সুখের_সন্ধানে শেষ পর্ব_

0
1676

#সুখের_সন্ধানে
#পর্ব_৫১(শেষ পর্ব)

প্রিয় সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত নিজের রুমে গেল। মিথিলাসহ বাকী সবাই হা হয়ে তাকিয়ে আছে কী এমন হলো? কিছু একটা খুব সিরিয়াস ঘটনা যে ঘটেছে এটা সবাই বুঝতে পারছে। সেলিম আমার সামনে এসে বসল। আমি সোফার উপরে একহাতে মাথা চেপে বসে আছি। একটু সামনেই আমার শাশুড়ি আর মিথিলাও জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার মুখে কিছু শোনার অপেক্ষায়।
আমি কী বলব বুঝতে পারছি না। এতরাতে না জানি আবার কোন ঝড় ওঠে এ সংসারে।
সেলিমেরও চোখেমুখেও প্রশ্নরা অপেক্ষা করছে। আমার একটা হাত চেপে ধরে বলল, কী হয়েছে? প্রিয় ওভাবে মিথিলাকে ছাড়াই ওপরে দৌড়ে গেল যে?

আমি সেলিমকে কিছু বলার জন্য মাথা তুলে তাকাতেই দেখলাম মিথিলা ততক্ষণে দোতলায় পৌঁছে গেছে। সর্বনাশ যে কোন পর্যায়ের ঘটবে সেটা আন্দাজ করতে বিন্দুমাত্র দেরি হলো না আমার আর।

প্রিয় এতদিন পর ছেলেকে কাছে পেয়ে যেন আকাশের চাঁদ পেয়েছে। আয়াতও বাবাকে পেয়ে একই অবস্থা। এ ক’দিন বাবাকে দেখতে না পেয়ে ছেলেটা একদম অসুস্থ হয়ে গিয়েছিল। বাবাকে পেয়ে যেন সেও পৃথিবী পেয়েছে।
মায়ের সাথে তার জন্মের পর থেকেই বণ্ডিং খুব একটা ভালো না। বাসার সার্ভেন্টরাই তার দেখভাল করে। এনা নিজের দুনিয়ায় ব্যস্ত থাকে। ছেলেকে বা স্বামীকে নিয়ে আদিখ্যেতা করার সময় তার কাছে কোনোদিনই ছিল না। ছেলেকে সে ভালোবাসে
এটাতে কোনো কমতি নেই। কিন্তু একজন মা তার সন্তানকে যেমন সারাক্ষণ বুকে আগলে রাখে তেমন করে এনা কখনোই করেনি। ছেলের খাওয়ানো, গোসল, দেখাশোনা সবকিছুই মেইডদের দায়িত্বে।
আয়াতকে জন্ম দিতেই যেন তার দায়িত্ব শেষ। তার ব্যস্ততা জুড়ে পার্লার, বন্ধুবান্ধব, ক্লাব, পার্টি এটেন্ড , ইচ্ছেমতো ঘোরাফেরা আরো কত কী! এসব করতে যেয়ে পড়াশোনাটাও শেষ করেনি।
তার এমন খামখেয়ালিপনার কারণেই প্রিয়র মন থেকে মিথিলার নাম কখনো মুছে যাবার সুযোগ হয়নি। এনার ব্যস্ত জগতে বসতি ছিল না প্রিয়র।
প্রিয় অফিস থেকে ফিরে যতটুকু সময় পেয়েছে ছেলেকে উজাড় করে ভালোবাসা দিয়েছে। ছেলেও যখন পাশে থাকত না তখন কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে যেত । সেই রাজ্যে সে নিজেই রাজা আর তার রাণী হিসেবে এনাকে কল্পনায় আনতেও কখনো স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করত না। চোখ বন্ধ করে কল্পনার রাজ্যে ভাসতে থাকলেই তার রাণীর আসনটা মিথিলাই দখল করত । সে জানত এটা অন্যায়। মিথিলা তখন অন্যের ঘরের বউ। তবুও কল্পনায় তাকে নিয়ে ভাসতে এক অন্যরকম ভালোলাগায় শিহরিত হতো । বারবার কল্পনার রাজ্য থেকে ধাক্কা মেরে মিথিলাকে বের করে দেবার ব্যর্থ চেষ্টা করেও লাভ হয়নি। আর সাজিদের যখন মৃত্যু হয়ে গেল তখন তো ভাবনাটা যেন আরো ডালপালা খুলল। তবে সে এটা কখনো চিন্তা করেনি মিথিলাকে সে আপন করে পাবে। কারণ তার সেই পথে বাধা হয়ে ছিল এনা। তাকে ছেড়ে অন্যকে নিয়ে কল্পনার রাজ্য সাজানোটাও অন্যায় সে জানতো। কিন্তু তারপরেও এই অন্যায় থেকে সে কিছুতেই নিজেকে মুক্ত করতে পারছিল না। এক অদ্ভুত রোগ তাকে জেঁকে বসেছিল। সকাল, দুপুর আর সন্ধ্যা নেই কাজের ফাঁকে হোক বা যে কোন কিছুর অবসরেই হোক একটু সুযোগ পেলেই সে কল্পনায় হারিয়ে যেত। কী ছিল না সেই কল্পনার রাজ্যে! বাস্তব জীবনে প্রিয়র একটা সুস্থ সংসার না থাকলেও কল্পনার রাজ্য ছিল ফুল-ফসলে ভরপুর।

প্রিয়র সাথে ডিভোর্স হবার পরেও প্রিয় প্রতিদিনই আয়াতের সাথে দেখা করত! আয়াত ভাবত মাম আর বাপির মাঝে ঝগড়া হয়েছে । এমন তো প্রায়ই হয়। এবার খুব বেশি ঝগড়া হয়েছে কিছুদিন বাদেই আবার চলে আসবে হয়ত। ছোট মনের আশা আর পূরণ হয় না আয়াতের। তার বাপী আসার সময়ে বলে এসেছে , “মামের সব কথা শুনবে! একদম লক্ষী ছেলে হয়ে চলবে। আমি কিছুদিনের জন্য আমার মায়ের কাছে যাচ্ছি । খুব তাড়াতাড়িই ফিরে আসব। তুমি ততদিনে আবার বাপীকে ভুলে যাবে না তো?”

