#সিন্ধুর_নীল (পর্ব-১০)
লেখনীতে–ইনশিয়াহ্ ইসলাম।
১৩.
আকাশ আজ চাঁদের আলোয় ঝলমল করছে। চাঁদটা আজ অনেক বড় আর একটু বেশিই উজ্জ্বল মনে হচ্ছে। এহসান আর সময় নিয়ে বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছেনা। তার অন্তরে এখন কিছুটা হতাশা আর অনেকটা আনন্দ ঘুরছে। নিদ্রা তার প্রাপ্তি হলো। এটা যেমন আনন্দের তেমনি এই বিয়েটা ঘিরে রয়েছে অনেকখানি হতাশা। নিদ্রা মন থেকে তাকে মানতে পারবে তো? এমন প্রশ্ন ক্ষণে ক্ষণে জাগ্রত হচ্ছে। পরক্ষণেই নিজেকে ধাতস্থ করে নেয় সে। নিদ্রা তার প্রথম ভালো লাগার হাওয়া! আর সে মনে প্রাণে চায় সেটা ভালোবাসার রুপ ধারণ করুক। এহসানের মন মস্তিষ্কের একাংশ জুড়ে কেবল নিদ্রা, প্রথমা নিদ্রা! এহসান একবার যখন তাকে পেয়েছে তাই সে তাকে আর ছাঁড়বেনা এমন পণ করে নিল।
চোখে ঘুম নেমেই এসেছিল নিদ্রার। তখনিই দরজা আটকানোর শব্দ হওয়াতে চমকে উঠে। এহসানকে সামনে দেখতেই তার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যায়। এই অনুভূতি প্রকাশ করবার নয়! এমন অনুভূতির নাম কী তা সে জানেনা। আতঙ্ক, লজ্জা, ভয়, হীনমন্যতায় ভূগে সে। নিজেকে সম্পূর্ণ গুটিয়ে নেয়। এহসান শান্ত গলায় নিদ্রাকে বলল,
“এতো ভারি পোষাকে কেন বসে আছো? যাও চেইন্জ করে আসো চটজলদি।”
নিদ্রার মনে এহসানের এই শান্ত অথচ স্পষ্ট অধিকারবোধ থেকে জন্ম নেওয়া বাক্যটি ঝংকার তুলে মুহূর্তেই। আশ্চর্য! কিছু সময়ের ব্যবধানে লোকটা তার উপর অধিকার দেখাচ্ছে? সে অধিকার পেয়েছে। কেন পেয়েছে? সে নিজেই তো দিয়েছে তাই! নিদ্রা এই প্রথম উচ্চ বাক্য তুলে এহসানকে কিছু বলতে পারল না। শুধু উচ্চ নয় একটা টু শব্দও বের করে না মুখ দিয়ে। গলায় সব দলা পেকে যাচ্ছে। এদিক ওদিক তাঁকিয়ে সে কিছুই খুঁজে পায়না। তার কোনো জামা কাপড়ই তো নেয় এখানে। তাহলে সে পড়বে কী? নিদ্রার সমস্যা এহসান বুঝল। গটগট শব্দ তুলে কাবার্ডের সামনে এগিয়ে গেল। কাবার্ড খুলে একটা কালো প্যাকেট নিদ্রার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
“এখানে তোমার পড়ার জিনিস আছে। আর শোনো! ফার্স্ট নাইট এর জন্য এটা আমি নিয়েছিলাম। বন্ধুদের চাপে পড়েই এই ড্রেসটা কিনেছিলাম। আমার বউয়ের জন্য! তখন কিন্তু নিহারীকার কথা মাথায় রেখে কিনি নাই। শুধুই বউয়ের জন্য কিনেছি। আমার কল্পনায়ও সে ছিল না।”
“কৈফিয়ত কে চেয়েছে?” নিদ্রার রুক্ষ জবাব অথচ প্রশ্ন!
এহসান মৃদু হেসে বলে,
“তুমি চাও নি ঠিক আছে তবে তোমার মন চাইবে জানতে। তাই আগে থেকেই বলে দিলাম। তোমার তো বুক ফাঁটলেও মুখ ফুটবে না।”
নিদ্রা ক্ষুদ্ধ হলো! এহসানের হাতে থাকা প্যাকেট নিয়ে সোজা ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে। সত্যি বলতে তার ফ্রেশ হতে হবে। শরীর চুলকাচ্ছে, সেই কখন থেকে এই লেহেঙ্গা তার গায়ে।
নিদ্রা ড্রেসটি পড়ে লজ্জা আর অস্বস্তিতে পড়ে যায়। তবুও চুপ থাকে সমস্ত লজ্জা আর অস্বস্তি নর্দমায় ছুঁড়ে ফেলে মনে মনে। এহসান নাইটি পরিহিতা নিদ্রার দিকে একবার তাঁকিয়ে চোখ সরিয়ে নেয়। ওয়াশরুম যাওয়ার আগে নিদ্রাকে বলল,
“বিছানায় গিয়ে ঘুমাও।”
নিদ্রার জবাবের তোয়াক্কা না করে সে চলে যায়। নিদ্রা মনে মনে দ্বিধা দন্ধে ভূগছে। সে যেহেতু বিয়ে করে নিয়েছেই তাই সে সব রকম দায়িত্ব পালনে প্রস্তত। একটা সুযোগ সে দিবেই। এখন অনাকাঙ্খিত বিয়ে নিয়ে সে তামাশা করতে চায় না। তবে তার মানতে কষ্ট হচ্ছে চাইলেও পারছেনা সব ভুলতে। তবে ভুলতেই হবে। আমরা নিজেদের মন যেদিকে ঘুরাবো সেদিকেই তা থাকবে। মন আমাদের হাতেই কিন্তু আমরা তা বুঝতে পারিনা। মনে করি মন কি কোনো বারণ শোনে? কিন্তু চেষ্টা করে দেখলে বোঝা যায় যে, মন শোনে। সব শোনে শুধু একটু কষ্ট সহ্য করে নিতে হয়।
নিদ্রা শুয়ে চোখ বন্ধ করে নেয়। কিছুক্ষণ পর ঘরের আলো নিভে যায়। এহসানের অস্তিত্ব অনুভব করে সে। এহসান তার পাশেই শুয়েছে। নিদ্রার কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে যায়। বুকে শীতল হাওয়া বইতে থাকে। এই লোকটা কেন তার হয়েছে? কেন? এই লোকটা তো তার দূরসম্পর্কের কাজিন হিসেবেই ভালো ছিল। স্বামী হতে গেল কেন?
