#সুখের_সন্ধানে
#পর্ব_১৭
– হাজারো অভাবের মাঝেও যদি স্বামী ভাল হয় তাহলে সব কষ্ট মাথা পেতে সহ্য করে নেওয়া যায়। দিন শেষে এতটুকু প্রাপ্তি তো থাকে যে মানুষটার হাত ধরে আমি আজ এতটা বছর পার করলাম সেই মানুষটা আমার, শুধু আমার। তুমি কি করে ভুলে গেলে সেই দিনগুলির কথা? আমাকে পাবার জন্য তুমি কিনা করেছিলে? তোমার সকল মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু ছিলাম আমি! হঠাৎ করে কী এমন হল যে দুজনের মধ্যে এত দূরত্ব চলে এল? ধীরে ধীরে আমার প্রতি তুমি আগ্রহ হারাতে শুরু করলে। নিজেকে নিজের কাছে খুব বেশি অপাংক্তেয় মনে হতে শুরু করল আমার । শুধু ভাবি এ জীবনের কী মূল্য যেখানে এক ফোঁটা ভালোবাসার জন্য আমাকে দিনের পর দিন হাহাকার করতে হয়! দিনের পর দিন অপেক্ষা করেছি তোমার। আর তুমি? এতদিন জানতাম তুমি তোমার কাজ, তোমার ব্যবসা, তোমার সোসাইটি এগুলো নিয়ে ব্যস্ত। প্রতিরাতে বুকভাঙা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে আমি ঘুমাতে যেতাম সেটা কখনো হয়তো তোমার চোখে পড়েনি। দিনের পর দিন একটা মানুষের জন্য অপেক্ষা করতে করতে যখন ক্লান্ত হয়ে পড়েছি তখন নিজের কাছেই নিজে হার মেনে নিয়েছি। নিয়তিকে মেনে নিতে চেষ্টা করি। তোমার দেওয়া অর্থ প্রাচুর্যের মধ্যে সুখ খোঁজার চেষ্টা করেছি।
কিন্তু আমি বোকা ছিলাম। প্রাচুর্যের মধ্যে যদি সুখ থাকতো তাহলে পৃথিবীর প্রতিটি ধনী মানুষ বুকে হাত রেখে বলতে পারতো আমি সুখী। তবে আমিও বলতাম, হ্যা, আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ !
তোমার কাছে সময় চাইলে তোমার সময় হতো না। আমি যে ঘরে একটা মানুষ তোমার জন্য অপেক্ষা করছি আমার মনে হয় না সে কথা কখনো তোমার মাথায় এসেছে! কিন্তু আমার প্রশ্ন হল কেন? কেন এমন হয়েছে? আমি কি চেঞ্জ হয়ে গিয়েছি? আমি তো সেই মানুষটাই আছি। আমার প্রতি তাহলে ভালোবাসা এত ফিকে হবার কারণ কী?
এতদিন ভাবতাম তুমি তোমার কাজকর্ম নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত তাই সংসারের দিকে মনোযোগী হতে পারছ না। কষ্ট পেলেও সে কষ্টটাকে ততটা অনুভব করতাম না যতটা এখন করছি। নিজেকে বড় তুচ্ছ মনে হচ্ছে আমার। যে মানুষটা আমাকে পাগলের মত ভালবাসত আজ সে আমাকে ফেলে রেখে অন্যের কাছে ভালোবাসা খুঁজে। একজন নারী হিসেবে এটা যে আমার কত বড় ব্যর্থতা সেটা তোমাকে বোঝাতে পারব না। আর বোঝাতে পারলেও হয়তো তুমি বুঝবে না।
আমাকে সিদ্ধার্থের সাথে দেখে তুমি সহ্য করতে পারোনি। সিদ্ধার্থের সাথে আমার এমন কোনো সম্পর্ক ছিল না। যা কিছু করেছি তোমাকে দেখানোর জন্য করেছি। যাতে তুমি কিছুটা হলেও আমার কষ্টটা অনুভব করতে পারো। কিন্তু হয়েছে উল্টো। আমাকে দিয়েছ নানান অপবাদ।
