সুখের_সন্ধানে পর্ব_৪০

0
439

#সুখের_সন্ধানে
#পর্ব_৪০

প্রিয় আমার সাথে যাবার জন্য টিকেট করে ফেলল। আগামী পরশুর ফ্লাইটে যাচ্ছি আমরা। প্রিয় আমার সাথে যাচ্ছে ভেবে আমার যে কি পরিমাণ খুশি লাগছে! ছেলেটা বাবার সাথে অভিমান করে আর কোনোদিন বাংলাদেশেই যাবে না বলে স্থির করেছিল । কিন্তু বাবার উপর যতই রাগ থাকুক বাবার এমন বিপদের কথা শুনে কোনো ছেলের পক্ষেই রাগ পুষে রাখা সম্ভব না। আমি সেলিমের কাছে কিছুই বলিনি। আমি ওকে সারপ্রাইজ দিতে চাই। ছেলেকে কাছে পেয়ে হয়ত শারীরিক অবস্থার উন্নতিও হতে পারে। ছেলের উপর যতই রাগ অভিমান থাক না কেন এতদিন পরে ছেলেকে কাছে পেলে সবই ভুলে যাবে সে। এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস। আমি কাউকেই এখন পর্যন্ত প্রিয় আসছে আমার সাথে এ কথা জানাই নি।

এদিকে প্রিয় আমার সাথে যাচ্ছে এ নিয়ে তুমুল হাঙ্গামা শুরু করেছে এনা এবং তার মা। তারা কিছুতেই প্রিয়কে এখন এনাকে এই অবস্থায় রেখে প্রিয়কে বাংলাদেশে যেতে দিবে না। এনার যেকোনো মুহূর্তে এখন ডেলিভারি পেইন শুরু হতে পারে। তাই তারা এ অবস্থায় প্রিয়র যাওয়াটা মেনে নিতে পারছে না। এনার বাবা চুপচাপ মানুষ। খুব সহজে কথা বলেন না। সেই তিনিও প্রিয়কে বাংলাদেশে কেন নিয়ে যাচ্ছি তা নিয়ে নানান ধরণের কথা শুনিয়েছেন আমাকে। আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে হজম করেছি। একটা কথাও বলিনি। কেন যেন কথা বলতে মন চায়নি। হজমশক্তি প্রচণ্ড উন্নতমানের যে আমার। সারাজীবন অমেরুদণ্ডী প্রাণীর মতো কথা হজম করতে করতে মেরুদণ্ড যে সাথে আছে সেটাই ভুলে গেছি। তাই চুপ করেই ছিলাম আমি। উনি নানান কথার বাণে আমার ধৈর্য পরীক্ষা নিচ্ছেন আর আমি শুনেই যাচ্ছি।

