সিন্ধুর_নীল (পর্ব-২২) লেখক– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

#সিন্ধুর_নীল (পর্ব-২২)
লেখক– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

৩৫.
কাঠফাঁটা রোদে ঘেমে নেয়ে একাকার হওয়া নির্ঝর যখন বহু কষ্টে একটি বাস পায়, তখন একনিমিষেই তার ক্লান্তি মিটে যায় বোধ হয়। আজ গাড়িটা হঠাৎ করেই যে নষ্ট হয়ে যাবে তা সে জানত না। অবশ্য নষ্ট হলে আগাম বার্তা জানা যায়ও না। কথা হচ্ছে গাড়িটা নষ্টও হয়নি তেল ফুরিয়েছে। কয়দিন বাসার বাহিরে ছিল গাড়ির দরকার পড়েনি খোঁজ খবর ও রাখেনি। আর এতটাই বেখেয়ালি ছিল যে তেল ভরতে হবে এমন কিছু মাথাতেও আনেনি। এখন মাঝরাস্তায় আটকা পড়েছে সে। কি বাজে অবস্থা! ঐদিকে এহসান কল দিয়েই যাচ্ছে। মিটিং শুরু হতে আর পনেরো মিনিট বাকি। তাই রাস্তাতেই গাড়ি ফেলে হাঁটা ধরে। উত্তপ্ত রোদের জ্বালায় অবস্থা হয় আরো ভয়াবহ! অবশেষে বাস পেয়ে মাথা একটু ঠান্ডা হলো। আর মাথা ঠান্ডা থাকলে বাকি সব আপনাআপনি ঠান্ডা হয়ে যায়। ভাগ্য প্রসণ্ণ ছিল বলেই জানালার পাশে একটি সিট পেয়েছে। বাতাসের তালে তালে তার ঘামে ভেজা শার্টটাও শুকিয়ে যাচ্ছে। যাক! এটাতেও একটু স্বস্তি! ঘামে জবজব করা শার্ট পরে তো আর বসদের সামনে যাওয়া যায়না। ব্যাপারটা অস্বস্তিকর সাথে সাথেই লজ্জাজনকও বটে! বাস তার গন্তব্যে পৌঁছানোর দুই মিনিট আগেই নির্ঝরের বাসটার পাশ দিয়ে একদম ঘেসে আরেকটা বাস যাচ্ছিল। একটু জ্যাম লাগার কারণে দুইটাই পাশাপাশি আটকে গেল। নির্ঝর ফোনেই ব্যস্ত ছিল তবে বাস আবার থামাতে সে চোখ তুলে আশপাশটা দেখে বোঝার চেষ্টা করল যে কি হয়েছে। যদিও সে আন্দাজ করেছিল যে জ্যামই হবে তবুও চোখটা যেই তুলেছে তখন ঠাউর করল যে তার পাশের বাসে একদম তার জানালার সাথেই অপর বাসের জানালাটি লাগোয়া ভাবে আছে। তাতে বসে আছে নিহারীকা! তবে সে চোখ বুজেই রয়েছে। তখন নির্ঝরও কি মনে করে দ্রুতই কালকের ব্ল্যাকলিস্টের নাম্বারটা ব্ল্যাকলিস্ট থেকে সরিয়ে নেয়। এবং তাতে তার অন্য নম্বর থেকে কল করে, বাহিরে হওয়া শব্দর কারণে সে কিছু শোনেনি তবে রিং হচ্ছিল তা সে বুঝতে পেরেছে ঠিকই। নির্ঝর চমকটা তখনিই পায় যখন নিহারীকা তার ফোন কানের পাশে রেখে ছোট করে বলল,
-“হ্যালো!”

উত্তেজনায় নির্ঝরের হাত কাঁপে। এত বড় অসভ্যতামি নিহারীকা তার সাথে কীভাবে করল সে ভেবে পায়না। তাকে কল করে সে কীসব বলেছে! ছিঃ!”

