#সংগোপনে
#ধারাবাহিক_পর্ব_৯
#অচিন_পাখি_কলমে_ভাগ্যলক্ষ্মী_দাস
আগের পর্বের পর————-
কাল ফিরতে ফিরতে অনেকটা রাত হয়েছিল, কি একটা গন্ডগোল হওয়ায় ফ্লাইট অনেকটা ডিলে হয়ে গিয়েছিল। টানা চার ঘণ্টা এয়ারপোর্টে বসে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে গিয়েছিল কুহেলি। শেষে যখন ব্যাঙ্গালোরে নিজের ফ্ল্যাটে পৌঁছায় তখন রাত এগারোটা পেরিয়ে গেছে। অত রাত হচ্ছে শুনে দেবার্ঘ্য ওকে এয়ারপোর্টে নিতে যেতে চেয়েছিল কিন্তু কুহেলি রাজি হয়নি, ব্যাঙ্গালোর ওর চেনা শহর, আর এই কথায় কথায় অন্যের ওপর নির্ভর করা ওর একেবারেই অপছন্দ, তা সে যেই হোক। বাড়িতে ফিরেই আগে গীতার কথা মনে হয়েছিল, এতদিন ওর কথা মাথাতেই আসেনি, খুব খারাপ লাগছিল কুহেলির, না জানিয়ে চলে গিয়েছিল, নিশ্চয়ই চিন্তা করেছে। কিন্তু মনে পড়লেও জানানোর কোনও উপায় ছিল না, গীতা ফোন ব্যবহার করে না, কুহেলি কতবার ওকে একটা ফোন কিনে দিতে চেয়েছে কিন্তু গীতা রাজি হয়নি। ফ্রেশ হয়ে ফ্রিজ খুলেই রান্না করা পদ গুলো দেখে মনটা খুশি হয়ে গিয়েছিল, গীতা রোজ এসে ওর কাজ করে গেছে। বড্ড খিদে পেয়েছিল, তাড়াতাড়ি ডিনার টা সেরে শুতে গিয়ে দেখে সেই অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি আবার মেসেজ করেছে। এবার আর অবাক হয়নি কুহেলি, কারণ ও খুব ভালো করেই বুঝতে পেরেছে এই ব্যক্তিটি ওর সম্পর্কে সব খবর রাখে, মেসেজটা পড়ে যথারীতি ডিলিট করে দিয়েছিল।
“টাফ ডে, রেস্ট আর্লি। গুডনাইট।“
আজ সকালে গীতা এসেই তো হাজার টা প্রশ্ন একসঙ্গে শুরু করে দিয়েছে, কি হয়েছিল, কোথায় গিয়েছিলে, কেন গিয়েছিলে, এমন কি দরকার পড়েছিল যে এভাবে তড়িঘড়ি যেতে হল। কুহেলি আগে সব প্রশ্ন চুপচাপ শুনে তারপর বলল,
হয়েছে? নাকি আরো কিছু জিজ্ঞেস করবে? না, মানে আরো কিছু জিজ্ঞেস করার থাকলে আগে থেকেই করে নাও আমি তারপর একে একে উত্তর দিচ্ছি।
গীতা কুহেলির মুখের হাসিটা দেখে বলল,
তোমার তো সবেতেই মজা, আমার কত চিন্তা হচ্ছিল জানো?
আচ্ছা সরি, বলছি, কিন্তু আগে ব্রেকফাস্ট টা দাও নাহলে লেট হয়ে যাবে, খেতে খেতে বলছি।
কুহেলির কাছে সব শুনে গীতা তো প্রায় কেদেই ফেলছিল, বড্ড আবেগ প্রবণ। কুহেলি খাওয়া শেষ করে অফিসের জন্য বেরিয়ে পড়ল, অফিসে ঢুকতেই অবাক, রুহি ওর আগে এসে বসে আছে। ওকে দেখেই ছুটে ওর কাছে এসে বলল,
দি, তুমি এত তাড়াতাড়ি চলে এলে? তোমার দাদিজী কেমন আছেন?
এখন ভাল আছে, কিন্তু তুমি এত আগে অফিসে কি করছ?
তোমার কাজ গুলো হ্যান্ডেল করতে গেলে তো আগেই আসতে হবে, আমি তো তোমার মত নই, আমার অনেক বেশি টাইম লাগে।
কুহেলি হাসতে হাসতে ওর ডেস্কে এসে বসল, ফাইল গুলো উল্টে পাল্টে দেখল রুহি অনেকটা এগিয়ে দিয়েছে। রুহিকে ছোট্ট করে একটা থ্যাঙ্কস বললে রুহি আবার ঠোঁট ফুলিয়ে বাচ্চাদের মত বলল,
থ্যাঙ্কস বলে পর করে দিচ্ছ তো?
