সিন্ধুর_নীল (পর্ব-৫)

#সিন্ধুর_নীল (পর্ব-৫)
লেখনীতে–ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

এহসানের চোখে ঘুম নেই। হৃদয়ে আশ্চর্যজনক ভাবেই তীব্র ব্যাথা অনুভব হচ্ছে। এই ব্যাথার ঔষুধ টা কি তাও সে জানে। কিন্তু তা যে অন্যায়! এহসানের এখন নিজের উপরেই ভীষণ রাগ হচ্ছে। কেন এত দ্রুত বিয়ের জন্য রাজি হয়ে গেল! আর কিছুদিন না হয় অপেক্ষা করে দেখত। নিদ্রা তার জীবনে আরো আগেই আসত। তাহলে হয়তো এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হতো না। এহসান শোয়া ছেড়ে উঠে পড়ে। ট্যারেসে(ছাদে) নাকি খুব সুন্দর ডেকোরেশন হয়েছে। পাহাড়ের পাশেই এই রিসোর্টটি। সুতরাং সেখানে গেলে এখন একটি সুন্দর দৃশ্য উপভোগ করা যাবে। তাতেও যদি মনে শান্তি আসে তো আসবে!

রাতের ৩ টা বেজে ৪৬ মিনিট। কেউ কোথাও নেই। সব নিজ নিজ কক্ষে গভীর নিদ্রায় তলিয়ে আছে। ট্যারেসে এদিকে কেউ না থাকলেও বাহিরে কিছু নিরাপত্তাকর্মী এখনও জেগে সবাইকে পাহারা দিচ্ছে ঠিকই! এহসান তাদের দিকে অপলক কিছুক্ষণ তাঁকিয়ে থাকে। জীবন বৈচিত্রময়! কেউ এখন ফোমের বালিশে মাথা ঠেকিয়ে ঘুমাচ্ছে তো কেউ এই ডিসেম্বরের শীতের রাতে সামান্য একটি শীতবস্ত্র পরিধান করে ঘুমন্ত সেই ব্যক্তির পাহারায় নিয়োজিত! হায়রে দুনিয়া! এখানে কেউ বাদশা তো কেউ প্রজা!

ট্যারেসের গ্লাসটা একপাশ থেকে সরানো দেখে এহসান হকচকিয়ে যায়। এখানে এত রাতে কেউ আছে নাকি গ্লাস লাগাতেই কারো খেয়াল নেই! কিন্তু এমন তো হওয়ার নয়। এহসান ভেতরে প্রবেশ করে দেখে চারিদিকে কৃত্রিম আলোক সজ্জা, ফুল, ঝারবাতি, বৈঠকখানা সহ আরার নানান আয়োজন করে রাখা। এহসান যদি এখন এখানে না আসতো তবে এত সুন্দর দৃশ্যটা দেখাই হতো না। নিজের না আসা ঘুমটাকে একটা ধন্যবাদ দেয় সে। তারপর হালকা হেসে সামনে এগিয়ে যায়। দেখতে পায় রেলিং ধরে একটি নারী দাঁড়িয়ে আছে। এহসান হঠাৎ দেখে ভয় পায়না কারণ সে প্রথমেই বুঝেছে কেউ এখানে আছে। তবে অবাক ঠিকই হয়। এতো রাতে কোন মেয়েই বা ছাদে আসে? তাও এমন অচেনা, অজানা জায়গায়! একটু সামনে এগোতেই এহসানের দমবদ্ধ হওয়ার উপক্রম। কারণ সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি আর কেউ নেই তার ঘুম কেড়ে নেওয়া সেই প্রথমা নিদ্রা! যে কিনা এখন একমনে আকাশের পানে তাঁকিয়ে আছে। তার পরনে রয়েছে হালকা গোলাপী রঙের একটি লং নাইটড্রেস। উপরের কোটিটি বাতাসে দুলছে। নিদ্রার খোলা অগোছালো চুলগুলো উড়ছে। এহসান একমনে সেইদিকেই তাঁকিয়ে আছে। নিদ্রা হঠাৎ করেই পেছনে কারো অস্তিত্ব অনুভব করে ঘাড় ঘুরায়। এহসানকে দেখে পুনরায় আকাশের দিকে তাঁকায়। অন্যসময় হলে সে স্বাভাবিক থাকতো তবে তখনকার ঘটনায় সে লজ্জিত। এহসানকে নিজের আশেপাশে সহ্য করা কষ্টসাধ্য তার পক্ষে। এহসান নিজের ভেতরের স্বত্তাটাকে ফিরিয়ে এনে গলা খাকারি দিয়ে ওঠে। তাতেও নিদ্রার কোনো হেলদোল নেই। এহসান এবার মুখ খুলল এবং ভারী গলায় প্রশ্ন করল,

“তুমি এই সময় এখানে কি করছ?”

