সুপ্ত_প্রেমাসুখ পর্ব-১

0
3568

তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা, তুমি আমার সাধের সাধনা,
মম শূন্য গগন বিহারী।
আমি আপন মনের মাধুরী মিশায়ে তোমারে করেছি রচনা,
তুমি আমারই, তুমি আমারই,
মম অসীম গগন বিহারী।

শ্রীকান্ত আচার্যের কন্ঠে প্রিয় একটা রবীন্দ্র সংগীত শুনতে শুনতে সিটে হেলান দিয়ে দুচোখ বুজে হালকা ঝিমুচ্ছে ইলোরা। পরপর দু’বার মনে হলো তার কানের কাছে কেউ কথা বলছে। পুরুষালি কন্ঠে কেউ হয়তো কাউকে ডাকছে। পরক্ষণেই মনে হলো লোকটা হয়তো তাকেই ডাকছে। কিন্তু এই মুহূর্তে তার চোখ খুলতে ইচ্ছা করছে না। ঘুমঘুম চোখে প্রিয় গানের সুর কানে এলে নিজস্ব একটা জগৎ সৃষ্টি হয়। যেখানে গানের তালে তালে নানা রকম কল্পনা সাজানো যায়। ইলোরার এখন সেই জগৎটা থেকে বের হওয়ার একদমই ইচ্ছে নেই। কিন্তু লোকটা তো দমে যাওয়ার পাত্র নয়। তখন থেকে ডেকেই যাচ্ছে। একটা মেয়ের কাঁচা ঘুম এভাবে ভাঙার মানে কী? আশ্চর্য! লোকটার মাথায় কি একটুও বুদ্ধি-সুদ্ধি নেই না-কি? এবার ইলোরার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। সে চোখ বন্ধ অবস্থাতেই কান থেকে ইয়ারফোন খুলে কিছুটা নড়েচড়ে বসতেই পাশ থেকে লোকটা আবার ডেকে উঠল,“হ্যালো মিস, শুনছেন?”

ইলোরা এবার চরম বিরক্তি নিয়ে মুখ দিয়ে চ-সূচক শব্দ করল। মুখ ফুলিয়ে দম নিয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও হুট করে চোখ খুলল। কিছু কড়া কথা বলার জন্য মুখ খুলতেই লোকটা কিছুটা জোরেই বলে উঠল,“আপনি সাকিবের বোন না?”

ইলোরার চোখে মুখে বিরক্তির ছাপ সরে গিয়ে একরাশ বিস্ময় এসে ভর করল। দু’হাতে চোখ কচলিয়ে ডান হাত মুখের কাছে নিয়ে হামি তুলে ঘাড় ঘুরিয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকাল। স্পষ্ট দৃষ্টিতে তাকাতেই দেখল তার পাশের সিটে এক সুদর্শন যুবক বসে আছে। গায়ের রং ধবধবে ফর্সা। কালো লেদার জ্যাকেটে তার রূপ আরো একগুণ বেড়ে গেছে। মাথার চুল গুলো সুন্দর করে ক্ল্যাসিক কাট দেয়া। সামনের কয়েকটা চুল ভাঁজ পড়া কপালের উপর পড়ে লুটোপুটি খাচ্ছে। মাঝারি আকারের গভীর দুটো চোখ প্রশ্নভরা। ইলোরা কিছুটা নড়েচড়ে বসে ছোট একটা শব্দ করল,“জি?”

“আপনি সাকিবের বোন?”

