#সিন্ধুর_নীল (১৮)
লেখক– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।
নিদ্রা রাতে যখন এহসান ঘুমিয়ে পড়েছিল ঠিক তখন বইটা নিয়ে সেই লাইব্রেরীতে চলে যায়। কারণ নিরিবিলিতে না পড়লে ঠিক মতো পড়াও হয়না। তাছাড়া বইটাও এহসানের। এহসান যদি ওর বই ধরাতে কোনো রিয়্যাক্ট করে তখন? উহু! এত রিস্ক না নিয়ে লাইব্রেরীতে গিয়ে পড়াই ভালো। এহসান তো ঘুমিয়েই আছে। সমস্যা হবে না। নিদ্রা যখন বইয়ের প্রথম পাতা টি মেলে ধরে তখন একদম হা হয়ে যায়। এখানে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে এটা কারো হাতের লেখার ফটোকপি। বইয়ের ছাপা নয় এটা একেবারে কোনো মানুষের কাগজে কলমে লেখা। তার উপর এখানে তারিখ সন সব উল্লেখ্য করা। তারমানে এটা কোনো সত্য কাহিনি। কিন্তু কীসের? নিদ্রার আগ্রহ আরো বেড়ে যায়। বইয়ের প্রথম থেকে পড়া শুরু করে।
☆☆☆☆☆
বাংলা ১২৮২ সন, বৈশাখ মাসের ২৬ তারিখ,
জমিদার শাহনেওয়াজ বিয়ে করে তার প্রথম স্ত্রী সুগন্ধ্যা আইনীন বেগমকে নিয়ে নিজ গৃহতে প্রবেশ করেন। সেদিন তপ্ত রোদে ভরা ছিল বাড়ির প্রাঙ্গন। শাহ নেওয়াজ বিয়ে করেছিলেন তার দুই গ্রাম দূরের জমিদার কন্যা সুগন্ধ্যা আইনীনকে। তৎকালীন সময়ের সেরা সুন্দরীর একজন ছিলেন তিনি। বাবা-মায়ের একটিমাত্র কন্যা। তার বড় দুই ভাইও ছিল বটে। তবে একমাত্র কন্যা হওয়ায় তার আদর যত্নও একটু বিশেষ ছিল। সেই কন্যা যে একদিন নানান যন্ত্রণা ভোগ করবে তা কে জানতো? যাই হোক! ধীরে ধীরে সব খোলাসা করা যাবে। এখন আসা যাক বর্তমানে। জমিদার শাহ নেওয়াজ ছিলেন উদাস মনের মানুষ। কোনো কিছুতেই তার খেয়াল থাকেনা ভালো করে। সে বরাবরই শান্তশিষ্ট মানুষ ছিলেন। তার মানে এই নয় যে তিনি দুর্বলও ছিলেন। যুদ্ধ বিদ্রহে তার তলোয়ারের আঘাত থেকে শত্রুপক্ষ রেহাই পেত না কখনোই। তার দেশপ্রেম এবং মাতৃভক্তি ছিল অনেক বেশি। আর তার গ্রাম বাসী ছিল তার অন্তর। তিনি ইংরেজ শাষণ কোনো কালেই মানতেন না। ইংরেজ দের তার গ্রামে কোনো ঠাই ছিল না। রাজা-বাদশাহ্, সম্রাট কেউই তাকে দাবিয়ে রাখতে পারত না। বরং উপরে উপরে সবাই তার উপর ইংরেজ শাষণ না মানায় ক্ষিপ্ত থাকলেও ভেতর ভেতর ছিল সন্তুষ্ট। তাকে লুকিয়ে চুরিয়ে কত শাষকই তো সাহায্য করেছিল সে সময় ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য। অপরদিকে, ইংরেজরা সামনা সামনি তাকে সম্মান করলেও ভেতরে ভেতরে তার বিপক্ষে ষড়যন্ত্র করত। তবে সফল হতো না। কারণ একটাই। তার ছিল দুই জন বিশ্বাসী বন্ধু প্রত্যয় শাহ্ আর শেখ মৃত্যুঞ্জয়। নামেই তারা তার বিশেষ দেহরক্ষী কিন্তু মূলত তারা ছিল তার বন্ধুর মতো। অনেকে তো তাদের শাহনেওয়াজের ডানহাত আর বামহাত বলেও আখ্যায়িত করেছিল। প্রত্যয় ছিল সেই সময়কার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আতাউরের একমাত্র পুত্র। বাবার অঢেল সম্পত্তি থাকা স্বত্তেও সে তাতে ভ্রুক্ষেপ না করে নিজের শখের বসে আয়ত্ত করা তলোয়ার আর ঘোড়া চালানোতেই নিজের জীবন কাটিয়ে