নিদ্রা পুনরায় অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। তবুও নিজেকে সামলে নেয়। এহসানের দিকে ফিরে শক্ত গলায় বলল,

“আপনি যা করতে এসেছেন আমিও তা-ই করতে এসেছি।”

“আমি কি করতে এসেছি তা তুমি জানো?” নিদ্রার একটু কাছে এসে ধীর গলায় বলল কথাটি। নিদ্রা হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। এদিক ওদিক তাঁকিয়ে বলে,

“কি জন্য আর আসবেন! হয়তো ঘুম আসছিল না তাই একটু চন্দ্রবিলাশ করতে এসেছেন।”

“তুমি কি সেই কারণেই এসেছ?”

“হ্যাঁ!”

“হুম, ঘুম আসছিল না তা ঠিক তবে চন্দ্রবিলাশ করার কথা মাথায় আসেনি। এখানকার মনোরম পরিবেশটা দেখতে এসেছি।”

“ও আচ্ছা।”

“যদি বলি আরেকটা কাজ করতে এসেছি?” নিদ্রার আরেকটু কাছে গিয়ে কথাটা বলল এহসান। নিদ্রা দু কদম পিছিয়ে শান্ত কিন্তু কঠিন গলায় বলল,

“কি সেই কারণ!”

“আমি এসেছি এক সর্বনাশা অনুভতির থেকে বাঁচতে। কিন্তু আমি মহা ভুল করে ফেলেছি। আমি এখানে আসার পর সেই অনুভতি আরো গভীর করে দিয়েছি।”

“কেমন অনুভতি?”

“প্রেমময়!”

“বিয়ে করতে চলেছেন এমন সব অনুভতি হবেই, স্বাভাবিক! পালিয়ে বেড়ানোর তো কোনো মানে হয়না।”

“তুমি কাউকে ভালোবাসো নিদ্রা?”

এহসানের চোখে আকুলতা আর নিদ্রার সারা গায়ে ভালোলাগার শিহরণ! হঠাৎ করেই যে অভ্র নামটি মাথায় এসে গেল! নিদ্রা এহসানকে সঠিক উত্তরটি দেয়নি উল্টো প্রশ্ন করে বসে,

“আপনার কী দরকার তা জেনে?”

“আমার দরকার টা জেনে তোমার কি লাভ?”

“আজব! আপনি আমার লাভ লাইফ নিয়ে জানতে চাইছেন। আর আমি সেই কারণটা জানতে চাইলে লাভ ক্ষতির ব্যাপার চলে আসছে কেন?”

“তুমি এমন কেন নিদ্রা? আমার সাথে এতো কঠোরতা কেন তোমার!”

নিদ্রা চমকে যায়। সত্যিই তো! এহসানের সাথে তার কীসের এতো কঠোরতা! তার রাগ কেন সে এহসানের উপরেই ঝারে? এসেছে থেকেই সে অকারণে এহসানের উপর বিরক্ত। এ যাত্রায় নিদ্রা কথা হারিয়ে ফেলে। চলে যেতে উদ্দ্যত হলেই তার চোখ যায় এহসানের ডান হাতের পিঠের চামড়া ছিলে যাওয়া। নিদ্রা বুঝতে পারে এটা তারই নোখের আঁচড়। তখন এহসানকে বোধ বুদ্ধি হারিয়ে চাপ্টে ধরায় এমন হয়েছে। আরেকটু অপরাধবোধ জন্মায় তার মনে। যেতে যেতে আদেশের সুরে বলে যায়,

“হাতে অয়েন্টমেন্ট লাগিয়ে দিবেন।”

এহসান মুঁচকি হাসে, সেই হাসিটি যদি তরুণীর চোখে পড়ত তবে হয়তো সে নিজের সর্বনাশটি দেখতে পারত! এহসান মনে মনে আওড়ায়,

“নহে আমি তোমার প্রেমিক, নহে তুমি মোর প্রেমিকা। তবুও দেখ! রাগ, অভিমান, ঝগড়া সব মোদের দুজনাতেই ঘটে। এমনই যদি প্রেম ঘটে তবে ক্ষতি কী তাতে!”

৭.
আজ নিহারীকা ও এহসানের হলুদ সন্ধ্যা। নিহারীকার পরিবার হাজির হয়েছে রিসোর্টে। রিসোর্ট তাদের বাড়ি থেকে বিশ মিনিট পথ দূরে। নিহারীকার বাবা এহসানের বাবাকে বলেছেন তাদের বাড়িতেই সবাইকে উঠতে। এহসান ও তার পরিবার তাতে সায় দেয়না। তারা রিসোর্টটা চারদিনের জন্য বুকড্ করে নেয়। কারণ এতে আত্নীয় স্বজনদের থাকার অসুবিধা তো হবেই আবার নিজেদের একটা সম্মানহানি হয়। তাদের সেই পরিমাণ অর্থ আছে নিজ আত্নীয়দের সমাদর করার।

