#সুখের_সন্ধানে
#পর্ব_২১
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি মিথিলার বাবার দিকে। মনে মনে কিছুটা ঘাবড়ে গেলাম ওর চোখের ভাষা পড়ে। এমনভাবে কড়া করে কোনোদিন আমার সাথে কথা বলেছে মনে পড়ছে না। সংসারের প্রতি উদাসীন থাকার কারণে টুম্পা মাঝেমাঝে কান্নাকাটি করে যখন ওর নামে নালিশ করত তখন অনেক সময়ই আমি আসাদকে বকেছি, কড়া করে কথা বলেছি। কিন্তু প্রত্যুত্তরে সে এভাবে কোনোদিনই রিয়্যাক্ট করেনি। আমাকে যথেষ্ঠ সম্মান দিয়েই সে কথা বলেছে। আমি ভাবলাম সেই সময়কার আসাদ আর এই আসাদের মাঝে আকাশ পাতাল পার্থক্য । সময়ের সাথে সাথে সম্পর্ক বদলে গেছে। তাই সেই অধিকারবোধের জায়গা এখন আর আমার নেই। এজন্য খুব ঠাণ্ডাভাবে ব্যাপারটাকে হ্যান্ডেল করতে হবে। নয়ত কিছুতেই মেহরাবকে নেওয়া যাবে না। উলটো মিথিলাকেও যেতে দিবে না আর। আর সেক্ষেত্রে আমার জোর খাটানোর আর কোনো অধিকারও থাকবে না।
আসাদ ঘরে ঢুকেই পারুলের দিকে তাকিয়ে বলল, এখানে বসে কী দেখছ? আপার জন্য রান্নাবান্নার আয়োজন করো। রাতে খেয়ে যাবেন আপা। আপা খাসির মাংস আর ইলিশ মাছ খেতে খুব পছন্দ করেন। ফ্রীজে কি খাসির মাংস , ইলিশ আছে? না থাকলে বলো নিয়ে আসি।
পারুল আস্তে করে বলল, আছে। আমি এখনি রান্না বসাচ্ছি। উনি বলল, এখনি চলে যাবেন বললেন তাই আর রান্নার আয়োজনে যাইনি।
– মানে কী? সে বলল আর তুমি হাত পা গুঁটিয়ে বসে থাকবে? টুম্পা থাকতে আপা কখনোই না খেয়ে এ বাড়ি থেকে যান নি। যত ব্যস্তই থাকুক টুম্পা তাকে না খাইয়ে যেতে দেয়নি। আজ ভুল করেছ কিন্তু আর কখনো আপা আসলে তার অনুমতির অপেক্ষা করবে না।
পারুল আর কোনো কথা না বলে কিচেনের উদ্দেশ্যে পা বাড়াল। আমি আসাদকে বুঝতে চেষ্টা করছি । ওর মধ্যে আসলে চলছে কী? আসাদকে দেখতে আগের থেকে অনেক বয়স্ক মনে হচ্ছে। মাথার চুলগুলি সব পেকে গেছে প্রায়। আসাদ খানিকক্ষণ মিথিলার সাথে কথাবার্তা বলে এসে আমার সামনের সোফায় বসল। আমি ওর ব্যবসায় বাণিজ্য আর শরীরের খোঁজখবর নিতে নিতে এক ফাঁকে মেহরাবের কথা তুলতেই বলল,
– আপা, আমি আপনার দুশ্চিন্তা হচ্ছে সেটা বুঝতে পারছি। কিন্তু আপা, আমি তো এখনো বেঁচে আছি। মেয়েটাকে নিয়ে গিয়েছেন। আমি অনেক ভেবে দেখেছি মিথিলার পাশে এ সময় ওর মায়ের প্রয়োজন। মাকে ছাড়া মেয়েদের জীবন চলার পথ খুব কঠিন। আমি কখনোই ওর মায়ের অভাব পূরণ করতে পারব না যেটা হয়ত কিছুটা হলেও আপনি পারবেন। তাই মেয়েটাকে আমি আপনার সাথে যেতে দিয়েছি। টুম্পা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। তাই ঘরে আসতেই মন চায় না। আরেকদিকে