#সুখের_সন্ধানে
#পর্ব_২
বান্ধবীদের কাছে আমার সমস্যার কথা বলতে গেলে ওদের একটাই কথা, “খবর নিয়ে দেখ তোর জামাই অন্য মেয়ের সাথে টাংকি মারে কি না।” কিন্তু কেন যেন আমার সেটা বিশ্বাস হয় না। সেলিম কাজ পাগল মানুষ। কাজের মধ্যে ডুবে থাকতে ভালোবাসে। তারপরেও সবার কথা শুনতে শুনতে কেন যেন একটু নিজের মনের মধ্যে সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করল।নানান ভাবে জানতে চেষ্টা করলাম আসলেই সেলিম অন্য কাউকে পছন্দ করে কি না! কিন্তু তেমন কিছু পেলাম না। তবে ওই যে মনের মধ্যে সন্দেহের বীজ দানা বেঁধেছে তাই কিছুতেই মনকে শান্ত করতে পারছি না। সেলিমের অবহেলার কথা মনে পড়লেই মনে হয় সত্যিই সে হয়তো অন্য কোন নারীর প্রেমে আসক্ত।
সত্যিই যদি আসক্ত হয় আমার কিছু করার থাকবে না। সেলিমের আর আমার মাঝে এখন বিশাল তফাৎ। দুইজন যেন দুই মেরুর বাসিন্দা। বয়সটা তো কম হলো না। তাই এখন আর এসব ভাবতেই পারি না।
কান্তা নামে একজন বান্ধবী আছে। ওর সাথে কয়েকদিন ক্লাবেও গিয়েছি নিয়মিত। হতাশা কাটিয়ে উঠতে আর সময় কাটাতে এসব জায়গার জুড়ি মেলা দায়। ঘন্টার পর ঘন্টা ক্লাবে বসে তাস খেলে কাটিয়ে দিচ্ছি আমরা। নতুন নতুন আরও অনেক ফ্রেন্ড সার্কেল হয়ে গেল। সবার মধ্যেই কোন না কোন হতাশা কাজ করছে। তবে আমি মনে হয় সবার থেকে আলাদা। সবার মাঝেই না পাওয়ার কষ্ট। ধীরে ধীরে এদের মাঝে আমিও কেমন যেন মিলিয়ে যেতে শুরু করেছিলাম। কিন্তু কয়েক দিন যেতে না যেতেই দেখলাম এটা খুবই খারাপ অভ্যাস।আমি আসক্ত হয়ে যাচ্ছি এসবের মাঝে। এখান থেকে এখনই বের হতে না পারলে ভবিষ্যতে হয়তো আরও বেশি নরক যন্ত্রণা সহ্য করার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। এসব থেকে বাঁচার জন্য উপায় খুঁজছিলাম।
হঠাৎ মনে হল কিছুদিনের জন্য দেশের বাইরে থেকে বেরিয়ে আসা যায়।
আমার আরেক ফ্রেন্ড নীরা, ও মাঝেমাঝেই দেশের বাইরে যায়। হাজব্যান্ড আর বাচ্চাদের নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। ওর বাসা আর ওর মায়ের বাসা একি বিল্ডিংয়ের জাস্ট উপর-নিচে হওয়ায় ও বাচ্চাদের নিয়ে একদম চিন্তা মুক্ত। মুক্ত বিহঙ্গের মতো উড়ে বেড়ায় সে। তার হাজবেন্ড বলতে বলতে এখন ক্লান্ত। এখন আর কিছুই বলে না। নীরা ছোটবেলা থেকেই ডেয়ারিং স্বভাবের। দেখতে শুনতে মোটামুটি হলেও নিজের স্মার্টনেস দিয়ে যেটুকু ঘাটতি সেটুকু ঢাকার প্রচেষ্টা তার আজীবনের। জীবনে কয়েক ডজন প্রেম করে পরে বিয়ে