“হ্যাঁ।”

ছেলেটা এবার মুচকি হাসল। তার ধারণা ঠিক হয়েছে এটা ভেবেই হয়তো সে মনে মনে বেশ খুশি হয়েছে। ছেলেটা আবার বলে উঠল,“তাহলে তো তোমাকে তুমি করেই বলা যায়। আমি সাকিবের খুব ক্লোজ ফ্রেন্ড। তুমি হয়তো আমাকে চেনো না। আমি তোমাকে চিনি। সাকিবের সাথেই একবার দেখেছিলাম তোমাকে।”

ইলোরার কথা বলার ইচ্ছে না থাকলেও ভদ্রতার খাতিরে জোর করে একটু মুচকি হেসে বলল,“ওহ্ আচ্ছা।”

ছেলেটা এবার নিজের সিটে গা এলিয়ে দিলো। মনে হচ্ছে ইলোরার ছোটো ছোটো উত্তরে সে কথা বলার তৃপ্তি হারিয়ে ফেলেছে। ইলোরা মনে মনে খুশিই হলো। নেহাত ছেলেটা ভাইয়ের ক্লোজ ফ্রেন্ড, নইলে কাঁচা ঘুম ভাঙার কারণে ছেলেটাকে এক্ষুনি সে কিছু কড়া-কড়া কথা শুনিয়ে দিত। কিন্তু এখন এটা করলে ছেলেটা হয়তো ভাইয়ের কাছে গিয়ে বলবে,“তোর বোন আমার সাথে অভদ্র আচরণ করেছে।”

ইলোরা ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেলে আশেপাশে তাকাল। বাস ভর্তি লোকজন। সন্ধ্যা সাতটায় বাস ছাড়ার কথা। সে এসেছে আধা ঘন্টা আগে। বাসের জন্য অপেক্ষা করতে হবে ভেবে বাসা থেকে বের হলেও বাসস্ট্যান্ডে এসে দেখল বাস আগে থেকেই দাঁড় করানো। তখন দু একজন যাত্রী ছিল। তাই বাসে নিরিবিলি পরিবেশে গান শুনতে শুনতে চোখে ঘুম চলে এসেছিল। কোলের উপর থেকে ফোনটা হাতে নিয়ে পাওয়ার বাটন চাপতেই দেখল ৮১+ মিসড কল। কল লিস্টে গিয়ে দেখল তার আব্বু, আম্মু, ভাই আর সব ফ্রেন্ডরা মিলে এতক্ষণ ফোন করেছে। ফোনটা সাইলেন্ট মুডে থাকায় সে শুনতে পায়নি। শুনলেও হয়তো রিসিভ করত না। পরে রিসিভ করলে তো সবাই মিলে শুধু বকা দিবে। দিলে দিক তাতে তার কী? সে যখন একবার রেগেমেগে বাড়ি থেকে চলে এসেছে তখন আর কেউ তাকে ফিরিয়ে নিতে পারবে না। যতই ফোন করুক সে কারো ফোন ধরবে না। ইলোরার ভাবনার মাঝেই বাস ছেড়ে দিলো। জানালা খুলে রাতের আকাশ দেখতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু এই শীতে জানালা খুললেই হুঁ হুঁ করে বাতাস এসে শরীর কাঁপতে শুরু করবে। আকাশ দেখার ইচ্ছাকে দমিয়ে রেখে সে পুনরায় আবার কানে ইয়ারফোন গুঁজে গুটিসুটি মেরে সিটে হেলান দিয়ে বসল।

বাস ছাড়ার প্রায় এক ঘন্টার মাথায় ইলোরার ফোন আবার নিঃশব্দে বেজে উঠল। এবার সে সজাগ থাকায় খেয়াল করল ঠিকই কিন্তু রিসিভ করতে ইচ্ছা করছে না। ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখল অরিশা ফোন করেছে। পরপর দু’বার বাজার পর সে কিছুটা বিরক্তি নিয়েই ফোন রিসিভ করল। ফোনটা রিসিভ করে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে অরিশা তেতে উঠল,“এই আক্কেল জ্ঞানহীন মাইয়া, কই তুই?”

ইলোরা মুখ গোমড়া করে পালটা প্রশ্ন করল,“কেন?”

“যা জিজ্ঞেস করেছি তার উত্তর দে। কই তুই?”

“তুই জেনে কী করবি?”

