সুপ্ত_প্রেমাসুখ পর্বঃ৩৮

0
859

#সুপ্ত_প্রেমাসুখ
#ইলোরা_জাহান_ঊর্মি
#পর্বঃ৩৮

ভোর হতেই বাড়ির বড়োরা সবাই কাজে লেগে পড়েছে। তাদের হাঁক ডাকে ছোটোরাও সবাই একে একে বিছানা ছাড়ছে। বাবুর্চিরা সকাল সকাল চলে এসেছে। তারা সকালের খাবার তৈরি করতে লেগে পড়েছে। এদিকে মিথিলা গতকাল থেকে সুযোগের সন্ধান করছে। বারবার চেষ্টা করেও সে মিজানুর রহমানের ফোন থেকে অনন্যার হবু বরের নাম্বার জোগাড় করতে পারেনি। আজও সে সকালে ঘুম থেকে উঠেই মামার পেছনে লেগে পড়েছে। একসময় একটা সুযোগ পেয়েও গেল। মিজানুর রহমান তার রুমে ফোন রেখে বাইরে গেলেন। সেই ফাঁকে মিথিলা ফোনটা নিয়ে ওপরে চলে গেল। কিন্তু কললিস্ট ঘাঁটতে গিয়ে মনে পড়ল বরের নাম্বার কোনটা তা সে বুঝবে কীভাবে? নামটাও মনে নেই। এক দৌড়ে গেল অনন্যার রুমে। গিয়ে অনন্যাকে প্রশ্ন করল,“আপ্পি, দুলাভাইয়ের নামটা যেন কী?”

অনন্যা বলল,“ফারদিন। কেন?”

মিথিলা হাতের ফোনটা দেখিয়ে বলল,“এই দেখো, দুলাভাইয়ের নাম্বার খুঁজছি।”

অনন্যা চোখ বড়ো করে বলল,“এটা তো বাবার ফোন। বাবা ফোন খুঁজলে কী করবি?”

“আরে ভাইয়ার নাম্বারটা খুঁজে আম্মুর ফোনে উঠিয়ে মামারটা রেখে আসব।”

“আচ্ছা তাড়াতাড়ি কর।”

মিথিলা পুরো কললিস্ট ঘেঁটেও ফারদিন নামের কোনো নাম্বারই খুঁজে পেল না। সে হতাশ হয়ে অনন্যাকে বলল,“পাচ্ছি না তো।”

অনন্যা হেসে বলল,“থাক, ফোন রেখে আয়। এমনিতেও আজ বিয়ে। এখন কথা না বললে কিছু হবে না।”

তখনই ইলোরা রুমে ঢুকল। মিথিলাকে লক্ষ্য করে প্রশ্ন করল,“কী হয়েছে?”

মিথিলা গাল ফুলিয়ে বলল,“মামার ফোন এনে দুলাভাইয়ের নাম্বার খুঁজছিলাম, পেলাম না।”

ইলোরা বলল,“না পেলে আর কী করবি? ফোন রেখে আয়।”

মিথিলা অনুরোধের সুরে বলল,“তুমি রেখে এসো না আপ্পি। মামা যদি দেখে ফেলে?”

“তো সেটা আনার সময় মনে পড়েনি?”

