামে পড়লে দেরী হয়ে যাবে।

কুহেলি বেরোনোর আগে একবার আলেখের সঙ্গে দেখা করে এল, রুহিকে যতটা সম্ভব বুঝিয়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়ল। অঙ্কিতের বাইক আছে কাজেই খুব একটা অসুবিধা হল না, আধঘন্টার মধ্যে ওরা এয়ারপোর্ট পৌঁছে গেল। অঙ্কিত কে ধন্যবাদ দিয়ে কুহেলি এগিয়ে গেল, ফ্লাইট বোর্ড করার পর নির্দিষ্ট সিটে বসে হঠাৎ কুহেলির দেবার্ঘ্যর কথা মনে হল, ওকে জানানো হয়নি, অবশ্য এখনও ফোন করে লাভ নেই, আজকে একটা মিটিং আছে ওর কখন শেষ হবে ঠিক নেই। কুহেলি একটা মেসেজ পাঠিয়ে ফোনটা ফ্লাইট মোডে করে দিল, কিছুক্ষণ পর ফ্লাইট টেক অফ্ করল। মাত্র আড়াই ঘণ্টার পথ কিন্তু কুহেলির কাছে যেন এক একটা মিনিট এক একটা ঘণ্টার সমান। ফ্লাইট যত কলকাতার দিকে এগোচ্ছে তত যেন অধৈর্য্য হয়ে উঠছে, ঠিক সময় মত ফ্লাইট ল্যান্ড করল দমদম এয়ারপোর্টে। একটা ট্যাক্সি নিয়ে সোজা রওনা হল এস.জি নার্সিংহোমের উদ্দেশ্যে, সাধারণত মিনিট চল্লিশেক লাগে কিন্তু সন্ধ্যেবেলা কলকাতার জ্যামে পাক্কা এক ঘন্টা লেগে গেল পৌঁছাতে। ভিজিটিং আওয়ার শেষ হয়ে গেছে কিন্তু তাতে কোনও অসুবিধা নেই নার্সিংহোমের সবাই ওকে মোটামুটি চেনে, ছোট থেকেই অনেকবার মায়ের সাথে এসেছে, রিসেপশনিস্ট অঞ্জনা কুহেলিকে দেখেই বলে উঠলেন,

আরে কুহেলি তুমি? তুমি তো ব্যাঙ্গালোরে ছিলে না?

হ্যা, খবর পেয়ে এসেছি, ঠাম্মু কোথায় গো আন্টি?

রুম নম্বর ১০৯ এ, লিফটে উঠে সোজা চারতলায় চলে যাও, ডানদিকের পাঁচ নম্বর রুম।

থ্যাঙ্ক ইউ আন্টি।

বলে কুহেলি এক মিনিটও দেরী না করে লিফটে উঠে পড়ল, রুম নম্বর ১০৯ খুঁজে পেতে কোনও অসুবিধা হল না। রুমে ঢুকে দেখল শৈলজা দেবী শুয়ে আছেন, ঘুমিয়ে আছেন না অজ্ঞান হয়ে আছেন দেখে বোঝা যাচ্ছে না, বেডের একপাশে টুলের উপর চৈতালী দেবী বসে আছেন। কুহেলিকে দেখেই উঠে দাড়িয়ে অবাক হয়ে বললেন,

কুহু, তুই এখানে!! তুই জানলি কীকরে?

কুহেলি কোনও উত্তর দিল না, ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে শৈলজা দেবীর কাছে গিয়ে বসল, সেই ছোট্ট থেকে ওর সবথেকে কাছের মানুষ ওর ঠাম্মু। এতক্ষণের বহু চেষ্টার বাঁধ ভেঙে গেল, দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল নোনা জলগুলো। চৈতালী দেবী জানেন কুহু ওর ঠাম্মুকে কতটা ভালোবাসে, মেয়েটা একদম ভেঙে পড়ে, এইজন্যই ওকে কিছু জানাননি কিন্তু তাও কিভাবে যে জেনে গেল সেটা বুঝতে পারলেন না। এগিয়ে এসে কুহুর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,

