সিন্ধুর_নীল (পর্ব-১৬) লেখনীতে–ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

#সিন্ধুর_নীল (পর্ব-১৬)
লেখনীতে–ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

২৫.
বাতাসে নিদ্রার কার্লি চুলগুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। সাথে সাথেই আঁচলটা পাল্লা দিয়ে উড়ছে। আর গুনগুনিয়ে নিদ্রা গান তো গেয়েই চলেছে। এই সব কিছুই চোখ বন্ধ করে উপভোগ করছে সে। ঐ বন্ধ চোখের পাতায় ভেসে উঠছে তার জীবনে ঘটা সেইসব ঘটনা। যা ছিল আকস্মিক এবং না চাওয়া। নিদ্রার সময়টা আজও বোধ হয় সেখানেই থমকে আছে, সেই সময়টাতেই থমকে আছে। অভ্রর আর তার শেষ বার যেই বাক্যলাপ হয়েছিল। নিদ্রার দু’চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে কেবল অভ্রর বলা সেই কথাটা মনে করলেই,
-“জোর করে তো আর ভালোবাসা হয়না!”

নিদ্রা ভাবে আর শত ভেবেও উত্তর পায়না। কেন জোর করে ভালোবাসা হয়না? এই যে তার জীবনে এত কিছু হয়ে গেছে সে কি তা চেয়েছে? তবুও হয়েছে তো! জোর করেই তো কেউ কেউ তার থেকে তার মূল্যবান কিছু কেড়ে নিয়েছে।

নিচে ড্রয়িংরুমে সবাই বসে গল্প করছে। নিদ্রা যেতেই অনিতা বলল,
-“এত দেরি করলে যে নিদ্রা! আমরা সেই কখন থেকে তোমার অপেক্ষায় বসে আছি। আসো এখানে বসে চা খাও। শুনেছি দুধ চা তোমার প্রিয়। আমার আম্মা খুব ভালো বানায় চা। তোমার জন্য আজ আরও স্পেশাল করে বানিয়েছে।”

নিদ্রা মুঁচকি হেসে এহসানের মায়ের দিকে তাঁকায়। উনি ফ্যামিলি লিভিংয়ের ঐদিকেই হেঁটে যাচ্ছে। নিদ্রার শুরুতে তাদের প্রতি রাগ থাকলেও এখন আর নেই। মানুষ গুলো অসাধারণ। তাদের মন মানসিকতাও সুন্দর। তবে এহসানকেই তার ভালো লাগেনা। হোক না সে সুদর্শন! তাতে কী? নিদ্রার তো একদমই সেই সুন্দর মানুষটাকে ভালো লাগেনা। একটুও না!

সবাই যখন গল্প গুজবে মশগুল তখনই মোবাইলে ব্যস্ত থাকা পৃথিলা ফট করে দাঁড়িয়ে টিভি চালু করে দেয়। খবরের চ্যানেলে আসতেই সবাই ভ্রু কুঁচকে নেয়। পৃথিলা দেখবে নিউজ? ভাবা যায়! সবাই হাসতে গিয়েও হাসতে পারেনি। কারণ খবরে দেখাচ্ছে আজ সকালে দ্য গ্ল্যামারাস্ শপিং মলের চতুর্থ তলায় মেয়েদের ওয়াশরুম থেকে একটি লাশ উদ্ধার হয়। দুপুর দেড়টায় এই ঘটনা ঘটে আনুমানিক। তবে লাশটা পাওয়া যায় কিছুক্ষণ আগেই। লাশটি লুকিয়ে রাখার কারণে কেউ দেখেনি। তবে পরিচ্ছন্নকর্মীরা যখন সাফ সাফাই করতে যায় তখন বেসিনের পেছনের দিকের দেয়ালের পাশেই লাশটি দেখতে পায়। অবাক করা কান্ড হলো লাশটি একজন পুরুষের। মহিলাদের ওয়াশরুমে সে কখন কীভাবে যায় সেইসব তল্লাশি করতে সিসিটিভি ফুটেজ চেক করা হয়। তখনিই দেখে দেড়টার দিকে এই লোক একটি লং কোর্ট পড়া মহিলার পেছন পেছন হেঁটে যাচ্ছিলেন। তারপর মহিলাটি বের হয়ে আসলেও তিনি আর আসেননি। অর্থাৎ সেইসময়ে লোকটি খুন হয়। সবাই ধারণা করছে মহিলাটি তাকে খুন করেছে। তবে এখানে মহিলাটির চেহারা কিছুই বোঝা যায়নি। লাশটির সারা শরীরে এবং পুরো ওয়াশরুমে কোথাও কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি যার মাধ্যমে খুনীকে ধরা যাবে। এই ঘটনায় সারা শপিং মলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। এবং অনির্দিষ্ট কালের জন্য তা বন্ধ ঘোষণা করা হচ্ছে। পূর্ণ সুরক্ষা নিয়েই পুনরায় খোলা হবে এটি। তবে এই ঘটনার জন্য কতৃপক্ষকে পুলিশের কাছে জবাবদিহি করতে হবে।
এমন সংবাদ দেখে সবারই চক্ষু চড়কগাছে ওঠে। অনিতার হাতে থাকা বিস্কুটটা তো সেই কখনই চায়ের কাপে ডুবে গেছে। নিদ্রাও বিস্ময় নিয়ে তাঁকিয়ে আছে। পৃথিলা একপ্রকার চেঁচিয়ে বলে ওঠে,
-“এই অনি আপু! দেখলে কি কান্ড? আমরা তো আজকে সেই মলেই গিয়েছিলাম। এই নিদ্রা তুইও তো ঐরকম সময়ে ওয়াশরুমে গিয়েছিলি। ফোর্থ ফ্লোরেই তো আমরা ছিলাম তাই না! ইয়া আল্লাহ্! যদি তোর কিছু হয়ে যেত?”