নির্ঝর কলটা কেটে দেয়। তারপর আবারও ব্ল্যাকলিস্টে ফেলে। তার মেজাজ খারাপ হয়ে যায় পুনরায়। জানালা থেকে মুখ সরিয়ে নেয়। বাসও আবার চলা শুরু করল। তার কিছুক্ষণ পরেই বাস থামলে নিজ গন্তব্য চলে যায়। ব্যাপারটা হজম করতে তার ভারী সমস্যা হচ্ছে।

৩৬.
নিদ্রা আজ ক্লাস করেই হলে ফিরে এসেছে। মুনতাহা আর অনিন্দিতা দুইজনেই এই সময়ে একটা একটা করে টিউশনি করায়। মূলত শখের বশেই করায় আর হল থেকেও কাছে। আসা যাওয়াতে খরচ নেই বরং মাস শেষে দুজনের পকেটেই একটা ভালো অ্যামাউন্ট আসে তাই তারা টিউশনি টা আনন্দ নিয়েই করায়। নিদ্রার টিউশনি টা সে মুনতাহাকে দিয়ে দিয়েছে। সে আসলে শিক্ষিকা হিসেবে ভালো নয়। একজন ছাত্রীকে তার শিক্ষক যেভাবে ধীরে ধীরে সবটা বুঝিয়ে পড়া টা শেখাতে পারে সে তা পারেনা। তার খুব অসহ্য লাগে। সবার তো আর গুরুদায়িত্ব নেওয়ার মতো যোগ্যতা নেই! তাই সে তার টিউশন টা মুনতাহার মতো ধৈর্য্যশীল মেয়েকে হস্তান্তর করেছে। মুনতাহাও ব্যাপারটা মন্দ না বলে সামলে নিয়েছে।

নিদ্রা যখন ফ্রেশ হতে যাওয়ার জন্য জামাকাপড় বের করছিল লাগেজ থেকে, তখনিই ভেতরে সিন্ধুর নীল বইটা দেখতে পায়। তার তো খেয়ালই ছিল না বইটার কথা। আর সে তো নিয়ে আসতেও চায়নি লুকিয়ে রেখে পড়তে চেয়েছিল। পড়া তো আর হলোই না বরং বইটির কথাও মাথা থেকে চলে গিয়েছিল। তবে নিদ্রা খুশি। এই ভেবে যাক ভালো হলো! সময় কাটানোর জিনিস পেয়ে গেছে যে!

ফ্রেশ হয়ে এসে বইটা নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে। ক্লান্তিও আছে তবে সেটা রেখে এখন বইটা পড়ায় মনোযোগ দিতে চায় সে। যখনিই বইটা খুলে সেই পেজে এসেছে যেখানে গতবার শেষ করেছিল, তখনিই তার মোবাইলটা কেঁপে উঠে। নিদ্রা পাশ থেকে মোবাইল নিয়ে দেখে অপরিচিত নাম্বার। সে আবার অপরিচিত নাম্বার থাকলে কেটে দেয়না। কারণ কেউ তো দরকারেও কল দিতে পারে এই ভেবে। আর বরাবরই তার ধারণা সঠিক প্রমাণ হয়েছে। তাই সে কখনোই এই কাজ করেনা। কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে কোনো সাড়া শব্দ পেল না। নিদ্রা একবারই বলল,
-“হ্যালো!
ওপাশ থেকে কোনো জবাব আসেনি। নিশ্বাসের শব্দটাও শোনা যাচ্ছেনা। হয়তো মিউট করে রেখেছে। নিদ্রা কলটা কাটতে গিয়েও কাটছেনা। কেন যেন কল করা মানুষটিকে সে চিনে ফেলছে। দুই মিনিট তিপ্পান্ন সেকেন্ড পরেও যখন ওপাশ থেকে কোনো শব্দ এলো না, তখন নিদ্রাই বলল,
-“এহসান বলছেন?”

ফোনের ওপাশে থাকা ব্যক্তির মুখে এবার হাসি ফুঁটে উঠে। কলটা আনমিউট করল, মৃদু হেসে বলল,
-“চিনলে কীভাবে!”
নিদ্রা এমন প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেল। আসলেই! চিনেছে কী করে? নাম্বারও জানেনা, কথাও শোনেনি, সামান্য নিঃশ্বাসের শব্দও শোনেনি। শুধু তার আচরণেই বুঝে গেল। সে তো এহসানকে কখনোই এতটা লক্ষ্য করেনি। তবে কী করে এহসানের ব্যবহার সে চিনতে পারল? এহসানের রকম সকম তো তার চেনার কথা না! তবুও নিজেকে সামলে বলল,