দু’দিন যেতে না যেতেই আয়াত প্রিয়র জন্য অস্থির হয়ে ওঠে। তার উপর প্রিয় কথাবার্তাও ঠিকঠাক বলছিল না এ ক’দিন । এজন্য আয়াত আরো বেশি অস্থির হয়ে ওঠে। এনা কিছুতেই আর সামলাতে পারেনি আয়াতকে তাই হুট করে সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশে আসবে। তার বাবা মা কতবার নিষেধ করেছে না আসার জন্য কিন্তু সে কারো কথা শোনেনি। সে নিজেও খুব অস্থির হয়ে উঠেছে প্রিয় ইতালি ছেড়ে চলে আসার পর থেকে। প্রতিট মুহূর্ত নিজের ভুলগুলি তাকে খোঁচা মেরে মেরে উপহাস করছিল আর বুঝিয়ে দিচ্ছিল কী করে সে প্রিয়র মতো একজন মানুষকে হেলায় হারিয়েছে। রাতের পরে রাত নির্ঘুম কাটিয়েছে । প্রিয় আসার পরে এই দশদিনে মনে হয় না কোনো রাত সে নিশ্চিন্তমনে ঘুমাতে পেরেছে। নিজেকে খুব অসহায় মনে হয় তার। চারপাশে এত এত সম্পদের পাহাড়, মা- বাবা, বন্ধুবান্ধব, চাকর বাকর সব আছে অথচ কিছুতেই মন বসে না তার। সারাক্ষণই মনে হয় প্রিয়কে ছাড়া তার অসম্ভব। তাছাড়া প্রিয়কে মন থেকে একটু সরাতে গেলেই আয়াত এসে মনে করিয়ে দেয়। সে ভেবেছিল তার বাপী হয়ত দু’একদিন বাদেই তার দাদীর কাছ থেকে ফিরে আসবে। এই দশদিন আয়াতের কাছে দশ মাসের সমান কেটে গেছে। এজন্যই একটু পর পর মায়ের কাছে যেয়ে , “বাপী কবে আসবে” প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করতেও ক্লান্ত হয়নি।

নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করে এনা সিদ্ধান্ত নেয় সে বাংলাদেশে আসবে। সে জানে তাকে অনেক কথা শুনতে হবে । কেউই তাকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিবে না। এমনকি প্রিয়ও না। তারপরেও সব তাকে শুনতে হবে। যে যাই বলুক সে কিছুতেই পিছু হটবে না। তার মা বাবা অনেকভাবে আটকাতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু সে আর কারো কথাই শুনবে না। মনের ডাকে সাড়া দিয়ে সব প্রতিকূলতাকে ছাড়িয়ে প্রিয়র কাছে ছুটে এসেছে । সারাটা পথ অনেক কিছু ভেবেছে সে।

প্রিয় আর আয়াত একজন আরেক জনকে বুকে জড়িয়ে আছে। কিছুতেই সে তার বাপীকে ছাড়বে না। এনা ছলছল চোখে বাপ ছেলের এই মিলনের দৃশ্য দেখছে। তার নির্বুদ্ধিতার কারণেই আজ বাবা ছেলে এত দূর। নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল তো মেরেছেই ছেলেটার ছোট্ট মনেও কত ব্যাথা দিয়েছে সে। মা হিসেবে একবারের জন্যও সে ছেলের মনের কথা ভাবেনি।

প্রিয় ঘরে ঢুকতেই আয়াত ছুটে এসে বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ছেলেকে পেয়ে একবারের জন্যও এনার দিকে তাকাবার সুযোগ হয়নি তার।

হঠাৎ প্রিয় কিছু বুঝে ওঠবার আগেই এনা এসে প্রিয়কে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে। প্রিয় কেঁপে ওঠে। এনা ডুকরে কেঁদে উঠে বলল, সরি… আ’ম …সো সরি…! আমি তোমার সাথে অনেক অনেক অন্যায় করেছি। শুধু নিজের খেয়াল খুশিমতো চলেছি আমি। একটাবারের জন্যও তোমার আর আয়াতের কথা ভাবিনি। মানুষ হারিয়েই বুঝতে পারে সে কী হারিয়েছে। তোমার অভাব আমি এখন প্রতিটি মুহূর্ত টের পাচ্ছি।

এনার কথাগুলো শুনে প্রিয় ভীষণ অবাক হয়ে যায়। কী এমন হলো হঠাৎ করে যে তার কাছে এনাকে ক্ষমা চাইতে হচ্ছে! এনা তো ক্ষমা চাওয়ার মতো মানুষ নয়। তাছাড়া এই সময়ে ক্ষমা চাওয়ার অর্থ কী? সে মৃদু ধাক্কা দিয়ে এনাকে দূরে সরিয়ে দিলো।

আয়াত প্রিয়র কোলে বসে সবি খেয়াল করছিল। তার বয়স এখন ছয় বছর । তবে প্রয়োজনের তুলনায় একটু বেশিই বুঝে। সে প্রিয়কে বলল,

‘বাপি, তুমি না আমাকে শিখিয়েছো কেউ সরি বলে তাকে ক্ষমা করে দিতে হয় তাহলে মামকে কেন তুমি ক্ষমা করতে পারছ না? মাম বলেছে সে কোনদিন আর তোমার সাথে ঝগড়া করবে না। তুমি যেভাবে বলবে সেভাবে চলবে। মাম তোমার জন্য সব সময় কান্না করে। প্লিজ, বাপী, মামকে ক্ষমা করে দাও না। মাম তো কতবার স্যরি বলল।
প্লিজ!

