সিন্ধুর_নীল (পর্ব-১৫) লেখনীতে–ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

#সিন্ধুর_নীল (পর্ব-১৫)
লেখনীতে–ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

২৩.
-“আপনাকে আমার খুব একটা পছন্দ না নির্ঝর।”
নির্ঝর আকস্মিক নারী কন্ঠে এমন কথা শুনে চমকে যায়। পাশেই নিহরীকাকে দেখে বিরক্তিতে নাক-মুখ কুঁচকে নেয়। গলার স্বর উঁচু করে স্পষ্ট করে বলল,
-“আমাকে আপনার পছন্দ হতে হবেই বা কেন? আর আপনি এখানে কী করছেন? পিছু নিচ্ছেন!””
-“হুম নিচ্ছি। কোনো সমস্যা আছে?”
-“কী! সমস্যা থাকবেনা? আপনি আমার পিছু নিবেন আর তাতে আমার সমস্যা থাকবেনা? এসব আজগুবি কথা বলেন কীভাবে!”
-“মুখ দিয়ে বলি।”

নির্ঝর নিহারীকার দিকে আঙুল তুলে বলল,
-“আপনি জানেন আপনি একটা অসভ্য আর নির্লজ্জ মেয়ে!”
-“এইতো এখন জেনে নিলাম। জানানোর জন্য ধন্যবাদ।”

নির্ঝরের নিহারীকার সাথে কথা বলতেই ইচ্ছা করছেনা। সে ভেবে পায়না নিহারীকা যেচে কেন আসছে কথা বলতে? সে নিহারীকার দিকে কটমটে দৃষ্টিতে চেয়ে বিড়বিড়িয়ে বলল,
-“ফালতু!”

এটা বলেই বড় বড় পা ফেলে চলে গেল হোটেলের দিকে। নিহারীকা এই ছোট্ট অথচ কটু শব্দটি নিতে পারলো না। চোখ বেয়ে দু’ফোঁটা নোনাজল গড়িয়ে পড়ে তপ্ত গালে। এই এত কথা যে সে শুনছে আদৌ কী সে সেসব শোনার মতো কিছু করেছে? সব দোষও কী শুধুই তার! যারা তার সুন্দর হেসে, খেলে কাটানো জীবনটা ছিনিয়ে নিয়েছে তাদের কি কোনো দোষই নেই? কোনো দায় নেই!

হঠাৎ করেই একটি শ্যাম বর্ণের বলিষ্ঠ হাত তার দিকে বাড়িয়ে দিল টিস্যু পেপার। নিহারীকা সেই মানবের দিকে তাঁকিয়ে রয় এক বুক বিস্ময় নিয়ে। অভ্র নিহরীকার চমকে যাওয়াতে কিছুটা বিব্রতবোধ করে। তা কাটাতেই মুঁচকি হেসে বলল,
-“নির্ঝর একটু রাগী মানুষ। তার এই হুট হাট রাগের কারণেই কখন, কোথায়, কাকে কী বলতে হবে তা সে প্রায়সময় বুঝে উঠতে পারেনা। আপনি প্লিজ ওর কথায় মনে কষ্ট নিবেন না।”

নিহারীকা মৃদু হাসে। অভ্রর হাত থেকে টিস্যু পেপারটা নিয়েই তার দিকে ছুঁড়ে দেয় একটি প্রশ্ন,
-“আপনার আমার উপর রাগ হচ্ছেনা?”
-“কেন বলুন তো?”
-“কেন মানে! রাগ হবেনা? এই যে আমি বি..

নিহারীকার কথার মাঝেই অভ্র বলল,
-“আপনি যা করেছেন তা কেন করেছেন আমি জানিনা। তবে আপনার কাছে কাজটি সঠিক হয়ে থাকলেও মূলত পদ্ধতি ছিল ভুল। আর তাছাড়া বিয়ে একটি মানুষের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। আর আপনার অধিকার আছে নিজের পছন্দের ব্যক্তিতে বিয়ে করার আর অপছন্দের ব্যক্তিকে না করার। এটা সম্পূর্ণ আপনার হাতেই। আমি বা আমরা তা বিচার করতে পারিনা। তবে আপনার শুরুতেই মানা করে দেওয়া উচিত ছিল। হয়তো ফ্যামিলি প্রেশার! থাকেই এমন। তবে এহসানকে বলতে পারতেন। সে কিন্তু আপনাকে জোর করতো না। তবে আমি পুরোপুরি শিউর না হলেও এটা আন্দাজ করে বলতে পারি যে আপনার বিয়ে ভাঙার পেছনে এই কারণটি নেই। এতক্ষণ এগুলো বলছিলাম কারণ এমনটা থাকতে পারে এই ভেবে। আর নির্ঝরের ভাবনাও আমার মাথায় কিছুটা খেলে গেছে। তাই আমার মনে হয়েছে। তবে আমি বোধ হয় আসল কারণ জানি।”

