#সুইটহার্ট
#Sohani_Simu
১৭.
.
সকাল হয়েছে একটু আগেই।কুয়াশার চাঁদরে ঢাকা পরে আছে পুরো শহর।গায়ে চাদর জড়িয়ে আমি বেলকুনিতে এসে দাঁড়ালাম।বেলকুনির গ্রীলে ফোঁটা ফোঁটা শিশির জমে আছে।কুয়াশার কারনে সামনে কিছু দেখা যাচ্ছে না।এখানে বসার কিছু নেই আর শীতের কারনে ফ্লোরে বসতে ইচ্ছে করছে না তাই আমি তৌসির রুমে চলে আসলাম।আমি প্রায় পনেরো-কুঁড়ি দিন ধরে ফুপ্পিদের বাসায় আছি।ফুপ্পি এক্সাম পর্যন্ত আমাকে এখানেই রাখবে।এই কয়দিন আমি তৌসির রুমে ছিলাম কিন্তু এখন থেকে ভাবছি পাশের রুমে থাকবো কারন তৌসির সাথে এক রুমে থাকলে দুজনেরই পড়ার সমস্যা হচ্ছে।ঘুমোতে গেলেও গল্প করতে করতে মধ্যরাত হয়ে যাচ্ছে,সকালে উঠতে লেইট হচ্ছে তারজন্য সকালে পড়া হচ্ছেনা।
সোয়েটার আর টুপি খুলে আমি জিনিসপত্র ট্রান্সফারের কাজে লেগে গেলাম।পাশের রুমে সব আসবাবপত্রই আছে শুধু পড়ার টেবিল টা নেই।অবশ্য টেবিল থাকলেও আমি টেবিলে বসতাম না।শীতের দিনে বিছানায় আমার টেবিল,সব বই খাতা বিছানাতেই রাখি।তৌসি ঘুমোচ্ছে দেখে ওকে আর ডাকলাম না।আমার ড্রেসগুলো সবার আগে পাশের রুমে নিয়ে গিয়ে আলমিরাতে রাখলাম।আলমিরাতে তেমন কিছু নেই, নিচের দিকে কাঁথা,পাতলা কম্বল আর বালিশ গুছিয়ে রাখা আছে।আমি আমার সবগুলো ড্রেস উপরে রাখলাম।তারপর আমার সাজার জিনিস গুলো নিয়ে এসে ড্রেসিং টেবিলে রাখলাম।বই গুলোও নিয়ে এসে বিছানায় বালিশের পাশে গুছিয়ে রাখলাম।তোসির বেলকুনি থেকে চারটে ফুলের টপ নিয়ে এসে আমার রুমের বেলকুনিতে রাখলাম।বেলকুনিতে বসার কিছু নেই দেখে ডাইনিং টেবিল থেকে একটা চেয়ার আর ড্রইং রুমের সোফা থেকে একটা কুশন নিয়ে এসে চেয়ারে রেখে তারউপর বসলাম,এখন নরম লাগছে কিন্তু জায়গা কম লাগছে তাই আরেকটা চেয়ার আর কুশন নিয়ে এসে দুটো একসাথে করলাম।এখন ঠিক আছে।রুমে এসে দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি আটটা পাঁচ বাজে আজকে যেহেতু ছুটির দিন তাই সবাই দশটার দিকে ঘুম থেকে উঠবে।এত কাজ করে আমার ক্ষুধা লেগে গেছে তাই এখন আমাকে খেতে হবে কিন্তু কি খাবো?ফুপ্পি তো এখনো উঠেইনি ঘুম থেকে।যাই হরলিক্স আর বিস্কুটই খাই,আমি তো হরলিক্স বানাতে পারি।
কিচেনে এসে একটা সসপ্যানে পানি গরম করতে দিলাম।মগে কিছুটা চকলেট হরলিক্স নিয়ে গরম পানি হরলিক্সের মধ্যে ঢেলে চামচ দিয়ে নাড়তে থাকলাম।বানানো হয়ে গেলে টেস্ট করে দেখি দারুণ হয়েছে, কিচেন থেকে বের হবো তখনই দেখি শ্রাবণ এর বাচ্চা শ্রাবণ কিচেনের দরজায় হেলান দিয়ে বুকে হাত গুজে দাঁড়িয়ে আছেন।উনাকে দেখেই আমার মেজাজ চটে গেল।কয়েকদিন ধরে উনি আমাকে জ্বালিয়ে মারছেন।আমি এক ঢোক হরলিক্স খেয়ে উনাকে মুখ ভেংচি দিয়ে দরজার দিকে যেতে লাগলাম।দরজার কাছে আসতেই উনি সোজা হয়ে আমার সামনে দাঁড়ালেন।আমি ভ্রু কুচকে বললাম,”খবরদার বলছি সকাল সকাল আমার সাথে লাগতে আসবেন না,এখন আমি মারামারি করার মুডে নেই।”
উনি আমার হাত থেকে মগ কেড়ে নিয়ে বললেন,”মুডে নেই তাহলে আমার মগ নিয়েছিস কেন?”
