সত্য পিঞ্জর পর্ব : ১২

0
660

‘সত্য পিঞ্জর’
পর্ব ১২.
তাবিনা মাহনূর

__________

ঘুম রাজ্য থেকে জাগ্রত রাজ্যে ফিরে এলো রিশতা। ধীরে ধীরে চোখ খুলে দেখলো, আরশ বারান্দার দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে কফি পান করছে। রিশতা দুই হাত নাড়িয়ে আড়মোড়া ভেঙে ঘড়ির দিকে তাকালো। সকাল সাড়ে নয়টা বাজে। ঘড়ির সময়টা দেখে প্রথমেই তার মাথায় এলো, আজ ফজরের সালাত কাযা হয়ে গিয়েছে!

দ্রুত উঠে বসলো সে। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো আরশের দিকে। আরশ এক চুমুক কফি পান করে একবার রিশতার ঘুম ঘুম মুখশ্রী দেখে আবার কফি পানে মনোযোগ দিলো। না তাকিয়েই বললো, ‘নরম সুরে কতবার ডাকলাম। কোনো সাড়া নেই। কান লাল করে ফেললাম, তাও উঠে না। এখন নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। সালাতটা…’

দুম করে দরজা লাগিয়ে দেয়ার আওয়াজ এলো। আরশ মুচকি হেসে ল্যাপটপ নিয়ে সোফায় বসে পড়লো। আজ সে অফিসে যাবে না। গেলেও দুপুরের পর যাওয়ার চিন্তা ভাবনা আছে তার।

ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এলো রিশতা। সালাত পড়ে দেখলো আরশ ফোনে কথা বলছে। কথার মাঝে জানতে পারলো, আজ আরশ দুপুরের পর অফিসে যাবে। সে দ্রুত রান্নাঘরে গিয়ে সকালের নাস্তা তৈরির আয়োজন করলো। গতকাল রাতের খাবার যা আছে তা দিয়ে দুপুরের খাওয়া দাওয়া হয়ে যাবে। আনিকাদের আসতে বিকেল হবে। জামিলের মা আজও দুপুরের খাবার না খাইয়ে আসতে দিবেন না। কাল যখন সবাই যাওয়ার জন্য তৈরি হলো, তখন রিশতা যেতে চাইলো না। আনিকাকে কথাটা বললে সে রিশতার হাত ধরে সেসময় অনেককিছু বুঝিয়েছে।

আনিকা জিজ্ঞেস করেছিল, ‘আমাকে সত্যি করে বলো তো তোমাদের সম্পর্ক কেমন?’
রিশতার উত্তর ছিল, ‘বন্ধুর মতো।’

আনিকা হেসে বলেছিল, ‘শোনো রিশতা, স্বামী স্ত্রী বন্ধু হলে খুবই ভালো কথা। কিন্তু এটা যদি বন্ধুত্বের সম্পর্ক হতো তাহলে বিয়ের কোনো প্রয়োজন ছিল না। আমার সাড়ে ছয় বছরের সংসারে তোমার ভাইয়া আমাকে কোনোদিন কটু কথা বলেননি। কিন্তু আমি তার মন খারাপ দেখেছি। তার খিটখিটে মেজাজ দেখেছি। আমি বুঝতে পারতাম সন্তান না থাকার কষ্ট তিনি আমার উপর চাপিয়ে না দিলেও, মনে মনে ঠিকই দুঃখ পাচ্ছেন। আমাকে তুমি বলো, তোমার একটা সন্তান থাকলে কি তুমি এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে?’

