সিন্ধুর_নীল (পর্ব-৮) লেখনীতে–ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

#সিন্ধুর_নীল (পর্ব-৮)
লেখনীতে–ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

১০.
যতটা উৎসাহ নিয়ে সবাই নিচে এসেছিল ততটাই মন খারাপ আর দুশ্চিন্তা নিয়ে সবাই রিসোর্টের ভেতর ফিরে এলো। নিদ্রা তখন সবে মাত্র প্রধান ফটকের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। পৃথিলার চোখে মুখে এক রাশ কালো মেঘ জমা দেখে তার ভ্রু কুঁচকে যায় আপনা আপনি। পৃথিলার হাতের কবজি ধরে টেনে নিয়ে আসে বড় খোলা জানালার পাশে। সবার চোখ মুখেই স্পষ্ট কিছু অঘটন ঘটেছে। নিদ্রার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় ইঙ্গিত দিয়ে চলেছে কিছু খারাপ হতে যাচ্ছে।

‘ কি হয়ছে আপু? সবার এইরকম অভিব্যক্তি কেন? কি হয়েছে! ‘

‘ নিহারীকা নাকি পালিয়ে গেছে। অবশ্য সত্যি কি তা জানিনা। এটা আমার শোনা কথা। নিহারীকার যে গাড়ি করে আসার কথা ছিল সেখানে শুধু তার বাবা আর দুই চাচা এসেছে। সবার মুখই থমথমে। এহসান ভাইয়ার আব্বু আর মামারা আর বাকি বড়রা সবাই হল রুমে বসেছে। আমাদের সেখানে যাওয়া বারণ। এই কাহিনির জেরেই সবাই এটা ধারণা করছে যে নিহারীকা পালিয়েছে।”

“বললেই হলো? পালাবে কেন? আরে গিয়ে দেখ ব্যাপারটা অন্য কিছু। নিহারীকা বিয়ে নিয়ে কত খুশি ছিল ওর চোখ মুখেই তো প্রকাশ পেত সে বিয়েতে রাজি। তাহলে এমন স্টেপ সে নিবে কেন? মানুষ গুলোও কেমন! তিলকে তাল বানাতে ওস্তাদ।”

“তা ঠিকই বলেছিস। কিন্তু আমার মনেও ঐরকম কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে রে!”

“বাজে চিন্তা করবেনা একদম। দেখি চলো মায়ের কাছে যাই।”

“আচ্ছা আমি এখানে থাকি তুই যা।”

নিদ্রা তার মায়ের জন্য বরাদ্দকৃত রুমটিতে গিয়ে মাকে পায়নি। তবে বিছানা থেকে তার ফোনটি নিয়ে নেয়। হাতে নিয়ে দেখে তার ভাই নিলয়ের অনেক গুলো কল এসেছিল। দ্রুত ভাইকে কল ব্যাক করে বিছানায় বসে কিছুক্ষণ কথা বলে। কথা বলা শেষ করে ফোনটা বিছানার সাথে লাগোয়া ছোট্ট টেবিলটার উপর রাখতেই হুড়মুড় করে দরজা খুলে ভেতরে পৃথিলা প্রবেশ করল। নিদ্রা আচানক ভয় পেয়ে গেছিল। পৃথিলাকে একটু কড়া কিছু বলবে তার আগেই পৃথিলা বলল,

“নিদু! নিহারীকা সত্যি পালিয়েছে। আমি সেখানে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। আমাকে কিছু বলেনি তাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে তাদের কথা শুনলাম। আর কথা শুনে যা বুঝলাম নিহারীকা পালিয়েছে ঠিক তার সাথে সাথে আজ আরেকটা জিনিসও ঘটবে?”

নিদ্রার বুক কেঁপে ওঠে অজানা ভয়ে। সে আতঙ্কিত গলায় বলল,

“কি?”

“ফুফুর কাছে এহসান ভাইয়ের আম্মু একটা আবদার রেখেছে।”

নিদ্রা অবুঝ নয় তার মস্তিষ্কে কথাটা কি তা ভালোভাবেই ঢুকে গেছে। বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। টেবিলের উপর থেকে ফোনটা নিয়ে হিল জুতোর গট গট শব্দ তুলে নিচের দিকে রওনা দেয়। পেছন পেছন পৃথিলাও ছুটতে থাকে। নিদ্রার মনকে নিদ্রা বুঝ দিয়ে চলছে যে তার মা-বাবা এসব কিছুতে রাজি হবেনা। রাজি হলেও বা তার কী! তার মত থাকতে হবে তো! এমন তো নয় জোর জবরদস্তিতে কিছু হবে।

