সিন্ধুর_নীল (পর্ব-৬) লেখনীতে–ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

#সিন্ধুর_নীল (পর্ব-৬)
লেখনীতে–ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

রেস্টরন্টের এক কোণায় বসে নির্ঝর চা খাচ্ছে। খাচ্ছে বললে ভুল হয় পান করছে বলতে হয়। কিন্তু আমরা খাচ্ছের সাথেই পরিচিত। এই মুহূর্তে এতো বড় অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হচ্ছে আর তার কোনো হেলদোল নেই। বিতৃষ্ণায় অঙ্গ ভরপুর! নিদ্রা নামক রমণীকে তার বেশ ভালো লেগেছে। তবে রমণী তাকে কোনো পাত্তা দেয় না। নির্ঝর সেই কলেজ থেকে অনেক মেয়ের প্রেমময় প্রস্তাব পেয়ে আসছে। বুয়েটে যখন চান্স পেয়েছিল তখন তো আরো বেশি নজরে আসে সবার। এখন সে একজন সিভিল ইন্জিনিয়ার। কোনো কিছুর দিক থেকেই তার কমতি নেই। সে একটু ঠোঁট কাটা স্বভাবের এই যা! এটা কী আহামরি কোনো দোষের কিছু? তার তো মনে হয়না। নির্ঝর মনে প্রাণে একটা কথা সেট করে নেয়। এবার ঢাকা ফিরেই মা-বাবাকে বলবে নিদ্রার বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে। নিদ্রার বাবার সাথে তার যেহেতু ভাব আছেই নিশ্চয়ই তাদের ফিরিয়ে দেবে না। আর নির্ঝরের মতো স্টাবলিশড ছেলেকে কে-ই বা ফিরাবে? আছে নাকি কারো সাধ্য! রূপের দিক থেকেও তো সে অভ্র, এহসানকে হারিয়ে দেয়। তাহলে! নির্ঝর মনকে শান্ত করে। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। নিদ্রা তারই হবে। শুধু একটু সময়ের ব্যাপার। চা-টা শেষ করেই পা বাড়ায় বন্ধুদের মজলিশের দিকে। টোটাল ইন্জয় করতে হবে তাকে। এহসানের বিয়ে বলে কথা, চুপচাপ বসে থাকলে হয় না কি!

———————————————
হলুদ পর্ব শেষ। এখন আবার পুনরায় গান বাজনা এবং নিজেদের মধ্যে আনন্দ উৎসব শুরু হয়েছে। সবাই এহসান আর নিহারীকাকে রেস্ট নিতে বলেছে কিন্তু তারা শোনে নি। দুজনেই সবার সাথে গল্প – গুজব, হাসি- ঠাট্টায় ব্যস্ত। কেউ কেউ ব্যস্ত ভোজন গ্রহণে। নিহারীকার এই মুহূর্তে ক্ষুদা লেগেছে। সেই দুপুরে যে খেয়েছিল সন্ধ্যায় বাবা-মায়ের সাথে রাগ করে হালকা পাতলা কিছু আর খায়নি। এই মুহূর্তে ক্ষুদায় তার নাজেহাল অবস্থা। রেস্টরন্টের দিকে যেতে দেখা হয় নিদ্রার সাথে। দুজনা কুশল বিনিময় করে। নিদ্রাও নাকি খেতে যাচ্ছে নিহারীকা কিছু বলার আগে তাকেও জোর করে খেতে নিয়ে গেল। টেবিলে সব মেয়ে কিন্তু এই এতো গুলো মেয়ের মধ্যে কেউ এখন তাদের দিকে একটু ফিরেও তাঁকায়নি কেবল পৃথিলা বাদে। নিদ্রা পৃথিলাকে চোখ দিয়ে ইশারা করে বলে, “এদের কি হয়েছে?”

পৃথিলা মৃদু হেসে বলল,

“সবাই একটা গ্রুপ ফটো তুলতে চেয়েছিল কিন্তু এহসান ভাইয়ার এক কথা সে তুলবে না। তাই সবাই রাগ করেছে একটু। আর সত্যি বলতে ওদের বেশি জোরাজুরিতে ভাইয়া খুব রূঢ় ব্যবহার করেছে। আমি তো ঐরকম এহসান ভাইয়ের সাথে কখনো পরিচিত ছিলাম না। তাই বলতে গেলে আমিও বেশ ভয় পেয়েছি।”

নিদ্রা ভীষণ বিরক্ত হয়। ভ্রু কুঁচকে বলে,

“তার মেজাজের হঠাৎ কী হলো?”

