সিন্ধু ইগল – (৭)

সিন্ধু ইগল – (৭)
ইসরাত জাহান দ্যুতি

১৭
বেশ যত্ন নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে জায়িন তার ফর্সা মুখ, গলা, হাত আর পাদু’টো মেকআপে ঢেকে মেঘবর্ণ বানিয়ে নিলো। তারপর সাদা শার্টটা প্যান্টের মাঝে ইন করে শার্টের হাতা কনুই অবধি গুটিয়ে নিয়ে আয়নার সামনে থেকে ওয়ালেট আর হাতঘড়িটা নিয়ে এগিয়ে এল জানালার কাছে। যেখান থেকে জাদু আর মাধুর বাংলোটা দেখা যায়।

আকাশের রংটা কেমন লালচে মেঘে পরিপূর্ণ। প্রায় ডুবুডুবু সূর্যটাকে ধীরে ধীরে চূড়ান্তভাবে অস্তমিত যেতে দেখল সে অনিমেষ চোখে। আজ সারাটা দিন আবহাওয়াটা খুব একটা ভালো ছিল না হয়তো। জায়িনের দক্ষ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিজোড়া আকাশটাকে দেখে বুঝে নিলো, বৃষ্টি নামবে যে-কোনো মুহূর্তে। তবু তাকে আজ ঢাকা পৌঁছতেই হবে। কাওরান বাজার ডিআইটি মার্কেটে বোমা হামলা হয়েছে। অবস্থা ভয়াবহ। খবর এসেছে এটা টেরোরিস্ট দলেরই একটি পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত। আবার একটু আগে জায়িনকে জানানো হয়েছে, হঠাৎ কিছু জায়গায় আগুনও লেগে গেছে নাকি। আজ রাতের মধ্যে এই অবস্থা নিয়ন্ত্রণের মাঝে না আনলে অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়বে ধীরে ধীরে। ওই এলাকার সকল বাসিন্দাকে আপাতত নিরাপদে সরে যেতে বলার হুকুম জারি করেছে আইনী প্রশাসক।

মেজাজ পুরোদমে ঘেটে আছে জায়িনের। বাইরে থেকে একটা টেরোরিস্ট চক্র এসে এভাবে হামলা করা শুরু করেছে, এটা সে একেবারেই সহ্য করতে পারছে না৷ তার ভাবনাটা অনেকটা এমন, ‘আমারই ঘরে এসে আমাকেই চড় মারা!’ তবে খুব বেশিদিন এই চক্রটা লাফালাফি করতে পারবে না বলে জায়িনের বিশ্বাস। সেভাবেই কাজ শুরু করতে যাচ্ছে সে আজ থেকে। তবে মেজাজ খারাপ ভাবটা তার কেটে যেত, যদি জাদুর থেকে সারাদিনে একটা কল বা ভয়েজ মেসেজ আসত তার কাছে। সেই যে ভোরে একটুখানি কথা বলতে পেরেছিল, আর কোনো খবর পায়নি জাদুর। আজ অবধি এত বেশি আত্মনিয়ন্ত্রণ, বাকসংযম কিংবা গাম্ভীর্য ধরে চলেনি কোনো মেয়ে তার সঙ্গে। আর এটা জায়িনের পছন্দও নয়, তার ওপর যদি আরও অতি আকাঙ্ক্ষিত বিষয় হয় তা। স্বেচ্ছায় তার চক্ষুদৃষ্টির সামনে এসে লক্ষ্যকেন্দ্র হয়ে দাঁড়ালে সে তো শিকার না করে ছেড়ে দেবে না কোনোভাবেই। বরং তাকে করা আজকের এই অবজ্ঞা, অযত্নের জন্য জাদুকে ভবিষ্যতে দারুণ মাশুল দিতে হবে যে।