কুহেলি হেসে বলল,
আচ্ছা ঠিক আছে বলছি না।
এরমধ্যেই আলেখ অফিসে ঢুকল, কুহেলিকে দেখে একটু অবাক হল আবার মনে মনে খুশিও হল। মুখে বললেও কুহেলির কাজটা অন্য কাউকে দিয়ে ঠিক হচ্ছিল না, আর ওর নিজেরও এত চাপ যে পেরে উঠছিল না। কুহেলির দিকে তাকিয়ে হেসে নিজের কেবিনের দিকে এগিয়ে গেল। সারাটা দিন কাজের মধ্যে দিয়েই চলে গেল, লাঞ্চ ব্রেকে কোনরকমে একটু খেয়ে আবার কাজে লেগে গিয়েছিল কুহেলি। হাতে সময় খুব কম, আর একমাসও টাইম নেই, গত দুদিনে রুহি অনেকটা এগিয়ে রাখলেও এখনও অনেকটা কাজ বাকি। ঘড়িতে পাঁচটা বাজলেও কুহেলির সেদিকে খেয়াল নেই, আজকে রুহিও ওর সাথে আছে, দুজনে যখন আজকের মত কাজ শেষ করল তখন সাড়ে ছটা। রুহির বাড়ি অফিস থেকে অনেকটাই দূরে, এমনিই দেরী হয়ে গেছে রুহি তাড়াতাড়ি ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে গেল। কুহেলি ব্যাগ গুছিয়ে বেরোনোর সময় দেখল আলেখের কেবিনে এখনও আলো জ্বলছে, আজ সারাদিন কথা বলার সুযোগ হয়নি, মানুষটা এতোটা হেল্প করল, একবার ধন্যবাদ জানানো উচিত মনে করে কুহেলি আলেখের কেবিনের দিকে পা বাড়াল। নক করতেই ভিতরে যাওয়ার অনুমতি এল, কুহেলি ভিতরে ঢুকতেই আলেখ বলল,
মিস বাসু, আসুন, হ্যাভ এ সিট।
কুহেলি একটা চেয়ার টেনে বসতেই আলেখ ওর হাতের ফাইলটা বন্ধ করে বলল,
বলুন, আপনার গ্র্যান্ড মাদার কেমন আছেন?
ভালো, ডক্টর বলেছেন ভয়ের কিছু নেই তবে এখন থেকে একটু সাবধানে থাকতে হবে।
হুম, আপনি এত তাড়াতাড়ি চলে এলেন কেন, আপনাকে তো বলেছিলাম তাড়াহুড়ো করার কোনও প্রয়োজন নেই।
ওদিকে আমার আর তেমন কিছু করার ছিল না, আর এদিকে এত কাজ রয়েছে, টাইমও তো কম। তাই চলে এলাম, আপনি সেদিন আমাকে এককথায় বাড়ি যাওয়ার পারমিশন দিয়ে দিলেন, আমি সত্যিই….
কুহেলি কথাটা শেষ করতে পারল না, আলেখ মাঝপথেই থামিয়ে দিল।
মিস বাসু, আপনি আমাকে অনেকবার থ্যাঙ্কস বলেছেন, আর বলতে হবে না। এত থ্যাঙ্কস বললে নেক্সট টাইম থেকে আর কোনও হেল্প করব না।
কুহেলি হেসে ফেলল, ওর সত্যি মনেই হচ্ছে না যে ওর সামনে ওর বস বসে আছে। কুহেলি উঠে দাড়িয়ে বলল,
ওকে স্যার, আমি তাহলে আসি।
ওহ ইয়েস, কালকে তো সানডে, বেশি প্রেসার নেবেন না, একটু রেস্ট করবেন।
ওকে স্যার।
বলে কুহেলি বেরিয়ে আসছিল কিন্তু থেমে গিয়ে আবার বলল,
স্যার, মিস্টার নিশীথ আগরওয়াল কি সোমবার আসছেন? মানে এখনও তো কনফার্ম কিছু জানতে পারিনি।
নো মিস বাসু, এখনও কোনও কনফার্মেশন আসেনি, কিন্তু কালকের মধ্যে এসে যাবে, ডোন্ট ওয়ারি, কনফার্মেশন আসলেই অঙ্কিত আপনাকে ইনফর্ম করে দেবে।
ফাইন স্যার। আমি আসছি তাহলে, গুড নাইট।
গুড নাইট।
অফিস থেকে বেরিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে সাড়ে সাতটা হয়ে গেল। ফ্রেশ হয়ে আবার কাজ নিয়ে বসল, কাজ করতে করতে অনেকটা লেট হয়ে গেল। দেবার্ঘ্যর ফোন আসলে সময়ের খেয়াল হল, ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল ইতিমধ্যে এগারোটা বাজে, এখনও খাওয়া হয়নি, কাজ করতে করতে মনেই ছিল না।
হ্যালো।
হ্যালো, খাওয়া হল?
না, মানে…
দেবার্ঘ্য রেগে গিয়ে বলল,
এখনও খাওনি? কুহু, এই স্বভাবটা কবে পাল্টাবে বলতো?
আরে এই তো খাব এখন, রাগ করছ কেন?
মিথ্যে কথা কেন বলছ বলত? আমি ড্যাম শিওর তুমি এখনও বসে কাজই করছিলে, আমার ফোন পেয়ে তবে হুশ হয়েছে।
আচ্ছা, সরি, এক্ষুনি খাচ্ছি। হয়েছে?
দেবার্ঘ্য একটু নরম হয়ে বলল,
নিজের একটু খেয়াল রাখ, এভাবে কীকরে চলবে?
সরি বললাম তো, বাদ দাও, বলছি কাল কিন্তু কোথাও যাওয়া হবে না, কাজের বড্ড চাপ, বাড়িতে বসেই অনেক কাজ সারতে হবে।
সে আর বলতে, আপনি তো কাজ ছাড়া কিছুই বোঝেন না, দিনে যে এই একবার আমার সাথে কথা বলেন এতেই আমি ধন্য।
অত ধন্য হতে হবে না, তুমি খেয়েছ?
হুম, এই জাস্ট খেলাম। আচ্ছা সেই মেসেজের কি খবর?
