সম্পর্কের মারপ্যাঁচে পাঠ-৯

#সম্পর্কের_মারপ্যাঁচে
পর্ব-৯
#tani_tass_ritt

ছবিতে তার মা এবং আলতাফ সাহেবে মানে তার চাচার ছবি।ছবিটি বেশ হাস্যোজ্জ্বল। আলতার সাহেব তার এক হাত তার মায়ের কাধে দিয়ে ছবিটি তুলেছে।কিন্তু ছবিটা বেশ আগের। তার মাকে অনেক ছোট লাগছে।

রুদ্র তার মায়ের দিকে তাকালো।দেখেই বুঝা যাচ্ছে তার মনে হাজারো প্রশ্ন জন্ম নিয়েছে।আর এই প্রশ্নের উত্তর শুধু মাত্র তার মায়ের কাছেই আছে।

“তখন সবে মাত্র এস.এস.সি দিয়েছি।বাসায় বিয়ের জন্য প্রচুর প্রেশার দিচ্ছিলো।মারধোর করছিলো।কিন্তু আমার একটাই কথা ছিলো আমি আমার পড়ালেখা চালিয়ে যাবো।কেননা আমার ছোট বোনটাকেও আমার দেখতে হবে।ক্লাস ৮ এর পর ই তারা আমার পড়ার খরচ বন্ধ করে দেয়।আমি মানুষের বাসায় যেয়ে টুকটাক কাজ করে যেই টাকা পেতাম সেটা দিয়েই নিজের পড়ালেখার খরচ টা চালাতাম।পড়ালেখায় ভালো হওয়ার জন্য স্যার রা বেশ সাহায্য করতো আমাকে।বেতনটাও হাফ নিতো।

তখন সবে মাত্র কলেজে উঠি।একদিন আব্বার বিপি হাই হওয়ার জন্য রাস্তায় পরে যায়।তখন একটা লোক তাদের বাসায় নিয়ে আসে। লোকটা হলো তোর বড় চাচা আলতাফ সাহেব।প্রথম দিনই সে কেমন যেনো আমার দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে ছিলো। দেখেও আমার থেকে বেশ বড় মনে হয়েছিলো।

কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার ঐদিনের পর থেকেই সে আমার বাসার সামনে দিয়ে ঘুর ঘুর করতো।আমি প্রায়ই তাকে দেখতাম।সে আমার দিকে একই ভাবে তাকিয়ে থাকতো।এভাবেই কেটে যায় এক মাস।

একদিন সে আমার কলেজের সামনে এসে দাড়িয়ে আছে।আমি তো তাকে দেখে অবাক।আমি বেড় হতেই সে আমাকে ডাক দিলো।তার নাকি আমার সাথে কিসের কথা আছে।আমি কি বলবো ভেবে পাচ্ছিলাম না।কিন্তু তার কথা কেন যেনো খুব শুনতে ইচ্ছে করছিলো।তখন বয়সটাও আমার কম ছিলো।

সেদিন সে আমাকে প্রথমবারের মতো ভালোবাসি কথাটা বলে।এর আগেও অনেক ছেলেই আমাকে বলেছে কিন্তু তার বলাটা ছিলো অন্যরকম।তার ঐ ভালোবাসি শব্দটা শুনেই যেনো আমি তার প্রেমে পরে যাই।একদম কঠিন প্রেম।

ঐদিনের পর থেকে আমাদের যাত্রা শুরু হয়।আমি নতুন করে বাঁচার মানে খুঁজে পাই।আমার মনে হয় আলতাফই আমার সুখের চাবিকাঠি।তার সাথে আমি জনম জনম পার করে দিতে পারবো।

এভাবেই কেটে গেলো ৩ টে বছর।আমার বয়স তখন ১৯ আর তার বয়স ৩০। তার বাসার থেকে বিয়ের চাপ দিচ্ছিলো।সে বলেছিলো সে বাসায় আমাদের কথা বলবে।”