চিন্তা করিস না, সব ঠিক আছে, একটা মাইনর হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল। এখন ঘুমোচ্ছে, ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে তো।

কুহেলির চোখের জল তবু থামছে না। শৈলজা দেবীর একটা হাতের উপর হাত রেখে একভাবে তাকিয়ে আছে ওনার ঘুমন্ত মুখের দিকে। চৈতালী দেবী বললেন,

তোর ঠাম্মু ঠিক আছে কুহু, কিন্তু তুই যদি এমন করিস তাহলে কীকরে চলবে বলতো?

কুহেলি উঠে চৈতালী দেবীর দিকে ঘুরে বলল,

তুমি আমাকে কেন জানাওনি?

চৈতালী দেবী কূহেলির চোখের জল মুছিয়ে দিতে দিতে বললেন,

এই কারণে, আমি জানতাম তুই জানতে পারলেই কোনোকিছু না ভেবেই এখানে চলে আসবি।

সেটা কি ভুল? তুমি তো জানো আমি তোমাদের দুজনকে কতটা….

কুহেলির কথা শেষ হল না তার আগেই ডক্টর সিংহরায় চেকআপে এলেন। ইনি এই শহরের নামকরা হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ, কুহেলি এনাকেও চেনে, ওনাকে দেখেই জিজ্ঞেস করল,

আঙ্কেল আমার ঠাম্মু কেমন আছেন?

ডক্টর সিংহরায় অত্যন্ত প্রবীণ চিকিৎসক, সেই ছোট্ট থেকে কুহু কে দেখছেন। হেসে বললেন,

তোমার ঠাম্মু একদম ঠিক আছেন, তবে এখন থেকে একটু বেশি খেয়াল রাখতে হবে। এটা মাইনর অ্যাটাক ছিল তাই তেমন সমস্যা হয়নি, তোমার মাকে সব বলে দিয়েছি, ডোন্ট ওয়ারি। কিন্তু তোমার একি অবস্থা!

কুহেলির অবস্থা সত্যিই উদভ্রান্তের মত, চোখ মুখ কেমন যেন বসে গেছে। ডক্টর সিংহরায় শৈলজা দেবীকে চেক করে নার্সকে কিছু ইনস্ট্রাকশন দিয়ে চলে গেলেন। চৈতালী দেবী এবার কুহেলিকে বললেন,

শুনলি তো, তোর ঠাম্মু একদম ঠিক আছে, এবার তুই বাড়ি যা।

না, আমি এখানেই থাকব।

কুহু, কি ছেলেমানুষী করছিস? আজকে মার ঘুম ভাঙ্গবে না, সেভাবেই ওনাকে ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে। তুই শুধু শুধু এখানে বসে কি করবি বল তো?

কিছু না, এমনি বসে থাকব।

কুহু, তুই এরকম অবুঝের মত কথা কেন বলছিস? আমি তো আছি এখানে, তুই বাড়ি গিয়ে আগে ফ্রেশ হবি, কি অবস্থা করেছিস দেখেছিস? এইভাবে মা তোকে দেখলে নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে না। আর অসুবিধা হলে ফোন তো আছেই।

তোমার ফোনে কিছুতেই কল কানেক্ট হচ্ছে না, কতবার ট্রাই করেছি।

চৈতালী দেবী নিজের ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলেন ফোনটা কখন যেন বন্ধ হয়ে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে ফোনটা অন করে বললেন,

খেয়াল করিনি, কখন যে অফ্ হয়ে গিয়েছিল, আসলে এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম মাকে নিয়ে। এখন অন করেছি, আর অসুবিধা হবে না, তুই বাড়ি যা, কিছু খেয়েছিস?

