সিন্ধুর_নীল (পর্ব-১৭) লেখনীতে—ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

#সিন্ধুর_নীল (পর্ব-১৭)
লেখনীতে—ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

২৭.
চোরাবালিতে নাকি তলিয়ে গেলে সহজে আর ফিরে আসা যায়না। ঠিক তেমনিই আমরা আমাদের কিছু প্রিয় মানুষ অথবা জিনিস হারিয়ে ফেললে তা আর ফিরে পাইনা। পেলেও তার কদর আগের মতো থাকেও না। মিত্র আর শুত্রুর এই পৃথিবীতে আমরা কখনোই টিকে থাকতে পারিনা। দিনশেষে হয়তো সেই পরম মিত্রর জন্য কাঁদি নয়তো পরম শত্রুর জন্য। শত্রু তো শত্রুতা করেই কাঁদায়। কিন্তু মিত্র কেন কাঁদায়? এই উত্তরটা বহু কষ্ট করেও মেলাতে পারিনি। আমাদের উচিত এই শত্রু আর মিত্রর বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে কেবল মানুষের মতো মানুষ হয়ে বেঁচে থাকা। যখন একে একে সবাই প্রকৃত মানুষের মতো চলতে পারব তখনিই আর শত্রু তৈরি হবে না। মিত্রও লাগবেনা। আমাদের সবার পরিচয় হবে একটাই। আমিও মানুষ সেও মানুষ। আপন না হই কিন্তু জাতি এক। এক সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি। আমাদের বাঁচা মরা সবই একরকম। আমাদের রক্ত লাল। কে কোন ধর্মের বা কে কোন বর্ণের তা আমরা না-ই বা ভাবলাম। আমাদের কর্ম হোক এক। সৎ, সততা, নিষ্ঠা, সত্যচার এবং স্রষ্টায়বিশ্বাসী হওয়াই হলো আমাদের একমাত্র উদ্দেশ্য। আমাদের চোখে সবাইকে সমান করে রাখতে হবে। তবেই তো এই বিশ্বে নেমে আসবে শান্তি। তবে এইখানেই সমস্যা। আমরা কেউই এসব কাজে জড়াই না। আমরা কেবল পারি অন্যের খাবার ছিনিয়ে নিতে, অন্যের সুখে দুঃখী হয়ে হিংসায় জ্বলে যেতে! আশরাফুল মাখলুকাত হয়েও আমরা কেউ কেউ পশুর চেয়েও অধম! একজনের আরেকজনকে খুন করতেও হাত কাঁপেনা। কতই না বর্বর সমাজের বাসিন্দা আমরা! ধিক্কার তাদের যারা এই অমানুষ তৈরি করছে তিলে তিলে। আজ তারা বেঁচে গেলেও পরকালে তারা তাই পাবে যা তাদের পাওয়া দরকার।

আজ দুইদিনে দেশে দুইটি লাশ পাওয়া গেছে। সারা দেশে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। কেউ কেউ তো ভয়ে ঘর থেকে বের হতেই চায়না। বাচ্চাদেরও এখন আর খেলার মাঠে দেখা যায়না। সব কেমন গুমোট ভাব ধরে আছে। এই পরিস্থিতিটা কেউই মেনে নিতে পারছেনা। অভ্র নির্ঝরকে নিয়ে এসেছে সমুদ্রের বালুচরে। নির্ঝরের মন মেজাজ কেমন একটা তেড়ছা হয়ে রয়েছে। হু হা করে বেশিরভাগ। ওরা এখানকার মারমেইড বিচ্ রিসোর্টটাতে উঠেছে। তাই এখানে নিজেদের একাকী সময়টা ভালোই কাটছে। চুপচাপ থাকলেও নির্ঝরের এখানে যে বেশ ভালো লাগছে তা অভ্র বুঝতেই পারছে। সে নির্ঝরকে বলল,
-“কিছু ভেবেছিস?”
-“কী নিয়ে?”
-“পরশু এহসানের রিসিপশনের ব্যাপারে।”
-“ভাবার কি আছে? কালকেই তো ঢাকা ফিরছি। আর ঢাকা যখন ফিরছি তখন তো বন্ধুর রিসিপশনেও যেতেই হবে। তাছাড়া আমাদের অনেক প্ল্যানিং ও তো আছে। তা ফুলফীল না কলে কী আর হয়!”
-“ভেবেছিলাম সেই সব ভুলে গেছিস।”
-“ডিল টুটা হ্যায় যারুর, মাগার হামারা ভেজা আভি তাক আচ্ছা হ্যায়!” (হৃদয় ভেঙেছে ঠিকই কিন্তু আমার মস্তিষ্ক এখনও ঠিক আছে।)
-“বহুত খুব!”