আমার রুমে বসে ফেরার জন্য আমি ব্যাগ প্যাক করছি। প্রিয়র কিছু টুকটাক প্যাকিংও আমাকেই করতে হচ্ছে। এনা প্রিয়র সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। এটা অবশ্য নতুন না। বাংলাদেশে বসেও দেখেছি পান থেকে চুন খসলেই এনা কথা বলা বন্ধ করে দেয় সবার সাথে। এনা অবশ্য এনার জায়গায় ঠিক আছে। সব স্ত্রীই চায় তার এমন মুহূর্তে তার স্বামী পাশে থাকুক। আমি হলেও তাই চাইতাম। কিন্তু কেন যেন আমি এখানে স্বার্থপরের মতো আচরণ করছি। এনাকে যদিও আমার কোনোকালেই পছন্দ না। আর পছন্দ হবার মতো কোনো গুণই আজ অবধি আমি খুঁজেও পাইনি। এখানে আসার পরেও দেখেছি ও সেই আগের মতোই অহংকারী আর বেয়াদবই রয়ে গেছে। চুল পরিমাণও পরিবর্তিত হয়নি বরং আগের চাইতে তেজ আরো বেড়েছে। চটাং চটাং করে কথা বলে আমার সাথে। বলবেই তো! সেই তো জিতেছে। আমার বুক খালি করে আমার একমাত্র ছেলেকে এই দূরদেশে নিয়ে চলে এসেছে। তাই পরোয়া কিসের আর তার। তাছাড়া বাচ্চা হচ্ছে। সে নিজেই আমাকে গতকাল বলেছে, “ আরেকটু অপেক্ষা ! এরপর আর ভয় কীসের? একবার বাচ্চা হয়ে গেলে প্রিয় আর কোনোদিনই মায়ার টানে বউ বাচ্চা রেখে ইতালি ছেড়ে বাংলাদেশে বাপ দাদার ব্যবসায় দেখাশোনা করতে যাবে না। এখানে আমাদেরও অঢেল আছে। একসময় তো সবকিছু তারই হবে । তাই প্রিয়র আর পিছুটান কীসের? “
আমি চুপচাপ শুধু শুনেছি। উত্তরই বা দিব কি? সারাজীবন শুধু উত্তর খুঁজতেই পার করে দিলাম। পুরো লাইফটাতে কম্প্রোমাইজ করতে করতে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। একসময় শ্বশুরবাড়িতে এসে সবার কথা শুনেছি , এখন নিজে যখন শাশুড়ি হয়েছি তখনও আবার বউয়ের কথা শুনছি। আসলে যে বলতে পারে না সে কোনোকালেই পারে না। আমি প্রতিবাদ করার চেষ্টা করেছি কিন্তু তাতে কোনোকিছুই শোধরায়নি। সবকিছুই তালগোল পাকিয়ে গেছে আরো। সংসার বাঁচাতে , সন্তানের ভবিষ্যৎ ভেবে কত কিছুই তো মুখ বুজে সহ্য করেছি, হজম করেছি। এখন জীবনের এই কালে এসেও সেই একইভাবে ঘুরছে আমার জীবনের চাকা। নিজের সন্তানকে কাছে পেতে অন্যের কথা শুনতে হয় আমার। জানিনা এটা আমার কোন জনমের পাপের শাস্তি?

সেলিমের জন্য খুব মায়া হয় এখন আমার। ছেলেটা চলে আসার পর থেকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত সে। ব্যবসায় বাণিজ্যে আগের মতো মন নেই একদম। বিজনেসের একের পর এক লস তাকে আরো ভেঙ্গে ফেলেছে। একসময় যে হাতে শক্ত করে বৈঠা ধরেছিল সেই হাত এখন হাল ধরতেই ভয় পায়। এই সুযোগে ব্যবসায় বাণিজ্যের অধিকাংশই প্রিয়র ছোট চাচা সজলের দখলে। প্রিয়র ফুফু বছরান্তে এসে হিসেব নিকেশ করে নিজের অংশ নিয়ে চলে যায়। সেলিম এখন কোনোকিছু নিয়েই মাথা ঘামায় না আর। তার শুধু ভাবনা এত সম্পত্তি দিয়ে হবে কি? খাবে কে? যে ছেলে বাবার সাথে এই দুই বছর একটা কথা পর্যন্ত বলেনি, ব্যবসায়ের খোঁজখবরও নেয়নি। সেই ছেলেকে নিয়ে আর কি আশা! উলটো শ্বশুরের ব্যবসায়ে খুব মন লাগিয়ে কাজ করছে। সব খবরই রাখে সেলিম। প্রিয়র এমন আচরণ তাকে পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছে। আমাকে ইতালিতে সে আসতে পর্যন্ত দিতে চায়নি সে। প্রিয়র বাচ্চা হবে কি না হবে তা নিয়েও তার কোনো মাথাব্যথা নেই। এনার পেটের সন্তানকে সে নিজের নাতি হিসেবে ভাবতেও চায় না। আমি অনেক বুঝিয়ে পরে এসেছি।
এতদিন তবু মনে অশান্তি থাকলেও শরীরটা তো ভালো ছিল কিন্তু এখন যে অবস্থা জানিনা কোনোদিন আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবে কিনা। মিথিলা আমাকে যতই যাই বলুক না কেন আমার মনে হচ্ছে সেলিম ভীষণ অসুস্থ। তার এমন বিপদের দিনে একটা আপনজনও পাশে নেই। কী হলো সারাজীবন ধরে এই মিথ্যে অহংকার দেখিয়ে?
এমন হাজার কিছু ভাবতে ভাবতে মনে হলো মাগরিবের ওয়াক্ত হয়ে গেল নামাজ পড়া দরকার। নামাজের জন্য উঠব মাত্র তখনই এনা আর ওর মা ঘরে ঢুকল। এই দু’জনকে দেখলেই আমার শিরদাঁড়া বেয়ে যেন ঠাণ্ডা স্রোত নামতে শুরু করে। খুব ভয় করে এদের। সারাক্ষণ দেখলেই টেনশান হয়। না জানি কি থেকে কি বলা শুরু করে! এগুলো ফেস করতে হবে জেনেবুঝেই আমি এখানে এসেছিলাম। শুধুমাত্র ছেলেটার কাছে থাকতে পারব সেই লোভেই আসা।
ওদেরকে দেখে আমি উঠে দাঁড়ালাম ।

