সিন্ধুর_নীল (পর্ব-১)

১.
“হ্যাঁ হ্যাঁ! ঐ মেয়েটাই গ্রীন ড্রেস পড়া। দেখ! জোরে জোরে ভাবী বলে ডাক।”
একটা ছেলে অনেক গুলো ছেলে মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বলল কথাটি। সবাই একযোগে চিৎকার করে ডাকতে থাকে সেই মেয়েটিকে যাকে উদ্দেশ্য করে কথাটি বলা হয়েছে।

“ভাবী! ভাবী!”

আত্মীয়ের বিয়েতে এসে সবার মুখে ভাবী ভাবী ডাক শুনে নিদ্রা বিস্মিত। কারো সাথে একটু পরিচয় হলেই সে-ই ভাবী বলে সম্বধোন করছে। ভরা রিসোর্টের প্রতিটা যুবক থেকে শুরু করে বালক তাকে শুধু ভাবী বলে টিজ করছে। সে ভেবেই পাচ্ছে না তারা কেন তাকে ভাবী বলছে! সে নিজেই তো এসেছে বিয়ের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে তাহলে তার মতো কুমরীকে ভাবী বলে হেনস্তা করা হচ্ছে কেন? এখানে হাতে গোনা দুই তিন পরিবার ছাড়া সে আর কাউকেই চিনেনা। চট্টগ্রামের এই নামকরা রিসোর্টটাতে বাবা আর মায়ের সাথে এসেছে সে। তার মায়ের দাদারা দুই ভাই ছিলেন। নিদ্রার মায়ের ছোট দাদার ঘরের নাতনি নিদ্রার মায়ের চাচাতো বোন হয় সম্পর্কে। আজ সেই চাচাতো বোনের ছেলেরই মানে নিদ্রার সম্পর্কে খালাতো ভাই হবে তার বিয়ে। এত দূরসম্পর্কের আত্মীয়র বিয়েতে সে একদমই আসতে চায় নি। মায়ের জোরাজুরিতেই আসতে হলো তাকে। যার বিয়ে সেই ছেলে পেশায় সফট্ওয়ার ইন্জিনিয়ার। নামটা যেন কি? ইশান না কুশান? ধুর মনেও থাকেনা। নিদ্রার এই এক সমস্যা পরিচিত না হলে কারো নাম মনে রাখতে পারেনা বেশি একটা। তার মায়ের সাথে তার সেই খালামণির ভাব খুব বেশি। এতবছরেও একজন আরেকজনের সাথে যোগাযোগ রেখেছে। তবে নিদ্রার সাথে তার দুবারই দেখা হয়েছে তার পরিবারের আর কারো সাথে হয়নি। তাই সে এখানে আসতে সংকোচ বোধ করছিল অনেক। অবেশেষে যখন এসেছে তখন শুরু হলো আরেকটি বিশ্রী ব্যাপার। ইচ্ছে করছে ঢাকায় ফিরে যেতে কিন্তু এখন তো আর সেটি সম্ভব না! তাকে যে রুমটা দেওয়া হয়েছে সেই রুমে গিয়ে ব্যাগটা রেখে সে মাথায় হাত দিয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকে। তারপর ফ্রেশ হয়ে আসে। তোয়ালেতে মুখ মুছে সামনে থাকা বিরাট ব্যালকনির গ্রিলে তা ঝুলিয়ে রাখে। এখানে আর কিছুই নেই যে ভেজা কাপড় রাখতে পারবে। মুখ দিয়ে বিরক্ত সূচক শব্দ করে সে বিছানায় গিয়ে বসে। মোবাইলটা হাতে নিচ্ছিল তখনিই দরজা খুলে তার আপন মামাতো বোন পৃথিলা তার রুমে ঢোকে। নিদ্রা সেদিকে তাঁকিয়ে মুঁচকি হাসে তবে ভেতরে ভেতরে আবারও বিরক্ত হয় কারণ সে লক করেনি কিন্তু এর মধ্যে সে ওয়াশরুমও গিয়ে এসেছে। এর মধ্যে যদি কোনো অসাধু ব্যক্তি রুমে প্রবেশ করত! তখন কি হতো?

নিদ্রাকে ভাবনার সাগরে মত্ত থাকতে দেখে পৃথিলা মৃদু হেসে বলে,

“কীরে! কেমন লাগছে? রিসোর্টটা সুন্দর না!”

“সুন্দর কিন্তু!”

“কিন্তু? কীসের কিন্তু!”

“দেখ না আপু এসেছি থেকে সবাই আমায় কেমন বিরক্ত করছে।”

“বিরক্ত?”

“হ্যাঁ! যাকে দেখি বা একটু কথা বলি সে-ই ভাবী বলে টিজ করছে। এটা কেমন ব্যাপার? আমি তাদের কোন ভাইয়ের বউ যে ভাবী বলে ডাকছে তারা আমায়!”

“আরে তুই তাহলে জানিস না!”

“কি জানব?”

“এহসান ভাইয়ের হবু বউয়ের নামও নিদ্রা। প্রথমে আমরাও নামটা শুনে চমকে গিয়েছিলাম এবং সবার আগেই তোর মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠছিল।”

“এই এহসান টা কে?”