ওই একটু।

জানি তো, এখন যা বাড়িতে, মান্তুকে বলবি খেতে দিয়ে দেবে।

কুহেলির এবার মনে হল চৈতালী দেবীও নির্ঘাৎ কিছু খাননি।

তুমিও তো খাওনি নিশ্চয়ই।

চৈতালী দেবী একটু হেসে বললেন,

না, এখনও খাইনি, তবে এবার খাব, তোকে অত চিন্তা করতে হবে না। আমি বিকাশকে বলে দিচ্ছি, তুই গাড়িটা নিয়ে চলে যা, আমি তো আজকে আর ফিরব না।

কুহেলি আরেকবার শৈলজা দেবীর কাছে গিয়ে ওনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বেরিয়ে এল। চৈতালী দেবীও সঙ্গে এলেন, কুহু কে গাড়িতে তুলে দিয়ে আবার ফিরে গেলেন। কুহেলির বড্ড ক্লান্ত লাগছে আজকে, গাড়িতে উঠে গা টা এলিয়ে দিল। শারীরিক ক্লান্তির থেকেও মানসিক ক্লান্তিটা অনেক বেশি, বাড়ি পৌঁছাতে খুব একটা দেরী হওয়ার কথা নয় কিন্তু কলকাতার জ্যামে পড়লে যে কতটা দেরী হবে কেউ বলতে পারেনা। যখন বাড়ি পৌঁছাল তখন রাত নটা, বাড়িতে ঢুকেই সোজা দোতলায় নিজের ঘরে ঢুকে আগে স্নান করে চেঞ্জ করে নিল। এখন অনেকটা ফ্রেশ লাগছে, মান্তু দি ওর খাবার নিয়ে এসে বলল,

এটা গরম গরম খেয়ে নাও, ঠাকুমা কেমন আছে গো?

ভালো আছে, কিন্তু এখন থেকে আরো বেশি খেয়াল রাখতে হবে।

সে তুমি চিন্তা করোনা, আমি ঠিক খেয়াল রাখব। তুমি খেয়ে নাও, আমি যাই দেখি রাতের রান্না দেখি, তুমি কি খাবে রাতে?

এখন তো সাড়ে নটা বাজে আবার রাতে আলাদা করে কি খাব! আর মাও আজকে ফিরবে না, তুমিও বরং খেয়ে নাও।

মান্তু চলে গেলে কুহেলি খাওয়া শেষ করে হাত ধুয়ে বিছানায় গা টা এলিয়ে দিল। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল সেটা এখনও ফ্লাইট মোডেই রয়েছে, ফ্লাইট থেকে নামার পরে আর খেয়াল ছিল না। নরমাল মোড অন করতেই একসাথে অনেকগুলো মেসেজ এল, প্রথম মেসেজটাই আলেখের, মেসেজটা ওপেন করে দেখল,

“আপনার গ্র্যান্ড মাদার এখন কেমন আছেন?”

খুবই সাধারণ ছোট্ট একটা মেসেজ কিন্তু এতেই কুহেলি অবাক হয়ে গেল, সকাল থেকে অনেক কিছু করেছেন ওর জন্য, আবার এখন মনে করে ওকে মেসেজ করে ওর ঠাম্মুর খবর নিচ্ছেন! একবার ভাবল মেসেজ করবে কিন্তু আবার মনে হল উনি এতোটা করেছেন সেখানে শুধু মেসেজ করাটা বোধহয় ঠিক হবে না। কনট্যাক্ট লিস্ট থেকে আলেখের নম্বরটা খুঁজে নিয়ে কল করতে গিয়েও থেমে গেল, রাত দশটা বাজে, এখন ফোন করাটা ঠিক হবে কিনা ভাবতে ভাবতে শেষে ফোনটা করেই ফেলল। কিছুক্ষণ রিং হওয়ার পরেই ওপাশে আলেখের কণ্ঠস্বর শোনা গেল,

বলুন মিস বাসু, সব ঠিক আছে তো? আপনার গ্র্যান্ড মাদার কেমন আছেন?