জানালাটা বন্ধ করতে করতে জায়িন একবার তাকাল বাংলোর লনের দিকে। সেখানে কোনো মানবী নেই। সেদিকে চেয়ে মৃদুস্বরে স্বগতোক্তি করে উঠল জায়িন, ‘ধরা যখন দিয়েছ, মরতে তো হবেই তোমাকে।’

রেজাকে কল করে গাড়িতে গিয়ে বসতে বলে জায়িন ক্লজেটের ক্যাবিনেট থেকে কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে বেরিয়ে এল। ঘরের মূল ফটক ছেড়ে বাড়ির মূল ফটকে পৌঁছনোর আগেই চলা থেমে গেল তার। বাগানের লেবুগাছ থেকে খুব সাবধানে সাবধানে লেবু ছিঁড়ছে জাদু তার মায়ের সঙ্গে৷ লেবু ছেঁড়ার ফাঁকেই জাদুর নজর পড়ল দাঁড়িয়ে থাকা জায়িনের দিকে। যে তার দিকেই গম্ভীর অভিব্যক্তিতে চেয়ে আছে। জান্নাতি বেগমের থেকে অনুমতি নিয়ে জায়িনের কাছে এল সে। সামনে এসে দাঁড়াতেই মুচকি হেসে জায়িনকে বলল, ‘কতক্ষণ ঘুমালেন বলুন তো? সেই যে ভোর সাড়ে পাঁচটায় ঘুমিয়েছিলেন, আর ঘুম ছেড়েছে নিশ্চয়ই বিকাল সাড়ে পাঁচটায়?’

কতক্ষণ নীরব থেকে গম্ভীর অভিব্যক্তি নিয়েই জাদুর মুচকি হাসিতে মেতে থাকা ঠোঁটের দিকে নিষ্পলক চেয়ে থাকল জায়িন। তারপর হঠাৎ করেই তার চটে যাওয়া মেজাজ ধীরে ধীরে আরও বিশ্রী হয়ে উঠল। ভার কণ্ঠে জবাব দিলো, ‘চারটায়।’

জাদুর হাসিটা এবার থামল, জায়িনের তীক্ষ্ণ চাউনি দেখে। আর তার কণ্ঠ শুনে। কিছুটা অপ্রস্তুত স্বরে জিজ্ঞেস করল জাদু, ‘রেগে আছেন বুঝি?’
-‘হুঁ, তবে আপনার ওপর নয়।’ কথাটা বলল জায়িন স্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করেই।
জাদু একটু আমতা আমতা করে এবার বলল, ‘আমার ওপরেও রেগে আছেন। এই যে আপনি সম্বোধন করছেন আবার আগের মতো।’
-‘অপ্রিয় এবং আপনজন নয় এমন ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে তুমিটা কখনোই আসে না। তুই কিংবা আপনি বহাল থাকে।’
খুব মন খারাপ হয়ে গেল জাদুর, এ কথায়। জিজ্ঞেস করল, ‘আপনজন তো নই। তা জানি৷ অপ্রিয় হয়েছি কেন? তা কি বলা যায়?’
এবার জায়িন একটু হাসল, তারপর বলল, ‘বলেছি কি আপনি আমার অপ্রিয়?’
-‘প্রিয়ও তো নই, তাই না?’
আশেপাশে একটু সচেতন দৃষ্টি বুলিয়ে জায়িন দেখল, তার মা আপাতত তাদের দিকে চেয়ে নেই। তাই জাদুর কানের কাছে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, ‘হতে চান প্রিয়?’
সেই মুহূর্তে জাদুর বন্ধ চোখের পর্দায় হঠাৎ করে ভীষণ অদ্ভুত একটি কল্পনাদৃশ্য ভেসে উঠল। নিবিড়ভাবে তাকে জড়িয়ে ধরে আছে জায়িন। জায়িনের উন্মুক্ত বুক সে ভিজিয়ে তুলছে তার ওষ্ঠ চুমুতে। ভীষণ আবেশে জায়িন তাকে বুক থেকে তুলে আদরের শেষ পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে, যা সুখের যন্ত্রণা।