এতোটুকু বলেই রুবি বেগম জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিলেন।এর পরের সত্যটা বলার মতো সাহস তার হচ্ছে না।সে নিজেকে নিজে বুঝাচ্ছে।

রুদ্র এক দৃষ্টিতে তার মায়ের দিকে চেয়ে আছে।সে কিছু বলছে না।

“আলতাফের ভালোবাসায় আমি মুগ্ধ ছিলাম।একটা মানুষ এতোটা ভালোবাসতে পারে তাকে না দেখলে আমি কোনোদিন জানতেই পারতাম না।তার প্রতি ছিলো আমার অন্ধ বিশ্বাস। সে আমাকে ভরসা দিয়েছিলো সে আমাকে বিয়ে করবে। আমি তার ভালোবাসায় এতোটাই মগ্ন ছিলাম যে আমার হিতাহিত জ্ঞান লোপ পেয়েছিলো।আর আমরা আমাদের জীবনের সব থেকে বড় ভুল করে বসি। তখন বুঝতে পারিনি এই ভুলের পরিনাম কতটা ভয়ানক হতে পারে।

তার দু মাস পরের কাহিনি।আলতাফ আমার সাথে দেখা করতে আসে।তাকে দেখে কেমন যেনো বিদ্ধস্ত দেখায়।চোখের নিচে কালি।মনে হয় কতকাল ধরে ঘুমোয় না।খুব ক্লান্ত সে।

সেদিন সে আমার হাত ধরে বলে সে আমাকে বিয়ে করতে পারবে না।সে তার মাকে আমার কথা বলতে গিয়েছিলো কিন্তু তার মা রাজি হয়নি।এমনকি আমাকে দেখেনও নি।আলতাফ যখন ছোট ছিলো তখন সে তার বোনকে প্রতিজ্ঞা করেছিলো যে সে তার বোনের মেয়েকেই তার বড় ছেলের বউ করে আনবে।”

রুবি বেগমের গলা দিয়ে কথা বের হতে চাচ্ছে না।কেমন যেনো আটকে যাচ্ছে।আজ এতোগুলো বছর পরও তার এইসব মনে পরলে তার ভিতরটা দুমড়ে মুচরে যায়।

“আলতাফ তার মায়ের উপর কথা বলতে পারবে না।সে সেদিন আমার হাত ধরে কি কান্নাটাই না কেঁদেছিলো।সেদিন তার কষ্ট দেখে আমার একদমই কষ্ট লাগছিলো না।নিজের ভাগ্যের উপর হাসি আসছিলো।এই জীবনের আমার না পাওয়ার খাতাটা কি কোনো দিনো পূর্ণ হবে না! সে সেদিন আমাকে তার অসহায়ত্বের কাহিনি শুনিয়ে বিদায় নিয়েছিলো।আর সাথে বিদায় হয়ে গিয়েছিলো আমার এতো দিনের সাজানী স্বপ্ন গুলো।তার সাথে ঘর বাধার স্বপ্ন আমার এই জনমে হলো না।বলেছিলো ভালো থাকতে।সেদিন আমি কিছুই বলতে পারিনি।বলার ভাষাই যেনো হারিয়ে ফেলেছিলাম।

এখানেই সব শেষ হতে পারতো কিন্তু শেষ হয়নি।দিনের পর দিন যেতে লাগলো আর আমার মধ্যে কিছু অদ্ভুত পরিবর্তন লক্ষ্য করতে পারলাম।বমি বমি ভাব। কিছু খেতে পারতামনা।শরীরটা কেমন যেনো ভারি ভারি লাগতো।আমার মধ্যে যে বিষেষ পরিবর্তন হচ্ছিলো তা বাড়ির সবার চোখে পরে।পরে আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়।আর আমি বুঝতে পারি আমি ২ মাসের প্রেগন্যান্ট। তার কষ্টে এতোটাই বিভোর ছিলাম যে এগুলো আমার মাথায়ই আসেনি।