করেছে মা বাবার পছন্দে। নীরার হাজবেণ্ড খুবই সরল আর ভদ্র। বিয়ের পরেও নীরার শোধরানোর কোনো নাম নেই। বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে। আদরে আদরে বাদর হলে যা হয়। লাইফটাকে কখনই সিরিয়াসভাবে নেয়নি। যখন যেখানে মনে চায় সেখানেই চলে যায়, রাত করে বাসায় ফিরলেও কারো কাছে জবাবদিহি করতে সে নারাজ। বিয়ের পরপরই ছেলেটা কন্সিভ করে। ছেলেটাকে কোনো রকম পেট থেকে বের করেই সে আবার সেই একই রকম। মায়ের ঘাড়ে বাচ্চার দায়িত্ব দিয়ে সে কর্পোরেট জগতে ঢুকে যায়। কাউকে কেয়ার করার সময় তার নেই। নীরার হাজবেন্ড ছাপোষা ঘরের সন্তান। তার কাছে প্রথম থেকেই নীরার আচরণ দম বন্ধ করার মতো মনে হলেও বাচ্চাটার কথা ভেবে নিজের জীবন কোরবানি দিতে প্রস্তুত হয়। ছেলে জন্মের পরপরই স্থায়ীভাবে মা বাবার সাথে এসে থাকছে নীরা। একসময় তো আসতেই হতো। তার বাবার নিজের বাড়ি মিরপুরে। ছেলের জন্মের ঠিক দেড় বছরের মাথায় ওর মেয়ের জন্ম। বাচ্চাদের নিয়ে তার কোনো আহ্লাদিপনা নেই। ছেলেমেয়ে দুইটার দায় দায়িত্ব বাবা, মা আর হাজবেন্ডের ঘাড়ে চাপিয়ে সে মুক্ত বিহঙ্গ। নীরার হাজবেন্ড এখন ছেলেমেয়ে দুইটার দিকে তাকিয়ে সব মেনে নেয়। নীরার কাছ থেকে সে কী পাবে এটা বোঝা হয়ে গেছে। বাচ্চা দুটিই তার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। তবে নীরার মা বাবা নীরার হাজবেন্ডকে জামাইয়ের থেকে ছেলের চোখেই দেখে বেশি। মেয়ের এমন আচরণে তারাও বিরক্ত। ভেবে ছিল বিয়ের পরে হয়তো নীরা বদলাবে কিন্তু তাদের ভাবনা আর সত্যি হলো না। নীরা নীরার মতোই রয়ে গেল। নীরার হাজবেন্ড নিতান্ত ভালো মানুষ বলে এগুলি সহ্য করে ওকে মেনে নিয়ে এখনো সংসার টিকে আছে। অন্য কোনো পুরুষ হলে কবেই ওকে ডিভোর্স দিয়ে চলে যেত। শুধুমাত্র বাচ্চাদের মুখের দিকে তাকিয়ে নীরার সাথে এখনো সংসার করছে। সবকিছুকে নিজের ভাগ্য বলে সে মেনে নিয়েছে। নীরা যা খুশি করে এ নিয়ে এখন একদমই প্রশ্ন তোলে না সে। নীরাকে ওর হাজবেন্ড বা মা, বাবার কাছে কিছুর জন্যই হাত পাততে হয় না । ও ওর নিজের মতো করেই খরচ করে। ওকে দেখলে মনেই হয় না যে ওর ছেলে ক্লাস টেনে পড়ে আর মেয়ে ক্লাস এইটে। চলাফেরা এখনও একদম সেই টিনেজদের মতো। ওকে নিয়ে আমরা কত যে হাসাহাসি করি কিন্তু এদিকে ওর কোন খেয়ালই নেই। আড্ডা মাস্তি , ক্লাব সবই চলে দেদারসে।
