সিন্ধুর_নীল (পর্ব-১১) লেখনীতে– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

#সিন্ধুর_নীল (পর্ব-১১)
লেখনীতে– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

“আয়না” নামক বস্তুটির সামনে বসে আছে নিদ্রা। নিজেকে আজ কেমন অদ্ভুত সুন্দর আর পরিপূর্ণ লাগছে। এর কারণ? তার তো পূর্ণতা পাওয়ার আগেই স্বপ্ন ভেঙে গেছে। তাহলে এত সুখী লাগছে কেন? খোলসে আবৃত মনটা না যায় ছোঁয়া আর না যায় দেখা। মনটা তো ভেঙে টুকরো হয়ে গেছে। আর ভাঙা জিনিস জোড়া দেওয়া যায় না। তাহলে কেন এত অভিনয়? সুখে থাকার অভিনয়! কাল রাতে ঘটা যাওয়া ঘটনা তার স্মৃতিপট থেকে মুছতে পারছেনা সে। এহসান তো পুরুষ তাই তাকে চাইতে পারে কিন্তু সে কীভাবে মেনে নিল? শত বৈধ হলেও তো জোর জবরদস্তি অন্যায় কাজ। এহসান জোর করেনি মোটেও তবে নিদ্রাও আপত্তি করল না একটিবার। সে নিজের মধ্যেই ছিল না তখন। সব কিছু বুঝে ওঠার আগেই শেষ হয়ে গেল। যা সে স্বপ্নেও ভাবেনি তাই ঘটে গেল। আজ সকালে নিজেকে এহসানের বুকে আবিষ্কার করল। যা কিছু ঘটছে তা কেমন ধোঁয়াশা লাগছে তার কাছে। এমনটা তো হওয়ার ছিল না। তবে কেন হলো? কেন? সব প্রশ্ন বিষের মতো লাগছে নিদ্রার কাছে।

দরজা খুলে নিদ্রার মা আর এহসানের মা রুমে প্রবেশ করল। তারা নিদ্রাকে নিজের জামা কাঁপড় গুছিয়ে নিতে বলল। ১২ টার দিকেই সবাই ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিবে। সেখানে গিয়েই রিসেপশন হবে। অনেকেই ইতিমধ্যে বেরিয়ে গেছে। নিদ্রাও কোনো রূপ ঝামেলা করে না। তৈরি হতে থাকে সে। তবে মনে চলছে বিশাল ঝড়! সে এই মুহূর্তে যা করবে বলে পরিকল্পনা করছে তা যদি করে তবে ভয়ানক কিছু ঘটে যাবে। তবে সে নিশ্চিত সে তেমন কিছুই করবেনা। তবে পরিকল্পনা করে রাখছে। তবে কী তার কাজ অন্য কেউ করবে?

ব্যাগপত্র সব ঠিক করে নিদ্রা যখন নিচে নেমে এলো তখন সব কাজিন তাকে ঘিরে ধরে। সবাই নানান ঠাট্টা করে চলেছে তার সাথে। যা মোটেও নিদ্রার পছন্দ হচ্ছেনা। পৃথিলা টুকটাক কথা বলে নিজেদের গাড়িতে গিয়ে ওঠে। তারা গাড়িতেই যাবে যেহেতু আসার সময় নিজেদের গাড়িতেই এসেছিল। জার্নিও এখন বেশিই করতে হবে। তাই আগে আগেই রওনা দিচ্ছে। নিদ্রারা যাবে বিমানে করে। তাই তাদের তেমন জলদি নেই। তবে ১২ টার আগেই রিসোর্ট ছাড়বে তারা।
নিদ্রা একা একা হাঁটছিল তখন পাশ থেকে কিছু ছেলে মেয়ে তাকে টিটকারি করে বলতে থাকে,
“দেখ! আমরা ভাবী ভাবী বলে ডাকাতে মেয়েটা সত্যিই আমাদের ভাবী হয়ে গেল!”
সবাই এই কথা শুনে শব্দ করে হেসে ওঠে। নিদ্রার তীব্র রাগ হয় তবুও চুপ থাকে। কারণ রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন। এই মুহূর্তে চুপ থাকাই শ্রেয়। পরবর্তীতে সবাইকে বোঝাবে প্রথমা নিদ্রা কি জিনিস।

অভ্র আর নির্ঝর দাঁড়িয়ে আছে একসাথে। নির্ঝরের চোখ মুখ কেমন শুকিয়ে গেছে। কাল রাত ঘুমানো হয়নি তাই চোখের নিচে কালি জমেছে। আর চোখ দুটোও একটু লাল হয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে একটা আস্ত পাগল। টিপটপ নির্ঝরকে এখন দেবদাসের থেকেও কেমন অসহায় আর পাগল পাগল লাগছে। অভ্র নির্ঝরের দিকে এক ধ্যানে তাঁকিয়ে এসবই ভাবছে।

নির্ঝর মৃদু হেসে বলে,
“কীরে! কী দেখছিস এমন? আমি কিন্তু গে টে না। সো ঐভাবে দেখবি তো খবর আছে।”

অভ্র হেসে বলে,
“তুই আর বদলাবি না! সব সময় এমন টাইপ কথা না বললেই নয় কী?”