ভালো আছেন, ডক্টর বলেছেন চিন্তার কিছু নেই, মাইনর অ্যাটাক ছিল।

দ্যাটস গুড।

আজকের জন্য থ্যাঙ্ক ইউ স্যার, আপনি এভাবে এককথায় আমাকে ছুটি দিয়ে দিলেন। আমি খুব বেশি দেরি করব না, ঠাম্মু কে ডিসচার্জ করলেই আমি ফিরে আসব।

মিস বাসু, আমি কি আপনাকে কিছু বলেছি? কাজ টা অবশ্যই ইম্পর্ট্যান্ট, কিন্তু ফ্যামিলির থেকে বেশি নয়। আপনজনকে হারানোর কষ্ট আমি বুঝি, অ্যান্ড আই অ্যাম গ্ল্যাড আপনাকে সেই কষ্টটা পেতে হয়নি।

আলেখের গলায় কষ্টের ছাপটা কুহেলির বুঝতে অসুবিধা হল না, নিজের মায়ের অভাবটা আলেখকে আজও কষ্ট দেয়। কুহেলি প্রসঙ্গ পাল্টে বলল,

স্যার আমি রুহিকে যতটা সম্ভব বুঝিয়ে দিয়ে এসেছি, কিন্তু ও হয়তো সবটা ম্যানেজ করতে পারবে না।

মিস বাসু, আপনাকে বললাম তো এদিকের টেনশন করতে হবে না, আমি দেখে নেব। আপনি আপনার গ্র্যান্ড মাদারের খেয়াল রাখুন, আর নিজেরও, লাঞ্চ ডিনার কোনোটাই কিন্তু স্কিপ করবেন না।

আলেখের কথায় কুহেলি হেসে ফেলল, ওপাশে আলেখও হাসছে। কুহেলি বলল,

আমি এইমাত্র ডিনার করেছি স্যার, চিন্তা করবেন না। গুড নাইট।

গুড নাইট।

ফোনটা রেখে কুহেলির মনে হল আলেখ শর্মা মানুষ টা কত সহজ, কোনদিনও সেই তথাকথিত বস সুলভ আচরণ করতেই দেখেনি। এবার অন্য মেসেজটার দিকে চোখ গেল, সেই অচেনা নাম্বার টা থেকে এসেছে, কিছুটা বিরক্ত হয়েই মেসেজটা ওপেন করল। কিন্তু মেসেজটা পড়ে বিরক্তির বদলে একরাশ বিস্ময় এসে ভিড় করল, ছোট্ট একটা লাইনের মেসেজ,

“ডোন্ট ওয়ারি, এভরিথিং উইল বি ফাইন।“

মানে এই ব্যক্তিটি ওর প্রতিটা মুহুর্তের খবর রাখে, আজ যা হয়েছে সেটাও জানে। কুহেলি আপন মনেই ভাবতে লাগল,

কে হতে পারে? আমার চেনা কেউ? নাহলে কীকরে জানবে? কিন্তু আমার চেনা কে এমন করবে?

অনেক ভেবেও কুহেলির মাথায় ওর চেনা এমন কারোর নাম এল না যে এমনটা করতে পারে। শেষে বিরক্ত হয়ে প্রতিদিনের মত এই মেসেজটাও ডিলিট করে দিল। বাকি মেসেজটা দেবার্ঘ্যর, না ঠিক দেবার্ঘ্যর মেসেজ নয়, দেবার্ঘ্য যে ওকে ফোন করেছিল তার মেসেজ এটা। নম্বরটা ডায়াল করার একটু পরেই দেবার্ঘ্য কল রিসিভ করল, আর সঙ্গে সঙ্গেই প্রশ্নের বন্যা বইয়ে দিল।

কি ব্যাপার? তোমার ফোন এতক্ষণ অফ্ কেন? সেই কখন থেকে ট্রাই করছি। কি খবর ওদিকের? দি বা চিরু দাকে কল করে যে খবর নেব তারও উপায় নেই, ওরা তো দুদিন হল ঘুরতে গেছে। কি হল? কথা বলছ না কেন? কুহু?