প্রিয় কি বলবে বুঝতে পারছে না। আয়াতকে চুপ করানোর জন্য বলল, ঠিক আছে আমি তোমার মামকে ক্ষমা করে দিয়েছি। এবার বলো তুমি এভাবে চলে এসেছো আমাকে আগে জানাও নি কেন? জানালে আমি এয়ারপোর্টে তোমাদের আনতে যেতাম।

তোমাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্যই আমরা বলিনি। মামই নিষেধ করেছে।

আচ্ছা, তুমি এসেছ খুব ভালো করেছ। আমি খুব খুশি হয়েছি। তোমাকে ভীষণ মিস করছিলাম।

তুমি বলেছিলে ক’দিন বাদে চলে আসবে। কতদিন হয়ে গেলো এরপরও তুমি ফিরে যাওনি।

কত বছর পরে আমি আমার মামার সাথে দেখা করতে এসেছি। এত তাড়াতাড়ি কি যাওয়া সম্ভব? আর কতদিন কোথায়? মাত্র তো দশ দিন গেল!

দশ দিন ! বাপী, সে তো অনেক লম্বা সময়। তোমার জন্য আমি খুব কেঁদেছি। মামকে অনেক ডিস্টার্বও করেছি।
তুমি না গুডবয়! তোমাকে তো বলে এসেছি মামকে জ্বালাবে না আর আমার জন্য কান্না করবে না একদম।

করতে তো চাইনি কিন্তু কেন যেন হয়ে গিয়েছে। তুমি যাচ্ছ না দেখে আমি নিজেই তোমাকে নিতে এসেছি। এবার আমরা ইতালিতে ফিরে সবাই একসাথে থাকব। মাম বলেছে আমরা আবার আগের মত থাকব।

আয়াতকে থামানোর জন্য প্রিয় বলল, আচ্ছা! ঠিক আছে, বুঝতে পেরেছি। চলো এবার তোমাকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেই। তোমাকে পেলে তোমার দিদা ,দাদা, বড় দিদা কত খুশি হবে তুমি জানো? আর তার সাথে এই বাড়িতে তোমাকে ঘুরে দেখাই। এই যে মস্ত বড় বাড়ীটা দেখছ , এটা কিন্তু তোমার বাড়ি?

হা হা ! মিথ্যে কেন বলছ ?আমার বাড়ি তো ইতালিতে।

উহু ইতালিতে যেটা ওটা তোমার নানার বাড়ি । অবশ্য ওটাও তোমার বাড়ি কিন্তু এই যে বাড়িটা দেখছ এটা তোমার বাপীর বাড়ি।

সত্যি তাহলে আমাদের দুইটা বাড়ি?

সত্যি, সত্যি, তিন সত্যি। ছেলের নাকের সাথে নাক ঘষতে ঘষতে বলল, প্রিয়।

আয়াত খুশিতে প্রিয়কে ছেড়েই একলাফে কোল থেকে নেমে দরজার বাইরে বেরিয়ে গেল ।

প্রিয়র থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে এনা ফুঁপিয়ে কাঁদছে।

এভাবে তোমার হুট করে চলে আসাটা ঠিক হয়নি।

স্যরি বলেছি তো! আমি জানি আমার আসা ঠিক হয়নি। কিন্তু আয়াত যেভাবে কান্নাকাটি করছিল তাই আমি আর না এসে পারিনি ।

আমাকে জানাতে পারতে !

তোমাকে জানানোর মতো সুযোগ হয়নি ।তোমাকে ফোনে পাচ্ছিলাম না।

বুঝতে পেরেছি ।এখন বলো এসব কি ?

এসব কী মানে বুঝতে পারছি না।

বুঝতে না পারার তো কোনো কথা বলিনি। তুমি আয়াতের কানে এগুলো কি ঢুকিয়েছো?
আমি তোমার সাথে ইতালিতে ফিরে যাব, একসাথে থাকব, ছোট বাচ্চাকে এসব উল্টাপাল্টা বুঝিয়ো না। এমনিতেই ও মনে অনেক বড় আঘাত পেয়েছে। হয়তো এতদিনে অনেকটা অ্যাডজাস্ট করে ফে্লেছে নিজেকে। নতুন করে ওকে আবার আঘাত দেওয়ার মানে কি?
এখন একটু ম্যাচিউর হও। বয়স তো কম হলো না। এখন এসব ন্যাকামো অ্যাটিটিউড বন্ধ করে স্বাভাবিকভাবে বাকিটা জীবন কি করে কাটানো যায় সেটা দেখো।

হঠাৎ করে এনা এসে প্রিয়কে দুই হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে ,আমি ন্যাকামো করছি না মোটেই। আমিও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে চাচ্ছি। তোমার মনের মতো হতে চাচ্ছি, প্রিয়। যে সব জিনিসকে প্রায়োরিটি দিতে যেয়ে আমি আমার সংসার হারিয়েছি, তোমাকে হারিয়েছি সব ছেড়ে দিব আমি। আলেয়ার পিছে ছুটে ছুটে আমি আমার জীবনের সবচাইতে মূল্যবান সম্পদ হারিয়েছি। আমাকে কী আবার আরেকটি সুযোগ দেওয়া যায় না, প্রিয়? অন্ততপক্ষে আয়াতের কথা ভেবে! বলতে বলতে এনা ডুকরে কেঁদে উঠল।
বুঝতে যে পেরেছ এজন্য ধন্যবাদ। কথাগুলি বেশ তাচ্ছিল্যের স্বরে বলতে বলতে এনাকে বেশ জোরেসোরেই ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিলো, প্রিয়।

আরো কিছু বলতে যাবে হঠাৎ আয়াত আবার দৌড়ে এসে প্রিয় আর এনার হাত ধরে টানতে টানতে বাইরে নিয়ে চলল।