-“আপনি ছাড়া এমন অড আর কে আছে? কল দিলেন অথচ কথা বলছেন না। এইরকম অস্বাভাবিক আচার- আচরণ তো আপনারই হবে।”
-“তাহলে তো তুমি আমাকে ভালোই নোটিস করেছ।”
-“কচু করেছি। কি এমন পারফিউম মাখেন যে লোক নোটিস করবেই!”
-“দামি ব্র্যান্ডেড পারফিউম। ফগ ইউজ করতাম একসময়। এখন আর করিনা।”
-“দামি না ছাই! আপনার গায়ের থেকে দুর্গন্ধ আসে। এত বেশি দুর্গন্ধ যে আমি রাজশাহী বসেও শুঁকতে পারছি।”
এহসান চটে গেল। কাঠ কাঠ গলায় বলল,
-“অপমান করবে ভালো কথা! একটু বুঝে শুনেও তো করবে নাকি! আমার গায়ের দুর্গন্ধ তুমি ঢাকা থেকে বহু দূরে বসে পাচ্ছো! আর আমার শরীরে দুর্গন্ধ তোমায় কে বলল? আমি ডেইলি দুইবার গোসল করি।”
-“এই যে! আপনি নিজেই সেটা প্রমাণ করছেন। ডেইলি দুইবার গোসল করার মানে হলো আপনার গায়ের গন্ধ দূর হয় না সহজে। আমি বলি কী! পাঁচবার করবেন। ফজর, যোহর, আসর, মাগরীব, এশা এই পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের আগেই গোসল আর ওযু সেরে নিবেন। তাহলেই আপনার গায়ের গন্ধ যাবে। আর আপনার শরীরে যে দুর্গন্ধ সেটা আমাকে বলা লাগে! আমি কী আপনার গায়ের গন্ধ চিনব না? সুগন্ধ না দুর্গন্ধ তা তো আমিই জানব। আমার চেয়ে ভালো তো আর কারো জানার কথা না! বউ হই আমি আপনার!”
এহসানের প্রতিটি কথাতেই রাগ লাগে। তবে শেষের কথাটা শুনে রাগ দূর হয়ে যায়। সে শব্দ করে হাসে, দুষ্টুমির সুরে বলে,
-“মানো তো যে তুমি আমার বউ আর আমি তোমার স্বামী?”
-“মানা না মানার প্রশ্ন আসছে কেন? এখন আমি যদি নাও মানি তবুও তো এই সত্য বদলাবে না।”
এহসান প্রসঙ্গ বদলে আগের ব্যাপারেই গেল,
-“তবে নিদ্রা! তোমার শরীর থেকে কিন্তু একটা সুগন্ধ্য আসে। অন্যরকম। জানো সেটা কী?”
নিদ্রা কিছু বলেনা। চুপ করে থাকে। এহসান নিজেই বলল,
-“বউ বউ গন্ধ। যার ঘ্রাণটা প্রতিটি পুরুষকে বেসামাল করে দিতে পারে। আমি কিন্তু এখানে বসে সত্যি সত্যি সেই ঘ্রাণটা পাচ্ছি।”
নিদ্রার দম আটকে আসছে। এত লজ্জা লাগছে! তবুও মুখ ফসকে বলে ফেলে,
-“কীভাবে পাচ্ছেন?”
-“তোমার রেড কালার নাইটিটা এখন আমার হাতে!”
নিদ্রার সারামুখ লাল হয়ে গেল। রাগে, দুঃখে আর এক আকাশ পরিমাণ লজ্জায় সে কলটা কেটেই দিল। নিদ্রা কল কেটে দেওয়ার পর এহসান হো হো করে হাসতে থাকে। সে নিদ্রাকে খুব মিস করছে। খুব!

#চলবে।
(আপনারা পড়ে চলে যান। কিন্তু একটিবারও নিজের মন্তব্যটা প্রকাশ করেন না। আমরা লিখি কেন? আপনাদের ভালো লাগার জন্যই তো! সেই আপনারাই যদি পড়েই চলে যান কোনো রকম রেসপন্স না করেন তবে আর লিখতে ভালো লাগে?)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here