সুখের_সন্ধানে পর্ব_৩৯

0
378

#সুখের_সন্ধানে
#পর্ব_৩৯

বিধবার বেশে মিথিলাকে দেখে মনে হচ্ছে বয়স দশ বছর বেড়ে গিয়েছে। চোয়ালগুলি কেমন ঝুলে গেছে। ওর দিকে তাকালেই কী এক শূন্যতা যেন গ্রাস করে নিচ্ছে । সেলিম হাসপাতালের বেডে শুয়ে অপলক নয়নে মিথিলার দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা এই তিনটা দিন ধরে তার পেছনে কত শ্রম দিচ্ছে। অথচ এই মেয়েটাকে সে কত নিচু করে দেখেছে । কত কী বলেছে! ভাবতেই লজ্জা হচ্ছে তার।

হঠাৎ করে গত পরশু ভোররাতের দিকে ওয়াশরুমে যেয়ে পা পিছলে পড়ে যায় সেলিম। সাথে সাথেই একটা চিৎকার দিয়ে সেখানেই জ্ঞান হারায়। সকালের দিকে একজন সার্ভেন্ট এসে তাকে সেখানে ওই অবস্থায় পায়। সাথে সাথে সেলিমের মা তার ছোট ছেলে সজলকে খবর দিলে সে এসে সেলিমকে হাসপাতালে নিয়ে আসে। হাসপাতালে ভর্তি হবার সাত ঘণ্টার মাথায় জ্ঞান ফেরে তার। ডান হাত আর ডান পা অবশ হয়ে আছে সেই থেকে। ডাক্তার বলেছে ওনার ডান পাশটা প্যারালাইসড হয়ে গিয়েছে। সেলিম যদিও এখনো সবকিছু জানে না। তাকে বলা হয়েছে মেডিসিনের কারণে হাত পা এমন অবশ হয়ে আছে। কিছুদিনের মধ্যেই ঠিক হয়ে যাবে। সেলিমের মা বয়সের ভারে এখন আর নড়াচড়াও তেমন করতে পারে না। বয়স তো কম হলো না। আশি ছুঁইছুঁই।
ছেলের জন্য কিছু করবেন সেই সাধ্য তার নেই। শুধু বিছানায় বসে আল্লাহকেই ডাকছেন। সেলিমের সাথে হাসপাতালে সবসময় থাকার মত কেউ নেই। সজল একা ক’দিকে সামলাবে? অফিসের পুরো দায়িত্ব তার ঘাড়ে। দু’জন সার্ভেন্টকে তার সাথে সবসময় কাছাকাছি থাকার জন্য দেয়া হলেও আমি ভরসা পাচ্ছি না। তাই মিথিলাকে বলার সাথেই ও রাজি হয়ে গেল। অভাগী মেয়েটা কারো বিপদের কথা শুনলে স্থির থাকতে পারে না।