– না আপু। আমার সন্তান থাকলে কখনোই বিয়ে করতাম না।
– সিঙ্গেল মাদার হিসেবে বেঁচে থাকা এখন খুব কঠিন বিষয়। তবু হয়তো তুমি চাইতে না তোমার সন্তান অন্য বাবার কাছে বড় হোক। কিন্তু তুমি এখনো একই পথে হাঁটছো। আমার ভাই বিয়ের পর যেমন প্রফুল্ল ছিল, এখন তা নেই। সে খুব চেষ্টা করে যাচ্ছে তোমার মন পাওয়ার, কিন্তু প্রতিদিন তাকে ব্যর্থ মনে হচ্ছে।

রিশতা মাথা নিচু করে আনিকার বলা উপদেশ শুনেছে। আনিকা তার উপর কিছুই চাপিয়ে দেয়নি। সে বলেছে, ‘আমার কথাকে চাপ হিসেবে নিও না। এটা আমার ভাইয়ের বিষয় না শুধু, এটা তোমারও ভবিষ্যৎ এর ব্যাপার। আজ কেউ নেই, তোমরা এই সময়টা সুন্দর করে কাটাও অথবা আরশকে নিজের ধারণা সম্পর্কে জানাও। তুমি তাকে নিয়ে কি ভাবো সেটা তাকে বলো সুন্দরী!’

তখনই রিশতা বলেছিল, ‘আপনার কি সাদা শাড়ি আছে আপু? আমার এক রঙা সাদা শাড়ি নেই।’

আর আজ সে ঘরণী হয়ে কাজে ব্যস্ত। এতে তার কোনো মন খারাপ হচ্ছে না। একা একা সামলাতে গিয়ে তার মর্জিনা খালার কথা মনে পড়লো। হয়তো হিশামের নামে থাকা বাড়িটা ডেভেলপারদের হাতে দিয়ে দিবেন আজমেরী। মর্জিনা কোথায় যাবে?

– আপনার স্কুল নেই আজ?

রান্নাঘরে আরশ দাঁড়িয়ে আছে। রিশতা সেদিকে তাকিয়ে বললো, ‘স্কুল আছে, চাকরি নেই।’

অবাক হলো আরশ, ‘কেন!’

রিশতা কাজ করতে করতে উত্তর দিলো, ‘অনুষ্ঠানে মেয়েরা নেচেছে। জমিদারের সামনে মনোরঞ্জন করে যেমন করে, ওদের নাচটা তেমনই লেগেছে আমার। গণ্য মান্য ব্যক্তিদের জন্য নাচ গান করেছে। ওদেরকে এ ব্যাপারে বুঝিয়ে বলেছিলাম ক্লাসে। পরেরদিন প্রিন্সিপাল ডেকে বললেন, আমি নাকি বাঙালি সংস্কৃতি নিয়ে অপব্যাখ্যা দিয়েছি। ব্যাস! চাকরি চলে গেল।’

আরশের খুব হাসি পেলো রিশতার বলার ভঙ্গি দেখে। হেসেও ফেললো সে। তার হাসি দেখে রিশতা মিথ্যে রাগ দেখিয়ে বললো, ‘আমার চাকরি নেই, আর তুমি হাসছো?’

চমকে উঠলো আরশ, ‘আর চমকে দিবেন না প্লিজ। কাল থেকে অবাক হতে হতে কখন যে অজ্ঞান হয়ে যাই!’
মুচকি হেসে রিশতা বললো, ‘আমার যখন প্রেম প্রেম পাবে, তখন তুমি করে ডাকবো। আর সবসময় আপনি।’

রিশতার কাছে গিয়ে আরশ বললো, ‘এখন কি প্রেম প্রেম পাচ্ছে?’
তাকে ধাক্কা দিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেল রিশতা। যেতে যেতে বললো, ‘না। একটু আগে পাচ্ছিলো। আপনি সকালের নাস্তা খেয়ে নিন। দেরি হয়ে যাচ্ছে।’

নাস্তা খাওয়ার মাঝে আরশ আজকের খবর জানালো রিশতাকে। আজ নির্বাচনে পদপ্রার্থীদের মনোনয়ন সম্পর্কে জানা যাবে। আরশের ধারণা, এখানে যে টিকে থাকবে তাকে সন্দেহ করা যায়। কেননা যে বাদ পড়বে, সে দলের অন্যান্য লোকদের দৃষ্টিতে নিশ্চয়ই অযোগ্য হবে। আর এটা সে জেনে থাকলে আজিমুপর কবরস্থানে ঘটে যাওয়া কাহিনীর মতো ঝামেলায় জড়াতো না। তবে রিশতা বললো অন্য কথা।

