সিন্ধুর_নীল (পর্ব-২৬) লেখক– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

#সিন্ধুর_নীল (পর্ব-২৬)
লেখক– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

৪২.
মুন্নার মেজাজ খারাপ। জমিদার বাবু তাকে কক্ষে প্রবেশ করতেই দিচ্ছেনা। মুন্না বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকলেও ভেতরের সব কথা ঠিকই শুনেছে। তার জমিদার বাবুকে এই মেয়ে এত বড় কথা কীভাবে বলল? শব্দও তো একটা হলো বেশ জোরালো ভাবে। কিন্তু কীসের? থাপ্পড়ের নাকি! যদি হয়েও থাকে তবে কে কাকে মেরেছে? জমিদার বাবু তো মারবেনা। অর্থাৎ, ঐ মেয়েটি মেরেছে। ভেতরে সে ঢুকতে পারবেনা যতক্ষণ না শাহনেওয়াজ নিজে তাকে ডাকে। এইসব কিছু নিয়ে মুন্নার মনটা বড়ই খারাপ হয়ে গেল। তখনিই ভেতর থেকে রাশভারী কন্ঠে হাঁক ছাড়ে শাহনেওয়াজ।

-“মুন্না! এই মুন্না!”
হন্তদন্ত হয়ে কক্ষে প্রহেশ করে সে। শাহনেওয়াজ বলল,
-“এই মেয়েকে তার বাড়ি রেখে এসো। আর একমুহূর্ত একে আমি সহ্য করতে পারছিনা।”
-“জ্বি বাবু!”

মুন্না এগিয়ে আসতেই সিন্ধু হুংকার ছেড়ে বলল,
-“এই! খবরদার আমার ধারে কাছে আসলেও তোর খারাপ কিছু হয়ে যাবে বলে দিলেম। অসভ্যের দল! মেয়ে মানুষ উঠিয়ে এনে কী প্রমাণ করতে চাইছিস? চরিত্তের ঠিক আছে তোদের! আজই, হ্যাঁ আজই তোদের সবয়টার নামে বিচার দিব জমিদারের কাছে। দেখি তোরা কীভাবে বাঁচিস।”

মুন্না হো হো করে হেসে উঠল। সে হাসতে হাসতেই বলল,
-“কী বললে? কার কাছে বিচার দিবা? জমিদার বাবুর কাছে? কার নামে দিবা!”
-“তোদের দুইটার নামে।”
-“কথা ঠিক কইরা কও মাইয়া। বেশি বাড় বাড়তেছ তো তুমি! তোমার কোনো ক্ষতিই আমরা করিনাই। বরং তুমি বারবার গায়ে পড়ে ঝগড়া করতে আসো। দোষখান তোমার আমাগো না!”
-“ধরা পড়লে সবাই নিজের সাফাই গায়। আজ হয়তো এসপার নয় ওসপার করেই তবে ছাড়মু। আমার নাম সিন্ধু, সাপুড়ে পল্লীর মাইয়া। খবর কইরা দিব নে সবার।”
-“ঠিক আছে! করো, আমগো ওতো সমস্যা নাই।”
-“সাপের বিষ চোখে ঢালার পরে কইতে আসিস এই কথা। বদমাইশ!”
-“মুখ সামলাও কইতেছি।”
-“কি..

এতক্ষণ অনেক চুপ করে ছিল শাহনেওয়াজ। এবার আর পারেনা নিজেরে আটকাতে। ক্ষিপ্ত গলায় বলল,
-“মুন্না! আমি এখানে তোমাকে ঝগড়া করতে ডাকিনি। একে বিদায় কর এক্ষুণি।”
-“মাফ করবেন বাবু।”
মুন্না সিন্ধুকে কিছু বলবে তার আগেই সিন্ধু হনহন করে বেরিয়ে গেল। সে বেরিয়ে যেতেই শাহনেওয়াজ হাঁফ ছাড়ে। তার এই মেয়ের সামনে দাঁড়াতে কষ্ট হয়। বক্ষস্হলে তীব্র ব্যাথা করে। শহরে ফিরে যেতে হবে জলদি। এইখানকার দিন গুলো কেমন দমবন্ধকর।