আমি ইতালিতে এসেছি সাতদিন হলো। প্রিয় খুব অনুরোধ করেছে তাই না এসে পারিনি। প্রিয়র বাচ্চা হবে। আমিই বা কী করে না এসে পারি? সেলিম অনেকবার আসতে নিষেধ করলেও আমি নিজেকে আটকাতে পারিনি। প্রিয়র চোখের পানির কাছে আমি হেরে গিয়েছি। তাই সব কষ্ট অপমান ভুলে ছুটে এসেছি। এখন মনে হচ্ছে কেন যে আসতে গেলাম? সেলিমের এই বিপদের সময় আমি ওর পাশে থাকতে পারছি না। বাংলাদেশে ফেরার টিকেটের জন্য প্রিয় হন্য হয়ে ঘুরছে। কিন্তু অভ্যন্তরীণ কিছু সমস্যার জন্য এমার্জেন্সী কিছু ফ্লাইট ছাড়া সমস্ত ফ্লাইট বন্ধ। আরো তিনদিনের আগে কোনো টিকেট পাওয়া সম্ভব না। আমার মন ছুটে গেছে কিন্তু কিছুই করার নেই।
আমার ছোট জাকে বলেছিলাম সেলিমের দেখভাল করার জন্য পাশে থাকতে কিন্তু তার নানান অজুহাত শুনে মনে হলো তাকে বলে বুঝি ভুলই করে ফেললাম। সজলের মাঝেও ভাইয়ের জন্য খুব বেশি দরদ দেখলাম না। দিনে একবার যেয়ে ভিজিটরের মতো দেখে আসে। আমি এ নিয়ে প্রশ্ন তোলায় সে বলে, “ দু’জন মানুষ সারাক্ষণ তার তদারকি করছে। আমাদের কারো কেন থাকতে হবে? তাছাড়া কখন কী লাগছে সব কিছুই তো দেখছি। “
কিন্তু আমার মন মানছে না। যতই লোকজন থাকুক আপন মানুষের মতো কী আর তারা করবে? তাছাড়া সেলিমের এই মুহূর্তে মানসিক সাপোর্টের দরকার। আমার সাথে ভিডিও কলে কথা বলার সময় হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। আমাকে বারবার ইতালি থেকে ফিরে আসার অনুরোধ করছে। প্রিয় ওর বাবার সাথে কথা বলতে চাইলে সেলিম মুখ ঘুরিয়ে নেয়। সে কিছুতেই ওর সাথে কথা বলবে না। আমার হয়েছে যত জ্বালা। একদিকে সেলিম হাউমাউ করে কাঁদছে অন্যদিকে প্রিয় ওর বাবার জন্য কেঁদে কেটে অস্থির। আমার দুঃখ কোথায় দেখাব সেই জায়গা আর পাই না।
আমি আসা পর্যন্ত মেহরাবকে যে বলব সেলিমের পাশে থাকতে সেই উপায়ও নেই। ছেলেটার এয়ারফোর্সে নতুন চাকরির হয়েছে মাত্র এই মাসে। ওর পক্ষেও আসা সম্ভব না। ভাইয়াকে বলেছিলাম কিন্তু সেও নানান ঝামেলায় জর্জরিত। কয়েকবার এসে দেখে গিয়েছে কিন্তু ফুলটাইম থাকার সময় তার নেই। আসলে এই জগতে কেউ কারো না। বিপদে পড়লেই আপন পর চেনা যায়।
অবশেষে এই হতভাগীকে বলার সাথেই রাজী হয়ে গেল হাসপাতালে থাকতে। সারাক্ষণ সেলিমের দেখভাল করছে। নিজের বাবার জন্য মেয়ে যেভাবে করে ঠিক সেভাবেই করছে সে। সেলিমের কখন কি লাগবে সবদিকে খেয়াল তার।

মেয়েটা আমার জনম দুঃখিনীই রয়ে গেল। কী ভাগ্য নিয়ে আল্লাহ ওকে দুনিয়াতে পাঠিয়েছে আমি হিসেব মিলাতে পারি না।
মাস ছয়েক আগে গ্রাম থেকে ফেরার পথে গাড়ি দুর্ঘটনার কবলে পড়ে সাজিদ আর ওর মা। সাজিদের মা স্পটেই মারা যান। সাজিদ দুর্ঘটনার পরে পনেরো দিনের মতো বেঁচে ছিল । পনেরোটা দিন হাসপাতালে জীবনের সাথে অনেক যুদ্ধ করেও টিকতে পারল না। মস্তিষ্কে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের জন্য পুরো শরীরের উপর ধীরেধীরে নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছিল সে। নিজেও বুঝতে পেরেছিল যে তার বুঝি আর সময় নেই। মিথিলার হাত ধরে ফ্যালফ্যাল করে শুধু তাকিয়ে থাকত। চোখের ইশারায় দু’জন কত কথা বলত । কত স্বপ্ন ছিল দু’জনের। মিথিলার মাস্টার্স শেষ হবে এ বছর। এ বছর তারা বাচ্চা নিবে সেই প্লান অবধি করেছে দু’জন মিলে।