আয়াতের সাথে আমাদের আগেই পরিচয় আছে। ভিডিও কলে আয়াতের সাথে আমাদের প্রায়ই কথা হতো। তাই আমাদেরকে দেখেই চিনতে পারে আয়াত। আমি দৌড়ে যেয়ে দুই হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আমার ছোট্ট প্রিয়কে। আয়াতকে কাছে পাওয়ার আনন্দে সেলিমের তো চোখ থেকে ঝর ঝর করে পানি পড়ছে। এক সময় আয়াতকে নাতী বলেই সে মানতে চাইত না। কিন্তু আমি যখন ফোনে কথা বলতাম তখন সেও উঁকিঝুঁকি মেরে দেখতে দেখতে মায়ায় জড়িয়ে গেছে। আয়াত দেখতে ঠিক ওর বাবার মতোই হয়েছে। ওকে দেখলে প্রিয়র সেই ছোটবেলার মুখখানা মনে পড়ে যায়।

আয়াত সবার সাথে মুহূর্তের মধ্যেই একদম মিলে গেল। এই মানুষগুলিকে সে জন্মের পর থেকেই দেখছে। কিন্তু কখনো ছুঁয়ে দেখা হয়নি। আজ বহু বছর পর সেই আক্ষেপটা যেন ঘুচল তার।
একদিকে আমি আয়াতকে বুকে জড়িয়ে আদর করছি অন্যদিকে আমার শ্যেন দৃষ্টি দূরে দাঁড়িয়ে থাকা এনার দিকে। কত বড় বেহায়া, বেশরম একটা মেয়ে। ডিভোর্সের পরেও সুড়সুড় করে এক্স হাজবেন্ডের বাড়িতে আসার আগে একবারও ভাবল না? ওকে দেখে মনেই হচ্ছে না ওর সাথে আমাদের কোনো সম্পর্কই নেই আর। কী সহজ আর স্বাভাবিকভাবে আমাদের সাথে কথা বলছে!
এতকিছুর পরেও এ বাড়িতে আসার সাহস হয় কি করে? আমার ছেলেটার জীবনটাকে জাহান্নামে পরিণত করে দিয়েছিল। প্রিয় আর মিথিলার জীবনের এমন একটা আনন্দঘন মুহূর্তে এই বেশরমটা না জানি আবার কী ঝামেলা করতে এসেছে।

হঠাৎ মিথিলার কথা খেয়াল হলো। মিথিলাকে কোথাও দেখছি না। দোতলায় তো গেল কিন্তু এখনো এলো না। আমি চোখের ইশারায় প্রিয়র কাছে জিজ্ঞেস করলাম মিথিলা কই?
প্রিয়ও হয়ত মনে মনে মিথিলাকে খুঁজছিল তাই আমার এক ইশারাতেই সে বুঝতে পারল আমি কী বোঝাতে চাচ্ছি।

দোতলায় করিডোর ধরে হাঁটতেই বাম পাশের শেষের যে রুম রয়েছে মিথিলা এ বাসাতে এলে সেই রুমটাতেই থাকে। প্রিয় প্রথমে নিজের রুমে এক নজর উঁকি মেরে দেখতে না পেয়ে সেই রুমে চলে গেল।

মিথিলা বউয়ের সাজ খুলে সাধারণ পোশাক পরেছে। প্রিয় ভীষণ অবাক হলো এটা দেখে। সে পেছন থেকে যেয়ে মিথিলাকে জড়িয়ে ধরে। মিথিলা খানিকটা চমকে যেয়ে পেছনে ফিরতেই প্রিয় মিথিলার চোখ দেখে অবাক হয়ে যায়। মিথিলা যে এতক্ষণ ধরে কাঁদছিল এটা সে নিশ্চিত।

– সেকি তুমি কাঁদছ ? তুমি আমাদের বিয়েতে খুশি হওনি? আর এই রুমে কেন? এটা তো গেস্ট রুম। তুমি থাকবে আমার রুমে।
– খুশি ! হুম , খুব হয়েছি। আর ওখানে তুমি আয়াতকে নিয়ে ছিলে তাই ভাবলাম!
– তবে কাঁদছ যে? আর সাজ পোশাক সব খুলে রেখেছ কেন? মন ভরে দেখতেও দিলে না।
– এমনিই। খুব অস্থির লাগছিল ,তাই। তোমার তো নিচে থাকার কথা।
– কেন? এমন মনে হলো কেন? আমার যেখানে থাকার কথা সেখানেই আছি। বলে আস্তে করে মিথিলার দু’হাতে মৃদু চাপ দিয়ে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরল।
– ছাড়ো তো! আয়াত চলে আসবে।
– ওহ! তুমি আয়াতকে দেখে তবে মন খারাপ করেছ? আয়াত আমাকে খুব মিস করছিল তাই ওকে নিয়ে এসেছে এনা। এ ক’দিন আসার পর থেকে ঠিকঠাক কথাই তো বলা হয়নি ওর সাথে। আমাকে খুব ভালোবাসে জানোই তো!
– আয়াতকে দেখে মন খারাপ করব কেন? কী বলছ?
– স্যরি! ভুল বুঝো না, প্লিজ! আজ একসাথে এতকিছু পেয়েছি যে মাথাই আউলাঝাউলা হয়ে গেছে।
– আর এনা?
– ওহ। এবার বুঝেছি তবে সমস্যা কোথায়? আমার বউয়ের খুব হিংসা হচ্ছে না? বলেই মিথিলার কপালের মাঝে আলতো চুমু খেলো, প্রিয়।

প্রিয়র মুখে ‘বউ’ শব্দটা শুনে মিথিলা যেন শিহরিত হলো। তার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না সে আসলেই প্রিয়র বউ।

