সত্য পিঞ্জর পর্ব : ১১

0
635

‘সত্য পিঞ্জর’
পর্ব ১১.
তাবিনা মাহনূর

__________

ফাতিহার বাবা মা এসেছেন। রিশতাকে দেখে ফাতিহার মা মঞ্জুরি বেগম বারবার ‘বারাকাল্লাহ ফিকি’ বলছেন। তার ধারণা, নজর লেগে মেয়েটার চেহারা নষ্ট হয়ে যাবে। রিশতা সবার জন্য চা বানাতে গেলে মঞ্জুরি আনিকাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বউ কি অল্প কথা বলে?’

আনিকা হেসে উত্তর দিলো, ‘জি আন্টি। সবার সাথেই অল্প অল্প কথা বলে। কিন্তু সবসময় হাসে। সুন্দরী গল্প শুনতে বেশি ভালোবাসে। আপনি যা বলবেন, সেটাই মনোযোগ দিয়ে শুনবে।’

মঞ্জুরি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আরশও তো শান্ত শিষ্ট?’

আনিকা বললো, ‘জি আন্টি। আরশ আরো অল্প কথা বলে। দুজনেই খুব শান্ত। মনেই হয় না বাসায় ওরা আছে।’

চিন্তিত হলেন মঞ্জুরি। কণ্ঠে তা প্রকাশ করে বললেন, ‘কী বলো মা? দুজন যদি কথাই না বলে তাহলে ওদের মধ্যে কেমিস্ট্রি হবে কীভাবে?’

হেসে উত্তর দিলো আনিকা, ‘আন্টি, কেমিস্ট্রি ফিজিক্স লাগবে না। বায়োলজি ঠিকঠাক হলেই হবে। না মানে ইয়ে…’

আনিকার কথা শুনে ফাতিহা, আমান দুজনেই হেসে উঠলো। রিশতা ঘরে নেই শুনে আমান এসেছে শাশুড়ি মায়ের সাথে দেখা করতে। এসে বোনের মুখে বেফাঁস কথাবার্তা শুনে সে শব্দ করে হেসে ফেললো। ফাতিহা আনিকার কাছে গিয়ে বললো, ‘চিন্তা করো না। আমার মা বায়োলজি বুঝবেন না। কেমিস্ট্রি শব্দটা নাটক দেখে শিখেছেন। মা! নাটক দেখা বন্ধ করো তো। এসব ভালো না।’

মঞ্জুরি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, ‘তুই জানলি কী করে এগুলো নাটকে থাকে? তুইও দেখিস তারমানে!’

মা মেয়ের খুনসুটি চলছে। আমানকে পেয়ে মঞ্জুরি জামাইয়ের খোঁজখবর নেয়া শুরু করলেন। আমানের দুই ছেলে মুয়াজ আর মুসআব নানীর কোলে বসে চকলেট খাচ্ছে।
এই ফাঁকে আনিকা বেরিয়ে গেল। তার বেশি কথা বলার অভ্যাসের কারণে সে এরকম বিপাকে বেশ কয়েকবার পড়েছে।

_____

দিন গড়িয়ে যায়, রিশতা আর আরশের সম্পর্কে দূরত্ব কমছে। তবু একটা সংকোচ থেকে যায়। রিশতা সবার সাথে যেমন হাসিমুখে কথা বলে, আরশের সাথেও তার কথোপকথন শুরু হয় মিষ্টি হাসি দিয়ে। কিন্তু আরশের বুকে শূন্যতা কাজ করে। রিশতা আজও বলেনি, ‘আপনার বুকে মাথা রাখি?’ তার হাত ধরে তার চোখে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে না রিশতা। তার লাজুক হাসিমাখা মুখ আরশ দেখেনি। এ অপূর্ণতা কবে কাটবে আরশের জানা নেই।