তুমি আমাকে কিছু বলার সুযোগ দিলে তবে তো বলব।

এইখানে বলে রাখি, দেবার্ঘ্য এখন কুহেলিকে কুহু বলে ডাকে আর দেবার্ঘ্যর অনেক চেষ্টার পর কুহেলি আপনি থেকে তুমিতে এসেছে। দেবার্ঘ্য একটু থেমে বলল,

সরি, আসলে এতক্ষণ ফোনে পাচ্ছিলাম না তো, তোমার মায়ের ফোনটাও তো নট রিচেবল বলছিল। তাই আর কি…

চিন্তা করো না, সব ঠিক আছে। ঠাম্মু এখন ঠিক আছে, ঘুমাচ্ছে। আমি বাড়ি এসেছি, কাল সকালে আবার যাব।

ওহ, ভালো। তুমি কিছু খেয়েছ তো?

হ্যা, এইতো একটু আগেই খেয়েছি।

তাহলে আর জেগে থেকো না, ঘুমিয়ে পড়, অনেকটা ধকল গেল তো।

হুম, তুমিও বেশি রাত করো না।

হুম, এইতো এবার ডিনার টা সেরেই শুয়ে পড়ব।

তুমি এখনও খাওনি?

না।

কেন?

তোমার ফোনের অপেক্ষা করছিলাম।

এটা শুনে কুহেলির হঠাৎ মনটা ভালো হয়ে গেল। একটু হেসে বলল,

হুম, এখন তো কথা হল, এদিকের খবরও পেয়েছ, এবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়, আমিও এবার শোব।

হুম, গুড নাইট।

গুড নাইট।

ফোনটা রেখে কুহেলি পাশের টেবিলে জ্বলতে থাকা নাইট ল্যাম্পটা অফ্ করে দিল। ঘুমানোর সময় ওর এতটুকু আলো পছন্দ নয়, পুরো ঘর অন্ধকার না হলে ওর ঘুমই আসেনা। পরদিন বেশ সকালেই ঘুমটা ভেঙে গেল, উঠে ফ্রেশ হয়ে আগে চৈতালী দেবীকে ফোন করল। শৈলজা দেবী ঘুম থেকে উঠেছেন শুনেই কুহেলি তড়িঘড়ি রেডি হয়ে নার্সিংহোমে পৌঁছে গেল, শৈলজা দেবীকে হেলান দিয়ে বসে থাকতে দেখে কুহেলি একদৌড়ে গিয়ে ওনাকে জড়িয়ে ধরল। চৈতালী দেবী বলে উঠলেন,

আরে, সাবধানে কুহু।

শৈলজা দেবী হেসে কুহেলির মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,

দেখি একটু আমার কুহুর মুখটা দেখি, তাহলেই একদম ফিট হয়ে যাব।

কুহেলি ওনাকে ছেড়ে সোজা হয়ে বসে বলল,

তুমি কি বলত? আমি কতটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম জানো? এবার থেকে কিন্তু মা যা বলবে তাই শুনবে, একদম নিজের মত চলবে না। আর তোমাকে যে ফোনটা দিয়েছি ওটা সবসময় কাছে রাখবে।

আচ্ছা বাবা, ঠিক আছে, একটু থাম তো দেখি, বড্ড কথা বলতে শিখেছিস। দেখেছ চৈতালী সেদিনের মেয়ে আজকে আমাকে চোখ রাঙাচ্ছে।

বেশ করেছি, নিজের খেয়াল না রাখলে আরও বলব।

ওদের কথার মধ্যেই ডক্টর সিংহরায় এসে পড়লেন, শৈলজা দেবীকে চেক করে বললেন,

সব ঠিক আছে, আপনি কালকেই বাড়ি ফিরতে পারবেন।

এটা শুনে কুহেলি খুব খুশি হল, ডক্টর চলে গেলে ওরা তিনজনে আরো কিছুক্ষন বসে গল্প করল। কুহেলি গোটা দিনটা নারসিংহোমেই কাটিয়ে দিল, মাঝে চৈতালী দেবীকে জোর করে একবার বাড়ি পাঠিয়ে ছিল, কতক্ষন যে ঠিকমত একটু বিশ্রাম করেননি তার ঠিক নেই। রাতটা আবার বাড়ি ফিরে এসে অভ্যাস মত দেবার্ঘ্যর সাথে একটু কথা বলে শুতে যাওয়ার আগে দেখল সেই নম্বরটা থেকে আবার একটা মেসেজ,