মিথিলাও নেই। নিজের বাসাতেই নিজেকে অচেনা মনে হয়। তাও নিজের কষ্টটাকে কিছুটা হলেও ভুলে থাকি যখন মেহরাবের মুখখান দেখি। ওরা দু’ভাইবোনই দেখতে মায়ের মতো হয়েছে। ওদের দিকে তাকিয়ে আমি টুম্পাকে খুঁজে বেড়াই। আপনি যদি মেহরাবকেও মিথিলার মতো আমার কাছা থেকে দূরে সরিয়ে দেন তবে আমার কী উপায় হবে একবার ভেবে দেখুন! বাকী যে ক’টা দিন আছি একটু ভালো করে বাঁচতে চাই আপা। ওরাই তো আমার অক্সিজেন।
আসাদের কথা শুনে দু’চোখ ভিজে এল আমার। আমি কোনোরকম করে নিজেকে সংবরণ করে বললাম, আমি বুঝিরে, ভাই। কিন্তু এটা কিন্তু স্বার্থপরের মতো করে বললে তুমি? তোমার নিজের একটু ভালো করে বেঁচে থাকার জন্য ওদের জীবনকে এক অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিতে পারো না।
– আমি বুঝতে পারছি আপনি কী বলতে চাচ্ছেন । সবাই বলে আমি নাকি আর ওদের বাবা নেই, তালুই হয়ে গেছি। আমার বিছানায় মৃত্যুশয্যায় প্রহর গুনতে থাকা মাও কাল আমাকে এ কথাই বলল। আমি শুধু শুনেছি কিছু বলতে পারিনি। হ্যা, সত্যিই তো আমি তালুই হয়ে গেছি। আমি অপারগ বাপ ওদের। বলতে বলতে চোখের কোণের ভেজাভাব লুকাতে সে অন্যদিকে তাকিয়ে চোখ মুছল।
পারুল এটা সেটা নেয়ার অজুহাতে বারবার ডাইনিং রুমে এসে দাঁড়িয়ে কালক্ষেপণ করছে । আমি তলচোখে তাকিয়ে খেয়াল করছিলাম ব্যাপারটা। ওবশ্য ব্যাপারটা আসাদেরও দৃষ্টিগোচর হয়েছে মনে হচ্ছে।
– উফ , আপা! আজ যা গরম পড়েছে। এখানে রান্নাঘরে চুলা জ্বলবার কারণে আরো গরম লাগছে। আমাদের রুমে চলেন না। এসি দিয়ে বসে কথা বলি, প্লিজ!
আমি বুঝতে পারলাম আসাদ আসলে এখান থেকে পারুলের আড়ালে যেতে চাচ্ছে। আমিও আর আপত্তি না করে ওর পেছনে পেছনে টুম্পার বেডরুমের দিকে গেলাম। টুম্পা চলে যাবার পরে এই প্রথম ওর রুমে ঢুকেছি। ঢুকেই বুকের মাঝে তোলপাড় শুরু হলো। দেয়ালের সাথে টুম্পা আর আসাদের বিয়ের তারিখ টুম্পা নিজের হাতে সেলাই করে লিখে বাঁধাই করে টাঙ্গিয়ে রেখেছিল। সেটা নজরে পড়লো না। রুমের ডেকরশনেও বেশ ভিন্নতা। টুম্পার ব্যবহৃত ওয়্যারড্রব আর ড্রেসিং টেবিলটাও চোখে পড়ল না। খুব অবাক হলাম। সেগুলি তো ব্যাবহার অযোগ্য ছিল না। তবে সেগুলিকে বাদ দিয়ে নতুন কেন? মনের মধ্যে খচখচ করছে খুব। আসাদকে ভাবছি জিজ্ঞেস করব। কিন্তু ইচ্ছে হচ্ছে না কেন যেন আবার। বোনটাই নেই সেখানে স্মৃতির খবর নিয়ে কী আর হবে? বারবার টুম্পার সেই ওয়ালম্যাটটার স্থানে চোখ যাচ্ছিল । সেখানে বেশ বড়সড় একটা রেডিমেড কেনা ওয়ালম্যাট ঝুলছে।
আমার চোখের ভাষা বুঝতে পেরে আসাদ বলল, আপা, যেটা খুঁজছেন সেটা স্টোররুমে।
– কেনো?
