সূর্য ডোবার আগে পর্ব-১১

0
2004

#সূর্য_ডোবার_আগে
পর্ব-১১
লেখিকা ~ #সুমন্দ্রামিত্র
কঠোরভাবে প্রাপ্তমনষ্কদের জন্য।
.
.
.

কড় কড় শব্দে দূরে কোথাও একটা বাজ পড়লো!

অবশ্য বাজটা ওর মাথায় ঠিক ওপরে পড়লেও এতটা অবাক হতো না তিন্নি। চোখের সামনে সারা পৃথিবী যেন দুলে উঠলো ওর। ব্যাগ হাতড়ে নিজের ফোনটা খুঁজতে লাগলো, নাহঃ, ফোন নেই! উল্টে ভাইয়ের ট্যাবটা রয়েছে ওর ব্যাগে। কি করবে কিছু বুঝতে পারছে না তিন্নি। নিজের গালেই নিজে দুটো চড় মারতে ইচ্ছে হচ্ছিলো ওর! হাতঘড়িতে তখন বিকেল সাড়ে চারটে, ঝির ঝির করে বৃষ্টি নেমেছে। আকাশ প্রায় অন্ধকার, একটু পরেই সূর্য ডুবে যাবে। জনহীন এই খাঁ খাঁ পাহাড়ের জায়গায় কি করবে ও? মনে মনে ঈশ্বরকে স্মরণ করতে করতে কোনোরকমে সাহস সঞ্চয় করে চা দোকানটায় ঢুকলো তিন্নি। গায়ের জামাটা ভিজে সপসপে, ঠান্ডায় আর টেনশনে হি হি করে কাঁপছে তখন। প্রায়ান্ধকার দোকানের ভেতর ঘন্টাখানেক আগের সেই হাসিখুশি দোকানিকে দেখতে পেল না তিন্নি।পুরো ফাঁকা, জলের আওয়াজ আসছে শুধু। অন্ধকারটা চোখে সয়ে আসতে খেয়াল করলো, একদম পেছনের কোনার দিকে এক বুড়ি লেপ্চা বা নেপালি মহিলা এঁটো কাপপ্লেট ধুচ্ছেন। যাক! কেউ তো আছে! বুকে বল পেয়ে এগিয়ে গেলো তিন্নি – “এই যে শুনছেন? ও দাদি? বাহার যে গাড়ি থে ওয়োহ্ কাহাঁ গ্যয়ে?”

বুড়ি মহিলা বোধহয় কানে শুনতে পান না, আর একটু এগিয়ে এসে তিন্নি এবার একটু জোরেই চেঁচালো। বুড়ি দাদি ওর দিকে ফিরে অবাক, তড়বর করে কি যে বলে গেলো ওর দেশোয়ালী ভাষায়, তিন্নি মাথামুন্ডু কিছুই বুঝলো না। আবার জিজ্ঞেস করলো – “ও দাদি?…..হিন্দি? ইংলিশ?”

দুদিকে ঘাড় নেড়ে মহিলা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কাকে যেন ডাকলো। কি হবে এবার? এই শীতেও দরদর করে ঘাম দিচ্ছে তিন্নির বা গা দিয়ে টপ টপ করে জল পড়ছে, ঠিক বুঝতে পারলো না ও। চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসছে! কি কুক্ষনে এই ট্রিপটায় আসতে চেয়েছিলো ও? এদিকে দাদির ডাকাডাকি শুনে চা ঝোপড়ির পেছনের পাথরের চাতাল থেকে একজন অল্পবয়সী ছোকরা বেরিয়ে এলো — “আরে দিদি? ক্যা আপ হি ইতনে দেড় তক বাথরুম মেঁ থে?”