“জানিনা।”

পৃথিলা এতক্ষণে নিদ্রার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নিহারীকাকে লক্ষ্য করে ভালো মতো। দেখেই বসা থেকে লাফিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। সবাইকে উদ্দেশ্য করে হেসে বলে,

“এই দেখ! ভাবী আছে তো। ভাবীর সাথেই নাহয় তুলে নে।”

নিহারীকা মুঁচকি হাসে সবাই এবার মাথা উচিয়ে নিহারীকাকে দেখে একটা চিৎকার দিয়ে উঠে ভাবী বলে। তবে তাদের আকস্মিক ভাবী বলে চিৎকার করার কারণে নিদ্রা হঠাৎ করেই ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে যেতে নেয়। কিন্তু পড়ে না তার আগেই নিজেকে সামলে নেয়। সবার দিকে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই দেখে সবাই নিহারীকার দিকে উচ্ছাসিত নয়নে চেয়ে আছে। নিহারীকা পুনরায় মুঁচকি হেসে একটি চেয়ার টেনে বসে পড়ে। নিদ্রাও নিহারীকার পাশে বসে। তারপর নিহারীকার দিকে তাঁকায়। নিহারীকা নিদ্রার দিকে তাঁকিয়ে দুষ্টু হেসে বলে,

“হবু বউটা আমিই নিদ্রা!”

নিদ্রা তো কিছুক্ষণ আগেই তা বুঝতে পেরেছে। এখন সে পুরোপুরি শিউর হলো। নিহারীকা নিদ্রাকে ফিসফিস করে বলে,

“থাক ভয় পেও না। আমি কিছু মনে করিনি কাল আমাকে আমার নামে বিচার দেওয়ায়। আমার খুব মজাই লাগছিল।”

নিদ্রা লজ্জা পায় নিজের কাজেই! এই যে এতক্ষণ সবাই বর বউকে হলুদ ছোঁয়ালো সে একটু সেদিকে একটু ঢু মারেনি। সেই দিকটায় যায়নি। তার আসলে বিন্দুমাত্র ইচ্ছা জাগেনি। তাই তো এখনও জানতেই পারেনি বউ কে!এতোটা অনিহা দেখানো উচিত হয়নি তার। বাবা ঠিকই বলে! তার মধ্যে সামাজিকতার বড্ড অভাব। একটা জায়গায় এসেছে তার উচিত মানুষ গুলোর সাথে সুন্দর ব্যবহার দিয়ে মেশার। কিন্তু সে কারো সাথেই কথা বলেনা একটু গল্প করেনা। এই যে এহসানের মা অর্থাৎ তার খালা। দূরসম্পর্কের হলেও খালা তো! তার দাওয়াতে যখন সে এখানে এসেছে তার তো উচিত ছিল ওনার সাথে বসেও ভালো মন্দ কিছু জিজ্ঞেস করার। নিদ্রার এখন একসাথে মাথায় সব চিন্তা এসে ভর করে। এই এক সমস্যা! আমরা যেমন একজনের আইডিতে ঢুকে আবার তার ফ্রেন্ড এর আইডিতে ঢুকি এভাবে একজন একজন করে অনেকজনের আইডি ঘুরে আসি, ঠিক তেমনিই নিদ্রার এবং নিদ্রার মতো কিছু মানুষের এক চিন্তা থেকে বহু চিন্তা মাথায় এসে ভর করে। এই চিন্তা করতে করতেই তো মাথার দুই তিনটা চুল পেঁকে গিয়েছে। যা সবসময় বা হঠাৎ করেই কেউ দেখবেনা। একটু ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে। তারপর কেউ দেখে ফেললে তার নাম হয়ে যাবে “বুড়ি বেটি নিদ্রা!”

ভাবনার সাগরে মত্ত্ব থাকা নিদ্রাকে পৃথিলা একটা ধাক্কা মারে। কন্ঠে বিরক্তি এনে বলে,

“কীরে নিদ্রা? হুটহাট এমন ভাবনার সাগরে ডুবে যাস কেন?”