– বোঝেনই তো ! সংসারটা এখন টূম্পার না পারুলের। কী আজব তাই না? সবকিছু কে করেছে আর কে এসে সব ভোগ করছে?
– তুমি কিছু বললে না?
– কী বলব ,বলেন? কত আর অশান্তি করা যায় ? ঝগড়াঝাঁটি করা আমার ধাঁতে নেই। কোনোদিন টুম্পার সাথেও গলা উঁচিয়ে কথা বলিনি। বলিনি বললে ভুল হবে আসলে আমি পারিই না। এটা আপনি তো জানেনই। কত চেষ্টা করি নিজেকে শোধরাতে কিন্তু কিছুতেই পারছি না। বরং এখন আগের চেয়েও আরো অকম্মা হয়ে গেছি।
– বুঝেছি , একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম আমি। আচ্ছা, এখন মেহরাবের কথা বলো!
– কী বলব? বলেই তো দিয়েছি ,আপা। আমি আমার ছেলেটাকেও মেয়ের মতো কোলছাড়া করতে পারব না।
আসাদের কথায় যুক্তি আছে বুঝলাম। কিন্তু সে মেহরাবকে এত আদরই যদি করবে তবে আবার এভাবে ছেলেটাকে মারছে কেন দু’দিন পর পর সেটা বুঝতে পারছি না।
– এতই ভালোবাসো তবে ছেলেটার দিকে ভালো করে তাকানোর সুযোগ হয়েছে তোমার? ওর হাল হয়েছে কী?
– দেখেছি আপা! খাওয়া দাওয়ার ঠিক ঠিকানা নেই । রাতভরে ফোন চাপে। ঘুম ঠিকমত না হলে এমনই হয়। এত ছোট মানুষের এত অনিয়ম শরীর নিতে পারেনি।
– খাওয়া হবে কী করে? ছেলেটা একটা দিনও নাস্তা পায় না। এসব কী? টুম্পা থাকতে কী এমন হয়েছে কোনোদিন? তুমি বিয়ে করেছ ওদের যাতে অযত্ন না হয় সেজন্য। কিন্তু এসব কী হচ্ছে? তুমি মেহরাবের গায়ে হাত তুলেছ কার ইন্ধনে আমি কি ভেবেছ বুঝিনি?
আসাদ খানিকসময় চুপচাপ থেকে বলল,
– আপা, আপনি কী বলতে চাচ্ছেন আমি বুঝতে পারছি। আমি কিন্তু দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে চাইনি। আমার আত্মীয় স্বজন জোর করে বিয়েতে রাজী করিয়েছে। বিয়ের পরে কিছুদিন মনে হয়েছিল দ্বিতীয়বার বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে ভুল করিনি। কিন্তু ধীরে ধীরে বুঝলাম কতবড় ভুল করেছিলাম আমি। পারুলের মন ভালো করার জন্য ওর ছেলেকে এখানে রাখার কথা বললে আমি রাজী হলাম । ভাবলাম ওর মন ভালো থাকলে হয়ত আমার সংসারকে, আমার বাচ্চাদেরকে আপন করে ভাববে। তাছাড়া একটা বাচ্চা মা ছাড়া থাকা কত কষ্টের সে তো আমি নিজের চোখেই দেখছি আমার বাচ্চাদের দেখে। সবকিছু ভেবে রাজী হয়েছিলাম। কিন্তু কোনো লাভ নেই। বরং এখন উটকো ঝামেলা মাথায় পড়েছে। ছেলেটাকে একদিনও নাস্তা দেয় না , টিফিন থাক দূরের কথা। এই ঝামেলা সেই ঝামেলা বলে সে সকালে উঠেই না। কয়েকদিন রাগারাগি করেছি এ নিয়ে কিন্তু তাতে হিতে বিপরীত হতে থাকে। কারণে অকারণে মেহরাবকে নিয়ে অভিযোগ করতেই থাকে। পরে এটার হাত হতে নিস্তার পেতে মেহরাবকে টাকা দিয়ে দেই দোকানে খাওয়ার জন্য। এছাড়া আর আমি করবই কী বলেন!
