#সিন্ধুর_নীল (পর্ব-২৩)
লেখক– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।
৩৭.
বাহিরে হঠাৎ করেই প্রবল বেগে ঝড় শুরু হয়েছে। নিদ্রা এই ঝড়ের তীব্রতা খুব পছন্দ করে। এই রকম ঝড় কারো কাছে ভয়াবহ তো কারো কাছে আনন্দের। নিদ্রার কাছে বরাবরই আনন্দের ছিল ঝড়টা। আজও ব্যতিক্রম হয়নি। তবে এই ঝড়টা এখন অসময়ে এসেছে। শীতের শেষের দিকে এমন ঝড় সচরাচর হয়না। সমুদ্রে হয়তো স্রোতের উত্থাল পাতাল শুরু হয়েছে। নিদ্রা কেটলির গরম পানি একটা লম্বাটে ধরনের নতুন ওয়ানটাইম কাপে নিয়ে তাতে একটা ন্যাসকফির পুরোটা ঢেলে দিল। তারপর সেটা চামচ দিয়ে নাড়তে নাড়তেই জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। তারপর ধীরে ধীরে কাপে চুমুক দেয়। সিন্ধুর নীল বইটা নিয়ে সেদিনের মতোই আবার বসে পড়ে। টেবিলে কাপটা রেখে সে বিন ব্যাগের মধ্যে বেশ আরাম করেই বসে। তারপর সেই খানে আবার ফিরে যায় যেখানে সেদিন শেষ হয়েছিল।
☆☆☆☆
জমিদার শাহনেওয়াজ তার বেগম সুগন্ধ্যাকে পছন্দ করত। আর পছন্দ করাতেই স্থির ছিল। ভালোবাসা পর্যন্ত গেল না সেটা। তাতেও বেগম সুগন্ধ্যা সন্তুষ্ট ছিল। কিন্তু যখন জানতে পারে তার স্বামী পর নারীকে ভালোবাসে তখন আর সেটা সহ্য করতে পারেনা। চার মাস পেরিয়ে পাঁচমাসে পড়ে সে। তার এইরকম অবস্থাতে স্বামীকে তো সে পায়নি বরং এমন কিছু জানতে পেরেছে যাতে তার হৃদয় ছাড়খার হয়ে গেছে। শ্বাশুড়িকে জানাবে জানাবে করেও জানাতে পারল না। মন বলত খবরটা মিথ্যা। কিন্তু সবসময় কী আর সব মিথ্যে হয়? সত্য তো সর্বদাই তিক্ত হয়। কোনো এক মাঘের শীতের রাতে যখন জমিদার শাহনেওয়াজকে নিজ হাতে গরম দুধের পেয়ালা এনে দিল সুগন্ধ্যা তখনই তো সব নিজ মুখে তাকে সবটা জানায় স্বয়ং জমিদার নিজেই। তার কাহিনি বর্ণণা ছিল এমন—
গ্রীষ্মের মাঝামাঝিতে, যখন জমিদার একদিন গ্রামের পূর্ব দিকের নীল নদীর ধারে হাঁটছিল তখন সে সাক্ষাৎ পায় এক রুক্ষ সুক্ষ্ম পোষাকের তরুনীর। যে কিনা লম্বাটে গড়নের, তামাটে বর্ণের, আর দীঘল কালো কেশের অধিকারিনী ছিল। প্রথম দেখাতেই জমিদার কিছুটা ধাক্কা খেয়েছিলেন। নদীর পাশেই বড় বটগাছটার পেছনে নিজেকে আঁড়াল করে দেখতে থাকলেন এক অপরিচিত কিন্তু ধারালো চেহারার নারীর স্নান করা মুহূর্ত। সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত ভাবে হলেও কাজটা সে করেছিল। ঘৃণিত অপরাধ যাকে বলা হয় সেইরকম এক অপরাধ সে করে। তখন নদী থেকে লোকালয় ছিল বেশ দূরে। পুকুর ছেড়ে অনেকে নদীতে গোসল করতেই আসতো। তবে দল বেধে আসতো। কেন না নদীতে একা আসা বিপদজনক। আর সেখানে কীনা এই একলা অবলা নারী একাই নদীতে নেমে পড়েছে! জমিদার বিস্মিত নয়নে শুরু থেকে শেষটা অবলোকন করে। একদম মেয়েটির বিরক্তি মাখা মুখ নিয়ে হেঁটে এসে নদীতে নেমে নিজেকে পরিষ্কার করা পর্যন্ত সবটাই জমিদার দেখেছে। মেয়েটি কি একটুও টের পায়নি? পেয়েছিল তো! তাই তো ভেজা কাপড়ে একটা শুকনো দোপাট্টার মতো কিছু জড়িয়ে সে উপরে উঠে আসে। একদম বটগাছটার পেছনে। জমিদার খেয়াল করেনি, করবে কী করে? সে যে অন্যমনষ্ক হয়ে কেবল ভেবেই চলেছে এই নারী এত সাহসিকতার সাথে নদীতে কীভাবে