তারপর শুরু হয় কালবৈশাখি ঝড়।আমার উপর দিয়ে চলে অমানবিক অত্যাচার।আমাকে নষ্টা বেশ্যা অনেক কিছু বলেই গালি দিতে থাকে।আমি পাগলের মতো হয়ে যাই।

তারা আমাকে আর আমার বোনকে বাসা থেকে বের করে দেয়। আমরা যেনো মাঝ সমুদ্রে এসে পরে গিয়েছিলাম।আমি কোনো কূলকিনারা পাচ্ছিলাম না।তখন আমার কাছে একটাই রাস্তা ছিলো আলতাফের কাছে যাওয়া।আমি শুধু আলতাফের ঠিকানা ওর কাছ থেকে একবার শুনেছিলাম। আমার কাছে কিছু টাকা ছিলো সেই টাকা নিয়েই বেরিয়ে পরি আলতাফের খোঁজে।

গ্রামের এক চাচার সাহায্য নিয়ে ঢাকায় চলে যাই।অনেক কষ্টে আলতাফের বাসার খুঁজে বের করি।সারাদিন না খাওয়া জীবন যায় যায় অবস্থা।আলতাফের বাসার সামনে যেয়ে দেখি খুব সুন্দর করে লাইটিং করা পুরো বাসা জুড়ে।আমার মনে কেমন যেনো ছ্যাত করে উঠে।একটু পর দেখি গাড়ি থেকে বিয়ের কনে নামছে।ওকে দেখেই আমি চিনে ফেললাম কেনোনা এর আগে আমি ওর ছবি দেখেছিলাম।

আমি সিমার কাছে গিয়ে তার সাথে আলাদা করে একটু কথা বলতে চাইলাম।তার সাথে শুধু তার একটা বোন ছিলো।তারা দুজনই আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালো।

আমি সিমার পা ধরে বসে পরলাম।আমার বাচ্চাটার জন্য ভিক্কা চাইলাম তার কাছে কিন্তু সে দিলো না।আমি আমার আর আলতাফের সম্পর্কের কথা বললাম।কিন্তু সে কোনোভাবেই তার ভালোবাসার মানুষকে হারাতে রাজি না।উল্টো আমাকেই যা না তাই বলা শুরু করলো।বুঝতে পারলাম তাকে বলে কোনো লাভ নেই।আমি সোজা আলাতাফদের বাসায় ঢুকে পরলাম।

সেখানে যেয়ে একপ্রকার চিৎকার করেই সব বলতে লাগলাম।কিন্ত আলতাফকে পেলাম না।ঐদিনই তোমার বাবার সাথে আমার প্রথম দেখা হয়। তোমার দাদি সব শুনেও আমার উপর দয়া করলেন না।এমনকি আমি কাজের মেয়ে হয়েও থাকতে রাজি ছিলাম।তাও তারা আমকে তাড়িয়ে দিলো।তোর দাদি আমাকে এতো জোরেই ধাক্কা দিয়েছিলো যে আমার পেটে আঘাত লাগলো খুব জোরে। আমি চিৎকার করতে লাগলাম।তখন তোর বাবা আমাকে আর আমার বোনকে নিয়ে সেখান থেকে বেড়িয়ে গেলেন।

হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার পর জানতে পারলাম আমার বাচ্চাটা আর নেই।সব শোক যেনো একসাথে এসে আমাকে ঘিরে ধরেছিলো।আমি কেমন যেনো পাথর হয়ে গিয়েছিলাম।

এইদিকে আলতাফ আর সিমার বিয়েও হয়ে গিয়েছে।সব হারিয়ে আমি সর্বশান্ত হয়ে গেলাম।মনে হলো এই জীবন রেখে লাভ টা কি আমার।কিন্তু তখন মনে পরলো আমি না থাকলে আমার বোনটার কি হবে।”