নিদ্রা কিছু বলে না। নিহারীকার দিকে তাঁকায়, নিদ্রা অবাক হয়। নিহারীকা এখনো মুঁচকি হাসছে। তার এতো মুঁচকি হাসি আসে কেন? কই নিদ্রার তো এতো হাসি আসে না! ঐ যে তখন পেছন ফিরে নির্ঝরকে পড়ে যেতে দেখছিল তখনও তার হাসি পায়না। কোনো অনূভুতিই হয়নি কিন্তু অভ্র হো হো করে হাসছিল। নিদ্রার তো শুধু অভ্রর হাসিটা দেখেই বুকে চিনচিন ব্যাথা হয়। তার তখন ইচ্ছা করে কিছুদিন আগে তুমুল জনপ্রিয় হওয়া সেই গানটি গাইতে,
‘বুকে চিনচিন করছে হায়,
মন তোমায় কাছে চায়!’

নিদ্রা পুনরায় চুপ হয়ে যায়। এবার পৃথিলা আর কিছুই বলেনি। নিহারীকা নিদ্রার কানে ফিসফিস করে বলে,

“কী নিদ্রা? ডুবে ডুবে ভালোবাসছো নাকি!”

নিদ্রা চমকে ওঠে। নিহারীকা বুঝল কীভাবে? এমন প্রশ্ন মাথায় আসে। নিহারীকা তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বলল,

“নিদ্রা? তুমি কি সবসময় এমন ভাবনার সাগরে পড়ে থাকো?”

“না আসলে হ্যাঁ!”

“রিল্যাক্স! আচ্ছা সবাই শুনো?” সবাইকে উদ্দেশ্য করে নিহারীকা বলল,

“আমি তোমাদের ভাইকে নিয়ে আসছি। তোমরা চলো, কোথায় ছবি তুলবে!”

“ঐ তো সামনেই।” জবাব দেয় পৃথিলা। নিহারীকার আর খাওয়া হয়না। ক্ষুদার্থ পেট নিয়েই এহসানের খোঁজে বেরিয়ে পড়ে। তার জানামতে এহসান অত্যন্ত শান্ত, ভদ্র, সভ্য পুরুষ। হুটহাট রেগে যাওয়া বা ধমকে কথা বলা তার স্বভাবে পড়েনা। নিশ্চয়ই তার কিছু হয়েছে। নয়তো ছোট বোনগুলোর সাথে এমন ব্যবহার তো সে করেনা!

৮.
এহসান, নির্ঝর, অভ্র তিনজন বাহিরে বৈঠক খানায় বসে আছে। সেই কখন থেকে নির্ঝর আর অভ্র কথা বলতে চাইছে এহসানের সাথে কিন্তু এহসান বলছেই না। তার চোখ মুখের অবস্থা এমন মনে হয় তার আজ ক’দিন ঘুম নেই চোখে। নির্ঝর তো এটা নিয়ে কিছু হাসি ঠাট্টা করেছে তাকে নিয়ে। বিয়ের জ্বালায় নাকি এহসান ছটফট করছে! অভ্রর মতো গম্ভীর মানুষও নানান জোক্স বলেছে। এহসানের কোনো হেলদোল নেই। এবার অভ্র কিছুটা বিরক্ত হয়েই বলল,

“কি হয়েছে বলবি? এভাবে আর কতক্ষণ চলবে! আশ্চর্য!”

এহসান এবার নড়াচড়া দিয়ে ওঠে। কিছুক্ষণ মাথায় হাত দিয়ে চেপে রাখে। আঙুল দিয়ে কপাল ঘষে, ঠোঁটে ঠোঁট চেপে মনকে ঠিক করে। ধুম করেই বলে ওঠে,

“আমি পর নারীতে আকৃষ্ট হয়ে যাচ্ছি রে!”

কথাটা বলেই এহসানের বুক জ্বালা করার অনুভূতি হয়। এদিকে অভ্র আর নির্ঝর যতটা না স্তব্ধ হয় এহসানের কথা শুনে, তার চেয়েও বেশি চমকে যায় এহসানের পেছনেই নিহারীকাকে দেখে। নিহারীকার ঠোঁটে মুঁচকি হাসি। তাতে বোঝা যাচ্ছেনা সঠিক সে কি এহসানের কথা শুনেছে নাকি না!

#চলবে!

(কেমন লাগছে জানাবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here