আমি বারবার মিথিলাকে বলতা্ম একটা বাচ্চা নেবার জন্য। তখন মিথিলা আমাকে বলত সাজিদই নাকি এখন বাচ্চা চাচ্ছে না। মিথিলার পড়াশোনায় যাতে কোনো ক্ষতি না হয় তাই সে একটু দেরি করেই বাচ্চা নেওয়ার প্লান করেছে। হায়রে নিয়তি! মুহূর্তেই সব স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার । আমি মিথিলার মুখের দিকে তাকাতে পারি না। মেয়েটার চোখের পানি শুকিয়ে গিয়েছে।
সাজিদ যেদিন এই পৃথিবীর সব মায়া ত্যাগ করে ওই পারে চলে গেল সেদিনও মিথিলার চোখে একফোঁটা পানি দেখিনি। মেয়েটা পাথরের মতো হয়ে গিয়েছে। একই সাথে মায়ের মতো শাশুড়ি আর স্বামীর মৃত্যুতে মিথিলা যেন একটা পাথরের মূর্তিতেই রূপ নিয়েছিল।
ওর এমন অবস্থা দেখে আমার অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। আমি নিজেকেই সান্ত্বনা দেবার ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলাম না সেখানে ওকে কী করে সামলাব? মিথিলার ননদ শান্তার বিয়ে হয়েছে বেশ আগেই। সে রাঙামাটিতে থাকে হাসবেন্ডের সাথে। বাসাতে ওর দেবর আর ওই থাকছে এখন। ওর দেবর পড়াশুনা শেষ করার আগেই গোপণে ক্লাসমেটকে বিয়েশাদি করে ফেলেছে। এটা সাজিদও জানত। এ নিয়ে দু’ভাইয়ের সম্পর্কও ভালো যাচ্ছিল না। সাজিদ ওর মায়ের কাছে এ কথা বলার সাহস পাচ্ছিল না। ভাইয়ের এত বড় অন্যায়ের কথা কি করে বলবে অসুস্থ মাকে। আমার কাছে এ কথা মিথিলা জানিয়েছিল তখনই। তবে ওর শাশুড়ির কানে যেন না যায় সেই কথা বলে আমাকে সাবধানও করেছিল। উনি জেনেই গেলেন না যে ওনার ছোট ছেলে কী করেছে!

সাজিদের মারা যাবার এক মাস বাদেই ওর ছোটভাই সাব্বির তার বউকে ঘরে তোলে। না তুলেও তো উপায় নেই। তাছাড়া এখন বাধা দেবারও কেউ নেই। মিথিলা একটা টু শব্দও করেনি। চুপচাপ সব দেখেছে। আমি কতবার বলেছি আমার কাছে চলে আসতে কিন্তু সে আসতে রাজি না। ও বাড়িতে সে সাজিদের ঘ্রাণ খুঁজে পায় । সাজিদকে ছেড়ে সে কিছুতেই আসবে না। ওর বাবাও কত বুঝিয়েছে কিন্তু সে কিছুতেই রাজী হয় না। আমার শুধু ভয় হয় মেয়েটা ওখানে থেকে থেকে সাজিদের কথা ভাবতে ভাবতে না পাগল টাগল হয়ে যায়। নাওয়া খাওয়া কোনোকিছুর ঠিক ঠিকানা নেই। শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। চোখের নিচে কালি পড়েছে। সাজিদের যাবার পর থেকে সেই যে সাদা পোশাক ধরেছে আর ছাড়ার নাম নেই। কিছুতেই ওকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে পারছি না। ওর জীবনটা যেন থেমে আছে সেই ছয়মাস আগে। ওর ননদ শান্তা অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে ওকে সাথে করে রাঙ্গামাটিতে তার বাসায় থাকবার জন্য নিয়ে গিয়েছিল গতমাসে। দু’দিন থেকেই পাগলের মতো ছুটতে ছুটতে আবার চলে এসেছে ঢাকাতে। কোথাও যেয়ে তার মন বসে না।