“প্লিজ। মামা তোমার হাতে ফোন দেখলেও তোমাকে কিছু বলবে না, আমি জানি।” এই বলে মিথিলা ইলোরার হাতের মুঠোয় ফোনটা গুঁজে দিয়ে এক ছুটে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। ইলোরা ফোন নিয়ে নিচে এল। মেইন দরজা দিয়ে বাইরে উঁকি দিয়ে দেখল মিজানুর রহমান বাইরে আছেন। সে মামার রুমের দিকে পা বাড়াল। রুমে ঢুকে ফোনটা রেখে আবার বেরিয়ে এল। সাকিবদের রুমের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় খেয়াল হলো অনেকক্ষণ ধরে এরেনকে আশেপাশে দেখা যাচ্ছে না। সবাই তো বাইরে আছে। সে কোথায়? রুমে আছে না-কি? ইলোরা ভেজানো দরজাটা একটু ফাঁক করে ভেতরে উঁকি দিলো। সঙ্গে সঙ্গে এরেনকে চোখে পড়ল। বিছানায় পা ঝুলিয়ে দুহাত কপালে ঠেকিয়ে মাথা নিচু করে বসে আছে। ইলোরা কপাল কুঁচকালো। একটু আগেও তো ঠিকঠাক ছিল। হঠাৎ করে কী হলো? মাথা ব্যথা করছে না-কি? ইলোরা রুমে ঢুকে দরজাটা আস্তে করে বন্ধ করে দিলো। এগিয়ে গিয়ে এরেনের মাথায় হাত রাখল। এরেন মাথা উঁচু করে তাকাল। তার চোখ মুখ খুবই চিন্তিত দেখাচ্ছে। ইলোরা বলল,“কী হয়েছে তোমার? এভাবে বসে আছো কেন?”

এরেন কোনো উত্তর না দিয়ে হঠাৎ দুহাতে ইলোরার কোমর জড়িয়ে ধরে পেটে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করল। ইলোরা কিছুটা অবাক হলো। আজকের আগে কখনও সে এরেনকে এতটা আপসেট হতে দেখেনি। হঠাৎ করে কী হলো যে এমন আপসেট দেখাচ্ছে? ইলোরা এরেনের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,“কী হয়েছে? মাথা ব্যথা করছে?”

এরেন তবু চুপ। সে এতটা জোরে আঁকড়ে ধরে আছে যে ইলোরা নড়াচড়াও করতে পারছে না। ইলোরা বারকয়েক জিজ্ঞেস করেও এরেনের থেকে কোনো উত্তর পায়নি। শেষে সে নিজের কোমর থেকে এরেনের হাত সরিয়ে তার পাশে বসে পড়ল। তারপর এরেনকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে গালে হাত রেখে চিন্তিত কন্ঠে বলল,“তোমাকে তো কখনও এমন চিন্তিত দেখিনি। প্লিজ বলো না কী হয়েছে? আমার খুব টেনশন হচ্ছে এখন। বলবে না?”

এরেন শান্ত স্বরে বলল,“আমাকে একবার শক্ত করে জড়িয়ে ধরবে ইলোনি? আমার মনে হচ্ছে আমি মনোবল হারিয়ে ফেলছি।”

ইলোরা এবার একটু বেশিই অবাক হলো। যে ছেলেটা সব পরিস্থিতিতে নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে জানে সে কি না বলছে মনোবল হারিয়ে ফেলছে! এরেন অসহায় দৃষ্টিতে ইলোরার দিকে তাকিয়ে আছে। ইলোরার কান্না পেয়ে যাচ্ছে মানুষটার হঠাৎ পরিবর্তন দেখে। সে এগিয়ে গিয়ে এরেনের গলা জড়িয়ে ধরে কাঁধে থুতনি রাখল। এরেন দুহাতে শক্ত হয়ে ইলোরাকে জড়িয়ে ধরে তার ঘাড়ে মুখ গুঁজে চুপ করে রইল। ইলোরা কেঁপে উঠল। আজ যেন এরেনকে অপরিচিত লাগছে। এরেনের নিরবতায় ইলোরার ভয়ও লাগছে। অনেকক্ষণ নিরবতায় কাটিয়ে ইলোরা বলল,“এখন কিন্তু আমার কান্না পাচ্ছে।”

এরেন নিচু স্বরে বলল,“কান্না পেলেও কাঁদবে না। তাহলে আমি একেবারে শক্তিহীন হয়ে পড়ব।”

“তাহলে বলছো না কেন কী হয়েছে? আমার কি চিন্তা হয় না?”

