#সিন্ধুর_নীল (পর্ব-৯)
লেখনীতে–ইনশিয়াহ্ ইসলাম।
দরজায় সেই কখন থেকে কেউ টোকা দিয়ে যাচ্ছে। এহসান দরজা খুলবে না খুলবে না করেও খুলেই দেয়। বড় বোন অনিতাকে দেখে ভ্রু কুঁচকে নেয়। অনিতা এহসানের দিকে তাঁকিয়ে চোখ কপালে তোলার মতো ভাব করে বলল,
“এই ভাই? তুই পাগড়ি খুলে ফেললি কেন! আর শেরওয়ানীটাতেও কেমন ভাজ ফেলে দিয়েছিস। তোর কি কোনো আক্কেল জ্ঞান নেই! একটু পর বিয়ে আর সে এমন দেবদাশ হয়ে বসে আছে!”
এহসান এবার মুখ দিয়ে বিরক্তি সূচক শব্দ বের করে বলল,
“উফ! পাগল হয়ে গেছিস নাকি? বিয়ে তো হচ্ছে না। এমন ঢং করছিস কেন?”
অনিতা মৃদু হেসে বলে, “কে বলেছে বিয়ে হবে না? বউ তো সেই কখন থেকে বসে আছে তোর অপেক্ষায়।”
এই যাত্রায় এহসান অবাক হলো। তার বোন মজা করছে বলে মনে হচ্ছে না তার। তবে কি বিয়ে হবে? নিহারীকা চলে এসেছে? সব প্রশ্ন মাথাতেই থেকে গেল। তার আগেই পিয়াম এসে এহসানের মাথায় পাগড়ি পড়িয়ে দিয়ে বলল,
“কি এহসান ভাই? আর কত অপেক্ষা করাবে আমার বোন টাকে?”
এহসান ধমক দিয়ে ওঠে পিয়ামকে। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
“তোরা কি আমার সাথে মজা করতে এসেছিস? একটা চটকনা দিব দেখবি সব মজা বের হয়ে যাবে।”
পিয়াম কিছু বলবে তার আগেই এহসানের মা একপ্রকার দৌঁড়েই রুমে ঢোকে। এহসানের গালে হাত বুলিয়ে বলে,
“দেখেছিস বাবা! কার ভাগ্যে কি থাকে? সব উপরওয়ালা আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছে। নাহলে এমন অসাধ্য সাধন হয় কীভাবে?”
“পরিষ্কার করে কথা বলবে মা?”
“আরে বলছি তো! নিদ্রা বিয়ের জন্য রাজি হয়েছে। আমার তো খুশি ধরছেনা।”
“তাহলে বিয়ে ভাঙার মতো একটা নাটক করল কেন?”
“আরে ধুর। নিহারীকার কথা বলছিনা তো! আরে আমাদের নিদ্রার কথা বলছি।”
এহসানের মুখভাব বদলে গেল মুহূর্তেই। চেঁচিয়ে ওঠে সে,
“নিদ্রা রাজি হয়েছে মানে? তোমাদের কি মথা খারাপ হলো নাকি! এর মধ্যে ওকে টেনে আনলে কেন?”
“আমরা টানিনি। কেউ জোর করেনি তো বাবা। ওর মত চেয়েছে আর ও সম্মতি দিয়েছে। কত ভালো মেয়ে! আমাদের সম্মান বাঁচাতে সে একটুও পিছুপা হয়নি।”
“ছিঃ মা ছিঃ, তোমরা শেষে কিনা নিদ্রাকে জোর করেছ?
“জোর কোথায় করলাম? শুধু ওর মা’কে বল…..
