সিন্ধুর_নীল (পর্ব-৩৫) লেখক– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

#সিন্ধুর_নীল (পর্ব-৩৫)
লেখক– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

৬১.
বাতাসের তীব্রতায় টেকা দুষ্কর! যেকোনো সময় ঝড় নামবে। এই বাতাসের মধ্যেই বাহিরের বসার জায়গায় বসে আছেন জমিদার শাহনেওয়াজ। তার মাথায় ঘুরছে মৃত্যুঞ্জয়ের বলা কথাগুলো। সে ভেবে দেখল আসলেই তার মধ্যে একটা পরিবর্তন এসেছে। সিন্ধু নামক মেয়েটির কথা সে ভাবে। খুব বেশিই ভাবে। কিন্তু এটা ঠিক নয়। মেয়েটি তার মধ্যে প্রভাব ফেলতে পারেনা। সামান্য সাপুড়ে পল্লীর মেয়ে তার মধ্যে এমন অনুভূতি তৈরি করতে পারে কী করে!

ঝড়ো হাওয়া, প্রচন্ড তা’ন্ড’বের মধ্যে হেঁটে আসছে সিন্ধু। উদ্দেশ্য জমিদারের সাথে দেখা করা। জমিদার তার স্বপ্ন পুরুষ ছিল। তবে এখন যাকে দেখছে সে ছিল তার কাছে এক অভদ্র বে’য়া’দ’ব পুরুষ। যাই হোক না কেন! তার দরকার সাহায্য। সে পালিয়ে এসেছে। বাবা তার বিয়েটা কাল দিবে বলে কথা দিয়েছেন সেই বুড়োকে। সিন্ধু বুঝল সম্ভব নয়, বিয়ে আটকানো তার পক্ষে সম্ভব নয়। সাহায্যের জন্য সে এগিয়ে যাচ্ছে জমিদারের কাছে। আজকে তার কথা শুনে মনে হলো সে একমাত্র যে তাকে এই বি’প’দ থেকে বাঁচাতে পারে।

মাথায় কাপড়ে পেচিয়ে আসা রমণীকে দূর থেকে দেখে চিনতে পারল না শাহনেওয়াজ। তবে যখন একটু কাছে এলো তখন ঠিকই চিনে ফেলে। ঐ রোদে পোড়া সেই তামাটে বর্ণের মুখটি যে তার খুব চেনা। বাতাসের দা’প’টে মাথার কাপড় যখন সরে গেলো তখনিই ঐ মুখটি উঁকি মারলো। শাহনেওয়াজ বিস্মিত না হয়ে পারেনি। এত রাতে এই মেয়ে এখানে কেন? আর কীভাবে এলো! রক্ষী আ’ট’কে ধরেনি? সিন্ধু উঠোনেই জমিদারকে দেখবে আশা করেনি। সে বেশ খুশিই হলো বলা চলে। এই এত গুলো পা’হা’ড়া’দা’র এর চোখ ফাঁ’কি দিয়ে আসা সহজ কথা নয়। নেহাৎ ঝড় বইছে তাই এই সুযোগ লুফে নিয়েছে। ঝড়ের হা’ম’লায় সবকটি ভেতরের কুঠিতে গিয়ে অবস্থান করছে। তবুও সে মূল ফটক দিয়ে আসেনি। বড় আম বাগানের ফাঁক ফোকড় দিয়ে লুকিয়ে চু’রি’য়ে এসেছে।