তবে হ্যাঁ, সিদ্ধার্থের সাথে আমি চাইলে যা খুশি তাই করতে পারতাম তুমি কখনো জানতে পারতে না। কেন জানতে পারতে না জানো? কারণ আমার প্রতি তোমার কোন খেয়াল ছিল না। আমি কী নিয়ে ব্যস্ত, কোথায় ব্যস্ত, কই যাচ্ছি, কী করছি সেটা নিয়ে তোমার একদমই মাথাব্যথা নেই। সিদ্ধার্থকে আমি ইচ্ছে করে তোমার সামনে হাইলাইট করেছি।
যাক, সবকিছুই আমি আমার নিয়তি হিসেবে মেনে নিয়েছি। তুমি তোমার জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত সুখে থেকো সেই দোয়া করি সবসময়। আমার ঝুলিতে না হয় না লেখা হল কোন সুখের অধ্যায়।
আমি আগামীকাল সকালে চলে যাচ্ছি। প্রিয়কে দেখে রেখো। ও বুঝবে নিশ্চয়ই আমাকে। সে এখন বেশ বড় হয়েছে। তাছাড়া আমি তো একই শহরেই আছি। ও চাইলেই আমার কাছে যেতে পারবে। আর সব সম্পর্কের দাফন হয়ে গেলেও ওর সাথে আমার নাড়ির সম্পর্ক। তাই আশা করছি আমাদের দু’জনের মাঝে খুব বেশি সমস্যা হবে না।
অনেকক্ষণ বকবক করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেলাম আমি। কি বলছি কি না বলছি কিছু জানি না। মুখে যা আসছে বলেই যাচ্ছি। মনে হচ্ছে কথাগুলো বলতে পেরে বুকের মাঝে কিছুটা হলেও হালকা হলো।
এতক্ষণ ধরে সেলিম ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে শুধু আমার কথা শুনছিল। কী বলবে সে? হয়তো তার কাছে বলার মতো কিছু নেই।
– আমি ডিনারের জন্য নিচে গেলাম। আজ নিজের হাতে ডিনার রেডি করতে চাই। আজ এ বাড়িতে আমার শেষ রাত। আশা করছি খুব ভালো একটা সময় কাটবে আমাদের। পেছনের সব তিক্ততাটুকু মুছে ফেলে নিশ্চয়ই একজন আদর্শ স্বামী হিসেবে বাকিটা সময় পাশে পাব।
কথাগুলি বলে এবার আর নিজের আবেগকে রোধ করতে পারলাম না।
কাঁপা গলায় কথাগুলো বলতে বলতে গলাটা বুজে আসছিল বারবার। কান্নাগুলি দলা পাকিয়ে বেরিয়ে আসার আগেই দ্রুত প্রস্থান করলাম সেখান থেকে।
ডিনার রেডি করে মেইডকে বললাম সেলিম আর প্রিয়কে ডাকতে। টেবিলে খুব বেশি সময় অপেক্ষা করতে হলো না। প্রিয় আর ওর বাবা প্রায় একই সময়ে এসেছে।
টেবিলে আয়োজন দেখে বাপ ছেলে দু’জনেই অবাক। সব আইটেমই সেলিম আর প্রিয়র পছন্দের আইটেম। খুব বেগ পেতে হয়েছে আমার এগুলি করতে। আজ ইচ্ছে করেই একদমই কারো হেল্প নেই নি।
একসাথে বহুদিন পর ডিনার করছি তিনজন। খাওয়ার টেবিলে একদমই কথা হলো না সেলিমের সাথে। প্রিয় টুকটাক যা দু’একটা কথা বলেছে এই আর কী! সেলিম রুমে যাবার পর প্রিয় এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল।
– আমি খুব খুশি হয়েছি, আম্মু। তুমি আব্বুকে তবে ক্ষমা করে দিয়েছ!