পরদিন হুট করেই শাহনেওয়াজের জন্য বার্তা এলো যে তাকে মহলে ফিরতে হবে। তখনও সে জানতো না যে কীসের জন্য তার হঠাৎ জরুরী তলব হলো। সে পরদিনই কাজ দ্রুত শেষ করে মহলের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। এবং সেখানে গিয়েই জানতে পারে সুগন্ধ্যা বেগম সন্তানসম্ভবা। সেই খুশিতে সে চারিদিকে মিষ্টান্ন বিতরণ করে। এবং বিরাট ভোজনের আয়োজন করে। দিন যাচ্ছিল খুবই সুন্দর ভাবে। তবে হঠাৎ করেই কী হয়ে গেল! জমিদার রাতে ঘুমাতে পারেনা, খেতে পারেনা। কোনো কাজেই মন বসাতে পারেনা। চোখ বুজলেই একটা রণচন্ডী মুখ ভেসে উঠে চোখের পাতায়। এতদিন নিজের অনাগত সন্তান আসবার খবরে তার সবদিকে খেয়াল ছিল না। তবে অবসর পাওয়ার পরেই তার একটি মানুষকে দেখার তীব্র ইচ্ছা জন্মায়। সে ছুটে চলে আবারও দূর দিগন্তে!
☆☆☆

নিদ্রার বই পড়ায় ব্যাঘাত ঘটল মুনতাহার আগমনে। সে এসেই নিদ্রার চুল টান দিল। নিদ্রা ‘আউচ’ শব্দ করে উঠে। বইটা একপাশে রেখে মুনতাহার পিঠে ধুমধাম কি’ল বসিয়ে দেয়। মুনতাহা ব্যাথায় কুকড়ে যায়। পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
-“এই বিবাহিত মহিলা! বিয়ে করে শক্তি আরো বেশি বাড়িয়ে ফেলেছিস নাকি? উহ কী ব্যাথা করছে! এত শক্তি কেমনে আসে?”
নিদ্রা আরো দু’ঘা বসিয়ে বলল,
-“এমনে আসে।”
-“অসভ্য একটা! যা সর।”
মুনতাহা নিদ্রাকে ফেলে ফ্রেশ হতে চলে গেল। নিদ্রা খেয়াল করে দেখে অনেক বেলা হয়ে গেছে। এখন আর বইটা পড়া সম্ভব না। কিন্তু না পড়েও শান্তি পাচ্ছেনা। পরে কী হলো?

৪৩.
নিহারীকা নিজের ফ্ল্যাটে প্রায় একমাস পর ফিরেছে। এসেই প্রথমে সাফ সাফাই এর কাজে লেগে পড়েছে। ছুটা বুয়াও ডেকে এনেছে। রাত বারোটায় সব কিছু ফিটফাট করে সে অর্ডার দিয়ে আনা পিৎজা খেয়েই ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু ঘুমটাও বেশিক্ষণ টিকতে পারল না। হঠাৎ করেই তার ফোনের রিংটোন বেজে উঠল। বিরক্তি নিয়ে রিসিভ করে বলল,
-“হ্যালো!”
-“ঘুমাচ্ছেন আপনি?”
নিহারীকা বুঝতে পারল মৃত্যুঞ্জয় কল করেছে। সে মৃদু হেসে বলল,
-“হুম চোখটা জাস্ট লেগেই আসছিল।”
-“আচ্ছা। একটা খুব দরকারি কথা ছিল আপনার সাথে।”
-“হ্যাঁ বলুন!”
-“মি. নির্ঝরের সাথে কথা হয়েছে আপনার? তিনি কী সাহায্য করবে?”
-“নির্ঝর কোনো প্রকার সাহায্য করবে বলে মনে হয়না। সে খুব চতুর। রাগী হলেও তার মাথা ঠিকই থাকে সর্বদা। ঐ যে কথায় আছে না, জাতে মাতাল তালে ঠিক! উনি ঠিক সেইরকম ক্যারেক্টার।”
-“কিন্তু খান বাড়ি ঢুকতে হলে তার সাহায্য দরকার। অবশ্য সে আমাকে সাহায্য করবেই। তবে এত দ্রুত তার থেকে সাহায্য চেয়ে বসলে সে অবশ্যই ধরে ফেলবে যে কিছু একটা আছে। আপনার আর কোনো প্ল্যান আছে?”
-“দেখুন! অভ্র এই ব্যাপারে খানিকটা হলেও সাহায্য করবে। অবশ্যই পরোক্ষভাবে। সে নির্ঝরের বেস্টফ্রেন্ড। এহসানের থেকেও সে নির্ঝরের বেশি ক্লোজ। এমনটাই আমি জানি। তাই অভ্রকে একটু নিজেদের দিকে আনতে হবে।”

