সিন্ধুর_নীল (পর্ব-৭) লেখনীতে–ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

#সিন্ধুর_নীল (পর্ব-৭)
লেখনীতে–ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

“এহসান? একটু এদিকে আসুন তো!”

নিহারীকার ডাকে এহসান ভিমড়ি খেয়ে ওঠে। পেছন ফিরে নিহারীকাকে দেখেই বসা থেকে দাঁড়িয়ে যায়। অভ্র আর নির্ঝরের দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে নিহারীকার দিকে এগিয়ে যায়। মৃদু হেসে নিহারীকার দিকে তাঁকায় ঠিকই কিন্তু মনে ভয় ঢুকে আছে। নিহারীকার কানে কথা গুলো গিয়ে থাকলে তার মুখ দেখানো দায় হয়ে পড়বে। নিহারীকার চোখ মুখের ভাষা দেখে বোঝা যাচ্ছেনা আদৌও কি সে তাদের কথা শুনেছে নাকি না! এদিকে নির্ঝর আর অভ্রও কৌতূহলী দৃষ্টি নিয়ে তাঁকিয়ে আছে তার দিকে। মনে মনে প্রার্থণা করছে যাতে খারাপ কিছু না ঘটে। সৃষ্টিকর্তা তাদের কথা শুনেছেন। নিহারীকা এহসানকে সবার সাথে ছবি তুলতে ডাকতে এসেছে শুনে মন কিছুটা হালকা হলেও পুরোপুরি চাপ মুক্ত হতে পারছেনা। নিহারীকার ভাব মূর্তিতেও কিছু বোঝা যাচ্ছেনা। এহসানও তা নিয়ে আর কোনো প্রশ্ন করেনি। নিহারীকার সাথে সে ছবি তোলার উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরে পেছন পেছন অভ্র আর নির্ঝর ও যায়।

ছবি তোলার সময় নিদ্রার পাশে নির্ঝর দাঁড়ায়। নিদ্রা তাতে অবশ্য কিছু মনে করেনা। সেও হাসিমুখে ছবি তুলে নেয় সবার সাথে। নিদ্রা মনকে ঠিক করেছে এই বলে যে, এখন থেকে আর কোনো মুড অফ নয়! সেও সবার সাথে মিলেমিশে বাকি দুইটি দিন আনন্দে কাটাবে। এমনকি নিদ্রা এহসানের সাথে একটি সেলফিও তুলেছে এবং নিজে থেকেই। নিদ্রা যখন এহসানের কাছে এসে সেলফি তুলতে চায় এহসান বলার মতো কিছুই পায়না। আলতো হেসে নিদ্রার সাথে একটা সেলফি তুলে। কিন্তু মনে মনে তার কষ্ট হচ্ছে তা বাহিরে কেউ দেখতে পারছেনা।

————————

রাতে এহসান সংকল্প করে যে নিদ্রার প্রতি তার মনে জন্ম নেওয়া সেই সব অনুভূতি সে মাটি চাপা দিবে। নিহারীকার সাথেই সে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছে এবং তার উচিত নিহারীকাকেই ভালোবাসা। দুইদিনের অনুভূতি আহামরি কিছুই না। ভেতরে ভেতরে দহন হলেও মাইন্ড সেট আপ করে নেয় এহসান। সত্যিই সে নিদ্রাকে নিয়ে ভাবা বন্ধ করে দেয়। তার এখন মাথায় একটি কথা বাজছে নিহারীকার সাথে দ্রুত বিয়ে করে নিদ্রা নামক সর্বনাশা অনুভূতির থেকে বাঁচতে হবে। দূরে চলে যাবে নিদ্রার থেকে। এইসব অনুভূতি একেবারেই যুক্তিহীন!

এমদাদ হকের বাড়িতে সবাই এক জোট হয়ে বসে আছে। আলোচনা হচ্ছে নিহারীকার বিয়ে নিয়ে। এখন বাজে সকাল ১০ টা। সবাই যাতে নির্দিষ্ট সময়ে তৈরি হয় এবং যার যার দায়িত্ব বুঝে নেয় এই নিয়েই আলোচনা চলছে। তাদের আলোচনা সভায় হঠাৎ করেই নিহারীকার আগমন। এমদাদ হক মেয়েকে দেখে বলল,

“কি ব্যাপার! তুমি রেডি হবে কখন?”