নিদ্রার তড়িৎ গতিতে হাঁটায় সে দ্রুত নিচে নেমে আসে। হল রুমে নিদ্রা প্রবেশ করা মাত্রই সকলের চোখ তার দিকে যায়। নিদ্রা কাউকে পরোয়ানা না করে সোজা তার মা-বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। রুমে ঢোকার পূর্বেই সে কিছু কথোপকথন শুনেছে। এখন সে মায়ের দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে আছে। নিহারীকার পরিবারের লোকজন মাথা নিচু করে বসে আছে। তাদের কোনো রা নেই। লজ্জায় মাথা কাটা পড়েছে যে!

নিদ্রার মা বসা থেকে দাঁড়িয়ে মেয়েকে নিজের জায়গায় বসিয়ে দেয়। তারপর মেয়ের মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে বলল,

“চুপ করে থাক। সবাই কি বলে তা আগে শোন।”

নিদ্রা এবার মেঝেতে দৃষ্টি ফেলে। অর্থাৎ সে শুনবে তারপর বলবে। এহসানের বাবা এনামুল সাহেব গলা খাঁকারি দিয়ে ওঠে। নিদ্রা তার দিকে তাঁকায়। তিনিও নিদ্রার দিকে ফিরে বেশ নরম স্বরে বলল,

“নিহারীকা পালিয়েছে তা হয়তো শুনেছ! আসলে সে পালিয়ে যায়নি। বিয়েটা ভেঙে দিয়েছে। আমাকে এবং তার বাবাকে উভয়কে সে ফোন দিয়ে বলেছে এই বিয়ে সে করবেনা। শেষ মুহূর্তে এসে তার এমন সিদ্ধান্তে সকলেরই মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের চেনা পরিচিত ব্যবসায়ীরা আমাদের কলিগ এবং প্রফেশনাল দিক দিয়ে পরিচিত যত লোক আছে সবাই চলে আসবে। আত্নীয় স্বজন যারা আমরা আছি তারা একান্তই নিজেদের। আমরা মানি তারা এই বিষয় নিয়ে হয়তো কিছু বলবে না। তবে সবাইকে তো চুপ করিয়ে রাখা যায়না! এতগুলো মানুষের সামনে লজ্জিত হতে আমরা কেউই চাইনা। আমাদের এই মুহূর্তে তুমি বাঁচাতে পারো মা।”

নিদ্রা হকচকিয়ে যায়। বিস্ময় নিয়ে বলল,

“আমি কীভাবে বাঁচাতে পারি? আর তাছাড়া আমিই কেন! অন্য কেউ কি নেই?”

“বাহিরে ভ্যানারে বড় বড় করে ছাপানো আছে নিদ্রা আর এহসান নামটি। এখানে শুধু নামটাই বড় ব্যাপার নয় মা। তোমার বাবা-মায়ের সাথে আমাদের সম্পর্ক খুব ভালো। আর তাছাড়া তুমি এহসানের জন্য একদম পার্ফেক্ট! আমরা তোমার কাছে আমাদের ইচ্ছাটা আমাদের আর্জিটা কেবল প্রকাশ করলাম। এবার তোমার উপর নির্ভর করছে। টেক ইউর টাইম। তোমাকে আমি জোর করছিনা। তোমার যদি মনে হয় যে এটা ঠিক নয় তবে তুমি জানাতে পারো। আমি জানি এখন ঠিক মনে হবেও না। তাই তোমাকে ভাবার সময় দিচ্ছি মা। তোমার মতামত যা হবে তা-ই আমরা মেনে নিব। তবে এটা বলতে পারি আমার ছেলে তোমার অযোগ্য না। আদর্শ শিক্ষা আমি তাকে দিয়েছি। পরবর্তীতে তুমি আফসোস করবেনা।”

নিদ্রার জীবনটা যেন সেখানেই থমকে গেল। একে একে নিহারীকার পরিবারের সবাই পুনরায় ক্ষমা চেয়ে চলে গেল। এহসানের মা আর নিদ্রার বাবা-মা ছাড়া সবাই হল রুম থেকে বেরিয়ে গেল। সিদ্ধান্ত তাদের নিজেদের। কাজেই তাদের মধ্যে আলোচনা হোক। পৃথিলাও এসে নিদ্রার পাশে বসে তার একহাত শক্ত করে ধরে। নিদ্রার বাবা অমত প্রকাশ করেছেন। তবে নিদ্রার মত থাকলে তার সমস্যা নেই এমনটি বলেছেন। এহসানের মা নিদ্রার মা নয়নতারার হাত ধরে বলে,