– কি ব্যাপার? হঠাৎ মা মেয়ে একসাথে আমার রুমে? কিছু কি বলবেন ,আপা?

– ব্যাপার তো সব আপনার কাছেই। তাই আপনার কাছে আসা ছাড়া আর উপায় আছে বলুন! আমার মেয়েটার মুখের দিকে তাকাতে পারছি না। ওর এ সময়ে কত হাসিখুশি থাকতে হবে আর সেখানে এমন আপসেট হয়ে থাকলে ওর এবং বেবির কী পরিমাণ ক্ষতি হবে আপনি বুঝতে পারছেন? এমনিতেই বেবির ওয়েট কম আর সেখানে যদি ওর সাথে এমন সিচুয়েশান তৈরি হয় তবে বেবির গ্রোথ কী করে হবে বলুন তো! যেতেহু একটা বাচ্চা আপনারও হয়েছে তাই নিশ্চয়ই এই মুহূর্তটার গুরুত্ব আপনি বুঝতে পারছেন! আমি অবাক হই ভেবে কেমন অবিবেচক মা আপনি? আর তেমনি হয়েছে আপনার ছেলে।

– আপা, প্রিয় মাত্র সাতদিনের জন্য যাচ্ছে। ভয় পাবেন না আপনার জামাইকে আমরা আটকে রাখছি না। ফিরতি টিকেট করেই সে যাচ্ছে। তাছাড়া প্রিয় চলে গেলেই বা কি আপনি ভাইসাহেব সবাইতো আছেন।
আমি একটু হেসে বললাম, আমরা যতই অবিবেচক হই আপনাদের মতো না!

– আমরা অবিবেচকের মতো কী করেছি? ক্ষেপে যেয়ে বলল, এনার মা। এনা পাশে দাঁড়িয়ে শুধু ফুলছে।

– কিছু করেন নি? এক মায়ের কোল খালি করে তার সন্তানকে নিয়ে এসেছেন। আবার বলছেন কী করেছি!

– আমরা তাকে মোটেও নিয়ে আসিনি। আপনারা তাকে ঘরছাড়া করেছেন। আমার মেয়ে নিশ্চয়ই পথে পথে ঘুরবে না ফকিরের মতো!

– মেয়ে বিয়ে দেবার পর আসল ঠিকানা শ্বশুরবাড়ি। সেখানে মান অভিমান কত কিছুই হতে পারে। সেলিম বের করে দিয়েছে আর অমনি পরের দিনই তাদের ইতালি চলে আসতে হবে? প্রিয়র তো টাকা পয়সার অভাব নেই যে থাকবার জায়গা হবে না। ঢাকাতে প্রিয়র থাকার জায়গার অভাব হবার কথা না। বাংলাদেশে আরো কিছুদিন থেকে বাবার কাছে ক্ষমা চাইলে বা তার সাথে কথা বললে হয়ত সে ক্ষমা করেও দিতে পারত! তাছাড়া আমিও সেলিমকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলাম! সেলিমের মন নরম হতো হয়ত ওদের আবার বাসায় উঠতে দিত। সেই অপেক্ষা কি করেছে আপনার মেয়ে? সেলিমের সাথে এতো এতো বেয়াদবি করেছে অথচ একবারও সরি বলার প্রয়োজন মনে করেনি। একটার পর একটা অন্যায় করেছে এই নাটক সাজানোর জন্যই। যাতে আমার ছেলেটা বাবার সাথে মিসবিহেভ করে আর আপনারা সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারেন।

– বাহ! কী চমৎকার ব্লেম দিচ্ছেন আমার মেয়েটার উপর! আপনার ছেলে কি ফিডার খায় যে আমার মেয়ে বলল অমনি সে তার হাত ধরে ঘর জামাই হতে চলে আসলো ? আর ওদেরকে কতক্ষণ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলতে চাচ্ছেন যতক্ষণ না আমার মেয়েকে প্রিয় ডিভোর্স না দেয়? কী চিপ মেন্টালিটিরে বাবা! বাপ হয়ে ডিসাইড করে ছেলে বউকে ডিভোর্স দিবে কি দিবে না!