“বাবা আমি আজ পার্লারে সাজতে চাইছি।”

“কী! এতদিন এত গুলো অনুষ্ঠান গিয়েছে সব গুলোতেই বাড়িতে এসে সাজিয়ে গেল তোমায়। আর আজ বিয়েতে তুমি পার্লারে যেতে চাইছ! তোমার মতলব কি নিদ্রা!”

“বাবা প্রথমত আমার কোনো মতলব নেই। আর দ্বিতীয়ত আমাকে নিদ্রা বলে ডাকবেনা। এই নামটি আমার নেই এখন আর। আমি বহু আগেই এই নাম ত্যাগ করেছি।”

“ত্যাগ করার কারণ?”
এমদাদ হক পুনরায় বলে, “কারণটা কী সেটা একটু বলবে আমায়!”

“প্রয়োজন বোধ করছিনা। আমি আজ পার্লারে যাব মানে যাব। পার্লারের মহিলাদের সাথে আমার কথা হয়েছে। আজ অনেক গুলো ব্রাইডাল মেকওভার আছে তাদের, তাই তারা বাসায় এসে সাজাতে পারবেনা। আমাকেই গিয়ে সাজতে হবে এছাড়া উপায় নেই।”

“উপায় যখন নেই তখন যাবে। কিন্তু! কোনো রকম মন্দ কাজ করবেনা বলে দিলাম। আমি শেষবার তোমার উপর ভরসা করছি। মনে রাখবে এটা তোমার শেষ সুযোগ!”

নিহারীকা হাসে, কিন্তু তা বাবার প্রতি তাচ্ছিল্যের হাসি। সে তার বাবার চোখে চোখ রেখে শক্ত গলায় বলল,

“আমি কখনোই মন্দ কাজ করিনি। আজও করব না, যা সঠিক তা-ই করব। আমার ভালোটা আমি বুঝতে শিখে গেছি।”

এমদাদ হোসেন মেয়ের প্রস্থান পথে চেয়ে থাকে। এমন কঠোর, স্পষ্টভাষী মেয়েটা কোনো এক সময় ছিল ভীতু, আর নরম মনের। আচ্ছা তার মেয়ের এতো বড় পরিবর্তনের পেছনে দায়টা কার! তাদের নাকি নিহারীকার নিজের? এই প্রশ্নটা এমদাদ হক নিজেকে কখনো করে দেখেন নি। যদি করতেন তবে আজ তার মেয়েটা পরিবার থেকেও পরিবার হারা হতো না!

৯.
নিদ্রা আজ খুব মন দিয়ে সাজে। তার সোনালী রঙের লেহেঙ্গাটার সাথে ভারী সাজ আর ভারী গহনায় তাকেই নতুন বউ লাগছে। একই রকম সাজ বাকি মেয়েরাও দিয়েছে। সবাই লেহেঙ্গা পড়েছে তবে রঙ ভিন্ন। পৃথিলার আর নিদ্রার লেহেঙ্গা একই রকম তবে পৃথিলার লেহেঙ্গা হলো কালো। নিদ্রা খুব ভালো সাজাতে পারে তাই অনেকেই আজ নিদ্রার কাছে সাজতে এসেছে। সবার ধারণা ছিল নিদ্রা হয়তো কাউকে সাজিয়ে দেবেনা কিন্তু সবার ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে নিদ্রা সবাইকে সুন্দর করে সাজিয়ে দেয়। তারই সাথে সবার সঙ্গে গল্প করে, হাসি ঠাট্টাও করে। সবার সাথে সে সুন্দর করে মিশে যায়। সবার সাথে সাথে পৃথিলাও খুব অবাক হয়। কারণ এরা সব এহসানের কাজিন আর নিদ্রা যেহেতু এতদিন কথাই বলেনি আজ নিশ্চয়ই সাজিয়েও দিবেনা এমন ধারণা মনের মধ্যে ছিল তারও। সে যাই হোক! নিদ্রাকে এখন সবার খুব পছন্দ হয়েছে। এহসানের বড় বোনের সাথেও নিদ্রার দুই ঘন্টায় খুব ভাব হয়ে গেছে। সবাইকে সাজিয়ে নিজে সেজে নিদ্রা হাঁটা ধরে তার মা আর খালামণিদের রুমের দিকে। এসেছে থেকে মায়ের সাথেও তার তেমন একটা কথা হয়নি। মা তো বোনদের সাথেই ব্যস্ত থাকতো তাই সেও আর সবার ভিড়ে মায়ের কাছে যেত না।