কুহেলি কিছুক্ষণ ভেবে মেসেজের কথাটা চেপে গেল, শুধু শুধু চিন্তা করবে। দেখা যাক, বলেছে তো কদিন পরেই জানা যাবে, তখন নাহয় অবস্থা বুঝে একটা কিছু করা যাবে।
ওই একই, রোজই একটা মেসেজ আসছে। বাদ দাও তো, এই খিদে পেয়েছে, আমি খেতে গেলাম।
এখন খিদের কথা মনে পড়ল? যাও, আর বেশি রাত করো না।
হুম, গুড নাইট।
গুড নাইট।
কুহেলি খাওয়া সেরে এসে ল্যাপটপ আর ফাইল গুলো গুছিয়ে রাখল, আগামীকাল সারাটা দিন পাবে তাই আজ আর শুধু শুধু রাত জাগার কোনও মানে হয় না। আজকেও ঠিক শোয়ার সময় একটা মেসেজ এল, “গুড নাইট” আর কুহেলিও প্রতিদিনের মত ডিলিট করে দিল। পরদিন গীতার ডাকে ঘুম ভাঙ্গল, ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে নটা দশ, এত বেলা অবধি কুহেলি কখনও ঘুমায় না, আজ যে কেন ঘুমটা ভাঙলো না কে জানে! গীতা না ডাকলে আরও কতক্ষন ঘুমাতো কে জানে। অতিরিক্ত পরিশ্রমে সত্যিই বোধহয় ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, গীতা বলল,
তোমার কি শরীর খারাপ নাকি আক্কা?
না, ঠিক আছি।
এত দেরি অবধি তো ঘুমাও না কখনো, আমারও প্রায় বেরোনোর সময় হয়ে এল, তাও উঠছো না দেখে ডাকলাম।
ভাল করেছ, তোমার কাজ হয়ে গেছে?
হ্যা, প্রায়। চিকেন টা হচ্ছে, ওটা হয়ে গেলেই হয়।
আচ্ছা, তুমি ব্রেকফাস্ট রেডি কর আমি স্নান সেরে আসছি।
গীতা ঘাড় নেড়ে চলে গেলে কুহেলি উঠে স্নান সেরে নিল, ব্রেকফাস্ট করা হয়ে গেলে গীতাও বেরিয়ে গেল। টুকটাক কাজ সারতে সারতে বারোটা বেজে গেল, এবার বাড়িতে ভিডিও কল করার পালা। ল্যাপটপ টা এনে গুছিয়ে সোফায় বসে ফেসবুকে লগইন করল, চৈতালী দেবী জানেন এই সময়টায় কুহেলি ভিডিও কল করে তাই ল্যাপটপটা অন করেই রেখেছিলেন। কল কানেক্ট হতে বেশি সময় লাগল না, স্ক্রীনে চৈতালী দেবী আর শৈলজা দেবীর মুখদুটো দেখে কুহেলির মনটা খুশিতে ভরে গেল। শুরু হল ওদের রবিবারের আসর, নানা কথা বলতে বলতে হঠাৎ দেবার্ঘ্যর কথা উঠল। দেবার্ঘ্যর কথা উঠলেই কুহেলি একটা আলাদা আনন্দ অনুভব করে, বেশ খুশি মনে কুহেলি বলছিল,
জান তো মা, দেবার্ঘ্যর সঙ্গে বেশ ভালই আলাপ হয়ে গেছে, ওর অ্যাপার্টমেন্ট টা খুব একটা কাছে না হলেও খুব বেশি দূরে না।
শুনে চৈতালী দেবী বললেন,
সে তো খুব ভাল কথা, অত দূরে একা থাকিস, চেনা পরিচিত কেউ কাছাকাছি থাকলে তো ভালই হয়। তবে তুই ওকে নাম ধরে বলছিস কেন?
কুহেলি অবাক হয়ে বলল,
নাম ধরে না বললে আর কি বলব!
সেকি! কি বলবি মানে! মামা বলবি।
কুহেলি আরও অবাক হয়ে বলল,
মামা!
হ্যা।
মামা কেন হতে যাবে?
কেন আবার কি? মামা হয় তাই।
কিন্তু কীকরে?
এবার শৈলজা দেবী হেসে বললেন,
তুই এখনও সম্পর্কগুলো বুঝলি না! আরে বাবা দেবাঞ্জলির ভাই মানে সে তো চিরুরও ভাই, আর মামার ভাই তো মামাই হয় নাকি!
শৈলজা দেবী হাসছেন, কিন্তু কুহেলির হাসিটা হঠাৎ মিলিয়ে গেল, সব কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। আরও কিছুক্ষণ কথা বলে ল্যাপটপ টা বন্ধ করে চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে রইল, হঠাৎ করে সব কেমন উল্টোপাল্টা মনে হচ্ছে। দেবার্ঘ্য সম্পর্কে ওর মামা হয়! এটা.. এটা কীকরে সম্ভব! কিন্তু ও যে দেবার্ঘ্যকে… আর দেবার্ঘ্যও যে ওকে… নাহ ভাবনা গুলোও কেমন জট পাকিয়ে যাচ্ছে। উঠে গিয়ে ঢক ঢক করে কিছুটা জল খেল, বেশ খানিকক্ষনের চেষ্টার পর কিছুটা শান্ত হল, ঠান্ডা মাথায় ভাবার চেষ্টা করল। এক এক করে সবটা পরিষ্কার হতে লাগল, চৈতালী দেবী সম্পর্কে দেবাঞ্জলির বড় ননদ হন, অর্থাৎ বড় দিদি। আর দেবাঞ্জলির ভাই হিসেবে চৈতালী দেবী সম্পর্কে দেবার্ঘ্যরও দিদি হন, আর তাছাড়াও এখন কুহেলির মনে পড়ছে চৈতালী দেবী দেবাঞ্জলির মাকে মাসিমা বলেন। নাহ আর ভাবতে পারছে না, চোখ দুটো হঠাৎ কেমন জ্বালা করছে, কোনোকিছু না ভেবে এটা কীকরে ফেলেছে সে। এই সম্পর্কের হিসেব গুলো ও সত্যিই তেমন বোঝেনা, কোনদিনও সেভাবে বোঝার চেষ্টাও করেনি। আজ নিজের উপর প্রচন্ড রাগ হচ্ছে, ছোট থেকেই যদি এই সম্পর্ক গুলোর প্রতি এত উদাসীন না হত তাহলে আজ এত বড় ভুলটা করত না। চোখের সামনে