– কে বলল, ক্ষমা করে দিয়েছি।
– কাউকে বলতে হবে কেন? আব্বুর পছন্দের সব আইটেম করেছ। তুমি খেয়াল করেছ আব্বুও কত মজা করে তার পছন্দের আইটেমগুলি খেয়েছে। আব্বু মুখে কিছু না বললেও আমি ঠিকই বুঝেছি। আমি জানি তুমি আব্বুর উপর রাগ করে থাকতেই পারবে না।
– বাবা, আমি আগামীকাল সকালে এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি। এ জন্য ভাবলাম তোমাদের জন্য স্পেশাল কিছু করি। সিদ্ধান্ত নিয়েছি বাকী জীবনটা তোমার নানুর বাড়িতেই থাকব। কারো দয়া দাক্ষিণ্যে আর বাঁচতে চাই না। ওখানে আমি আমার বাবার বাড়িতে থাকব। খেয়ে থাকি না খেয়ে থাকি দিন শেষে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে ঘুমুতে যেতে পারব। হয়ত তোমার মামা মামির কাছে বোঝা মনে হতে পারে, বাট আই ডোন্ট কেয়ার! আমি তোমার মামা বা মামির কারো দয়ায় সেখানে থাকব না। নিজের বাবার সম্পত্তিতে থাকব সো তাতে কারো মন খারাপ হলে করার কিছুই নেই। আমি অলরেডি তোমার মামা আর টুম্পা মায়ের সাথে কথা বলেছি এ ব্যাপারে। এটা ঠিক এখানের মতো লাক্সারিয়াস লাইফ লিড করতে পারব না আমি। হয়ত তিন বেলার জায়গা একবেলা পেটপুরে খাওয়া হবে। কিন্তু তাতে কী! এটা ভেবে তো কষ্ট পাব না যে কেউ আমার পিছপিঠে তলোয়ার বসাচ্ছে, আমাকে প্রতিনিয়ত ধোঁকা দিচ্ছে। তখন ভাবব আমার কেউ নেই। এই পৃথিবীতে আমি একা।
কথাগুলি বলতে বলতে চোখের পানি আটকাতে পারলাম না আর। দরদর করে বয়ে চলছে চোখের নোনা পানি।
– প্রিয় এগিয়ে এসে আমার চোখের পানি মুছিয়ে দিতে দিতে বলল, আমিও তোমার কেউ নই?
– তুমিই তো আমার সব, বাবা। তুমি তো আমার অস্তিত্বের সাথে মিশে আছ। তাই তোমাকে আমি কখনোই আলাদা করে ভাবি না। তোমার জন্যই আমি বেঁচে আছি , বেঁচে থাকব। না হলে আরো আগে হয়ত তোমার বাবাকে মুক্ত করে দিয়ে নিজেও মুক্ত হয়ে যেতাম । এখানে কোনোদিন নূন্যতম সম্মান আমি পাইনি। তোমার দাদা আমাকে সাপোর্ট করেছিল বিধায় আমি আজও এখানে আছি। তোমার দাদীর চোখে আমি সারাজীবনই তোমার আব্বুর জন্য অযোগ্য একজন মানুষ, এই ঘরের জন্য অযোগ্য একজন বউ। তোমার আব্বুর কাছেও হয়ত ধীরেধীরে এটাই মনে হতে থাকে। তাই তো কোনোদিন চেষ্টা করেনি আমার সম্মানটুকু বজায় রাখবার মতো পরিস্থিতি তৈরি হোক। সেও তার মা, ভাই, বোনের সাথে তাল মিলিয়ে আমাকে এক সাইড করে রেখে দিয়েছে। হয়ত শুধুমাত্র তোমার মা সেই পরিচয়টুকু আমার সাথে আছে বলেই আমি এখনো পর্যন্ত এই বাড়ির ছাদের নিচে বসে আছি। কিন্তু বাবা, আমিও তো মানুষ! আমারও আত্মসম্মানবোধ আছে। তারপর সবই মেনে নিয়েছিলাম কিন্তু তোমার আব্বু এখন যেসব করছে সেটা মানতে পারছি না। বোঝই তো ! বয়স হয়েছে। বিভিন্ন ধরণের হরমোনাল চেঞ্জ আসছে। তাই হয়ত আগের মতো নিতে পারি না এত অপমান । এখন তুমি বড় হয়েছ। একা থাকতে শিখেছ । তাই এখন আর তোমাকে নিয়ে চিন্তা নেই। তাছাড়া সবাই তোমাকে আদর করে। আর আমি তো মরে যাচ্ছি না। পৃথিবীর সব সম্পর্ক শেষ হয়ে গেলেও আমি যতদিন বেঁচে থাকব তোমার মা হয়েই বেঁচে থাকব। এই সত্য চন্দ্র, সূর্যের মত সত্য। এখানে কোনো মান, অভিমান, সত্য , অসত্যের স্থান নেই।
– প্রিয় কান্নাজড়িত কণ্ঠে আমার বুকের সাথে লেপ্টে গিয়ে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, তার মানে তুমি আব্বুকে ক্ষমা করতে পারোনি ,আম্মু?