“আই হ্যাভ টোল্ড ইউ, সি, এভরিথিং ইজ ফাইন নাও।“

কুহেলি এবার চিন্তিত হল, কে এই ব্যক্তি? ওর ঠাম্মুর সুস্থ হওয়ার খবরটা পর্যন্ত জানে। কোনও লাভ নেই জেনেও একবার কল করল নাম্বারটায়, প্রত্যাশিত ভাবেই কলটা কানেক্ট হল না। একটা মেসেজ সেন্ড করল কুহেলি,

“আপনি কে সেটা আমি জানি না। কিন্তু আপনি যেটা করছেন সেটা কিন্তু অন্যায়, আপনি হয়তো জানেন না এটাকে স্টক করা বলে। আমি চাইলেই পুলিশ কমপ্লেন করতে পারি, এতদিন করিনি এটা ভেবে যে কিছুদিনের মধ্যে হয়তো বন্ধ হয়ে যাবে, কিন্তু এখন দেখছি এছাড়া আর কোনও উপায় নেই। হয় আপনার পরিচয় দিন নাহলে এইভাবে মেসেজ করা বন্ধ করুন, নাহলে আমি পুলিশে কমপ্লেন করতে বাধ্য হব।“

সবটুকু রাগ মেসেজে উগরে দিয়ে ফোনটা ছুড়ে দিল বিছানায়, তারপর লাইট অফ করে শুয়ে পড়ল, চোখটা হালকা লেগে এসেছিল কিন্তু একটু পরেই মেসেজের টুং টাঙ শব্দে আবার জেগে গেল, রাত নেহাৎ মন্দ হয়নি, এত রাতে কে আবার মেসেজ করল দেখার জন্য ফোনটা হাতে নিয়েই আরেক দফা অবাক হল। অত্যন্ত অপ্রত্যাশিত ভাবে সেই নম্বর থেকে মেসেজের রিপ্লাই এসেছে, এতদিন ইংলিশে আসত আজ হিন্দিতে এসেছে,

“এরমধ্যে পুলিশ কি করবে? আমি কি করছি সেটা আমি খুব ভালো করেই জানি। আমার মনে হয় না আমি আপনাকে এমন কোনও কথা বলেছি যেটা আমার বলা উচিত নয়, তবুও যদি আপনি পুলিশে যেতে চান, অবশ্যই যেতে পারেন। তবে খুব একটা লাভ হবে বলে মনে হয় না, আর হ্যা, আমার পরিচয় আপনি খুব তাড়াতাড়ি পাবেন। গুড নাইট।“

মেসেজ টা পড়ে কুহেলি সঙ্গে সঙ্গে কলব্যাক করল, কিন্তু কোনও লাভ হল না, সেই একই যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর। বিরক্ত হলেও পাশাপাশি মনে একটা কৌতুহলও কাজ করতে লাগল, কে এই ব্যক্তি? এটা জানার সত্যিই কোনও উপায় হয়তো নেই, মেসেজ পড়লে সহজেই বোঝা যায় পুলিশের ভয় তার নেই। মেসেজ অনুযায়ী খুব তাড়াতাড়ি এর পরিচয় পাওয়ার কথা, দেখা যাক। কুহেলি আর বেশি না ভেবে শুয়ে পড়ল, কাল আবার শৈলজা দেবীকে ডিসচার্জ দেবে, আর কালকে বিকেলের ফ্লাইটেই সে ব্যাঙ্গালোর ফিরে যাবে, টিকিটও বুক করা হয়ে গেছে, আলেখ বললেও ও বেশি দেরি করতে চায় না, কাজের প্রেসার এখন অনেক বেশি, এইসব ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়ল কুহেলি। পরদিন যথারীতি সময়মত শৈলজা দেবীকে নিয়ে চৈতালী দেবী আর কুহেলি ফিরে এল, শৈলজা দেবীকে ওনার ঘরে শুইয়ে দিয়ে চৈতালী দেবী নিজের ঘরে গেলেন, কুহেলি ওর ঠাম্মুর পাশেই বসে রইল। শৈলজা দেবীর মন খারাপ, তার কুহু একটু পরেই চলে যাবে শুনে মুখ ভার করে বসে আছেন। কুহেলি বলল,

