#সুখের_সন্ধানে_১
বিয়ের আগে জীবনটাকে ফ্যান্টাসি মনে হতো! সেলিমের মতো ছেলেকে বিয়ে করলে আমার মতো যে কারো কাছেই এটা মনে হওয়া স্বাভাবিক।
দেড় বছর প্রেম করার পর দুই পরিবারের সম্মতিতেই খুব ধুমধাম করে বিয়ে হয়েছিল বাবার এমডির ছেলে সেলিম মালিকের সাথে। তার আভিজাত্য, ঐশ্বর্যতে আমি ছিলাম মুগ্ধ! বলিষ্ঠ আর তেজোদৃপ্ত পুরুষালি সৌন্দর্যে কী এক স্বর্গীয় অনুভূতি হতো আমার মধ্যে অথচ তাকে দেখলে সেই অনুভূতি এখন হাজার চেষ্টা করলেও হয় না!
এমন জীবন তো আমি চাইনি! নিজেকেই নিজের কাছে বড় অপাংক্তেয় মনে হয়। ক্যাডেট পড়ুয়া পনেরো বছরের ছেলে প্রিয়র কাছেও নিজেকে বড় অচেনা মনে হয়!
অভিজাত পরিবারের ছেলের বউ! বলা যায় শাড়ীর মডেলের সাথেই পরিবর্তন করি গাড়ির মডেল। এই তো গত সপ্তাহেই বিক্রয় ডট কমে বিক্রি করেছি বছর খানেক আগের কেনা টয়োটা প্রিয়াসের খুব প্রিয় গাড়িটি। ক’দিন ধরে খুব জিপের নেশা চেপেছে। কিনে ফেললাম হ্যারিয়ারের ব্র্যান্ড নিউ কার। এটাও বা কতদিন মনে ধরে সেটাই দেখার বিষয়! এই প্রিয়াস কারটা নেবার আগে হোন্ডা গ্রেসের নিউ মডেলটাও অনায়সেই অল্পদামে ছেড়ে দিয়েছিলাম। কোনো কিছুতেই একদম মায়া জন্মায় না আজকাল আর। অনুভূতিগুলি এত ভোতা কেন হয়েছে , কবে হয়েছে নিজেই টের পেলাম না। দামি গাড়ি , শাড়ি এসবের মাঝে সুখ খুঁজতে খুঁজতে এখন নিজেকে বড্ড ক্লান্ত লাগে। সত্যিই আমি ক্লান্ত! বড় ক্লান্ত! শশুর শাশুড়ি আলাদা বাড়িতে থাকেন। শশুরবাড়ীর উটকো ক্যাচালে কোনোদিন ভুগেছি মনে পড়ে না। কোনো কিছুর মধ্যে নাক গলাতে আসে না তারা কেউই। আমার ছেলেটা বিয়ের পরপরই কনসিভ করেছিল। এরপরে আর শত চেষ্টাতেও কনসিভ করলাম না। সেকেন্ড বারের মত আর বাচ্চার মুখও দেখা হলো না। ছেলেটাকে নিয়েই সব আশা ভরসা। প্রিয়র খুব শখ হলো ক্যাডেটে পড়ার! না করতে পারলাম না। একমাত্র ছেলে কোলছাড়া হয়ে যাচ্ছে তাতেও আমি নিরুত্তাপ! সবকিছুতেই এত অনীহা আমার! শেষ কবে রান্নাঘরে চুলাতে রান্না চাপিয়েছি মনে পড়ে না।
পড়বেই বা কি করে? ঘর ভরা এত চাকর বাকর থাকতে আমার রান্নাঘরে ঢুকে রান্না করার কি দরকার? সেলিমও কখনো আবদার করে বলে না “আজ তোমার হাতের রান্না খেতে চাই। ” মাঝেমাঝে শখ করে কিছু রান্না করে সামনে দিয়ে যদি বলি, কেমন হলো দেখতো! আজ তোমার জন্য নিজের হাতে রান্না করেছি। তেমন কোনো রিয়্যাক্ট নেই সেলিমের। বলবে, “কষ্ট করতে কেন গেলে? কুককে কী আর মাস গেলে এমনিতেই বেতন দিব? ” রান্নার কষ্টটাই মাটি। তাই এখন আর ও মুখো হই না।
আমি সমাজসেবায় সময় দিচ্ছি খুব! এতে দু’পয়সা ইনকাম হোক বা না হোক মনের শান্তি কিছুটা হলেও জুটছে। আমার কোনো কিছুতেই আপত্তি নেই আমার স্বামী সেলিম বা তার পরিবারের!