দেয়। শাহনেওয়াজ এর সাথেই সে একই পাঠশালায় পড়ত এবং পরবর্তীতে একই সাথে তারা নিজেদের যোদ্ধা হিসেবে তৈরি করার প্রশিক্ষণ নেয়। তাদের বন্ধুত্ব সেই ছোট থেকেই ছিল। তবে শেখ মৃত্যুঞ্জয় ছিল তৎকালীন সম্রাটের একমাত্র আদরের ভাগ্নে। সম্রাটের বোন আর বোনের স্বামী মারা যাওয়ার পরে শেখ বংশের সেই একমাত্র উত্তরসরী মৃত্যুঞ্জয়কে নিয়ে আসেন তিনি। ছোট থেকেই নিজ পুত্রের মতো লাল পালন করেন। মৃত্যুঞ্জয়কে নিজ হাতেই তরবারি চালানো গোলা বারুদের ব্যবহার এবং শিকার করা সবই শিখিয়েছিলেন তিনি। মৃত্যুঞ্জয় যেমন ভালো তলোয়ার চালাতো তেমনিই ভালো লিখতে পারতো। নিজ হাতে তিনি কত শত কবিতাই না লিখেছিল। এই লোকটির মস্তিষ্ক ছিল জ্ঞানে ঠাঁসা। বীরত্বের এক চেটিয়া অধিনায়ক ছিলেন সেইসময়ের। এত ধনী হওয়া স্বত্তেও হঠাৎ কেন তিনি জমিদার শাহনেওয়াজের দেহরক্ষী হলো সেটাই তো প্রশ্ন? জানা যাবে। ধীরে ধীরে সব জানা যাবে। জমিদার শাহনেওয়াজ বেগম সুগন্ধ্যাকে বিয়ে করেছিল কেবল তার মায়ের কথা রাখতেই। তার মায়ের শখের পুত্রবধূ ছিল সুগন্ধ্যা বেগম। তার একপ্রকার মনের আর প্রাণের ইচ্ছা ছিল এই পরম সুন্দরী রমণী তার পুত্রবধূ হবে। হলোও তাই। সুগন্ধ্যা আইনীন যেদিন প্রথম জমিদার শাহনেওয়াজকে দেখেছিল সেদিন রাতে সে একপ্রকার নেশাগ্রস্থের মতো হয়ে গিয়েছিল। তার নাওয়া খাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল কতদিনের জন্য। সে সৃষ্টিকর্তার কাছে খুব করে সেই অতি সুদর্শন পুরুষটাকে চাইতো। সৃষ্টিকর্তা তার চাওয়া পূরণ করেছিল ঠিকই তবে পুরোপুরি নয়। শাহনেওয়াজ তার স্বামী হয়েছে ঠিকই তবে সে প্রেমিক পুরুষ হতে পারেনি। সে সুগন্ধ্যাকে কখনোই হয়তো ভালোবাসেনি। এমনকি বিয়ের ছয় রাত পার হয়েও যায় সে সুগন্ধ্যাকে ছুঁয়েও দেখেনি। বেগম সুগন্ধ্যা প্রথমে তা মেনে নিলেও পরবর্তীতে পারেনি। রাত-দিন কেঁদে কেঁদে হয়রান হয়ে যেত। সব দেখে শাহনেওয়াজের মা বেগম ডেকে পাঠালেন। বেগম সুগন্ধ্যা শ্বাশুড়িকে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন। অশ্রুশিক্ত ভেজা চোখের ভাঙা গলায় বলল,
-“আম্মাজান! আপনার পুত্র যে আমায় ভালোবাসে না।”
মাশহুদা বেগম বিব্রতবোধ করেন। মৃদু হেসে বলেন,
-“কে বলল ভালোবাসে না? তাছাড়া ভালোবাসা কি এত সহজেই হয় নাকি? একটু সময় লাগেই।”
-“আমি তো তাকে প্রথম দেখাতেই ভালোবেসে ফেলেছি। তবে সে কেন আমায় ভালোবাসতে পারেনি? মানলাম যে কখনো কখনো অনেক সময়ও লেগে যায়। কিন্তু তিনি তো আমার কাছেও আসেন না। একটু হেসে কথাও বলেন না। কেমন গম্ভীর, চুপচাপ হয়ে থাকে। আমার তো তার সাথে কথা বলতেই সংকোচ আর ভয় হয়। এই বুঝি রেগে যায়!”
-“নেওয়াজ বরাবরই এমন ধারার পুরুষ। তুমি তা নিয়ে মোটেও চিন্তা করবেনা। আমি নিজে তার সাথে কথা বলব। তাকে বোঝাবো। তুমি বরং আজ দিবারাত্রির আগে একটু সেজে গুজে নিও। আমার পুত্র তোমার কামড়ায় যাবে।”
বেগম সুগন্ধ্যার চোখ মুখ খুশিতে ঝলকে ওঠে। মৃদু শব্দে হেসে বলল,
-“সত্যি আম্মাজান?”