অফিসের কাজের চাপে দিনগুলো ব্যস্ততায় কাটছে তার। বকুল ফুলের মালা গাঁথা হয়নি। শুকনো পরে থাকে টেবিলের উপর। রিশতা সেগুলো পানির মধ্যে রেখেছিল। কিছুদিন সুগন্ধ ছড়িয়েছে, এরপর তা নেই। ঠিক আরশের অনুভূতির মতো। প্রাণবন্ত আরশ এখন বিয়ের আগে যেমন নিরামিষ ছিল, তেমনই গম্ভীর হয়ে গিয়েছে। রিশতার হাসি দেখলে সেই গম্ভীরতা কেটে যায়। তখন সেও মুচকি হেসে রিশতার গল্প শোনে।
কিন্তু যখন পড়ন্ত বিকেলের গোধূলি আভা রিশতার কপোলে রক্তিম বর্ণের সৃষ্টি করে, তখন তার মাঝে সুপ্ত সত্তা জাগতে চায় বারবার। সেই সত্তাকে দমিয়ে রাখতে সে গল্পের সমাপ্তি ঘোষণা না করেই চলে যায় কাজে। রিশতা তখন মন খারাপ করে আনিকার কাছে চলে যায়। আরশ রিশতার মনে অনেক কষ্ট করে জায়গা নিয়েছে। এতো দ্রুত নিজের চাহিদা মেটাতে রিশতার মতো বন্ধু হারাতে চায় না সে।

এভাবেই চলছে যান্ত্রিক সংসার। এই সংসারে রিশতা চেয়েছে একজন বন্ধু, যেটা সে পেয়েছে। আরশ চেয়েছে বন্ধু ও সহধর্মিণী। বন্ধু পেলেও দ্বিতীয়টা পাওয়া হয়ে ওঠেনি তার। রিশতা এখন আর রুদ্রর কবর দেখতে যায় না। সময়টা সে ইস্তেগফার করে কাটায়। এটা আরশের শেখানো। রিশতার প্রত্যাবর্তন হয়েছে, অথচ সে ইস্তেগফার করে না। বিষয়টা রিশতার মাথাতেই ছিল না যে আগের গুনাহ গুলোর জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে।

আজ বন্ধুদের সাথে দেখা করতে গিয়েছে আরশ। পিয়াস, ইমরান, গালিব, ত্বহা, প্রত্যেকের সাথে দেখা হয়ে মনের অশান্তি অনেকটা কমে গিয়েছে তার। তবে সমস্যা শুরু হলো দুষ্টু বন্ধু গালিবের কথায়।

– দোস্ত, তুই একদম ভ্যাবলা। তোর বউ চঞ্চল তো?

আরশের নির্বিকার উত্তর, ‘না।’

গালিব উপহাস করে বললো, ‘যা ব্যাটা! এখন আবার বলিস না তোদের সম্পর্ক কুমার কুমারীর মতো।’

সবাই হেসে উঠলেও এই আলোচনা একদম পছন্দ নয় আরশের। ব্যক্তিগত ব্যাপারগুলো খোলামেলা আলোচনা করা তার কাছে ব্যক্তিত্বহীনদের কাজ বলে মনে হয়। এসব প্রয়োজনে ডাক্তার কিংবা ভালো পরামর্শককে বলা যায়। সবার কাছে বলে বেড়ালে নিজের হায়া বলে কিছু থাকে না।

আরশ বেশ বিরক্ত হয়ে বললো, ‘এগুলা বন্ধ কর।’

গালিব এবার কণ্ঠে গুরুত্ব প্রকাশ করে বললো, ‘দোস্ত, সত্যি করে বল তো সব ঠিক আছে তোদের? দেখ এটা বন্ধু হিসেবে তোর ভালোর জন্যই জানতে চাইছি।’

আরশ কিছুই বললো না। এতেই সবাই বুঝে গেল। পিয়াস বললো, ‘কিরে? তোর বউ আগের স্বামী নিয়ে কল্পনায় থাকে নাকি?’

আরশ বড়সড় উত্তর জানালো, ‘না। আমার স্ত্রী সবই বুঝতে পারে। মাঝে মাঝে আমার দিকে মন খারাপ করে তাকিয়ে থাকে। আমি জিজ্ঞেস করি কিছু হয়েছে কিনা। সে উত্তর দেয় না। আরেকবার বলেছিল, আমি তাকে বোঝা মনে করি কিনা।’

ত্বহা প্রশ্ন করলো, ‘তুই কি বললি?’

– কখনোই বোঝা মনে করি না।

গালিব বিরক্ত হয়ে বললো, ‘ধুর ব্যাটা! তোর বলা উচিত ছিল, বোঝা মনে করি না। কিন্তু আমার ভেতরে একটা বোঝা আছে। সেটা তুমিই প্রশমন করতে পারো!’