– ধরুন লাবিব জামান মনোনয়ন পেলেন না। কিন্তু তিনি যে আতিক ও ভুবন হত্যাকাণ্ডে জড়িত না, এটা বলা যায় না। কেননা এই ঘটনা দেড় মাস আগের। তখন দলের মানুষদের অভিব্যক্তি বুঝতে পারলে লাবিব হয়তো পদপ্রার্থীই হতেন না। ঠিক একই কাজ আফজালের সাথে। আফজাল যদি মনোনয়ন না পান তাহলে উনি নির্দোষ, এ কথা বলা যায় না।

রিশতার কথার পৃষ্ঠে আরশ বললো, ‘হুম, এটা ঠিক বলেছেন। কিন্তু এই মনোনয়ন পাওয়া না পাওয়ার উপর নির্ভর করছে অনেক কিছু।’

রিশতা কিছুক্ষণ চিন্তা জগতে বিচরণ করে আরশকে বললো, ‘আপনি সজলকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন?’

– না। এটার দায়িত্ব কার্তিক স্যারের উপর ছিল।
– তবু আপনি ভালোভাবে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। আর ইমামকেও ছাড়বেন না। প্রত্যেককে জিজ্ঞেস করবেন।
– এতে লাভ?
– আমার ধারণা এদের কারো না কারো কাছে আপনি তথ্য পাবেন যেটা আপনার কাজে আসবে।

আরশ খাওয়া শেষ করে বললো, ‘ঠিকাছে। আমি রাজীব ভাইকে বলে ম্যানেজ করবো বিষয়টা। সজলকে আগে ধরবো। সে আতিকের ফোন পেলো, সেটা চোরাই বাজারে বিক্রি করলো। অথচ ভুবনের ফোন পেলো না!’

রিশতা সন্দেহ প্রকাশ করে বললো, ‘হতে পারে পেয়েছে এবং লুকিয়ে রেখেছে, কিন্তু স্বীকার করছে না।’

– হুম, জোরালো জিজ্ঞাসাবাদ চালাতে হবে। আমি আজ দেরি করে ফিরতে পারি। আপনি একা থাকতে পারবেন?
– তা পারবো, আর আনিকা আপুরা তাড়াতাড়ি চলে আসবে।

আরশ হাত মুখ ধুয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে যাচ্ছে। কিন্তু উপরে না গিয়ে সে আবার নীচে নামলো। রিশতার কাজে সাহায্য করতে করতে বললো, ‘চাকরির বেতন কত ছিল আপনার? কিছু মনে করবেন না…’

রিশতা তাকে থামিয়ে বললো, ‘এভাবে বলছেন কেন? আপনি জানতেই পারেন। বিশ হাজার পেতাম আলহামদুলিল্লাহ। প্রথমে পনেরো ছিল। পরে ক্লাসের সংখ্যা বেড়ে গেল বলে টাকাও বেড়ে গেল।’

আরশ আর কিছু বললো না। দুপুরের খাবারের পর সে তৈরি হয়ে অফিসে চলে গেল। রিশতা বিকেলের নাস্তা আর রাতের খাবারের একটা আয়োজন মনে মনে সাজিয়ে রাখলো। আজ নাজিফা কিংবা ফাতিহা, কাউকেই সে রান্নাঘরে ঢুকতে দিবে না। তারা ক্লান্ত হয়ে আসবে বলে সে রান্নার দায়িত্বটা আজ নিয়ে নিলো।

আনিকাকে ফোন করে খোঁজ নিয়ে রিশতা ঘরে গেল। সেসময় ফোনে একটা ম্যাসেজ দেখলো যেটা আরশ বের হওয়ার পরপরই পাঠিয়েছে। তাতে লেখা, ‘প্রথম ড্রয়ার খুলে একটা নীল খাম দেখবেন। সেটা আপনার।’