যাক! এ তাও হিন্দি জানে! অল্প সাহস পেয়ে তড়বর করে তিন্নি জিজ্ঞেস করলো – “ওয়োহ্ কার কাহাঁ গ্যা? দো কার থা ইঁহান…”

পরবর্তী কথাগুলো হিন্দিতেই চলতে লাগলো ওদের। ছোকরাটি বললো – “গাড়ি তো সব চলে গেছে দিদি, অনেকক্ষন হলো! আপনি কোন গাড়িতে ছিলেন?”

— “সাদা গাড়ি, ইনোভা।“

হেসে ফেললো ছেলেটি – “এখানে সব ভাড়ার গাড়ি তো সাদা। আপনি গাড়ির নাম্বার বলুন, বা ড্রাইভারের নাম্বার।”

ভাড়ার গাড়ির “লাইসেন্স প্লেটের নাম্বার” কে মনে রাখে?? এবার বোধহয় কেঁদেই ফেলবে তিন্নি। ওর অবস্থা দেখে ছেলেটা বললো – “তা আপনি আপনার সাথীদের ফোন করুন, আমরা ওয়েট করছি ওদের আসা অবধি।”

– ফোনটা তো গাড়িতে ফেলে এসেছি।

ছেলেটার ভুঁরু কুঁচকে উঠলো। – “কেমন বুদ্ধু আপনি? গাড়ির কাউকে না বলে, ফোন ছেড়ে এরম একটা রাস্তার ধারের ঝুপড়িতে নেমে পরলেন?”

– না না, আমি তো বলেই নেমেছিলাম, তারপরও….

ছেলেটার থেকে মোবাইল ফোনটা নিয়ে সাত তাড়াতাড়ি নিজের ফোনে কল করলো তিন্নি। নাহ! ফোনটা সুইচ অফ আসছে ! আর কি করা যায় ভেবে পাচ্ছে না ও! তিন্নির মুখচোখের অবস্থা দেখে ছেলেটা বললো

– আপনার কোনো বন্ধুর ফোন নাম্বার দিন তবে ।

– একটা কাগজ পেন হবে?

সাদা কাগজে বহুকষ্টে সায়কের নাম্বারটা মনে করে লেখার চেষ্টা করলো তিন্নি। প্রথম ৪টে ডিজিট আর শেষে ২টো ডিজিট মনে আছে, কিন্তু মাঝে? হাতে পেন নিয়ে সাদা কাগজের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তিন্নি, মাথা ফাঁকা হয়ে গেছে, কিচ্ছু মনে পড়ছে না, কিচ্ছু না। কি হবে এবার? আর যদি ও বাড়ি ফিরতে না পারে? এরা যদি ওকে এখানেই আটকে রেখে দেয়? যদি আরো খারাপ কিছু হয়? নাহ্!!আর ভাবতে পারছে না তিন্নি। বুকের বামদিকে আরো জোরে ব্যাথা হচ্ছে, দমবন্ধ হয়ে আসছে। আর যাই হোক, কিছুতেই অজ্ঞান হওয়া চলবে না! শেষ খড়কুটো আঁকড়ে ধরার মতো বাবার শেখানো শান্তি মন্ত্রটা জোরে জোরে বলতে লাগলো তিন্নি

ওঁ পূর্ণমদঃ পূর্ণমিদং পূর্ণাৎ পূর্ণমুদচ্যতে ।
পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে ।।
ওঁ শান্তিঃ ওঁ শান্তিঃ ওঁ শান্তিঃ ।।

কোনো লাভ হল না, বুকটা ছিঁড়ে যাচ্ছে ব্যাথায়, তিন্নির চারপাশের আলো নিভে আসছে আস্তে আস্তে, বাতাসে কি অক্সিজেন কমে গেছে? চোখের সামনে সবকিছু অন্ধকার হয়ে আসার আগে তিন্নি বুঝতে পারলো লেপ্চা ছোকরা আর ওর দাদি দুজনেই চেঁচিয়ে উঠলো – “আরে! আরে, এই কি হলো? কি হলো?”