মাঝে মাঝে ভাবি এ জগতে সুখী মানুষ কে? সুখের সংজ্ঞা কি? কোথায় পাওয়া যায় সুখের খোঁজ ? কীভাবে সুখী হওয়া যায় ? এত দুঃখ কষ্ট নিয়েই যদি পৃথিবীতে বাঁচতে হবে তবে এই বেঁচে থাকবার চাইতে মরে যাওয়াই বুঝি ভালো। সুখের পেছনে ছুটতে ছুটতে আমি এখন ক্লান্ত।

এনার সাথে প্রিয় যেদিন ইতালিতে চলে এসেছিল সেদিনের কথা আমি আজও ভুলতে পারি না। যে সেলিম ছেলের জন্য নিজে পছন্দ করে বউ এনেছিল সেই সেলিমই নিজ হাতে ছেলে আর ছেলে বউকে ঘর থেকে বের করে দেয় সেদিন।

এনার বেয়াদবি দিনদিন এতই বেড়ে যাচ্ছিল যে আমার সাথে বেয়াদবি করতে করতে সে সেলিম , সেলিমের মা কাউকেই ছাড় দেয়নি।

সেলিমের আদর আর সাপোর্ট পেয়ে সে খুব বেশি বেপরোয়া হয়ে পড়ে। প্রিয় এগুলি একদমই গায়ে মাখত না। কারণ সে জানত এনা বশে আসার মতো মেয়ে না। তাই নিজেদের মাঝে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে সে কখনোই এনার সাথে তর্কাতর্কিতে যেত না।
এনার এটা সেটা নিয়ে আমি যখন আপত্তি করতাম তখন প্রথম দিকে আমার বিপরীতে থাকলেও ধীরেধীরে আমার শাশুড়ি বুঝতে পারে যে এনা আসলেই বেয়াদব। সেও একসময় আমার সাথে তাল দিয়ে এনাকে বোঝাত। আবার নানা সময় শাসনও করতে চাইত।
এনার ঘর সংসারে একদমই মন ছিল না। যখন যেখানে মন চাইত সেখানে চলে যেত। সে প্রিয়কেও কিছু বলার প্রয়োজন মনে করত না। ওর বাবা মায়ের সাথে এ নিয়ে কথা বললে তারা জানায় এনা ছোটবেলা থেকেই একটু বেপরোয়া। কিন্তু এতটা ছিল না। তারা এনাকে সাংসারিক করার জন্য সলিউশান হিসেবে বলে তাকে আর প্রিয়কে ইতালিতে পাঠিয়ে দিতে। এনাও বেশ কিছুদিন ধরে ইতালি যাবার জন্য পায়তারা করছিল । সে ইনিয়ে বিনিয়ে প্রিয়র কাছে অনুরোধ করত ইতালিতে চলে যাবার জন্য। প্রিয় এটা পাত্তাই দিত না । এতে এনার চলাফেরা আর ব্যবহার আরো খারাপ হতে শুরু করে। একসময় এমন অবস্থা হয় যে সে সেলিমকেও অপমান করতে ছাড়ত না সে। সেলিমকে আমার শাশুড়ি প্রায়ই ওর উল্টাপাল্টা আচরণের কথা নালিশ করত। তাছাড়া আমাকে অপমান অপদস্ত করত তো করতোই। সে আমার শাশুড়িকেও ছাড়ত না। উনি এনার এমন চলাফেরা নিয়ে কথা তুললেই নানান কথা শুনিয়ে দিত উলটা তাকে। সেলিমও বিরক্ত হয়ে পড়ে এনার আচরণে। এটা নিয়ে তার সাথে কথা বলতে গেলেই সেলিমের উপরও ফোঁস করে উঠত এনা। এনার ধারণা সেলিমের ব্যবসা বাণিজ্যের অধিকাংশই তার বাবার টাকায় চলে। দু’একদিন তো মাথা গরম করে এ নিয়ে খোঁটাও দিয়েছে সেলিমকে।
প্রিয়কে তো প্রায়ই বলত, এ দেশের ব্যবসা বাণিজ্য সব নাকি তার বাবার। প্রিয়র সাথে বাকবিতণ্ডাও হতো এসব নিয়ে।