“আমি জানি তুমি কি করেছ বা করতে পারো। আমি করব না এই বিয়ে।”
“কেন করবিনা? নিদ্রা নিহারীকার থেকে কম কীসে! বরং ওর গায়ের রঙ আর উচ্চতা নিহারীকার থেকেও বেশি ভালো।”
“তুমি যেভাবে বিচার কর আমি সেভাবে করিনা মা! নিদ্রা স্বেচ্ছায় বিয়েতে রাজি হয়নি।”
অনিতা এবার কথা বলল,
“ভাই? নিদ্রা স্ব ইচ্ছাতে রাজি হয়েছে। আর এখন তুই যদি বলিস বিয়ে করবিনা তো মেয়েটা ভরা মজলিশে অপমানিত হবে। নিহারীকার কর্মফল ও কেন ভোগ করবে?”
“আমি তো সেটাই বলছি। ওর তো তা করার দরকার নেই! আমি নিদ্রার সাথে কথা বলব। ও এখন কোথায়?”
এহসানের মা এহসানের হাত মুঠোয় নিয়ে বলল,
“বাবা, আমি ওর মা-বাবাকে রাজি করিয়েছে। এখন সবাই জানেও যে ওর সাথে বিয়ে হবে তোর। এখন তুই না করলে ওর সম্মান থাকবে? ও তো আমাদের সম্মান বাঁচাতেই বিয়েটা করছে।”
“এটা ঠিক না মা! এটা ঠিক না।”
“ঠিক ভুল বিচার করতে হয় না সবসময়। কখনো কখনো যা হতে যাচ্ছে তা হতে দিলেই একটা সুন্দর সূচনা পাওয়া যায়। তবে তুই যদি এখন এমন করিস মেয়েটার জীবনে একটা দাগ বসে যাবে। আমি চাই না সেটা হোক! তুই কি আমার কথা বুঝতে পারছিস?”
এহসানের চোখে মুখে অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে। সে তো চায় নিদ্রাকে। তবে তা তো এভাবে নয়। নিদ্রা তো তাকে ভালোবেসে বা পছন্দ করে বিয়েটা করছেনা। করছে পরিস্থিতির চাপে বাধ্য হয়ে। এহসান চাইলেই পারে বিয়েটা ভেঙে দিতে। কিন্তু তার স্বার্থপর হতে ইচ্ছা করছে। আবার মায়ের কথাটিও তার মাথায় নাড়া দিয়েছে। সত্যিই তো! এখন সে বিয়ে ভেঙে দিলে লোকে আবার নিদ্রাকে নিয়েই হাসবে।
১২.
আজকের মতো অন্ধকার রাত্রি আর কখনো দেখেনি নিদ্রা। নিকষ কালো এই আঁধার তার মনেও বিচরণ করছে। অথচ আজ সকালের ফুটফুটে আলোতেও তার চোখে মুখে ছিল কত শত রঙের স্বপ্ন! আর এখন? সে রঙহীন! সবাই বলছে এহসান এখন থেকে তার সব। তার জীবনের রঙ, আনন্দ, হাসি, সুখ! কারণ সে এখন নিদ্রার স্বামী। নিদ্রা মনে করে এহসান তার জীবনের একটি রঙ যা বিষাদের! বেদনার! আর আনন্দ নয় কষ্ট, হাসি নয় কান্না, সুখ নয় দুঃখ! এহসান না থাকত তাহলে আজ তার বিয়েও থাকত না। আর নিদ্রাকেও এই বিয়েতে আসতে হতো না। অভ্রর প্রেমে পড়তে হতো না, শেষে পরিস্থিতির চাপে পড়ে এহসানকে বিয়েও করতে হতো না। নিদ্রার মতো শক্ত, স্পষ্টভাষী মেয়েটাও কেমন নিষ্প্রাণ, নির্বোধ, অপারগ হয়ে পড়েছিল এই পরিস্থিতির কাছে। কেউ কি ভেবেছিল সেই মেয়ে কখনো এমন একটা বিয়েতে রাজি হবে? সে নিজেও কি ভেবেছিল? অথচ ভাগ্যের কি খেলা! সেই মেয়েটাই এমন নিরীহ হয়ে পড়েছে এখন। পারেনি প্রতিবাদ করতে তার উপর হওয়া অন্যায় এর। হ্যাঁ! এটা অন্যায়। নিদ্রার উপর চাপিয়ে দেওয়া এই বিয়েটা অন্যায়। পরিস্থিতির চাপ ভাগ্য এসব কিছুই না। অন্যায় করা হয়েছে। তাকে ব্যবহার করা হয়েছে। এখনও হয়তো করবে! কারণ এখন তো তার আর এহসানের বাসর রাত। ফুলে সজ্জিত রুমটি তার আর এহসানের জন্যই সেজে আছে। অপ্রিয় হয়েও সব প্রিয় তার। এই যে সাদা গোলাপ দিয়ে খাট সাজানো, কালো গোলাপ দিয়ে মধ্যিখানে লাভ শেইপ বানিয়ে তার উপর লাল গোলাপ দিয়ে তার আর এহসানের নামের প্রথম অক্ষর লিখে রেখেছে। এই সব কিছুই তার পছন্দ হয়েছে কারণ এই সাদা আর কালো গোলাপ তার প্রিয়। লাল গোলাপ তো প্রেমের রঙ! তা অপ্রিয় হয় কীভাবে? তবে কালো গোলাপটা এখানে দেখে নিদ্রার কপাল কুঁচকেছে ঠিকই। সহজে পাওয়া যায়না আর পেলেও কেন এই ফুল দিয়ে কেউ খাট সাজাবে? নিদ্রা এসব ভাবতে ভাবতে সময় পার করছে। এহসানের হদিশ নেই।
———————————
নির্ঝর রুমে এসে দরজা আটকে দিতে নেয় বাধ সাধে অভ্র। একটু আগে তারা দুজনেই চরম ঝটকা খেয়েছে নিদ্রাকে বউ হিসেবে এহসানের পাশে দেখে। নির্ঝরের অবস্থা বেগতিক দেখে অভ্র সেই মুহূর্তেই তাকে সেখান থেকে সরিয়ে গার্ডেন এড়িয়াতে নিয়ে বসায়। নির্ঝর স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে। অভ্র এই প্রথম বোধ হয় এতো চমকেছে। নিদ্রা এহসানকে বিয়ে করেছে! এটা ভাবতে তার অদ্ভুত লাগছে।
বিয়ে শেষ হলেই নির্ঝর রুমে চলে আসে। পেছন পেছন অভ্র এসে পড়ে। নির্ঝর অভ্রর দিকে অসহায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে,
“নিদ্রা এখন পরের বউ তাই না?”
অভ্র মৃদু হাসে। নির্ঝরকে ধরে বিছানায় বসিয়ে বলে,
“হ্যাঁ, তাতে কার কী যায় আসে?”
“আমার খুব কষ্ট হচ্ছে অভ্র! আমি তো আজ রাতেই ওকে প্রোপোজ করব ভেবেছিলাম।”
অভ্রর তখনকার কথা মনে পড়ে যায় যখন নিদ্রা তার কাছে ভালোবাসার প্রকাশ করেছিল। নিদ্রা তাকে ভালোবেসে থাকলে অন্যত্র বিয়ে করবে কেন এমন কথা অভ্রর মাথায় আসে। পরমুহূর্তেই ভাবে হয়তো সে নিজ ইচ্ছায় বিয়ে করেনি আর সে নিজেই তো নিদ্রাকে ফিরিয়ে দিয়েছে। হয়তো নিদ্রা তার প্রত্যাক্ষাণে কষ্ট পেয়েই বিয়েতে রাজি হয়েছে! পিয়ামের থেকে সে শুনেছে নিদ্রার মায়ের কাছে এহসানের মা প্রস্তাব রেখেছে। তাই হয়তো বোনের স্বামী-সন্তানের সম্মানের কথা ভেবে নিদ্রার মা রাজি হয়েছে। আজকাল এই একটা ফালতু অযাচিত সম্মান নামক শব্দটার জন্য অনেক মেয়েকেই বলির পাঠা হতে হচ্ছে। কেন? একটা বিয়ে কি একটা মেয়ের জীবনের সুখ শান্তির চেয়েও বড় কিছু? অভ্র ভেবে পায় না নিদ্রা কীভাবে রাজি হলো!