“আরে কে আবার! যার বিয়েতে এসেছিস তার নামটাই জানিস না? ভালোই! বরের নাম যেখানে জানিসনা সেখানে বউয়ের নামটাও না জানারই ব্যাপার। আচ্ছা নিদু? তুই এত উদাসীন কেন রে!”

“আমি উদাসীন?”

“হ্যাঁ তো!”

“হতেও পারে। আচ্ছা শোনো না আমার খুব ক্ষিদে পেয়েছে।”

“এই দেখ! এখন বলছিস খাবারের কথা! তোর আরো আগেই বলা উচিত ছিল নিশ্চয় ক্ষিদে দু তিন ঘন্টা আগেই লেগেছিল।”

নিদ্রা কিছু বলেনা শুধু মাথা দোলায়। যার অর্থ হ্যাঁ। পৃথিলা হতাশ হলো। তার চৌদ্দ গুষ্ঠিতে এই নিদ্রাই একটা মানুষ যার নিজস্ব দুনিয়ার বাহিরে আর কিছুর খবর থাকেনা। গম্ভীর, নিশ্চুপ মেয়েটাকে দেখলে অনেকেই প্রথম যাত্রায় মেয়েটাকে অহংকারি মনে করে। তারা মনে করে রূপ আর পড়ালেখা নিয়েই তার এত অহংকার। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে যে তার সাথে মিশে সে জানে নিদ্রা কতটা নরম মনের মানুষ। পৃথিলা নিদ্রাকে তাড়া দিয়ে বলল,

“ওঠ!”

“কেন?”

“কেন মানে! খেতে যাবি।”

“এখানে এনে খাওয়া যায়না আপু!”

“যায় তবে নিচের যেই রেস্টুরেন্টটা আছে সেখানে গিয়েই সবাই প্রতিবেলার খাবার খায়। ভাইয়ারা তো সব কিছু চারদিনের জন্য বুকড করে ফেলেছে। আর জানিস! জায়গাটা এতটা সুন্দর কি আর বলব! গেলেই দেখতে পাবি।”

“তারা খুব ধনী?”

“হুম আমাদের আর তোদের থেকেও।”

“আমরা আর ধনী কই হলাম? সব তো বাবা আর ভাইয়ের করা। আমাদের নিজের যেদিন কিছু হবে সেদিনই আমাদের কথাটা বলব।”

“আচ্ছা ঠিক আছে এখন চল। আর চাবিটাও নে লক করে বেরুবি।”


রেস্টুরেন্টটা সত্যিই চমৎকার। চারিদিকে দামি দামি ফার্ণিচার ঝারবাতি সামনেই কাঁচের দেয়াল বেধ করে দেখা যাচ্ছে সুইমিং পুল। ওয়েটাররা খুব সুন্দর ব্যবহার করছে। সব কিছু মিলিয়েই খুব ভালো লাগছে নিদ্রার। বিরক্তি টা কিছুটা হলেও কমেছে। ফ্রাইড রাইস আর চিলি চিকেন টা একটু একটু করে খাচ্ছে আর পরিবেশটা উপভোগ করছে নিদ্রা। পাশেই পৃথিলা লেমনেড খাচ্ছে আয়েশ করে। এখানে আসার সাথেই সাথেই সে খাবার অর্ডার করেছে। খাবারও দশ মিনিটে হাজির হয়েছে। নিদ্রা আপনমনে খাবার খাচ্ছিল তখন কোথা থেকে দুইজন যুবক এসে তাদের সামনের সোফায় বসে পড়ে। খাওয়া থামিয়ে সেদিকে ভ্রু কুঁচকে তাঁকায় নিদ্রা। ব্যাপারটা যে তার একদমই ভালো লাগেনি তা হয়তো দুই যুবকও বুঝে গেছে। সত্যি বলতে তারা দুজনে খুবই সুন্দর আর স্মার্ট। তবে স্বভাবটা বাজে যার ফলে নিদ্রার ভালো লাগেনি। নীল শার্ট পড়া একজন হুট করেই বলে ওঠে,

“মিস ভাবী!”

নিদ্রা আকস্মিক আবারও সেই বিরক্তিকর ডাকটিতে রেগে যায়। গরম চোখে তার দিকে তাঁকাতেই লোকটি বলল,

“সবাই বলাবলি করছে ভাবী এসেছে ভাবী এসেছে তাই ভাবীকে দেখতে এলাম। কিন্তু আমি ভিষণ আশাহত, আপনার সাথে তো ভাবীর একটুও মিল দেখছিনা।”

“কারণ আমি ভাবী নই।”

“যাক! আপনি ভাবী নন জেনে বুকের আগুনটায় কেউ যেন পানি ঢেলে দিল। এবার শান্তি!”

“মানে?”

