#সিন্ধুর_নীল (পর্ব-২৪)
লেখক– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।
৩৮.
-‘জমিদার বাবু? শরবত খাইবেন?”
-“হু দাও!”
জমিদারের বিশ্বস্ত কাজের লোক হলো মুন্না। সে জমিদারের সাথে বিগত ছয় বছর ধরে আছে। সবজায়গায় জমিদারের সাথেই যায়। তার খেয়াল রাখবার জন্য। আজও ব্যতিক্রম হয়নি। সে এসেছে এবং জমিদারের খেয়াল রাখছে। জমিদারের সামনে শরবতের পান পাত্র রেখেই সে চলে গেল। কারণ জমিদার এখন লিখালিখি করছেন। সে আরো সাত দিন থাকবে এখানে। কাজ পড়ে গেছে হঠাৎ করেই। তাই বাড়ির উদ্দেশ্যে চিঠি পাঠাচ্ছে। সুগন্ধ্যা যে সর্বক্ষণ তার চিন্তায় থাকে! এই খবর না দিলে তো সে হা হুতাশ করেই ম*রে যাবে। তাই জমিদার তার বৃত্তর হাতে চিঠি শহরে পাঠানোর ব্যবস্থা করছে। এইখানে তার নিজস্ব দালান আছে। এখানেও সে বিলাশবহুল জীবন কাটায়। কোনোরূপ সমস্যা হয়না। সাতদিন ভালোই কেটে যাবে তার।
চিঠি লিখে তা মুন্নার হাতেই দিয়ে বলল শহরগামী বৃত্তকে সব বুঝিয়ে দিতে। বর্তমানে সে নিদ্রায় আচ্ছন্ন হতে চাচ্ছে। মুন্না রাতের খাবার কি খাবে জিজ্ঞেস করলে জমিদার শাহনেওয়াজ করুণ স্বরে বলল,
-“আজ আর ক্ষুদা নেই মুন্না। তুমি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়। আমার এখন বিশ্রাম প্রয়োজন।”
মুন্না টু শব্দও করল না। চলে গেল নিজ কক্ষে। শাহনেওয়াজের উপরে সে কখনোই কথা বলতে পারেনা। তবে শাহনেওয়াজ রাতে না খেয়ে থাকবে ভেবে তার নিজেরই খারাপ লাগছে। তাই সে নিজেও আর আহার গ্রহণ করল না। চুপচাপ গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে।
————————————————————-
পাখির কিচির মিচির শব্দে চারিদিক ভরে উঠছে। সিন্ধু ঘুম থেকে উঠে ইবাদত সেরে নিল। তারপর নিজেদের পুকুরেই গোসল করে তৈরি হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে। আজ তারা কিছু সখী মিলে বিলের একপাশে রান্নাবান্না করবে। নিজেরা নিজেদের মত সময় পার করবে। তার কাছের সই সেতারার বাড়ির সামনে এসে জোরে ডাক পাড়ে,
-“সেতু! কইরে! যাবি নে? শিগ্গির আয়!”
