সিন্ধুর_নীল (পর্ব-২৭)

#সিন্ধুর_নীল (পর্ব-২৭)
লেখক— ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

৪৫.
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলেছে। চারিদিকে ভ্যাপসা গরম গরম ভাব। এসি চলার ফলে তা বোঝা যাচ্ছেনা ঠিকই, তবে রোদের প্রকটে দিব্যি বোঝা যায়। নিদ্রা আর এহসান একসাথে যাচ্ছে এখানকার একটা রেস্টরন্টে। এহসান চেয়েছিল ফাইভ স্টারে যেতে। তবে নিদ্রার ফাইভ স্টার অসহ্য লাগে। তার উপর খুব বেশিই খুদার্থ সে। ফাইভ স্টারে এত বড় নাম থাকে একেক আইটেমের যে মনে হয় কি না কি! যখন সার্ভ করা হয় তখনই বোঝা যায় আসল ব্যাপার। তারওপর অনেক চওড়া দাম! এমন নয় যে সে এফোর্ড করতে পারবেনা। সে পারবে। চাইলে তিন বেলা খেতে পারে ফাইভ স্টারে। তবে সে শুধু শুধু নামের জন্য টাকা খরচ করা পছন্দ করেনা। সবচেয়ে বড় হচ্ছে তৃপ্তির ব্যাপার। প্লেটের উপর সসের একটা লম্বা দাগ আর ছোট্ট একটা কিমা একদম ছোট ছোট মোমোর মত দেখতে থাকে সেটাই একটা আইটেম। এই টাইপেরই আরো দশটা বিশটা আছে। তাও যদি খবারের মান ভালো হতো! সবমিলিয়ে অসহ্যকর লাগে ফাইভ স্টার রেস্টরন্ট। এই জন্য এহসানকে সে এখানকার একটা হোটেল টাইপ রেস্টরন্টে নিয়ে যাচ্ছে দিকনির্দেশনা দিয়ে।

নিদ্রা ভেবে পায়না! এত পথ পাড়ি দিয়ে ড্রাইভ করে এহসান তার সাথে দেখা করতে এসেছে? এটাও সম্ভব! আর তার দরকারই বা কী? তার উদ্দেশ্য আছে কোনো? থাকতেই পারে। কিন্তু মনের গহীনে কোথাও কেউ বলছে,
-“না রে! তার আর কোনো উদ্দেশ্য নেই। প্রকৃত অর্থেই সে তোর সাথে সাক্ষাৎ করতে এসেছে।”

তখন এহসানকে দেখে সে এতটা চমকে গিয়েছিল! এখনও তো তার রেশ রয়ে গেছে অনেকটা। মুনতাহার সাথে এহসান খুব সুন্দর ভদ্র ভাবে কথা বলল। খানিক বাদে অনিন্দিতা এলে তার সাথেও হাসিমুখে কথা বলল। অনিন্দিতা তো কতক্ষণ হা করে ছিল। নিদ্রা সবটা খেয়াল করেছে। ইচ্ছা করছিল মুখের হা এর মধ্যে গোবর ঠুসে দিতে। নিদ্রা ভেবে পায়না! তার তখন এত বাজে ইচ্ছা কেন হয়েছিল? সে কী তবে ঈর্ষান্বিত হয়েছিল! কিন্তু কেন? এহসানের প্রতি তার তো কিছু থাকার কথা না। কোনো পুরুষের প্রতিই থাকার কথা না। যাও একজনের প্রতি ছিল! সে তো তাকে বুঝল না। আর নিদ্রাও এখন তাকে নিয়ে ভাবেনা। শত হোক! সে বিবাহিত, স্বামী আছে, একটা সংসার আছে। শুধু শুধু পাপের বোঝা আরো বাড়িয়ে বয়ে বেড়ানোর কী দরকার?
অনিন্দিতা আর মুনতাহাকে কতবার করে এহসান আর সে অনুরোধ করল সাথে আসতে। কিন্তু তারা আসেনি। নিদ্রা ভালোই বুঝেছে ওদের ছল। নিদ্রাকে ইচ্ছা করেই একা একা এহসানের সাথে টাইম স্পেন্ড করতে দিয়েছে।

ভাবনার সুতো কাটে এহসানে ডাকে,
-“নিদ্রা সামনের গ্রীন কালার রেস্টরন্ট টা?”
-“উহু! পাশের লাল রঙের টিনের ঐটা।”
-“ঐ টা কী ধাবা?”
-“আরে না। ঐটা রেস্টরন্টই। সবধরনের খাবার আছে। ফাইভস্টারের গুলোও কিছু আছে। আসলে ঐখানকার মালিক একটু গ্রামীণ পরিবেশে একটা রেস্টরন্ট করতে চেয়েছিল। যেখানে ধনী, গরীব সব রকমের মানুষ খেতে পারবে। তার এই বুদ্ধির আর ভালো উদ্যেগের প্রশংসা না করে থাকা যায়না। আই লাইক হিম!”
-“ইউ লাইক হুম?”
-“দ্য ওনার, ফাইয়াজ হক।”