– রাগের মাথায় সে যেটা করেছে ঠিক করেনি এটা আমি অস্বীকার করছি না। কিন্তু তাই বলে বাবার থেকে ছেলেকে এভাবে আলাদা করেও আপনার মেয়ে খুব ভালো কিছু করেনি। আচ্ছা, আমরা এসব পুরানো কথা নিয়ে বর্তমানকে আর কত খারাপ করব , বলুন তো! এসব কথা এখন বাদ দিন, প্লিজ। আসার পর থেকে তো এই একই কথা শুনিয়ে যাচ্ছেন। আমি আপনার এখানে শখ করে আসিনি। প্রিয় খুব করে ধরেছে তাই আসতে বাধ্য হয়েছি। না হলে আসতাম না। তাছাড়া অনেকদিন ধরে দেখতেও মন চাইছিল যে আমার আদরের ছেলেটা কোন দোজখের আগুনে পুড়ছে একটু দেখে আসি!

– আমার বাসাকে আপনার বাসাকে আপনার দোজখ মনে হচ্ছে? হাউ ফানি! কি আর বলব? আমার মেয়েটাকে তো জান্নাতে রেখেছিলেন আপনারা! তাই আপনার ছেলেকেও ভাবছেন একই ট্রিট দিচ্ছি কি না তাইতো! ভয় নেই । আমরা আপনাদের মতো অমানুষের মতো ব্যবহার করছি না।

– বলতে বলতে কী বলেই যাচ্ছেন হুশ নেই। যাদেরকে অমানুষ বলছেন সেই অমানুষের বাচ্চার ভ্রূণই আপনার আদরের মেয়ের গর্ভে বড় হচ্ছে। তাই একটু সাবধানী হয়ে কথা বলবেন ,প্লিজ!

– আচ্ছা, আচ্ছা! যা বলতে এসেছি সেটা বলি!

– এখনো কিছু বলতে বাকি তবে!

– আপনি প্রিয়কে আজ আসলে বলবেন, তাকে আপনার সাথে নিচ্ছেন না।

– হা হা! কেন আপনার মেয়ে আর আপনি প্রিয়কে আটকাতে পারছেন না?

– আমরা কি পারছি আর কি না পারছি সেটা দেখতে না চাওয়াই আপনার জন্য মঙ্গল । তাই হেয়ালিপনা বাদ দিয়ে যা বলছি সেটা করবেন। কিছুটা হুকুমের স্বরে বলল, এনার মা ।

– আমি অবাক হবার শেষ পর্যায়ে চলে গেলাম। বললাম, আমি কি আপনার হুকুমের দাস? এমনটা ভুলেও ভাববেন না। আপনারা আমার ছেলেটাকে হুকুমের দাস বানাতে পারেন কিন্তু আমাকে না। আপনারা কি খুব ভয় পাচ্ছেন যে প্রিয়কে আর আসতে দেই কি না! ভয় নেই সেটা করব না। বাপের থেকে সন্তানকে আলাদা করার কষ্ট কতটা ভয়ানক আমি দেখেছি। তাই সেম কষ্ট আমার ছেলেকে আমি দেবার মতো নির্দয় না। এনার নয় মাস পূর্ণ হতে এখনো সপ্তাহ পড়ে আছে। ডেট আরো ক’দিন পরেই। তাই আল্লাহ না করুক কোনো অঘটন না ঘটলে প্রিয় আসার পরেই ওর ডেলিভারি হবে। এক অসুস্থ বাবাকে তার সন্তান দেখতে যাবে সেটাতে এত বাঁধা দিচ্ছেন কেন আপনারা ?

– প্রিয় গেলেই কি আপনার স্বামী ভালো হয়ে যাবে? উনি সারাজীবনের জন্য ল্যাংড়া হয়ে গেছে। গিয়ে একটা হুইল চেয়ার ধরিয়ে দিন। শুধুশুধু আমার মেয়ের জীবনটা নরক বানাতে ইতালিতে কেন এসেছেন?