-“একদম।”
এই মায়ের মতো শ্বাশুড়ির প্রতি বেগম সুগন্ধ্যার ভালোবাসা আরো বেড়ে গেল যেন! সে হেলিয়া দুলিয়া মাশহুদা বেগমের কক্ষ হতে প্রস্থান করে। বৈকেলের শেষ সময়ে মাশহুদা বেগম পুত্রকে ডেকে আনায় নিজ কক্ষে। থমথমে গলায় বলল,
-“তোমার কাউকে ভালোবাসতে বা পুরোপুরি বুঝে উঠতে সময় লাগবেই। তাই বলে এই নয় তুমি নিজের গুরু দায়িত্ব ভুলে যাবে।”
শাহনেওয়াজ হকচকিয়ে গেল। মায়ের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
-“আমি তো নিজের সব কাজই যথারীতি সম্পন্ন করছি আম্মাজান। তবে এমন কথা কেন আসছে?”
-“করছ না তুমি। আসল কাজটাই তো করছ না। আমার লজ্জা শরমের কথা ভুলে এটা বলতেই হচ্ছে যে তুমি বংশ বৃদ্ধি করার মতো মূল কাজটাই সম্পন্ন করছ না। আমি কী ভুল বলছি?”
এই যাত্রায় শাহনেওয়াজ কিছুটা দমে গেল। আসলেই এটা তাদের একটি গুরু দায়িত্ব। প্রত্যেক রাজা বলো বা জমিদার সবারই প্রধান কাজের একটি হচ্ছে বংশের প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখার। সে প্রকৃত অর্থেই সুগন্ধ্যাকে মেনে নিতে পারেনি। তবে ফেলেও তো দিতে পারেনা। তারও তো হক রয়েছে। এবং গ্রামের মানুষদের দেখভালের জন্যও তো পরবর্তী জমিদার আনতে হবে। এসব তো সে ভেবে দেখেইনি। মায়ের কথা শুনে সে লজ্জিত হয়। মাশহুদা বেগম পুত্রকে নুয়ে যেতে দেখে বলল,
-“আজ তুমি সুগন্ধ্যার কামড়ায় যাবে। আশা করি আমার কথার নড়চড় হবে না।”
শাহনেওয়াজ মাথা নেড়ে বলল,
-“জ্বি আম্মাজান।”
সেই রজনীতে জমিদার এবং সুগন্ধ্যা বৈবাহিক জীবনের আরেকটি ধাপের সূচনা করেছিল। তবে জমিদার মন থেকে তেমন কিছুই অনুভব করত না সুগন্ধ্যার প্রতি। তারও কিছু শারীরিক চাহিদা থাকতোই কারণ সেও মানুষ। এবং চাহিদা মেটানোর জন্যও তার বেগম তো ছিল। দেখতে দেখতে বছর অতিবাহিত হয়। বেগম সুগন্ধ্যা গর্ভবতী হোন। চারিদিকে একটা হৈ হৈ পড়ে যায়। তখনই ঘটে এক অনাকাঙ্ক্ষিত কান্ড। বেগম বুঝতে পারেন তার স্বামী কোনো রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন। যে সে রোগ নয়! প্রেম রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। বেগম যখন বুঝতে পারলেন তখন তিনি চারমাসের অন্তঃসত্বা। কাউকে বলতেও পারতেন না আর সহ্যও করতে পারতেন না। দিনরাত কেবল কাঁদতেন। হা হুতাশ করতেন। জমিদারের সেইসব দেখার সময় কই? সে তো তখন ছদ্মবেশ বদলেও এক সাঁপুড়ে পল্লীতে গিয়ে বসে থাকতো। বেগম সুগন্ধ্যা জানতে পারেন সব কিছু শেখ মৃত্যুঞ্জয়ের কাছ থেকে। তবে মৃত্যুঞ্জয় নিজে থেকে জানায়নি সে যখন এই ব্যাপারে প্রত্যয় শাহ্কে জানায় তখন পর্দার আড়ালেই সে শুনে ফেলে।
☆☆☆☆☆
-“নিদ্রা!”
এহসানের আকস্মিক ডাকে নিদ্রা চমকে উঠে। বইটা বন্ধ করে নিজের নাইটড্রেসের আড়ালে লুকিয়ে ফেলে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এখন এখান থেকে বের হলে এহসান কী বলবে? এই চিন্তাটা যতটা না হচ্ছে তারচেয়েও বেশি চিন্তা হচ্ছে শাহনেওয়াজ কেন এমন করল? সুগন্ধ্যাকে কেন ভালোবাসেনি? আর সাঁপুড়ে কন্যার প্রেমেই কেন পড়ল? তারচেয়েও বড় এই সব কি সত্যিই হয়েছিল? নিদ্রার মাথা ভনভন করছে এই সব অসহ্যকর চিন্তায়।
#চলবে।
(আগামীকাল আরেক পর্ব দিব। আপাতত এই ছোট পর্বটাই পড়ুন। অতীত এবং বইটির কাহিনি বর্ণণার সময় ☆☆ এমন চিহ্ন প্রয়োগ হবে।)