বুক দুরুদুরু করতে আরম্ভ করেছে জাদুর। জায়িন তার কাছে দাঁড়িয়ে তার চেহারার সম্পূর্ণ অভিব্যক্তি পড়তে পেরে একটুখানি বাঁকা হাসল। তারপর আর দাঁড়াতে চাইল না সে। জাদুকে পার করে চলে যেতে পা বাড়াতেই জাদু কেমন কম্পিত স্বরে জায়িনকে বলে উঠল, ‘আপনজন হতে চাই। শুধু প্রিয় নয়।’
জবাবে জায়িন হাসতে হাসতে বলল, ‘তবে চলুক অপেক্ষা।’ বলেই চলে গেল সে।

১৮
প্রায় সপ্তাহ একটা চলে গেছে৷ জায়িন ঢাকা থেকে সেদিন আর গাজীপুর ফেরেনি। বেশ ভালোভাবেই এবার টেরোরিস্ট চক্রটার পেছনে পড়েছে সে, তার টিম নিয়ে। ডিপার্টমেন্ট বেশ ভরসা নিয়ে আছে তার ওপর। এসবের মাঝে শরীরের চাহিদা পূরণে সে কখনো ফারজানা, কখনো রাজিয়াকে না ডাকতেই তার ঘরের বিছানায় পেয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন। কিন্তু এবার বিপদ হয়ে পড়েছে তার, আগের মতো করে সম্পূর্ণ মনোযোগ সে কোনোভাবেই রাখতে পারছে না কাজে। অস্থির মনকে কোনোভাবেই শান্তি দিতে পারছে না দু’টি কারণে। প্রথম কারণ, জাদু। যাকে না দেখে শুধু তার খোঁজ খবর শুনে থাকতে হচ্ছে প্রত্যেকটা দিন। গভীর রাতে নিবিড় আলিঙ্গনে ফারজানাকে বুকে নিয়েও সে চিন্তায় মেতে থাকছে জাদুকে নিয়েই। কোনোভাবেই এক দণ্ড ভুলতে পারছে না তার সেই ঠোঁট, ঠোঁটের মিষ্টি মুচকি হাসি, আর তার বিষণ্ন, অতৃপ্ত, শীতল চোখদু’টি। আসল কথা, ভুলতে চাইছে না সে। চুম্বকের মতো টানছে মেয়েটি তাকে। তাই আর সম্ভব হচ্ছে না তার পক্ষে অপেক্ষা করা। কয়েকটা ঘণ্টার জন্য হলেও ওই মুখটা তার দেখা চায়। আর সর্বশেষ কারণ, এই লুকায়িত টেরোরিস্ট চক্রটা।

১৯
মাধু ভীষণ বিরক্ত নিয়ে বাইরে থেকে ফিরল। ফোনে কথা বলতে বলতে সামনের রাস্তাটায় হাঁটতে বেরিয়েছিল সে। কথা বলতে বলতে কখন ঘণ্টা দুইটা পার হয়ে গিয়েছিল, তা সে খেয়াল করেনি৷ হঠাৎ বুবন ঘেউঘেউ করতে করতে তার দিকে ছুটে আসে। তারপর তার জামার নিচের অংশ কামড়ে ধরে টানতে থাকে বাড়ির দিকে। বুঝতে পারে সে, জাদু কিছু একটা ঘটিয়েছে নিশ্চয়ই।