সাংসারিক অশান্তি এমন পর্যায়ে যেয়ে পৌঁছে যে সেলিমের সাথে এনার বাবার সম্পর্ক খারাপ হতে শুরু করে। মেয়েকে আর জামাইকে ইতালিতে নেবার জন্য নানান ভাবে কৌশল করতে থাকে সে। কিন্তু প্রিয় কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না। হঠাৎ খেয়াল করলাম এনা আর প্রিয়র সম্পর্ক ধীরেধীরে স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। সংসারে মনোযোগী না হলেও প্রিয়র প্রতি যে মনোযোগী হয়েছে এটাতেই আমার ভালো লাগে। দু’জন একসাথে বাইরে যাচ্ছে , সময় কাটাচ্ছে, একজন আরেকজনের পছন্দ অপছন্দ নিয়েও বেশ সতর্ক। মনে মনে খুব দোয়া করতে থাকলাম আল্লাহর কাছে যাতে ওদের সম্পর্ক আরো মজবুত হয়।
কিন্তু সেলিম আর কিছুতেই এনাকে মেনে নিতে পারছিল না। আমি ওকে বোঝাতে শুরু করলাম যাতে এনার ব্যাপারে সে পজিটিভ হয়। কিন্তু কিছুতেই সে এনার সেই বেয়াদবির কথা মন থেকে সরাতে পারছে না। তাছাড়া এনার বাবার সাথের ব্যবসায়িক সম্পর্কও খুব খারাপ যাচ্ছে। আমি ভাবলাম এটাই হয়ত এনাকে পছন্দ না করার কারণ।
এনা আমাদের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক না রাখলেও প্রিয়র সাথে খুব ভালো সম্পর্ক তৈরি করে ফেলেছিল কয়েক মাসের মধ্যে। এনাকে আমরা খুব বেশি পছন্দ করতাম না এটাতে প্রিয়র খুব আপত্তি ছিল। সে এনার ভাষায় কথা বলতে শুরু করল আস্তে আস্তে। তাছাড়া এনার বাবার নানান অসঙ্গতি নিয়ে খাবার টেবিলে প্রায়ই বাকবিতণ্ডা হতো বাপ ছেলের। আমি নিরব দর্শকের মতো সব সহ্য করতাম । এছাড়া করারই বা কী ছিল?

এরমাঝে হঠাৎ একদিন সেলিম বাসায় এসে চিৎকার শুরু করল এনার নাম ধরে। প্রিয়ও সেদিন বাসাতেই ছিল। এনার সাথে সাথে সেও রুম থেকে বের হলো।
এনাকে দেখেই সেলিম হুংকার করে বলে ওঠে, আমরা নাকি তোমার সাথে খুব দুর্ব্যবহার করি? এনা কোনো উত্তর না দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। সেলিমও আবারও একই প্রশ্ন করলে এবার প্রিয় মুখ খোলে। সে তার বাবাকে বলে, কী হয়েছে সেটা বলো। এসব পুরানো কাসন্দী ঘেটে কী লাভ?
– বউয়ের জন্য দরদ একদম উথলে উঠছে দেখছি। তোমার শ্বশুর কী করছে সেদিকে কোনো খোঁজখবর রাখছ?

– কী করেছেন উনি?