রুবি বেগম এবার ফ্লোরে বসে পরলেন।রুদ্র তার মায়ের পাশে এসে বসলো।এতোগুলো সত্যি একসাথে শুনে তার মাথা ঘুরছে।এতোটা কষ্ট করেছে তার মা।

রুবি বেগম আবার বলতে শুরু করলেন।

“আমার জীবন এখানেও থেমে থাকেনি।নতুন ঝরের প্রস্তুতি নিচ্ছিলো।তোর বাবা আমাকে আর আয়শাকে তার এক বন্ধুর বাসায় থাকার জায়গা করে দেয়।সেই আমাদের খেয়াল রাখছিলো।এভাবেই কেটে গেলো ৬ মাস।তোর বাবা আমাদের এতো খেয়াল রাখছিলো যেনো আমি তার খুব চেনা।

কিন্তু একদিন ঘটলো এক অদ্ভুত ব্যাপার।সে আমাকে এসে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দিলো।সেদিন আমি রাজি হয়ে গিয়েছিলাম।কোনো কিছু না ভেবেই তাকে বিয়ে করে ফেলি।তখন আমার মাথার উপর একটা ছাদ দরকার।

বিয়ের পর সে আমাকে তার বাসায় নিয়ে যায়।আমাকে দেখে আলতাফ সবথেকে বেশি অবাক হয়।ঐদিন আমি এটা জানতে পারলাম আলতাফ কিছুই জানে না আমার আর তার বাচ্চার ব্যাপারে।আমাকে দেখে তোর দাদি চিৎকার শুরু করে দিলেন।সে আমাকে মেনে নিবেই না।কিন্তু তোর বাবার জিদের কাছে তাকে হার মানতে হলো।

আলতাফ আর সিমাকে দিনের পর দিন একসাথে থাকতে দেখে আমার ভিতরটা জ্বলে পুরে ছাই হয়ে যাচ্ছিলো।তার উপর তোর দাদির খোটা তো আছেই।তোর বাবার আচার আচরন আমার যেনো কেমন লাগতো।সিমার সামনে সে আমার সাথে খুব ভালো কিন্তু বন্ধ দরজার ভেতরে সে শুধু তার স্বামীর অধিকারটুকুই ফলাতো।এই যেনো এক নতুন আযাব শুরহ হয় আমার জন্য।

একদিন আমি আলমারি পরিষ্কার করার সময় তার আলমারির থেকে সিমার ছবি আর একটা ডায়েরি পাই।যেই ডায়েরিতে লেখা ছিলো অনুভুতির কথা।তার প্রথম প্রেম সিমার কথা।ঐদিন এতো বড় ধাক্কা খেয়েছিলাম।মনে হলো আমার পুরো পৃথিবীটাই থমকে #সম্পর্কের_মারপ্যাঁচ যে এতোটা ভয়নাক হতে পারে তা আমি ধীরে ধীরে উপলব্ধি করতে পারছিলাম।

ঐদিন আমি তোর বাবাকে এটা নিয়ে প্রশ্ন করলে সে প্রথমবার আমার গায়ে হাত তুলে।সে আমাকে বিয়ে করেছিলো শুধু মাত্র আলতাফকে জ্বলাতে।কেনোনা আলতাফের জন্য সে সিমাকে পায়নি। সিমা বরাবরই আলতাফকে ভালোবাসতো।সে চেয়েছিলো আমাকে হাতিয়ার বানিয়ে আলতাফকে জ্বালাবে।কিন্তু সে যে তখনো সিমাকে ভালোবাসে তার চোখ দেখেই আমি বুঝতে প্রেছিলাম।আমি মুখ বুজে সব মেনে নেই।কেনোনা আমার যাওয়ার যায়গা নেই।তারা আয়শাকেও যে আশ্রয় দিয়েছিলো।