আমার এত অপমান আর সহ্য হচ্ছিল না। মন চাচ্ছিল মহিলার গালে কষিয়ে একটা থাপ্পড় মারি। আরো একটা দিন এই অমানুষগুলির সাথে থাকতে হবে ভেবে বুক ধড়পড় করছে। আমি চাইলেই অন্য জায়গায় যেয়ে থাকতে পারি কিন্তু সেটা করছি না যাতে প্রিয়কে আবার আমার বিরুদ্ধে ভড়কে না দেয়। আমার এই একটু আশা ছেলেটাকে তার বাবার সামনে দাঁড় করলে বাপ ছেলের মান অভিমান পর্ব হয়ত শেষ হবে। আমার ছেলেটা আমার শূণ্য বুকে ফিরে আসবে। এনাও ওর ছেলেকে নিয়ে আমাদের সাথেই থাকবে । আমি সব অপমান মুখ বুজে সহ্য করতে রাজি শুধুমাত্র আমার আদরের ধনকে কাছে পাবার আশায়।
ছেলেটা এখানে শ্বশুর , শাশুড়ি আর বউয়ের হুকুমের গোলাম! সারাদিন অফিস সামলে এসে আবার এনার ফাই ফরমায়েশ আর নখরা দেখতে দেখতেই ওর যে একটা পার্সোনাল লাইফ আছে সেটা ভুলেই গেছে। খুব ক্লান্ত থাকে সবসময়। সেই আগের মতো শরীরটাও আর নেই। কেমন মুটিয়ে গেছে। নিজের দিকে একদমই খেয়াল নেই ওর। আগে কত মেইন্টেইন করত! এখন কোথায় কী!

আমি আর কোনো কথা বলছি না দেখে মা মেয়ে গজগজ করতে করতে চলে গেল।

আজ সকালে সেলিমকে ডিসচার্জ করে দিয়েছে। হাত পা অবশ ছাড়া আর কোনো সমস্যা নেই আপাতত। প্রেসারও মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে। সকালে প্রিয়র চাচ্চু সজল এসে ডিসচার্জ করে বাসায় দিয়ে গেছে।

মিথিলার এ বাড়িতে ঢুকতেই মন চাচ্ছে না। তাছাড়া এখানে রূম্পা মা নেই। তাই একদমই মন চাচ্ছে না বাড়ির ভেতর আসতে তবুও বাধ্য হয়ে সে এসেছে। তার খালুকে দেখবার মতো অনেক অনেক সার্ভেন্ট থাকলেও কোনো আপনজন নেই। উনার যে অবস্থা তাতে সারাক্ষণ কারো থাকাটা খুব জরুরী। সেলিমকে তার রুমে নিয়ে একজন সার্ভেন্টের সাহায্য নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলো। সেলিম ওর ডান হাত আর পা একদমই নাড়াতে পারছে না। কথা বলতেও খুব কষ্ট হচ্ছে তার। তারপরেও বলছে টুকটাক।

সেলিমের মা এসে ছেলের এ অবস্থা দেখে হাউমাউ করে কান্নাকাটি শুরু করল।
মিথিলা তাকে তাড়াতাড়ি রুমের বাইরে নিয়ে যেয়ে নানাভাবে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করছে । কিন্তু মায়ের মন। মানতে কি চায়?

– আমার ছেলেটা কি আর কোনোদিন দাঁড়াতে পারবে না আগের মতো? আমার সিংহের মতো ছেলেটার একি হলো? ওকে সুস্থ না করে কেন নিয়ে এলিরে তোরা? কাঁদতে কাঁদতে বলল, সে।

– দাদি, আংকেল এখন মোটামুটি সুস্থ। হাসপাতালের থেকে বাসায়ই থাকা তার জন্য ভালো। ওখানের পরিবেশ কেমন তা তো জানেনই। বাসায় এসে ডাক্তার প্রতিদিন চেক আপ করে যাবে। আর ফিজিওথেরাপিস্ট এসে তাকে থেরাপি দিয়ে যাবেন। আশা করা যায় দ্রুতই হাত পায়ের সেন্স ঠিক হয়ে যাবে। শুধু দোয়া করেন। এভাবে আংকেলের সামনে কান্নাকাটি করলে সে আরো বেশি সিক হয়ে পড়বে। ডাক্তার বলেছে তাকে মানসিকভাবে খুব সাপোর্ট দিতে হবে । এতে তার মনোবল বৃদ্ধি পাবে যা তার ট্রিটমেন্টের জন্য খুবই কার্যকরী।

– তুই কত কি করছিস রে, বোন! কি দিয়ে এই ঋণ শোধ করব, বল!