নির্ঝরের মুখটা হঠাৎ করেই কেমন বেজার হয়ে যায়। সামনের দিকে একদৃষ্টিতে তাঁকিয়ে বলল,
“আমার বদলে যাওয়া উচিত তাই না?”

অভ্র অবাক হয় এমন কথা শুনে। নির্ঝরের পিঠে চাপড় মেরে বলে,
“ব্যাটা তুই যেমন ছিলি এবং আছিস তেমনি থাকবি অলওয়েজ। প্রতিটা মানুষের একটি নিজস্ব স্বত্তা থাকে। যা সকলের থেকে আলাদা হয়। এটা ভালো কিংবা খারাপ যা-ই হোক না কেন এটা একান্তই তার নিজের ব্যক্তিগত সম্পদ। ইভেন! এই স্বত্তা জিনিসটা কখনো কারো সাথে মিলে যায়না পুরোপুরি। কিছুটা মিললেও পুরোটা মিলেনা বুঝলি! একটা মানুষকে প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠতে হলে সর্বপ্রথম নিজের স্বত্তাকে গ্রহণ করতে হবে সুষ্ঠভাবে। কেন না, আমরা মানে মানুষ জাতি যেন এটা বুঝতে পারি যে আমি/আমরা আলাদা। হাত, পা, কান, চোখ, মুখ, সব কিছু অপর ব্যক্তিটির মতো হলেও আমি আলাদা। এমন একটা চিন্তা ধারা নিজের মনের মধ্যে ধারণ করতে হবে। এতে করেই আমরা তৈরি করতে পারি নিজের আলাদা গন্তব্য এবং উদ্দেশ্য। এই যে সারা পৃথিবীতে এতো এতো মানুষ আছে তাদের সবারই নিজ নিজ পরিচয় আছে। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে আমরা অন্যকে দেখে ইন্সপায়রড হই তাদের মতো হতে চাই কিন্তু! আমরা পুরোপুরি তাদের মতো হতে পারিনা। যেমন ধর আমি তোর মতো হতে চাই। আমি তোর মতো চলছি ফিরছি কিন্তু আমি তুই না। আমি অভ্রই। বুঝলি তো! আরেকটা মোস্ট ইম্পোর্টেন্ট কথা হলো, আমরা যদি নিজেকে অন্যের মতো তৈরি করতে চাই তবে আমরা নিজের সাথেই বিশ্বাস ঘাতকতা করে ফেলি। আমরা অন্যের মতো হতে চাইব, তাই বলে নিজের স্বত্তা থেকে বেরিয়ে নয়। আমরা অনেকেই এই কাজটা করে ফেলি অন্যকে খুশি করতে। কিন্তু কী হয়? সে তো খুশি হয়ই না বরং আমরা নিজেদের স্বত্তাটা হারিয়ে ফেলি। দিনশেষে যার জন্য এতোটা বদল সেই আমাদের পাশে থাকেনা। এটাই প্রকৃত সত্য! তাই কখনো, আই মিন নেভার এভার! নিজেকে বদলাবি না। যদি খারাপ কিছু থাকে তা ত্যাগ কর কিন্তু নিজের স্বত্তা থেকে বেরিয়ে আসিস না। মানে খারাপ অংশটা কেটে দে তবুও বাকিটা সুন্দরভাবে শান্তিপূর্ণ ভাবে বজায় রাখ, নিজের মধ্যে ধারণ কর।”

নির্ঝর মুগ্ধ হয়ে অভ্রর বলা প্রতিটি কথা শুনল। অভ্রকে হুট করেই জড়িয়ে ধরে বলল,
“তুই এত বুঝদার কেন রে? আর এতটা ভালোই বা কেন? আমি তোর মতো হতে চাইনা তবে আমি আমার মতো করে ভালো হবো এবং নিজেকে চিনব আর নিজের আনন্দর, হাসি-কান্নার যত্ন নিব।”

অভ্রও নির্ঝরকে শক্ত বন্ধনে আবদ্ধ করে বলল,
“এইতো দেখ! তুই কতোটা বুঝদার। আমার কথাগুলো কী সুন্দর করে বুঝে গেলি।”

দুইজনের মুখেই হাসি। আর হাসিটি হলো প্রশান্তির। দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে এখন স্নিগ্ধ শ্বাস নেওয়ার আকুলতা দেখা দিয়েছে তাদের। অভ্র চট করেই মত বদলে নিল। সে আজই ঢাকা ফিরবেনা। হাতে যখন ছুটি আছে তখন সে মুক্ত আকাশে অতিথি পাখির মতো ঘুরে বেড়াবে।