আমি তেঁতে উঠে বললাম,”ওমনি আপনার হয়ে গেল?আমার হরলিক্স আমাকে দিয়ে দিন।মগে কি আপনার নাম লিখা আছে নাকি?”
উনি কিছু নাবলে হরলিক্স খেতে খেতে নিজের রুমের দিকে চলে গেলেন।আমার রাগ হচ্ছে,রাগে উনার মাথা ফাটিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে।ওখানেই দাঁড়িয়ে থেকে রাগে ফুসতে লাগলাম।ফুপ্পি এসে আমাকে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল,”আম্মু,এখানে কি করছিস?কখন উঠলি?তৌসি উঠেছে?”
আমি ফুপ্পির দিকে তাকিয়ে বললাম,”শ্রাবণ ভাইয়া আমার হরলিক্স নিয়ে চলে গেল আর তুমি এখন আসলা?”
“আচ্ছা যাক আমি তোকে আবার বানিয়ে দিচ্ছি চল।”- বলেই ফুপ্পি কিচেনে ঢুকলো।আমি যেয়ে ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসলাম।ফুপ্পি এক মগ হরলিক্স আমাকে দিতে এসেই অবাক হয়ে বলল,
“এখানকার চেয়ার কে সরালো?”
“আমি ওগুলো আমার রুমের বেলকুনিতে রেখে দিয়েছি।ফুপ্পি,আমি এখন থেকে ওই রুমে থাকবো।”- হাত দিয়ে ইশারা করে ফুপ্পিকে রুম টা দেখিয়ে দিলাম।ফুপ্পি আমাকে সম্মতি দিতেই আমি অনেক খুশি হয়ে হরলিক্স শেষ করে রুমে চলে আসলাম।
দুপুরে গরম পানি দিয়ে গোসল করে আমি,দাদু আর তৌসি রোদের জন্য ছাদে এসেছি।শীত বেশি হওয়ায় আমাদের মতো অনেকেই ছাদে এসেছে।আমি ছাদের রেলিং এ হাত দিয়ে একবার নিচে তাকাচ্ছি একবার দুই হাতে চোখ-কপাল নেড়ে নিজেকে স্বাভাবিক করছি।আমার বেশি উচ্চতা ভয় লাগে তাই ভয় দূর করার প্রাকটিস করছি।হঠাৎই কেউ পেছন থেকে আমার দুইবাহু ধরে আমাকে সামনের দিকে ধাক্কা দেওয়ার মতো করতেই আমি ভয়ে চোখ খিঁচে বন্ধ করে এক চিৎকার দিয়ে এলাকা কাঁপিয়ে ফেললাম।কিছুক্ষণ পর আমি ঠিক ভাবে দাঁড়িয়ে কারো বাহুর মধ্যে আবদ্ধ আছি বুঝতে পেরে ধীরে ধীরে চোখ খুলে দেখি শ্রাবণ।উনি আমার দুই গালে হাত রেখে মিষ্টি হেসে বললেন,
“ভয় ভেঙেছে? ”
আমার ভেতরে এখনও ধক ধক করছে।উনার ঠান্ডা হাত গাল থেকে সরিয়ে দিলাম।উনাকে কিছু কড়া কথা শুনানোর জন্য মুখ খুলতেই তৌসি বলল,”ভাইয়া, শিরিন ভাবির ওই কাজিনটাকে দেখলাম দারোয়ান এর সাথে কথা বলতে।”
“কখন?কি কথা বলছিল”- ভ্রু কুচকে তৌসির দিকে তাকিয়ে বললেন উনি।
তোসি আমার পাশে দাঁড়িয়ে বলল,”কলেজ থেকে ফেরার সময়।কি কথা বলছিল বুঝতে পারিনি।”
শ্রাবণ রেলিং এ হেলান দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,”ওকে ফরগেট ইট।”
আমি এখনও উনার দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছি।উনি মুচকি হেসে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে চট করে আমাকে রেলিং এ বসিয়ে দিলেন ভয়ে আমি উনার কাঁধে দুই হাত রাখলাম।উনি দুষ্টু হেসে বললেন,
“ভয় পাচ্ছো সুইটহার্ট?এই তৌসি, আমার ফ্লাস্কে রাখা হট ওয়াটারে সল্ট মিক্সড করেছে কেরে?”