– কথা বলছ না যে! খুব বেশি জেলাস ফিল হচ্ছে ?
– একদম না। হিংসা করব কেন? তুমি এখন যাও তো, ভাইয়া। সারাদিন আজ অনেক স্ট্রেস গিয়েছে। একটু রেস্ট নিবো।
– ভাইয়া? এখনো ভাইয়া ডাকবে?
– স্যরি! একটু তো সময় লাগবে।
– সৎ চেষ্টা থাকলে মোটেও লাগবে না। আমার কথাই ধরো না! আমি তোমাকে তুই করে বলতাম। কিন্তু এবার বাংলাদেশে এসে ইচ্ছে করেই সেই ‘তুই’ শব্দটাকে তুমিতে নিয়ে গেছি। কারণ ভালোবাসার মানুষের সাথে রোমান্টিক হতে গেলে তুমির কোনো বিকল্প নেই।
– তবে তুমি ইচ্ছে করেই আমাকে তুমি বলেছিলে? তুমি না বললে …
– কী বলেছি কিছুই মনে নেই। শুধু মনে আছে টুডে ইজ মাই ফার্স্ট নাইট উইদ ইউ। দ্যাটস ইট!
– আর এনা?
– এনা আবার কেন এর মাঝে? এনা আমার কেউ না এটা কী প্রমাণ দিতে হবে তোমাকে?
– ভুল বললে । সে তোমার সন্তানের মা।
– হুম! এটা অস্বীকার করছি না। আয়াতের মা বলেই এ বাড়িতে এখনো দাঁড়ানোর সাহস পাচ্ছে।
– এনা তোমাকে ভালোবাসে সেটা টের পাচ্ছ না?
– হোয়াট ?
– সে তার ভুল বুঝতে পেরে তোমার জীবনে ফিরতে চায়।
– সে চায় তাতে আমার বা তোমার কী? আমি কী চেয়েছি? তাহলে সবই শুনেছ তুমি?
– মিথিলা নিশ্চুপ!
– এনা আমার অতীত এবং শুধুই অতীত। আর তুমি আমার অতীত, বর্তমান , ভবিষ্যৎ সব। তাই প্লিজ, ওসব নিয়ে আর কোনো কথা শুনতে চাই না। বুকের মাঝে কতটা রক্তক্ষরণ হয়েছে আমার সেটা আর বাড়তে দিতে চাই না। হারিয়ে ফেলেও আমি তোমাকে আপন করে পেয়েছি সেখানে কোনো তৃতীয় কারো স্থান নেই। পৃথিবীতে যতদিন বেঁচে থাকব শুধু তোমার হয়েই থাকব। আজ আমার খুব ভালো একটা দিন। একদিকে আমার এত বছরের ভালোবাসাকে আপন করে পেয়েছি আর অন্যদিকে আয়াতকে দেখতে পেয়েছি । দু’টি ঘটনাই আমার কাছে আকাশের চাঁদ পাবার স্বপ্নের সমান। কল্পনা করতেও সাহস হয়নি যে আমার মনের গভীরের এই অমূল্য প্রত্যাশাটুকু কোনোদিন পূর্ণ হবে। আল্লাহ আমার প্রতি খুব সদয় । তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।
প্লিজ, তুমি একদমই মন খারাপ করবে না। তোমার চোখের পানির আর কোনো কারণ আমি হতে চাই না।

মিথিলাকে শক্ত করে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে প্রিয়। মিথিলার ঠোঁট জোড়া কিছুটা জোর করেই দখল করতে গেলে মিথিলা লজ্জা পেয়ে সরে যেতে চাইলে সে বলে, আজ নিশ্চয়ই আবার তোমার কোমল হাতে গত রাতের মতো থাপ্পড় দিচ্ছ না। আজ কিন্তু সবাই মিলে চুমু খাওয়ার লাইসেন্স দিয়েই আমাকে পাঠিয়েছে। বলতে বলতেই মিথিলাকে যেন একসাথে জড় করে সবটুকু বুকের মাঝে টেনে নিয়ে তার শরীরের উষ্ণতায় পুড়িয়ে দিতে চাচ্ছে । আর সেই উষ্ণতায় মিথিলা হারিয়ে যাচ্ছে কোন এক স্বপ্নজগতে।

দরজায় নক করার শব্দ শুনে মিথিলা দ্রুতই ছিটকে সরে যায় প্রিয়র বুক থেকে। তাকিয়ে দেখল এনা আর আয়াত দাঁড়িয়ে আছে। আয়াত দৌড়ে এসে প্রিয়র হাত ধরে রুম থেকে বের করে প্রিয়র বেডরুমের দিকে এগিয়ে গেল। মিথিলা আয়াতের সাথে পরিচিত হবারও সুযোগ পেল না। তার দিকে লক্ষ্য করে এনার বিস্ফোরিত চোখ দু’টি দেখে সে থ’ মেরে দাঁড়িয়ে আছে সেই জায়গাতেই।

এনা চুপচাপ ওদের পিছু হাঁটছে । প্রিয়কে কত কথা বলতে চাইছে কিন্তু পারছে না। কারণ তার সেই অধিকার নেই। মিথিলা আর প্রিয়কে ওই অবস্থায় দেখে কিছুতেই নিজেকে স্থির রাখতে পারছে না। সে ঠিকই জানত এই মেয়ে প্রিয়র মাথা খেয়েছে। লজ্জাও করে না এই বয়সে এসে কাজিনের সাথে …ছি!

আয়াত রুমে এসে প্রিয়কে বলল, বাপী, আজ আমরা তিনজন একসাথে ঘুমাব ঠিক আগের মতো। মামকে তো তুমি মাফ করে দিয়েছ , তাই না!

প্রিয় পড়েছে মহা বিপদে। কী করে বোঝাবে ছেলেকে? সে বলল, তুমি এখন বিগ বয় তো! মাম বাপীর সাথে ঘুমানো কী ঠিক?

আজ একদিনই তো! কতদিন একসাথে শুয়ে গল্প করি না আমরা। প্লিজ, বাপী!