সেলিম ব্যস্ত মানুষ, সে সারাদিন ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়েই থাকে। আমার কোন ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়া পছন্দ-অপছন্দের মাঝে সে কখনোই নাক গলাতে আসে না। আমার বাবা ছিলেন ওদের কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার। সেই সুবাদে ওদের বাসাতে আমার মাঝেমাঝে আসা যাওয়া হতো। কখন যে সেলিমের সাথে আমার মন দেওয়া নেওয়া হয়ে গেল এখনো ভাবলে অবাক লাগে। সেলিমই পাগল ছিল আমার জন্য। আমিও মনে মনে পছন্দ করতাম ওকে কিন্তু বলার সাহস হয়নি কখনো। সেলিম যেদিন আমাকে প্রথম তার পছন্দের কথা জানাল আমি তো বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না। আব্বুকে যখন আমি জানিয়েছিলাম আমার পছন্দের কথা সে তো শুনেই ভয়ে একাকার। সেলিম তাকে অভয় দিয়েছিল বলেই সাহস করে আমাদের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যায় আমার শ্বশুর আফাজ মালিকের কাছে।
আব্বুর মত এত ভালো আর বিশ্বস্ত ইমপ্লয়িকে তিনি নিরাশ করেননি । আমার শাশুড়ি মা আমাকে খুব বেশি পছন্দ না করলেও ছেলের যেহেতু পছন্দ তাই তিনি আর অমত করেননি। আমাকে যে খুব বেশি পছন্দ তিনি তখনো করতেন না এবং এখনও করে না এটা আমি স্পষ্ট বুঝতে পারি। কিন্তু এ নিয়ে কখনোই তার সাথে কোন ধরনের কথা বলিনি ।মাঝে মাঝে কিছুটা হীনমন্যতায় ভুগি ।
সেলিমের কাজিনরা যখন তাদের মতো হাই সোসাইটির মেয়েদেরকে বিয়ে করে তখন আমার শাশুড়ির মুখ দেখে কিছুটা হতাশ মনে হয়। আমি বুঝি আমাকে মেনে নিতে হয়তো এখনো তার খুব কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু সবকিছু বুঝেও না বোঝার ভান করি। সেলিমের ছোট ভাই বোন দুটোও আমাকে খুব বেশি সম্মান করে না, তবে অসম্মান করে এটাও বলব না। আমার ছোট দেবর সাহিল বিয়ে করেছে তিন বছর আগে। দেবরের বউ মালিহাকে একদম চোখে হারায় সবাই। প্রথম প্রথম খুব কষ্ট পেতাম তবে এখন আর পাই না। ওদের সাথে আমার খুব বেশি দেখা-সাক্ষাৎ হয় না। পারিবারিক কোনো অনুষ্ঠানে যদি একটু আধটু দেখা হয় জাস্ট হাই হ্যালো টাইপের কথাবার্তা ছাড়া আর কথা থাকে না আমাদের।
বছরে দু’দিন শ্বশুরের বাড়ীতে আমার যাওয়া হয়। দুই ইদে খুব ঘটা করে অনুষ্ঠান করা হয় আমার শ্বশুর বাড়িতে। আমি সেখানে মেহমানের মত যাই । খেয়ে দেয়ে ফুর্তি করে চলে আসি। অন্য মেহমানদের থেকে আমি নিজেকে আলাদা করতে পারি না। আমার শ্বাশুড়ির কাছে ওদের আর আমার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই হয়তো।