মিনিট দশেক পড়ে নিদ্রা অনুভব করল তার মুখের উপর উত্তপ্ত শ্বাস উপচে পড়ছে। এহসানের মুখমন্ডল যখন তার গলায় গিয়ে ঠেকল তখন সে চূড়ান্ত পরাজয় গ্রহণ করল। মনে হলো অভিশপ্ত রাত আর কলঙ্কিত চাঁদ তাকে ঘায়েল করেছে! সূচনা হলো দুটো ভিন্ন মানুষের অভিন্ন দিনের!
—————————
নিহারীকার চোখে সবে মাত্র ঘুম ধরা দিয়েছে । মেসেজের টুং টাং শব্দে ঘুম চোখ থেকে উধাও! হোওয়াটসআপ থেকে মেসেজ এসেছে আর মেসেজটি পাঠিয়েছে তার চাচাতো বোন মারিয়া।
“এই নিহা আপু? তুই কোথায়! বাড়ি ফিরে আয়। জেঠা টেনশন করছে।”
নিহারীকা মৃদু হাসে। এই টেনশন তার আরো আগে করা উচতি ছিল। যদিও সে টেনশন করছেনা তা নিহারীকা নিশ্চিত। তবে সে হয়তো ভয় পাচ্ছে। নিহারীকা হাত ফসকে গেলে তো সব শেষ! তবে নিহারীকা এটা মানে যে “নদীর একূল ভাঙে তো অকূল গড়ে।” তাইতো সে নতুন করে সব কিছুর শুরু করবে। হয়না! শেষ থেকে শুরু!
১৪.
ঝাউবন পেরিয়ে গেলেই সামনের জীপটা দেখা যাবে। উত্তপ্ত বালি পেরিয়ে এখন আবার ঝাউবন! সব মিলিয়ে নিহারীকার অবস্থা হয়েছে একেবারে রফাদফা! বহু কষ্টে যখন জীপের দেখা পায় তখন ক্লান্তি সব দূর হয়ে যায়। জীপে কালো হুডি পড়ে কেউ একজন বসে আছে। মুখে কালো মাস্ক, নিহারীকা দেখে ভ্রু কুঁচকে নেয়। এই এতো কড়া রোদে সে হুডি পড়ে আছে? মানা যায়! নিহারীকা জীপ গাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই গাড়িতে বসা সেই চালক গম্ভীর স্বরে বলল,
“আপনার নাম নিহারীকা এমদাদ।?”
নিহারীকা চট করে গাড়িতে উঠে বসল। আর চোখের সানগ্লাসটা খুলে একটু মুছে আবার চোখে লাগিয়ে বলল,
“জ্বি হ্যাঁ!”
কথাটা বলতে না বলতেই গাড়িটি বেশ দ্রুতই চালু দেওয়া হয়। তড়িৎ বেগে চলা গাড়িটিতে বসে থাকা নিহারীকা একবার এদিকে গিয়ে পড়ছে তো একবার ওদিকে। সিটবেল্ট লাগানোর মতো সময়ও সে পায়নি। নিহারীকা বেশ জোরেই হুংকার ছেড়ে বলল,
“হেই ইউ? মি. হোয়াটএভার! গাড়ি থামান বলছি এক্ষুণি থামান।”
পাশের ব্যক্তিটি গাড়ির ব্রেক কষে সাথে সাথেই নিহারীকা সামনের দিকে ঝুকে যায়। একটুর জন্য প্রাণে বেঁচেছে সে। চালক কে কিছু বলতে নিবে তার আগেই সে বলে ওঠে,
“মৃত্যুঞ্জয়! আমার নাম মৃত্যঞ্জয় সরকার। কোনো হোয়াটএভার না। গট ইট?”
নিহারীকা মৃত্যুঞ্জয় নামক পুরুষটির দিকে একদৃষ্টিতে অবাক চোখে চেয়ে থাকে। তারমানে এই সে লোক! যাকে সে সারা দেশ খুঁজে চলেছে সে নিজেই আজ তার সামনে। এর কারণ?
#চলবে
(আমার ভাই এখন সুস্থ আছে আগের চেয়ে। আমার মনেও স্বস্তি ফিরেছে। আর আগামীকাল থেকে নিয়মিত হচ্ছি। আর একটা কথা? সিন্ধুর নীলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র এসে গেছে। আর যেটা জানাতেই হবে তা হচ্ছে এটা থ্রিলার উপন্যাস। নামেই তার প্রমাণ মেলে।)