সুপ্ত_প্রেমাসুখ পর্বঃ২০

0
940

#সুপ্ত_প্রেমাসুখ
#ইলোরা_জাহান_ঊর্মি
#পর্বঃ২০

রিশাদ ইলোরার পাশে বসে বকবক করেই চলেছে। ইলোরা বেচারি না পারছে চুপ করতে বলতে, আর না পারছে সেখান থেকে উঠে যেতে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও সে রিশাদের কথায় কথায় হুঁ-হা শব্দ করে চলেছে। হঠাৎ করে এরেন কোত্থেকে এসে যেন ইলোরা আর রিশাদের মাঝে ধপ করে বসে পড়ল। এরেনের এহেন কাজে ইলোরা আর রিশাদ হকচকিয়ে গেল। দুজনেই প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে এরেনের দিকে তাকিয়ে রইল। এরেন তাদের দুজনের মুখোভাব লক্ষ্য করে দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল,“হোয়াট? জায়গাটা খালি ছিল তাই বসে পড়লাম। এনি প্রবলেম?”

রিশাদ অপ্রস্তুত হেসে বলল,“না না।”

এরেনের কান্ড দেখে ইলোরা অন্যদিকে তাকিয়ে ঠোঁট টিপে হাসল। তারপরই হঠাৎ প্রচন্ড অস্বস্তি হতে লাগল। লজ্জায় সে এরেনের দিকে তাকালও না আর। রিশাদ মনে মনে এরেনের উপর খুব অসন্তুষ্ট হলেও গোমড়া মুখে চুপচাপ বসে রইল। এরেন সরু চোখে একবার ইলোরা আরেকবার রিশাদের দিকে তাকিয়ে বলল,“আমি কি এখানে বসে ভুল করে ফেললাম?”

রিশাদ জোরপূর্বক হেসে বলল,“আরে না না। ভুল করবে কেন?”

তখনই রিশাদের ফোন বেজে উঠল। সে ফোন রিসিভ করে সোফা থেকে উঠে কথা বলতে বলতে অন্যদিকে চলে গেল। এরেন কিছুক্ষণ চুপচাপ সূক্ষ্ম চোখে ইলোরাকে নিরীক্ষণ করল। ইলোরা সেই যে ওদিক ফিরেছে, আর এদিক ফেরার নামই নেয়নি। এরেন এবার কিছুটা বিরক্ত হলো। গলা ঝেড়ে বলল,“পাশে যে আস্ত একটা মানুষ বসে আছে, তা কি কেউ দেখেনি?”

ইলোরা একটু নড়েচড়ে বসল, কিন্তু ফিরে তাকাল না। এরেন শান্ত স্বরে বলল,“এদিক তাকাও।”

এবার আর কী করার আছে? অনিচ্ছা সত্ত্বেও ইলোরা এলোমেলো দৃষ্টিতে এরেনের দিকে তাকাল। কিন্তু সে সরাসরি এরেনের চোখের দিকে তাকাল না। এরেন মুচকি হেসে বলল,“সম্পূর্ণ সুস্থ আছো এখন?”

ইলোরা উপর নিচে মাথা দোলালো। এরেন চোখ পাকিয়ে বলল,“আবার অস্বস্তি? মুখে বলো।”

ইলোরা দুহাত কচলাতে কচলাতে মৃদু কন্ঠে বলল,“ভালো।”

“যা চিন্তায় ফেলে দিয়েছিলে আজ!”

ইলোরার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলো ‘আপনার এত চিন্তা কেন হয়েছে আমার জন্য?’ কিন্তু করল না। তার জন্য এরেনের এই দুশ্চিন্তাটা দেখতে তার ভালোই লাগছে। এরেন আবার প্রশ্ন করল,“রিশাদ ভাই কী বলছিল এতক্ষণ?”

“ওনার ব্যাপারেই বলছিল।”

“বায়োডাটা?”

“হুম।”

এরেন চোখেমুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলল,“লোকটা বোধ হয় গায়ে পড়া স্বভাবের।”

ইলোরা ভ্রুকুটি করে বলল,“মানে?”