এ নিয়ে মাঝে মাঝে সেলিমের কাছে খুব আফসোস করে বললে সেলিম সেটাকে পাত্তা দেয় না। সে থাকে তার কাজ নিয়ে ব্যস্ত, আমার কথা শোনার সময় কোথায় তার? আমার কষ্টগুলো সে হয়তো বোঝে না? বিশাল বড় ডুপ্লেক্স বাড়িতে সারাদিন একাকিত্বের যন্ত্রনা আমাকে কুরে কুরে মারে।
আমার শাশুড়ি তার বাসাতে আমাকে একজন মেহমানের অতিরিক্ত কখনো ভেবেছে বলে আমার মনে পড়ে না। আমার এখানে আসেও খুব ফর্মাল ভাবে। জাস্ট মেহমানের মত আসে, খাওয়া-দাওয়া করে কিছুক্ষণ থেকে চলে যান। লিভিং রুম থেকে কখনো আমার বেডরুমে আসার কথা সে চিন্তাও করেন না।
মাঝে মাঝে ভেবে অবাক হই এ আবার কেমন সম্পর্ক? বউ শাশুড়ি সম্পর্কে এতটা নিরুত্তাপ ভাব কোন বউয়ের পক্ষেই মেনে নেওয়া সহজ হবে না।
সেলিমের কাছে নালিশ টা কী করব মাঝেমাঝে সেটাই ভেবে পাই না। আমার শাশুড়ি তো আমার কোন কিছুতে দোষ ধরেন না বা আমার কোন কিছু নিয়ে অভিযোগও করেন না। ইদ হোক আর পহেলা বৈশাখ হোক কোনো অনুষ্ঠানে আমাকে গিফট পাঠাতেও তার ভুল হয় না। আমিও সময়মতো তাকে গিফট পাঠিয়ে আমার দায়িত্ব পালন করছি।
আমার শশুড় শাশুড়ি থাকে ধানমন্ডিতে বিশাল বড় আলিশান ডুপ্লেক্স বাড়িতে। আমারও ডুপ্লেক্স বাড়ি, আমি থাকি উত্তরাতে। আমারটা তাদের মত অত বড় আর আলিশান না হলেও যতটুকু সেটাই আমার কাছে রাজপ্রাসাদতুল্য।
আব্বুর বাসা মিরপুরে। ছয় শতক জমির উপর পুরানো আমলের একটা তিনতলা বাড়ি। এটাই আব্বুর রেখে যাওয়া একমাত্র সম্পদ। আব্বু মারা গেছেন আমার বিয়ের বছর খানেক পরে স্ট্রোক করে। আম্মু মারা গেছেন গত বছর । ভাইয়া ভাবি আর তার তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে বাড়িটাতে থাকেন। নিজে দোতালায় থাকেন, নিচতলা আর তিন তলা ভাড়া দেওয়া। আমার ছোট বোন চম্পা ,ওর সাথে কথা হয় না প্রায় দুই বছর। চম্পার বিয়ে হয়েছে পুরান ঢাকাতে। শশুর শাশুড়ি ননদ দেবর সবাই একসাথেই থাকে। যৌথ পরিবারের বড় বউ চম্পা। দায়িত্বের অভাব নেই তার।
কী সামান্য একটা বিষয় নিয়ে ওর সাথে আমার কথা বলা বন্ধ । বড় মামার মেয়ের বিয়েতে আমাদের আত্মীয় স্বজনেরা যখন আমার শ্বশুরবাড়ির অর্থ-বিত্ত নিয়ে খুব প্রশংসা করছিলেন তখন এটাকে সহজভাবে নিতে পারেনি চম্পা। নিজেকে বড় করতে যেয়ে আমাকে খুব বেশিই ছোট করে ফেলল সবার সামনে। ছোটবেলা থেকেই ওর বুদ্ধিশুদ্ধি একটু কম। কখন কার সামনে কী বলতে হয় আর না হয় হুশ থাকে না। আর রেগে গেলে তো কথাই নেই। সবার সামনে বলে ফেলল, ” এত বড়লোক ঘরে বিয়ে হলে কি হবে? মনে শান্তি আছে? মনের শান্তি বড় শান্তি! আমার ওর মতো অর্থ সম্পদের পাহাড় না থাকলেও শান্তির অভাব নেই। ওর শ্বশুর বাড়িতে ওকে তো কেউ দু’আনার দাম দেয় না। এদিকে আমাকে সবাই মাথায় করে রাখে। এমন অর্থ কড়ি থাকা আর না থাকা একই কথা।”
