#সিন্ধুর_নীল (পর্ব-২১)
লেখক– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।
৩৩.
আজ রবিবার। আকাশ একদম ঝকঝকা ফকফকা! নিদ্রা শ্বশুরবাড়ির এবং বাপের বাড়ির সবার থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে বসে। এহসানকে সকাল থেকে দেখেনি সে। এই যে এখন চলে যাচ্ছে এখনও তার দেখা মেলেনি। বিদায় বেলাতে এহসানকে দেখতে না পাওয়াটা তাকে কিছুটা ব্যথিত করেছে বোধ হয়। কেন? তা সে জানেনা। কিছুদিন একসাথে বসবাস করেছে তার ফলেই হয়তো নিদ্রার মনে বিরাজমান সে। কয়দিন আলাদা থাকলেই আবার সব আগের মত হয়ে যাবে বলে নিদ্রা মনে করে।
কয়েক ঘন্টার জার্নি শেষে যখন রাজশাহীর সেই হলে গিয়ে পৌঁছায় তখন সারাদিনের ক্লান্তিরা তাকে ঘিরে ধরে। ফ্রেশ হয়ে আসার সময় নিয়ে আসা কিছু হালকা খাবার খেয়ে শুয়ে পড়ে। তার রুমমেট মুনতাহা আর অনিন্দিতা তার সাথে কথা বলার জন্য এগিয়ে আসতেই নিদ্রা বলল,
-“অনু, মুন? আমি খুব ক্লান্ত রে! একটু ঘুমাই?”
মুনতাহা বলল,
-“হ্যাঁ অবশ্যই। আমরা না হয় পরেই কথা বলব।”
অনিন্দিতা আর মুন সোজা রুম থেকেই বেরিয়ে গেল। সন্ধ্যা নামবে আর কিছুক্ষণের মধ্যে। হলের সামনেই এই সময় ভেলপুরি পাওয়া যায়। তারা চট করে সেগুলো কিনে আনতে যায়। নিদ্রা বেশিক্ষণ শুয়ে থাকবেনা তা তারা জানে। আজান দিলেই তড়িৎ গতিতে উঠে নামায পড়ে নিবে। আজ তো আবার কাজাও বাকি আছে।
নিদ্রা যখন উঠে তখন চারিদিকে মাগরীবের আজান দিচ্ছে। সে উঠে যোহর, আসর টাও কাজা পড়ে নিল। মুনতাহা আর অনিন্দিতাই কেবল মাগরীব পড়ে কারণ তাদের কাজা নেই। নিদ্রা সবেমাত্র নামায শেষ করে বিছানায় এসে বসে। তখনিই অনিন্দিতা আর মুনতাহা ভেলপুরি, চিকেন চাউমিন, আর এক লিটারের একটা ঠান্ডা মোজো নিয়ে তার পাশে বসে পড়ে। নিদ্রা ওদের মুখপানে তাঁকিয়ে হাসে। দীর্ঘ একমাস পর তাদের দেখা হচ্ছে। এর মধ্যে পনেরদিনের মতোই ঐ বিয়ের ব্যপারে আটকা ছিল আর তার আগে নিজের বাসায়। এই মেয়েগুলোর সাথে তার বিয়ের দিনের পর থেকেই আর কোনো কথা হয়নি। যোগাযোগ করার মত অবস্থাতেই তো ছিল না। অন্য কেউ হলে ব্যাপারটা আমলে নিয়ে খুব বেশি বড় একটা হাঙ্গামা করে ফেলত। আর তারা কী সুন্দর তার মন বুঝে গেছে। নিশ্চয়ই কিছু একটা হয়েছে। আর সব জানতেই নিদ্রার ম্যুড ঠিক রেখেই সব শুনতে এই আয়োজন। এমনিতেও তারা সব সময় এমন আড্ডা দিয়েই থাকে। তবে আজকের ব্যাপারটাতে একটু ভিন্ন ব্যাপার আছে। নিদ্রা হেসে বলল,
-“এই কয়েকদিন নামাযের অনেক হেলাফেলা করেছি রে!”
-“কেন? এমন তো করিস না।”
-“এবার করে ফেলেছি।”
-“আচ্ছা মাফ চেয়ে নিস।”
-“চাইছি কিন্তু আল্লাহ যদি মাফ না করে?”
-“আল্লাহ’র দয়া নিয়ে তুই বোধ হয় কিছুই জানিস না। তিনি যে মাফ করে দিতে জানে তা কি তুই জানিস না? তার মাফ করারও যে কতবড় গুণ আছে।”
-“জানি তো।”
-“তবে চুপ থাক। এখন থেকে নিয়মিত পড়বি। মিস না দিলেই হয়।”
-আচ্ছা।”
মুনতাহা এতক্ষণ গ্লাসে কোক ঢালছিল। সে নিদ্রা আর অনিন্দিতার দিকে গ্লাস বাড়িয়ে বলল,
-“আচ্ছা সেইসব রাখ। চিন্তা করিস না। এখন বল যে কি এমন হয়েছিল যার জন্য তোর এতবড় একটা প্রেয়ার মিস যায়?”