নিহারীকা পুনরায় চমকালো। অভ্র পাশেই পেতে রাখা চেয়ারে বসে পড়ে। ইশারায় নিহারীকার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল,
-“বসুন।”
নিহারীকাও বসে পড়ে। অভ্র পুনরায় বলা শুরু করল,
-“সেদিন আপনি আমাদের কথো-পকথন শুনেছিলেন তাই না?”
-“হ্যাঁ।”
-“এহসান কাউকে পছন্দ করে এটা শুনে আপনি আর বিয়েটা করতে চান নি তাই তো?”
-“বলতে পারেন। প্রথমে আমার মত ছিল না পরবর্তীতে এহসানের ব্যক্তিত্বর সাথে পরিচয় হওয়ার পর মনে হলো লোকটা ভালো, বিয়েটা করলে আমার আহামরি কোনো ক্ষতি হয়ে যাবেনা। বরং সুন্দর চিন্তা ধারার এক মানুষের সংস্পর্শে থাকতে পারব। তার প্রতি আমার ভালো লাগা বা ভালোবাসা কিছুই ছিল না। ছিল শুধুই মুগ্ধতা। তাও আবার তার আচার-আচরণ, চাল-চলন এর উপর। সে সুদর্শন ঠিকই তবে আমি তার প্রেমে পড়িনি। ভাবলাম বিয়ের পর সব কিছু হয়তো গড়ে উঠবে। যাক! রাজি হয়ে গেলাম। আয়োজন শুরু হলো আর হঠাৎ করেই জানতে পারলাম তার মনে অন্য নারীর বসবাস। তখন মনে হলো আমি একটা অন্যায় করতে যাচ্ছি। বিয়েটা হয়তো দুজনেই করে নিতাম তবে কেউ কাউকে ভালোবাসতে পারতাম না। দুই বছর পর দেখা গেল ডিভোর্সের মতো কিছুর সম্মুখীন হতে হবে। আর আমি কখনোই ডিভোর্সের পক্ষে নেই। বোঝাপড়া থাকবে কিন্তু ভালোবাসা থাকবেনা এমন সম্পর্কও আমি নিতে পারব না। তাই এর থেকে ভালো অপশন আমি পাই নি। আর আমি পালিয়ে যাইনি। এহসানের বাবাকে কল করে বিয়ে ভেঙে দেওয়ার কথা জানিয়েছি। আমি কোথায় সেটাও তাকে জানিয়েছিলাম। তাহলে এটা নিশ্চয়ই পালিয়ে যাওয়া নয়!”
-“আমি তো পালিয়ে যাওয়ার কথা বলিনি।”
-“আপনি বলেননি কিন্তু অনেকেই বলছে। প্রথম প্রথম খারাপ না লাগলেও এখন কেন যেন খুব খারাপ লাগছে। আমার খুব পছন্দের এক ব্যক্তিও এমনটা ভাবছেন।”
-“কে সেই ব্যক্তি? জানতে পারি!”
-“এখন নয় পরে জানাবো। তা আপনারা এখানে?”
-“ছুটি এখনো বাকি আছে তাই ভাবলাম ভালো ভাবে তা কাটিয়ে নেই।”
-“সাউন্ডস্ নাইস। তো আগে এসেছিলেন এখানে?”
-“দুইবার এসেছিলাম। প্রথমবার পরিবার নিয়ে যখন ক্লাস নাইনে ছিলাম। আর পরেরবার এসেছিল বন্ধুরা মিলে ভার্সিটি থেকেই। এহসান আর অভ্রদের ভার্সিটির কিছু ফ্রেন্ড ট্রিপটা প্ল্যান করেছিল। আমি তখন মেডিকেলের চাপে অতিষ্ট হয়ে উঠেছিলাম। তখন ছিল কোন একটা উৎসব উপলক্ষে বন্ধ। মাত্র তিনটা দিন হাতে ছিল। আমরা তিনজন বেস্টফ্রেন্ড কখনোই কাউকে ছেড়ে একা কোনো ট্রিপে যাইনা। শুধু ফ্যামিলি গেট টুগেদারেই আর কী একসাথ হই না তেমন একটা। কিন্তু কোনো বন্ধুর বাড়ি যাওয়া থেকে শুরু করে তাদের ঘিরে যত দাওয়াত আর ট্যুর সব আমাদের একসাথেই হয়। তো আমাকেও সেদিন ওরা নিজেদের খরচে নিয়ে নিল। আসলে হঠাৎ প্ল্যান ছিল আর আমারও হাতে তখন পর্যাপ্ত টাকা ছিল না। সেই তিনদিন আমার জন্য কি ছিল আমি এখনও বুঝে উঠতে পারিনা। ফিরে এসে নতুন উদ্দমে পড়ালেখা শুরু করলাম। আর পরের বছরই আমার স্বপ্ন পূরণ হলো। তারপর আমি ইন্টার্নি করেই ডাক্তারের মর্যাদাটা পেলাম। দিন গুলো হয়তো কষ্টের ছিল তবে কিছুক্ষণের চকমকে স্মৃতিটাও অনেক প্রেরণা যুগিয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা জীবনে প্রথমবার আমি বাবা-মায়ের ইচ্ছাকে নয় নিজের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়েছিলাম। আমি এটা বলছিনা যে বাবা-মায়ের কথা শুনলে খারাপ হয়। আমি এটা বোঝাতে চাইছি মাঝে মাঝে নিজের ইচ্ছার দাম দিতে হবে যদি তা সকলের জন্য কল্যাণকর হয়ে থাকে। আমরা নিজেরাই যদি নিজের জন্য না ভাবি তাহলে অন্যকেউ আর কী করে ভাববে? এখানে স্বার্থপর হতে বলছিনা এখানে নিজেকে ভালোবাসতে বলছি। নিজেকে একটু দাম দিলেই সব কিছু ঠিক থাকবে। আল্লাহ্ তাদের ভালোবাসেন যারা নিজেকে ভালোবাসে। নিজেকে ভালোবাসাটা অপরাধ নয়। স্বার্থপরতাও নয়। এটা একটা বিশেষ গুণ কারণ যে নিজেকে ভালোবাসে মানে সে একটি মানুষকে ভালোবাসে। আর যে একটি মানুষকে ভালোবাসে সে অনেক মানুষকেও ভালোবাসতে পারার ক্ষমতা রাখে।”