– কাঁদছ কেনো? বোকা ছেলে! তুমি কাঁদলে কী করে হবে? তুমিই তো আমার শক্তি। আমি তোমার আব্বুকে ক্ষমা করে দিয়েছি তো! মেয়ে মানুষের আর ছেলে মানুষের মাঝে পার্থক্য কী জানো? একটা মেয়ে তার হাজবেন্ডের হাজার দোষও মাফ করে দেবার মতো মানসিকতা রাখে, কিন্তু ওই মেয়েই যদি তার হাজবেন্ড যে অন্যায় করেছে তার সিকি ভাগও করে তখন সেই মেয়েকে ক্ষমা করার বদলে তার উপর দিয়ে যে কী পরিমাণ তুফান বইয়ে দেওয়া হয় সে ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।
– তাহলে কেন চলে যাবে আমাদের ছেড়ে?
– আরে বোকা! যাচ্ছি কোথায়? আমি তো মরে যাচ্ছি না। আমি তোমার আব্বুকে মুক্তি দিয়ে যাচ্ছি। তোমার আব্বুকে আমি প্রচণ্ড ভালোবাসি , বাবা। সেই মানুষটা আমার উপস্থিতি সহ্য করতে না পেরে যখন এভাবে কষ্ট পেতে থাকবে । প্রতিনিয়ত এটা আমি কী করে সহ্য করব? তুমি বল! তাছাড়া এভাবে নিজেকে আর ছোট করতে ইচ্ছে হচ্ছে না। যুদ্ধ করে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখবার চাইতে সেই অস্তিত্ব না রাখাই ভালো। আমি যুদ্ধ চাই না , একটু শান্তি চাই।
– কিন্তু আমি?
– তুমি এতে ইউসড টু হয়ে পড়বে। তোমার বন্ধু সাদমানের মা তো ওকে সেই ছয় বছরের রেখে চলে গিয়েছে। ওর কি কোনো কিছু থেমে থেকেছে। ও তো ঠিকই বড় হয়েছে। হয়ত ওর মানসিক বিকাশ কিছুটা হলেও বাঁধাগ্রস্ত হয়েছে । কিন্তু তোমাকে নিয়ে সেই ভয় নেই। সেই বয়স তুমি পেরিয়ে এসেছ। প্রথমে খুব কষ্ট লাগবে। কিছুদিন পরে ওকে হয়ে যাবে সবকিছু। এখন আর কান্নাকাটি , কথা কিছুই হবে না। চল, রুমে যাই। সকাল ছ’টায় তোমাকে বেরুতে হবে। তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়তে হবে। আমি তুমি যাবার পরেই আমি বের হবো। তোমার কষ্ট হবে না , বাবা।
প্রিয় কাঁদতে কাঁদতে বলল, তাহলে পরেরবার আসার পরে বাড়িতে এসে যখন দেখব কেউ আমার জন্য হাসিমুখে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে না তখন আমার কেমন লাগবে?