দেবার্ঘ্যর মুখটা বারবার ভেসে উঠছে, হঠাৎ দেবার্ঘ্যর উপরেও রাগ হল, সে নাহয় সম্পর্কগুলো ঠিক বোঝে না কিন্তু দেবার্ঘ্যও বা কীকরে এটা করতে পারল? শান্ত স্বভাবের কুহেলির আজ হঠাৎ সব কিছু ভেঙে চুরমার করে দিতে ইচ্ছে করছে, ঠিক যেমন ওর মনটা ভেঙে গুড়িয়ে যাচ্ছে সেভাবেই সব কিছু তছনছ করে ফেলতে ইচ্ছে করছে। আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না, একছুটে ওয়াশরুমে গিয়ে শাওয়ার টা চালিয়ে দিল, শাওয়ারের ঠান্ডা জলের ফোঁটা গুলো আপ্রাণ চেষ্টা করছে কুহেলির দুচোখ বেয়ে নেমে আসা উষ্ণ জলের ধারাকে ধুয়ে দিতে কিন্তু বাধ ভাঙ্গা স্রোতের মতই তারা অপ্রতিরোধ্য। কুহেলির খুব ইচ্ছে করছে চিৎকার করে কাদতে, কিন্তু পারছে না, কেউ যেন ওর আওয়াজ গুলো কেড়ে নিয়েছে। একসময় ওয়াশরুমের ফ্লোরেই বসে পড়ল, শাওয়ারের জল অবিরাম ঝরে চলেছে তার সাথে পাল্লা দিয়ে অব্যাহত রয়েছে অশ্রুপাত। দুটো হাঁটুর মধ্যে মুখ গুজে একটা কথাই বারবার ভেবে চলেছে, মনের মধ্যে চলতে থাকা প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে নিতে চাইছে সেই অদৃশ্য অদৃষ্টের কাছে।
কেন? যদি পূর্ণতা নাই পাওয়ার ছিল তাহলে কেন আমার মনে ভালোবাসা জাগালে? আমি তো কখনও চাইনি আমার জীবনে প্রেম আসুক, তাহলে কেন? বেশ তো ছিলাম, এত বছর ধরে মনের দরজাটা বন্ধ করে রেখেছিলাম, শত করাঘাতেও ফিরেও তাকাইনি। যদি এভাবেই শুরু হওয়ার আগেই শেষ হয়ে যাওয়ার ছিল তাহলে কেন সব বন্ধ দরজা খুলে পথ খুঁজে দিয়েছিলে? আজ এইভাবে আঘাত পাওয়ার জন্য?
ঘণ্টার পর ঘন্টা বসে বসে থেকেও উত্তর খুঁজে পায়নি কুহেলি। এই পৃথিবীতে কটা প্রশ্নেরই বা উত্তর মেলে! চব্বিশ বছরের প্রেমহীন জীবনে প্রথমবার ভালোবাসার রং লেগেছিল, কিন্তু একনিমেষে সব রং গুলো ধুয়ে ফ্যাকাসে হয়ে গেল। গীতার রান্না করা কুহেলির প্রিয় চিকেন রেজালা টা ডাইনিং টেবিলেই পড়ে রইল, আর কুহেলি…. নরম পাশ বালিশ টাকে আঁকড়ে ধরে নিজেকে গুছিয়ে নেওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। বালিশের নরম তুলোগুলো শুষে নিতে চাইল ওর নিঃশব্দ কান্নাগুলো। কতক্ষন এভাবে শুয়ে ছিল জানে না, কিন্তু বেশিক্ষণ এইভাবে অসহায়ের মত চোখের জল ফেলার মেয়ে সে নয়, একটা মস্ত বড় ভুল করেছে সেটা শুধরে নেওয়া প্রয়োজন। না, ভালোবেসে সে ভুল করেনি, কাউকে ভালোবাসা কখনও ভুল হতে পারে না, কিন্তু সবাইকে যে সব ভাবে ভালোবাসা যায় না। জীবনের কিছু নিয়ম আছে যেগুলো সবাইকে মেনে চলতে হয়, জানি অনেকেই বলবেন ভালোবাসা তো উত্তাল ঢেউয়ের মত, তাকে নিয়মে বাধা যায় না। ঠিকই, ভালোবাসা কোনও নিয়ম মানে না, কিন্তু আমাদের জীবনের কতগুলো নিজস্ব নিয়ম আছে যেগুলো আমাদের জীবনের ছন্দ টা বজায় রাখে। একটা ছোট্ট ভুলের জন্য যদি সেই ছন্দ একবার হারিয়ে যায়, তাকে সারাজীবনেও আর ফিরিয়ে আনা যায় না। কুহেলি আর একমুহুর্ত সময় নিল না, এখন ওর কি করণীয় সেটা ঠিক করে নিয়েছে। কুহেলির চরিত্রের এই দিকটা সত্যিই অবাক করার মত, শত কষ্ট হলেও ঠিক নিজেকে সামলে নেয়, এই অসম্ভব মনের জোরটা যে কোথা থেকে আসে সেটা সত্যিই অজানা। কুহেলি বিছানা ছেড়ে উঠে মোবাইলটা হাতে নিয়ে ব্যালকনিতে এল, বিকেল শেষ হয়ে এসেছে প্রায়, পড়ন্ত বেলার একফালি নরম রোদ ব্যালকনির কোনায় রাখা গোলাপ গাছ দুটোর ওপর এসে পড়েছে। গোলাপ গাছ দুটোয় কদিন আগে সুন্দর দুটো ফুল ফুটেছিল, একটা হলুদ একটা লাল। আজকে কেমন যেন শুকিয়ে গেছে, বড্ড নিষ্প্রাণ লাগছে ফুলদুটো, কতগুলো পাপড়ি নিচে ঝরে পড়ে গেছে। ফুলদুটোর দিকে তাকিয়ে কুহেলি একটু ক্ষীণ হাসল, মনে মনে বলল,
তবু তো ফুল দুটো ফুটেছিল, এভাবে অঙ্কুরেই……
ভাবনাটা শেষ করল না, আর ভেঙে পড়লে চলবে না, এখনও যে অনেক কাজ বাকি। রিসেন্ট কল লিস্ট থেকে দেবার্ঘ্যর নম্বরটা ডায়াল করে ফোনটা কানের কাছে নেওয়ার বেশ একটু পরে ফোনের অপর প্রান্ত থেকে দেবার্ঘ্যর ঘুম জড়ানো আওয়াজ ভেসে এল।
হ্যালো।
ঘুমের ঘোরে বোধহয় কার ফোন সেটা না দেখেই রিসিভ করেছে। কুহেলি খুব শান্ত স্বরে বলল,
ডিস্টার্ব করলাম?