সেদিনের পর থেকে তোর বাবা আর আমার সম্পর্কটা যেনো কেমনই হয়ে গিয়েছিলো।কেটে গেলো আরো ৮ মাস। আমার মধ্যে আমি আবার সেই পরিবর্তন দেখতে পেলাম।বুঝতে পারলাম আমি মা হতে চলেছি। এই খবর শুনে সবাই বেশ খুশি হলেন।তোর বাবার মাঝেও পরিবর্তন দেখতে পারছিলাম।

কিন্তু এইদিকে সিমা পাগল হয়ে গেলো বাচ্চা নেয়ার জন্য।কিন্তু কোনো ভাবেই কন্সিভ হচ্ছিলো না।এই ডাক্তার ঐ ডাক্তার দেখিও লাভ হচ্ছিলো না।কাঁদতে কাঁদতে সে দিন পার করছিলো।

তার এই অবস্থা দেখে তোর বাবা আমার কথা ভুলেই গেলেন। তার শোকেই যেনো সে কাতর।আর আলতাফ সে তো একটা পুতুল মাত্র।তাকে আমার পাথরের মূর্তি মনে হতো।কোনো কিছুই যেনো তার মনে কোনো অনুভুতি জাগাতে পারে না।

দেখতে দেখতে আমার ডেলিভারির সময় এসে পরলো।”

রুবি বেগমের ঠোট কাঁপছে।

“সেদিন আমার যমজ সন্তান হিয়েছিলো।তুই আর তোর ভাই।বিশ্বাস কর আমি শুধু তোকেই কোলে নিতে পেরেছিলাম। আমার আরেকটা সন্তানকে তোর বাবা সিমাকে দিয়ে দিয়েছিলো।ঐদিন আমি চিৎকার করে কেঁদেছিলাম।ঐদিন মনে হয়েছিলো তার থেকে খারাপ মানুষ আর নেই।আমি যদি এটা না মানি তাহলে নাকি আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দিবে।সেদিন সব কিছু মুখ বুজে মেনে নিয়েছিলাম। এরপর সে আমাকে নিয়ে টাংাইল সিফট হয়ে যায়।যাতে আমি সিমার থেকে বাচ্চা না নিতে পারি।তোর বাবার থেকে আমি আলাদা থাকতে শুরু করি।আলাদা রুম সব কিছু থেকেই তার থেকে দূরে দূরে থাকি। কেটে যায় ৪ টে বছর।”

এবার রুবি বেগম হুহু করে কঁদে ফেললেন।রুদ্র তার মাকে শান্তনা দিচ্ছে।কিন্তু সে জানতোনা যে তাকে আরো একটা সত্যের সম্মুখীন হতে হবে।

“একদিন খবর আসে তোর ভাই ছাদ থেকে পরে গিয়েছে। এটা শুনে আমি পাগলের মতো হয়ে গেলাম।তোর বাবা না পেরে আমাকে হসপিটালে নিয়ে গেলো।কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না রে।আমার ছেলেটা মরে গিয়েছিলো।ঐদিন প্রথম আমি তোর বাবাকে থাপ্পর মেরেছিলাম। তার জন্য আমার ছেলেটা মরে গেলো।আমি আমার ২ টো সন্তানকে হারিয়েছি।এর পর থেকে আমি আর ঐ বাড়ির সাথে কোনো যোগাযোগ রাখিনি।তোর বাবাও কেমন যেনো চুপচাপ হয়ে যায়।

সিমাকে দেশের বাহিরে নিয়ে যাওয়া হয় ট্রিটম্যান্ট করার জন্য।আল্লাহ ওর দুয়া কবুল করেছিলো তাইতো প্রভাতির জন্ম হয়। প্রভাতির জন্মের ঠিক ৬ বছর পর যখন তোর চাচা চাচি মারা যায়। তোর চাচার শোকে কাতর হয়ে তোর দাদিও না ফেরার দেশে চলে যায়।প্রভাতির যাওয়ার কোনো জায়গা থাকেনা।তখন তোর বাবা ওকে এখানে নিয়ে আসে।আমাকে বলেছিলো আমি যাতে ওর খেয়াল রাখি।কিন্তু কোনো ভাবেই আমি ওকে মন থেকে মেনে নিতে পারছিলাম না।ওকে দেখেই আমার সবটা মনে পরে যায়।ওর মধ্যে আমি সিমাকে দেখতে পাই।

