সিন্ধুর_নীল (পর্ব-২৫) লেখক– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

#সিন্ধুর_নীল (পর্ব-২৫)
লেখক– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

৪০.
চারিদিকে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজমান। জমিদার শাহনেওয়াজের মুখ অপমানে কালো হয়ে গেছে। সিন্ধু তাকে দেখতে পেয়ে এমন মন্তব্য করেছে যে তার আর মুখ রাখার মত অবস্থা রইল না। এদিকে মুন্না গেল চমকে। একরত্তি মেয়ে কীনা জমিদারের সাথে উচ্চবাক্য ব্যয় করছ? ভাবা যায়! সে গরম হয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই শাহনেওয়াজ চোছের ইশারা দিয়ে তাকে বোঝালো “চুপ থাকো! আমার ব্যাপার আমাকে বুঝতে দাও!”
মুন্না জমিদার বাবুর মুখের উপর কথা বলার সাহস কি রাখে? এদিকে যে চুপ করে থেকে জমিদার বাবুর অপমানও সে সহ্য করতে পারছেনা। সেতারা, নয়নতারা পুরুষের সামনে মুখ ঢেকে রাখে সর্বদা। এবারও তাই করেছে। তারা মুখ ঢেকে ভয়ে তটস্থ হয়ে বসে আছে এক কোণে। শিমুল কোনো রকম মাথায় কাপড় দিয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়। সিন্ধুর ঠিক পাশেই দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলে,
-“এই সিন্ধু! তুই এই বেটাছেলেরে ওমন করে কইছিস ক্যান! কি করছে ওয় তরে!”
-“কি করেনাই সেইটা ক! এই লোক একটা বদমাইশ! মাইয়া মানুষ দেখলে এর হুশ থাহে না।”
-“তুই তারে চিনিস!”
-“আগে তো একটু চিনবার পারছিলাম। এখন হাড়ে হাড়ে চিনি।”
-“মানে! কেমনে চিনলি?”
-“সব কইয়াম। আগে এর ব্যবস্হা করবার দে! তুই যা এর সাথে আমি বোঝাপড়া করুম।”
-“যাহ! চল চল। হুদামিছা ঝগড়া কইরা লাভ কী! বেলা হইতেছে। বাড়িও তো যাওন লাগব। আম্মা আইজকা হাত পা কাইট্টে দিব।”
-“কইলাম তো তোরা যা! আমি দেহি। যা!”

শিমুল সুবিধা করতে পারল না। অগত্যা চলে গেল। সেতারা আর নয়নতারা ইতিমধ্যে সব গুঁছিয়ে নিল। শিমুল যেতেই তার হাত ধরে বিল পার করে তারা বাড়ির আঙিনায় চলে গেল। এবার সেইখানে কেবল সিন্ধু, শাহনেওয়াজ আর মুন্না। জমিদার মুন্নাকে বলল,
-“তুমি যাও। আমি আসছি।”
-“কিন্তু জমিদার বাবু…
-“যাও!”
মুন্না চলে যায়, যাওয়ার আগে সিন্ধুর দিকে ক্রোধ প্রকাশ করে দৃষ্টির মাধ্যমে। সিন্ধু তা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে। শাহনেয়াজের সামনে বরারবর দাঁড়ায়। গলায় বেশ খানিকটা জোর এনেই বলল,
-“কি! একবার মানা করছি না? কথা কানে যায়না?”
-“কী এমন করেছি আমি যে আপনি এমন বাজে আচরণ করছেন আমার সাথে!”
-“কি কর নাই! মানা করছিলাম মাইয়া মানুষের দিকে বাজে চোখে তাঁকাইবানা। তাও তাঁকাইছো! এত স্পর্ধা!”
-“প্রথমত আমি কোনো মেয়ের দিকে তাঁকিয়ে থাকিনি। আমি কেবল কৌতূহল বশত এদিকে তাঁকিয়েছিলাম। ভাবিনি যে এমন কিছু হবে। আর আমার স্পর্ধার কথা বলছেন? তবে শুনে রাখুন! আমার স্পর্ধা কতটুকু তা আপনি আন্দাজও করতে পারবেন না। তাই বলছি শুধু শুধু ঝামেলায় জড়ানোর চেষ্টা করবেন না।”
-“ডর দেহাই লাভ আছে কোনো! আমি ডরাই তোমার হুকনা কথায়? আর হগ্গল ব্যাপারেই কৌতূহল হয় কীসের জন্যে!”
-“আপনি এবার বিনা কারণেই ব্যাপারটা ঘোলাচ্ছেন।”
-“তাই? তবে আসো! আমি খালি ঘোলাইতেছি তুমি এবার দুধ, চিনি মিশাইয়া ঘোলাও। এই ঘোল পরে তোমারে বাইট্টা খাওয়ানোর ব্যবস্থৃ করতেছি।”
-“কথা-বার্তার কি ছিড়ি! ছিঃ”
-“খবরদার! ছিঃ কইবানা। ছিঃ তো তোমারে। বদ পুরুষ। আজকে তোমার ছাড় নাই তুমি আজ বুঝবা সিন্ধু কী জিনিস!”
-“জিনিস? আপনি মানুষ নন?”
-“তোমারে তো আমি আইজকা….
সিন্ধুর কথা থেমে গেল হঠাৎ করেই। কারণ সে জ্ঞান হারিয়েছে। আর জ্ঞানটা হারিয়েছে জমিদারের কৌশলে করা তার ঘাড়ের পাশে আঘাত। অতি বিচক্ষণের মত সে কাজটা করেছে। গায়ের শালটা দিয়ে সিন্ধুর শরীর ঢেকে রেখে হাঁক ছাড়ে, “মুন্না!”