এরেন কিছু বলার আগেই বাইরে থেকে তাহসিন ডেকে বলল,“এরেন ভাই, সাকিব ভাই খেতে ডাকছে।”

এরেন ইলোরাকে ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গলা উঁচিয়ে বলল,“তুমি যাও আমি আসছি।”

দরজার ওপাশে আর কোনো শব্দ পাওয়া গেল না। এরেন বড়ো একটা শ্বাস নিয়ে দরজার দিকে পা বাড়াতেই ইলোরা উঠে গিয়ে তার এক হাত ধরে ফেলল। এরেন ঘুরে দাঁড়িয়ে ইলোরার গালে হাত বুলিয়ে হাসার চেষ্টা করে বলল,“ইটস ওকে। একদম ঠিক আছি আমি। চিন্তা করো না। চলো।”

ইলোরাকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে এরেন দরজা খুলে দ্রুত পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। ইলোরা কিছুক্ষণ সেখানেই ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইল। তারপর সেও রুম থেকে বেরিয়ে গেল। সবাই সকালের নাস্তা করতে ব্যস্ত। ইলোরাকে দেখে মালিহা বেগম ডেকে বললেন,“অমি, সবাই খেতে বসেছে তুই ঘুরঘুর করছিস কেন? তাড়াতাড়ি খেতে বস।”

ইলোরা এগিয়ে গিয়ে একটা খালি চেয়ার পেয়ে বসে পড়ল। তার সোজাসুজিই এরেন বসে খাচ্ছে। ইলোরা খাবার মুখে দিতে দিতে খেয়াল করল এরেন শুধু খাবার নাড়াচাড়া করছে আর দু একবার মুখে তুলছে। খাওয়ার দিকে একদমই মনোযোগ নেই তার। সাকিব হঠাৎ এরেনকে লক্ষ্য করে বলল,“এরেন, তুই তো খাচ্ছিসই না।”

এরেন গ্লাস থেকে এক ঢোক পানি খেয়ে বলল,“ক্ষুধা নেই রে। খেতে ইচ্ছে করছে না আর।”

এরেন উঠে চলে গেল। ইলোরা আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তার দিকে। নাদিয়া ইলোরার পাশের চেয়ার থেকে ফিসফিস করে বলল,“ভাইয়া অসুস্থ না-কি? কেমন যেন দেখাচ্ছে।”

ইলোরা হতাশ কন্ঠে বলল,“জানি না। বলল তো ঠিক আছে।”

খাবার শেষ করে ইলোরা অনেকবার চেষ্টা করল এরেনের সাথে কথা বলার। কিন্তু সুযোগ পেল না। আত্মীয়-স্বজনে বাড়ি গিজগিজ করছে। বাবুর্চিদের রান্নার ধুম লেগে গেছে। খাবারের গন্ধে চারদিক ম ম করছে। দুপুর বারোটা বাজতেই মেয়েরা সাজগোজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। অনন্যাকে রেডি করার আগে সবাই রেডি হওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। ইলোরা এরেনের দেয়া শাড়িটা লাগেজ থেকে বের করতেই ডালিয়া অবাক হয়ে বলল,“এটা কোন শাড়ি? তুই তো আসার সময় এই শাড়ি আনিসনি।”

ইলোরা খুব ভালো করেই জানে এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে। সে কোনোমতে জবাব দিলো,“এটা আমি কিনেছি।”

“কবে?”

“পরশুদিন মার্কেটে গিয়ে।”

“কখন কিনলি? আমরা তো কেউ দেখলামই না।”

“তো এখন দেখ।”

ডালিয়া সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকাল। মেয়েরা সবাই রেডি হয়ে অনন্যাকে রেডি করতে লেগে পড়ল। যোহরের নামাজের পর বরযাত্রী আসবে। অরিশা যখন অনন্যাকে মেকআপ করাচ্ছে তখন ইলোরা রুম থেকে বের হলো। এরেনের দেয়া শাড়িটা পড়ে অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে। চারদিকে এরেনকে খুঁজতে গিয়ে সে মায়ের সামনে পড়ল। মালিহা বেগম ইলোরাকে নিরীক্ষণ করে বললেন,“অমি, এই শাড়ি আবার কার? দেখে তো নতুন মনে হচ্ছে।”

ইলোরা একটা শুকনো ঢোক গিলল। মায়ের কাছে সে কখনও মিথ্যা বলে না। আজ বাধ্য হয়ে বলতেই হবে। সে সাহস জুগিয়ে হেসে বলল,“এটা আমি নিজেই কিনেছি। টাকা জমিয়ে রেখেছিলাম। পরশুদিন মার্কেটে যাওয়ার পর হঠাৎ এটা চোখে পড়ল। খুব পছন্দ হয়েছে তাই কিনে ফেললাম। সুন্দর না আম্মু?”