ঘুমের মধ্যেও কুহেলির গলা চিনতে কোনো অসুবিধা হল না দেবার্ঘ্যর। এক নিমেষে ঘুমের ভাবটা ঝেড়ে ফেলে বলল,
একদম না, তুমি ফোন করলে আমি ডিস্টার্ব ফিল করব সেটা হতে পারে?
কুহেলি একথার কোনও উত্তর না দিয়ে প্রশ্ন করল,
সন্ধ্যেবেলায় কি করছ?
কিছু না, কেন?
একবার আমার ফ্ল্যাটে আসতে পারবে?
দেবার্ঘ্য যারপরনাই অবাক হল, এতদিনে কুহেলি একবারও ওকে নিজের ফ্ল্যাটে ডাকেনি, একবার বরং দেবার্ঘ্য নিজে থেকেই যাওয়ার কথা বলেছিল কিন্তু কুহেলি পাত্তাই দেয়নি। সেখানে আজ নিজে থেকে যেতে বলছে! এই তো কালকেই বলল আজ আর দেখা করতে পারবে না, কাজের বড্ড চাপ, আর এখন ফোন করে সোজা বাড়িতে ডাকছে! এই মেয়ে কখন যে কি করে সেটা দেবার্ঘ্য এখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। তবে এই অনাকাঙ্খিত আমন্ত্রণে দেবার্ঘ্য দারুন খুশি হয়েছে, ঠোঁটে একটা চওড়া হাসি ফুটিয়ে বলল,
সে তো আসতেই পারি, আর তুমি ডেকেছ বলে কথা।
কুহেলি সেই একইরকম শান্ত ভাবে জবাব দিল,
তাহলে চলে এস, অ্যাড্রেস তো জানোই তাও যদি অসুবিধা হয় তো ফোন করো।
ওকে, আমি এক্ষুনি রেডি হয়ে বেরোচ্ছি।
বাই।
বাই।
কুহেলি ফোনটা রেখে সযত্নে ঝরে যাওয়া পাপড়ি গুলো কুড়িয়ে নিল, তারপর একটা একটা করে ছড়িয়ে দিতে লাগল হাওয়ায়। পাপড়ি গুলো সুতো কাটা ঘুড়ির মত এদিক ওদিক ভাসতে ভাসতে একসময় ছড়িয়ে পড়ল নিচে, নিভে আসা দিনের আলোয় পাঁচ তলার ব্যালকনি থেকে কুহেলি আর দেখতে পেল না সেগুলো। ওদিকে দেবার্ঘ্য কুহেলির ফোন পাওয়ার পরেই উঠে তৈরি হতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে, অনেক বেছে একটা ডিপ ব্লু টিশার্ট আর হোয়াইট জিন্স পরল, চুলটা একটু ঠিকঠাক করে, একটু সুগন্ধির ছোয়া লাগিয়ে হাতে ওর প্রিয় ঘড়িটা পরে বেরিয়ে পড়ল কুহেলির ফ্ল্যাটের উদ্দেশ্যে। যদিও রাস্তায় একটু থামতে হল, প্রথম বার কুহেলির ফ্ল্যাটে যাচ্ছে কিছু একটা নিয়ে যাওয়া দরকার। কি নিয়ে যাবে সেটা আরেক সমস্যা, অন্য কেউ হলে একটা ফুলের তোড়া নিয়ে গেলেই হত কিন্তু কুহেলি ফুল ভালোবাসে কিন্তু একমাত্র গাছে, অনেক ভেবে শেষে একবক্স চকোলেট নিল। মনটা বড্ড বেশি রকমের ভালো লাগছে, ক্যাব তার নিজস্ব গতিতেই চলছে কিন্তু দেবার্ঘ্যর যেন মনে হচ্ছে গাড়িটা চলছেই না, একমুহূর্ত দেরী সইছে না। এদিকে কুহেলি ওর বাড়ির পোষাকটা পাল্টে একটা পালাজো আর কুর্তি পরল, বাড়ির পোষাকে অন্য কারো সামনে যেতে ভালোলাগে না। সন্ধ্যে সাড়ে ছটা নাগাদ দেবার্ঘ্য কুহেলির ফ্ল্যাটে পৌঁছাল, কলিংবেল বাজানোর আগে চুলে আঙ্গুল চালিয়ে একবার সেট করে নিল। তারপর কলিংবেল বাজিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল, কেমন একটা অদ্ভুত ফিলিংস হচ্ছে, স্পন্দন যেন দ্বিগুণ হয়ে গেছে। একটুপরেই কুহেলি এসে দরজা খুলে দিল, দেবার্ঘ্যর হাসি মুখটা দেখে বুকের বাপাশ টা কেমন চিন চিন করে উঠল। একটা ক্ষীণ হাসি ফুটিয়ে তুলে বলল,
এস।
দেবার্ঘ্য হেসে ভিতরে এসে বসল, চকোলেটের বক্সটা এগিয়ে দিয়ে বলল,
এই নাও, তোমার জন্য কি আনব ভেবে না পেয়ে শেষে এটাই নিয়ে এলাম।
কুহেলি কিছু না বলে বক্সটা নিয়ে সেন্টার টেবিলে রেখে দেবার্ঘ্যর মুখোমুখি বসল। যেটা বলার জন্য আজ দেবার্ঘ্যকে প্রথমবার নিজের ফ্ল্যাটে ডাকল ওর চোখের দিকে তাকিয়ে যেন সব কথাগুলো ঘেঁটে গেল। সেই ঘুম জড়ানো চোখ দুটো, ওই চোখ দুটোর মায়াতেই তো আস্তে আস্তে জড়িয়ে পড়েছিল, কুহেলি আর তাকিয়ে থাকতে পারল না, চোখদুটো সরিয়ে নিল অন্যদিকে। দেবার্ঘ্য এতক্ষণ সেভাবে লক্ষ্য করেনি কিন্তু এবার যেন কুহেলিকে একটু অন্যরকম লাগল। একটু চিন্তিত হয়ে বলল,
কুহু, তোমার কি শরীর খারাপ?