রিশতা ড্রয়ার খুলে খামের সাথে একটা চিঠি পেলো।
চিঠিতে লেখা,
‘চাকরি যেহেতু চলেই গিয়েছে তাহলে আর চাকরি করার দরকার নেই। আমি বেঁচে আছি, আমিই খাওয়াবো। নাহলে আপনাকে ঘরের বাইরে কষ্ট করতে দেয়ায় আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতার সম্মুখীন হতে হবে। আপনার বেতনের পরিমাণ টাকা দেয়ার সামর্থ্য এখনো হয়নি নূরজাহান। তবে অর্ধেকটা দিলাম। এটা একান্তই আপনার। প্রয়োজনীয় সব দায়িত্ব আমার। সুতরাং এই টাকা আপনি প্রয়োজনে নয়, নিজের পছন্দ অনুযায়ী খরচ করবেন। তবে খেয়াল রাখবেন অপচয় যেন না হয়।
হাত খরচ দেয়াকে ছোট মনে করবেন না দয়া করে। এটা একটা সম্মানী। আমার স্ত্রীকে আমি ভালোবেসে উপহার দিতে পারি। এটা তেমনই উপহার যা দিয়ে আপনি আপনার শখ পূরণ করবেন।
ইফতিখার’

রিশতা মুচকি হেসে টাকা বের করলো। সেখানে দশ হাজার টাকা রাখা। সে এখান থেকে পাঁচ হাজার টাকা মর্জিনাকে দিবে। মনে পড়লো তার, আগামী সপ্তাহে মেঘের দেশে আসতে পারে। তখন সিদ্ধান্ত নেয়া হবে, বাড়িটার গতি কি হবে। এর উপর নির্ভর করছে মর্জিনার আশ্রয়।

_____

লাবিব মনোনয়ন পাননি। সাংবাদিক মহলে এ নিয়ে আলোচনার ঝড় চলছে। আজিমপুর কবরস্থানের ঘটনার পর সবার ধারণা ছিল, আফজালকে মনোনয়ন দেয়া হবে না। তার বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ তুলেছিল এলাকাবাসী। অথচ আফজালকে দলের লোকজন কেন এতো যোগ্য মনে করছে তা ভেবে কোনো কূল পেলো না কার্তিক। তার সামনে এখন আরশ আর জাহাঙ্গীর বসে আছে। তিনি কপাল কুঁচকে বললেন, ‘নাহ! এই ইলেকশন আর কেসের কোনো বিষয় মাথায় ঢুকছে না। এতো সহজ ব্যাপার, অথচ সমাধান করতে গিয়ে মাথা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।’

জাহাঙ্গীর বললো, ‘ভুবনের ফোনটা পেলে মনে হয় সমাধানের একটা পথ পাওয়া যেত।’

কার্তিক বললেন, ‘তার চেয়ে বড় বিষয়, লাবিব নাকি অত্যন্ত ভদ্র স্বভাবের মানুষ। তবু তাকে কেন উপযুক্ত মনে করা হলো না বুঝতে পারছি না। নিশ্চয়ই এমন কিছু আছে তার মাঝে যেটা দলের লোকজন ছাড়া আর কেউ জানে না।’

আরশ বললো, ‘ইনজেকশনে কার ফিঙ্গারপ্রিন্ট মিলেছে?’

কার্তিক বললেন, ‘আফজালের ড্রাইভার মকবুল। আসলে এটা অন্য বিষয়। সে ওই ইনজেকশন ব্যবহার করে মাদক নিয়েছে। ওটা প্যাকেটে ভরে আতিককে দিয়েছে। এর সাথে খুনের সম্পর্ক নেই।’

– কিন্তু মাদকের পেছনে যার হাত আছে তাকে খুনের সাথে…

কার্তিক ধমকে উঠলেন, ‘আমরা খুন নিয়ে গবেষণা করছি। মাদকের বিষয়টা আমাদের নয়।’

আরশ চুপ হয়ে গেল। সে বুঝতে পারছে না, কেন নেশাদ্রব্যের বিষয়টা হেলাফেলা করছে সবাই। সেসময় সিআইডি অনিরুদ্ধ ভেতরে ঢুকেই বললেন, ‘স্যার, চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গিয়েছে।’

কার্তিক নড়েচড়ে বসলেন। অনিরুদ্ধ আরশের পাশের চেয়ারে বসে তার কথাগুলো গুছিয়ে বললো। উপস্থিত সকলে হতবাক হয়ে গেল।

– আফজাল আর লাবিব একই দল থেকে প্রতিনিধী ছিলেন। মনোনয়ন আফজালকে দেয়া হলেও লাবিবকে দেয়া হয়নি তার কারণ, দলের লোকজন সবাই লাবিবের বিরুদ্ধে প্রমাণ পেয়েছে যা আমরা পাইনি।

জাহাঙ্গীর বলে উঠলো, ‘মানে?’