কথাটা ও হয়তো ওভাবে বলতে চায়নি। কিন্তু ও কখনই ঘুরিয়ে পেচিয়ে কথা বলতে পারেনা। যা বলে সোজাসুজি মুখের উপর বলে ফেলে। তাতে কেউ কষ্ট পেলো কি না পেল সেটা নিয়ে কোন মাথাব্যাথা নেই। সেদিন ওর কথায় আমিও প্রচন্ড কষ্ট পেলাম ।আমাদের আত্মীয় স্বজনের সামনে এভাবে আমাকে ছোট না করলেও পারত। অনুষ্ঠানের শেষে বাসায় ফিরে প্রচণ্ড ঝগড়া হয়েছিল সেদিন চম্পার সাথে আমার। আম্মু তখন বেঁচে ছিলেন। আম্মুও প্রচুর চেষ্টা করেছেন থামানোর কিন্তু পারেননি। আম্মু আমাদের ছেড়ে চলে যান ।অনেক কিছুই বদলে গেছে কিন্তু আমাদের দু’বোনের সম্পর্ক এখনো সেই আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে ।দুজনের সাথে দুজনের মুখ দেখাদেখি বন্ধ। আমি কয়েকবার চেষ্টা করেছিলাম ওর সাথে কথা বলার কিন্তু হয়তো আন্তরিকতা ছিল না সেই চাওয়ায় তাই ওর সাথে সম্পর্কটাকে স্বাভাবিক করতে পারিনি। আম্মু চলে যাবার পরে ভাইয়ার বাসাতেও সব কিছু আর আগের মতো নেই। ভাবির মা আব্বা আমাদের বাড়িতেই থাকেন ভাইয়াদের সাথে। একাকীত্ব কাটাতে সেখানে গেলেও সেই চেনা ঘর দোর আর মানুষগুলিকে কেমন যেন বড় অপরিচিত মনে হয়। আম্মু মারা যাবার পর মাঝে মাঝে যেয়েই আম্মুর রুমে দরজা বন্ধ করে আম্মু আব্বুর খাটে শুয়ে তাদের শরীরের ঘ্রাণ নেবার চেষ্টা করতাম। এখন সেই রুমে ভাবির আব্বা মা থাকেন। আমি গেলে গেস্ট রুমে জায়গা হয় আমার। নিজেকে একদমই মানাতে পারি না সেই বাড়িতে যে বাড়ির আলো ছায়াতে বড় হয়েছি আমরা তিন ভাই বোন। তাই ধীরে ধীরে চেনা পথও আজ বড্ড অচেনা।
সেলিম পড়ে থাকে তাদের বিশাল ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ে। আমার সাথে রাতে খাবার টেবিলে যা টুকটাক কথাবার্তা হয়! সারাদিন ফোন করেও পাই না তাকে। তাই আজকাল ফোন করাই বন্ধ করে দিয়েছি। সেদিন সেলিমকে বললাম ,আমি শাশুড়ির আম্মার কাছে যেয়ে কিছুদিন থাকতে চাই। একা একা এভাবে থাকতে ভালো লাগে না। সেলিম জানাল তার মা হয়তো এটা পছন্দ করবে না। তাই সেখানেও না যাওয়াটাই ভালো। এটা শুনে খুব মন খারাপ হলো। জিজ্ঞেস করলাম, আমার সাথে সবাই কেন এমন ব্যবহার করে ? আমার কী সেখানে যাবার অধিকার নেই? তাদের মাঝে কেন আমাকে আপন করে নিতে পারে না?