ছেলের জোরাজুরিতে অগত্যা রাজী হতে বাধ্য হলো প্রিয়। এনার পাশে এক মুহূর্ত কাটানো সম্ভব না তার। সেখানে এক রুমে তাও আবার এক বিছানায়। ভাবতেই গা ঘিনঘিন করে উঠল প্রিয়র।

মাঝখানে আয়াত আর দু’পাশে এনা আর প্রিয়। ঘণ্টাখানেক কাটতেই আয়াত ঘুমিয়ে গেল। এবার প্রিয় বলল, আমি তবে উঠি। ওর দিকে খেয়াল রেখো।

প্রিয় উঠতে যাবে তখন এনা ওর হাত চেপে ধরে বলে , এই রুমের প্রতিটি কোণা আমার পরিচিত। এখানেই তোমার সাথে আমার সংসার জীবনের শুরু তাই না! সবকিছু সেই আগের মতই আছে শুধু বদলে গেছে আমাদের সম্পর্কটা।
আমরা কী আগের মতো এখানে আমাদের জীবনের আরেকটি অধ্যায় শুরু করতে পারি না? আমি গুগল সার্চ করে সবকিছু জেনেছি। ভুল বুঝতে পেরে ডিভোর্সের পর যদি হাজবেন্ড ওয়াইফ আবার এক হতে চায় তাতে ধর্মে কোনো বাঁধা নেই। কিছু ডেফিনিট রুলস মেনে আবার আগের অবস্থান ফিরে পাওয়া যায়। আমি আর ইতালিতে ফিরে যেতে চাই না। আমি তোমার কাছে থাকতে চাই। আজ থেকে চাই, এখন থেকে চাই।

– আর ইউ ক্রেজি? ডিসগাস্টিং!
– কেন? আমি খুব বেশি কিছু চেয়ে ফেলেছি তোমার কাছে? আমাকে আপন করে নিতে চাইছ না ওই মিথিলার জন্য? একটু উচ্চস্বরে জিজ্ঞেস করল , এনা।
– তুমি কী জানো আ’ম ম্যারিড! বোকার স্বর্গে বাস করছ তুমি! আমি আজই মিথিলাকে বিয়ে করেছি।

মিথিলাকে বিয়ে করেছে শুনে এনার যেন পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেল। এতক্ষণে সে হুঁশে ফিরল। প্রথমে ভাবল প্রিয় হয়ত ফান করছে। কিন্তু প্রিয়র চোখের দিকে তাকিয়ে মনে হলো না সে ফান করছে।

– তুমি ফান করছ ?
– তোমার সাথে আমার ফান করার মতো রিলেশান না। সো , এসব বলে টাইম ওয়েস্ট করো না। আয়াতকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। সকালে তোমার সাথে কথা বলব। মিথিলা আমার জন্য অপেক্ষা করছে।
প্রিয় বেরিয়ে যাচ্ছিল তখনই এনা যেয়ে প্রিয়র পা জড়িয়ে ধরে।

প্রিয় অবাক হবার শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে এবার। এনা আর মাথা নত করে পা ধরা!
অসম্ভব!

– প্লিজ, আমার কথা শোনো! আমি তোমার জীবনে ফিরতে চাই। বিনিময়ে যা করতে বলবে তাই করব। আয়াতকে তোমাকে ছাড়া রাখাও আমার সাধ্যের বাইরে। প্লিজ, আমাকে বোঝার চেষ্টা করো।

প্রিয় দু’হাতে এনাকে তুলে বলল, এসব করে কী হবে বলো! আ’ম সো স্যরি! সেই সময় আর এখন নেই। শুধুশুধু কান্নাকাটি করে কী হবে ! আ’ম রিকোয়েস্টিং ইউ। স্টপ ইট, প্লিজ! সকাল হতেই তুমি তোমার কোনো রিলেটিভসের কাছে চলে যেও। আয়াত না হয় থাকুক কিছুদিন আমার কাছে। শুধুশুধু এখানে টাইম ওয়েস্ট কেন করছ? বহু বছর পরে দেশে ফিরেছ , সবার সাথে মিট করো! ভালো লাগবে।

– তুমি সত্যিই মিথিলাকে বিয়ে করেছ। ফোঁপাতে ফোঁপাতেঞ্জানতে চাইল, এনা।
– মিথ্যে কেন মনে হচ্ছে? কথা বাড়াতে মন চাচ্ছে না। তুমি ঘুমিয়ে যাও, প্লিজ।
প্রিয় শান্তস্বরে কথাগুলি বলে বেরিয়ে যাচ্ছিল ।

– এনা চোখের পানি মুছে বলল, সিরিয়াসলি তুমি আমাকে চলে যেতে বলছ?

– সেটাই তো বললাম ।

– এনা চোখের পানি মুছে বলল, বেশ ! কিছু আর বলার নেই তবে। আমি একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েই এদেশে এসেছি।
– প্রিয় নিশ্চুপ!
– যা হারিয়েছি তা আর পাব না ভেবেই রেখেছিলাম। তাই নিজেকে ব্যস্ত রাখতে আমি আবার স্টাডি শুরু করতে চাই। আমি বিজনেস ম্যামেজমেন্টে হায়ার এডুকেশনের জন্য ইউকেতে চলে যাচ্ছি। আব্বুর বিজনেসের হাল ধরতে চাই। আয়াতকে তোমার কাছে রেখে যাচ্ছি। ওকে দেখে রেখো। অনেক ভেবে দেখেছি আমার থেকে ও তোমার কাছেই ভালো থাকবে। আমি কোনোদিনই একজন ভালো আর দায়িত্বশীল মা হতে পারিনি। পারব কিনা জানি না। শুধুশুধু তোমার উপর জিদ করে ওর মেন্টাল হেলথের বারোটা বাজিয়ে ছাড়ছি। কিছুকিছু অধিকার জোর করে আদায় করা যায় না , অর্জন করতে হয়। তুমি আয়াতের অধিকার অর্জন করেই নিয়েছ। এখানে ও তোমাকে পাবে , দাদা দাদুর আদর পাবে। আমার কাছে থাকলে কিছুই মিলবে না। আমার আম্মু আব্বু দু’জনেই ব্যস্ত মানুষ। আর আমি তো শুরু থেকেই ওর ব্যাপারে বেপরোয়া। তাই শুধুশুধু ছেলেটাকে কষ্ট দেবার মানে হয় না। ওর ভবিষ্যতের কথা অনেক ভেবেছি। ভেবেই এই কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