রুমে ঢুকতেই সকলে নিদ্রার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে থাকে। নিদ্রার মা তো বসা থেকে উঠে নিদ্রার চোখের কোণা থেকে একটু কাজল নিয়ে কানের লতিতে ছোঁয়ায়। মেয়ের দিকে চেয়ে মৃদু হেসে বলল,

“মাশাআল্লাহ্! আমার মেয়েটাকে আজ পরীর মতো লাগছে। কারো নজর না লাগুক!”

নিদ্রা মায়ের কথায় লজ্জা পেয়ে যায়। এহসানের মা আর তার আপন দুই খালা এবং এহসানের মায়ের আপন তিনবোন সেখানে উপস্থিত ছিল। সবাই নিদ্রার খুব প্রশংসা করে। এহসানের মা মুখে প্রশংসা করে আর ভেতরে করে আফসোস! এই মেয়েকে যদি সে আগে দেখত তাহলে এই বিয়ের পাকা কথায় কখনো রাজি হতো না। ছেলের জন্য এই নিদ্রাকেই বেছে নিত। নিদ্রা কিছুক্ষণ খালামণিদের সাথে গল্প করে এবার হাঁটতে হাঁটতে তিন তলায় চলে গেল। দুইকদম হাঁটতেই একটি রুমের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে। সেখান থেকে কারো হাসির আওয়াজ আসছে আবার কারো কথা শোনা যাচ্ছে। অভ্রর গলার স্বর শুনে কৌতূহল দমন করতে না পেরে সে ভেতরে ঢুকে গেল। গিয়ে দেখে বেশ বড় একটি রুমে নির্ঝর, এহসান, অভ্র এবং আরো দুই তিনজন ছেলে রয়েছে এর মধ্যে পৃথিলার ভাই পিয়াম ও আছে। সকলের দৃষ্টিই এখন নিদ্রার উপর। নির্ঝর সোফায় আধশোয়া অবস্থায় ছিল নিদ্রাকে দেখেই দাঁড়িয়ে যায়। আর মৃদুস্বরে মুখ দিয়ে বের করে “ওয়াও” কথাটি। অভ্র এহসানকে তৈরি হতে সাহায্য করছিল। সে নিদ্রার দিকে তাঁকিয়ে সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে পুনরায় এহসানকে তৈরি করতে থাকে। নিদ্রা তাতে কিছুটা আহত হয়। পিয়াম হেসে বলে,

“কীরে নিদু? এমন বউ সেজে আছিস যে! বিয়ে কি তোর নাকি?”

নিদ্রা পিয়ামকে চোখ রাঙানি দিয়ে বলল,

“আমি তো ঠিকই আছি। নরমাল সাজ দিয়েছি। আর বিয়ের দিনে যারই বিয়ে লাগুক না কেন সাজবে তো সবাইও। আর তাছাড়া বউয়ের সাজ আরো গর্জিয়াস হয়। বউ আসলে দেখে নিস।”

এই কথা বলে নিদ্রা এহসানের দিকে তাঁকায়। এহসান চোখ নিচের দিকে নামিয়ে রেখেছে। নিদ্রাকে এখন এক পলক দেখার পরই তার ব্যাথাটা নাড়া দিয়ে উঠেছে। যেহেতু সে ঠিক করেছে আর এসব ফিলিংস এর জায়গা তার মনে দিবে না। তাই সে চোখটাও নামিয়ে নেয়। নিদ্রার দিকে তাঁকালে তাঁকিয়ে থাকতেই ইচ্ছা করে।
নিদ্রা এহসানের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলে,

“ব্রুজ তো উল্টো পড়েছেন। এভাবে কেউ ব্রুজ লাগায়?”