।
– সবই যদি বোঝ তবে ওর গায়ে হাত তুলছ কেনো?
– মিনিটে মিনিটে ওর বিরুদ্ধে নালিশ শুনতে শুনতে আমি তেতো তেতো হয়ে গেছি। সারাদিন কাজের টেনশানের মধ্যে থাকি। এমনিতে মনে হয় টুম্পা চলে যাবার সময় হয়ত আমার ভাগ্যের চাবিকাঠিও সাথে করে নিয়ে গেছে। ব্যবসা বাণিজ্যের অবস্থা তেমন ভালো না। আশেপাশে আরো কয়েকটি ফ্যাক্টরি উঠেছে। আমার সেকেলে যন্ত্রপাতি দিয়ে ওদের আধুনিক ফিটিংসের ফ্যাক্টরির প্রডাকশান , কোয়ালিটির সাথে পাল্লা দিয়ে এগুতে পারছি না। অর্ডার কমে যাচ্ছে দিন দিন। কোনোরকম টিকে আছি। বাড়িটা নিজেদের বলে এখনো কিছু আয় হচ্ছে । ভাড়া দেওয়া লাগলে কী যে হতো! নিজের খামখেয়ালিপনার কারণে চাকরিটা হারালাম। এখন এটাও যদি হারিয়ে ফেলি তবে একদম পথে বসতে হবে। সীমিত আয়ে সংসার চালাতে হয়। কিন্তু এটা পারুল একদমই মেনে নিতে পারে না। তার আগের স্বামী আগে তার কাছে বাণ্ডেল বাণ্ডেল নোট পাঠাতেন সৌদি থেকে, সেই গল্প সকাল বিকাল খোঁটা দিয়ে শোনাতে তার একটুও দেরি হয় না। অসহ্য মানসিক যন্ত্রণায় ভুগি সারাক্ষণ। এর মাঝে যদি মেহরাবের নালিশ শুনতে হয়! তার উপর মেহরাবের পড়াশুনায় একদমই মন নেই । বাসায় এসে টিচার পড়িয়ে যায় কিন্তু তার মাথায় কিচ্ছু নাকি ঢোকে না। পরপর তিনটা পরীক্ষায় ম্যাথে ফেল করেছে। এসব শুনলে মাথায় রক্ত উঠে যায় একদম। কিন্তু তারপরেও যদি বিবেক হতো! সারারাত সারাদিন গেমস নিয়ে পড়ে থাকে। ওই সাদমান ছেলেটাকে এটা সেটা নিয়ে খোঁটা দেয় সে। কিছু ধরতে দিতে চায় না। এ নিয়েও নাকি নিজেদের মাঝে হূলস্থুল কাণ্ড করে। আর সাদমানকে সে সহ্য করতে না পেরে ওর ছোট মাকেও সহ্য করতে পারে না। তাকে নানান আজেবাজে কথা বলে আজকাল। সব শুনে শুনে আর কন্ট্রোল করতে পারি না নিজেকে। কী করব বলুন আমিও তো মানুষ! সব রাগ যেয়ে ওর উপরে ঝাড়ি। আর ও যে আমাকে কেন বোঝে না সেটাই বুঝি না। কেন যে কাজ নিষেধ করি সেসব কাজই করে?