রুবি বেগম হুহু করে কঁদে ফেললেন।সব কিছু শুনে রুদ্র স্তব্ধ হয়ে বসে আছে।এতো কিছু ঘটে গিয়েছে তার মায়ের জীবনে।এতো কষ্ট আর সে কোনোদিন জানতই না।

” আমি তোর সাথে প্রভাতিকে দেখতে পারবোনা রে।আমার খালি মনে হয় ও তোকে আমার থেকে আলাদা করে দিবে।আমি সব কিছু হারিয়েছি বাবা তোকে হারাতে পারবো না। ও তো ওর মায়ের ই মেয়ে।ওর মা ও তো আমার থেকে আলতাফ কে কেড়ে নিয়েছিলো।কতো মিনতি করেছিলাম।পায়ে পর্যন্ত ধরেছিলাম কিন্তু লাভ হয় নি।তুই তোর মায়ের জন্য এতোটুকু করতে পারবি না!আমার যে তুই ছাড়া আর কেউ নেই।”

“মা তুমি শান্ত হও প্লিজ।আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না। তুমি যা চাও তাই হবে।আমি তোমাকে কষ্ট দিবো না।”

খুব সহজে রুদ্র এটা বলে ফেললেও তার ভেতরটা যে তোলপাড় শুরু হয়ে গিয়েছে এটা তো আর কেউ বুঝলো না।

রুবি বেগম যেনো আশার আলো দেখতে পেলেন।তার ছেলে তাকে ছেড়ে যাবে না।

“মা তুমি ঘুমিয়ে পড়ো।”

রুবি বেগম তার ছেলেকে আদর করে দিয়ে রুমে চলে গেলেন।

রুদ্র আস্তে আস্তে সিরি বেয়ে ছাদে চলে গেলো।ছাদের কর্ণারে যেয়ে হেলান দিয়ে বসলো।
“কি অদ্ভুত ব্যাপার।তার মায়ের জন্য বুক ফেটে যাচ্ছে।এতো গুলো বছর তার মা কতটা কষ্ট পেয়েছে।কিন্তু এতোকিছুর মধ্যে তার আর প্রভাতির দোষ টা কোথায়! সব কিছুরই আবার পূনরা বৃত্তি ঘটছে। রুদ্র তার বড় চাচার কথা চিন্তা করছে।সে ও কি তার মতো অসহায় হয়ে পরেছিলো সেদিন!

আজ সে সম্পর্কের #মারপ্যাঁচে_আটকে গিয়েছে।এটার থেকে বের হওয়ার সাধ্য তার নেই।যেকোনো একটা তো তার বেঁছে নিতেই হবে।কি অদ্ভুত তার সব দিকেই হার।এই হার মেনে বেঁচে থাকাটা যে কতটা কষ্টের সেটা শুধু মাত্র হেরে যাওয়া মানুষই বুঝতে পারে।সে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিলো।সে কোনোদিনো তার ভালোবাসার কথা প্রভাতিকে বলবেনা।থাকুক না তার ভালোবাসাটা না বলা। তার চোখ বেয়ে পানি পরছে।তার খুব ইচ্ছে করছে চিৎকার করে কাঁদতে কিন্তু না ছেলে মানুষের কাঁদতে নেই।তাকে যে শক্ত হতে হবে।

নির্ঘুম রাত কেটে ভোরের আলো ফুটে উঠলো।কিন্তু এই আলো তার কাছে বিষের মতো লাগছে।সে যে এতক্ষণ যে ছাদে ছিলো খেয়াল ই করেনি।

রুমে যাওয়ার পর সে দরজা লাগিয়ে শুয়ে পরলো।কিছুক্ষণ পর রুবি বেগম তার রুমে এলেন।

রুদ্রের মাথার কাছে বসলেন।
” বাবা তুই ঠিক আছিস তো?” তুই এমন করলে তৌকির ওরা কি ভাববে বল তো।ওদের তো সন্দেহ হবে।তুই প্লিজ একটু স্বাভাবিক হ।আর তিথি তো খুব ভালো মেয়ে তুই ওর সাথে এমন কেন করছিস?”