নিহারীকার ঠোঁটে হাসি ফুটে ওঠে। অভ্রর দিকে তাঁকিয়ে ঝরঝরা এক হাসি দিয়ে বলল,
-“চমৎকার! আপনি খুব সুন্দর করে কথা বলেন।”
অভ্র বিরোধিতা করে বলল,
-“আমি চমৎকার কথা বলতে পারিনা। বক্তার বক্তব্য তখনিই সুন্দর এবং চমৎকার হয় যখন শ্রোতা একজন সুন্দর আর ভালো মনের অধিকারী হয়ে থাকে। অসাধারণ হয়ে থাকে!”

নিহারীকার মনটা শান্তিতে ভরে উঠল। চোখে মুখে একরাশ কৃতজ্ঞতা নিয়ে তাঁকায় অভ্রর দিকে। অভ্র বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে বলল,
-“আপনাকে পুনরায় দেখে আমার খুব ভালো লাগলো। আশা করি আবার দেখা হবে।”
নিহারীকাও আলতো স্বরে বলল,
-“ইন শা আল্লাহ্!”

অভ্র চলে যাওয়ার পরই নিহারীকার ফোনে মৃত্যঞ্জয়ের কল আসে। নিহারীকা কল রিসিভ করতেই অপরপাশ থেকে মৃত্যুঞ্জয় বলল,
-“তুমি কোথায়? বলেছিলাম না আমি বিল দিব! আর তুমি বিল পে করে এমন দৌঁড়ে বের হয়ে গেলে কেন? কোথায় আছো হ্যাঁ!”

নিহারীকা দুষ্টুমির সুরে মৃত্যুঞ্জয়কে বলল,
-“আপনি এত কেন না খুঁজে আগে এটা ভাবুন আমাকে আপনি করে বলবেন নাকি তুমি! আপনার এসব আপনি আর তুমিতে আমি প্রচন্ড বিরক্ত।”
ওপাশ থেকে আর কোনো কথা ভেসে এলো না। স্তব্ধ হয়ে বসে আছে বোধহয়। কিছুক্ষণ পরই তার জবাব এলো এটা,
-“আপনাকে আমি আপনি করে বলব নাকি তুমি তা সম্পূর্ণ আমার মুডের উপর নির্ভর করে। বুঝলেন!”