– তুমি সরাসরি নানুর বাসাতে চলে আসবে। আমি সেখানে তোমার অপেক্ষায় থাকব। এখন আর কথা না । তাড়াতাড়ি ঘুমাতে যাও। আমিও একটু ঘুমাব। সারারদিন খুব দৌড়াদৌড়ি হয়েছে আমার। তোমারও তাই। সো , ঘুমাতে চলো, প্লিজ। আর এ বিষয়ে কোনো কথা না একদম।
ডাইনিং চেয়ার থেকে উঠে পেছনে ফিরতেই দেখলাম আমাদের ঠিক পেছনে দোতলায় উঠার সিঁড়ির নিচের একটা ধাপে সেলিম চুপচাপ বসা। সেলিম কখন এল আমি টেরই পাইনি। তার মানে আমাদের সব কথা সে এতক্ষণ শুনেছে। ভীষণ লজ্জা লাগছে ভেবে। আমি আর কোনো কথা না বলে চোরের মতো দ্রুত সেলিমের দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিলাম।
কিছুটা জোর করেই প্রিয়কে নিয়ে ওর রুমে শুইয়ে দিয়ে আমিও রুমে গেলাম। সেলিম তখনো আসেনি। আমি চুপচাপ ছোট একটা লাগেজে আমার খুব প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র প্যাক করে নিলাম। এসব দামী শাড়ি , অর্নামেন্টস, জুতা, কসমেটিকস এগুলিতে একদমই কোনো মোহ কাজ করছে না। ভাইয়া বলেছে নিচ তলাটা আমাকে ছেড়ে দিবেন। বেঁচে থাকার জন্য যদি কিছু করতে নাও পারি আমি কর্ণারের দিকের একটা রুমে থাকব আর বাকী তিনটা রুম ভাড়া দিয়ে নিজের মৌলিক চাহিদা অন্ততপক্ষে মেটাতে পারব। তাই শুধু শুধু এত এত মালপত্র টেনে নিয়ে ঘর দখলের কোনো মানে নেই। তাছাড়া এসব উচ্চবিলাসী জীবন থেকে মুক্তি চাই। এসবের মাঝে নিজের সুখ খুঁজে আর বোকামি করতে চাই না।
রাত বেশ হয়েছে। ঘুম আসবে কি না জানি না। তবুও ঘুমানোর জন্য কিছুটা চেষ্টা করছি। সেলিম তখনও আসেনি রুমে। হয়ত সে আমার সাথে আর থাকতেই চায় না। ভালোই হয়েছে ও আসলে আমারও কেমন সাফোকেশান ফিল হতো। এ বাড়িতে থাকা শেষ কয়েকটা মুহূর্ত একটু স্বস্তির দম নিতে চাই। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম টের পাইনি।
পায়ের উপর কিছু একটা অনুভূত হওয়ায় আমি লাফিয়ে উঠলাম ।
তাড়াতাড়ি টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে উঠে বসলাম। বসে অবাক হয়ে দেখলাম আমার পায়ের কাছে বসে আছে সেলিম। ফুঁপিয়ে কাঁদছে সে। আমার পা দু’টি তার চোখের নোনাপানিতে সিক্ত। কিছুটা ভয় পেয়ে গেলাম। সেলিম আমার পায়ের কাছে বসে আছে! এটা কী করে সম্ভব? আমি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না। আমি যে লাইট জ্বালিয়েছি বা উঠে বসেছি কোনোদিকেই খেয়াল নেই সেলিমের । সে মাথা উপুর করে বসে ফুঁপিয়েই যাচ্ছে।
আমি কী করব বুঝতে পারছি না। কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়ার মতো করে বললাম ,
– এ … … এ….ই করছ কী? এভাবে এখানে বসে আছ কেন?
সেলিম চোর ধরা পড়ে যাবার মতো অবস্থায় পড়েছে। সে ভীষণ লজ্জা পেয়েছে মনে হলো। তাড়াতাড়ি নিজেকে আড়াল করতে যেন মরিয়া। দ্রুত নিজেকে সামলে নিতে চেষ্টা করতে যেয়ে যেন আর বেশি ধরা পড়ে গেল।
সেলিমের চোখদুটি টকটকে লাল। তাকে দেখে মনে হলো বেশ কতক্ষণ ধরে কান্নাকাটি করেই এই হাল করেছে । আমি বেশ অবাক হলাম। আমার মনে পড়ছে না কখনো সেলিমের চোখে পানি দেখেছি এত বছরে। খুবই কঠিন হৃদয়ের মানুষ সেলিম। ওর কোনো আপনজনের মৃত্যুতেও ওকে কাঁদতে দেখিনি। সেই সেলিমের চোখে পানি দেখলে আমার জায়গা অন্য কেউ হলেও অবাক হতো!