– ওর বয়সটাই এখন এমন। তোমাকে বুঝতে হবে। তাছাড়া ওর জীবনের উপর দিয়ে এমন একটা ঘটনা ঘটে গেল। নিজেকে সেট করতে পারছে না এই পরিবেশে। তুমি যেহেতু বুঝতেই পারছ যে পারুলকে এ সংসারে রাখা মানে ঝামেলা কমানো নয় বরং বাড়ানোই তবে এখনো ওর সাথে রিলেশান রাখছ কেন? আমার কেন যেন মনে হচ্ছে ওর সাথে বাকী জীবনেও কখনো সুখী হতে পারবে না।
– আমি জানি আপা।
– তাহলে আবার কী?
– একটা সমস্যা হয়ে গেছে, আপা। আমিও নিজে একটা বেশ বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম মনে মনে। কিন্তু….
– কিন্তু কী? থেমে গেলে কেন? পারুল কি সন্তান সম্ভবা?
– একটু আমতা আমতা করে আসাদ বলল, জি আপা। আমি আসলে এমন টা চাইনি। আমি এবোরশান করানোর কথা বললে সে কিছুতেই রাজি না। আমি তো তার ব্যাপারটা বুঝি। আমি একদম হাত পায়ে শেকল পরার মতো অবস্থায় আছি। না পারছি ফেলতে , না পারছি গিলতে।
– আমি কিছুসময় চুপচাপ থেকে বললাম, তাইলে কী আর করা! ফেলার যেহেতু অপশন নেই যত তেতোই হোক এবার গিলতেই হবে। আচ্ছা, এবার তোমার সমস্যা বুঝলাম। কিন্তু মেহরাবকে তুমি দিতে চাচ্ছ না কেন?
– আপা, একজন তো আছেই আর কত ঝামেলা বাড়াবেন?
– ওরা আমার কাছে ঝামেলা হবে কেন? ওরা তো আমার সন্তান! আমি মোটেই ঝামেলা ভাবি না।
– জানি আপা। আপনি আছেন বলেই নিশ্চিন্তে আছি ওদের নিয়ে। মাঝেমাঝে তো পারুলের অত্যাচারে মনে হয় দম বন্ধ হয়ে মরে যাচ্ছি। বুঝি না কেন যে আমার আগে টুম্পাকেই যেতে হলো? আমি যেতাম। আল্লাহ আমাকে দেখল না? আজ আমি না থাকলে আমার দশটা বাচ্চা থাকলেও টুম্পা ঠিকই ম্যানেজ করতে পারত। আর আমি?
– মন খারাপ করে আর কী হবে! আল্লাহর সিদ্ধান্তে প্রশ্ন তুলবার কী সামর্থ্য আমাদের? মানকে শান্ত করো। তুমি মেহরাবকে যাবার অনুমতি দাও। ও যেতে চাইছে । দু’ভাইবোন একসাথে থাকবে। এত বড় বাড়ি আমার । কোনো অসুবিধাই হবে না।
– আপা, একেক করে তো সেটাই হচ্ছে যেটা পারুল চাইছে। মিথিলা চলে গেল এখন আবার মেহরাবও যদি চলে যায় ! এভাবে সে জিতে যাবে?