১৫.
কক্সবাজারের কেএফসিতে বসে কোকাকোলা খাচ্ছে নিহারীকা। পাশেই বেশ আয়েশি ভঙ্গিতে বসে আছে মৃত্যুঞ্জয়। তার চোখে মুখে হাসি থাকে সবসময়। তখন মাথায় রাগ চড়ে গিয়েছিল তাই তো সে রূঢ় আর গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল। এখন রাগ নেই বললেই চলে। নিহারীকা নামক মেয়েটি তার কোনো ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে আসেনি বরং সাহায্য করতে এসেছে। আর সে চোখ পড়তে পারে তাইতো নিহারীকাকে সে বিশ্বাস করেছে। বর্তমানে সে নিজের সাধারণ তবে অসাধারণ রূপটায় ফিরে এসেছে। নিহারীকা মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে অলস ভঙ্গিতে তাঁকিয়ে বলল,

“আর কতক্ষণ এভাবে এখানে বসে থাকব আমরা? চিকেন ফ্রাইটাও তো এখনও আসেনি। বজ্জাত গুলো থার্টি মিনিট বলে ফোর্টি টু মিনিট ওয়েট করাচ্ছে। কি সাংঘাতিক ব্যাপার!”

মৃত্যুঞ্জয় ফিচেল হেসে বলল, “আমি চিকেন ফ্রাইয়ের অর্ডারটা ক্যান্সেল করে দিয়েছি তাই আসছেনা।”

নিহারীকা একপ্রকার চেঁচিয়ে উঠে বলল,
“হোয়াট! ক্যান্সেল করে দিয়েছেন? কই! কখন! আমি তো দেখিনি…”

“ঐ যে ওয়াশরুম যাব বলে উঠে গিয়েছিলাম তখন।”

“আপনার সাহস তো কম না মি. মৃত্যু! আপনি আমার অর্ডার ক্যান্সেল করেন।”

মৃত্যুঞ্জয় রাগেনি উল্টো হেসে বলল,
“বাহ দারুন তো! হোয়াট আ নিকনেইম! মৃত্যু? ইট সাউন্ডস্ বোমবাস্টিক!”

“বোমবাস্টিক? সেটা আবার কী?”

“আমার স্পেশাল ভাষা। আপনি বুঝবেনা না তবে আমার সাথে যতদিন থাকবেন এরকম আরো নতুন নতুন শব্দ সম্পর্কে জানতে পারবেন।”

“আপনি অদ্ভুত!”

“সবাই বলে।”

“জানেন? তবুও!”

“অভ্যাস হয়ে গেছে। আমার অপছন্দের কাজ অভ্যাস বদলানো। তাই আর ….”

“বুঝেছি বুঝেছি! কিন্তু আমার চিকেন ফ্রাই কি দোষ করল? আপনি কেন এমন করলেন!”

“করার যথেষ্ট কারণ আছে মিস. নিহারীকা। আমরা এখন পাহাড়ে উঠতে চলেছি আর এমন খাবার খেলে বদহজম হবেই মাস্ট! আর সেই অবস্থায় হাইকিং ইম্পসিবল! আপনি যদি মনে করেন আপনি পারবেন তো আপনি পুনরায় অর্ডার করতে পারেন। তবে আমি যা করছি এবং বলছি সবই আপনার ভালোর জন্য। নিজের ভালো পাগলও বোঝে।”

নিহারীকা অসহায় মুখ করে বলল,
“আমার সত্যিই প্রচন্ড ক্ষিদে পেয়েছে। সামান্য কোক খেয়ে থাকা যায়?”

“আমি তাহলে ফ্রুট সালাদ অর্ডার দেই? ভেজেটেবল্ ও দিতে পারি যদি আপনি চান।”

“নো নিড। আমি ওসব খাই না। আমরা তো বিকেল বেলায় যাচ্ছি, আমার হোটেল টা বেশি দূরে নেই। আগে একটা বাঙালী রেস্টরন্টে ঢুকে ভাত খেয়ে নিই। তারপর হোটেলে গিয়ে কিছুক্ষণ রেস্ট করার পর ফ্রেশ হয়েই যাব। এতে বদ হজমের চান্স নেই।”

মৃত্যুঞ্জয় কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
“ঠিক আছে। যাওয়া যায়, তবে আপনি কিন্তু নিজের কথা রাখবেন।”

নিহারীকা মৃদু হেসে বলল,
“আমি নিহারীকা! নিজের কথা রাখি এবং রাখব যদি আমাকে প্রাণ ত্যাগও করতে হয়।”

মৃত্যুঞ্জয় বিস্মিত নয়নে নিহারীকার দিকে তাঁকিয়ে বলে,
“জীবনের মায়া নেই আপনার? যা করতে চলেছি তাতে হয় জয় নয়তো মৃত্যু নিশ্চিত।”

“জীবনের মায়া আছে তবে পিছুটান নেই।” নিহারীকার স্পষ্ট জবাব। মৃত্যুঞ্জয় ভেবে পায়না মেয়েটি আর কতবার তাকে অবাক করবে।

————————-
এহসানের পাশে নিদ্রাকে দাঁড় করিয়ে সবাই কয়েকটা গ্রুপ ফটো তুলে নিল। অনিতা নিদ্রাকে নিয়ে যখন গাড়িতে বসায় তখন নিদ্রার চোখ যায় সেই কঠোর হৃদয়ের সুপুরষটির দিকে।

#চলবে।
(গঠন মূলক মন্তব্য না পেলে লেখার মজা নেই।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here