– সে আমাদের গার্মেন্টেসে যত অর্ডার করেছিল সব ক্যানসেল করে দিয়েছে। শিপমেন্ট প্রায় রেডি আর উনি এই সময় অর্ডার ক্যানসেল করছে। তুমি কি কিছু বুঝতে পারছ? তাছাড়া উনি আমাকে একমাসের সময় দিয়েছেন উনার সব ইনভেস্টমেন্ট তুলে দেবার জন্য। তোমার শ্বশুরকে তো আমি সেধে আমার কোম্পানীতে ইনভেস্ট করতে বলিনি। সে নিজে থেকে এসেই ইনভেস্ট করেছে। সে টাকা আমি নানান জায়গায় অলরেডি ইনভেস্ট করে ফেলেছি। আর উনি হুট করে এখন এসে টাকা ফেরত চাইছেন এসবের মানে কী?

– আমি কী করে বলব? তাকে জিজ্ঞেস করলেই তো হয়।

– তাকে জিজ্ঞেস করেছি। সে বলেছে সে নাকি আমাদের কোম্পানীতে এসেছিল তার মেয়ের সুখ কিনতে! যেহেতু তার মেয়ে আমাদের সংসারে সুখী নয় তাই সে সব ফিরিয়ে নিতে চায়। আমার কথা হলো তার মেয়েকে আমরা কী করি যে সে সুখী না? জিজ্ঞেস করো তোমার ওয়াইফকে । সে কী এমন নালিশ করেছে তার বাবাকে?

– যা করেছে মিথ্যা নিশ্চয়ই করেনি। তোমরা কেউই তো ওর সাথে স্বাভাবিক আচরণ করো না। এক টেবিলে বসে খাবার পর্যন্ত খাও না।
– বা বাহ! বউয়ের দিকে কত খেয়াল! এই যে মেয়ে এনা, তুমি শুনে রাখো! তোমার বাবা নিজেকে কী মনে করে জানি না। তাকে বলে দিও আমার নামও সেলিম । তোমার বাবার ওই দুই টাকা ফিরিয়ে দেওয়া আমার জন্য বা হাতের ব্যাপার। আমি সবই ফিরিয়ে দিচ্ছি। আর শিপমেন্ট বাতিল হওয়ায় যা লস হচ্ছে তাও ইন শা আল্লাহ পুষিয়ে নিব। তোমার বাবা আমাকে কী রাস্তার কেউ ভেবেছে?

– তাইই ভালো। উনার ইনভেস্টমেন্ট ফিরিয়ে দিলেই তো ল্যাঠা চুকে গেল। বলল, প্রিয়।

– আজকাল তো বউয়ের ভাষায় কথা বলা শিখতে শিখতে শ্বশুরের ভাষায়ও বলা শিখেছিস। মন্দ না। দারুণ উন্নতি।

ওইদিন রাতে খাবার পরে প্রিয়কে রিডিং রুম ডাকল সেলিম। আমিও যাই সেখানে। ভেবেছিলাম আমাকে হয়ত সেলিম বের করে দিবে কিন্তু দিলো না।

সে প্রিয়কে যা বলার জন্য ডেকেছে সেটা শোনার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। সে প্রিয়কে বলে এনাকে ডিভোর্স দিতে। এ কথা শুনে আমার মতো প্রিয়রও মুখ হা! সেলিম আদেশের সুরে আবারও তাকে একই কথা বলে, আমি বোঝাতে গেলে আমাকে ধমক মেরে বসিয়ে দেয়। এনাকে বউ করে এনে সে ভুল করেছে সেটাও অকপটে স্বীকার করে।

কিন্তু প্রিয় তার বাবাকে সাফ মানা করে দেয় ডিভোর্সের ব্যাপারে। সেলিম প্রচণ্ড ক্ষেপে যায় প্রিয়র কথা শুনে।