সবাই হেসে উঠলেও আরশ চুপ করে থাকলো। তার মোটেও ভালো লাগছে না। সবার হাসি থামলে সে বললো, ‘একজন বন্ধু পেয়েছি আমি। অফিসের কাজের বাইরে মনের কথা বলার মতো একজনকে চেয়েছিলাম। সেটা পেয়েছি আলহামদুলিল্লাহ! জোর করে নিজের আশা পূরণ করে তার বিশ্বাস হারাতে চাই না আমি।’

গালিব আবার বললো, ‘হ, পরে কুমার হয়েই জীবন কাটানো লাগবে। তুই কতদিন থাকতে পারবি জানি না। পরে মানুষ বলবে তোর সমস্যা আছে।’

আরশের মুখ শক্ত হয়ে এলো। ভয়াবহ বাজে কথাগুলো সে সবসময় এড়িয়ে চলে। এগুলো বলে বেড়ানো ইসলামও সমর্থন করে না। তাই আরশ এ ব্যাপারে বরাবরই কঠোর। এখন এখানে থাকার ইচ্ছেটা নষ্ট হয়ে গিয়েছে।

ইমরান জানে আরশ ব্যক্তিগত বিষয়ে কথা বলতে খুব অপছন্দ করে। আরেকটু গভীরে গেলে হয়তো আসর ছেড়ে উঠে চলে যাবে। সে আরশের মুখ দেখে বুঝে গেল সমস্যা শুরু হতে চলেছে। তাই সে দ্রুত অন্য প্রসঙ্গ এনে রিশতার ব্যাপারটা এখানেই বন্ধ করলো।

কিন্তু আরশের মন থেকে রিশতা মুছে গেল না আলাপের মাঝেও। স্বল্প কথোপকথন সেরে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হলো সে। আজ সবাই জামিলের বাড়ি গাজীপুর গিয়েছে। আরশের অফিসের কাজ শেষ করতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। তাই ওই বাড়ির আয়োজনে সে যায়নি, রিশতাকে যেতে বলেছে। গাজীপুর থেকে ফিরতে বেশ সময় লাগবে তাদের। তাই অফিস থেকে বেরিয়ে বন্ধুদের সাথে দেখা করতে গিয়েছিল সে। কিন্তু রিশতা তাকে ফোনে ম্যাসেজ করেছে, ‘কোথায় আপনি?’

এই প্রথম রিশতা তার খোঁজ নিলো যত্ন মাখা ম্যাসেজে। এই দুই শব্দের বার্তা আরশকে বাসায় যাওয়ার তাগিদ জানালো। রিকশায় চড়ে বাসার দিকে রওনা হলো সে। মেঘলা আকাশ, ডিসেম্বর হওয়া সত্ত্বেও বৃষ্টি বৃষ্টি ভাব। আল্লাহর কাছে এখনই ঝুম বৃষ্টি না দেয়ার আবেদন পেশ করলো আরশ। বাসায় পৌঁছে তালা খোলা দেখে প্রথমে ভয় পেলো সে। পরক্ষণেই রিশতার ম্যাসেজের কথা ভেবে সে কলিং বেল বাজালো। তার অবচেতন মন রিশতার উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। রিশতা দরজা খুললে চমকে উঠলো আরশ।

– কখন থেকে বসে আছি! রাত হয়ে গেল তবু আসার নাম নেই উনার।

রিশতা দরজা ছেড়ে ডাইনিং রুমের দিকে এগিয়ে গেল। তড়িঘড়ি করে ওভেনে নাস্তা গরম করতে দিয়ে চুলায় থাকা পাতিলে ভাত উতলে পড়ছে কিনা তা দেখতে চলে গেল। আরশ ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে বললো, ‘আপনি বাসায় আছেন আমি জানতাম না। আমাকে জানালে আরো আগে আসতাম।’

কথা বলছে না রিশতা। আরশ অপলক তাকিয়ে দেখছে, ঘরের বউয়ের মতো রিশতা পটু হাতে কাজ করছে। গায়ে জড়ানো সাদা তাঁতের শাড়ি, লাল রঙের ঘটি হাতার টপ। হাতে নতুন করে মেহেদী পরেছে যা টকটকে লাল রং হয়ে আছে। লম্বা বেনি করা চুলের উপরের অংশে সাদা রঙের কয়েকটা চন্দ্রমল্লিকা ফুল। রিশতা একবার আরশের দিকে তাকিয়ে আবার কাজে ব্যস্ত হয়ে বললো, ‘ফ্রেশ হয়ে নিন। নাস্তা খাওয়ার পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিবেন। তারপর রাতের খাবার দিব।’