“বোন আমার! তোর মেয়ের হাত আমি এর আগেও একবার আমার এহসানের জন্য চেয়েছিলাম। তখন তুই হ্যাঁ বলেছিলি। পরে নিহারীকার সাথে বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়ায় আমাদের সিদ্ধান্ত বদল করতে হয়েছে। এখন আবারও সেই সুযোগ এসেছে। তোর মেয়েটাকে আমাকে দে। আমি ওর যত্নের কোনো ত্রুটি রাখব না। আমাদের এই পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার কর। এহসানের বাবা বাহিরে ঠিক থাকলেও ভেতরে নুইয়ে পড়েছে। আজকে যদি সবাই জেনে যায় এইরকম কিছু ঘটেছে তবে লজ্জায় সে মরেই যাবে! একটি পরিবারের জন্য এর থেকে লজ্জাজনক পরিস্থিতি আর হয়নারে! রাজি হয়ে যা নিদ্রাকেও রাজি করা। আমার অনুরোধ! বোন হিসেবে তোর কাছে এটাই আমার চাওয়া। আমার স্বামী সন্তানের মান বাঁচা দয়া করে।”

এহসানের মা কেঁদেই ফেললেন। নিদ্রা তার মায়ের দিকে তাঁকালে দেখে তার মা অসহায় চোখে তার দিকেই চেয়ে আছে। যার অর্থ “রাজি হয়ে যা নিদ্রা! রাজি হয়ে যা!”

নিদ্রা পড়ে অথৈ সাগরে। তার মন মানছেনা এদিকে মানুষগুলোর অসহায় দৃষ্টিও উপেক্ষা করতে পারছেনা। তার ভেতরটা কেঁদে উঠছে। সে দৌড়ে চলে যায় অভ্রর খোঁজে। এতক্ষণে সবার কানেই হয়তো খবর পৌঁছে গেছে। অভ্রর মনে যদি তার জন্য কিছু থেকে থাকে তো আজ কি! কখনোই সে অন্যত্র বিয়ে করতে রাজি হবে না। এখন তার সিদ্ধান্ত নির্ভর করছে অভ্রর উপর। কারণ মানুষটাকে সে সত্যিকার অর্থেই ভালোবেসে ফেলেছে।

———————————
এহসান রুমের দরজা আটকে বসে আছে। খবর পাওয়ার পর থেকেই সবাইকে রুম থেকে বের করে সে একা বসে আছে। সবার এটা মনে হচ্ছে সে হয়তো দুঃখে কষ্টে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। তবে প্রকৃত অর্থে তা নয় কিন্তু! সে খুশি হয়েছে। দিনরাত সে এমন একটা সংবাদের আশা করছিল। মনে প্রাণে তো এটাও চাইতো যে বিয়েটা কোনোভাবে ভেঙে গেলে ভালো হতো। তা সত্যিই হয়ে যাবে তা সে ভাবতে পারেনি। নিহারীকাকে বিয়ে করলে সে নিহারীকাকে ঠকাতো। একজনকে ভালোবেসে আরেকজনকে বিয়ে করা আর তারপর তাকে তার প্রাপ্য অধিকার না দেওয়া মানে তো ঠকানোই। যা হয়েছে ভালো হয়েছে। এ নিয়ে আর তার কোনো আক্ষেপ নেই। তবে প্রশ্ন মনে থেকেই যায়। নিহারীকা কী তবে গতকাল তার কথা শুনে ফেলেছ? পরক্ষণেই এটা ভেবে সে অনুতপ্ত হয়। এহসান শতভাগ নিশ্চিত হয় যে নিহারীকা হয়তো তার কথা শুনেছে। তাহলে এখানে সম্পূর্ণ দোষ এহসানের তাও সে কি সুন্দর স্বান্তনা পাচ্ছে আর নিহারীকা পাচ্ছে বঞ্চনা। এহসান অপরাধী মনে করে নিজেকে। নিহারীকার নাম্বার ডায়াল করে কল দেয়। নাম্বার ব্যস্ত বলছে। নিহারীকা হয়তো তার নাম্বারটা ব্ল্যাক লিস্টে ফেলে দিয়েছে।

১১.
অভ্র আনমনে হেঁটে যাচ্ছে করিডোর দিয়ে। নিদ্রা কোথা থেকে দৌড়ে এসে তার সামনে দাঁড়িয়ে হাফাতে থাকে। অভ্র মুঁচকি হেসে বলে,

“এনিথিং রং মিস. নিদ্রা?”