মালিহা বেগম হেসে বললেন,“খুব সুন্দর হয়েছে। তোকেও খুব মানিয়েছে শাড়িটাতে।”

মালিহা বেগম নিজের কাজে চলে গেলেন। ইলোরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করে এরেনকে পেয়েও গেল। এরেন তার সাথে ম্যাচিং করে নীল পাঞ্জাবি পড়েছে। সে ইলোরাকে দেখে হা করে তাকিয়ে রইল। তার চোখে ইলোরাকে আজ বাকি সব দিনগুলো থেকে কয়েকগুণ বেশি সুন্দর লাগছে। শাড়িটায় খুব মানিয়েছে মেয়েটাকে। মনে হচ্ছে এই শাড়িটা অন্য কারো পরনে এতটা মানাত না। এরেনের দৃষ্টি দেখে ইলোরা লাজুক হাসল। এরেন আশেপাশে দৃষ্টি বুলিয়ে ইলোরার কাছে গিয়ে সময় নিয়ে কপালে চুমু খেল। ইলোরার চিবুক স্পর্শ করে মুখটা উঁচু করে ধরে বলল,“এমন পরী সেজে আমার কাছে এলে সত্যি সত্যিই অসভ্যতামি করে বসব। তখন কিন্তু আমার দোষ দিতে পারবে না মহারানি।”

ইলোরা লজ্জা পেয়ে এরেনের বুকে মুখ লুকাল। এরেন ইলোরাকে আরেকটু লজ্জায় ফেলার জন্য ফিসফিস করে বলল,“বিয়ের ছয়মাস হয়ে গেল অথচ আজ পর্যন্ত বাসর হলো না। আমার মতো পোড়া কপাল মনে হয় দ্বিতীয় কোনো ছেলের নেই।”

ইলোরা লজ্জায় কোনো কথা বলতে পারল না। শুধু এরেনের পিঠে ছোট্ট একটা চিমটি কাটল। এরেন ইলোরাকে ছেড়ে দিয়ে হেসে বলল,“বেশিক্ষণ এমন আঠার মতো লেগে থাকলে আমি আবার অসভ্য হয়ে যেতে পারি। তাই কোনো অঘটন ঘটানোর আগে মুক্ত করে দিলাম। সব অঘটন তোলা রইল ম্যাডাম।”

ইলোরা মুচকি হেসে বলল,“অসভ্য!”

ইলোরা দ্রুত পায়ে সেখান থেকে সরে গেল। অনন্যাকে রেডি করতে করতে দুইটা নয় বেজে গেল। বরযাত্রী আরও আগে আসার কথা ছিল। কিন্তু তাদের দেরি হচ্ছে দেখে মিজানুর রহমান আর সাজিদ হোসেন বরের বাবা আর বোনকে ফোন লাগাল। কিন্তু কয়েকবার ফোন করেও তাদের পাওয়া গেল না। বারবার রিং হয়ে কেটে যাচ্ছে কিন্তু কেউই ফোন তুলছে না। ঘড়ির কাঁটা তিনটার ঘরে পৌঁছল। তবু বরযাত্রীদের কোনো খবর পাওয়া গেল না। তিনটা পনেরোতে বরের বাবার ফোন এল। মিজানুর রহমান স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ফোন রিসিভ করলেন। কিন্তু ফোনের ওপাশ থেকে হবু বেয়াইয়ের করুণ কন্ঠের কথাগুলো শুনে তিনি স্তব্ধ হয়ে গেলেন। সাজিদ হোসেন তার পাশেই ছিলেন। তিনি চিন্তিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,“কী হয়েছে ভাইজান? কোনো সমস্যা?”