কুহেলি অনেক কষ্ট করে নিজেকে শক্ত করল, দেবার্ঘ্যর দিকে তাকিয়ে বলল,
নাহ, আমি ঠিক আছি।
কিন্তু তোমাকে কেমন একটা লাগছে। তুমি সত্যি করে বলোতো কি হয়েছে?
কুহেলি এবার হেসে বলল,
বলছি তো কিছু হয়নি। ছাড়ো, বলো কি খাবে?
কিছু না।
তাই বললে হবে কেন? প্রথম বার এসেছ, দাড়াও একটু কফি করে আনি।
কুহেলি একরকম পালিয়ে এল ওখান থেকে, দেবার্ঘ্যর সামনে কেমন যেন দুর্বল হয়ে পড়ছে। দুকাপ কফির জল বসিয়ে ভাবতে লাগল,
না, এভাবে দুর্বল হয়ে পড়লে চলবে না। আমাকে এটা করতেই হবে, সবার ভালোর জন্য এটা করতেই হবে।
মনটাকে শক্ত করে নিয়ে কফির কাপ দুটো নিয়ে ফিরে এল ড্রয়িং রুমে। একটা কাপ দেবার্ঘ্যকে দিয়ে নিজে ওর মুখোমুখি বসল। দেবার্ঘ্যই কথা শুরু করল,
তারপর, হঠাৎ জরুরি তলব, কি ব্যাপার? এই তো কালকেই বললে আজ সময় হবে না, অনেক কাজ আছে।
হুম, বলেছিলাম কিন্তু এখন কাজের থেকেও বেশি জরুরি তোমার সাথে কথা বলা।
কুহেলিকে হঠাৎ করে এত গম্ভীর হয়ে যেতে দেখে দেবার্ঘ্যর মনটা কেমন যেন করে উঠল।
কি কথা কুহু? আর তুমি এভাবে বলছ কেন?
কুহেলি একথার কোনও উত্তর না দিয়ে হঠাৎ বলল,
আচ্ছা, আমাদের সম্পর্কটা ঠিক কি তুমি জান?
আচমকা এরকম একটা প্রশ্ন দেবার্ঘ্য আশা করেনি, একটু থতমত খেয়ে বলল,
মানে? হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন?
আগে বলো।
উম, ঠিক জানি না, আসলে এই সম্পর্ক গুলো ঠিক মাথায় ঢোকে না আমার। কিন্তু হঠাৎ একথা উঠছে কেন?
কুহেলি এবারও উত্তর দিল না, অনেক কষ্টে চোখের জলগুলো আটকে বলল,
আমি জানি।
দেবার্ঘ্য স্পষ্ট বুঝতে পারছে কিছু তো একটা হয়েছে, কিন্তু কি হয়েছে সেটাই বুঝে উঠতে পারল না। শুধু একটা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল কুহেলির দিকে। কুহেলি একটা ম্লান হাসি ফুটিয়ে বলল,
তুমি সম্পর্কে আমার মামা হও, জান?
দেবার্ঘ্য ভিষন অবাক হল,
মামা! আর ইউ ক্রেজি!! কি বলছ এসব?
ঠিকই বলছি, তুমি আমার মামীর ভাই, তাই সেই সূত্রে তুমি আমার মামা।
কুহু এসব কি উল্টোপাল্টা কথা বলছ তুমি?
ঠিকই বলছি, বিশ্বাস নাহয় একসময় মামীকে জিজ্ঞেস করো।
দেবার্ঘ্য এবার ভিষন বিরক্ত হয়ে বলল,
কুহু, আমি জানিনা কি হয়েছে, আর হঠাৎ তুমি এই সম্পর্ক নিয়ে কেন পড়েছ সেটাও বুঝতে পারছি না। প্লিজ একটু খুলে বলবে আমাকে?
কুহেলি উঠে গিয়ে জানালার কাছে গিয়ে দাড়াল, আকাশের চাঁদ টাও আজকে কেমন ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। কুহেলি চোখ দুটো বন্ধ করে একটা নিশ্বাস ফেলল, তারপর দেবার্ঘ্যর দিকে পিছন ফিরেই বলল,
খুলে বলার মত কিছু নেই, আমি শুধু আমাদের সম্পর্কটা ক্লিয়ার করে নিলাম। যে সম্পর্কটা থেকে এতদিন আমরা দুজনেই অজ্ঞাত ছিলাম, সেটার সঙ্গে তোমার পরিচয় করালাম।
দেবার্ঘ্য এবার অধৈর্য্য হয়ে উঠে এসে কুহেলিকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল,
তুমি ঠিক কি বলতে চাইছ বলত?
