সুখের সন্ধানে পর্ব ১৫

0
653

#সুখের_সন্ধানে
#পর্ব_১৫

– ছেলের আদালতে মায়ের নামে বিচার বসছে। ব্যাপারটাকে তুমি কি খুব হালকাভাবে দেখছ? এটা যে কত বড় লজ্জার, কতটা ঘৃণার সেটা কি তুমি আন্দাজ করতে পারছ? তোমার নির্লিপ্ত চেহারা দেখে অবশ্য সেটা মনে হচ্ছে না।

– হালকাভাবে কেন দেখব? একদমই হালকাভাবে দেখছি না। তবে এমন দিন আমাকে দেখতে হবে সেটা ভাবি নি কোনোদিন !

– যেমন কর্ম তেমন ফল। এসব কাজ করার আগে তোমার প্রিয়র কথা একবার চিন্তা করা উচিত ছিল।

– আমারও এখন তাই মনে হচ্ছে। আচ্ছা, যাই হোক অন্যায় যদি করে থাকি ছেলের সামনে সেটা ফাঁস হবে। আমি ভয় পাই না।

দু’জন কথা বলছে ঠিক সে সময় প্রিয় এসে রুমে ঢুকল। রুমের মধ্যে বেশ থমথমে পরিবেশ।

– আম্মু, কী এমন হল যে আমাকে এভাবে জরুরী নোটিশে বাসায় নিয়ে আসতে হলো?

– সেটা তোমার আব্বুকে জিজ্ঞেস করো।

– আব্বু, কী হয়েছে এমন?

সেলিম এবার কিছুটা নড়েচড়ে বসল।

– বলছি। আগে তুমি বসো।
বাবা তুমি এখন যথেষ্ট ম্যাচিউরড হয়েছ। বয়স প্রায় আঠারো ছুই ছুই। তাই অনেক সাহস করে তোমার কাছে কথাগুলো বলতে চাচ্ছি।
আমার কেন যেন খুব মনে হচ্ছিল তোমাকে ব্যাপারগুলি জানানো দরকার। বাবা হয়ে ছেলের কাছে এগুলো বলাটা খুবই দৃষ্টিকটু মনে হলেও পরে আমার মনে হল কথাটা তোমাকে না জানালেই বরং তোমার সাথে অন্যায় করা হবে কারণ এর সাথে তোমার নজীবন জড়িত।

– আব্বু, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

– না, মানে! ব্যাপারটা আসলে কিভাবে বলব! ভেবেছিলাম তোমার কাছে বলাটা আমার জন্য সহজ হবে। অনেক কথা গুছিয়ে রেখেছিলাম কিন্তু এখন তো দেখছি এটা বলা খুবই কঠিন আমার জন্য।

– আব্বু, কি হয়েছে বলবে তো!

– না, মানে! ব্যাপারটা আসলে তোমার আম্মুর ব্যাপারে!

-কি করেছে আম্মু?

– সি ইজ ইন লাভ!

– সো?

– তোমার আম্মু একজনের সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছে। সে তাকে বিয়ে করতে চায়।

– আর ইউ সিরিয়াস, আব্বু?

– আমি জানি কথাটি তোমার জন্য মোটেই সুখকর নয়। কোন সন্তানের জন্যই নয়। তুমি কষ্ট পাবে আমি জানি। জেনে-বুঝেই আমি তোমাকে ডেকেছি। যাতে কষ্টটাকে মেনে নেওয়া শিখতে পারো।

আমি বাপ বেটার আলাপ-আলোচনা শুনছি আর মনে মনে হাসছি।

– তোমার মা ব্যাংককে যেয়ে কোন এক হিন্দু লোকের সাথে রিলেশনে জড়িয়েছে। সেই লোক এখন বাংলাদেশে। বেশ কিছুদিন ধরেই বাংলাদেশে আছে। তার সাথে তোমার মায়ের নিয়মিত আড্ডা দেওয়া, ঘোরাফেরা এমনকি বাসা পর্যন্ত নিয়ে এসেছিল। যাই হোক মানুষের বন্ধু থাকতেই পারে তা নিয়ে আমার কোন আপত্তি নেই। কিন্তু আপত্তি ঘটেছে যেটা দেখে সেটাই তোমাকে আমি দেখাবো। তুমি এই ছবিগুলো দেখো।

সেলিম নিজেই তার মোবাইল বের করে একটার পর একটা ছবি প্রিয় কে দেখাচ্ছে। প্রিয় চুপচাপ ছবি দেখা শেষ করল।

প্রিয় কোনো কথা বলছে না দেখে সেলিম তাকে জিজ্ঞেস করল কী কথা বলছ না যে? কী বুঝলে বলো!