“দেখছো না এসে হতে তোমার পিছু ছাড়ছে না? ভারি বিপদজনক মানব! এর থেকে দূরে থাকবে।”

ইলোরা ফট করে বলে বসল,“কথা শুনে তো মনে হলো উনি খুব ভালো আর মিশুক ছেলে।”

এরেন ইলোরার দিকে তাকিয়ে কপাল কুঁচকে ফেলল। তারপর গম্ভীর মুখে বলল,“ভালো না খারাপ তা তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি? দূরে থাকতে বলেছি দূরে থাকবে ব্যাস।”

এরেনের কথায় শাসনের সুর শুনে ইলোরা ঠোঁট টিপে হাসল। ইলোরার হাসি এরেনের দৃষ্টিগোচর হলো না। সে ভ্রু নাচিয়ে বলল,“কী? হাসছো কেন?”

ইলোরার মুখ থেকে হাসিটুকু উধাও হয়ে গেল। সে কিছুটা নড়েচড়ে বসে বলল,“এমনি। ভাই কোথায়?”

“কথা ঘুরাচ্ছ?”

ইলোরার মুখটা চুপসে গেল। সে সোফা থেকে উঠতে যেতে নিতেই এরেন তার একহাত চেপে ধরল। ইলোরা উঠতে গিয়েও আবার ধপ করে বসে পড়ল। ইলোরা প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে এরেনের দিকে তাকাতেই এরেন গম্ভীর মুখে বলল,“উঠবে না। এখানেই বসে থাকো।”

ইলোরা স্থির দৃষ্টিতে নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে রইল। এরেন বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি ইলোরার হাত ছেড়ে মুচকি হেসে বলল,“সরি।”

ইলোরাও অপ্রস্তুত হাসল। এরেনের আজকের আচরণে সে বারবার অবাক না হয়ে পারছে না। সে আর উঠল না সেখান থেকে। এরেন মাঝে মাঝে দু একটা কথা বলল, আর ইলোরা জবাব দিলো। এরেনের সাথে কথা বলার এক পর্যায়ে সে খেয়াল করল, আস্তে আস্তে তার অস্বস্তি কমতে শুরু করেছে। হয়তো একটু একটু করে এভাবেই অস্বস্তিটা পুরোপুরি কেটে যাবে।


রাত নয়টায় সেলিব্রেশন শুরু হলো। তুশি শাড়ি পড়ে খুব সুন্দর করে সেজেছে। শাকিল বারবার হা করে তুশিকেই দেখছে। তা নিয়ে সবাই বেশ মজা করছে সাকিলের সাথে। কেক কাটার সময় ইলোরা একপাশে দাঁড়ানো ছিল। এরেন ধীর পায়ে এসে ইলোরার পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে গলা ঝাড়া দিলো। শব্দ পেয়ে ইলোরা প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে তাকাল। এরেন ইলোরার দিকে কিছুটা ঝুঁকে নিচু স্বরে বলল,“একদিন আমার ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি আমি আরও ধুমধাম করে সেলিব্রেট করব।”

ইলোরা বড়ো বড়ো চোখ করে এরেনের দিকে তাকিয়ে রইল। সঙ্গে সঙ্গে পেছন থেকে ফিসফিস করে কেউ বলে উঠল,“কিন্তু তুই তো এখনও বিয়েই করলি না। সেলিব্রেট করবি কি কোলবালিশের সাথে?”

এরেন-ইলোরা থতমত খেয়ে দ্রুত পেছন ফিরে তাকাল‌। তাকিয়ে দেখল রনি সন্দিহান দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের দুজনের মুখোভাব দেখে রনি এক ভ্রু উঁচু করে এরেনকে বলল,“কী ভাই? কোলবালিশের সাথে সংসার শুরু করলি না কি?”

ইলোরা ফিক করে হেসে উঠল। এরেন চোখ পাকিয়ে রনির দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,“হাড্ডি না গুঁড়ো করতে সামনে থেকে সর।”

রনি দাঁত বের করে হেসে বলল,“আমি এমনিতেও এখানে দাঁড়িয়ে থাকব না। এখন শুনছি কোলবালিশের সাথে ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি সেলিব্রেট করার কথা। আরও কিছুক্ষণ থাকলে আর কী কী শুনতে হয় আল্লাহ্ জানে! তার থেকে ভালো আমি চলে যাই।”

এরেন আবার কটমট চাহনিতে তাকাতেই রনি এক দৌড়ে সেখান থেকে কেটে পড়ল। এরেন ইলোরার দিকে তাকিয়ে দেখল ইলোরা এখনও মিটিমিটি হাসছে। এরেন ভ্রুকুটি করে বলল,“খুব মজা নিচ্ছ মনে হচ্ছে?”