স্কুল লাইফ থেকে একসাথে পড়াশুনা করেছি আমরা । ওকে সারাজীবন কিছুটা এভয়েড করে চলার চেষ্টা করেছি। আম্মু একদমই পছন্দ করতেন না ওকে। কিন্তু ও মানুষ হিসেবে যেমনই হোক বন্ধু হিসেবে বেশ ভালোই। মাঝখানে বেশ কিছুদিন ওর সাথে খুব বেশি যোগাযোগ না থাকলেও হঠাৎ করে ইদানিং আবার খুব যোগাযোগ বেড়ে গিয়েছে। প্রায়ই আড্ডা হয় , কথা হয়। ক্লাবে যেয়েই মূলত ওর সাথে সম্পর্কটা ভালো হয়েছে আগের থেকেও। আমার কষ্টের কথাগুলি খুব মনোযোগ দিয়ে সে শুনে। ইদানীং আমার খুব ভালো লাগে এজন্য ওকে। কোথাও তো তবু কষ্টের কথা বলতে পারি।
ও আমাকে বলল ওর সাথে কিছুদিন বাইরে থেকে ঘুরে আসলে আমার মন ভালো হবে। নেক্সট মাসে নীরার তিন দিনের ছুটি আছে। সেই সাথে আরো দুদিন ছুটি বাড়িয়েছে। সে ব্যাঙ্ককে যেতে চায়। ওর হাজব্যান্ড বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ এ বেশ বড় পোস্টে জব করে । তাই ওর টিকেট পাওয়াটা খুব সহজ। বেশিরভাগই ফ্রী টিকেটে ঘোরাঘুরি করে। এজন্যই দেশের বাইরে যাওয়াটা ওর জন্য খুব সহজ। আমিও ওর প্রস্তাব লুফে নেই। কিছুদিনের জন্য হলেও মনটাকে ভালো করে আসা যাবে।
আমি ব্যাংককে যেতে চাই এ কথা শুনে সেলিম কিছুক্ষণ অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। প্রথমে বুঝতে পারছিলাম না সে হ্যাঁ বলবে নাকি না বলবে!
আমার আগ্রহ বোঝার জন্য হয়তো সে খানিকটা অপেক্ষা করছিল উত্তর দেবার জন্য।
কোনও উত্তর দিচ্ছে না দেখে আমি আবার বললাম,
– কি ব্যাপার কিছু বলছ না যে?
– এত দূরে যাবে তাও একা একা । তুমি সামলাতে পারবে?
– কেন পারব না? আমি তো কোনো বাচ্চা নই! তাছাড়া নীরা যাচ্ছে তো। আমি একা কোথায়?
– নীরা মানে তোমার ক্লাবের বান্ধবী, তাই না!
– ক্লাবের ঠিক না। ওকে আমি আগে থেকেই চিনতাম। আগে সম্পর্কটা তত ভালো ছিল না। ক্লাবে যাবার পরে আমাদের সম্পর্কটা মজবুত হয়েছে। ও আর আমি একসাথেই পড়াশুনা করেছি ছোট থেকেই।
– তোমার কি মনে হয় তুমি ম্যানেজ করতে পারবে? যদি পারো, দেন যাও। আই হ্যাভ নো প্রবলেম।
সেলিমের অনুমতি পেয়ে আমার খুশি হওয়ার কথা ছিল কিন্তু কেন যেন আমি খুশি হতে পারছিলাম না। সেলিম তো একবারের জন্য হলেও বলতে পারত “নীরার সাথে তোমার যেতে হবে না, তোমার ব্যাংককে যাবার ইচ্ছে হয়েছে, আমি তোমাকে নিয়ে যাব। ”
নাহ ,সেলিমের কাছে এতটুকু আশা করা খুব বেশি হয়ে গেল।