“আশ্চর্য! আমি কি জিজ্ঞেস করতে পারি না?”

“আমি কি জিজ্ঞেস করার কারণ জানতে পারি না?”

বারবার প্রশ্নের পিঠে পালটা প্রশ্ন শুনে অরিশা আরও তেতে উঠল। ঝাঁজালো গলায় বলে উঠল,“সমস্যা কী তোর? একটা প্রশ্নের উত্তর ঠিকভাবে দিতে পারছিস না? এক ঘন্টা ধরে তোর বাপ-মা আমাদের সবাইকে ফোন করে বারবার তোর কথা জিজ্ঞেস করছে। শুধু জিজ্ঞেস করছে অমি কি তোমার বাসায় গিয়েছে। অথচ যখনই কারণ জিজ্ঞেস করছি কিছু না বলেই ফোন কেটে দিচ্ছে। তখন থেকে সবাই মিলে তোকে ফোন করে যাচ্ছি আর তোর খবরই নাই। কাহিনি কী বলতো।”

ইলোরা একইভাবে উত্তর দিলো,“পরে বলব। এখন ভালো লাগছে না।”

অরিশা এবার অধৈর্য হয়ে বলল,“গোষ্ঠী কিলাই তোর ভালো লাগার। সবাইকে চিন্তায় ফেলে রাতদুপুরে নিরুদ্দেশ হয়ে ভালো না লাগার খবর বলতে এসেছিস! আচ্ছা এটা বল, এখন কোথায় আছিস?

ইলোরা কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই অরিশা পুনরায় সন্দিহান কন্ঠে বলে উঠল,“ওয়েট ওয়েট, লোকজনের হৈচৈ আর গাড়ির হর্ন শুনতে পাচ্ছি। তার মানে তুই গাড়িতে আছিস। এই তুই কোথায় যাচ্ছিস রে?

“মামার বাড়ি।”

ইলোরার সোজাসাপ্টা উত্তর শুনেই বিস্ময়ে অরিশার চোখ দুটো ছানাবড়া হয়ে গেল। সে চিৎকার করে বলল,“হোয়াট! তোর মামার বাড়ি তো কিশোরগঞ্জ। তুই এই রাতবেলা কাউকে না জানিয়ে একা একা কিশোরগঞ্জ যাচ্ছিস?”

ইলোরা স্বাভাবিকভাবেই উত্তর দিলো,“হ্যাঁ।”

অরিশা শক্তপোক্ত গলায় বলল,“সত্যি করে বলতো কী হয়েছে।”

“আমাকে চট্টগ্রাম ভার্সিটিতে ভর্তি করানোর জন্য আব্বু-আম্মু উঠেপড়ে লেগেছে। আমি বারবার করে বলছি যে আমি ঢাকা ছেড়ে কোথাও যাব না অথচ তারা আমার কোনো কথাই শুনতে চাইছে না। তোরা সবাই ঢাকা ভার্সিটিতে ভর্তি হবি আর আমি একা চট্টগ্রাম গিয়ে পড়ে থাকব কোন দুঃখে?”

“তাই বলে তুই এই রাতদুপুরে একা একা কিশোরগঞ্জ যাচ্ছিস কোন সাহসে?”

ইলোরা এবার বিরক্ত হয়ে উত্তর দিলো,“আমি বাড়ি থেকে চলে না এলে কাল সকালেই আব্বু আমাকে চট্টগ্রাম রেখে আসতো।”

“বাস তো অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছে। এখন তো ফিরতেও পারবি না। আমার বাসায় চলে আসতি। একা একা কিশোরগঞ্জ যাচ্ছিস? পাগল না-কি তুই?”