খানিকবাদেই সেতারা বের হয়ে আসে। তার হাতে একটা পটলি। তার মধ্যে সব জিনিসপত্র। আজ সেতারাই বেশি জিনিস নিয়েছে কারণ বাকি সবার এত কিছু আনবার সামর্থ্য নেই। সিন্ধু এনেছে কেবল পালংশাক আর শর্ষে বাটা। মাছ আনবে নয়নতারা, নিজেদের মুরগীর ডিম আনবে শিমুল, আর চুলো সেখানে গিয়ে করবে। আর যত মশলা, চাল, চাদর, পানীয়, পাত্র, থালা-বাসন, বাকিসবই সেতারা নিচ্ছে।
সিন্ধু আর সেতারা বিলে যাওয়ার পর দেখে নয়নতারা, শিমুল আরো আগেই এসে চুলো বসিয়েছে। বসার জায়গা পরিষ্কার করেছে। এবার চাদর বিছালেই হবে। সিন্ধু এতে সন্তুষ্ট হলো। যাক! কাজ কিছুটা কমেছে। এক এক করে বাকিসবও তারা ঠিক করতে লাগে। যেহেতু সবাই সকাল বেলা খালি পেটে বেরিয়েছে তাই সেতারার সাথে করে আনা মুড়ি পানিতে ভিজিয়ে নারিকেল, লবণ আর চিনি দিয়ে মেখে মজা করে খেল।
তারপর দুপুরের ভাত তরকারি রেঁধে সবাই হাঁটতে থাকে আশেপাশে। গল্প করে অনেক্ষণ। সেতারা বলল,
-“ভাইজান শহর থেকে আমার জন্য বই এনেছে। আমি এখনো পড়িনি। ভাইজান বলেছে খুব সুন্দর নাকি। সিন্ধু তুই পড়বি?”
তাদের মধ্যে পুরো শুদ্ধভাবে কথা কেবল সেতারাই বলে। সিন্ধুও বলতে পারে। তবে তার নিজের আঞ্চলিক ভাষাটাই বেশি ভালো লাগে বলতে। সেতারা আর সিন্ধু পড়াশোনা করেছে। পড়তে পারে আর লিখতেও পারে। বাকি দুইজন নয়নতারা আর শিমুলকে তাদের পিতা-মাতা শত বুঝিয়েও রাজি করাতে পারেনি একটু পড়ালেখার জন্য। তাদের নাকি ভালো লাগেনা। আর সিন্ধু! সে খুব কষ্ট করেই এই পর্যন্ত এসেছে। তার পড়ালেখা তে তার বাবা-মায়ের সমস্যা না থাকলেও এলাকার মানুষের অনেক সমস্যা। সবাই বলে সাপুড়ের মেয়ে কেন পড়বে? ভাগ্যিস পাঠশালার পন্ডিতরা অতি ভদ্রলোক। তারা বিনা খরচেই তাকে পড়িয়েছে। উচ্চশিক্ষার জন্য সে এখনও বসে আছে। সময় বা সুযোগ কিছুই যে পাচ্ছেনা! বড় কষ্টেই দিন যাচ্ছে তার। অভাব নেই এমন না, অভাব আছে। তবে আগের থেকে কম। এখন সে বাবার সাথে গিয়ে সাপ ধরে। তাই দুইদিক থেকে পয়সা এসে একটু অভাব গুচিয়ে দিচ্ছে। তবে এতে তার পড়ালেখার বড্ড সমস্যা হচ্ছে। সিন্ধু ঠিক করেছে এখন থেকে কাঁথা শেলাই করবে। একটু পয়সা জমা হলেই সে শহরে যাবে। তার যে এখনো অনেক পড়া বাকি। সেতারা সামনের মাসেই যাচ্ছে নাকি! তার ভাইজান মানুষটা তাকে খুব স্নেহ করে। তাকে শহরে নিজের বাসায় নিয়ে যাবে। সে তার ভাই ভাবীর কাছেই থাকবে। সেতারা চলে গেলে সিন্ধুর খুব খারাপ লাগবে। কিন্তু সিন্ধু মুখ ফুটে বলেনা। সেতারা শুনলে হয়তো যেতেই চাইবেনা। এমনিতেও সে যেতে চায়নি খুব করে চেয়েছিল সিন্ধুকে সাথে নিতে। কিন্তু তা তো হয়না! সিন্ধু নিজেই খুব করে বুঝিয়ে তাকে পাঠাচ্ছে শহরে। বলেছে সেও যাবে একটু দেরি হবে তবুও যাবে। সেই আশা নিয়েই সেতারা রাজি হলো। কেন না, সিন্ধু মিথ্যা বলেনা। এইটাই সবচেয়ে ভরসা।
৩৯.