ইলোরা এরেনের দিকে তাকিয়ে হাসি থামানোর চেষ্টা করে বলল,“না না।”

এরেন হঠাৎ সামনের দিকে ইশারা করে বলল,“দেখো, সাকিল ভাইয়া আর ভাবির জুটিটা সুন্দর না?”

ইলোরা তাকাল সাকিল আর তুশির দিকে। তারা দুজন হাসিমুখে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। দেখলে যেকেউ বলবে এরা সুখী দম্পতি। ইলোরা মুচকি হেসে ছোটো একটা শব্দ করল,“হুম।”

কেক কাটার পর্যায় শেষ করে সবাই ডিনার করে নিল। এরমধ্যে রিশাদ কয়েকবার চেষ্টা করেছে ইলোরার সাথে কথা বলার। কিন্তু এরেন বেচারাকে সেই সুযোগটাই দেয়নি। ডিনার শেষ করে তুশির বাড়ির লোক সবাই বিদায় নিয়ে চলে গেল। যাওয়ার সময়ও রিশাদ অসহায় মুখে ইলোরার দিকে তাকাল। কিন্তু তখনও এরেন ইলোরার সাথে বকবক করে চলেছে। সবশেষে সাকিব, এরেন, ইলোরা আর মিথিলা একসাথে বিদায় নিয়ে বাড়ি থেকে বের হলো। সাকিব একটা সিএনজি ডেকে এরেনের থেকে বিদায় নিয়ে উঠে পড়ল। সিএনজিতে ওঠার সময় ইলোরা একবার এরেনের দিকে তাকাল। এরেন মুচকি হেসে বলল,“নিজের খেয়াল রেখো। আল্লাহ্ হাফেজ।”

উত্তরে ইলোরাও শুধু মুচকি হাসল। সাকিবরা চলে যাওয়ার পর এরেনও তার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলো।


সামান্য জ্বর নিয়েই আজ ভার্সিটিতে এসেছে ডালিয়া। মালিহা বেগম, সাকিব, ইলোরা সবাই বারবার বারণ করা সত্ত্বেও সে শোনেনি। আর এই নিয়ে তাহসিন তার কানের কাছে ঘ্যান-ঘ্যান করেই চলেছে। তার একটাই কথা,“জ্বর নিয়ে এসেছিস কেন?”

ডালিয়া কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলল,“তোকে আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারি না তাহসিন। আজ জ্বর নিয়ে এসেছি বলে বলছিস কেন এসেছি। আবার না এলে বলতি সামান্য জ্বরই তো ছিল, এলি না কেন।”

তাহসিনের মুখটা চুপসে গেল। অন্তর তাহসিনকে চোখ মেরে ফিসফিস করে বলল,“কী ভাই? প্রেম সাগরে তো হাবুডুবু খাচ্ছ। প্রপোজ করবা কোন জনম?”

তাহসিন দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল,“দেরি আছে।”

“কেন?”

“আগে আমার প্রতি ওর একটা টান জন্মাক, তারপর।”

“ওররে মামা। এই বুদ্ধি নিয়াই থাকো!”

সবার আড্ডার মাঝেই হঠাৎ সেখানে উপস্থিত হলেন আফসার স্যার। ওনাকে দেখে সবাই বেশ অবাক হলো। এতদিন সামনেও আসেননি, আজ আবার নিজে থেকেই এসে উপস্থিত। সবার মতো মুনাও কিছুটা অবাক হলো। কারণ এই স্যারের হাবভাব কিছুই সে বুঝে উঠতে পারছে না। আফসার স্যার এসেই আগের মতো সবার সাথে কুশল বিনিময় করলেন। হাসিমুখে সবার সাথে কিছুক্ষণ কথাও বললেন। অরিশা হঠাৎ বলল,“স্যার, আপনার সাথে তো কয়েকদিন ধরে ঠিকমতো দেখাই হয় না। বিজি ছিলেন এ কদিন?”