ইলোরা গাল ফুলিয়ে বলল,“এতো চিন্তা করতে হবে না। আমি একাই যেতে পারব। এখন এত চিল্লাচিল্লি ভালো লাগছে না। ফোন রাখ।”

অরিশা একইভাবে চিৎকার করে বলল,“আক্কেল জ্ঞানহীন কোথাকার! সামনে পেলে তোকে আস্ত চিবিয়ে খেতাম। আমাদের চিন্তায় ফেলার শাস্তি তোকে পেতে হবে। আল্লাহ্, এখন তো আমার ভয় লাগছে। এতটা পথ একা একা যাচ্ছিস, যদি কোনো বিপদ আপদ হয়?”

অরিশার মনটা অজানা ভয়ে কেঁপে উঠল। এদিকে ইলোরা এবার আর উত্তর না দিয়ে ফোনটা কেটে দিলো। ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাশে ঘাড় ঘুরাতেই দেখল তার ভাইয়ের বন্ধু বলা ছেলেটা ভ্রু কুঁচকে সন্দিহান দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ইলোরা কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে নড়েচড়ে বসতেই আবার ফোনটা নিঃশব্দে বেজে উঠল। ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখলো মুনা ফোন করেছে। এবারও ফোন রিসিভ করে অরিশার মতোই মুনার থেকেও ঝাঁজালো গলায় কিছু ঝাড়ি শুনল। তারপর একে একে টুম্পা, অন্তর, তাহসিন, নাদিয়া সবাই ফোন করে একই কাজ করল। ইলোরা সবার ঝাড়ি শুনে গাল ফুলিয়ে বসে রইল। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার ভাই ফোন করল। বন্ধুদের লাগামহীন ঝাড়ি শুনে এখন আর তার কোনো কথাই বলতে ইচ্ছে করছে না। যদিও সে জানে তার ভাই ওদের মতো বকবে না। এবারও সে অনিচ্ছা সত্ত্বেও ফোনটা রিসিভ করল। হ্যালো বলার আগেই ফোনের ওপাশ থেকে সাকিবের উত্তেজিত কন্ঠ শোনা গেলো,“ইলু, বোন তুই না-কি এই রাত-বিরেতে একা একা কিশোরগঞ্জ যাচ্ছিস? আমি বাসায় ফিরে দেখলাম আব্বু-আম্মু, মিথি সবাই চিন্তিত হয়ে বসে আছে। জিজ্ঞেস করে জানলাম তুই রাগ করে বাসা থেকে চলে গেছিস। তোর বন্ধুরাও কেউ কিছু জানে না। কতবার ফোন করেছি অথচ তুই ফোনটাই তুললি না। অরিশা মাত্র ফোন করে বলল তুই কিশোরগঞ্জ যাচ্ছিস। তুই কি পাগল হয়েছিস বোন? এমন নির্বোধের মতো কাজ কেউ করে! চিন্তায় আমার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। এর আগে প্রতিবার আমি তোকে কিশোরগঞ্জ নিয়ে গিয়েছি। আজ তুই একা যাচ্ছিস, তা-ও আবার এই রাতের বেলা। যখন তখন যেকোনো বিপদ হয়ে যেতে পারে, তখন কী হবে ভেবে দেখেছিস? এখন তো ফিরতেও পারবি না। আর আমারও তোর কাছে যাওয়া সম্ভব না। কী করি এখন আমি?”

