#সন্ধ্যে_নামার_আগে
#লেখিকা_সুমাইয়া_জাহান
#পর্ব_১৬
(৩৪)
প্রহেলিকা ঘাঢ় আবরণে ঢাকা অলকানন্দপুরের বিস্তর ধানের খেত। চারদিক সাঁইসাঁই করে বইছে উত্তরী সমীরণ। হাঁড় কাঁপানো শীত থেকে বাঁচতে গ্রামের লোকজন রাস্তার পাশে খড় জ্বালিয়ে আগুন পোহাচ্ছে। রুমাইসা তাদের পাশ কাটিয়ে কিছুটা সামনে এগিয়ে গেলে একজন মধ্যবয়স্কা মহিলা তাকে পেছন থেকে ডাকপাড়ল। রুমাইসা ঘুরে তাঁকাতে মহিলা আগুনের পাশ থেকে সরে এসে দ্রুত তার দিকে এগিয়ে গেলো।
“ও রুমাইসা হুনলাম তোমার নাকি বিয়ার দিন ঠিক হইছে সামনের শুক্কুরবার? শুধু কি কলেমা পড়ায় বিয়া হইবো?”
মহিলা বেশ আগ্রহ নিয়ে কথাটা জিজ্ঞাস করলেও রুমাইসা একেবারেই উত্তর দিতে আগ্রহবোধ করলো না। সে নিছক মাথা দুলালো আর এতেই যেনো মহিলাটি দ্বিগুণ উৎসাহ পেলেন, তিনি আরেকটু আগ্রহী হয়ে বললেন,
“জামাই নাকি তোমার আপন মামতো ভাই? বিদেশ থেইকা আইছে, মেলা টাকা পয়সার মালিক। যাক তুমি মা মরা মাইয়া নিজের মামাতো ভাই তোমারে বিয়া করতে রাজী হইছে এইডা তো তোমার সৌভাগ্য।”
রুমাইসা প্রশস্ত শ্বাস ছেড়ে মাথা দুলিয়ে জবাব দিলে মহিলা এক গাল হেসে রুমাইসার চিবুক স্পর্শ করে বললেন,
“সুখী হ মা, সুখী হ। সারাটা জীবন তো সৎ মার লাথি ঝাঁটা খাইয়া দিন পার করছো, এইবার যদি আল্লাহ তোমার কপালে সুখ লেইখা রাখে।”
রুমাইসা চুপচাপ মহিলার কথা শ্রাবণ করছে। তার পরিবারের মতো গ্রামের কিছু মানুষ একি কথা মনে করে। তারা বিয়েটাকে সুখ বলে ভাবে। আচ্ছা, মা মরা মেয়ে হয়েছে বলে কি তার জীবনে বিয়ে ছাড়া সুখের অন্য কোনো পথ আর বাকি নেই, নাকি বিয়েই একমাত্র সুখের দ্বারপ্রান্ত?
“তা কোন দিকে যাইতে নিছিলা?”
“স্কুলে।”
অন্যমনষ্ক হয়ে জবাব দিলো রুমাইসা আর তাতেই মহিলা অবাক হবার ভঙ্গিতে কপালে ভাঁজ তুললেন। কিছুটা ভ্রুকুঞ্চন করে প্রশ্ন ছুড়লেন,
“এইডা আবার কেমন কথা, দুই দিন পর বিয়া আর আইজ তুমি ইশকুলে যাও? এমন কথা তো বাপের জন্মে হুনি নাই। তা মাইয়া মানুষ এত ইশকুলে যাইয়া কি হইবো, সেই তো বিয়া কইরা ঘর, সংসার, বাচ্চাকাচ্চা পালতে হইবো। এত পড়ালেহা কইরা কোনো লাভ কিছু হইবো?”