– সেও তোমার বাচ্চার মা হচ্ছে। তাই তাকেও দেখেশুনে রাখো। সব মানুষ একরকম হয় না। হার জিতের কিছু নেই। মাথা ঠাণ্ডা করো। এখানে থাকলে মেহরাব কতটা মানসিক অত্যাচারের মধ্যে থাকবে বুঝতে পারো? সারাদিন তুমি থাকো না। ওই মা ছেলের মধ্যে ওকে থাকতে হয়। আর তুমিও ওকে ভুল বোঝ! ওর দিকটা ভেবে দেখ , প্লিজ! তাছাড়া ওরা একটু ম্যাচিউর হলেই আমি এখানে পাঠিয়ে দিব। তখন আর কেউ ওদের সাথে মিসবিহেভ করার সাহস পাবে না।
আসাদ কোনো কথা বলছে না। আসাদকে একদম চুপচাপ দেখে রুম থেকে বেরিয়ে গেলাম! ওকে ভাবার সুযোগ দেয়া প্রয়োজন।
রাতের খাবার দাবার শেষ হতে হতে প্রায় সাড়ে দশটা বেজে গেল। মেহরাবের মন খুব খারাপ। তেমন কিছু খায়ও নি। মিথিলারও একই অবস্থা। আসাদের রায়ের অপেক্ষায় আছি। জানি না সে কী বলবে! তবে আমার বিশ্বাস যে ভেবেচিন্তে ছেলের ভালোটাই নিশ্চয়ই বেছে নিবে।
আমি আর মিথিলা যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি তখন আসাদ মেহরাবের উদ্দেশ্য করে বলল, তোমার যা যা নেওয়া দরকার প্যাক করো। মিথিলা সাহায্য করো মেহরাবকে। ও তোমাদের সাথেই যাচ্ছে।
আমি আসাদের এমন সিদ্ধান্তে ভীষণ খুশি হলাম। যাক, অবশেষে সে বুঝতে পেরেছে। মিথিলা আর মেহরাবের এ কথা শুনে প্রথমে খুব খুশি খুশি ভাব হলেও কিছুক্ষণের মধ্যেই যেন কালোমেঘে ছেয়ে যায় ওদের চেহারা। আপন আঙিনা ছেড়ে যাওয়া এত সহজ কি? মায়ায় মাখা প্রতিটি মুহূর্তকে ধূলায় মিশিয়ে অন্য ভুবনে মিশে যাওয়ার মাঝে কোনো সুখ থাকে না। তাই ওদেরও নেই। মুহূর্তেই বিষাদের কালো ছায়ায় ভরে উঠল পুরো পরিবেশ। পারুল কিছুটা বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করলেও আমার বুঝতে আর বাকী নেই তার অন্তরের কথা।
বাপ ছেলের জড়িয়ে ধরে কান্নার দৃশ্য আমি সহ্য করতে পারছি না একদমই। হায়রে নিয়তি!
বাসায় পৌঁছে দেখলাম প্রিয় তখনো ফেরেনি। ওর বাবা মনে হয় রুমে। আমি ওদেরকে নিয়ে আমার শাশুড়ির রুমে গেলাম। উনি ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আমার সাথে মেহরাবকে দেখে খানিকটা অবাক হলেন।
– এত রাতে আপনাকে বিরক্ত করার জন্য সরি, আম্মা।
– না , না! ঠিক আছে। এই যে মিথিলার ভাই না?
– জি আম্মা। ওকে নিয়ে এলাম। এখানেই থাকবে আজ থেকে। কোনো সমস্যা নেই তো আম্মা? সৎ মায়ের সংসার বোঝেনই তো! খুব কষ্টের মাঝে থাকছে । আমি সহ্য করতে না পেরে আপনার অনুমতি না নিয়েই নিয়ে এসেছি। কারণ আমি জানি আপনি কখনোই না করবেন না।
– আমার শাশুড়ি আস্তে করে বললেন, না , সমস্যা আর কী! এত বড় বাড়ি, একজন মানুষের জন্য আর কতটুকুই বা লাগবে। যাও ওকে একটা রুম দিয়ে দাও।
আম্মার কথা শুনে বুকের উপর থেকে যেন পাথর নেমে গেল। এবার সেলিমকে নিয়ে চিন্তা। প্রিয়কে নিয়েও যে চিন্তার শেষ নেই তা নয়। তারপরেও আমার বিশ্বাস ওকে বুঝিয়ে বললেই বুঝবে।
চলবে…
পর্ব-২০
https://www.facebook.com/111576077291737/posts/355956892853653/