নীরার সাথে চলে এলাম ব্যাংককে। নীরা আগে ব্যাংকক এলেও আমার জন্য এই প্রথম। থাইল্যান্ড সময় ভোর পাঁচটায় আমরা ব্যাংককের ডনমুয়েং আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে পৌঁছাই। সিদ্ধার্থ নামের এক ছেলে এসে আমাদের ওয়েলকাম করল। সিদ্ধার্থের ভাষা শুনে আন্দাজ করার উপায় নেই যে সে পশ্চিমবঙ্গের । কথাবার্তার ধরণ একদম বাংলাদেশীদের মতই। সিদ্ধার্থের কথা আমাকে নীরা আগেই বলেছিল। দেখতে শুনতে খুব হ্যান্ডসাম। বলিউডের হিরোদের মত লুক। তাই বয়সটা ঠিক আন্দাজ করতে পারলাম না। আমাদের থেকে খানিকটা ছোট হবে এটা ঠিকই আন্দাজ করতে পারছি। সহাস্যে কথা বলছে পুরোটা সময় ধরেই। এমন ছেলেকে দেখে যে কোনো কিশোরী এক চান্সে প্রেমে পড়ে যাবে। হৃদয়ে ঝড় তোলার মতই সুদর্শন সে। নীরা ওর সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলো। সিদ্ধার্থের বেড়ে ওঠা বাংলাদেশেই। ওর মামারা নীরাদের বাসাতেই ভাড়া থাকত সেই সুবাদে নীরার সাথে বেশ আগে থেকেই পরিচয় তার।
সিদ্ধার্থ এখানে কী নাকি ব্যবসায় করে। আমাদের হোটেলে পৌঁছে দিয়ে সে চলে গেল। হোটেলে পৌঁছে আমি অবাক। চল্লিশ তলা একটা হোটেলে উঠেছি আমরা।
হোটেলে পাশাপাশি রুম আমাদের। আমি ভেবেছিলাম এক রুমেই থাকব। কিন্তু নীরা বলল, ঘুরতে এসে কিছুটা প্রাইভেসিরও দরকার আছে। দু’জন দু’জনের মতো থাকাটাই বেটার। আমিও আর কথা বাড়ালাম না। ভেবেছিলাম পুরো সময় ওর সাথে গল্প করে কাটানো যাবে। এখানে এসেও যদি সেই একাই থাকতে হয় তবে আর লাভ কী হলো? কিন্তু যেহেতু নীরা একা থাকতে পছন্দ করে তাই আর কথা বাড়ালাম না।
রুমে এসে মনে হলো সেলিমকে জানানো দরকার আমরা পৌঁছেছি। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে মনে হলো ও এখনো হয়তো ঘুমাচ্ছে তাই আর ফোন না দিয়ে একটা মেসেজ করে রাখলাম।
” সেইফলি রিচড”!
সকাল দশটার দিকে আমরা বের হলাম ব্যাংকক শহর ঘোরার উদ্দেশ্যে। আমাদের প্রথম গন্তব্য ‘দ্যা রয়্যাল গ্র্যান্ড প্যালেস’! গেটে পৌঁছাতেই দেখি সিদ্ধার্থ আছে সেখানে। বুঝতে পারলাম আমাদের জন্যই অপেক্ষা করছে। থাই রাজার বাসভবন এই গ্র্যান্ড প্যালেস। খুব সুন্দর জায়গা। প্রসাদের মাথা থেকে সোনা যেন গলে গলে পড়ছে। আমাদেরকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাচ্ছে সিদ্ধার্থ! নীরাকে কিছুই দেখাতে বা বলতে হচ্ছে না। একাই আগে আগে হাঁটছে আর সবকিছু খুব মনোযোগ সহকারে দেখছে। সিদ্ধার্থ মূলত আমাকেই সবকিছু ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছে।
প্রথম কিছুটা অস্বাভাবিক লাগলেও সিদ্ধার্থের বন্ধুসুলভ ব্যবহারে আমি স্বাভাবিক হয়ে যাই দ্রুত।
– আপনি শাড়ি পরতে খুব ভালোবাসেন মনে হচ্ছে?