****************************__***************************
.
.
.

নিকষ কালো অন্ধকার এক টানেলের ভিতর দিয়ে হেঁটে চলছে তিন্নি, কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না, শুধু অনুভব করছে পায়ের তলায় ভিজে মাটি, সোঁদা পাহাড়ী গন্ধ আর বৃষ্টির শব্দ। টানেলের শেষ প্রান্ত থেকে ক্ষীন ডাক ভেসে আসছে — “শুনতে পাচ্ছেন? এই যে ম্যাডাম। চোখ খুলুন।”

হঠাৎ করে ঘোর কেটে গেল তিন্নির। কোথায় টানেল? ও তো সিকিমের পাহাড়ী রাস্তার একটা ঝোপড়িতে ছিল, সায়করা কি তবে ফিরে এসছে? ওরা ছাড়া আর কে এখানে বাংলায় কথা বলবে ওর সাথে?। কার কোলে শুয়ে আছে ও?
অনেক কষ্টে ভারী হয়ে আসা চোখ খুলে যে মুখটা দেখলো তাতে তিন্নি শিওর হয়ে গেল, এখনো ওর হ্যালুসিনেশন কাটে নি। তবে এ যদি হ্যালুসিনেশই হয় তবে আরও কিছুক্ষন এটাই দেখতে চায় ও। সেই গাঢ় বাদামী চোখ যা গত দুইদিন ধরে প্রতি রাতে তিন্নির স্বপ্নে আসে। সেই চওড়া কপাল, খাড়া নাক, আর, চিন্তার হালকা ছায়া মুখে…. ঠিক আগের বারের মতো। ভারী হয়ে আসা চোখটা আচ্ছন্ন হয়ে আবার বুজে আসতে আসতেই শক্ত হাতের আর একবার ঝাঁকুনি খেয়ে দু তিনবার চোখ পিটপিট করলো তিন্নি! স্লীপ প্যারালাইসিস? না স্বপ্ন দেখছে ও? যাহ্… স্বপ্ন কি এত রীয়্যাল হয় নাকি? ধড়ফড় করে উঠে বসতে গিয়েই মাথাটা আবার টলে গেল তিন্নির, আর সঙ্গে সঙ্গেই মেজর অভিমন্যু সেনের বলিষ্ঠ হাত শক্ত করে ধরে ফেললো ওকে, পড়ে যাওয়ার আগেই। সেই ভারী ব্যারিটোন, ঘন গলা বলে উঠলো
— “আস্তে। এখনো এতো তাড়া?”

হ্যালুসিনেশন নয় তবে? অনেক কষ্টে গলা দিয়ে আবছা আওয়াজ বেরোলো তিন্নির
— “আপনি? এখানে??”

— “যাক! চিনতে পেরেছেন তবে! কি অবস্থা করেছেন নিজের শরীরটার? বলেছিলাম ডাক্তার দেখান!”

তিন্নির খেয়াল হলো ও তখনও অভিমন্যুর কোলেই আধশোয়া হয়ে আছে! পরনের হলদে শিফন ড্রেসটা জলে ভেজা সপসপে। লজ্জায় অস্বস্তিতে তাড়াতাড়ি আবার উঠে বসার চেষ্টা করতেই অভিমন্যুর বাদামী চোখদুটোয় হালকা একটু বিরক্তি ফুটে মিলিয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে। ঝট করে নিজে দাঁড়িয়ে পড়ার সাথে সাথেই ওর বলিষ্ঠ হাতগুলো তিন্নিকেও টেনে দাঁড় করিয়ে দিল, অল্প ছোঁয়ায় কোমরের কাছে একটা হাত দিয়ে সাপোর্ট দিয়ে বললো
— “ঠিক আছেন এবার? দাঁড়াতে পারবেন তো?”

তিন্নির তখনও বিশ্বাস হচ্ছে না! এ যেন ডেজা ভ্যু! হবহু একই দৃশ্যের পটপরিবর্তন! এমনও কি হয়??বিষ্ময়ে, আকস্মিকতায় কথা খুঁজে পাচ্ছিল না তিন্নি, আবার জিজ্ঞেস করলো
—- “আপনি …এখানে??? কি করে??”