সেলিমের উত্তর শুনে ভীষণ অবাক হই।
– তোমার শ্বশুর ,শাশুড়ি, দেবর , ননদ সবাই আলাদা থাকে। তোমার তো খুশি হওয়ার কথা। অন্যান্য বউরা তো এটাই চায়। তুমি কি সেটা চাও না?
– আমি অন্যদের থেকে আলাদা হতে চাই। আমি সবার সাথে মিলেমিশে থাকতে চাই সেলিম। এই নিঃসঙ্গ জীবন আমি চাই না। তুমি থাকো তোমার কাজ নিয়ে আর আমি সারাদিন এভাবে কী করে থাকি বলতো! আমার তো মনে হয় তারা এত বছরেও আমাকে তাদের পরিবারের একজন বলে মেনে নিতে পারেন নি।
– হ্যাঁ! সত্যি কথা এটা । আমি পছন্দ করি বলেই তারা আমার পছন্দকে প্রাধান্য দিতেই ছেলের বউ হিসেবে তোমাকে মেনে নিয়েছেন। আচ্ছা, তোমার সমস্যা কোথায় ? তুমি আলাদা থাকছ এত বড় বাড়িতে । চাকর বাকর বাড়ি ভরা । তোমার শ্বশুর শাশুড়ি কেউই কখনো এসে তোমাকে কোন কিছু এ সংসারের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেন না। তারা তাদের জগত নিয়ে খুশি , তুমি তোমার জগৎ নিয়ে খুশি থাকার চেষ্টা করো।
– সেলিম, সত্যি কথা বলবে ? তারা কেন আমাকে এত বছরেও মেনে নিতে পারছে না ? মেনে যদি নাই নিবে তাহলে তখন বিয়েতে কেন সম্মতি দিয়েছিলেন?
– বললাম তো !বিয়েতে সম্মতি দিয়েছিল কারন আমি তোমাকে পছন্দ করি তাই। আমার পছন্দকে তারা না করতে পারেনি!
– তাদের ছেলের বউ হিসেবেই যখন ঘরে এনেছে তবে আমাকে প্রাপ্য সম্মানটুকু কেন দিবে না? কী দোষ আমার? আমি কেন বিয়ের এত বছর পরেও তাদের কাছ থেকে আমার প্রাপ্য ভালোবাসাটুকু পাবো না? আমি কি কখনো তাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করি নাকি অসম্মান করি? তোমার ভাইয়ের বউকে তো খুব আদর করে তারা।
– তুমি তাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করো না এটা ঠিক। শুনতেই যখন চাইছ তখন শোনো! তোমার অন্যায় হচ্ছে তোমাদের স্ট্যাটাস আমাদের স্ট্যাটাসের সাথে যায় না। এজন্যই তুমি সবার থেকে দূরে। মালিহার সাথে নিজেকে কেন কম্পেয়ার করো? আর বিয়ের এতগুলি বছর পর এসব কথা আমার শুনতে ভালো লাগে না একদম।
– তোমার থেকেও কী তবে এজন্য এমন দূরে রাখছ আমাকে?
– রুম্পা , তুমি কিসের সাথে কী মেলাও? তুমি এটা তো অস্বীকার করতে পারবে না যে আমাদের সাথে তোমাদের স্ট্যাটাস কোনো দিক দিয়েই যায় না। তাহলে সেটা নিয়ে আবার কেন এত অবুঝের মতো করছ? তুমি আমার স্ত্রী! তোমার সব দায়িত্ব আমার। তোমার কোনো কিছুর অভাব কি আমি রাখছি? চাওয়ার আগেই সবকিছু পেয়ে যাচ্ছ না? কখনও তোমার কোনো কিছুতেই আমি আপত্তি করি না। যখন যেটা চাচ্ছ সেটাই পাচ্ছ। তোমার সাথে কখনো কিছু নিয়ে বিবাদ বা কথা কাটাকাটিই কি করছি আমি? তাহলে অসম্মানটা হয় কী করে? দূরেই বা রাখলাম কোথায়?