মহিলার কথায় খানিকটা বিরিক্ত হলো রুমাইসা। ইচ্ছে করছিলো কয়েকটা কথা শুনিয়ে দিতে কিন্তু এই মুহূর্তের তার তর্ক করতে ইচ্ছে করলো না। যে যেটা বুঝে না তার সাথে সে বিষয় নিয়ে তর্ক করা অনর্থক বলে মনে করলো সে। তাই আর কোনো কথা না বাড়িয়ে খেতের আইল ধরে হাঁটা লাগালো সে। যত দ্রুত সম্ভব তাকে রমিজের বাড়ি গিয়ে পৌঁছাতে হবে। নিজেকে বাঁচানোর শেষ চেষ্টাটুকু সে করবে। আর তাতে যা হবার হোক তবুও সে হার মানবে না। নিজের আপন লোকদের কাছ থেকে ঠকে যাবার মতো ভুল সে আর দ্বিতীয় বার করবে না।
(৩৫)
বিছানার এক কোণে তিনটি ছেড়া খাম অবহেলায় পড়ে আছে। স্মরণ ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে তোয়ালে চুল মুছতে মুছতে বিছানার একপাশটায় এসে বসলো। নিশ্চিন্দপুর থেকে রমিজ চিঠি পাঠিয়েছে। আজ থেকে প্রায় পাঁচ দিন আগে আসা চিঠি আর খুলে পড়া হয় নি স্মরণের। প্রচণ্ড ব্যস্ততায় সুযোগ করে উঠতে পারে নি চিঠিগুলো পড়ে দেখার।
হাত থেকে তোয়ালে রেখে চিঠির উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বেশ কিছু সময় বসে থেকে পরে সেখান থেকে একটা চিঠি তুলে তা পড়তে আরম্ভ করলো স্মরণ।
বরাবরের মতো এবারো রমিজ তাকে গ্রামে যাবার জন্য নিমন্ত্রণ করেছে, সাথে গ্রামের নানান সমস্যার কথাও সে জানিয়েছে। স্মরণ চিঠিতে চোখ বুলিয়ে স্মিত হাসলো তারপর দ্বিতীয় চিঠি হাতে তুলে নিলো। এই চিঠিটা আজ থেকে চারদিন আগে এসেছে। খামের উপর রমিজের নাম থাকলেও চিঠির শেষাংশে রুমাইসার নাম দেখে কিছুটা অবাক হলো স্মরণ। নিশ্চিন্দপুর ছেড়ে আসার পর রুমাইসা কখনো তাকে চিঠি লিখে পাঠায় নি, হয় তো অনেকটা অভিমান থেকে নয় তো লজ্জায়। অবশ্য রুমাইসা থেকে চিঠি পাওয়ার আশা কখনো সে করে নি। তবে মনের কোথাও না কোথাও থেকে সে চেয়েছিলো রুমাইসা তাকে চিঠি দিক।
রুমাইসার টানা হাতে লেখাগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠতেই স্মরণের বুকের বা পাশটা চিন চিন করে উঠলো। তার নামে লিখা এটাই রুমাইসার প্রথম চিঠি, যদিও এর আগে একটি চিঠি সে রুমাইসার কাছ থেকে পেয়েছিলো তবে সেটা সে একান্ত তাকেই উদ্দেশ্য করে লিখে নি। একটুকরো খোলা চিঠি যার আগাগোড়া জুড়ে শুধু প্রিয় মানুষটির অসুখের কথা লিখা ছিলো, ভাগ্যক্রমে সে চিঠি স্মরণের হাতে এসেই ধরা দিয়েছিলো। অবশ্য চিঠিটা পাওয়ার পেছনে পুরো অবদান ছিলো রমিজের। রমিজ মেডিকেল ক্যাম্পে শুধু একজন ডাক্তারকেই ভালোভাবে চিনতো আর সে হলো স্মরণ। তাই তো রুমাইসার দেয়া চিঠিখানা সে স্মরণের হাতেই দিয়েছিলো।
প্রথম দিনের মতো আজও চিঠির ভাঁজ খোলার সঙ্গে সঙ্গে শিউলি ফুলের মৃদু সুবাস এসে স্মরণের নাকে তীব্রভাবে লাগলো। অজান্তেই স্মরণের অন্তঃকরণে এক অন্যরকম অনুভূতির ঢেউ খেলে গেলো। ঠিক প্রথম দিনের মতো নাম না জানা কিছু শিহরণ চারদিকে নিজেদের আলাদা একটা জগৎ তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। স্মরণ চোখ বুজে যেনো রুমাইসার অস্তিত্ব অনুভব করলো। মেয়েটাকে সে কোনোভাবেই মাথা থেকে সরাতে পারছে না।