শাহনেওয়াজ বেরিয়েছে বিলের কিছু কৃষি জমি দেখতে। যার মধ্যে বর্তমানে কোনো চাষ হচ্ছেনা। পানি শুকিয়েছে ধানও তুলেছে সবাই। তবে এখন অন্যান্য ফসল চাষ করতে চাইছে। এভাবে বসে থাকলে তো চলবেনা! এদিকে ইংরেজ জোর দাবি জানাচ্ছে এখানের কিছু জমিতে আফিম চাষ করতে। শাহনেওয়াজ মানা করেছে এরপরও নবাব তাকে ডেকে বলল যে চাষ করতে। এতে অর্থ লাভ হবে দ্বিগুণ। ইংরেজ খুশি থাকলে তার জমিদারিও টিকবে বেশিদিন। তবে শাহনেওয়াজ মাথা নত করবার নয়। সে চাইছে কিছু ভালো, স্বাস্থ্যকর সবজির চাষ করতে। আফিমের বিপক্ষে সে। এসব নেশা দ্রব্য তৈরি তার একদমই পছন্দ না। তাছাড়া ইংরেজরা এসব করে তাদের খাদ্যজমি নষ্ট করছে। কেবল আফিমই চাষ হবে, খাওয়ার জন্য ফসল হবে না। তাহলে মানুষ কী না খেয়ে থাকবে? বাঁচবেই বা কী করে! নবাবের সাথে একপ্রকার তর্কাতর্কি করে সে জমি রক্ষা করে। নবাব এমনিতে চুপ থাকার নয়, কেবল মৃত্যুঞ্জয়ের জন্য তিনি দমে থাকেন। সে একবার চেতে গেলে নবাবের বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারে। মৃত্যুঞ্জয়ের জান প্রত্যয় আর শাহনেওয়াজের মধ্যেই বন্ধি। তাই তাদের সাথে শত্রুতা বাড়িয়ে লাভ নয় বরং নিজের ক্ষতিই করে ফেলবেন। এর থেকে ভালো তার নিজের কিছু জমিতে আফিম চাষ করাক। তার তো আর অভাবের তাড়না নেই।
শাহনেওয়াজ খবর পাঠিয়েছিল গ্রামের মোড়লের কাছে যে স্বশরীরে উপস্থিত থাকবার জন্য। কিন্তু মোড়লের খবর নেই তখনো। শাহনেওয়াজ এবার আর রাগ সংবরণ করতে পারল না। মোড়ল আসার সাথে সাথেই সে উচ্চবাক্যে কথা বলে। সবাই ভয় পেয়ে যায়। শাহনেওয়াজ সবটা দেখিয়ে, বুঝিয়ে বিলের দক্ষিণ পরিদর্শনের জন্য মুন্নাকে নিয়ে হাঁটতে থাকে। একেবারে কোণায় গিয়ে যখন পৌঁছালো তখন নারী কন্ঠের হাসির শব্দ শুনতে পেল। কৌতূহল বশত সে উঁকি দিল গাছপালার আড়ালে বসে থাকা রমণীদের দিকে। দেখে তারা নিজেদের মধ্যে কথা বলছে আর হাসছে। সামনে খাবার পড়ে আছে তাতে মাছি উড়ছে। সেদিকে কারো হুশ নেই। মহিলা মানুষ যে এমন অদ্ভুত তা সে আজ হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছে। কিন্তু! বিপত্তি যা ঘটার ঘটেই গেছে। সিন্ধু তাকে দেখে চিৎকার করে উঠল,
-“বদমাইশ লোক! আজকে আবারও বদমাইশি করবার লাগি চইলা আইছো?”
শাহনেওয়াজ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। এইখানে এই মেয়েকে সে একদম আশা করেনি! একদমই না! এখন আবার একটা তুলকালাম ঘটাতে চলেছে মেয়েটা। ইশ! এবার কী হবে?
#চলবে!
(ভুল ত্রুটি থাকলে ধরিয়ে দিবেন।)