নামতে পারল তাও আবার একা একা! এই নদীর এমনিতেও খারাপ নাম আছে। লোকে হারিয়ে যায় নাকি এইখানে যখন একা আসে। তারউপর অনেকে ডুবেও গেছে। কেউ কেউ তো বলে কুমির রয়েছে এই পাড়ের দিকে। ঘাপটি মেরে বসে থাকে নড়ে না চড়ে না শিকার সামনে গেলেই এক লাফে গিলে নেয়। অবশ্য সবই শোনা কথা। সত্য যে নয় তাও না। ভয়ংকর এক নদী এটা। পানি খুব স্বচ্ছ মনে হয় নীল রঙের পানি। তাই তো পূর্ব পুরুষেরা এটার নাম দিয়েছে নীল নদী। তবে এখন নীল ভাবটা খুব একটা দেখা যায়না। ভবিষ্যৎ কালে হয়তো আর তাও থাকবেনা হয় নদীর পানি শুকিয়ে যাবে নয় তো রঙ হারাবে। কুচকুচে কালো দুর্গন্ধ যুক্ত এক বিশ্রী নদী হবে। কেন না দিনদিন এইসব নদ নদীর সঠিক ব্যবহার করা হচ্ছেনা। ইংরেজ বাবুদের নতুন নতুন পণ্যই এর জন্য বেশি দায়ী। আর মানুষের অসচেতনতা গুলোও। জমিদারের ভাবনার দেয়াল ভাঙে তখন, যখন মেয়েটি কর্কষ স্বরে চেঁচিয়ে বলল,
-“এই অসভ্য বেটালোক! লজ্জা শরমের বালাই খেয়েছিস? বদমাইশ! লুকিয়ে চুরিয়ে গোসল করা দেখছিস!”
জমিদার এমন কিছু আশা করেনি। কিন্তু সে এবার প্রকৃত অর্থেই লজ্জিত হলো। হিতাহিত জ্ঞানশূণ্য হয়ে তো সে সত্যিই এই রমণীর গোসল করা দেখছিল। এখন কী হবে? এইভাবে ধরা খাওয়াটা আসলেই ভালো হয়নি। ভাগ্য প্রসণ্ণ দেখেই এখন চারিপাশ খালি। দূর দূরান্তে কাউকে দেখা যাচ্ছেনা। বিস্তৃত মাঠটা ফাঁকা। হ্যাঁ, কয়েকটি গরুর বাছুর এদিক ওদিক ছুটছে। তবে তারা তো সমস্যা নয়। জমিদার মেয়েটির ব্যবহারেও তাজ্জব। মেয়েটি কি জানেনা সে কাকে এমন উগ্র ভাষায় কথা বলছে? পরিচয় জানে তার! জানবেও বা কেমন করে? সে তো এদিকে আসেইনি আগে কখনো। তার সেবকরাই এসে খাঁজনা নেয় আর ঝামেলা মিটায় তারপর ফের চলে যায় মহলে। পুরুষশ্রেণীর অর্ধেকের বেশি লোক তাকে দেখে থাকলেও মহিলা কেউ তাকে দেখতে পায়নি। সেও কাউকে ফিরে দেখেনি। জমিদার অনুতপ্তের স্বরে বলল,
-“ওহে কন্যা! আমি এথায় এমনিই হাঁটছিলাম। আপনি যে হঠাৎ এসেই এভাবে গোসল করতে নেমে যাবেন নদীতে তা আমি জানতাম না। জানলে তো অবশ্যই এই পানে আসতাম না।”
-“আহা! ঢং করা হচ্ছে? তা এত সাধু পুরুষ যদি হতেই তবে কেন এইখানটায় ঠায় খাঁড়াইয়া রইলে? চলে যাইতে পারিলে না? তোমার তো বদ উদ্দেশ্য আছে মনে হইতেছে।”
-“একদমই নয়। আমি কোনো বাজে উদ্দেশ্যে এখানে আসিনি। তাছাড়া আপনার গোসল দেখার ইচ্ছা হবে আমার!”
-“এমনভাবে কইতেছো বোধ করি নিজেরে জমিদার মশাই ভাবো?”
জমিদার শাহনেওয়াজ থমকে গেল। সে তো জমিদারই। মেয়েটি তাকে চিনেনি। তবে সে যদি বলে যে সে জমিদার তবে মেয়েটি সারা গ্রাম করবে। এক গ্রাম দুই গ্রাম করে করে দশগ্রাম পৌঁছাবে। তারপর যাবে শহরে শেষে নবাবমহলেও চলে যাবে। এর চেয়ে ভালো হয় পরিচয় গোপন করা। নয়তো সবাই ভাববে যেখানে জমিদারের কাছেই তারা নিরাপদ নয় সেখানে অন্যের থেকে কি আশা করা যায়! শাহনেওয়াজ নরম গলায় পুনরায় বলল,
-“ইচ্ছাকৃত ছিল না। ভাবলাম এখন এখান দিয়ে হেঁটে চলে গেলেও ব্যাপারটা আপনাকে অস্বস্তিতে ফেলবে। তাই গাছের পেছনে নিজেকে আঁড়াল করেছিলাম কেবল।”
-“আঁড়াল কইরা আমারে দেখছিলে না? অসভ্য পুরুষ মানুষ! লুকাইবা কেন? দেখার লাগি তো!”