“মানে কিছুনা। আচ্ছা আপনার নাম নিদ্রা রাইট! আমি নির্ঝর আর ও আমার বন্ধু অভ্র।”

নিদ্রা নির্ঝরের পাশে বসা ছেলেটির দিকে তাঁকায়। ছেলেটি কিছুই বলছেনা খুব গম্ভীর হয়ে আছে। এই ছেলেটি নির্ঝরের মত গৌড় বর্ণের নয় এই ছেলে উজ্জবল শ্যাম বর্ণের অধিকারী। তবে তাকে নির্ঝরের চাইতেও বেশি ভালো লাগছে দেখতে। নিদ্রা হুট করেই খেয়াল করে অভ্রর কালো শার্টটির হাতা ফোল্ড করে রাখা আর যাতে তার পুরুষালী শক্ত হাতটা দৃশ্যমান হয়ে আছে প্রচন্ড আকর্ষণীয় ভাবে। নিদ্রা চোখ সরিয়ে নেয় তার থেকে। চোখটাই যেন ঝলসে যাবে আর কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলে। তখনিই একটা ভরাট কন্ঠ তার শরীরে শিহরণ বসিয়ে দেয়। মুখ তুলে তাঁকাতেই দেখে অভ্র নামক প্রাণীটি নির্ঝর নামক প্রাণীকে বলছে,

“ভাবী দেখা শেষ? এখন চল।”

“এই দেখা শেষ হবে নারে।”

“শেষ করতেই হবে করার কিছু নেই। উনি খেতে বসেছেন এভাবে তাকে বিরক্ত করার কোনো মানেই হয়না চল।”

নির্ঝরকে এক প্রকার টেনেই উঠিয়ে নিয়ে গেল সে তবে যাওয়ার আগে বিনয়ের সাথে নিদ্রাকে উদ্দেশ্য করে বলল,

“আই এম এক্সট্রিমলি সরি মিস! না চাইতে ডিস্টার্ব করে ফেললাম। প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড।”

তাকে উদ্দেশ্য করে বলা এই তিনটি বাক্য যেন নিদ্রাকে নাড়িয়ে দিল। কেমন লোভনীয় দৃষ্টিতে সুপুরষটির যাওয়ার পানে তাঁকিয়ে ছিল সে। ধ্যান ভাঙে তখন যখন পাশ থেকে পৃথিলা বলে,

“কালো শার্ট পড়া ছেলেটা কত সুন্দর! কি সুন্দর তার চাল চলন আর কথা বলার ধরণ। দেখলি?”

নিদ্রার হঠাৎ করেই তার প্রিয় আপুটার প্রতি খুব রাগ হয়। ছেলেটাকে সে সুন্দর বলল কেন? নির্ঝরকে বলত অভ্রকেই কেন!

করিডোরে একা একা হাঁটছিল নিদ্রা তখনিই একদল এসে আবারও তাকে ভাবি ভাবি বলে ডাকতে শুরু করে। নিদ্রা তাদের দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে কিন্তু তারা চুপ হয়না। কিন্তু হঠাৎ করেই সবাই দৌঁড়ে সেখান থেকে চলে যায়। নিদ্রা তাদের অদ্ভুত আচরণে অবাক হয়। তখনিই পেছন থেকে কেউ খুব মধু মিশ্রিত গলায় তাকে বলল,

“কিছু মনে করবেনা নিদ্রা। আমি খবর পেয়েছি তুমি এসেছো থেকেই এরা তোমায় ভাবি ভাবি বলে বিরক্ত করছে। পরে জানলামও কারণ কি। আসলে বিয়ে বাড়ি তো তাই এমন মজা হাসি ঠাট্টা করাই হয়। প্লিজ কিছু মনে কর না।”

নিদ্রা পেছন ফিরে দেখে লম্বা সুঠাম দেহী এক সুদর্শন পুরুষ তার দিকে মুঁচকি হেসে তাঁকিয়ে আছে। লোকটি কে তা সে চিনতে পারেনি। তাই সে জিজ্ঞেস করে,

“আপনি কে?”

“এহসান, এহসান মাহবুব। আমার বিয়েতেই তুমি এসেছো আর আমার হবু স্ত্রীর নামই নিদ্রা।”

নিদ্রার হুট করেই এহসানের উপর রাগ উঠল। সে ধমকের সুরে বলে ওঠে,

“আর মেয়ে পাননি বিয়ে করার জন্য! পেয়েছেন যখন তার নাম নিদ্রা কেন হতে গেল? আর কোনো নাম কী নেই তার!”

এহসান নিদ্রার হঠাৎ করা উগ্র ব্যবহারটা ঠিক হজম করতে পারেনি। কিছু বলতেও পারছেনা মুখ দিয়ে কথা বের হয়না তার। নিদ্রাও রাগে ফুসতে ফুসতে জায়গা ত্যাগ করে। সবকিছুই এখন তার কঠিন বিরক্ত লাগছে।

#চলবে।

#সিন্ধুর_নীল (পর্ব-১)

লেখনীতে–ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

(বলেছিলাম ডিসেম্বরে নতুন করে শুরু করব আর শুরু করলাম ও। কুঞ্জলতার পর আর নিয়মিত হতে পারিনি সোশ্যাল মিডিয়াতে। যার ফলে গল্প জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলাম। দয়া করে রেসপন্স করবেন। কেমন লেগেছে জানাবেন। ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here