সাকিব একনাগাড়ে কথাগুলো বলে থামল। ভাইয়ের চিন্তিত কন্ঠ শুনে এতোক্ষণে ইলোরা বুঝতে পারল সে না বুঝে কত বড়ো ভুল করে ফেলেছে। ভাই তো ঠিকই বলছে। রাত-বিরেতে একা একটা মেয়ে ঢাকা থেকে কিশোরগঞ্জ যাচ্ছে। রাস্তায় বিপদে পড়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু বাসা থেকে বের হওয়ার সময় তো এতো কিছু মাথায় আসেনি। আজ সারাদিন সে আব্বু-আম্মুকে অনেক বুঝিয়েছে কিন্তু কেউ তার কোনো কথা কানেই নেয়নি। সন্ধ্যায় তার মায়ের সাথে এক পর্যায়ে কথা কাটাকাটি ও করেছে। শেষে অধৈর্য হয়ে রাগে ক্ষোভে ফুঁসতে ফুঁসতে কোনো কিছু না ভেবেই সবার অলক্ষ্যে লাগেজ গুছিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়েছে। ওপাশ থেকে সাকিব আবার হা-হুতাশ শুরু করে দিয়েছে। ইলোরার এবার মনটাই খারাপ হয়ে গেল। তার ভাইটা সবার থেকে আলাদা। সবাই কতো বকাবকি করল, অথচ সে ফোন করেই হা-হুতাশ করে চলেছে। ভাই যদি আজ বাসায় থাকতো তাহলে এমন কিছুই হতো না। কিন্তু সে কোন জরুরি কাজে যেন আজ সারাদিন বাসার বাইরে ছিল। ইলোরা মন খারাপ করেই ভাইকে মিথ্যা সান্ত্বনা দিয়ে বলল,“ভাই, এত চিন্তা কোরো না প্লিজ। আমি যেতে পারব। কোনো সমস্যা হবে না দেখো। আমি গিয়েই তোমাকে ফোন করব।”

ইলোরার মিথ্যা সান্ত্বনায় লাভ কিছুই হলো না। সাকিব কিছুতেই শান্ত হচ্ছে না। একইভাবে হা-হুতাশ করে চলেছে। ইলোরা অসহায় ভাবে কয়েকবার সাকিবকে বুঝানোর চেষ্টা করল কিন্তু লাভ হচ্ছে না। ইলোরাকে অবাক করে দিয়ে হঠাৎ পাশে বসা ছেলেটা গলা ঝাড়া দিয়ে বলে উঠল,“কিছু মনে না করলে ফোনটা একটু আমাকে দিবে?”

ইলোরা প্রথমে বিস্মিত হয়ে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে রইল। পরক্ষণেই মনে পড়লো ছেলেটা তো ভাইয়ের বন্ধু। হয়তো কোনো দরকারি কথা মনে পড়েছে। ইলোরা কোনো উত্তর না দিয়ে চুপচাপ ইয়ারফোন খুলে রেখে ফোনটা ছেলেটার দিকে এগিয়ে দিলো। ছেলেটা ফোন হাতে নিয়ে কানে ধরেই একগাল হেসে বলল,“হেই সাকু।”

ছেলেটার মুখে নিজের ভাইয়ের নামের এমন বিকৃত উচ্চারণ শুনে ইলোরা ভ্রু কুঁচকালো। ওপাশ থেকে সাকিব অবাক হয়ে বলে উঠল,“এরেন, তুই!”

“হ্যাঁ। আমরা একই বাসে আছি। তোর বোনের আর আমার সিট পাশাপাশি পড়েছে। যদিও তোর বোন আমাকে চেনে না। কিন্তু আমি চিনতে পেরেছি। আমিও প্রথমে মনে মনে অবাক হয়েছিলাম তোর বোনকে একা দেখে। এতক্ষণে বুঝতে পারলাম তোর বোন রাগ করে বাসা থেকে বেরিয়ে এসেছে। যাইহোক, এতো চিন্তা করিস না, আমিও কিশোরগঞ্জ যাচ্ছি। এতটুকু পথ আমার সাথেই থাকবে।”

সাকিবের বুকের উপর থেকে যেন ভারী কিছু সরে গেল। সে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে চিন্তিত স্বরে বলল,“ভাই, তুই আমাকে কত বড়ো চিন্তা থেকে মুক্তি দিলি জানিস না। আমার বোনটাকে একটু দেখে রাখিস প্লিজ। বাস থেকে নেমে ওকে একটা সিএনজিতে উঠিয়ে দিস। আমার বোনটা ছোটো মানুষ। কেমন চিন্তায় ফেলে দিলো সবাইকে দেখলি তো। প্লিজ এরেন, কৃতজ্ঞ থাকব তোর কাছে।”