মিজানুর রহমান ধপ করে পাশের একটা চেয়ারে বসে পড়লেন। মাথায় একহাত দিয়ে ধরা গলায় বললেন,“এতদিনের মানসম্মান মনে হয় আর বাঁচাতে পারব না সাজিদ। ছেলে পালিয়েছে।”

সাজিদ হোসেন চমকে উঠে বললেন,“মানে?”

“ছেলে এই বিয়েতে রাজি ছিল না। তার বাবা জোর করে রাজি করিয়েছিল। ছেলের অন্য মেয়ের সাথে সম্পর্ক আছে। বরযাত্রী রওনা দেয়ার আগেই সে সবার চোখে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে গেছে। ছেলে যে এই বিয়েতে রাজি ছিল না তা আমরা জানতাম না। এখন কী হবে সাজিদ? গ্রামের মানুষ এসব কথা শুনলে ছিঃ ছিঃ করবে। আমার মেয়েটাকে কত কথা শুনতে হবে।” মিজানুর রহমানের কথা শুনে সাজিদ হোসেন হতবাক হয়ে গেলেন। এমন একটা দিনে এমন খবর শোনার পর কীইবা বলার থাকতে পারে? মিজানুর রহমানকে সান্ত্বনা দেয়ার মতো কোনো কথাই তিনি খুঁজে পেলেন না। বাড়ির ভেতরে গিয়ে কথাটা বলতেই আলিয়া বেগম কান্নায় ভেঙে পড়লেন। আলিয়া বেগমের কান্নার শব্দে অনেক মানুষ জড়ো হয়ে গেছে। ইতোমধ্যে চারপাশে কানাকানিও শুরু হয়ে গেছে। খবরটা একসময় অনন্যার কানেও পৌঁছল। বিয়ের কিছুক্ষণ আগে বিয়ে ভাঙার কথা শুনে সে পাথরের মতো নিশ্চুপ হয়ে বসে রইল। বুঝে উঠতে পারল না এই মুহূর্তে তার কেমন রিয়েক্ট করা উচিত। ছোটোদেরও সবার মুখ কালো হয়ে গেছে। চারপাশের অবস্থা বেগতিক দেখে সাজিদ হোসেন বড়োদের নিয়ে অনন্যার রুমে গেলেন। এর কারণ কেউই বুঝে উঠতে পারল না। ছোটোদের মধ্যে শুধু ডালিয়া, নাঈম আর সাকিবকে ভেতরে ডাকা হলো। বাকি সবাই বাইরে দাঁড়িয়ে চিন্তায় হাঁসফাঁস করছে। এরেন ইলোরার পাশে গিয়ে তাকে স্বান্তনা দিয়ে বলল,“চিন্তা করো না।”

ইলোরা চিন্তিত কন্ঠে বলল,“আব্বু সবাইকে নিয়ে অনু আপ্পির রুমে গেল কেন বলো তো?”

এরেন বলল,“কী জানি! বুঝতে পারছি না। অপেক্ষা করে দেখি।”

প্রায় বিশ মিনিট পর অনন্যার রুম থেকে সবাই বেরিয়ে এল। সবার সাথে অনন্যাও এল। সবার মুখোভাব গম্ভীর দেখাচ্ছে। বিয়েতে যাদের নিমন্ত্রণ করা হয়েছিল তাদের বেশিরভাগই খেয়েদেয়ে চলে গেছে বরযাত্রী আসতে দেরি হচ্ছে বলে। কেউ কেউ কৌতুহলবশত থেকে গেছে। এখন বাড়ির ভেতরে শুধু অনন্যার আত্মীয়-স্বজনরা। ছোটোরা সবাই কৌতুহলী দৃষ্টিতে বড়োদের দিকে তাকিয়ে আছে। অনন্যা কাঁদছে। সবার মুখোভাব দেখে কেউ কিছু আন্দাজও করতে পারছে না। বড়োরা সবাই অনন্যাকে নিয়ে গিয়ে বসার ঘরে বসল। ছোটোরাও তাদের পেছন পেছন চলে এল কিছু জানার আগ্রহে। সাজিদ হোসেন এরেনকে ডেকে বললেন,“এরেন, কাজি সাহেব কোথায়?”