– কিছুই করতে হবে না দাদি। আংকেলের জন্য করছি আমার দায়িত্ব থেকে। সে আমার বাবার মতো। তার জন্য কিছু করতে পারাটা আমার সৌভাগ্য। আমার জন্য শুধু দোয়া করবেন দাদি যেন আগামী দিনগুলি একটু স্বস্তির সাথে কাটাতে পারি আর একটা শান্তির মৃত্যুকে বরণ করতে পারি।

– আরে পাগলি! এসব কেন বলছিস ? আল্লাহ তোকে আমার হায়াত দিক! অনেক বছর বেঁচে থাকবি এই আলোবাতাসের দুনিয়ায়।

– এই দোয়া দিবেন না , প্লিজ! বেঁচে থাকার একদমই সাধ নেই। কার জন্য বাঁচব ? কী করতে বাঁচব ?

– প্রিয়র দাদি নিজের চোখের পানি মুছতে মুছতে বলল, আমার পাপের শাস্তিই বোধ হয় আমার ছেলেটা পাচ্ছে। আমি যদি সেদিন সেলিমকে বোঝাতে সক্ষম হতাম তবে হয়ত আমাদের সংসারটা হতে পারত হাসি খুশির বাগিচা । এভাবে ধু ধু মরুভূমিতে পরিণত হতো না। সোশ্যাল স্টাটাস ঠিক রাখতে যেয়ে তোর মতো একটা লক্ষী মেয়ের সাথে কতবড় অন্যায় করেছি। আর সেই তুইই আমাদের চরম বিপদের সময় পাশে এসে দাঁড়িয়েছিস ! কোথায় আমাদের সেই দাম্ভিকতা আর সোশ্যাল স্ট্যাটাস? আমার আদরের ধন , আমার কলিজা প্রিয়কে মনে হয় না আর মরার আগে এক নজর দেখার সৌভাগ্য হবে! সবই আমার পাপের ফল। এখন শুধু চোখটা বোজার অপেক্ষা।
আমাকে মাফ করে দিস রে ,বোন! মাফ করে দিস! বলতে বলতে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল প্রিয়র দাদি।

– এসব কী বলছেন দাদী ? আমি সেসব কবেই ভুলেই গেছি। আল্লাহর ইশারায়ই সবকিছু হয়। তিনি আমার জন্য যা ভালো বুঝেছেন সেটাই করছেন। আমার কারো প্রতি এক ফোঁটা অভিযোগ নেই। আমার ভাগ্যটাই এমন। এখানে কারো কোনো হাত নেই। বলতে বলতে চোখের পানি মুছল মিথিলা।

সেলিমের খুকখুক কাশির শব্দ শুনে মিথিলা দৌড়ে রুমের ভেতরে গেল। তাড়াতাড়ি একহাতে সেলিমের মাথা তুলে অন্যহাতে সে তাকে পানি খাইয়ে দিলো। আবার খুব যত্নের সাথে তাকে শুইয়ে দিয়ে বলল, আমি আপনার স্যুপ নিয়ে আসি । খাবারের সময় হয়ে এল।

সেলিমের মাকে হুইল চেয়ারে ঠেলে তার কাজের মেয়েটা ছেলের রুমের ভেতরে নিয়ে আসলো। ছেলের এমন অবস্থা সে কিছুতেই সহ্য করতে পারছে না। না চাইতেও চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি পড়েই যাচ্ছে। আঁচলে গোপনে চোখ মুছে বলল, এখন কেমন লাগছে , বাবা?