– আমি কিছুই বুঝলাম না! শুধু বুঝলাম একটা লোক আই মিন আম্মুর বন্ধুর সাথে আম্মু শপিং করছে, খাওয়া দাওয়া করছে এই তো!

– তুমি অনেক ছোট বাবা। তাই এসব বুঝতে পারছ না। কিন্তু যেহেতু এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে সেক্ষেত্রে তোমার জানা দরকার। এ জন্যই তোমাকে ডাকা।
তুমি আমাদের একমাত্র সন্তান। তাই তোমার সবই জানা উচিত।

– আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। তুমি কী বলবে বুঝিয়ে বলো, আব্বু।

– তোমার আম্মু তার নিজের বিয়ের শপিং করছে। সে আমাদেরকে ছেড়ে যেতে চাচ্ছে। তুমি কি এটা সহজভাবে মেনে নিচ্ছ?

প্রিয় আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আম্মু! আব্বু যেটা বলছে সেটা কি সত্যি?

– বাবা, তোমার আব্বুকে বল তার একটা কমনসেন্স থাকা দরকার ছিল । আমি একজনের বিবাহিতা স্ত্রী হয়ে অন্য জনকে কি করে বিয়ে করি? তোমার বাবার সাথে তো আমার এখন পর্যন্ত ডিভোর্স হয়নি! আর একটা ডিভোর্সের প্রসেস শেষ হতে কতদিন লাগে সেটা নিশ্চয়ই তোমার আব্বু জানে!

– হোয়াট ডু ইউ মিন? তুমি আমাকে ডিভোর্স দিতে চাচ্ছো?

– সেটা কখন বললাম?

– আলাদাভাবে কেন বলতে হবে? তোমার কথা দিয়ে বুঝিয়েই তো দিলে।

– তুমিই তো বললে আমি নাকি সিদ্ধার্থকে বিয়ে করছি। আমি তো একবারের জন্যও এমন কথা বলি নি। আসল কথা হচ্ছে যে যেমন, সে অন্যকেও নিজের মতো করেই ভাবে!

– হোয়াট? আমি আবার কী করলাম?

– প্রিয়, তোমার আব্বুকে মনে করিয়ে দিতে হয় তবে।
তাকে জিজ্ঞেস করো তার পি এস হেলেনের সাথে অফিসিয়াল সম্পর্কের বাইরে আর কী সম্পর্ক তার? তোমার চতুর বাপ মনে করেছে আমি কিছুই জানি না। আমি সবই জানি, সব খবর আমি রাখি।
হঠাৎ করে হেলেনের গায়েব হয়ে যাবার পেছনের কাহিনীও কিন্তু আমি সব জানি। আমি কী তবে মুখ খুলব?

হেলেনের নাম শুনে সেলিম এবার নড়েচড়ে বসল খানিকটা। অবাকই হলো বলা যায়।

– এসব কী বলছ? নিজের অন্যায় ঢাকতে আমাকেই উল্টো ব্লেম করছ?

– সত্যি বলছি, সেলিম । তুমি কী এখন ছেলের সামনে আমাকে ডিটেইলস বলতে বলছ? তবে তুমি অনুমতি দিলে প্রিয়র কাছে আমি সবকিছু জানাতে চাই।

– রূম্পা! চিৎকার করে উঠলো সেলিম।

– চিৎকার করছ কেন? তোমরা পুরুষ মানুষ বলে যা খুশি করে বেড়াতে পারবে। আমরা কিছু করলেই দোষ! তোমরা হাজার অন্যায় করেও পার পেয়ে যাবে। আর আমাদের জন্য জেল জরিমানা!
আগে নিজেকে শোধরাও তারপর না হয় অন্যকে জ্ঞান দিতে এসো। আমাদের মেয়েদের একফোঁটা অন্যায় দেখলে সহ্য করতে কষ্ট হয়। তাহলে ভেবে দেখো দিনের পর দিন আমরা কী করে সহ্য করি? তুমি চাইলেই হেলেনের ব্যাপারটা অস্বীকার করতে পারো। আমি কিছুই বলব না। আমার বলা না বলায় কিছুই পরিবর্তন হবে না। নিজের বিবেকের কাছে প্রশ্ন করো তুমি কী একবারের জন্যও আমার কথা, প্রিয়র কথা, সমাজের কথা, ধর্মের কথা ভেবেছিলে এসব কুকর্ম করার আগে?

– বাজে কথার লিমিট থাকে রূম্পা। ছেলের সামনে নিজের দোষ ঢাকতে কীসব উল্টাপাল্টা বলছ?