শাহনেওয়াজ সামনের দিকে অগ্রসর হলো। বাতাসে দুজনের পোশাকই এলোমেলো হচ্ছে। চোখে ধুলো লাগার ভ’য়ে দুজনেই চোখের পাতা বন্ধ করছে তো আবার খুলছে। যাচ্ছে তা অবস্থা! শাহনেওয়াজ গুরুগম্ভীর স্বরে কিছুটা উচ্চবাক্যেই বলল,
-‘তুমি এই অসময়ে এখানে কী করছ? তাছাড়া তুমি ভেতরে এলে কীভাবে!’
জমিদারের প্রতিটি কথা সিন্ধুর বুকে কামড় বসায়। এতদিন সে পাল্টা বলত আর আজ সাহসে কুলোচ্ছে না। আসলে ব্যাপারটা সাহসের নয়। ব্যাপারটা আসলে মনের কোথাও চুপটি করে বসে থাকা লজ্জা। এই লজ্জার জন্যই সে চুপ।
-‘কী হলো! কথা বলছ না কেন?’
-‘জমিদার বাবু আমি আপনার কাছে সাহায্যের জন্যে এসেছি।’
এই এতকিছুর মধ্যেও জমিদারের ভেতরকার অহংকারী মনটা হেসে উঠল। অবশেষে উঠ পাহাড়ের নিচে এসেই গেল! আগে তো কম অপমান করেনি! আর আজ সাহায্য চাইছে। কেন? সে জমিদার বলে! সে জমিদার বলেই কী এত ভয় আর সম্মান! মানুষ হিসেবে তাকে কেন সম্মান করে না সিন্ধু? জমিদার এই যাত্রায় ভুল বুঝল। তবে আসল সত্যি তো তা নয়। আসল সত্যি এই জমিদারের বৃত্তান্ত শোনার পর থেকেই সিন্ধুর মনে তার জন্য জায়গা আছে। বিশেষ জায়গা। যা আর কারো জন্য নেই। ভুল বোঝাবোঝির জন্য সৃষ্ট মুহূর্ত গুলো তো আর এতদিনের সেই জায়গা পরিবর্তন করে দিতে পারেনা!
দাম্ভিকতা বজায় রেখে শাহনেওয়াজ বলল,
-‘কী সাহায্য চাইছ?’
-‘আমার বাবা আমার বিবাহের কথা পাকা করিছে ঐ বুইড়া মঞ্জুর সাথে। আমার এই বিয়েতে মত নাই। আমি নাকোচ করবার পরেও জোর জবরদস্তিতে আমার এই বিবাহের আয়োজন শুরু করতেছে। ঐ লোকের আগের সংসার আছে। শুধু বউ নাই। ঐ বদ ব্যাটারে আমি বিবাহ করুম না।’
-‘বউ নেই দেখেই তো বিয়ে করছে। বউ থাকলে তো আর করত না।’
সিন্ধু রেগে গেল। বলল,
-‘আপনি মশকরা করছেন?’
-‘আমি মশকরা করব? কেন? আমাদের কী মশকরা করার মতো সম্পর্ক?’
-‘না। তবে একটা সম্পর্ক তো ছিল।’
শাহনেওয়াজ ধীমি কন্ঠে বলল,
-‘কেমন সম্পর্ক?’
-‘সাপ বেজি।’
-‘তুমি সাপ ছাড়া আর কিছু চেনো না?’
-‘না।’
শাহনেওয়াজ হাসে। বলল,
-‘বেশ। ভালো। তা আমি তোমাকে কীভাবে সাহায্য করব!’
-‘যেভাবে আজকে ঐ মেয়েরে করছেন। আমারেও সাহায্য করেন। আমি পড়তে চাই। ওই বুড়ার সংসার করতে চাইনা।’
-‘তুমি পড়ালেখা করতে চাও মানে!’
-‘আমি পড়ালেখা করতে চাই না আমি পড়ালেখা করি ও। উচ্চতর শিক্ষার জন্য শহরেও যেতে চাই। বাবারে বুড়ো এই লোভ দেখাইয়া রাজি করাইছে। আমারে নাকি শহরে নিয়া পড়াইবো। তবে আমি জানি, সব মিথ্যা। ভং চং এর কথা।’
-‘কীসের কথা?’
-‘ভং চং। মানে বলার মতো বলছে তবে কামে করব না।’
-‘বাহ! ভং চং!’
সিন্ধু হেসে দিল এবার। জমিদারের মুখে ভং চং কেমন হাস্যকর শোনা গেছিল। শাহনেওয়াজ সিন্ধুর হাসি দেখে মুগ্ধ নয়নে। চারিদিকে বাতাস বইছে এখনো। সেই বাতাসেই চুল উড়ছে এই কন্যার। কেশের বাহার দেখেই শাহনেওয়াজ চমকিত হলো। এতদিন তো এই লম্বা চুল খোপা আড়াল করেছিল। আজ আর সেই খোপা নেই ঝড়ো হাওয়ায় খুলে গেছে। ওমনি কেশমালা ছড়িয়ে পড়ল সবদিকে। সিন্ধু ব্যতিব্যস্ত চুল সামলাতে। তখনিই জোরসে বৃষ্টি শুরু হলো। দুজনেই ভিজে যাচ্ছে শাহনেওয়াজ সিন্ধুর হাত ধরেই দৌঁড়ে ভেতরে এলো। সিন্ধু অবাক চোখে কেবল চেয়ে রইল। শাহনেওয়াজ বলল,
-‘এই ঝড়ের মধ্যে আর বের হওয়া লাগবে না। কাল সভা বসবে। তখন তোমার সমস্যাটা দেখব। মুন্নাকে বলছি তোমাকে কক্ষ দেখিয়ে দিবে।’
শাহনেওয়াজ চলে যাচ্ছিল পেছন থেকে সিন্ধু ডাকে,
-‘আপনি আজ আমারে তুমি করে বললেন যে!’
জমিদার পেছন ফিরে, বলল,
-‘তুমি আজ আপনি বলছ যে? আগে তো এই রকম সম্মান দেখাওনি।’
-‘দেখেন ভুল একটা হয়ে গেছে।’
-‘আমার জানামতে ভুল একটা ছিল না।’
শাহনেওয়াজ চলে গেল। থমথমে মুখ ছিল তার। মুন্নাকে ডাক দিল কেবল। ডেকে কথা সেড়ে চলে গেল নিজ কক্ষে। বারান্দা থেকে শেখ মৃত্যুঞ্জয় ও এবার সরে দাঁড়ায়। এতক্ষণ সবটাই সে দেখছিল। দু পক্ষের কথা না শুনলেও একের প্রতি অন্যের ব্যবহার দৃষ্টি ভঙ্গি দু’টোই পরখ করল। যা বুঝল! অবস্থা ভালো না। প্রণয় ঘটে যেতেও পারে। কারণ শাহনেওয়াজের দৃষ্টি ছিল অন্যরকম।