– সেলিম অনেক কষ্টে একটা মুচকি হাসি দিয়ে বলল, খুব ভালো , মা! তুমি কাঁদছ কেন? আমার তো ভালোই লাগছে। আগে তুমি একা হুইল চেয়ারে চলাফেরা করতে এখন তোমার সঙ্গ দিতে পারব। মা ছেলে মিলে পাশাপাশি হুইল চেয়ারে সারাঘরে ঘুটঘুট করে ঘুরে বেড়াব। ভালোই তো হয়েছে।

– এবার আর সেলিমের মা নিজেকে সামলাতে পারল না। হাউমাউ করে কেঁদে উঠে ছেলের বিছানার কাছে যেয়ে তার বুকের ওপর আছড়ে পড়ল।

মা ছেলের এই দৃশ্য দেখে মিথিলাও এবার চোখের পানি আটকাতে পারল না। তারপরেও নিজেকে কোনোভাবে সামলে সে দাদিকে সামলাতে চেষ্টা করল। সে নিজেই সেলিমের এমন অবস্থা মেনে নিতে পারছে না। বাঘের মতো গর্জন করা মানুষটিকে এভাবে অপারগ দেখে সেও সহ্য করতে পারছে না। এ ক’দিন হাসপাতালে একটা বাচ্চাকে যেভাবে সামলাতে হয় সেভাবেই সামলেছে তাকে সে। এমন একজন মানুষের এমন অপারগতা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। সে শুধু রূম্পা মায়ের কথা ভাবছে। সে এলে কী করে সহ্য করবে। নিজের চোখে যখন সরাসরি সে এই দৃশ্য দেখবে কী করে নিজেকে সামলাবে? রূম্পা মাকে মিথ্যা মিথ্যা করে সে বলেছে আগের থেকে অনেকটাই বেটার ! ডাক্তার বলেছে খুব তাড়াতাড়ি সে আগের মত স্বাভাবিক হয়ে যাবে। কিন্তু সে তো জানে ডাক্তার কী বলেছে। সেলিমের বয়স প্রায় ষাটের কাছাকাছি। এই বয়সে তার যে অবস্থা হয়েছে তাতে এখান থেকে ওভারকাম করে সেই আগের অবস্থায় যাওয়াটা কিছুটা অসাধ্য সাধনের মতোই। কিন্তু এসব কথা সে রূম্পা মা বা সেলিম আংকেল কাউকেই বলেনি। তবে সেলিমের ছোটভাই সজল সবই জানে। সেও মিথিলার পরামর্শে এ কথা কাউকে জানায়নি। ধীরে ধীরে সময় হলে সবই একসময় জানবে। এখনই বলার দরকার নেই। তাছাড়া রূম্পা মা এসব জানলে অসুস্থ হয়ে পড়বে। সে নিজেও হাজারটা রোগে জর্জরিত। মিথিলা তার সব খবরই তো জানে। তাই সাহস পায়নি সবকিছু জানাতে। তার শুধু চিন্তা হচ্ছে রূম্পা মা নিজেই তো নানান সমস্যায় ভুগছে , এই পেশেন্ট সে কী করে সামলাবে? তাছাড়া ব্যবসায় বাণিজ্য বা কে সামলাবে? সেলিম আংকেলের ছোট ভাইকে দেখে কেন যেন মিথিলার মনে হয়েছে আংকেলের এই অবস্থায় সে হয়ত মনে মনে খুশি হয়েছে। পুরো ব্যবসায় বাণিজ্য সব একার দখলে। এমনিতেই ব্যবসায়ে রূম্পা মাদের অংশ বেশি বলে কত কত তামাশা করেছে সে আর তার বউ। মিথিলার কোনো কিছুই অজানা নয়। কিন্তু কিছুই করার নেই তার । সবই উপরওয়ালার ইশারায় ঘটছে। প্রিয়র উপর জমানো অভিমানটা তার আরো বেড়েছে। এই দুই বছরে মাত্র একবার তার সাথে কথা হয়েছে প্রিয়র। সাজিদের দুর্ঘটনার পরে প্রিয়ই রূম্পা মায়ের ফোনে কল দিয়েছিল ওর সাথে কথা বলার জন্য। মিথিলা মিনিট দুয়েক কথা বলেছিল মাত্র। এরপর সাজিদের মৃত্যুর পরে তার ফোনে কল দিলেও মিথিলা ফোন তোলেনি কখনো ।
কারো সান্ত্বনা তার ভালো লাগে না। নিজেকে নিজের মাঝে গুটিয়ে একটা গড়পড়তা জীবনকে বেছে নিয়েছে সে।

সাজিদের ছোট ভাই সাব্বির অফিস থেকে ফিরে ল্যাপটপের ব্যাগটা রাখার সাথে সাথেই তার স্ত্রী লিসাকে বলল, এক গ্লাস পানি দাও। আমি আবার বেরুব।

– ওর বউ লিসা দৌড়ে এল। এক গ্লাস পানি দিতে দিতে সাব্বিরকে বলল, শান্তা আপা কল দিয়েছিল নাকি তোমাকে?