রুদ্র তার মায়ের কথার কোনো জবাব দিলোনা।কেননা তার সব কিছুই খুব বিরক্ত লাগছে।

এইদিকে তৌকির আর ওর মায়ের যাওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে। তৌকিরের সব কিছুই বেশ অস্বাভাবিক লেগেছে। যদিও কারো সামনে কিছু বলছে না।

তৌকির আর সালমা বেগম যাওয়ার সময় প্রভাতি রুম থেকে বেরুলো।প্রভাতিকে দেখেই তারা চমকে গেলো।মাত্র এক রাতেই মেয়েটার কি হাল হয়ে গেলো।চোখ মুখ শুকিয়ে গিয়েছে।মুখে বিষাদের ছাপ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে।সালমা বেগম কিছু জিজ্ঞেস করতে গেলেও তৌকির আটকে দিলো তাকে। তারা সেদিন সেখান থেকে চলে গেলো।

★★★★★

১ সপ্তাহ পর প্রভাতি আর তৌকিরের বিয়ে ঠিক হলো।এটা রিয়া জানার পর তার মাথা ঘুরে গেলো এটা কিভাবে সম্ভব! সে রুদ্রকে সাথে সাথে ফোন দিলো।

১ বার ২ বার রিং বাজার পরও ফোনটা রিসিভ হলো না। রিয়া কল দিতেই থাকলো।

রুদ্র না পেরে ফোনটা রিসিভ করলো।
“ভাই এগুলা কি শুনছি আমি? তুই না ওকে প্রপোজ করবি তাহলে ওর বিয়ে কিভাবে ঠিক হতে পারে?”

রুদ্র চুপ করে আছে।

“ভাই বল না আমাকে কি হিয়েছে? এমন কেন করছিস?”

“রুদ্র বাচ্চাদের মতো কেঁদে ফেললো।শুধু কেঁদেই যাচ্ছে।”

রিয়ার কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে।কেননা রুদ্রকে তা আপন ভাইয়ের থেকেও বেশি।তার বেস্ট ফ্রেন্ড সে।

“আমি কাল আসছি ভাই।তুই ধৈর্য ধর।” বলেই ফোনটা কেটে রিয়া তার মায়ের রুমে চলে গেলো।

“মা আমার সাথে তোমার কথা আছে।আশা করি তুমি আজ সব সত্যিটা বলবে।”

আয়শা বেগম অবাক হয়ে গেলেন মেয়ের এমন কথা শুনে।

“মা খালামনির প্রভাতির সাথে কি সমস্যা আমাকে একটু বলবে? আজ তুমি যদি আমাকে এটা না বলো এর পরে কিন্তু নিজেই আফসোস করবা।”

আয়শা বেগম আর চুপ থাকতে পারলোনা।সে সবটা বলে দিলো রিয়াকে।রিয়া সব শুনে বড় একটা ধাক্কা খেলো।

★★★★★★★★★★

রাত ২ টা বাজে রুদ্র তার রুমের বারান্দায় দাড়িয়ে আছে।আর ৫ দিন বাদে তার মায়াপরীর বিয়ে।ভাবতেই তার বুকে চিন চিন ব্যাথা শুরু হলো।হঠাৎ কেউ এসে তাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। একদম আষ্ঠে পৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো।

রুদ্র বুঝে গেলো এটা আর কেউ না প্রভাতি। সে চোখ বন্ধ করে প্রভাতির স্পর্শ অনুভব করলো।তাপর না চাইতেও সে নিজেকে প্রভাতির থেকে ছাড়িয়ে নিলো।

“কি হয়েছে তোর এভাবে ধরে আছিস কেনো?”