দুজনেই এক তালে হেসে ওঠে। তারপর নিজেদের ফোনে নানা পোজে ছবি তোলে। দুইটা কোকাকোলা ক্যান সাথে এনেছিল অভ্র। বালুতে বসে ক্যান খুলে নির্ঝরের দিকে দিতেই নির্ঝর হেসে তা গ্রহণ করল। অভ্র নিজের ক্যানে চুমুক দিতে দিতেই বলল,
-“গতকাল নিহারীকার সাথে অড বিহেইভ করেছিলি।”
-“আমার কাছে ঠিক মনে হয়েছিল।”
-“মনে হওয়া আর করা এক নয়। তোর একটা মেয়ের সাথে এভাবে কথা বলা উচিত নয় যখন সে দোষী নয়।”
-দোষী নয়? কে! নিহারীকা! ওহ্ কাম অন অভ্র। ওই মেয়ে বিয়ের দিন পালিছে।”
-“সে পালায়নি। বিয়ে ভেঙে দিয়েছিল।”
-“সেটা একই হলো। শেষ মুহূর্তে এসে বিয়ে ভেঙে দেওয়ার মানে কী! সে ভীতুর মতো পালিয়ে গেছে। এতোই যখন ব্রয়ফ্রেন্ডের সাথে পালানোর শখ ছিল তো আগে কেন পালায়নি?”
-“নির্ঝর সে বয়ফ্রেন্ডের সাথে পালিয়ে যায়নি। এখানে ওর দোষ নেই। ও নিজেও ভুক্তভোগী।”
-“তুই ওর হয়ে এত কথা বলছিস কেন?”
-“কারণ এখানে সঠিক ভুল বিচার-বিবেচনা করে তারপর একটা কথা বলতে হবে। তাই। সেদিন যখন মানে হলুদের রাতে এহসান যখন আমাদের বলেছিল সে পরনারীতে আসক্ত হয়ে পড়েছে তখন নিহারীকা সেখানেই উপস্থিত ছিল।”
-“কিন্তু ও তো শোনেইনি।”
-“সব শুনেছে নির্ঝর। প্রতিটি কথা শুনেছে কিন্তু আমাদের তা বুঝতে দেয়নি।”
-“কারণ সেও একটা ছুতা পেয়ে গিয়েছিল। ভেবে রেখেছে এখন পালিয়ে যাবে পরে কিছু হলে নিজের সাফাই গাইতে এহসানকে ফাঁসিয়ে দিবে। আর নিজে সাধু হয়ে যাবে।”
-“তুই আসলেই একটা নির্বোধ। বোঝার চেষ্টা কর। ও বলার হলেই কবে বলে দিত। বিষয়টা তেমন নয় যেমনটা তুই ভাবছিস।”
-“তাহলে কেমন?”
অভ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মুখটাকে বিকৃত করে গালি দিতে গিয়েও দিল না। গালি তো সে অনেকগুলোই জানে কিন্তু দিতে গেলে দিতে পারেনা। এটা ভালো গুণ। সে চোখ মুখের ছাপ আর দৃঢ় করে বলল,
-“সময়ের তালে তালে সব বুঝে যাবি। তোর উপর কোনো চাপ নেই। তবে আর কখনো তার সাথে খারাপ ব্যবহার করবিনা। এটা আসল পুরুষের কাজ নয়। নারীকা সম্মানের দৃষ্টিতে দেখাই হলো আসল পুরুষের কাজ।”