নিদ্রা মাথা ঝাকিয়ে বলে, “এভরিথিং রং!”

অভ্র ভেবেছে এহসানের বিয়ে ভাঙার খবর দিতে এসেছে নিদ্রা। তাই সে মৃদু হেসে বলে,

“আমি খবর পেয়ে গেছি। আপনাকে এত কষ্ট করে বলতে হবেনা।”

“সত্যিই পেয়েছেন?”

“হ্যাঁ!”

“তাহলে প্লিজ আপনার মনের কথা বলুন। বলুন আপনার মন কি চায়?”

“মানে? এখানে আমার মনের আবার কী চাওয়ার আছে?”

“ভণিতা করবেন না আপনি। আপনি কি সত্যিই বোঝেন না আমার মনের কথা?”

এ যাত্রায় অভ্র চুপ হয়ে যায়। সে যে বোঝেনা তা নয় আসলে সে বোঝে তবে নিজের ভুল ধারণা ভেবেই তা কাটিয়ে দিতে চায়। তবে কি সত্যিই নিদ্রার মনে তার জন্য কিছু আছে! থেকেও কি লাভ! সে তো নিদ্রাকে নিয়ে তেমন কিছু ভাবেই না। নিদ্রা তার ভালোবাসার মানুষ হতে পারেনা। এমন না যে নিদ্রার কোনো খুঁত আছে বলে। নিদ্রা তো নিখুঁত বলা চলে। কিন্তু সে তো তাকে ঐ নজরে দেখতে পায়না আর চায়ও না। অভ্রকে চুপ করে থাকতে দেখে নিদ্রা বলল,

“আপনি কি সত্যিই বোঝেন না।” এটা বলতে গিয়ে নিদ্রার চোখ ছলছল করে ওঠে। অভ্র অপরাধীর মতো নিদ্রার মুখের দিকে তাঁকিয়ে বলল,

“নিদ্রা আমি আপনাকে ঐ নজরে দেখিনা। আপনি যা বলতে চাইছেন তা অসম্ভব।”

“অসম্ভব কেন? আমি কি দেখতে খারাপ! নাকি আমার কোনো স্বভাবে খারাপ কিছু আছে? যদি থেকে থাকে আমাকে বলুন আমি তা বদলাতে প্রস্তুত।”

“তা নয় নিদ্রা। ব্যাপারটা সেটা না যা আপনি ভাবছেন।”

“তাহলে কী? আপনার জীবনে কেউ আছে!”

“বর্তমানে নেই তবে ভবিষ্যৎে থাকবেনা তা কিন্তু না!”

“আমি আপনার ভবিষ্যৎ হতে পারিনা অভ্র!”

নিদ্রার গাল বেয়ে টুপ করে ফোটা ফোটা অশ্রু কোণা গড়িয়ে পড়ছে। অভ্র সেদিকে একমনে চেয়ে থাকে। তার নিদ্রার প্রতি সহানুভূতি আসে তবে ভালোবাসার মতো কোনো অনুভূতি জন্মায় না। অভ্র নিদ্রার সামনে থেকে সরে আসে। উল্টো ঘুরে চলে যাওয়ার জন্য উদ্ধত হয়। আবারও ফিরে আসে। নিজের রুমালটা নিয়ে নিদ্রার চোখের পানি মুছে দেয়। তারপর নিদ্রার হাতে রুমালটা ধরিয়ে পরিষ্কার গলায় বলল,

“জোর করে তো আর ভালোবাসা হয়না নিদ্রা!”

অভ্র চলে গেল। নিদ্রা অভ্রর চলে যাওয়া দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল। চিৎকার করে কাঁদতে চাইলেও পারেনা। এদিকে সদ্য ফোটা তার ভালোবাসার ফুলটা নেতিয়ে গেল। বুকের ভেতর অসহনীয় ব্যথা হতে থাকে। কষ্টে কোনোরকমে হাতে থাকা ফোনে পৃথিলার নাম্বার ডায়াল করে তাকে কল দেয়। ওপাশ থেকে ‘হ্যালো’ বলতেই এক ঝাক কান্না লুকিয়ে ঠান্ডা অথচ জ্বলন্ত স্বরে বলল,
“মা’কে বলে দাও আমি এহসানকে বিয়ে করতে প্রস্তুত।”

#চলবে।

(দুইদিন দেইনি কেন দেইনি তা হলো মন খারাপের জন্য। ছোট্ট ভাইটা হাসপাতালে ভর্তি। মন মেজাজ ভালো নেই।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here