তৌসি কিছু বলার আগেই আমি বললাম,”আমি করেছি আপনি আমার হরলিক্স খেয়েছেন আমি আপনার পানিতে লবন মিশিয়ে দিয়েছি,শোধ বোধ।”
উনি আমার দুই বাহু শক্ত করে চেপে ধরে বললেন,”আমি তোর হরলিক্স খেয়েছি জন্য তুই রিভেঞ্জ নিলি কিন্তু তুই আমার ওয়াটার স্পয়েল্ড করলি, রিভেঞ্জ তো আমাকেও নিতে হবে তাইনা?আমি বরং তোকে এখান থেকে ফেলে দিই তারপর তুই নিচে থেকে উঠে এসে আবার আমার উপর রিভেঞ্জ নিস।”
বলেই উনি আমাকে পেছন দিকে হেলিয়ে দিলেন।আমি আতংকে উনার নীল-সাদা কালারের হুডি গলার কাছে খামছে ধরে বললাম,
“আমি আর কিছু করবোনা,আপনাকে প্রতিদিন হরলিক্স দিব।ছাড়বেন না,আপনি বিয়ে করার জন্য সারাদিন ফুপ্পির আচঁল ধরে ঘুরেন না?আমি পরে গেলে আপনাকে অভিশাপ দিব আপনার যেন কখনও বিয়ে নাহয়।আমার অভিশাপ কিন্তু ফলে যায়,বিশ্বাস নাহলে রকির কাছে শুনে দেখুন ওর গার্লফ্রেন্ড নেই কেন।বিয়ে করার ইচ্ছে থাকলে আমাকে নামিয়ে দিন।”
উনি হু হা করে হাসতে লাগলেন।উনার হাসি দেখে আমার কুচকে থাকা চোখ মুখ স্বাভাবিক হয়ে গেল।রোদ পরে উনার মুখ আরও ফর্সা হয়ে উঠেছে। ভেজা কালো চুল কপালে পরে আছে বাম চোখের পাশে চিপের কাছে একটা নীলাভ রগ ফুলে আছে।কি ভয়ানক সুন্দর লাগছে উনাকে!ইশ শ্রাবণ ভাইয়া সিজান হলে ভাল হতো!না মানে সিজানটা উনি হলে ভাল হতো।
মনে মনে এসব ভাবছিলাম তখনই উনি আমাকে নিচে নামিয়ে আমার গালে হাত দিয়ে ঝাকিয়ে বললেন,”কিরে ছাদ থেকে পরে কোমায় চলে গেলি নাকি?”
আমি আনমনেই উনাকে বললাম,”আপনি সিজান হবেন?”
উনি আমার দুই গাল ইলাস্টিকের মতো টেনে ছেড়ে দিয়ে বললেন,”নেভার।”
তৌসি পাশে থেকে হাসতে হাসতে বলল,”ভাইয়া সিজান হলে তুই সারাদিন ভাইয়াকে বিয়ে করতে চাইবি?যেমনটা সিজানকে করতে চাস?”
আমি কিছু বলার আগেই শ্রাবণ ভাব নিয়ে বললেন,”তোকে বিয়ে করতে আমার সিজান হতে হবে?হাও ফানি!তোর মতো গাধীকে সিজানের বউ হলেই ভাল মানাবে।একজন পাগল আরেকজনের মাথা খারাপ।”
আমি রেগে উনাকে বললাম,”আমার মাথা খারাপ?আপনারই মাথা খারাপ।আপনি জানেন আমাকে কতজন বিয়ে করতে চাই?”
উনি মুচকি হেসে বললেন,”তাহলে তুই বলছিস আমি তোকে বিয়ে করি?আরে আগে বলবি তো তুই আমাকে বিয়ে করতে চাস।”
আমি রেগে আগুন হয়ে উনার বুকে উরাধূরা কিল ঘুষি দিতে লাগলাম।উনি আমার দুই হাত ধরে হাসতে লাগলেন।তৌসিও নিজের চশমা ঠিক করতে করতে হাসছে।একটু দূরে দাদুও হাসছে।কিছুদূর কয়েকটা অ্যান্টি বসে আছে ওরা কিছু শুনতে না পেলেও হাসছে ঠিকই।আমি এবার ঠোঁট উল্টে কান্না শুরু করে দিলাম।
বিকেলে সোফায় বসে দাদুর সাথে টিভিতে নিউজ দেখছিলাম তখনই কলিং বেল বেজে উঠলো।আমি উঠে গিয়ে দরজা খুলতেই শ্রাবণ আমার কপালে আর গালে কিস করে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললেন,
“মাই ডিয়ার সুইটহার্ট।”
আমি রেগে উনার বুকে হাত দিয়ে ঠেলে বললাম,
“কুত্তার সুইটহার্ট,ছাড় আমাকে,,ফুপ্পিিিি!!!!!!!!”