নির্ঝর চুপ হয়ে গেল। তবে ক্ষণিক বাদেই সে অভ্রকে একটা প্রশ্ন করে বসে,
-“আচ্ছা এহসান যে বলেছিল ও অন্য কাউকে পছন্দ করে সে কে? তারমানে নিদ্রা এদিক থেকেও ঠকে গেল। এহসান তো অন্যকাউকে ভালোবাসে। তাই না!”

ব্যাপারটা অভ্রও খেয়াল করেনি। আসলেই তো! নিদ্রা কী বাজে ভাবেই না ঠকে গেল। অভ্রর এখন নিজের উপরেই রাগ হচ্ছে। সে-ই নিদ্রার দূর্বলতার কারণ ছিল। যদি সে না থাকতো তবে নিদ্রাও দূর্বল হতো না। আঘাত পেত না আর বিয়েটাও করত না। ইশ! মেয়েটার কপালই খারাপ।

২৮.
নিদ্রা এহসানের সারা রুম ঘুরে ঘুরে দেখছে। সাজানো গোছানো রুমটাতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ আসবাবপত্র আছে যা তার কাজের সাথে জড়িত। লোকটা ওতপ্রোত ভাবেই প্রফেশনটার সাথে জড়িয়ে আছে দেখলেই বোঝা যায়। চেইঞ্জিং রুমের পাশেই আদেকটা দরজা আছে। নিদ্রা কখনো খুলে দেখেনি। আজ খুলে ভেতরে ঢুকেই গেল। ভেতরে ঢুকে সে অবাক। বিশাল এক জায়গা জুড়ে একটা লাইব্রেরী। কতগুলো তাক রয়েছে। নানান রকম বইয়ে ঠাসা হয়ে আছে তাক গুলো। কোন পাশে কোন জনরার বই তাও লিখে রাখা আছে। থ্রিলার/রহস্য আর বিদেশি লেখকদের নানান মোটিভেশনাল বইও আছে। অবাক করা কান্ড বিখ্যাত স্প্যানিশ, জাপানিজ বইও আছে। নিদ্রাও তো বইপ্রেমী। এক মুহুর্তের জন্য হিংসে হলো তার এহসানের প্রতি। তারও কালেকশন আছে। তবে এত বৃহৎ নয়। আধুনিক এই লাইব্রেরীটা নিদ্রাকে বশ করে ফেলেছে। সিঁড়িও আছে প্রত্যেকটা শেল্পের পাশে। মইও আছে একপাশে। আরও আছে, বড় এক টেবিল সাথে কিছু চেয়ার, দুইটা সোফা আর টি-টেবিল। সোফা গুলোতে আরামে শুয়েও বই পড়া যাবে। পাশেই বিশাল এক জানালা। কেবল কাঁচ টানা আছে। সাদা জর্জেটের পর্দা একপাশে গুটিয়ে রাখা। নিদ্রা কাঁচ সরিয়ে নিল। সাথে সাথেই শীতের বৈকেলের শীতল হাওয়া নিদ্রার সবুজ শিপনের শাড়ির আঁচলটা উড়িয়ে দিয়ে গেল সাথে তার কার্লি চুলগুলোও কি একটু হেলে গেল নাকি? মনে তো হয়! নিদ্রা অবাক হলো আরেকটা ব্যাপারে। তার কালেকশনের সব বইও এখানে আছে। তবে নিদ্রা বর্তমানে যেগুলো কালেক্ট করতে চেয়েছিল সেগুলো দেখে সে খুশিই হয়েছে। পড়তে পারবে এই ঢের। হ্যাঁ! সে এখন পড়বে। যেই বইটা ভালো লাগবে সেটাই পড়বে। নিদ্রা কোনো একটা নির্দিষ্ট বই নিতেই পারছেনা। একটা নিলে আরেকটা দিকে চোখ যায়। ব্যাকুল হয়ে যখন ফিরে আসবে তখন দেখে অদূরেই কোণাতে ছোট্ট একটি টেবিলের উপর পিসি আছে। আর ডেস্কটপ টার সাথেই একটা গাঢ় নীলবর্ণের বই দেখা যাচ্ছে। নিদ্রা সেদিকে এগিয়ে গেল। বইটা দূর থেকেই চৌম্বুকের মতোন টানছে। কাছে এসেই তার হার্টবিট মিস হতে গিয়েও হলো না। এত সুন্দর চমৎকার প্রচ্ছদের একটি বই। যার নাম বোধ হয় স্বর্ণাক্ষর লিখে রেখেছে। হাতে নিয়েই নিদ্রা কয়েকবার বিড়বিড়িয়ে বলল,
-“সিন্ধুর নীল!”
আরেকটু খেয়াল করে দেখল সিন্ধুর নীল লেখাটার নিচেই আরেকটি লেখা “ভালোবাসার প্রতীক! যা কল্পনা নয় বাস্তবে অবস্থিত কোথাও।”
নিদ্রার কী মনে হলো কে জানে! বইটা লুকিয়ে নিল নিজের আঁচলের ভাজে। এই বই সে পড়বে। যে করেই হোক! নামটাই তো কেমন টানছে তাকে। কী অবাক কান্ড!