এরেন বলল,“বাইরে বসে আছে।”

“ওনাকে ভেতরে নিয়ে আসো।” সাজিদ হোসেনের কথা শুনে ছোটোরা সবাই প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালেও কারো সাহস হলো না প্রশ্ন করার। এরেন গিয়ে কাজিকে ভেতরে ডেকে নিয়ে এল। সাজিদ হোসেন কাজিকে বসতে বললেন। কাজি সাহেব বসার পর তিনি বললেন,“বিয়ে পড়ানো শুরু করুন ভাই।”

ছোটোরা ফ্যালফ্যাল করে সাজিদ হোসেনের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। ‌বরই তো নেই, বিয়ে কার সাথে? কাজি সাহেব বললেন,“বরযাত্রীই তো এল না এখনও। বিয়ে পড়াব মানে?”

“আপনি শুরু করুন। বর এখানেই আছে। বরের নামের জায়গায় আব্দুল্লাহ্ সাকিব লিখুন।” সাজিদ হোসেনের কথাটা শুনে কক্ষমধ্যে যেন ছোটোখাটো একটা বাজ পড়ল। ছোটোরা সবাই অবাক হয়ে বড়োদের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। সাজিদ হোসেন সেটা বুঝতে পেরে সবার উদ্দেশ্যে বললেন,“ভাইজান আর অনুর সম্মান বাঁচানোর জন্য আমি সাকিবের সাথে অনুর বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আর এতে সবার মত আছে। সবদিক বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে তাই তোমরা এটা নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ো না।”

সাকিব একপাশে ভাবলেশহীন ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। সাজিদ হোসেন তাকে ডেকে অনুর পাশে বসালেন। অনুর কান্না ক্রমাগত বাড়ছে। কাজি সাহেব বিয়ে পড়ানো শুরু করলেন। রেজিস্ট্রি পেপারে সাইন করার সময়ও অনু কান্নায় ভেঙে পড়ায় সাজিদ হোসেন বললেন,“মা রে, তোর জীবনে এমন একটা ঘটনা আল্লাহ্ লিখে রেখেছিলেন তাই এমন হচ্ছে। ভেঙে পড়িস না মা। তুই আমার আরেক মেয়ে হয়ে আমার বাড়িতে উঠবি। তোর সুখে একটুও কমতি হবে না। কাঁদিস না। সাইনটা কর।”

মিজানুর রহমানও ধরা গলায় বললেন,“সাইন কর মা।”

অনু কাঁপা কাঁপা হাতে সাইন করল। কিছুক্ষণের মধ্যেই বিয়ের কাজ সম্পন্ন হলো। সাজিদ হোসেন সিদ্ধান্ত নিলেন অনুর আজ যেভাবে বাবার বাড়ি ছেড়ে শ্বশুরবাড়ি চলে যাওয়ার কথা ছিল সেভাবেই যাবে। তাই তিনি সবাইকে বললেন যার যার ব্যাগ গুছিয়ে নিতে। সন্ধ্যার আগেই তারা রওনা দিবেন। মালিহা বেগম, ইলোরা, মিথিলা, অরিশা, নাদিয়া, সাকিব, এরেন, রনি, তাহসিন সবাই চলে গেল নিজেদের ব্যাগ গোছাতে। অনু তার বাবা-মাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। মিজানুর রহমান আর আলিয়া বেগমও সমান তালে কেঁদে চলেছেন। এমন একটা পরিস্থিতির শিকার হবেন তা তারা দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেননি। ডালিয়াও নিরবে চোখের পানি ফেলছে। ইলোরা আর মিথিলা নিজেদের ব্যাগ গুছিয়ে ডালিয়ারটাও গুছিয়ে নিল। সবাই সবকিছু গুছিয়ে নিতে নিতে বিকাল পাঁচটা বেজে গেল। এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার তালে বাড়ির কারো খাওয়াও হয়ে ওঠেনি। মিজানুর রহমান অনুরোধ করলেন সবাই যেন খাওয়া-দাওয়া করে যায়। তার অনুরোধ রাখতে সবাই খেতে বসল। কিন্তু কারোরই ঠিকমতো খাওয়া হলো না। সাকিব আর ‌অনুকে জোর করেও খাওয়ানো যায়নি।‌ বিদায়ের সময় অনু কাঁদতে কাঁদতে একদম শক্তিহীন হয়ে পড়ল। মিজানুর রহমান সাকিবের হাত ধরে ধরা গলায় বললেন,“পারলে মাফ করে দিস বাবা। আমি জানি তোর মনের অবস্থা এখন কেমন। এমন কিছুর জন্য আমরা কেউই প্রস্তুত ছিলাম না। আমার মেয়েটাকে না চাইতেও তোর হাতে তুলে দিলাম।”