এনার চোখের পানিতে প্রিয়র আয়াতকে পাবার খুশিটাও যেন ম্লান হয়ে যাচ্ছে। একজন মায়ের থেকে সন্তানকে আলাদা করার মাঝে কোনো বীরত্ব নেই। সে জোর করে কিছুই করছে না । তবুও কেন যেন খারাপ লাগছে এনার জন্য। এনার কথার কোনো উত্তর দিতে পারছে না সে। কেন যেন মনে হচ্ছে মুখ খুললেই তারও কান্না বেরিয়ে আসবে।

– একটা রিকোয়েস্ট থাকবে তোমার কাছে … কান্নাটা গিলে ফেলে কোনোরকম করে এনা নিজেকে সামলে বলল, আমার ছেলের মায়ের স্থানে আমার নামটাই রেখো। তোমার লাইফ থেকে আমাকে মুছে ফেললেও ওকে কখনো মুছতে দিও না। প্রতিদিন ওর সাথে যেন কন্ট্যাক্ট করতে পারি সেই আশাটুকু নিশ্চয়ই করতে পারি তোমার কাছে। আমি ওকে দেখতে আসব মন চাইলেই। আর মাঝেমাঝে ওকে নিয়ে যাব আমার কাছে। ভয় নেই তোমার থেকে আলাদা করব না । কথা দিয়ে গেলাম । একদম পাকা কথা।

এনা ফোঁপাতে ফোঁপাতে শেষের কথাগুলি বলল। আরো কিছু বলতে চাচ্ছিল কিন্তু পারল না। প্রিয়র খুব মায়া হলো এবার এনার জন্য। সে এনাকে সান্ত্বনা দিবে কী বলে সে নিজেও জানে না। অনেক সময় ভেবে কিছু বলার জন্য মাত্র মুখ খুলতে যাবে এনা দৌড়ে বেরিয়ে গেল।

আমি মিথিলার মনের অবস্থা বুঝতে পারছি। এনা যে কোনোরকম ঝামেলা করতে পারবে না এটা সেটা বলে ওকে বোঝাচ্ছি। এনা কী করে ঝামেলা করবে তার সাথে প্রিয়র লিগ্যালি ডিভোর্স হয়ে গেছে। একমাত্র আয়াতের প্রসঙ্গ ছাড়া প্রিয়র সাথে তার আর কোনো রিলেশান নাই।

মিথিলা পাথরের মতো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে । কী বলবে সে নিজেও জানে না। এমন একটা ঝড় আসবে সে স্বপ্নেও ভাবেনি। এনা যে এখন আবার প্রিয়কে চায় তার জীবনে ফিরতে চায় এটা সে নিজের কানে শুনে এসেছে। আয়াত তাদের সন্তান। আয়াতের কথা ভেবে প্রিয় যদি কোনো সিদ্ধান্ত নিয়েও ফেলে মিথিলার করার কিছু থাকবে না। তার সাথে এই সামান্য কয়েক মুহূর্তের সম্পর্কের কোনো অস্তিত্বও থাকবে না তবে। আর সেও পারবে না অন্য মেয়েদের মতো অধিকারের জন্য প্রিয় বা এনার সাথে যুদ্ধ করতে। এই কাজটাই সে কোনোদিন করতে পারল না। নির্দ্বিধায় অধিকার ছেড়ে দেয়ার মাঝেই সে সুখ অনুভব করে।
.
দরজা নক করার শব্দে আমি মিথিলাকে রেখে দরজা খুলতে গেলাম । দেখলাম বাইরে এনা দাঁড়িয়ে। আমার মেজাজ গরম হয়ে গেল। এ দেখছি শান্তি দিবে না।

– কী বলবে? এখানে কেন? তেজের সাথে জিজ্ঞেস করলাম আমি।
– স্যরি ! ডিস্টার্ব করলাম ! আমি আপনাকে খুঁজছিলাম । পরে জানলাম এখানে আছেন ।
– বলো কী বলবে!
– আমি চলে যাচ্ছি।

মনে মনে হাফ ছেঁড়ে বাঁচলাম যেন । তবে ভয় হলো আয়াতকেও তবে নিয়ে যাবে কি!

– এত রাতে কোথায় যাবে?
– আমার নানুর বাসাতে যাচ্ছি এখন। সেখান থেকে কাল হয়ত ইতালি চলে যাব। আয়াতকে ওর বাবার কাছে রাখতে এসেছিলাম। দায়িত্ব শেষ করেছি এবার চলে তো যেতেই হবে। ওকে দেখে রাখবেন। আপনার ভরসাতেই আয়াতকে রেখে যাচ্ছি। আপনার সন্তানকে আপনার থেকে আলাদা করে আমি যে অন্যায় করেছি তার প্রায়শ্চিত্ত হয়ত কিছুটা হলেও হবে আমার।
এনা আর কোনো কথা বলতে পারল না। সে দ্রুত আমার সামনে থেকে চলে গেল।

আমি যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছি না। কী বলছে ও! এ তো মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। আমি ওকে কিছু জিজ্ঞেস করব সেই সুযোগটুকুও দিলো না। মিথিলার সাথে একটা কথাও বলেনি এনা। ওকে যতটুকু চিনি তাতে আমি বুঝতে পারছি ওর ভেতরে কতটা রক্তক্ষরণ হচ্ছে। মিথিলার সাথে সোজামুখ করে কথা বলার মতো মানসিকতা আর ধৈর্য ওর নেই।