-“দয়া করে এভাবে বলবেন না। আমি আজ পর্যন্ত কোনো অপরিচিত নারীকে দেখিনি। আপনারটা হঠাৎ করেই হয়ে গেল।”
-“বুঝাও আমারে! আমি কে জানো? জানলে তো আর সাহস কইত্তা না এখনো খাড়াই থাকবার।”
-“কেন? আপনি কে?”
-“আমি কে! তোমার বর্তমান জম লাগি। আমার নাম সিন্ধু। সাপুড়ে পল্লীর মাইয়া। আমার সাথে লাগতে আইসো না ভুলেও। একদম বিষাইল্লা সাপের বিষ খাওয়াই দিমু। হতচ্ছাড়া!”
জমিদার মশাই ইহজীবনেও এতটা অপমান বোধ করেনি। তার মনে হচ্ছে নারী বলেই সিন্ধুর গায়ে হাত তুলতে পারছেনা। কঠোর হতে পারছেনা। কিন্তু সে তো ভুল। ভেতরে ভেতরে তার মন তো তার সাথে বেঈমানী করেই বসে আছে। এই অজ্ঞাত সাপুড়ে কন্যা যে ক্ষণকাল আগেই তার হৃদয়ে দখল নিয়ে নিয়েছে।
সিন্ধু বলল,
-“শোনো! তোমার পোশাক আশাক কয় ভদ্দর ঘরের পোলা। তয় ব্যবহার এমন কেন? তোমার লগে দেহি আমার শুদ্ধুও বাইর হয়। নেহাৎ ভদ্দর পোশাকে আছো নইলে পিটাইয়া ছাল তুলতাম। এখন গায়ে হাত তুলতেও বাঁধে। মুখটাও সরল। এই যে আমার এত চিন্তা হইতেছে তোমার গায়ে টোকা দেওয়ার তোমার একটুও বিবেকে বাধেনাই আমারে ওমন নজরে দেখবার! এত অসভ্য মানুষ ক্যা তুমি?”
-“দূঃখীত! আমি সত্যিই ঐরকম ভাবে আপনাকে দেখিনি। আপনি একা নামছিলেন আমার তাই কৌতূহল হয়েছিল।”
-“কথা পেট হইতে বাহির হইয়া গেল শেষমেশ! ভালাই তো। তয় শোনো মন দিয়া। আমার ভয় ডর নাই। বিষাইল্লা সাপ খপ কইরা ধরে পটলায় পুড়ি। বুঝলা! এইসব ভয় ডর আমার উপর কাজ করবার পারেনা।”
শাহনেওয়াজ কিছুটা বিচলিত হয় বটে। সে আর কিছু বলবে তার আগেই সিন্ধু বলল,
-“বেলা ফুরায়। আজ মাফ পাই গেলা কারণ আমার সময় নাই হাতো। নইলে খবর করতাম। তোমারে নতুন দেখতেছি। কোন ঘরের মেহমান তুমি?”
-“আমি আসলে এখানে কাজে এসেছি।”
-“কীসের কাম?”
-“আছে একটু। জমিদারের খাঁজনার দেখভাল হচ্ছে কিনা খোঁজ নিতে আসলাম।”
-“জমিদারের লোক তুমি? তয় হেই মিয়া জানে তুমি খাঁজনা না দেইখা মাইয়াগো গোসল দেখো?”
-“ছিঃ এভাবে বলবেন না। আমি সত্যি ওমন পুরুষ না। দয়া করে বারবার এভাবে বলে লজ্জা দিবেন না। আমি ভুল করেছি আমি তা মেনে নিচ্ছি। মাফ করুন আমাকে। তবুও এমন করে বলবেন না।”
-“মাফ করতাম আর কী! আগামীতে আর এই কাম করবানা। নইলে ওই চোখে সাপের বিষ ঢালতে দুইবার ভাবুম না।”
সিন্ধু নামক রমণী চলে যেতেই শাহনেওয়াজ স্বস্তির শ্বাস ফেলে। এতক্ষণ তার হৃৎপিন্ড দ্রুতবেগে চলছিল। এখন কিছুটা শান্ত হলো।
#চলবে।
#বি:দ্র: ☆☆☆ এই চিহ্নটা অতীত বোঝাতে প্রয়োগ হবে। আর আগামী কিছু পর্বে কেবল সিন্ধুর নীলের ইতিহাস থাকবে। তা শেষ হলেই বর্তমানে ফিরে আসা হবে। সিন্ধুকে কেমন লাগছে?