-“আমি তোদের এখন যেটা বলব সেটা শুনে তোরা আমাকে কি বিশ্বাস করবি?”
-“কেন করব না? আমরা তো তোকে অবিশ্বাস ও করিনা।”
-“তোরা কষ্ট পাবি?”
-“কষ্ট পাওয়ার হলে কী কষ্ট পাব না?”
-“আমার তোদের কথাটা বলতে বুক ভার হয়ে আসছে।”
-“বলিস না তবে।”
-“না বললে থাকতে পারব না।”
-“তাহলে দেরি না করে বলে ফেল।”
-“আমার বিয়ে হয়ে গেছে।”
অনিন্দিতা চিৎকার করে উঠল “কি” বলে। তবে মুনতাহা আগের মতোই নির্বিকার। সে আগে থেকেই বুঝতে পেরেছিল এমন কিছু হবে, এমন সংবাদই বোধ হয় পাবে। অনিন্দিতা মৃদু রাগ দেখিয়ে বলল,
-“হাউ? হাউ নিদ্রা? আমাদের বললি না? আমাদের! এই তোর বেস্টফ্রেন্ডের নমুনা?”
নিদ্রার চোখের পানি গড়িয়ে পড়ে। এতদিনে সে তার কষ্টগুলো প্রকাশ করে কেঁদে বুক হালকা করতে পারছে বোধ হয়। সে বলল,
-“হঠাৎ করেই হয়ে গেল। আমি চাইনি।”
মুনতাহা গ্লাসের তরলে চুমুক দিয়ে বলল, -“পুরোটা বল!”
চোখ মুছে এক এক করে সব কিছো খুলে বলল নিদ্রা। অনিন্দিতার রাগ নিমিষেই গায়েব হয়ে গেল। তবে, মুনতাহার মধ্যে বিশেষ পরিবর্তন দেখা গেল না। সে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন করল,
-“এহসানকে কেমন লাগে তোর?”
-“ভালো না।”
অনিন্দিতা যেন ঝাঁপিয়ে পড়ে জিজ্ঞেস করল,
-“সুন্দর না? হায় রে সবদিক থেকে মেয়েটার কপাল পুড়েছে।”
-“সুন্দর না কে বলেছে? হবে তার বাহ্যিক সৌন্দর্য উপচে পড়া। ভেতরটাই আমার অসহ্য লাগে।”
-“কেন? ভেতরে কোথাও কোনো সমস্যা আছে নাকি?”
অনিন্দিতার চোখ মুখ কিছুটা নেতিবাচক ভঙ্গিমা ফুঁটিয়ে তোলে। নিদ্রা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল,
-“আজব! তুই শোধরাবি কবে? এই নামায কালাম পড়ে যদি ঐসব নিয়েই ঘাটিস তো আর ভালোটা হলো কোথায়?”
অনিন্দিতা এবার নিষ্পাপ চেহারা করে বলল,
-“ছিঃ নিদু! আমি তো তোকে এটাই বলছিলাম যে মন টোন আবার কালো নাকি! তুই কীসব ভাবিস? জেনারেশন টাই এমন যে না বিগড়ে উপায় নেই। আহারে!”
-“থামবি তোরা! একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা চলছে তার মধ্যে তোর এসব না ঢোকালেই হয়না অনি?”
-“আমি আবার কি করলাম মুন? ও তো ভুল ভাবছে।” অনিন্দিতার চোখে মুখে দুষ্টুমি ভরা হাসি। তার কষ্ট লাগলেও সে কেন যেন একটু মজা পাচ্ছে। হঠাৎ করেই সে বলল,
-“নিদু রে! তোর জামাইর ছবি টবি আছে?”
-“জানিনা।”
-“জানিনা মানে কী? জামাইয়ের ছবি থাকবেনা তা হয়?”
-“না নেই।”
-“আচ্ছা ফোনটা দে।”
-“কেন?”
-“দিতে বলেছি দে।”
অনিন্দিতা ফোনটা একপ্রকার কেড়েই নিল। পাসওয়ার্ড তার জানাই আছে। তাই আর অসুবিধা হলো না লক খুলতে। অনেক খুঁজেও যখন পেল না তখন হতাশ হয়ে বলল,
-“ফেসবুক আইডি আছে?”
-“থাকলেও আমি জানিনা।”
-“আজকাল সবারই থাকে। দেখি তার নাম বল।”
-“নাম? এহসান মাহবুব না মাহমুদ কি একটা খেয়াল করতে পারছিনা।”
-“হায়রে! নিজের জামাইর নাম মনে নাই? আজকালকার জেনারেশনটাই খারাপ। হাবিজাবি সবই মনে থাকে কিন্তু দরকারি জিনিস মনে রাখেনা।”
-“এই? তুই যে কথার সাথে সাথে বলছিস আজকালকার জেনারেশন, তুই কি আগেরকার জেনারেশন? তুই আমাদের সময়কারই তো!”