প্রিয় তখন বলে, তুমি কী পেয়েছ আমকে? আমি কি তোমার হাতের খেলনা নাকি চাবি দেওয়া রোবট? আমার জীবনের সব সিদ্ধান্ত তুমি নিয়েছ । আমি মুখ বন্ধ করে সহ্য করেছি সবসময়। আমার চাওয়া পাওয়া , ভালো লাগা মন্দ লাগা কোনোকিছুরই মূল্য নেই তোমার কাছে। যখন যা মনে চেয়েছে চাপিয়ে দিয়েছ। আমার ভালোবাসাকে গলা টিপে খুন করেছ আর আমি বোবার মতো শুধু চেয়ে চেয়ে দেখেছি। তোমার পছন্দের একটা মেয়ের সাথে বিয়ে ঠিক করলে। স্টাটাসের লেভেল বজায় রাখতে যেয়ে একটা বেপরোয়া , বেয়াদব টাইপের মেয়েকে বউ করে গলায় ঝুলিয়ে দিলে। আমি কিচ্ছু বলিনি। তোমার আদেশ মাথা পেতে নিয়েছি। আর এখন যখন সেই মেয়েটিকে নিয়ে শিখিয়ে পড়িয়ে মোটামুটি কিছুটা নিজের মতো করে একটা জগত তৈরি করেছি তখন আবার তুমি নিজেই তাকে ডিভোর্স দিতে বলছ! বাহ!
আমার জীবন কোনো এক্সপেরিমেন্ট করার স্থান না যে যখন যেভাবে প্রয়োজন এক্সপেরিমেন্ট শুরু করবে।
অনেক হয়েছে। এবার আর আমি এসব একদমই টলারেট করব না। একদম না।

সেলিম প্রচণ্ড ক্ষেপে যায়। সে প্রিয়কে আরো বোঝায় কিন্তু সে কিছুতেই তার সিদ্ধান্ত থেকে নড়ছে না। তুমুল বাকবিতণ্ডা হয় দু’জনের মাঝে। সেলিম সেদিন গায়েও হাত তোলে অতবড় ছেলের। পরে কিছুতেই যখন প্রিয় এনাকে ডিভোর্স দিতে রাজী হয় না তখন সেলিম সেই মুহূর্তে প্রিয়কে তার বউ নিয়ে ঘর ছেড়ে চলে যেতে বলে।

প্রিয়ও আর অপেক্ষা না করে রাগে গড়গড় করতে করতে সেখান থেকে বেরিয়ে যায়। আমি সেলিমকে বোঝাই যাতে ওকে বোঝায়। কিন্ত লাভ হলো না। সেই যে প্রিয় ওর বউকে নিয়ে ঘর ছাড়ল আজ পর্যন্ত সে বাসায় ফেরেনি। বাপ ছেলে নিজেদের অহমিকাবোধ নিয়েই ব্যস্ত। কেউ একবারের জন্যও আমার মনের অবস্থা বুঝতে চাইল না। কিছুই করতে পারলাম না শুধু চোখের পানি ফেলা ছাড়া।

আজ দুই বছর বাপ ছেলেতে মুখ দেখাদেখি বন্ধ। প্রিয় এখানে এসে শ্বশুরের ব্যবসায়ের হাল ধরেছে। তার শ্বশুরও ভীষণ খুশি। এগুলি সব আসলে প্রিয়কে ইতালিতে নেয়ার একটা প্লান ছিল পরবর্তীতে বুঝতে পেরেছি। কিন্তু বাপ ছেলে ওনার ট্রাপে পা দিয়ে ফেলেছে যেটার। কারণে আমাদের সংসার একদম ছিন্নভিন্ন।

এনার বাচ্চা হবে। আমাদের বংশের প্রথম প্রদ্বীপ। কত আশা আর স্বপ্ন ছিল আমার। সবই শেষ। প্রিয়র অনেক অনুনয়ে আমি ইতালিতে আসি। প্রিয়র খুব শখ তার বাচ্চাকে যেন প্রথমে আমি কোলে নেই। তাই ছেলের শখ পূরণ করতেই ইতালি ছুটে আসা। কিন্তু এখানে আসতে না আসতেই সেলিমের এতবড় বিপদ।

চলবে…

পর্ব- ৩৮
https://www.facebook.com/111576077291737/posts/384180386697970/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here