প্রিয় ফ্যালফ্যাল করে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকল আমার দিকে।
খানিকটা সময় চুপচাপ থেকে সে তার আব্বু আর আমার দিকে তাকিয়ে ছলছল চোখে বলল,

আমি কোনোদিন ভাবিনি এমন একটা ব্যাপার নিয়ে তোমাদের সাথে আমার কোনোদিন কথা বলতে হবে! পৃথিবীর কোন সন্তানের যেন এমন দুর্ভাগ্য না হয়।
তোমাদের দুজনের সাথে কথা বলে যেটা বুঝলাম তোমরা একসাথে সুখী নয়। এজন্যই একে অপরকে দোষ দিয়েই যাচ্ছ। আমি এখন যথেষ্ট বড় হয়েছি। অনেক কিছুই বুঝি। মোটামুটি যে জ্ঞান আছে সেই জ্ঞানের ভিত্তিতেই এটুকু বলব, তোমাদের যদি একসাথে থাকতে ভালো না লাগে, একজন আরেকজনকে শ্রদ্ধার সাথে দেখতে না পারো তবে শুধুশুধু তিক্ততা আর না বাড়িয়ে আলাদা হয়ে যাওয়াই উচিত। আমি খুব কষ্ট পাব। কিন্তু কিছুই করার নেই। আমি মেনে নিতে চেষ্টা করব। তারপরও তোমাদেরকে এই অসুস্থ সম্পর্ককে টেনে নিয়ে যেতে অনুরোধ করব না। ক্যাডেটে পড়ে এই ক’বছর অনেক কিছু শিখেছি। তোমাদের থেকে দূরে থেকে তোমাদের মূল্যটাও বুঝতে শিখেছি। কিন্তু তোমরা? যাক, সেটা আমার ভাগ্যে নেই হয়ত।
তোমাদের যখন আমার জন্য কোনো ভাবনাই নেই সেখানে কান্নাকাটি করে হাত পা ধরে তোমাদের একসাথে রাখার কোনো মানে নেই।

আমাকে যখন তোমরা জানানোর জন্য ডেকেছই তাই আমি বলব, আম্মু যদি তার বন্ধুকে বিয়ে করে নিজের জীবনটাকে নতুন করে সাজাতে চায় আমি আপত্তি করব না। আমি তোমাদের সুখী দেখতে চাই।
তআমি নিজেই তোমার বিয়েতে উপস্থিত থাকব। আর আব্বুর জন্যও একই কথা। তুমিও যদি কাউকে এ ঘরে এনে আম্মুর জায়গা দিতে চাও আমি একবারের জন্য বাঁধা দিব না।

শেষের দিকের কথাগুলো কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলতে বলতে প্রিয় সেখান থেকে দ্রুত চলে গেল।

আমি প্রিয়র কষ্ট বুঝতে পারছি। কিন্তু কিছুই করার নেই। খানিকক্ষণ থম মেরে বসে থেকে সেলিমের উদ্দেশ্যে কিছুটা আবেগমিশ্রিত গলায় বললাম,

প্রিয়র কথা তো শুনলেই। আমি তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ। প্রিয়কে ডেকে আমাকে চিন্তামুক্ত করলে। আমি নির্ভার হলাম। আমার কাছ থেকে সবকিছু বুঝে নিও। আমার কাছে তোমার যা কিছু আছে আমি সব রেখে যাচ্ছি। যে সংসারে শুধু অপমান আর অপদস্তই হলাম সেখানের কোনো স্মৃতি চিহ্ন আমি আর বয়ে বেড়াতে চাই না।
আমার এত বছরের ভালোবাসা যার কাছে একটা রাস্তার মেয়ের ভালোবাসার থেকে সস্তা সেখানে আর যাই পাওয়া যাক মানসিক সুখ কোনোদিন মিলবে না।
এই আধুনিক যুগে এসেও আমরা নারীরা আজও শৃঙ্খলিত , নিপীড়িত, নির্যাতিত। । অনেকে মুখ খুলে কারো কাছে হয়ত বলতেও পারি না নিজের কষ্টের কথা। প্রতিটি নারী মাত্রই জানে প্রতিনিয়ত কতটা অবহেলা , অসম্মান, অবজ্ঞা আর আত্মসম্মানহীণতার ভেতর দিয়ে দিন পার করতে হয় তাদের।
শুধু পেট ভর্তি খাবার, ভালো পোশাক আর প্রাচুর্যের মাঝেই যদি মানুষের প্রকৃত সুখ মিলত তবে আমি বলতাম আমি সুখী।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here