নিহারীকার লেহেঙ্গার সঙ্গে এহসানের পান্জাবী মিলিয়ে নেওয়া হয়েছিল। অনুষ্ঠান শুরুর আগে কিছুক্ষণ দুজনের ফটোসেশন করা হয়। তারপর সবাই মিলে দুজনকে হলুদ ছোঁয়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। নিদ্রাও একটি হলুদ লেহেঙ্গা পড়ে তৈরি হয়ে বসে আছে। আজকের লেহেঙ্গাটি হালকা কাজের উপর। সামলাতে কষ্ট হচ্ছেনা। তাই কতক্ষণ এদিক সেদিক ঘুরে এসেছে। এখন পৃথিলা সহ হল রুমে বসে ছবি তুলছে। পৃথিলাকে আসছি বলে নিদ্রা অভ্রকে খুঁজতে থাকে। একটু সামনে গিয়ে পেয়েও যায়। দেখে সাথে নির্ঝরও রয়েছে। তবে তারা দুজনেই মই বেয়ে উপরে উঠছে। নিদ্রা ভ্রু কুঁচকে নির্ঝরকে প্রশ্ন করে,

“কি করছেন আপনারা!”

নির্ঝর তো নিদ্রাকে দেখেই হেসে দেয়। খুশিতে গদগদ হয়ে যায়। কিন্তু অভ্র আকস্মিক নিদ্রার কথা শুনে পা নাড়িয়ে ফেলে। পড়ে যেতে নিলেই নিদ্রা মই শক্ত করে ধরে। তাতে অভ্র বেঁচে যায় ঠিকই তবে নিদ্রার দিকে হতাশ দৃষ্টিতে তাঁকায়। নিদ্রা লাজুক হেসে বলে,

“ভয় নেই! আমি এটা শক্ত করে ধরছি।”

অভ্র সৌজন্যতার খাতিরে মৃদু হেসে বলে,

“লাগবেনা আমি পারব। আপনার হঠাৎ আগমনের কারণেই পা পিছলে যাচ্ছিল আমার।”

“আচ্ছা।”

নিদ্রা এবার সোজা হয়ে দাঁড়ায়। পুনরায় প্রশ্ন করে,

“কিন্তু আপনারা এই কাজ করছেন কেন? এখানে তো আরো লোক আছে!”

নির্ঝর হুংকার ছেড়ে বলে ওঠে,

“থেকেও কী লাভ! প্রত্যেকটা গর্দভ। বারবার বলেছি এই জায়গায় সবাই ছবি তুলবে। এটার একটু স্পেশাল ডেকোরেশনের জন্য। তারা তা না করে চিপায় চুপায় লাইট ফিট করেছে। এদিকেও যে একটু এক্সট্রা লাইট দিবে তা না! এই যে দেখুন! আমি আর অভ্র মিলে এইগুলো লাগিয়েছি।”

নিদ্রাকে হাতের ইশারা করে দেখায় নির্ঝর। নিদ্রা দেখে তারা প্রকৃতপক্ষেই খুব সুন্দর করে সাজাচ্ছে জায়গাটি। এরা ওয়েডিং প্ল্যানার হলে মন্দ হতোও না! নির্ঝর এবার একটু কেঁশে বলল,

“মিস. নিদ্রা? আপনি কি আমার মইটা ধরতে পারবেন। না মানে আমি যদি পড়ে যাই?”

নিদ্রা বিরক্ত হয় খুব। সে কি মই ধরার চাকরী নিয়েছে নাকি! সবাই কি আর অভ্র নাকি যে সবার জন্য মই ধরবে? নির্ঝরকে এক প্রকার ধমকেই বলল,

“পারব না! আপনি পড়ে গেলে আমার কী?”

কথাটা বলেই হন হন করে চলে গেল। এদিকে সত্যিই নির্ঝর আর দুই সিঁড়ি নামতে গিয়ে পড়েই গেল। ভাগ্যিস পাশে থাকা ডিভাইনের উপর পড়েছে নাহলে সত্যিই ব্যাথা পেয়ে যেত খুব। অভ্র তা দেখে হো হো করে হেসে ওঠে। তারপর নিজে মই থেকে নেমে নির্ঝরের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। নির্ঝর এক ঝামটা দিয়ে অভ্রর হাতটা সরিয়ে রাগে গিজগিজ করতে করতে উঠে চলে যায়। এদিকে অভ্রর হাসি থামছেই না। হাসতে হাসতে সে ডিভাইনে বসে পড়ে।

#চলবে!

(আপনাদের কি ভালো লাগছেনা? নায়ক কে সেটা জানতেই হবে! তো বলে রাখি তিনজনই নায়ক। এবার তাদের নায়িকা আলাদা হবে। প্রত্যেকটা চরিত্র আমার কাছে সমান এবং আমি তাদের জন্য তাদের কাজ এবং সঙ্গীও বেছে রেখেছি। রি-চেইক করিনি, ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here