“অভ্র আমার নিদ্রা চাই!”
নির্ঝরের বিধ্বস্ত কন্ঠে অভ্রের মধ্যে একটা খারাপ লাগা কাজ করে। সে যদি তখন হ্যাঁ বলে দিত নিদ্রাকে তবে হয়তো নিদ্রা বিয়েটা করত না। তবে হ্যাঁ বলেও বা কি লাভ! সে তো নিদ্রাকে ভালোই বাসেনা তখনও তো নিদ্রাকে ঠকানো হতো। এই এতো এতো খারাপ লাগা অভ্র আর নিতে পারছেনা। নিদ্রার জন্য তার মায়া হচ্ছে তবে একটা মানুষ হিসেবে অন্য কোনো অনুভূতি থেকে নয়! এদিকে নির্ঝরের জন্য তার কষ্ট লাগছে। এই প্রথম কোনো মেয়েকে নিয়ে নির্ঝর সিরিয়াস হয়েছিল
নির্ঝর বিছানায় শরীর এলিয়ে দেয়। চোখ বন্ধ করতেই চোখের কার্ণিশ বেয়ে উত্তপ্ত নোনা জল গড়িয়ে পড়ে। অস্পষ্টভাবে বিড়বিড়িয়ে আওড়ায়, “আমার নিদ্রা চাই!”
এই অস্পষ্ট কথাটাও অভ্র বুঝে যায়। এই মুহূর্তে সে নির্ঝরের পাশে বসে থাকতে পারছেনা। তার অপরাধী মনে হচ্ছে নিজেকে আবার অন্যদিকে মনে হচ্ছে যা ঘটার তা-ই ঘটেছে। এতে তার কোনো প্রভাব নেই!
——————————
কক্সবাজারের হোটেল ওশিয়ান প্যারাডাইসের একটি রুমে বসে নিহারীকা গান গাইছে। গানের গলা তার বরারবরই ভালো। তবে গান গাইতে গলা আগে কখনো এমন কাঁপেনি তার। এতো বুক ফাঁটা কষ্টও হয়নি। সে এই এতো দুঃখ, যন্ত্রণা নিয়ে দিব্যি গেয়ে চলেছে,
‘একা বসে তুমি! দেখছ কী একই আকাশ!
দিনশেষে তার তারা গুলো দিবে দেখা,
মেঘে ঢাকা তারার আলো, দেখে থাকো তুমি দেখ ভালো
হয় তো তার মাঝে খুঁজে পাবে আমায়!
সেই দিনের এক গানে এক গল্পকারের গল্প খুঁজে পাবে
খুঁজে পাবে না সেই গল্পকার!
দিন গুলো খুঁজে পাবে গানের প্রতিটা ছন্দে
শুনতে পাবে মৃত মানুষের চিৎকার
আমার দেহখান
নিওনা শ্মশান এমনিতেও পুড়ে গেছি
আমার সব স্মৃতি ভুলো না তোমরা যা কিছু ফেলে গেছি’
গান শেষ হতেই নিহারীকা বদ্ধ দরজার ভেতরে চিৎকার করে কেঁদে বলে,
“ইয়া আল্লাহ্! আমি কেন এতো একা? কেন? সব থেকেও কেন আমার কিছুই নেই! ভালোবাসার খোঁজ করে খুঁজে পাওয়ার পরেও কেন আমার ভালোবাসা মেলে না! আমি কি এতোই অধম?”
#চলবে।
(গল্প তিনদিন দেই নি। টেনশন আর মন খারাপে দিন কাটে। আপনারা আমার ছোট(চাচাতো ভাই আপনের চেয়ে কম না!) ভাইয়ের জন্য দোয়া করবেন। তার ক্যান্সার টেস্ট করিয়েছে যেন তা নেগেটিভ আসে! আর আমি উপন্যাস নিয়মিত দেওয়ার চেষ্টা করছি কিন্তু পারছিনা। এই অবস্থায় আমার মাথা আর হাত অচল। লিখতে চাইলেও লিখতে পারিনা।)