সেলিমের কথা শুনে আমি আর কোন উত্তর দিতে পারিনি। দরদর করে বেয়ে পড়া চোখের পানিতে বুক ভাসিয়েছি। ঠিকই তো সেলিমের মত ভালো স্বামী আমি কই পাব? আমার কিছুতেই তার আপত্তি নেই। কোনোদিন কিছু নিয়েই সে প্রশ্ন তোলে না। আমি তো সুখের সাগরে ভাসছি। পৃথিবীর সব চাইতে সুখী মানুষটা আমি। একই ছাদের নিচে থাকি দু’জন মানুষ । কেউ কারো ভালোমন্দ খবর নেয়ার প্রয়োজন মনে করি না। আজ আমি এটাও ক্লিয়ার হলাম যে সেলিমের পরিবারের মতো সেলিমও আমাকে তার যোগ্য মনে করে না। মাসান্তে সেলিম আমার একাউন্টে ব্যালান্স ট্রান্সফার করেই দায় মুক্ত। এর অতিরিক্ত কিছু লাগলেও সেলিমকে জানানো মাত্র পেয়ে যাই। এত পাওয়ার পরেও নিজেকে কেন সুখী ভাবতে পারি না আমি?
সকালের খাবার টেবিলে সেলিম খুব ব্যস্ত থাকে। কোনোরকম হালকা কিছু খেয়েই বেরিয়ে যায়। আজও একই রকম । খুব তড়িঘড়ি করছে। আমার সাথে সকালে একদমই কথা হয় না এ সময়। চলে যাচ্ছে ঠিক তখন পেছন থেকে ডাক দিয়ে বললাম,
“ আমি প্রিয়কে হোস্টেল থেকে নিয়ে আসতে চাই। একা একা আমার একদমই ভালো লাগে না। এসব ক্যাডেট ফ্যাডেট পড়ে কী হবে? ওর বাপ দাদার কী কম আছে যে চাকরি করে খেতে হবে!”
সেলিমের পা যেন আটকে গেল।
“ জীবনটা শুধু অর্থের মাপকাঠিতে মেপেই চলে না। ওর আগ্রহ হয়েছে ও পড়ুক। আর পড়লেই জব করতে হবে এ কথা কেন ভাবছ? আমার ছেলের কোনো স্বপ্ন অপূর্ণ থাকুক আমি চাই না। তখন তো কিছুই বললে না। এখন এসব বলার কোনো অর্থ হয় না। আমি গেলাম।“
তার চলে যাবার দিকে তাকিয়ে শুধু ভাবছি , আমি তো এমন জীবন চাই নি। যে সেলিমকে আমি ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম সেই সেলিম আর এখনকার সেলিমের মাঝে বেশ পার্থক্য!
সেলিমের কাছে কিছু চাইলে সাথেসাথেই পেয়ে যাই। কিন্তু সেলিমকে পাই কি? নিজের কাছে নিজে এমন নানা প্রশ্ন করে যাচ্ছি। সেলিমও হয়তো তার পরিবারের মতই এই সম্পর্ককে টেনে নিয়ে যাওয়ার জন্য হীণমন্যতায় ভুগছে। এত ভালোবাসা, এত ওয়াদা সব তবে মিথ্যে? সেলিম আমাকে প্রতিনিয়ত ঠকাচ্ছে। একসাথে দু’জন শেষ কবে বাইরে গিয়েছি মনে পড়ে না। হ্যা , কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে আমাদের একসাথে যাওয়া হয়। কিন্তু নিজেদের জন্য একান্ত সময় কাটাবার মত সময় কখনো তার কাছে চেয়ে আমি পাইনা বহু বছর। তাই এখন আর এ সবের আশাই করি না।
চলবে…..