৬২.
বিশাল গণরুমে বেশকিছু মানুষের মধ্যে কানাঘুষা চলছে। জমিদারের জরুরী ডাকে সিন্ধুর বাবা এবং মঞ্জুর পরিবারের পুরুষরা এসেছে। গতরাতেই সিন্ধুর পালানোর খবর চারিদিকে ছড়িয়েছে। তবে সে যে জমিদার বাড়িতে থাকবে সেটা কেউ ভাবতেও পারেনি। এখানে এসে সিন্ধুকে দেখে সবাই অবাক হলেও চুপ ছিল। সভাতে শাহনেওয়াজ সিন্ধুর বাবাকে জানালো সে কেন এই বিয়ে দিচ্ছে জোর জবরদস্তিতে! সিন্ধুর বাবা জানালেন তার আর্থিক অস্বচ্ছলতার কথা। সে অপারগ মেয়ের সমস্ত দায়িত্ব নিতে। তার শহরে পড়ার ইচ্ছা ছিল যা এই মঞ্জু পূরণ করতে পারবে। তাই সে বিয়ে দিবে মঞ্জুর কাছেই। শাহনেওয়াজ পরিশেষে জানালো সে নিজে শহরে নিয়ে সিন্ধুর পড়ার ব্যবস্থা করবে। এই বিয়ে যেন বন্ধ হয়। জমিদারের হুকুম অমান্য করা যায় না, তাছাড়া সিন্ধুর বাবা মঞ্জুকে কেবল এই একটি কারণেই মেয়ে দিচ্ছিলেন। এখন যখন স্বয়ং জমিদার দায়িত্ব নিল তখন তো আর কথা বাড়ানোর দরকার নেই। সে রাজি হলো। তবে মঞ্জু বেশ ঝামেলা করে গেল। সে নাকি দেখে নিবে সিন্ধু আর তার বাপকে।

এই বিচারে সিন্ধু সবচেয়ে বেশি খুশি হলো। বাবার সাথে বাড়ি ফিরে শিমুলের কাছে গেল প্রথমে। তাকে জড়িয়ে ধরে সবটা জানালো। শিমুল সিন্ধুর এই আনন্দ দেখে নিজেও আনন্দিত হলো। দুই সখী ঠিক করল বিকেলে পিঠে বানিয়ে পাঠাবে জমিদার বাড়ি।

সারা দুপুর দুজন মিলে পিঠে বানিয়ে নিয়ে গেল জমিদার বাড়ি। তবে ভেতরে নিজেরা গেল না। মুন্নাকে ডেকে দিয়ে দিল। মুন্নার জন্যও কিছু অতিরিক্ত এনেছিল। মুন্না ভীষণ খুশি হয়েছে যা তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল।

পরদিন মুন্নাকে দেখে জিজ্ঞেস করল যে জমিদার খেয়েছে কিনা। সে জানালো জমিদার এবং মৃত্যুঞ্জয় দুজনেই খুব প্রশংসা করেছে। তবে সে তাদের নাম বলেনি। বলেছে গ্রামের দুই বৃদ্ধা এসে পিঠে দিয়ে গেছে। সব শুনে রাগে ক্ষোভে সিন্ধু মুন্নাকে দৌঁড়ানি দিল। মুন্না হা হা করে হাসতে হাসতেই ছুট লাগায়। সিন্ধু খেয়াল করে বহু বছর পর তার পুরোনো সত্তা উঁকি মারছে। চঞ্চলতা ফিরে এসেছে। সবটা কেন কার জন্য বুঝতে পেরে সে লজ্জায় মুখ ঢাকে। ছিঃ শেষে কীনা সে ওত বড় মাপের মানুষের প্রেমে পড়ল! ব্যাপারটা বামুন হয়ে চাঁদে হাত দেওয়ার মতো। সে কেমন চুপসে গেল আবারও। কী হচ্ছে এসব! কেনই বা হচ্ছে? সে তো চায়নি এমন হোক। তবে কেনো!

#চলবে।
(আজ রি-চেইক দেওয়া হয়নি। ভুল ধরিয়ে দিবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here