এটা বলে সে মুঁচকি হেসে এহসানের বুকে উল্টো হয়ে লাগিয়ে থাকা ব্রুজটি খুলে নেয়। এতক্ষণ চোখ নামিয়ে রাখলেও এখন আর এহসান চোখ নামিয়ে রাখতে পারেনা। নিদ্রার দিকে তাঁকায় সে। ভালো করে নিদ্রাকে পর্যবেক্ষণ করে এহসান। হিল পড়ার পরই হয়তো এহসানের কাঁধ অবধি তার মাথা এসেছে। বাকি সময় বুক সমানই দেখা যায়। নিদ্রা যে খাটো তা নয়! নিদ্রার উচ্চতা ৫’৬ যা একটি মেয়ের জন্য পার্ফেক্ট। এহসানের একেবারে ৬’১ বা একটু বেশি বলা চলে। তাই নিদ্রা যথেষ্ট লম্বা হলেও এহসানের বুকে পড়ে থাকে। এহসানের শেরওয়ানীর সাথে নিদ্রার লেহেঙ্গার রঙ মিলে গেছে। নিদ্রাকে সত্যিকার অর্থেই বউ বউ লাগছে। এহসান আনমনে হাসে তার হাসি দেখে নির্ঝর বলে,

“ওই ব্যাটা! মিটিমিটি হাসতেছিস কেন? ভাবীর কথা ভাবছিস! চাপ নিস না রাত হতে আর বেশি দেরি নাই।”

নির্ঝরের কথা শুনে সবাই হাসলেও নিদ্রার অস্বস্তি লাগে। নির্ঝর বরাবরই ঠোঁট কাটা স্বভাবের তাই নিদ্রা তাকে তেমন একটা পছন্দ করেনা। অভ্র নির্ঝরকে উদ্দেশ্য করে ভারী গলায় বলল,

“কোথায় কী বলতে হয় তা আজও শিখিস নাই!”

নিদ্রা অভ্রর দিকে আড়চোখে তাকায় যা অভ্র ধরে ফেলে। অভ্রর অস্বস্তি লাগছে নিদ্রার কাজকর্মে। মেয়েটি একেবারে অদ্ভুত নির্ঝরকে আর এহসানকে ধমকের উপরে রাখে আর তাকে দেখলেই কেমন ভাউ থেকে মিউ হয়ে যায়। অদ্ভুত! নিদ্রা অভ্রর মুখপানে তাঁকিয়ে মিষ্টি হেসে এহসানের ব্রুজটা সুন্দর করে লাগিয়ে দিয়ে এহসানের শক্ত পোক্ত বুকে চাপড় মেরে বলে,

“লুকিং ভেরী হ্যান্ডসাম গ্রুম!”

এহসান মৃদু হাসে। তার কোথাও খুব কষ্ট হচ্ছে কিন্তু সেই কষ্টের কথা মুখ ফুটে বলতে পারছেনা। নিদ্রা হঠাৎ করেই বলল,

“আমি নতুন বরের সাথে একটা ছবি তুলতে ইচ্ছুক। আমাদের একটা ছবি তুলে দিন তো কেউ!”
নিদ্রা খেয়াল করে তার মোবাইল মায়ের রুমের বিছানায় ফেলে এসেছে। তখনিই চোখ যায় এহসানের হাতে থাকা মোবাইলের দিকে। সে এহসানের হাত থেকে মোবাইলটা নিয়ে নির্ঝরের হাতে দিয়ে বলল,

“নিন সুন্দর একটা ছবি তুলে দিন।”

নির্ঝর কোনো প্রকার ভণিতা ছাড়াই তাদের দুজনের একসাথে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকটি ছবি তুলে দিল। যেখানে রয়েছে নিদ্রার প্রাণোচ্ছল হাসি আর এহসানের নিদ্রার উপর তাক করে রাখা মুগ্ধ দৃষ্টি।

নিদ্রা ছবি গুলো চেক করার সময় পেল না। তার আগেই একদল রুমের সামনে দিয়ে ছুটে গেল তাদের মুখ থেকে সবাই স্পষ্ট শুনে,
“বউয়ের গাড়ি চলে এসেছে! বউয়ের গাড়ি চলে এসেছে!”

নিদ্রাও আর কোনোদিকে না তাঁকিয়ে ছুট লাগায় নিহারীকাকে দেখতে যাওয়ার জন্য। এতদিনে তার নতুন বউয়ের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ পাচ্ছে। সেটা কম কীসে!

#চলবে!
(গঠন মূলক মন্তব্য করতে পারলে করবেন। নাইস, নেক্সট লিখবেন না। অনুরোধ রইল!)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here