এহসান কিছু বলল না। চুপচাপ গাড়ি পার্কিং করল। নিদ্রা আগে আগেই নেমে গেল। এহসান তার পেছন পেছন আসলো। বাহির থেকে কেবল টিনের মনে হলেও রেস্টরন্টটাতে দামি চেয়ার-টেবিল,সোফা, কাঁচের দেওয়ালে ঘেরা ছোট বড় কেবিন সব দেখল। আরেকটু সামনে গিয়ে অবাক নাহয়ে পারল না সে। সামনেই ছোট পুকুরের মত তাতে পদ্ম ফুঁটে আছে বোধ হয়। এর পাশেই বেতের চেয়ার, সোফা, টেবিল, দোলনা সহ আরো অনেক আসবাব পত্র দেখল। ছন, কাঁঠ, বাঁশের যথাযথ ব্যাবহার চারিদিকে। আবার রয়েছে গাছপালায় ভরা! ফুল গাছের দেখা মিলছে কোণায় কোণায়। প্রাকৃতিক পরিবেশটায় শ্বাস নিতে বেশ লাগছে। এখানে মানুষও আছে বেশ! এহসান কিছুক্ষণ পরিবেশটা উপভোগ করল। তারপর নিদ্রার খোঁজ করতেই দেখা মিলল দূরের একটা টেবিলে বসে আছে। সেখানে ছায়া আছে আর রয়েছে ফুরফুরে বাতাস। নিদ্রার উড়ন্ত চুলের গতিই তা প্রমাণ করছে। এহসান নিদ্রা সামনে বরারবর বেতের সোফাটায় বসে। আহ! দারুন আবহাওয়া। এত গুলো পথের ক্লান্তি গুলো ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছে। এবার খেয়ে নিলেই একেবারে শান্তি!

-“অর্ডার আমি দিব নাকি আপনি দিবেন?”
-“তুমিই দাও। আমার তো আইডিয়া নেই কোনটা কোনটা ভালো হবে। তুমি এসেছ, খেয়েছ, তাই তোমার একটা আইডিয়া আছে। সো তুমিই দাও।”
-“আমার অলমোস্ট সবগুলোই ট্রাই করা হয়েছে। এর মধ্যে সবগুলোই দারুন লেগেছে। তাই আপনি আপনার ফুড টা নিজের মত অর্ডার দিন।”
-“না। তুমি দাও আমার আর এখন মেন্যু কার্ড ঘাটার ইচ্ছে নেই।”
-“আচ্ছা তবে আমিই দিচ্ছি।”

ওয়েটারকে ডেকে নিদ্রা সাত আটটা আইটেম অর্ডার করল। এত আইটেম নেওয়ার কারণ এহসানকে সে এখানকার খাবারের টেস্ট বোঝাতে চায়। অবশ্য সব কম পরিমাণেই অর্ডার দিল। খাবার নষ্ট করা তার এবং এহসানের পছন্দ না। খাবার পনেরো মিনিটেই হাজির। এর মধ্যে এহসান আর সে ওয়াশরুম থেকে হাত মুখ ধুয়ে এসেছে। খাবার গুলো দেখতেও আকর্ষণীয়। সুগন্ধ্য তো আছেই!
প্রত্যেকটা আইটেম নিদ্রা এহসানকে টেস্ট করালো। এহসানের মুখের ভাবেই প্রকাশ পাচ্ছিল সে কতটা প্রসণ্ণ হয়েছে এবং তৃপ্তি পেয়েছে!

-“আরে নিদ্রা! কখন এলে?”
এহসান আর নিদ্রা সবেমাত্র ডেসার্ট আইটেম খেতে নিল। তখনিই কেউ একজন এই ভাবে তাকে ডাকে। নিদ্রা সামনে তাঁকাতেই দেখতে পেল ফাইয়াজ অর্থাৎ এখানকার মালিক দাঁড়িয়ে। নিদ্রা তাকে ভারোভাবেই চেনে সেও নিদ্রাকে চেনে। চিনবে না কেন? ফাইয়াজ তো মুনতাহার বাগদত্তা! ওরা খুব ফ্রেন্ডলি বলা চলে।