আমি যা বলতে চাইছি, সেটা আশা করি তুমি বুঝতে পেরেছ।
দেবার্ঘ্য এবার রেগে গিয়ে কুহেলির হাত দুটো শক্ত করে ধরে বলল,
না, আমি কিছু বুঝিনি। তুমি যা বলতে চাও পরিষ্কার করে বলো, হেঁয়ালি আমার ভালোলাগে না।
কুহেলি দেবার্ঘ্যর চোখের দিকে তাকিয়ে খুব শান্ত গলায় বলল,
বেশ, পরিষ্কার করেই বলছি।
কুহেলির শান্ত গলার স্বর শুনে দেবার্ঘ্যর অন্তর পর্যন্ত কেপে গেল। কিছু যে একটা খুব খারাপ হতে চলেছে সেটা যেন ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় ওকে আগে থেকে জানান দিয়ে দিল। ওর হাত দুটো আপনা থেকেই কুহেলির হাত থেকে নেমে এল, কুহেলি স্থির দৃষ্টিতে দেবার্ঘ্যর দিকে তাকিয়ে বলল,
আমাদের সম্পর্ক টা তেমন নয় যেমনটা আমরা ভেবেছিলাম, খুব অদ্ভুত শোনালেও এটাই সত্যি। আর তেমন কিছু হওয়া সম্ভব নয়, আর উচিতও নয়। এবার আশা করি বুঝতে পেরেছ আমি কি বলতে চাইছি।
দেবার্ঘ্যর মনে হল কেউ যেন ওর পায়ের তলা থেকে মাটিটা সরিয়ে নিল, একটা অবাক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ কুহেলির দিকে তাকিয়ে বলল,
তুমি এসব কি বলছ কুহু? কুহু আমি এই সম্পর্কের কথা জানিনা, আমি শুধু জানি আমি…. আমি তোমাকে ভালোবাসি।
এতদিনের মধ্যে যে কথাটা কখনও ভাষায় প্রকাশ করার প্রয়োজন হয়নি সেই কথাটা আজ এভাবে বলতে হবে কখনও ভাবেনি দেবার্ঘ্য, আর কুহু… একদিন আগে হলেও যে কথাটা শুনে ওর সবথেকে বেশি আনন্দ হত আজ সেই কথাটা শুনেই সবথেকে বেশি কষ্ট হচ্ছে। চোখের জল গুলো অনেক কষ্টে ধরে রেখে বলল,
যেটা হওয়ার নয়, সেটা না বলাই ভাল।
দেবার্ঘ্য আবার কুহেলির হাতদুটো ধরে আকুল স্বরে বলল,
কোনটা হওয়ার নয় কুহু? আর কেন? আমরা চাইলে সব হবে।
এবার কুহেলি কিছুটা বিরক্ত হয়ে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
সব কিছু চাইলেই হয় না, তুমি জান তুমি কি বলছ? এই সম্পর্কের পরিণতি কি জান তুমি?
না, জানি না, জানতেও চাই না। তুমি সঙ্গে থাকলে আর আমার অন্য কিছু জানার প্রয়োজন নেই কুহু।
আবেগের বশে অবুঝের মত কথা বলো না। পারবে তুমি তোমার পরিবারের এতগুলো লোককে কষ্ট দিতে? পারবে?
দেবার্ঘ্য চুপ করে রইল, সত্যিই এতক্ষণ কুহেলি ছাড়া অন্য কোনো কথা মাথাতেই আসেনি। দেবার্ঘ্যকে চুপ করে থাকতে দেখে কুহেলি আবার বলল,
আমি জানি, পারবে না। আমিও পারব না, আমার কাছে সবার আগে আমার পরিবার, ওদের কষ্ট দিয়ে আমি কিছু করতে পারব না।
দেবার্ঘ্যর চোখ দুটো লাল হয়ে গেছে, প্রাণপণ চেষ্টা করছে নিজেকে ধরে রাখার, এক নিমেষে সাজানো স্বপ্ন গুলো এভাবে ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে সেটা কখনও কল্পনাও করেনি। কুহেলিও আপ্রাণ চেষ্টা করছে নিজেকে শক্ত রাখার, দেবার্ঘ্যর কাছ থেকে সরে এসে সোফায় বসল, দেবার্ঘ্য সেইভাবেই ওখানেই দাড়িয়ে রইল। কুহেলি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
আমার মনে হয় তোমার এবার ফেরা উচিৎ, অযথা সময় নস্ট করে কি লাভ?