– সমস্ত ঘটনার প্রমাণ ড্রাইভার মকবুল। আফজাল সাহেবের নেশা করার অভ্যাস আছে। কাজের ছেলে আতিক আর ড্রাইভার মকবুল এই নেশার বস্তুগুলো জোগাড় করে আনতো রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে পালানো একজন মাদক পাচারকারীর কাছ থেকে। আফজালকে দিয়ে বাকিটা তারা আজিমপুর কবরস্থানে বসে অন্য নেশাগ্রস্থদের সাথে ভাগাভাগি করে নিতো। এর নিয়মিত সদস্য ছিল ভুবন।

আরশ বলে, ‘কিন্তু এ ব্যাপারে রক্ষীরা কেন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি?’

– বলছি। রক্ষী সজল ও আকিজ এ ব্যাপারে সব জেনেও কিছু বলতে সাহস পায়নি শুধুমাত্র ওদের কাছে ধারালো অস্ত্র থাকতো বলে। আর আফজাল এ ব্যাপারে জানলেও কিছু বলতেন না নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য। কিন্তু বিপত্তি বাঁধলো তৃতীয় ব্যক্তির প্রবেশের কারণে। এই তৃতীয় ব্যক্তি হলেন লাবিব।

কার্তিকের প্রশ্ন, ‘লাবিবও কি মাদকের সাথে জড়িত?’

– জি না। উনি শুধু নির্বাচনে নিজের জয় নিশ্চিত করতে চাইছিলেন। নম্র স্বভাবের পেছনে একজন পিশাচ লুকিয়ে আছে। ভুবনকে দিয়ে আতিককে খুন করিয়ে আফজালকে ফাঁসাতে চেয়েছিলেন লাবিব। ভুবন আর আতিকের হাতাহাতি হওয়ায় দুজনেই মারা যায়। এতে অবশ্য লাবিবের লাভ হয়েছে। প্রমাণ মুছে গেছে এর মাধ্যমে। এলাকায় আফজালের নামে দুর্নাম ছড়িয়ে দিলে তার দলের সদস্যরা তাকে মনোনয়ন দিতে অনিচ্ছা পোষণ করবে বলেই লাবিব ধারণা করেছিলেন। কিন্তু সদস্যরা আফজালকে চিনে ভালো। তাদের ধারণা ছিল আফজাল আর যাই করুক না কেন, তিনি খুনের সাথে জড়াবেন না। কেননা লাবিব রাজনীতির দুনিয়ায় নতুন। আর আফজাল প্রায় পনেরো বছর ধরে আছেন। সুতরাং এই কাঁচা কাজ লাবিবের দ্বারাই সম্ভব।

আরশ বললো, ‘কিন্তু আমরা ধারণা করেছিলাম আতিককেও হয়তো ভুবনকে মেরে ফেলার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তা নাহলে ধারালো ছুরি…’

তাকে থামিয়ে দিয়ে অনিরুদ্ধ আবার বললো, ‘ওটা আতিকের কাছে সবসময় থাকে। মাদকের সাথে জড়িয়ে থাকায় আতিক নিজেকে নিরাপদ মনে করতো না। এজন্য অস্ত্র রেখে দিতো।’

জাহাঙ্গীর প্রশ্ন করলো, ‘কিন্তু প্রমাণ হলো কীভাবে যে লাবিব এই কাজ করেছে?’

– ড্রাইভার মকবুলের ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়ার পর আমরা বিষয়টা আমলে নিইনি কারণ এটা তাদের মাদক দ্রব্য সেবনের কৌশল ছিল শুধু। কিন্তু এখানেই ঘটেছে মূল ঘটনা।

কার্তিক জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি ঘটনা?’