-“তো? আমি তোদের মত এত উদাসীন না তো সব ব্যাপারে। ভালোই আছি হু।”
মুনতাহা বলল,
-“পৃথিলা আপু না গিয়েছিল?”
-“হ্যাঁ।”
-“ওর কাছেই খোঁজ তাহলে।”
-“আরে না। ব্যাপারটা কেমন একটা হয়ে যাবে।”
-“পৃথিলা আপু তো ফেসবুকে ছবি টবি খুব ছাড়ে। দেখ তো বিয়ের কোনো ছবি ছাড়ছে কিনা!”
নিদ্রার এবার টনক নড়ে। আসলেই পৃথিলা তো ছাড়বেই। এই বিয়েটা নিয়ে কত এক্সাইটমেন্ট ছিল তার মধ্যে। নিদ্রার এই কয়দিনে এফবিতে লগইন করা হয়নি। সে আজ কি মনে করে লগইন করল। লগইন করেই দেখল মোটামুটি তার অনেক কাজিন বিয়েতে তোলা ছবি পোস্ট করেছে। নিদ্রার ছবিও আছে। নেই শুধু এহসানের। সে পৃথিলার আইডিতেই কেবল তার আর এহসানের ছবি পেয়েছে। এবং আশ্চর্যজনক ভাবে দুজনেরই হাস্যজ্জ্বল ছবি সেটা। মনে হচ্ছে হ্যাপিলি ম্যারিড! অনিন্দিতা একপ্রকার কেড়ে নিল ফোনটা। সেখানে ঢুকেই হা হয়ে গেল। বিড়বিড়িয়ে বলল,
-“হি ইজ টু মাচ্ হ্যান্ডসাম! হেই গার্লস হোল্ড মি!”
তারপর নিদ্রার দিকে তাঁকিয়ে পুনরায় বলল,
-“ট্রাস্ট মি নিদু! এই ছেলের সাথে যদি এক্সিডেন্টলি আমার বিয়ে হতো তবে আমি খুশিতে হার্টফেইল করতাম। আর দরকার পড়লে এক্সিডেন্টলি বিয়েটা আমিই ঘটিয়ে ফেলতাম। গেট দিস ম্যান এ ডাইভোর্স! আই ওয়ান্ট টু ম্যারি হিম! ও মাই! হি ইজ ফায়ার! হিজ আই’স! জাস্ট কিলিং মি! ক্রিস ইভানসের মতোন লাগছে। ওহ নো! আই কান্ট ব্রিদ।”
অনিন্দিতার হা হুতাশ স্বাভাবিক। কেন না এমন সুন্দর ছেলে দেখলেই মাথা ওর ঘুরে যায়। আর উত্তেজনায় ইংরেজী চর্চা বেশি করে। তবে এই স্বাভাবিক অভিব্যক্তিটাও নিদ্রার অস্বাভাবিক ঠেকছে। এই অতি সুদর্শন পুরুষ তার স্বামী। আর সে কিনা এতদিন নজরও দেয়নি। আর এখন এমন কথা শুনে তার গা কাঁপছে। বুক জ্বলছে। অসহ্যকর অনুভূতি!
৩৪.
এহসান নিজের রুমে বসে ছিল। নিদ্রা কয়েকদিনেই তার হৃদয়ের পুরোটা দখল করে নিয়েছে। সে নিদ্রাকে খুব করে মিস করছে। আজ নিদ্রাকে বিদায় দিতে না যাওয়ার পেছনে দু’টো কারণ রয়েছে। এক, নিদ্রাকে বিদায় দিতে তার কষ্ট আরো বেশি হতো। দুই, সে নিদ্রার মনে নিজের জন্য কিছুটা ভাবনা তৈরি করতে এমন করেছে। তার না যাওয়া যেন তাকে ভাবায় খুব করে। সে চায় নিদ্রা তাকে ভালোবাসুক। তার অভাববোধ করুক। কারণ নিদ্রা তার অঘোষিত প্রিয়তমা! কেবল তার, কেবলই তার!
——————–
নির্ঝর সবে মাত্র বিছানায় গা এলিয়েছে। ওমনি মোবাইল ফোন টা ক্রি ক্রি করে উঠল। বিরক্তি নিয়ে কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে কেউ বলল,
-“ঘুমাতে যাচ্ছিলেন?”
আকস্মিক নারী কন্ঠের এমন প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেল সে। অবাক হয়ে বলল,
-“আপনি কে? এত রাতে কল করে এসব কি ধরনের প্রশ্ন করছেন?”
-“আমি আপনার কেউ না। তবে আপনি আমার অনেক কিছুই হয়ে গেছেন। তা আপনি জানেন? উহু! জানবেন না। আপনি তো আমাকে অপছন্দ করেন খুব।”
নির্ঝরের এবার কেন যেন কন্ঠটা পরিচিত ঠেকল। খট করে কল কেটে নম্বরটা ব্ল্যাকলিস্টে ফেলে দিল। তার ধারণা যদি সত্যি হয় তবে কলকারীর করুন দশা করবে সে।
#চলবে।
(একটা গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য দিয়ে যাবেন।)