মৃত্যুঞ্জয় কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
-“অভ্র যাতে ঘুনাক্ষরেও টের না পায়। আমাদের খুব সাবধানে থাকতে হবে। বাই দ্য ওয়ে! কাল একবার গুলশানের একটা রেস্টুরেন্টে আসবেন, লোকেশন এসএমএস করে দিব। ঐখানে আপনাকে কাগজপত্র বুঝিয়ে দিব। আর মি.এমদাদের সাথে কোনো প্রকার যোগাযোগে আছেন?”
-“না নেই।”
-“তাহলে থাকুন। থাকার চেষ্টা করুন। তার কাছে কিছু তো আছেই। আমি শিউর!”
-“আমার মনে হয় না।”
-“আপনার না মনে হওয়ার কারণ কী?”
-“সে যদি কিছু জেনেই থাকে তবে বাংলাদেশে এতদিন যাবৎ বসে আছে কেন? তিনি কিছুই জানেন না। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন। যতই হোক! আমারই তো বাবা। আমার চেয়ে ভালো তাকে আর কে জানে?”
-“তা ঠিক বলেছেন। তবে আপনাকে সাবধানে থাকতে হবে। বাসা বদলানো বেশি বেটার হবে।”
-“তার দরকার পড়বে না।”
-“পড়বে।”
-“উহু! আমি যেইখানে আছি তার খবর কেউ জানেনা। সবাই জানে আমি বসুন্ধরায় আছি। আমি সেটাই বলেছিলাম। অবশ্য প্রথম প্রথম ঐখানেই থাকতাম। এই প্রজেক্টের সাথে জড়িয়ে আজ ছয় মাস এখনকার ঠিকানায় আছি।”
-“বাহ! আপনি নিঃসন্দেহে খুবই ভালো কাজ করছেন। এভাবেই শেষ পর্যন্ত টিমের সাথে থাকবেন।”
-“ইয়াহ শিউর।”
-“তাহলে রাখছি। গুড নাইট।”
-“হুম।”
নিহারীকা কল কেটে দিল। তারপর ভাবতে লাগে কীভাবে কী করবে। এরই মধ্যে মৃত্যুঞ্জয় লোকেশন মেসেজ করে দিয়েছে। নিহারীকা একটা দীর্ঘঃশ্বাস ছেড়ে ঘুমে তলিয়ে পড়ে।

৪৪.
ক্লাস শেষে নিদ্রা আর মুনতাহা বেরিয়ে এলো। ভার্সিটির মূল ফটকে আসতেই মুনতাহা ‘নিদ্রা’ বলে মৃদু স্বরে চেচিয়ে উঠল। নিদ্রা বিরক্ত হয়ে বলল,
-“কি হয়েছে? এমন করস কেন?”
-“ওটা তোর হাজব্যান্ড এহসান না?”
-“কোথায়?”

নিদ্রাকে আঙুলের ইশারা করে দেখাতেই সে দেখতে পেল ডার্ক ব্লু শার্ট আর কালো প্যান্ট পরিহিত এহসান গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শার্টের হাতা ফোল্ড করা আর হাতগুলো বুকে গুজে রেখেছে। গলার দিকে বোতম দুইটা খুলে রেখেছে। যে গরম পড়েছে! না খুলে উপায় আছে? এহসান এতক্ষণ অন্য দিকে তাঁকিয়ে ছিল। হঠাৎ এদিকে তাঁকাতেই নিদ্রার আর তার চোখে চোখ পড়ে যায়। মুহূর্তেই এহসানের চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সেই উজ্জ্বলতা নিদ্রার চোখে মুখেও কিছুটা ফুটে উঠে। এহসান ঐপাশ থেকেই মৃদু হেসে তার সামনে এসে দাঁড়ায়। নিদ্রা তখনো মুগ্ধ নয়নে এহসানকে দেখেই চলেছে। লোকটাকে দেখে এত খুশি হচ্ছে কেন সে নিজেই বুঝে পায়না। এহসান নিদ্রাকে সেই ভরাট স্বরেই ডেকে বলে,
-“নিদ্রা! কেমন আছো?”

#চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here