এ ধরণের প্রশ্নের জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। তাই কিছুটা অপ্রস্তুত ভাবে উত্তর দিলাম,
– না… মানে… হ্যা…আমার প্রিয় পোশাকই বলা চলে। কেন বলুন তো!
– আপনার ফ্রেন্ড তো জিন্স আর টি শার্ট পরেছে, তাই বললাম। ঘুরতে আসলে সবাই বেশিরভাগই এ ধরণের কমফোর্টেবল ড্রেস পরে কিন্তু আপনি ব্যতিক্রম তাই বললাম।
– না…. মানে…. আমি ওসবে অভ্যস্ত নই। তাছাড়া ও ধরণের পোশাক আমাকে মানাবেও না। নীরার জন্য ঠিক আছে। ও এখনো বেশ পার্ফেক্ট আছে।
– কে বলেছে আপনাকে মানাবে না? আপনি যথেষ্ঠ পার্ফেক্ট। এত সুন্দর মেদহীন টল ফিগার! যে ড্রেসই পরবেন মানিয়ে যাবে। আমার চোখে তো আপনি আপনার ফ্রেন্ডের থেকেও পার্ফেক্ট! তবে সত্যি কথা বলতে শাড়িতেই আপনাকে বেশি মানাচ্ছে মনে হচ্ছে। দূর থেকে আপনার ফিগার আর চেহারার গড়ণ দেখলে যে কেউ সুস্মিতা সেন ভেবে অবাক হবে! এয়ারপোর্টে তো আমার ভাবনায় প্রথমে হোঁচট দিয়েছিলেন আপনি। আমি সুস্মিতা সেনই ভেবেছিলাম দূর থেকে দেখে।
সিদ্ধার্থের কথা শুনে আমি ভীষণ লজ্জা পেয়ে গেলাম। কিন্তু এই লজ্জার মাঝেও যেন কী এক ভালো লাগা কাজ করছে। ব্যাপারটা অনুধাবন করে আমি খুব অবাক হলাম। সিদ্ধার্থের কথায় আমি রাগ না করে বরং কেমন হাসি হাসি মুখে তার কথাটি রিসিভ করছি।
সেলিম এমন করে কবে আমাকে দেখেছে মনে পড়ে না। কখনও আমি কী ড্রেস পরলাম , না পরলাম, আমাকে কেমন লাগছে এগুলি নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই। প্রথমে খুব আশা করতাম ওর একটা কমপ্লিমেন্টের কিন্তু এখন আর ওসব মাথাতেই আসে না।
সেখানে ঘুরতে ঘুরতে বেশ বেলা হয়ে গেল এরপর আশেপাশের আরো কয়েকটা বৌদ্ধমন্দির রয়েছে সেগুলো বেশ নান্দনিক এবং দার্শনিক সেখানেও নিয়ে গেল আমাদের সিদ্ধার্থ। সন্ধ্যার দিকে চলে যাই শপিংমলে। আমাদেরকে মলে রেখে সিদ্ধার্থ চলে গেল। বেশ কিছু কেনাকাটা করলাম আমি আর নীরা।
রাতের নিয়ন আলোয় ব্যাংকক শহর এক ভয়ানক মায়াবী শহর। আকাশ ছোঁয়া হোটেলের ছাদে দাঁড়িয়ে নিচের পৃথিবীকে এক অদ্ভুত সুন্দর রূপে দেখছি। গভীর রাতে হোটেলের ছাদে দাঁড়িয়ে ভাবছি এ এক আজব শহর। সবাই শুধু ছুটছেই। গভীর রাতে গতি যদিও কিছুটা স্লথ আর শান্ত। চারপাশে তাকিয়ে ভাবছি আর কতগুলি উঁচু উঁচু বিল্ডিং হলে এর পাশে বয়ে চলা চাও ফ্রায়া নদীর জল শেষ হবে?