“আমি এই বিয়ে করবোনা রুদ্র ভাই।আমি এই বিয়ে করবোনা।আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবোনা।কেন পারবো না নিজেও জানিনা।কিন্তু আমি তোমার সাথে থাকতে চাই।আমার মধ্যে তোমার জন্য এক অদ্ভুত অনুভুতি কাজ করে।আর দিন দিন তা বেরেই চলছে।কি হচ্ছে কেন হচ্ছে আমি এতোকিছু জানি না।আমি শুধু তোমার কাছে থাকতে চাই।আমি এই বিয়ে করবোনা।” এক নিঃশ্বাসে বলে ফেললো প্রভাতি।

রুদ্র আকাশ থেকে পরেছে প্রভাতির কথা শুনে।সে খুশি হবে না কি করবে বুঝতে পারছে না।তার এতো বছরের ভালোবাসার মানুষটা নিজ থেকে এসে তাকে বলছে।তার ইচ্ছে করছে প্রভাতিকে জড়িয়ে ধরে একদম তার নিজের করে নিতে।তার খুব বলতে ইচ্ছে করছে,
“আরে পাগলি তুই আমাকে ভালোবাসিস এটাও বুঝতে পারছিস না!” কিন্তু বলতে পারলোনা রুদ্র।তার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে যে সে তার মায়াপড়িকে কতটা ভালোবাসে।কিন্তু তার হাত পা বাধা।তার নিজেকে আজ সব থেকে অসহায় মানুষ মনে হচ্ছে।

রুদ্র অনেক কষ্ট করে নিজেকে কন্ট্রল করে উল্টো দিকে ঘুরে গেলো।নিজের চোখের জল মুছলো।

“তুই আর কোনো দিন এইসব কথা বলবিনা।মানুষ খারাপ বলবে।তুই না আমার ভালো প্রভাতি।আর কদিন বাদে তোর বিয়ে।তুই এখন এগুলো আবলতাবল কি বলছিস।চুপ করে নিজের বিয়ে নিয়ে ভাব।আর তৌকির খুব ভালো ছেলে।তুই এতোদিন আমার সাথে ছিলি তো তাই এমন হচ্ছে।আর কিছুনা।তুই এখান থেকে এখন যা।আর বিয়ের জন্য প্রস্তুত হ।”

প্রভাতি এমনটা আশা করেনি রুদ্রের কাছ থেকে।প্রভাতি কিছু বলতে যাবে তখনি রুদ্র একটা ধমক দিলো।
“যা নিজের রুমে যা।আর কিছু বলবিনা।প্রভাতি ভয় পেয়ে নিজের রুমে চলে গেলো।

রুদ্র শরীরে যেনো কোনো শক্তি পাচ্ছে না। তার হাত পা কাঁপছে।কেমন যেনো যন্ত্রনা হচ্ছে।এই যন্ত্রনা সে নিতে পারছে না।সব কিছু ঝাপসা দেখছে।ছোট থেকে যাকে এতোটা ভালোবেসেছে আজ তাকে প্রত্যাক্ষান করেছে সে।তার ভেতরটা যেনো চিৎকার করে বলছে
” রুদ্র তোর মায়াপরি তোকে ভালোবাসে।” তার কানে শুধু প্রভাতির কথা গুলো বাজছে।

★★★★★★★★★

রিয়া সকাল ১০ টার মধ্যে এসে হাজির রুদ্রদের বাসায়।আয়শা বেগমও এসেছেন।রিয়া এসেই রুদ্রের রুমে যায়।রুম টা ধাক্কা দিতেই খুলে যায়।ভেতরে ঢুকতেই সে জোরে একটা চিৎকার দেয়।

চলবে…

(কাল শেষ পর্ব দিবো)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here