– হ্যা, দিয়েছে। কেন?

– না বাইরে যাবার কথা বললে যে, তাই! ভাবিকে আনতে যাচ্ছ?

– হুম! আজ নাকি ওনার খালুকে ডিসচার্জ করেছে। তাই আপা ফোন দিয়ে বলল, ভাবিকে বাসায় নিয়ে আসতে।

লিসা মেজাজ দেখিয়ে বলল, ওনাকে নিয়ে আসার কী দরকার? শান্তা আপার সব কিছুতে বেশি বেশি। এত দরদ তো ভাবিকে নিজের কাছে রাখলে পারে।

– কেন, কেন? ভাবি নিজের বাড়ি থাকতে আপার বাসায় থাকবে কেন? রাগের সাথে বলল, সাব্বির।

– শোনো, এত আদিখ্যেতা করতে পারো তোমরা দুই ভাই বোন! উনি এ বাড়ির কে? এ বাড়ির ওনার সাথে যার সম্পর্ক ছিল সে এখন নেই। আর ভাবির কোনো বাচ্চাকাচ্চাও নেই । সে এ বাড়িতে কিসের অধিকারে থাকতে চাইছে? তোমরা ওনাকে যেভাবে মাথায় করে নিয়ে নাচো তাতে না কবে তোমাদের মাথায় ওঠে নাচা শুরু করে?

– মুখ সামলে কথা বলো! ভাবি সারজীবন এ বাড়িতে থাকবে। ভাইয়ার যা কিছু সব ভাবিরই। এসব কথা আজ বলেছ কিন্তু আর বলবে না। ভাইয়া ভাবির সব দায়িত্ব আমার হাতে দিয়ে গিয়েছে। আমি যতদিন বেঁচে আছি ভাবিকে আমি দেখে রাখব। সে আমার চোখে আমার মায়ের স্থানে। তুমি এ নিয়ে আর একটা কথা বলারও আর দুঃসাহস দেখাবে না।

– বাহ! আমি তো অপরাধ করার মতো কিছু বললাম না। আইন সঙ্গত কথা বলেছি। তাছাড়া ওনার বয়স কম। দায়িত্ব যেহেতু নিয়েছ তবে ওনাকে বিয়ে দিয়ে দাও। একটা সংসারও পাবে জীবনটাও গোছাতে পারবে।

-সেসব নিয়ে তোমার মাথা ঘামাতে হবে না। আপা আছেন। উনি যেটা ভালো বোঝেন করবেন। তাছাড়া ভাবির বাবাও আছেন।

– হ্যা , হ্যা ! আপার বাসায় তো বসে পড়ে খায় না । সারাদিন আমি রান্না বাড়া করব আর উনি ঘরের দরজা দিয়ে ধ্যান করবে। তিনবেলা দাওয়াত দিয়ে দিয়ে খাওয়াতে হবে নইলে তো আবার ওয়াক্তের সময় হলে তোমরা দু’ভাইবোন মিলে ফোন করে করে আমার কান ঝালাপালা করে ফেল। সে কীসের অস্বাভাবিক? এই যে খালুর সেবাযত্ন করতে ঢ্যাং ঢ্যাং করতে করতে চলে গেল। অথচ বাসায় প্লেটটা পর্যন্ত ধুয়ে খায় না। অসহ্য!

– লিসা! চিৎকার করে উঠল সাব্বির! এই এক কথা প্রতিদিন শুনতে ভালো লাগে না। কাজ তো করো শুধু রান্নাবান্নাই। সব তো আখির মা করে। রান্নাটুকুও যদি না পারো করো না তবে। আখির মাকে বলে দাও সে করবে। বেতন একটু বাড়িয়ে দিলেই সারবে।

লিসাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সে বেরিয়ে গেল।

চলবে…

পর্ব-৩৯

https://www.facebook.com/111576077291737/posts/385451043237571/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here