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম রাত সাড়ে তিনটা । সেলিম অপরাধীর ভঙ্গিতে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ওকে দেখে কেন যেন মায়া হচ্ছে খুব। লোকটার মধ্যে প্রচুর অহংকারবোধ আর ইগোতে ভরপুর। কখনই কারো সামনে ছোট হতে সে রাজী না। কিন্তু ওর কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে দাঁড়ানো দেখে মনে হলো পুরাই অন্য মানুষ। তাকে দেখে মনে হলো সে কিছু বলবে আমাকে।
আমি নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে আস্তে করে তাকে বললাম, তুমি ঘুমাওনি?
সেলিম নিশ্চুপ দেখে আবার জিজ্ঞেস করলাম, কিছু কী বলবে?
– নাহ, ঘুমাইনি।
– কেনো? আর একটু বাদেই ফজরের আযান হবে।
– এরপরে সূর্যের আলোয় আলোকিত হবে পুরো পৃথিবী, তাইনা!।
– হুম, সেটাই তো হয় রোজ!
– কিন্তু আমার পৃথিবী অন্ধকারই থেকে যাবে। আগামীকালের সূর্য আমার জন্য কোনো নতুন ভোর নিয়ে আসবে না।
– এ কথা কেন বলছ ? সূর্য সবার জন্য । সে তো সবার জন্যই নতুন ভোর নিয়েই আসে। কারো জন্য ভেদাভেদ সে কখনো করে না, নিঃস্বার্থভাবে আলো বিলানোর জন্যই তার জন্ম। কারো উপর তো তার কোনো রাগ ক্ষোভ নেই।
– সূর্যের আলোয় আলোকিত হয়েই আমরা আমাদের জীবনকে আলোকিত করি। অথচ সূর্যের থেকে দীক্ষা গ্রহণ করার মত মানসিকতা আমাদের কেন নেই?
– আমি বুঝতে পারছি না তোমার কথা। কী বোঝাতে চাচ্ছ?
– সূর্যকে প্রতিদিন দেখছি কিন্তু কিছু কি শিখছি?
– আমি এখনো বুঝতে পারছি না তোমার কথা।
– তুমিই বললে সূর্য নিঃস্বার্থভাবে আলো বিলিয়ে নিজেকে উজার করে দেয়। সে না আসলে পৃথিবী আলোকিত হয় না। পুরো পৃথিবী আধারেই ছেয়ে থাকে। আমার জীবনেও তুমি আমার সূর্যের মতো। তবে তুমি কেন এভাবে আমার পৃথিবী অন্ধকার করে দিতে চাচ্ছ? কেন উদার হতে পারছ না। আমি মহাপাপী , আমি তোমার সাথে অনেক অন্যায় করেছি আমি অস্বীকার করছি না । আমার জন্য কী একটু ক্ষমা হতে পারে না?