স্যার মুচকি হেসে বললেন,“হ্যাঁ, একটু ঝামেলার মধ্যে ছিলাম। ও হ্যাঁ ভালো কথা, তোমাদের সাথে তো আমার সম্পর্ক পালটে গেল।”

আফসার স্যারের কথায় সবাই দাঁত কেলিয়ে হাসল। স্যার আড়চোখে মুনার দিকে তাকিয়ে দেখলেন মুনা গম্ভীর মুখে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে।‌ অন্তর বলল,“স্যার থেকে দুলাভাই। একদিক থেকে ভালোই হয়েছে স্যার। আমাদের এই মুনা লেখাপড়ায় আর ফাঁকি দিতে পারবে না।”

মুনা কটমট চাহনিতে অন্তরের দিকে তাকাল। স্যারও অন্তরের সাথে তাল মিলিয়ে বললেন,“তা তো পারবেই না। আমি এই ধরণের ফাঁকিবাজি একদম পছন্দ করি না।”

তারপর স্যার গলা ঝাড়া দিয়ে আবার বললেন,“যাইহোক, তোমাদের তো এখন ক্লাস আছে। তোমরা ক্লাসে যাও, আর তোমাদের ফ্রেন্ডকে রেখে যাও।”

স্যারের কথায় সবাই ঠোঁট টিপে হেসে রাজি হয়ে গেল। মুনা সরু চোখে বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে বলল,“আমিও এখন ক্লাসে যাব, চল।”

স্যার বললেন,“এমনিতেও তোমার ক্লাস ফাঁকি দেওয়ার অভ্যাস আছে। আজ একটা ক্লাস না করলে তেমন কোনো ক্ষতি হবে না।”

মুনা তার কথায় পাত্তা না দিয়ে সবার সাথে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। অন্তর হঠাৎ হাত দিয়ে অন্যদিকে ইশারা করে কিছুটা জোরে বলে উঠল,“মুনা, তোর বাবা এখানে কেন?”

মুনা অবাক হয়ে সেদিকে তাকিয়ে দেখল সেখানে কয়েকটা ছেলে বসে আড্ডা দিচ্ছে। সে চোখমুখ শক্ত করে পেছনে তাকাতেই দেখল সবাই ক্লাসের দিকে দৌড় মেরেছে, আর স্যার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসছে। মুনা ওদের চালাকি বুঝতে পেরে দ্রুত ওদের পিছু নেওয়ার জন্য উদ্যত হতেই স্যার এসে তার সামনে দাঁড়ালেন। মুনা পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিতেই স্যার আবার তার পথ আটকালেন। মুনা গম্ভীর গলায় বলল,“স্যার, আমার ক্লাস আছে। পথ ছাড়ুন।”

স্যার ছোটো একটা নিঃশ্বাস ফেলে স্বাভাবিকভাবেই বললেন,“আমি জানি তোমার ক্লাস আছে। কিন্তু তোমার সাথে আমার কথা আছে, সেজন্যই তোমাকে ক্লাসে যেতে দিলাম না। নইলে কারণ ছাড়া ক্লাস ফাঁকি দেওয়া আমি নিজেও পছন্দ করি না।”

মুনা বুঝল এখন এখান থেকে ছাড় পাওয়ার উপায় নেই। তাই সে বলল,“বলুন, কী বলবেন?”

“এখানে? চলো ভার্সিটির বাইরে কোথাও গিয়ে বসি।”

“আমি এখন কোথাও যাব না।”

“এখানে একা দাঁড়িয়ে কথা বলাটা কেমন দেখায় বলো? তাকিয়ে দেখো, আশপাশের সব স্টুডেন্টসরা কীভাবে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। ওদের মনে এখন প্রশ্ন জেগেছে, স্যার তোমার সাথে এত কী কথা বলছেন। ওরা তো আর জানে না আমি তোমার কে হই।”

মুনা আড়চোখে আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দেখল সত্যিই অনেক স্টুডেন্টসরা কেমন করে যেন তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। তবু সে কিছু বলল না। স্যার মুচকি হেসে বললেন,“চলো।”

মুনা আর কোনো কথা না বাড়িয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও চুপচাপ স্যারের সাথে গেইটের দিকে পা বাড়াল।

চলবে…………………..🌸

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here