রুমাইসার লিখা চিঠিতে খুব একটা বেশি কিছু লিখা নেই, তবে যতটুকু লিখা তাতে একজন পুরুষ মানুষের হৃদয়ে অসারতা অনুভব করানোর জন্য যথেষ্ট।
“ভরসা করার মতো একটা হাত সবার কপালে জুটে না, হয় তো আমি সেই সৌভাগ্যবতী যে তার বিপরীতমেরুতে অবস্থান করা একজন অপরিচিত পুরুষের বাড়িয়ে দেয়া ভরসার হাত মাথার উপর পেয়েছি। ধন্যবাদ দিয়ে আপনাকে ছোট করতে পারবো না, তবে আপনার এই উপকার কখনো ভুলবো না।”
ইতি, রুমাইসা
রুমাইসার চিঠি একপাশে ফেলে রেখে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াল স্মরণ। নিশুতি রাতের আঁধারে তলিয়ে গেছে রাতের শহর। একাকীত্বরা এসে ঝেঁকে ধরেছে চারদিক থেকে, কোথাও যেনো এতটুকু নিশ্বাস ফেলার জায়গা নেই। সারাদিনের কর্মব্যস্ত জীবন আর রাতে একটুকরো আঁধার আজকাল তার সঙ্গি হয়ে উঠেছে। পরিবার থেকে দূরে অচেনা অজানা নিশ্চিন্দপুর থেকে চার কোশ দূরবর্তীতে ছোট্ট একটি মফস্বল শহরে এসে ঠাঁই নিয়েছে সে। কিসের আশায় আর কিসের মোহে সে এতদূর পর্যন্ত ছুটে এসেছে। শুধুই কি ওই ষোড়শীর ভরসার একটি জায়গা হয়ে উঠার জন্য, নাকি অন্তঃকরণে ষোড়শীর প্রতি অজানা কোনো টান থেকে।
স্মরণ দশ দিন আগে শুভ্রনগর নামে এক মফস্বল শহরের একটি হাসপাতালে জয়েন করেছে। এখান থেকে অলকানন্দপুর কিংবা নিশ্চিন্দপুর যেতে প্রায় ঘন্টা দুইয়েক সময় লাগে। এখানে আসার কথা তেমন কেউ জানতে না পারলেও রমিজ জানে যে স্মরণ এখন শুভ্রনগর অবস্থান করছে। মাত্র তিন মাসের জন্য সে এখানে জয়েন করেছে তাও কতৃপক্ষকে মোটা অংকের টাকা খাইয়ে। বেঁটেখাটো রমিজ স্মরণের এমন আচরণ বুঝতে পারে না। শহরের এত বড় ডাক্তার হয়ে কেনো সে শুভ্রনগরের ছোটোখাটো হাসপাতালে টাকা খাইয়ে জয়েন করেছে, অবশ্য তাতে তেমন কোনো মাথা ব্যাথা নেই রমিজের। সে শুধু স্মরণের কথা অনুযায়ী রুমাইসার পরিবারের খোঁজ খবর এনে দেয়।
(৩৬)
রিমা এবং রুমাইসা এক কম্বলের নিচে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে। রুমাইসা আধবোজা চোখে সামনের মিটমিট করে জ্বলতে থাকা হারিকেনের দিকে তাকিয়ে আছে। রিমা কিছু সময় এপাশ ওপাশ করে শোয়া থেকে উঠে বসলো। রিমাকে উঠতে দেখে রুমাইসা বলল,
“উঠে পড়েছিস কেনো?”
“ঘুম আসে না আপা।”
“চোখ বুজে শুয়ে থাক তাহলেই ঘুম আসবে।”
রুমাইসার কথায় কোনো প্রতিক্রিয়া করলো না রিমা। চুপচাপ জায়গায় বসে কিছু ভাবতে লাগলো।
“কি ভাবছিস এতো?”
“একখান কথা কমু আপা?”
“হু।”
“শেহ্ওয়ার ভাইর সাথে সত্যিই তোমার বিয়া হইবো?”
“হু।”
“তুমি বাবারে না কইয়া দাও, তুমি এখন বিয়া করবা না বইলা দেও।”
“কেউ এখন আমার কথা শুনবে না রিমা। তুই এসব নিয়ে আর ভাবিস না ঘুমিয়ে পড়।”
“কিন্তু আপা শেহ্ওয়ার ভাই,,,।”
হঠাৎ ঘরের বাহিরে কারো চলার শব্দ পেয়ে চুপ হয়ে গেলো রিমা। নিলুফার বেগম ঘরে দরজা আলগা করে মাথা গলিয়ে দেখলেন মেয়েরা কি করছে। রিমা কম্বলের নিচ থেকে উঁকি মেরে দেখলো নিলুফার বেগম গেছেন কিনা। নিলুফার বেগম চলে গেলে রিমা আবার উঠে বসে রুমাইসা চুপচাপ শুয়ে রিমার দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা তাকে বড্ড বেশি ভালোবাসে তাই হয় তো সেও চাইছে না শেহওয়ারের সাথে তার বিয়ে টা হোক।
চলবে,,,,