দেবার্ঘ্য ধীরে ধীরে কুহেলির কাছে এসে দাড়াল, কুহেলির ভিতর টাও যে ভেঙে গুড়িয়ে যাচ্ছে সেটা আর আলাদা করে বলে দিতে হয়না। কি অদ্ভুত না, দুটো মানুষ যারা একে অন্যকে ভালোবাসে তারা চেয়েও এক হতে পারছে না, সম্পর্কের বেড়াজালে পড়ে কোথায় যেন হারিয়ে গেল ওদের ভালোবাসা। দেবার্ঘ্য হাটু গেড়ে কুহেলির সামনে বসল, কুহেলি মুখটা নীচু করে বসে ছিল, দেবার্ঘ্য একটা হাত কুহেলির হাতের উপর রেখে ওর দিকে তাকিয়ে বলল,
আমি জানি না কুহু, এখন ঠিক কি বলা যায়, আমার কাছে বলার মত কিছু নেইও, কিন্তু একটা কথা বলতে পারি। আমাদের ভালোবাসা টা না হয় অপূর্ণই থাক, কিন্তু বন্ধুত্ত্ব টা তো পূর্ণ হতেই পারে।
কুহেলির এতক্ষণের ধরে রাখা বাধটা যেন এক লহমায় ভেঙে গেল, দুচোখ বেয়ে নোনা জল গুলো নেমে আসতে লাগল, দেবার্ঘ্যর চোখের কোনেও চিক চিক করছে জল। দেবার্ঘ্য সযত্নে কুহেলির চোখের জল মুছিয়ে দিল, কুহেলি কিন্তু একবারের জন্যও চোখ তুলে তাকায়নি, দেবার্ঘ্য আবার বলল,
একটা কথা মনে রেখ কুহু, আমি সবসময় তোমার পাশে আছি, একজন বন্ধু হিসেবে আমাকে সবসময় নিজের পাশে পাবে তুমি।
কথাগুলো বলে আর একমুহুর্ত সেখানে দাড়াল না দেবার্ঘ্য, ঝড়ের বেগে ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে গেল। দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দে কুহেলি চোখ তুলে বন্ধ দরজাটার দিকে তাকিয়ে রইল। ফ্ল্যাটের দরজাটার সঙ্গে সঙ্গে কুহেলির মনের দরজাটাও আবার বন্ধ হয়ে গেল, এবার হয়ত চিরদিনের জন্য। কুহেলি একছুটে বেডরুমে ঢুকে বিছানার উপর আছড়ে পড়ল, চোখের জল গুলো ভিজিয়ে দিতে লাগল দুধ সাদা বিছানার চাদরটা। দেবার্ঘ্য কুহেলির ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে উদ্দেশ্যহীন ভাবে হাটতে লাগল রবিবারের সন্ধ্যের ব্যস্ত রাস্তা ধরে, চারিপাশে সবাই কত খুশি, ছুটির দিনের আমেজ গায়ে জড়িয়ে উপভোগ করছে সুন্দর সন্ধ্যেটা, কিন্তু দেবার্ঘ্যর মন থেকে যেন খুশি শব্দটাই হারিয়ে গেছে, কোনদিনও সত্যিই কুহেলিকে নিজের মন থেকে সরিয়ে দিতে পারবে কিনা জানে না, কিন্তু চেষ্টা তাকে করতেই হবে। চোখের কোণের জলটা মুছে একটা ট্যাক্সি দাড় করিয়ে তাতে উঠে পড়ল, বাড়ি ফেরার সময় হয়েছে। কুহেলি আজ সারাদিন কিছু মুখে দেয়নি, ইচ্ছে হয়নি, দেবার্ঘ্য চলে যাওয়ার পর একভাবে বিছানা আঁকড়ে পড়ে ছিল, জীবনে এই প্রথমবার আজ জরুরি কাজেও হাত দেয়নি সে। ঘড়ির কাটা কখন যেন পৌনে বারোটায় পৌঁছে গেছে, হয়তো তাও কুহেলির খেয়াল হত না কিন্তু ফোনটা টুং টং শব্দে নিজের অস্তিত্ব জানান দিতেই হুশ ফিরল। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল অঙ্কিতের মেসেজ, আগামীকাল মিস্টার নিশীথ আগরওয়াল আসছেন। মেসেজটা পড়ে ফোনটা সরিয়ে রাখতে যেতেই আবার একটা মেসেজ ঢুকল, এবার সেই অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি।
“গুডনাইট”
মেসেজটা পড়ে কুহেলির ঠোঁটে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠল, এই অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি যে কিনা ওর সব খবর রাখে সেও আজ কুহেলির মনের খবর জানে না। মেসেজ টা ডিলিট করে ফোনটা সরিয়ে রাখল, পাশবালিশ টাকে নিজের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়ে চোখদুটো বন্ধ করল কুহেলি, কিন্তু বন্ধ চোখের পাতার আগল ভেদ করেও কুহেলির নিঃশব্দ কান্নাগুলো তপ্ত জলের ধারা হয়ে ভিজিয়ে দিতে লাগল নরম বালিশের তুলো। আজ আর ঘুম কুহেলির চোখে ঠাই পেল না, সেখানে যে এখন অকাল শ্রাবনের ধারা নেমেছে, কে জানে কখন সব কালো মেঘ কেটে গিয়ে নতুন সূর্যের আলো ফুটবে!
ক্রমশ_______________
© স্বত্ব সংরক্ষিত
এখানে একটা কথা বলা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। আমি জানি এখানে কুহেলি এবং দেবার্ঘ্যর মধ্যে সম্পর্কের যে বাধা দেখানো হয়েছে সেটা সর্ব ক্ষেত্রে বাঁধা নয়। আমাদের সমাজে ভিন্ন পরিবারের ভিন্ন ভিন্ন মূল্যবোধ থাকে, এবং সকলে সেটাই মেনে চলে। এখানে যে ঘটনা টা আমি দেখালাম সেটা আমার এক খুব নিকট আত্মীয়ের সঙ্গে ঘটেছিল বলেই আমি জানতে পেরেছিলাম। তাই আগেই বলছি এটা সকলের মনঃপূত নাও হতে পারে। যাইহোক আজ আর কিছু বলব না। শুধু আপনাদের প্রতিক্রিয়ার অপেক্ষায় থাকব। কেমন লাগল আজকের পর্বটা জানাবেন কিন্তু। কুহেলির প্রথম প্রেম অঙ্কুরেই ঝরে গেল, আবার সে বন্ধ করে নিয়েছে নিজের মনের দরজা। কি মনে হয়? আবার কি কোনোদিনও কারোর জন্য খুলবে সেই বন্ধ দরজা? আমি তো জানি না, আপনাদের কি মনে হয় জানাবেন অবশ্যই। দেখা হবে আগামী পর্বে ততদিন পর্যন্ত পড়তে থাকুন ভালো থাকুন।