এমন প্রশ্নে নিদ্রার চোখ মুখের ভাব বদলে যায়। ঘামতে থাকে। সবাই বোঝে নিদ্রা ভয় পেয়েছে। এহসানের মাও ততক্ষণে এদিকে ছুটে এসেছেন। নিদ্রাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
-“ভয় পাচ্ছিস কেন? তোর কিছুই হয়নি তুই ঠিক আছিস। আলহামদুলিল্লাহ্! অনেক বড় বিপদ থেকে বেঁচে গেলি।”

নিদ্রা এহসানের মায়ের দিকে তাঁকায়। তার চোখে মুখে নিদ্রার জন্য কত স্নেহ আর ভালোবাসা রয়েছে। নিদ্রার মুহুর্তেই সব অস্থিরতা দূর হয়ে যায়। মনে হয় এই তো তার মা তার পাশেই আছে।

২৬.
রাতে এহসান আসলে পৃথিলা গড়গড় করে সব বলে দিল। এহসান জানায় সেও অফিসে দেখেছিল নিউজটা। নিদ্রার কথা তখন তার মাথাতেও এসেছিল। যাক নিদ্রা সুরক্ষিত আছে সেটাই যথেষ্ট। রুমে ঢুকেই দেখে নিদ্রা ডিভাইনে শুয়ে আছে। তার দৃষ্টি বেডের পেছনে এহসানের ছবিটার দিকে। এহসান নিদ্রার সামনে গিয়ে দাঁড়ালে নিদ্রা কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। শোয়া থেকে উঠে বসে। রুম থেকে বের হয়ে আসতে নিলেই এহসান বলল,
-“নিদ্রা তুমি কি ভয় পাচ্ছো?”

নিদ্রা শক্ত গলায় জবাব দিল,
-“না। আমার ভয় পাওয়ার কি আছে?”
এহসান কিছুটা রেগে গেল। ঝাঁঝালো গলায় বলল,
-“হ্যাঁ তোমার তো ভয় ডর নেই। তুমি তো নিজেই একটা সিরিয়াল কিলার। তোমার এসবে ভয় হয় নাকি?”

এমন কথা শুনে নিদ্রা থতমত খেয়ে যায়। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
-“কি উল্টা পাল্টা কথা বলছেন? আমি সিরিয়াল কিলার হতে যাব কেন? আশ্চর্য! আমি কাকে খুন করেছি?”
-“আমাকে!”

নিদ্রা একপ্রকার চেঁচিয়ে বলল,
-“আপনাকে খুন করলাম কখন? এই তো চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। একদম সুস্থ্য!”
-“বাহিরটা দেখলে ভেতরটা তো দেখলে না। ক্ষত বিক্ষত করে রেখেছ সব।”
এহসান কাবার্ড থেকে টি-শার্ট আর ট্রাউজার নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। নিদ্রা ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। লোকটার কথা বার্তা শুনে সে কখন হার্ট ফেইল করে বসে! এসব কেমন কথা বার্তা? নিদ্রার মনে ভয় জন্মায়। সিরিয়াল কিলার? তাও সে! যত্তসব অবান্তর কথা।

—————————-
-“আজকের খুন হওয়া খবরটা দেখেছেন?”

নিহারীকা চোখ মুখ কুঁচকে বলল,
-“দেখে ফেলেছি তবে আর দেখতে বা শুনতে চাইনা। এসব খুন খারাবির কথা আমার একদম সহ্য হয়না। মানুষ মানুষকে কীভাবে মেরে ফেলে! ভাবা যায়?”

মৃত্যুঞ্জয় হেসে বলল,
-“ভাবা যায় না কেন? মানুষ মানুষকে জন্ম দিতে পারলে মারতে পারবে না কেন?”
-“যে জন্ম দেয় সে মারবে? আদৌ সম্ভব!”