এনা বেরিয়ে গেছে আধাঘণ্টা হলো। এত রাতে বেরিয়ে গেছে আমার খুব চিন্তা হচ্ছে। যদিও আমার ড্রাইভার ওকে নিয়ে গেছে। তাছাড়া ওর নানুর বাসা আমার বাসা থেকে খুব বেশি দূরে না। আয়াতের বেশ মন খারাপ মায়ের জন্য। যাবার আগে ছেলের সাথে আর দেখা করেনি এনা। সে প্রিয়র কাছে বিদায় নেবার আগে আয়াতকে ঘুম থেকে ডেকে বলেছে সে তাকে বাপীর কাছে রেখে যাচ্ছে। জরুরী কাজ পড়েছে তাই আজই আবার ফিরতে হবে। মাঝেমাঝে এসে সে তাকে দেখে যাবে। এ কথা শুনে আয়াত সাথে সাথেই থাকতে রাজী হয়ে যায়। মাকে ছেড়ে সে আগেও থেকেছে। এটা তার কাছে নতুন কিছু না। বাবার কাছে থাকতে পারবে ভেবেই সে খুশী। কিন্তু এনা যাবার পর খুব খারাপ লাগে তার। তাছাড়া ঘুম ভেঙ্গেই এমন একটা খবরে কিছুটা ঘাবড়ে যায় সে। প্রিয় ছেলেকে আদর করে বোঝায় যাতে মন খারাপ না করে।
আমি প্রিয়কে বললাম এনা ঠিকঠাক পৌঁছেছে কি না জানতে।

মিথিলা এগিয়ে গেল আয়াতের দিকে। আয়াত প্রিয়কে মিথিলার পরিচয় জিজ্ঞেস করল।

– ইনি কে বাপী?
– ওর নাম মিথিলা ! তোমার মা, দ্যাট মিনস সি ইজ ইওর মম। তুমি ওকে মা বলে ডাকবে আজ থেকে।

মিথিলা হাসিমুখে হাত বাড়িয়ে দিলো আয়াতের দিকে । আয়াত কিছুটা এগিয়ে এসে আবার প্রিয়র বুকে যেয়ে লুকিয়ে পড়ে। কিছুই বুঝতে পারে না সে।

ভোর হবার পথে তাও মনে হলো একটা বড়সড় ঝড় শেষ হলো। এক রাত্তিরে কত কী ঘটে গেল। অপ্রত্যাশিত কিছু প্রাপ্তিতে আমার ঝুলি আজ ভরপুর! আয়াত ওর বাবার কোলে বুকের সাথে জড়িয়ে ঘুমিয়ে গেছে। মিথিলা আর প্রিয়র আজ কত প্রত্যাশিত একটা ক্ষণ! আমি প্রিয়কে বললাম, আয়াত তো ঘুমিয়ে গেছে। ওকে আমার রুমে শুইয়ে দিয়ে আসো। তুমি আর মিথিলা রুমে যাও । একটু ঘুমিয়ে নাও। কত ধকল গেল আজ ! প্রিয় খানিকসময় কী যেন ভেবে আয়াতের গালে দু’টো চুমু খেয়ে মতিনকে ডাক দিলো আয়াতকে আমার রুমে দিয়ে আসার জন্য।

– মতিন চাচাকে ডাকতে হবে না। ওকে আমার কাছে দাও।
– আয়াতকে নিয়ে তুমি উপরে উঠতে পারবে না, মিথিলা।
– সন্তানের ভার বইতে পারবে না এমন মা কী তুমি একটাও পাবে ? আর আয়াত রূম্পা মায়ের ঘরে কেন থাকবে? মা অসুস্থ। তার বিশ্রামের দরকার। তাছাড়া মায়ের বুকেই সন্তানের প্রকৃত সুখ! ওকে আমাদের সাথে থাকতে দাও , প্লিজ! ঘুম ভেঙ্গে আয়াত তোমাকে খুঁজবে । রূম্পা মাকে ও ভালো করে চিনে না। উঠেই কান্নাকাটি করবে। সারাক্ষণ তোমার পাশেপাশে রাখাটাই এখন ওর জন্য ভালো। সেই সুবাদে আয়াতের সাথে আমার বন্ডিংটাও মজবুত হবে।

প্রিয় মিথিলাকে না করতে পারল না। ছেলেকে ঘাড়ের ওপরে নিয়ে দোতলায় রওয়ানা হলো। আর আমি ইশারা দিতেই পিছে পিছে গুটিগুটি পায়ে চলল মিথিলা, আমার মায়াবতী! আমার মায়ার সাগর!

আমি ওদের তিনজনের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে সিক্ত চোখে ভাবছি এতবছরে আমি বুঝি সুখের সন্ধান খুঁজে পেয়েছি! আনমনেই ওপরের দিকে মাথা তুলে ওই উপরওয়ালাকে একটা ধন্যবাদ জ্ঞাপন করি।

বাম হাতে বুকের সাথে চেপে কাঁধের উপরে আয়াত আর ডানহাতে মিথিলার হাতটা ধরে চলছে প্রিয়। করিডোর ধরে ধীরে ধীরে এগুচ্ছে ওরা । আমার সারাজীবনের তৃপ্তি যেন এই দৃশ্যের মাঝেই দেখতে পাচ্ছি। এমন বন্ধনেই কেটে যাক ওদের আগামীর পথচলা ।সেই প্রত্যাশায় সৃষ্টিকর্তার কাছে হাত তুলেছি আমি। দু’চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে বহুল প্রত্যাশিত বাধাহীন নোনাধারা।

(সমাপ্ত)

প্রিয় পাঠক, জানিনা কী লিখলাম। আপনাদের ভালো লাগাতেই আমার পরম প্রাপ্তি। কেমন লাগল জানাবেন। অপেক্ষায় থাকব। এতদিন ধরে যারা অসীম ধৈর্য ধরে আপনারা সাথে ছিলেন , পাশে ছিলেন সবার প্রতি আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা। অন্তরের গভীর থেকে ভালোবাসা রইল, প্রিয়জনেরা। এবারের লেখাটা লিখতে যেয়ে আপনাদের এতটা অপেক্ষায় রেখেছি নিজেই বিরক্ত হয়েছি নিজের উপর। তবুও আপনারা পাশে ছিলেন এটা আমার সৌভাগ্য। দোয়া করবেন সবাই। ভীষণ মিস করব আপনাদের সবাইকে।

পর্ব-৫০

https://www.facebook.com/111576077291737/posts/405352927914049/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here