সন্ধ্যার মরা আলোয় দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, জাদু জানালার সামনের সোফাটায় গা এলিয়ে বসে আছে। অনেকটা সাহেবিয়ানা ভঙ্গি যেন জাদুর বসে থাকাটা। আর তার উদ্দেশ্যহীন দৃষ্টি গেঁথে আছে টি টেবিলের পায়ার দিকে। মাধু এগিয়ে এল, তারপর দেখতে পেল সামনের টি টেবিলটাতে ক্র্যাক কোকেন, আর একটি ইঞ্জেকশন। হঠাৎ জাদুকে আজ এই অবস্থায় দেখে মাধু কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়ল। গুটি গুটি পায়ে এসে ওর পাশে দাঁড়াতেই জাদু তিরিক্ষি নজরে তাকাল ওর দিকে। তাতেই মাধু একটু আঁতকে উঠল। জাদুর শান্ত চোখদু’টো প্রচণ্ড রক্তিম হয়ে আছে। খেয়াল করল মাধু, সোফার ডান পাশে মদের বোতলটা খালি পড়ে আছে। জিজ্ঞেস করল ওকে, ‘ঠিক আছিস?’
জাদু কোনো জবাব দিলো না। কেমন করে যেন চেয়ে রইল মাধুর দিকে। মাধু বুঝতে পারছে, সিরিয়াস কিছু একটা ঘটেছে। যার জন্যই মদের নেশা কাটিয়ে শরীরে জোর আনতে কোকেন নিতে হয়েছে তাকে। মাধু আবার জিজ্ঞেস করল, ‘হঠাৎ এসব নিয়ে বসলি যে?’

সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে জাদু গায়ে শার্ট ঢোকাতে ঢোকাতে ওকে আদেশ করল, ‘আজ যেন বাসায় কেউ না ঢোকে।’
-‘কী হয়েছে?’
জাদু এ প্রশ্ন এড়িয়ে সেন্টার টেবিলের ড্রয়ার থেকে কিছু একটা বের করে প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কোথাও বের হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে সে। তা মাধু বুঝতে পেরে ওকে বলল, ‘এই মুহূর্তে আমাদের বাসা থেকে না বের হওয়াই ভালো।’
ধারাল ব্লেডটা শার্টের গোটানে হাতের ফাঁকে গুঁজে রাখতে রাখতে জাদু বলল, ‘পিনিক কমা। আবার বলছি, কেউ যেন আজ বাসায় না ঢোকে।’
মাধুর মেজাজটাই এবার গরম হয়ে গেল। কঠিন গলায় সে জিজ্ঞেস করল, ‘তুই যাচ্ছিসটা কোথায়? আর আজ বাসায় এলে কী সমস্যা?’
প্রশ্ন মাধুর শেষ হতেই জাদু ভয়ঙ্কর গতিতে হঠাৎ তেড়ে এসে মাধুর গলা চেপে ধরল, ‘স্পর্ধা দেখাস? আমাকে কৈফিয়ত দিতে বলিস! বিছানায় ফেলে রাখব চিরতরে। ভালো আছিস, ভালো থাক।’ বলেই ধাক্কা দিয়ে সোফার ওপর ফেলে দিলো ওকে।
জানটা বেরিয়ে আসারই উপক্রম হয়ে দাঁড়িয়েছিল মাধুর। গায়ে যেন জাদুর হিংস্র পশুর মতো শক্তি এসে ভর করেছে। তার কণ্ঠও খুব অচেনা লাগছিল সেই মুহূর্তে। অত্যাধিক ক্রোধ মিশে আছে যেন সেই কণ্ঠে। আর কিছু বলবার বা জাদুর দিকে তাকাবার সাহসটাও পেল না মাধু। তবে সে রাগটা পুষে রাখল। আবার এও সে জানে, একটু বাদেই জাদু ফিরে এসে তার পায়ের কাছে বসে হাতদু’টো জড়িয়ে ধরে বলবে, ‘ব্যথা পেয়েছিস আপু? আমি বুঝিনি এমন কিছু করে ফেলব তোর সাথে৷ প্লিজ কষ্ট পাস না। তুই তো জানিসই আমার মাথা এলোমেলো হয়ে যায় হঠাৎ হঠাৎ। তুইও তো কত মেরেছিস আমাকে। আমি কিন্তু একদম কষ্ট পাইনি তখন।’

________
ইন শা আল্লাহ আজকে থেকে আবার রেগুলার চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here