মৃত্যুঞ্জয় মৃদু হেসে বলল,
-“সম্ভব তো! আমার দাদার দাদাকে তার মা বিষ খাইয়ে মেরেছিল। কারণ কী জানেন?”
নিহারীকা আৎকে উঠে বলল,
-“কী কারণ?”
-“সে কেবল এক সাঁপুড়ের মেয়েকে বিয়ে করেছিল বলে। অবশ্য তিনি আমার দাদার আপন দাদী না। তিনি হলেন ছোটজন। মানে আমার দাদার দাদা শাহনেওয়াজ সরকারের দ্বিতীয় স্ত্রী ছিলেন সেই সাঁপুড়ে কন্যা সিন্ধু।”
নিহারীকা অবাক হয়ে বলল,
-“শাহনেওয়াজ সরকার আত্মহত্যা করেনি?”
মৃত্যুঞ্জয় আবারও হেসে বলল,
-“সেটা তো ছঁড়ানো কথা। মিথ্যে আর বানোয়াট গল্প। সত্য তো মাশহুদা বেগম নিজেই তার জ্যেষ্ঠপুত্র শাহনেওয়াজকে হত্যা করেছিলেন। এই ঘটনা এতদিন আমি জানতাম আর এখন তুমি জানলে। আর কোনো জীবিত মানুষই এই ঘটনা জানেনা।”
-“আপনি জানলেন কীভাবে?”
-“আমার দাদা রশিদউল্লাহ সরকার আমাকে একটি বই দিয়েছিল। বই বললে ভুল হবে ডায়েরী সেটা। আমার দাদা সেই ডায়েরীটা নিয়েছিল তার দাদী সুগন্ধ্যা বেগমের থেকে। মানে শাহনেওয়াজ সরকারের প্রথম স্ত্রীর থেকে। তার অভ্যাস ছিল তার সাথে ঘটা সব ঘটনা লিখে ফেলার। বিয়ের পরে সে ঐ ডায়েরীটা লিখে। তার বিয়ে থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ঘটা সব বিশেষ কাহিনি সে লিখে রেখেছেন সেইখানে। মরার আগে ডায়েরীটা তার একমাত্র নাতিকে সে দিয়ে যায়। এবং এটা জানায় তার মৃত্যুর পর যেন তার ধারণামতে সবচেয়ে যোগ্য বংশধর এই ডায়েরী পায় এবং ততক্ষণ অক্ষত রাখে যতক্ষণ না জমিদার শাহনেওয়াজের সেই বিশেষ গুপ্তধন না পায়। আমার দাদা তার মৃত্যুর অনেক আগেই অর্থাৎ আমার আঠারো তম জন্মদিনেই আমাকে ডায়েরীটা দেয়। তাও খুব গোপনে এবং দিয়ে বলেছিল গুপ্তধনটা উদ্ধার করবে দাদাভাই। আমি হেসে বলেছিলাম কী গুপ্তধন? দাদা কেবল বলেছে তোমার বয়স পঁচিশে যেদিন যাবে সেদিন তুমি এই বইটি পুরোটা পড়বে। খুব মন দিয়ে পড়বে। এটা আমার পূর্বপুরুষদের নিয়ে লেখা। আমি কী করেছিলাম জানেন? আমি সেদিন রাতেই বইটা পড়েছিলাম। সারারাত জেগে পড়েছিলাম। আর পড়ার পর দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই আমি। ঐ গুপ্তধন আমি উদ্ধার করবই। তাই তো এই প্রফেশনের সাথে জড়িয়ে পড়ি। তবে দাদা কখনোই জানতে পারলেন না আমি পঁচিশের জন্য আর অপেক্ষা করিনি। একটা কথা মানতেই হয়! সুগন্ধা বেগমের হাতের লেখা অসাধারণ। লেখায় একটা চমৎকার ব্যাপার আছে। মনে হয় সব চোখের সামনে ঘটছে।”
নিহারীকা কাঁচুমাচু হয়ে বলল,
-“আমি ভাবতাম আপনি হিন্দু।”
মৃত্যুঞ্জয় হেসে বলল,
-“অনেকেই মনে করে প্রথমে।”
-“একটা কথা বলবেন?”
-“কী?”
-“গুপ্তধনটা আসলে কীসের?”
-“গুপ্তধনটা জমিদার শাহনেওয়াজের প্রেমের প্রতীক।”
-“প্রেমের প্রতীক!”
-“হ্যাঁ।”
-“নাম টাম নেই?”
-“আছে তো! এমন একটি নাম যা শুনলেই তোমার হৃদয়ে একটা ভালোলাগার স্রোত বয়ে যাবে।”
-“তাই না কি? তাহলে বলুন তো শুনে দেখি কেমন লাগে।”

মৃত্যুঞ্জয় কিছুক্ষণ চুপ থেকে পুনরায় মৃদু হেসে বলল,
-“সিন্ধুর নীল! সেই দামী এবং ভালোবাসার প্রতীকটি হলো সিন্ধুর নীল।”

নামটা শুনেই সত্যিই নিহারীকার সারা শরীর কেমন ছনছন করে উঠে। নামটা কানে আসতেই অন্যরকম অনুভূতি অনুভব করে সে। ভালোবাসার প্রতীক! সিন্ধুর নীল!

#চলবে।
(গঠন মূলক মন্তব্য আশা করছি।
আপনারা জানাচ্ছেন না কেন? কেমন লাগছে!)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here