ঠাম্মু, তুমি তো সবই বোঝো, খুব দরকার নাহলে আমি কি যেতাম? এখন যা কাজের প্রেসার তাতে আমার আসারই কথা ছিল না, আমার স্যার অত্যন্ত ভালো মানুষ বলে আমি আসতে পেরেছি।

শৈলজা দেবী একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,

জানি, তাই তো কিছু বলছি না, তবে খারাপ তো লাগে। কতদিন তোকে কাছে পাইনা বল তো, তিনমাস আগে চিরুর বিয়েতে এলি তা অত হ্যাঙ্গামের মধ্যে দুটো কথা বলারই সুযোগ পেলাম না। আর এবারের কথা তো ছেড়েই দে, আবার কবে আসবি তা তো তুই নিজেও জানিস না।

ঠাম্মু, আমি কথা দিলাম এই প্রজেক্টটা কমপ্লিট হলে বেশ একটা লম্বা ছুটি নিয়ে এসে তোমার কাছে থেকে যাব।

বৃদ্ধার মুখে এই সামান্য কথাতেই হাসি ফুটে উঠল, অল্প বয়সে ছেলেকে হারানোর পর এই নাতনীই তার সবটুকু জুড়ে রয়েছে। খুশি হয়ে বললেন,

সত্যি বলছিস?

একদম সত্যি, তবে তোমাকেও একটা কথা দিতে হবে কিন্তু।

কি?

একদম অনিয়ম করবে না, মা যা বলবে তাই শুনবে, আর ফোনটা যেন সবসময় কাছে থাকে, আমি ফোন করলেই যেন পাই।

আচ্ছা বাবা, তাই হবে।

হাসি ঠাট্টার মধ্যে দিয়ে দুপুরটা কেটে গেল, কুহেলি খাওয়া দাওয়ার পর বেরোনোর জন্য রেডি হল, সঙ্গে কিছুই আনেনি, তাই লাগেজপত্রের বালাই নেই। বেরোনোর আগে একবার শৈলজা দেবীর সঙ্গে দেখা করে চৈতালী দেবীর গাড়িতে করেই রওনা হল এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে।

ক্রমশ__________

© স্বত্ব সংরক্ষিত

আজকের পর্বটা বড় করে দেওয়ার চেষ্টা করেছি। দেবার্ঘ্য আর কুহেলি নিজের মনের কথাটা মুখে না বললেও বুঝতে পেরেছে। আগামীতে কোনদিকে এগোবে ওদের সম্পর্ক? আবার কোনও এক অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি কুহেলিকে প্রতিদিন মেসেজ করছে। কুহেলির প্রত্যেকটা খবর সে রাখে, কে এই ব্যক্তি? কি তার উদ্দেশ্য? আদৌ সে অজ্ঞাত পরিচয়, না কি খুবই পরিচিত কেউ? কি মনে হয় আপনাদের? আমাকে জানাতে ভুলবেন না কিন্তু। আপনাদের কমেন্ট গুলো পড়লে মনে হয় আমার কষ্ট করে লেখাটা সার্থক। অপেক্ষা করব আপনাদের কমেন্টের। দেখা হবে আগামী পর্বে ততদিন পর্যন্ত পড়তে থাকুন ভালো থাকুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here