নিহারীকা কলটা কেটে দিল। হুহ! আপনি, তুমি নাকি মুডের উপর নির্ভর করে? যত্তসব!

২৪.
নিদ্রার সামনে অনেকগুলো লেহেঙ্গা মেলে রাখা হয়েছে। তার যেটা পছন্দ হবে সেটাই রিসিপশনে পড়া হবে। নিদ্রার বিন্দু মাত্র আগ্রহ নেই। তবুও এত মানুষের সামনে তা প্রকাশ করতে পারছেনা। মানুষগুলোর চোখে-মুখে ভেসে ওঠা আনন্দটা নষ্ট করার সাহস পাচ্ছে না সে। শপের মহিলা গুলো কিছুক্ষণ পরপরই “ম্যাম এটা আমাদের বেস্ট কালেকশন” বলে বলে চেঁচাচ্ছে। নিদ্রার বিরক্ত তাতে আরো বাড়ে। সব কিছুই তো বেস্ট তাহলে আর এত বাছাই করার কি আছে একটাই দিয়ে দে না। না! তারা তো ব্যবসা করছে। সবকিছু সুন্দর আর বেস্ট বলে একটার বদলে তিন চারটা কেনাতে চাইছে। বোকা পৃথিলা আর অনিতাও তাই কোনো একটা নির্দিষ্ট করতে পারছেনা। মহিলা যতগুলো বেস্ট বের করছে তারা ততগুলোই চয়েজ করে নিচ্ছে। নিদ্রা কী এখন এই সব গুলোই একসাথে পড়বে? অদ্ভুত!

একটা ল্যাভেন্ডার আর সিল্ভার কালারের সংমিশ্রণের লেহেঙ্গা যখন মহিলা বের করে তখনিই নিদ্রার পাশে সোফায় বসে থাকা এহসান বলল,
-“এটা ঠিক আছে।”
নিদ্রা এতক্ষণ খেয়াল করেনি এহসানের কথা শুনে তাঁকাতেই দেখে আসলেই অত্যন্ত সুন্দর লেহেঙ্গাটা। পৃথিলা তো হেসে বলল,
-“বাহ! ভাইয়ার পছন্দ আছে বলতে হয়। আসলেই এটা সুন্দর। নিদ্রা ট্রায়াল দে তো। নে ধর!”

পৃথিলা জোর করে নিদ্রাকে ট্রায়াল রুমে পাঠিয়ে দিল। নিদ্রাও মনে মনে একটু ট্রায়াল দেওয়ার চিন্তা করছিল তাই আর তেমন একটা মানা করেনি।
কিছুক্ষণ পর নিদ্রা যখন লেহেঙ্গাটা পরে সামনে এলো তখন এহসানের বুক কাঁপতে থাকে। পৃথিলা বলল,
-“লেহেঙ্গাটায় তোকে খুব মানিয়েছে। অনেক সুন্দর লাগছে তো লেহেঙ্গাটাতে।”
এহসান বিড়বিড়িয়ে বলে,
-“নিদ্রাকে লেহেঙ্গাতে সুন্দর লাগেনি বরং লেহেঙ্গাকে এত সুন্দর লাগছে কেবল নিদ্রার অঙ্গে জড়িয়ে। লেহেঙ্গাটাই ধন্য হয়েছে নিদ্রার শরীরে বসতে পেরে।”

নিদ্রা হঠাৎ করেই এহসানের দিকে তাঁকায়। হয়তো জানতে চাইছে কেমন লাগছে। কিন্তু এহসান এমন ভাবে তাকে পাশ কাটিয়ে পেছনের দিকে চলে গেল যেন সে দেখেইনি নিদ্রাকে। নিদ্রা অজানা কারণে খুব আহত হলো। পৃথিলাকে বলল,
-“আমার ভালো লাগেনি। অন্য আরেকটা দেখ।”

পৃথিলা কিছু বলবে তার আগেই এহসান আদেশের সুরে বলল,
-“পৃথি? আর একটু দেরি করিস যদি তো খবর আছে। এমনিতেও দুইঘন্টা ধরে বসে আছি শুধু শুধু। আর পারব না। এখন যেটা হয়েছে সেটাই নিয়ে নে।”

নিদ্রার এত রাগ হলো! কিন্তু কিছু বলল না। চুপটি করে সব কিছু সয়ে নেয়। একদিন তারও সুযোগ হবে তখন সে এহসানকে বোঝাবে সে কী জিনিস।

#চলবে!
(রি-চেইক করা হয়নি তেমন। তাই ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here