এরেন হাসিমুখে বলল,“এমনভাবে বলছিস মনে হচ্ছে আমি তোর অপরিচিত কেউ। আর অপরিচিত একজনের কাছে তুই অনুরোধ করছিস। নিশ্চিন্ত থাক বস।”

এরেনের কথায় সাকিব কিছুটা শান্ত হলো। দুজনের মধ্যে টুকটাক কিছু কথা হলো। এরেন সাকিবকে আশ্বস্ত করে ফোন কেটে দিয়ে হাসিমুখে ফোনটা ইলোরার হাতে ফিরিয়ে দিলো। ইলোরাও মনে মনে কিছুটা খুশি হলো কিন্তু মুখে প্রকাশ করল না। দুজনের মধ্যে আবার নিরবতা ভর করল। ইলোরা হাতের ইয়ারফোনটা ব্যাগে ঢুকিয়ে রেখে চুপচাপ সিটে মাথা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল। বেশ কিছুক্ষণ পর হঠাৎ জোরেশোরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বাস থেমে গেল। হঠাৎ এমন হওয়ায় এরেন আর ইলোরা দুজনেই টাল সামলাতে না পেরে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ল। ইলোরা কিছু না বুঝতে পেরে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ভীতু দৃষ্টিতে এদিকে-ওদিক তাকাল। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাসের যাত্রীদের মাঝে শোরগোল শুরু হলো। শোনা গেল বাসের পেছনের দুটো টায়ারই পাংচার হয়ে গেছে। দূর্ভাগ্যবশত বাস যেখানে থেমেছে সেখানে আশেপাশে কোনো গ্যারেজ নেই। বাধ্য হয়ে বাসের কন্ডাক্টর হাতে একটা টর্চ লাইট নিয়ে ছুটল গ্যারেজের খোঁজে। সব যাত্রীরা ইতোমধ্যে চিন্তিত মুখে বাস থেকে নেমে এদিক-ওদিক হাঁটাহাঁটি শুরু করেছে। সবার মুখে চিন্তার ছাপ। এই রাত-বিরেতে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা কেউ আশা করে নি। এই শীতের রাতে এখন যদি গ্যারেজের লোক এই অব্দি আসতে রাজি না হয় বা অন্য কোনো গাড়ি না পাওয়া যায় তাহলে কী হবে? অনিশ্চিত বিপদের আশঙ্কায় কেঁপে উঠলো ইলোরার কোমল নারী মন। সে একটা শুকনো ঢোক গিলে ভয়ে ভয়ে অসহায় দৃষ্টিতে এরেনের দিকে তাকাল। তার চাহনি দেখে এরেন বুঝতে পারল মেয়েটা ভয় পাচ্ছে। এরেন চোখের ইশারায় ইলোরাকে আশ্বস্ত করে চুপ থাকতে বলল। কিছুক্ষণ সেভাবেই বসে থেকে হঠাৎ এরেন উঠে দাঁড়িয়ে ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে ইলোরাকে উদ্দেশ্য করে বলল,“ব্যাগ নিয়ে চলে এসো।”

ইলোরা লাফিয়ে উঠল। কিছুটা অবাক হয়ে ভীত কন্ঠে প্রশ্ন করল,“কোথায় যাব?”

এরেন কোনো উত্তর না দিয়ে সামনের দিকে হাঁটা দিলো। ইলোরা কী করবে কিছু বুঝতে না পেরে বাধ্য হয়ে ব্যাগ হাতে নিয়ে এরেনের পিছু পিছু বাস থেকে নেমে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে পড়ল।

#সুপ্ত_প্রেমাসুখ
#ইলোরা_জাহান_ঊর্মি
#সূচনা_পর্ব

চলবে…………………🌸

নোট: ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। আশা করি নিজেদের মন্তব্য জানাবেন। হ্যাপি রিডিং।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here