ফুপ্পি রুম থেকে বেড়িয়ে আসার আগেই উনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে বললেন,
“এভাবে গলা ফাটাচ্ছিস কেন?আর সামনে থেকে সর, কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি।”
আমি উনার দিকে ভ্রু কুচকে তাকালাম।ফুপ্পি এসে কি হয়েছে বলতেই আমি সব বলে দিলাম।ফুপ্পি তো অনেক রেগে গেল,নিশ্চয় আজকে উনি মায়ের হাতে মাইর খাবেন।আমি কেবল একটু আনন্দের হাসি দিবো তখনই শ্রাবণ ইনোসেন্ট মুখ করে বললেন,
“আমি কিছু করিনি আম্মু।তোমার বিশ্বাস নাহলে দাদুকে জিজ্ঞেস করে দেখ,দাদু নিশ্চয় এসব কিছু দেখেনি।তাইনা দাদু?তুমি তো কিছু দেখোনি তাইনা?”
দাদু সোফায় বসে হো হো করে হেসে বলল,”নাতো আমি কিছু দেখিনি।জুঁই ফুল তো দরজা খুলেই ফুপ্পি বলে চিৎকার দিল।”
আমি হা করে দাদুর দিকে তাকালাম।শ্রাবণ দাদুর কাছে যেতে যেতে বললেন,
“দেখেছো তো আম্মু?জুঁই আমাকে মাইর খাওয়ানোর জন্য তোমাকে এসব বলে আর তুমি শুধু শুধু আমার উপর রেগে যাও।”
বলেই উনি দাদুর সাথে হাই ফাইভ করে সোফায় বসলেন।ফুপ্পি আমার দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে চলে গেল।আমিও রাগী চোখে দাদুর দিকে তাকিয়ে বললাম,
“কাজটা তুমি ভাল করলা না বুড়ো।আজ থেকে তোমার সাথে সব ডিল ক্যান্সেল।”
বলেই আমি গট গট করে হেঁটে রুমে চলে গেলাম।
.
সকালে ব্রেকফাস্ট টেবিলে এসে ফুপ্পাকে দেখে আমি অবাক হয়ে বললাম,
“এই কে তুমি?আমার ফুপ্পার মতোই দেখতে।”
আমার কথা শুনে সবাই হাসতে লাগলো।তৌসি হাসতে হাসতে বলল,”আরে বাবার মতো নয় বাবায় এটা,ভোরে এসেছে তুই তখন ঘুমোচ্ছিলি।”
ফুপ্পা হাসতে হাসতে বলল,”আমার জুঁই মা কেমন আছে?”
আমি ফুপ্পার পাশে চেয়ার টেনে বসে মন খারাপ করে বললাম,”একটুও ভাল না ফুপ্পা।শ্রাবণ ভাইয়া সব সময় আমার উপর গুরুগিরি করে।”
শ্রাবণ চোখ ছোট করে আমার দিকে তাকালেন।ফুপ্পা বলল,”শ্রাবণ তুমি জুঁই মাকে….।”
“আমি ওকে কিছুই বলিনা,পড়া না পারলেও কিছু বলিনা।এমনিতেই আম্মু সারাদিন আমাকে বকে তুমি আর নতুন করে কিছু বলো না প্লিজ।আমার জন্য নাকি ও একটুও ভাল নেই তাহলে আমি ওকে আর কিছু বলবোনা, ওর সাথে কথাও বলবোনা তাও ও একটু ভাল থাকুক।”
কথা গুলো বলে উনি মাথা নিচু করে চুপচাপ খেতে লাগলেন।আমি ভ্রু কুচকে উনার দিকে তাকিয়ে থাকলাম।ফুপ্পাও আর কিছু বলল না।ফুপ্পি আমার প্লেটে খিচুড়ি,ডিম ভাজি আর বেগুন ভাজি দিয়ে খেতে বলল।আমি খাচ্ছি আর শ্রাবণের দিকে তাকাচ্ছি।উনি আর তাকাচ্ছেন না আমার দিকে,অন্যদিন তো অনেকবার তাকান।হুহ্ ঢং,ফুপ্পার সামনে ভাল সাজার চেষ্টা করছেন উনি।
চলবে……….!