সাকিব থমথমে মুখে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। মিজানুর রহমান, আলিয়া বেগম আর বাকি আত্মীয়-স্বজনদের থেকে বিদায় নিয়ে সবাই যখন রওনা দিলো তখন মাগরিবের আজান শোনা গেল। দুইটা লেগুনা নিয়ে সবাই বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছল। বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত মিজানুর রহমান, নাঈম আর আরও কয়েকজন গেল। সাজিদ হোসেন বললেন,“সাকিব-অনুকে নিয়ে আমি, মিথিলা আর মালিহা মাইক্রো নিয়ে চলে যাই। তোমরা বরং বাসে আসো। আপত্তি আছে তোমাদের?”

এরেন বলল,“না আঙ্কেল, এটাই ভালো হবে।”

একটা মাইক্রো ভাড়া করে সাকিব, অনন্যা, সাজিদ হোসেন, মালিহা বেগম আর মিথিলা উঠে পড়লেন। বাকিরা সবাই টিকিট কেটে বাসে চড়ে বসল। নাদিয়া আর অরিশা একদম সামনের সিটে বসল। তাদের পেছনের সিটে বসল তাহসিন আর ডালিয়া। অপর সারির পেছনের দিকে বসল এরেন আর ইলোরা। রনি গিয়ে একদম পেছনের সিটে বসল। সিটে বসেই ইলোরা এরেনের বুকে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করল। এরেন ইলোরার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,“ক্লান্ত লাগছে?”

ইলোরা কোনো উত্তর দিলো না। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাস ছাড়ল। এরেন নিজের বুকের কাছে ঠান্ডা অনুভব করতেই বুঝল ইলোরা নিঃশব্দে কাঁদছে। এরেন হন্তদন্ত হয়ে দুহাতে ইলোরার মুখটা তুলে ধরল। চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল,“কাঁদছো কেন? সাকিবের কপালে যে ছিল তার সাথেই বিয়ে হয়েছে। এটা নিয়ে এত কান্নাকাটি করে কী হবে বলো?”

ইলোরা ধরা গলায় বলল,“আমার মতো ভাইয়ের বিয়েটাও হঠাৎ করে এক্সিডেন্টলি হয়ে গেল। ভাইয়েরটা তো তবু আব্বুর সিদ্ধান্তে হয়েছে। কিন্তু তারা যখন শুনবে আমারও এক্সিডেন্টলি বিয়ে হয়েছে তখন তাদের মনের অবস্থা কী হবে? আমার খুব ভয় লাগছে।”

এরেন ইলোরাকে বুকে চেপে ধরে বলল,“ভয়ের কী আছে পাগলী? আমি তো আছি। কিচ্ছু হবে না দেখো। শুধু শুধু কান্নাকাটি করো না প্লিজ। বলেছি না আমার সামনে কান্না করবে না।”

ইলোরা কান্না থামিয়ে দিলো। ভালোবাসার মানুষটাকে আঁকড়ে ধরে চুপচাপ বুকে পড়ে রইল।

চলবে………………..🍁

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here