– মকবুল সেটা ব্যবহারের পর সেখানে অজ্ঞান করার ইফেক্টিভ মাদক রেখেছিল যেটা আতিক কখনোই ব্যবহার করেনি। ওটা ব্যবহার করার কারণে আতিক দুর্বল হয়ে পড়েছিল, এবং সহজেই তাকে খুন করা গিয়েছে। তবে ভুবন মারা গিয়েছে কারণ আতিকের ছুড়িতে বিষ মাখানো ছিল। এটা আতিকের নিজস্ব কৌশল।

কার্তিক আবার বললেন, ‘মকবুল সব স্বীকার করেছে?’

– হুম। প্রতিমন্ত্রী মনিরুজ্জামান এ ব্যাপারে সরাসরি আমার সাথে কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, লাবিবকে দল থেকে বহিষ্কার করা হবে কিন্তু কোনো মামলায় জড়ানো হবে না। এই প্রতিজ্ঞায় মকবুল সব স্বীকার করেছে। মূলত মকবুল লাবিবের পুরোনো বাড়ির কেয়ারটেকার। সমস্যা শুধু আফজালকে নিয়ে। তিনি চাইছেন লাবিবকে পুলিশের হাতে দিতে। দলের মানুষ তা চাইছে না শুধু শুধু ঝামেলার সূত্রপাত হবে বলে। আর সাংবাদিক নামের জোঁক তো আছেই।

পুরো ব্যাপারটা আরশের অদ্ভুত মনে হলো। সে প্রশ্ন করলো, ‘কিন্তু ইফেক্টিভ মাদকের বিষয়টা ফরেনসিক রিপোর্ট ছাড়া জানলেন কীভাবে?’

– রিপোর্ট ছাড়া জানবো কেন? ইনজেকশনে সেটা ছিল এই রিপোর্ট তো সবার জানা।

অবাক হলো আরশ, ‘আমি তো জানতাম না!’

তিনজন আরশের দিকে এমনভাবে তাকালো যেন সে এই কেসের সাথে কোনোভাবেই যুক্ত ছিল না। আরশ বুঝতে পারলো, তার কাজে অনেক গাফিলতি হয়েছে। এই খামখেয়ালির কারণে তাকে সিআইডি ডিপার্টমেন্টের লোকজন কেস সম্পর্কিত তথ্য জানানোর কোনো প্রয়োজনই মনে করেনি। তাকে শুধু বিভিন্ন জায়গায় পাঠানোর কাজ দেয়া হয়েছে তার তরুণ বয়সের কারণে। আরশের কাছে বিষয়টা অপমানজনক মনে হলো।

কার্তিক, জাহাঙ্গীর, অনিরুদ্ধ নিজেদের আলাপে ব্যস্ত। আরশ নামের কেউ যে এখানে বসে আছে তা যেন তাদের দৃষ্টির বাইরে। আরশ চুপচাপ শুনে গেল। কোনো মন্তব্য করলো না। আলোচনা শেষ হতেই সে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়িতে ফিরে এলো।

বাড়ির লোকজন সবাই এসেছে। জামিল আজ এখানে থাকবে। আরশ মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে নিজের কর্মবিমুখতার কারণে। তার সব ক্ষোভ এখন পরিবারের উপর, এমনকি রিশতার উপরেও রাগ চড়ে বসেছে। সে বিয়ে করতেই চায়নি এসব কারণে।

কিন্তু রাগটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না রিশতার মুচকি হাসি দেখে। এই হাসি আজ অন্যরকম যা কাল সকালেও ছিল না। কাল ছিল বন্ধুত্বের আন্তরিক হাসি, আজ অর্ধাঙ্গিনীর লাজুক হাসি। আরশ অফিসের পোশাক পরেই বিছানায় শুয়ে পড়লো। তার মাথার কাছে রিশতা বসলে সে রিশতার কোলের উপর মাথা এলিয়ে বললো, ‘ভালো লাগছে না নূরজাহান।’

_____

(চলবে ইন শা আল্লাহ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here