৪১.
মুন্না বসে আছে শাহনেওয়াজের কক্ষের মেঝেতে। তার চোখে মুখে বিরক্তি। জমিদার বাবু মেয়েটিকে তার পাহারায় রেখে গেছেন। মেয়েটার জ্ঞ্ন ফিরলেই তাকে খবর দিতে বলেছেন। তবে সে তা না করে জমিদারের কক্ষে চলে এসেছে। তার মেয়েটিকে কিছুটা ভয় হচ্ছে। কেমন রণচন্ডীর মতোন! শাহনেওয়াজ কয়েকবার বলল যেতে কিন্তু সে ঠাই বসে রয়। তাই শাহনেওয়াজ নিজেই সিন্ধুকে রাখা কক্ষে চলে গেল। ঘুমন্ত অবস্থায় দেখে মনেই হয়না এই মেয়ে এমন রুক্ষ স্বভাবের। শাহনেওয়াজ নিজেও বিরক্ত হয়। সে জানেনা কেন সে সিন্ধুকে তুলে এনেছে। তবে তার কাছে মনে হয়েছে যে তুলে আনাটাই ঠিক হবে। এনে একটা কঠিন শাস্তি দিতে হবে। সাধারণ জনগণ হয়ে বারবার জমিদারকে অপমান করে মেয়েটি! স্পর্ধা কত তার! মেয়েটিকে এবার কিছু বলতেই হবে। শুধু শুধু মেয়েটি তাকে লোক সম্মুখে অপমান করেছে। লজ্জায় গা কাঁপছে তার। জীবনেও এমন কিছুর সাথে পরিচিত হয়নি সে। তখন যখন সে সিন্ধুকে অজ্ঞান করে, মুন্না আসতেই তাকে বলে গাড়ি নিয়ে আসতে। গাড়ি সেইসময়কার বড় সাহেববরাই কেবল ব্যবহার করত। শাহনেওয়াজের এই গাড়িটি তাকে শেখ মৃত্যুঞ্জয় উপহার দেয়। তিনি যখন প্রথমবার লন্ডনে গিয়েছিলেন তখন এই গাড়ি গুলো দেখে পছন্দ করে। অঢেল ধন সম্পদের মালিক মৃত্যুঞ্জয় তিনটে গাড়ি ক্রয় করেছিলেন। একটি নিজের জন্য, একটি শাহনেওয়াজের জন্য আর একটি প্রত্যয়ের জন্য। তিন বন্ধু মাঝে মাঝেই গাড়ি প্রতিযোগিতা করে থাকেন। আজ সেই গাড়িতেই সিন্ধুকে একপ্রকার উঠিয়ে নিয়ে আসে।

সিন্ধুর যখন নিদ্রা ভঙ্গ হয় তখন সে কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থাকে। তার মাটির ঘরের কক্ষের সাথে এই কক্ষের মিল না পেয়ে সে চূড়ান্ত অবাক হয়। সুসজ্জিত, সুবিশাল কামড়াটি যেন আভিজাত্যে মুড়িয়ে আছে। চমকে যায় সিন্ধু। এ সে কোথায় এলো? এটা কার ঘর? সে বেঁচে আছে তো! নানান চিন্তা মাথায় ভর করা শুরু করল তার। তখনিই দেখে সামনেই আসনের মত কি একটাই বসে আছে শাহনেওয়াজ। অর্থাৎ তার সেই বদমাইশ!

সিন্ধু উঠে এসে ঠাস করে শাহনেওয়াজের গালে চড় মেরে দেয়। আকস্মিক আক্রমণে শাহনেওয়াজ হতভম্ব হয়ে যায়। না! এবার বেশিই হয়ে যাচ্ছে। সে জমিদার। তার আলাদা একটা পদমর্যাদা আছে আর এই মেয়েটি বারবার তাকে হেনস্তা করছে। এই মেয়েকে এখন বড় কোনো শাস্তি দিতেই হবে। কিন্তু সেটা কী? নারী লোককে সে কোনো কালেই শাস্তি দেয়নি। এইখানে নারী দাসীও নেই যে তাদের মাধ্যমে শাস্তি প্রদান করবে। তবে কী সিন্ধুকে এমনিই ছেড়ে দিবে? উহু! তা যে হয় না। অধিকারের বেলায় নারী-পুরুষ সমান হলে শাস্তির বেলায় কেন নয়? হ্যাঁ, নারী বলে তার শাস্তি হয়তো পুরুষের মত ভয়াবহ হবেনা। তবে কিছু তো একটা হবেই! সেটা কী?

#চলবে।
(দেরিতে দেওয়াতে সবার অসুবিধা হচ্ছে। আমিও নিয়মিত হতে পারছিনা। তাই আপাতত কেউ এই উপন্যাসের লিঙ্ক শেয়ার করবেন না। আমি চাইনা অপেক্ষার চাদরে আরো কেউ মুড়িয়ে যাক। আর দশ-বারো পর্ব আছে প্রথম খন্ডের। আমি আপ্রাণ চেষ্টায় আছি প্রথম খন্ড সুন্দরভাবে সাজিয়ে শেষ করার জন্য। যেহেতু উপন্যাস তাই আমি তাড়াহুড়ো করে লিখে সৌন্দর্য নষ্ট করতে চাইছিনা।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here