সেলিম কে খুব মিস করছি। এখন যদি সেও আমার পাশে থাকত! দুজনে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে হাত ধরে উপভোগ করতাম রাতের এই নৈসর্গিক আর মায়াবী সৌন্দর্য।
সারাদিনে মাত্র একবার কথা হয়েছে সেলিমের সাথে তাও মাত্র দু’মিনিটের মত। এরপরে সেলিমও আর ফোন দেয়নি আমিও আর দেই নি।
আপনা আপনিই চোখ জোড়া ভিজে আসছে। এই সুউচ্চ ভবনের ছাদে দাঁড়িয়ে আকাশ পানে চেয়ে ভাবছি চারদিকে এত এত মানুষ । অথচ আমার জন্য ভাববার মত একজন মানুষও কী নেই। ছেলেটাকে খুব মনে পড়ছে। আসার কথা ওকে বলে আসিনি। ওর কষ্ট লাগবে তাই। আমিও আজকাল খুব পাষণ্ড হয়ে যাচ্ছি। নিজের এত পরিবর্তন কখন হলো ভাবতেই বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল। আমাদের ডিনারের আয়োজন আজ ছাদেই। ডিনার শেষে বেশ রাতে রুমে আসলাম। রুমে এসে নিজে থেকে সেলিমকে ফোন দিলাম। দু’বার রিং বাজতেই সে রিসিভ করল।
– হুম, কেমন লাগছে ব্যাংকক শহর?
– খুব মায়াবী।
– দেখো মায়ার টানে যেন আবার থেকে না যাও।
– থাকলে কী খুব খারাপ কিছু হবে?
– থাকতে চাইলে তোমার স্বাধীনতায় তো হস্তক্ষেপ করতে পারি না। তবে দেশে যে একজন স্বামী আর একটা ছেলে রেখে গেছ সেটা একটু মাথায় রাখলেই চলবে। আসা না আসা তোমার ব্যাপার। কিছুটা ঠাট্টার সাথেই বলল , সেলিম।
এরপর এই টুকিটাকি দু’চারটা কথাবার্তা বলে ফোন রাখলাম। ঘুমই আসছে না। ফোন হাতে নিয়ে ফেইসবুকে ঘাটাঘাটি করছি। নোটিফিকেশানে দেখলাম একটা আইডি থেকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট এসেছে। ওপেন করতেই দেখলাম সিদ্ধার্থ! একটু এদিক সেদিক ভেবেই এক্সেপ্ট করে ফেললাম।
সাথে সাথেই মেসেঞ্জারে টুং করে উঠল। মেসেঞ্জার ওপেন করতেই দেখলাম তার মেসেজ।
– চিনতে পেরেছেন তবে! ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এক্সেপ্ট করার জন্য ধন্যবাদ।
– চিনবো না কেন? কিছুক্ষণ আগে তো আপনার সাথে থেকে এলাম। এতটা ভুলোমন এখনো হয়নি।
– হা হা। কেমন শপিং হলো আজ?
– হুম , খুব ভালো। কী করছেন? এত রাতে ঘুমান নি?
– নাহ! আপনিও তো ঘুমান নি।
– আমি না হয় হাজবেন্ড আর ছেলের কথা ভাবছি । আপনিও কী বউ বাচ্চাকে ভাবছেন?
– হা হা! সাত পাঁকে না ঘুরতেই বউ বাচ্চা কই পাবো? কেউ রেডিমেড দিলে অবশ্য মন্দ হতো না।
– এসব জিনিস রেডিমেড পাওয়া যায় না। আচ্ছা, আমার আইডি লিংক কই পেলেন?
– আপনার ফ্রেন্ডের থেকে। ওর সাথে মাত্র কথা বলে আপনার আইডি লিংক পেলাম। ভুল হয়ে গেল কি?
– না না, ঠিক আছে।
– কাল কখন রওয়ানা হবেন পাতায়ার উদ্দেশ্যে?