নাস্তা খেয়ে ফিরেছে আরশ। তবু রিশতার বানানো লুচি আর আলুর দম খেলো সে। ভরা পেটে আবার খাবার, খেতে মোটেও খারাপ লাগেনি তার। সে শুধুই দুআ করে যাচ্ছে, আজ যেন কেউ বাড়িতে না আসে।

ঝুম বৃষ্টি নেমেছে। শীতের দমকা হাওয়ার সাথে বৃষ্টির ঝিরঝির জলবিন্দু রিশতা জানালার বাইরে হাত রেখে উপভোগ করছে। রাত প্রায় দশটা বাজে। আরশ রাতের খাবার খাবে না। অফিস থেকে ফিরে সে প্রতিদিন ক্বুরআন হাদিসের সাথে থাকে। অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ সবকিছুকে দ্বীন দ্বারা বিশ্লেষণ করে। এখনো তার সময় কাটলো রাসূলের জীবনী নিয়ে। ঘন্টা খানেক পর সে প্রশ্ন করলো, ‘ওরা এখনো আসছে না কেন? একটা ফোন করে দেখি।’

রিশতা বৃষ্টির জলধারায় হাত বাড়িয়ে বললো, ‘আজ আসবে না কেউ।’

চমকে তাকালো আরশ। একের পর এক ঘটনা তাকে বিস্মিত করছে। কিছুক্ষণ পর সে আবারো হতবাক হলো রিশতার কথায়, ‘ছাদে যাবেন?’

জলবিন্দুর অক্লান্ত ধারায় হারিয়ে যায় হৃদজগৎ। আরশের সামনে অপূর্ব দৃশ্য। সাদা শাড়ির মোহিনী নারী যেন কোনো মানবী নয়। ঘোর তিমিরের নীলচে কালো মেঘগুলোর মাঝে একগুচ্ছ শুভ্র মেঘ লুকিয়ে ছিল। সেই মেঘ নেমে এসেছে মাটিতে, আরশের সামনে। এখানেই তার একাকী বিচরণ যা শুধু আরশের চক্ষুদ্বয় প্রশান্ত করছে। সেই শীতলকারিণী! যাকে নিয়ে আরশ শুধু বলতো, ‘আমি আমাকে পেতে চাই আল্লাহ!’

আরশ নিজেকে পেয়েছে। প্রাণ চঞ্চল অপরূপার পেলব হাত দুটো তাকে বারিপাতের সাক্ষী করতে চাইলো। দুজন ভিজছে। আরশ স্তব্ধ চেয়ে আছে, আর রিশতার অশান্ত মনের প্রকাশ ঘটছে। ভয় হলো আরশের। তার অন্য সত্তাকে সে চোখ বন্ধ করে শাসালো। কিন্তু হঠাৎ এক জোড়া হাত তার হাতের মুঠো ধরে বললো, ‘ভালো লাগছে?’

চোখ খুললো আরশ। খুব মায়াবী আঁধারে শ্রেয়সীর ছলছল সবুজ নয়ন জোড়ায় উজ্জ্বলতা ছড়িয়ে আছে। তার নেশা কাটে না। গম্ভীর কণ্ঠে উত্তর দেয়, ‘হুম।’

মিষ্টি হাসলো রিশতা। হঠাৎ আরশের প্রশ্ন, ‘আপনি কি ছোট বাবু ভালোবাসেন না?’

রিশতার মুচকি হাসির উত্তর, ‘অবশ্যই!’

আরশ আবারো প্রশ্ন করলো, ‘আপনার কি মনে হয় না, আপনার একটা ছোট্ট মেয়ে থাকলে কত আনন্দের হতো সময়গুলো?’

হাত ছেড়ে উত্তর দিলো রিশতা, ‘না!’

মুহূর্তেই সময়টা থমকে গেল আরশের। চোখ বুজে সে নিজেকে তিরস্কার করলো, ‘কেন নষ্ট করছিস সুন্দর সময়টা? নূরজাহান যে ভুল বুঝবে!’

কিন্তু তার বুকের তোলপাড় আরো বাড়িয়ে হঠাৎ জড়িয়ে ধরলো রিশতা। দুই হাত দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে তার বুকে চিবুক ঠেকালো। মুচকি হেসে তার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘আমার মনে হয়, আমার যদি একটা সন্তান থাকতো!’

__________

(চলবে ইন শা আল্লাহ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here