২৯.
নিহারীকা আর মৃত্যুঞ্জয় আজ আবারও সেই জায়গাতে যাচ্ছে যেখানে আগেরবার ক্যামেরা ফিট করে এসেছিল। এবার তারা সেখানে ততক্ষণ থাকবে যতক্ষণ না কোনো ক্লু পাচ্ছে। মৃত্যুঞ্জয়ের লোকেরা চব্বিশঘন্টা পর্যবেক্ষণ করেও সন্দেহভাজন কিছু লক্ষ্য করতে পারেনি। তবে মৃত্যুঞ্জয়ের স্পষ্ট ধারণা ঐখানেই কিছ একটা আছে যা সিন্ধুর নীল পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারবে। নিহারীকাকে নিয়ে মৃত্যুঞ্জয় সংশয়ে আছে। কারণ নিহারীকার অভিজ্ঞতা নেই বললেই চলে। তবুও নিহারীকার সেই জায়গায় অনেক প্রয়োজন পড়বে। স্বার্থের জন্য হলেও নিতে হচ্ছে তাকে। তবে সে জানে এখন নিহারীকাকে সাথে না নিলেও সে ঠিকই তার পেছন পেছন যাবে। কারণ তার নিজেরও যে অনেক কিছুর উত্তর চাই। মৃত্যুঞ্জয় সব জানে তবুও কিছু জানাচ্ছেনা। কারণ একটাই। নিহারীকা এসব সইতে পারবেনা। তাই আগে তাকে শক্ত হতে হবে। বাহিরের শক্তভাবটা তো খোলস কেবল। আসলে তো নরম ভেতরটা। এবার ভেতরটাও শক্ত হতে হবে হীরার মতো। স্বর্ণের মতো নরম হলে চলবেনা।

#চলবে।
(রি-চিইক করিনি। ভুল ত্রুটি ধরিয়ে দিবেন।)
#বি:দ্র: আগামী পর্ব আমার আইডিতে পাবেন না। পাবেন আমার সদ্য খোলা পেজে। লাইক+ফলো দিয়ে সাথে থাকুন।

https://www.facebook.com/Inshiyah-Islam-ইনশিয়াহ্-ইসলাম-102321272375774/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here