– এসব কী বলছ তুমি? আমার চলে যাবার সাথে তোমার পৃথিবী অন্ধকার হবার কী আছে? আমি তোমার জীবনের এমন কোনো ইম্পর্ট্যান্ট কেউ না। হয়ত সাময়িক কিছু প্রবলেম ফিল হবে। এত বছর পাশাপাশি থেকেছি একটু খারাপ লাগা তো ফিল হতেই পারে। কিন্তু তার মানে এই নয় আমি তোমার পৃথিবী অন্ধকার করে দিয়ে যাচ্ছি। আমি চলে গেলে সেখানে অন্য কাউকে বসাতে পারবে। তোমার পৃথিবী আলোয় আলোয় ঝলমল করবে। হয়ত ততটা আলো কোনোদিনই আমি ছড়াতে পারিনি তোমার জীবনে।
– এসব কথা আর বলো না। আমার কাটা ঘায়ে আর নুনের ছিটা দিয়ে ক্ষত বিক্ষত করো না। আমাকে এমন পানিশমেন্ট দেবার কথা ভেব না, প্লিজ। আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি। আমি কাউকে চাই না তোমার জায়গায়। আমি ভুল করেছি। ভীষণ ভুল করেছি। আমাকে অন্য যেভাবে চাও শাস্তি দাও বাট এ বাড়ি ছেড়ে যাবার কথা কখনো বলো না। আমি আর আমাদের ছেলে প্রিয় ভীষণ একা হয়ে পড়ব। দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা বুঝিনি। এটাই আমাদের সমস্যা। আমি তোমার সম্মান রক্ষা করতে পারিনি। সব সময় তোমাকে ছোট করে ভেবেছি। তোমার কষ্টগুলিকে কখনো বুঝতে চেষ্টা করিনি।
– প্লিজ, এসব কথা বলে আমাকে দুর্বল করো না। আমি পারব না তোমার কথা রাখতে। তুমি আমার থেকে সেদিনই দূর হয়ে গেছ , পর হয়ে গেছ যেদিন তোমার বেডে অন্য নারী এসেছে।
– আ’ম সো সরি, সো সরি। প্লিজ, সব ভুলে নতুন করে আমরা জীবনটাকে সাজাব কথা দিলাম। আমি কখনোই এমন ভুল পথে পা বাড়াব না। কথা দিলাম তোমাকে। এরপর কোনোদিন এমন ভুল তোমার চোখে পড়লে নির্দ্বিধায় তুমি আমাকে যেকোনো শাস্তি দিও।
– বাহ, সেম ভুল যদি আমি করতাম? ধরো , আমি যদি অন্য কারো সাথে আমার বেড শেয়ার করতাম, পারতে আমাকে সব ভুলে মেনে নিতে?
– সেলিম নিশ্চুপ।
– দেখেছ , এটাই তোমাদের সমস্যা। তোমরা নিজের বেলায় ষোলোআনাই ঠিকঠাক চাও বাট বউয়ের বেলায় ?
– আমি যে পাপ করেছি , পাপ করে কী এক মানসিক দ্বন্দ্বে ভুগছি আমি কোনোদিনই চাই না ভুল করেও তুমি এই পাপের পথে পা বাড়িয়ে সেই একই কষ্ট ভোগ করো। এ কষ্ট তুমি সহ্য করতে পারবে না। জানি তুমি অনেক কষ্ট সহ্য করেছ জীবনে কিন্তু এই কষ্ট তোমার কষ্টের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। কী যে বিশ্রী আর জঘণ্য যন্ত্রণা! নিজের চোখে নিজে চোখ মেলাবার সাধ্য নেই, সেখানে স্ত্রী, সন্তান , মা ,বাবা তো দূরের কথা। আমি কতটা অন্তর্জ্বালায় ভুগছি সেটা তুমি অনুভব করতে পারবে না।
– নিজের ভুল অনুভব করছ জেনে খুব ভালো লাগছে। এখন দেখবে সময়ের সাথে সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে। তোমার ভেতরের কষ্টও লাঘব হবে।
– আমিও বিশ্বাস করি সেটা সম্ভব । তবে যদি তুমি আমার পাশে থাকো। তুমি সাথে থাকলে আমি সব ভুলে তোমার সাথে নতুন স্বপ্ন দেখব। জীবনটাকে ঠিক তেমনি করে সাজাব ঠিক যেমন স্বপ্ন আমরা দেখেছিলাম আমাদের শুরুর দিনগুলিতে।
– আমাকে প্লিজ এভাবে লোভ দিও না। এই লোভের পাল্লায় পড়েই এত বছর পার করে দিলাম। কিন্তু প্রাপ্তির খাতা শূন্য। সেই শূণ্য নিয়েই আপাতত খুশি থাকতে চেষ্টা করছি। শূণ্যকে মাইনাস ফিগারে নেওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই আর। তাহলে একদমই সহ্য করতে পারব না। বেঁচে থেকেও মরে যাব। আমাকে বোঝার চেষ্টা করো।
– তুমি আমাকে বোঝার চেষ্টা করো , রূম্পা।
চলবে….
পর্ব-১৬
https://www.facebook.com/111576077291737/posts/349199850196024/