-“ফাইয়াজ! কাম টেক আ সিট!”
ফাইয়াজ বসে পড়ে। এহসান ভ্রু কুঁচে চেয়ে আছে। নিদ্রা ফাইয়াজকে বলল,
-“তুমি কেমন আছো?”
-“বেশ ভালো। আল্লাহর রহমতে আমি সবসময় ভালোই থাকি। তুমি?”
-“আলহামদুলিল্লাহ।”
-“সাথে কে? বিএফ!”
-“আরে না। হি ইজ মাই হাজব্যান্ড!”
এই কথা শুনে এহসানের মন পুলকিত হলো। তবে মুখের ভাব আগের মতো আছে। ফাইয়াজ হাত বাড়িয়ে দিল এহসানের দিকে বলল,
-“হাই ব্রো! আমি ফাইয়াজ হক।”
এহসান হাত মিলিয়ে মৃদু হেসে বলল,
-“এহসান মাহবুব।”
-“আপনাদের বিয়ের ব্যাপারে তো আমি কিছুই জানতাম না। হলো কবে?”
-“হয়েছে। একমাসের মত।”
-“নিদ্রা? আমি কী তোমার বিয়েতে খুব বেশিই খেয়ে ফেলতাম নাকি!”
নিদ্রা ফাইয়াজের কথার সারমর্ম বুঝল। সে হেসে বলল,
-“তুমি যেমনটা ভাবছ তেমন কিছুই না। মুনের থেকে জেনে নিও।”
-“সেও জানে? আমাকে বলল না একবারও!”
-“মুন ও কিছুদিন হলো জেনেছে। বাদ দাও। এই টপিকে কথা বলতে চাইছিনা এখন।”
-“আচ্ছা ঠিক আছে।”
-“ফাইয়াজ হচ্ছে মুনতাহার ফিয়্যন্সে।” এহসানের উদ্দেশ্যে নিদ্রা বলল।
এবার এহাসন পুরোপুরি স্বস্তি পেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের গল্প গুজব শুরু হলো। আসার আগে ফাইয়াজ এহসান কিংবা নিদ্রা কাউকেই বিল দিতে দেয়নি। বারবার করে বলেছে, -“আমার পক্ষ থেকে তোমাদের জন্য জাস্ট ছোট্ট একটা ওয়েডিং গিফ্ট ভেবে নাও।” এহসান বারবার না করেছে। পরে ফাইয়াজের মনঃক্ষুণ্ণ হওয়ায় দুজনেই এই ব্যাপারে চুপ হয়। ফাইয়াজ তাদের গাড়ি পর্যন্ত এগিয়েও দিয়েছে। সবমিলিয়ে এহসানের ফাইয়াজকে দূর্দান্ত লেগেছে।

৪৬.
সন্ধ্যার পূর্বে এহসান নিদ্রাকে হলে দিয়ে আসতে বললে নিদ্রা জানতে চায় এহসান কোথায় থাকবে! এহসান বলে এখন আবার ফিরে যাওয়ার শক্তি নেই। আজ রাত হোটেলে থাকবে। অলরেডী বুকিং করে ফেলেছে। নিদ্রা হলে যেতে নিলেই এহসান বলল,
-“নিদ্রা?”
-“কী?”
-“আজ হলে না গেলে হয়না!”
-“হলে না গেলে কোথায় থাকব আমি?”
-“আজ আমার সাথে হোটেলে স্ট্যে করবে?”

নিদ্রা কিছু বলল না। হলে চলে গেল গটগট পায়ে। এহসান সেদিকেই তাঁকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপরে গাড়িতে উঠে বসে। গাড়ি স্টার্ট দেয় কিছুক্ষণ বসে থাকার পরে। যখন স্টার্ট দিল তখন কোথা থেকে নিদ্রা দৌড়ে এলো। এহসান গাড়ি সবে মাত্র স্টার্ট দিয়েছিল ইঞ্জিন শব্দ করেছিল। ড্রাইভ শুরু করার আগেই নিদ্রা এসেছে। এহসান কিছুক্ষণ অবাক চোখে তাঁকিয়ে থাকে। নিদ্রা গাড়িতে উঠে বসে বলল,
-“এমন তাঁকিয়ে আছেন কেন?”
-“তুমি তো চলে গিয়েছিলে।”
-“হুম। জামা আনতে গিয়েছিলাম। কোথাও যে থাকব তো জামা কাপড় নিতে হবে না? আপনি কিছু এনেছেন সাথে!”
-“না।”
-“হোয়াট! প্রস্তুতি ছাড়া সোজা ঢাকা থেকে রাজশাহী চলে এলেন?”
-“এত কিছু মাথায় ছিল না।”
-“মাথায় কী থাকে তাহলে?”
এহসান কিছু বলল না। নিদ্রা রয়ে সয়ে বলল,
-“সামনে একটা জেন্টস শপ আছে। ঐখানে গাড়ি থামাবেন।”
-“হুম।”

জেন্টস শপ থেকে একটা ট্রাউজার, টি-শার্ট, একটি ফুলহাতা শার্ট, আর প্যান্ট চুজ করে নিল নিদ্রা। এহসান শুধু বিল পে করেছে।
হোটেলে এসে নিদ্রা কিছুক্ষণ থম মেরে রইল। হোটেলটা ও ফাইভস্টার। এই লোকের কী সবই ফাইভস্টার নাকি? কী বোঝাতে চায় তার খুব টাকা! হুহ!

রুমে ঢুকে আরো অবাক হয়ে গেল। বোঝাই যাচ্ছে এটা একটা হানিমুন কাপলের জন্য সাজানো হয়েছে। নিদ্রা বিস্ময়ে এহসানের দিকে তাঁকাতেই দেখতে পেল এহসান নিজেও অবাক চোখে চেয়ে আছে। অর্থাৎ সে নিজেও জানত না এমন কিছু যে হবে।

#চলবে।
(অনেকদিন পর দিলাম। রি-চেক করার সময় পাচ্ছিনা। তাই ভুল থাকলে ধরিয়ে দিবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here