– এই তো ! নীরা বলল, দুপুরের দিকে। আপনি যাবেন নাকি আমাদের সাথে?
– ইচ্ছে তো আছে যদি সুন্দরীদের আপত্তি না থাকে।
– কী যে বলেন! সুন্দরী আবার কে?
– নিজেকে বুঝি আয়নায় বহু বছর দেখেন নি!
– হা হা! আপনি যা বলেন না। আচ্ছা, আমাদের সাথে গেলে আপনার ব্যবসায়ের ক্ষতি হবে না?
– সারাবছরই তো বিজনেস করি। আপনাদের জন্য না হয় দু’চারদিন বন্ধ থাকবে । অসুবিধা কি! সব সময় টাকার পেছনে ছুটলেই কী চলবে? মাঝেমাঝে এমন সুন্দরীদের জন্য জীবনের কিছু মুহূর্ত যদি আলাদা করে কাটানো যায় সেটা স্মৃতির পাতায় আলাদা একটা জায়গা হয়ে থাকবে। নীরার কোনো আপত্তি নেই। আপনি যদি কোনো ধরণের হেজিটেট ফিল করেন দেন আমি যাব না। আপনি নির্দ্বিধায় বলতে পারেন।
– আরে না! হেজিটেট ফিল করার কী আছে? আপনি থাকলে বরং আমাদের জন্য ভালোই হয়। আমার জন্য বিশেষ করে। আমার জন্য একদমই অচেনা পরিবেশ। সাথে আপনি থাকলে কিছুটা সাহস পাব। কাল তবে দেখা হবে।
– কালও কী শাড়ি পরেই যাবেন?
– হুম। আমি শাড়িতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। তবে বীচে অবশ্যই শাড়ি পরছি না। হা হা।
– গ্রেট! আমিও আপনাকে শাড়ি পরাই দেখতে চাচ্ছিলাম। চারপাশের সবার থেকে আপনাকে আলাদা লাগুক আমিও সেটাই চাই।
– কেন বলুন তো!
– জানি না। কিছু কেনর উত্তর হয় না। তবে শুধু এটুকু বলব , সেই এয়ারপোর্টে প্রথম দেখা আপনাকে কিছুতেই মাথা থেকে সরাতে পারছি না। এত মায়াবী চেহারা। অপূর্ব!
যদি কিছু বেশি বলে ফেলি ক্ষমা করবেন। তবে সুন্দরকে সুন্দর বলার অপরাধে যে শাস্তি দিবেন মাথা পেতে নিতে রাজি আছি।
– হা হা! আপনি হলেন কথার জাদুকর। আপনার সাথে কথায় পারা আমার সাধ্য নয়। আচ্ছা, কাল তবে দেখা হবে। আজ রাখছি। ভালো থাকবেন।
– আপনিও!
সিদ্ধার্থের সাথে কথা শেষ করে আমি অবাক হলাম । সিদ্ধার্থ আমাকে এমন কিছু কথা বলেছে যেগুলি ওর বলা উচিত হয়নি। অথচ আমি অনায়সে সেগুলি শুনে গেলাম আর তাকে বাহবা দিয়েই গেলাম। আমার অবচেতন মন কি তবে এমন কিছুই আশা করছিল সিদ্ধার্থের কাছ থেকে? খুব বেশিই অবাক হলাম নিজের এমন পরিবর্তনে।
পরদিন সকাল বেলা মাদাম তুসো মিউজিয়াম আর সি লাইফে খানিক সময় কাটিয়ে দুপুরের দিকে তিনজনে ট্রেনে রওয়ানা হলাম পাতায়ার উদ্দ্যেশ্যে।
বিকেল পাঁচটার দিকে আমরা পাতায়া এসে পৌঁছলাম।
চলবে…
পর্ব-১
https://www.facebook.com/111576077291737/posts/323796316069711/