—- “বলছি পরে। আপাতত ….”, বলতে বলতে নিজের ইউনিফর্মের শার্টটা খুলে তিন্নির হাতে ধরিয়ে দিলো অভিমন্যু — “আপাতত আপনার ড্রেসটা চেন্জ করে এই শার্টটা পরে নিন, এই ঠান্ডার মধ্যে আবার জলেও ভিজে গেছেন পুরো। এরপর যে নিউমোনিয়া হয়ে যাবে!। আর, হ্যাঁ, আবার দরজা বন্ধ করতে যাবেন না যেন, আমি ঠিক বাইরেই আছি। শরীর খারাপ লাগলেই ডাকবেন।”

যন্ত্রের মতো অভিমন্যুর শার্টটা হাতে নিলো তিন্নি। কি ভেবে একটু থেমে তিন্নির হাঁ হয়ে থাকা মুখের দিকে তাকিয়ে অভিমন্যু আশ্বাস দিলো — “ভয় নেই, অন্য কেউ ঢুকবে না।”

লম্বা দৃঢ় পায়ে পাথরের অস্থায়ী টয়লেটটা থেকে বেরিয়ে গেল অভিমন্যু, তিন্নিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই।
.
.
.
থম মেরে যাওয়া মরচে রঙা সন্ধ্যের নরম পশমের মতো বৃষ্টি, বাইরে দুটো জংলা সবুজ রঙা মিলিটারি ট্রাক হেডলাইট জ্বেলে রয়েছে আর জনা বিশেক ইউনিফর্ম পরা সেনা ভিড় করে দাঁড়িয়ে, জোর আলোচনা চলছে ওদের মধ্যে। হি হি করে কাঁপতে কাঁপতে তিন্নি জড়োসড়ো হয়ে বেরিয়ে এলো অভিমন্যুর জংলা সবুজ-বাদামী মেশানো ইউনিফর্মের মোটা সুতির শার্টটা পরে। হাঁটুর একটু ওপরে শার্টটা শেষ হয়েছে, গমরঙা ফর্সা পা গুলো বেরিয়ে আছে। ওকে দেখেই সবার গুন্জন থেমে গেল। অভিমন্যু এগিয়ে এলো দ্রুতপায়ে, তিন্নি কিছু বোঝার আগেই নির্দ্বিধায় পাঁজাকোলা করে তুলে নিলো ওকে! নিয়ে কোলে করেই ওকে মিলিটারি ট্রাকটায় তুলে দিল অনায়সে। গা গুলিয়ে ওঠা গন্ধযুক্ত তেলচিটে মোটা কালো কম্বল ওর গায়ে ভালো করে জড়িয়ে দিয়ে ঠিক ওর মুখোমুখি বসে ধারালো স্বর বেজে উঠলো অভিমন্যুর
— “এবার বলুন, কি কান্ড করেছিলেন? এইরকম শুনশান জায়গায় একা একা গাড়ি থেকে নেমেছিলেন কেন? আর আপনি যাদের সাথে ঘুরতে এসেছিলেন তারাই বা কোথায়? কি রকম বন্ধু আপনার যে এরকম অচেনা পাহাড়ী রাস্তায় আপনাকে ফেলে চলে গেল?”

আগের দিনের অভিমন্যুর সাথে আজকের অভিমন্যুর কত তফাৎ! বকাটা একই আছে, কিন্তু স্বর আরো গম্ভীর, আরো কঠিন! মিলিটারি শাসনের কড়া ধমকে ধাতব জিপের ভেতরটা গমগম করছিল, তার সাথে অভিমন্যুর চোখের ওমন এফোঁড় ওফোঁড় করে দেওয়া দৃষ্টি! ঘটনার আকস্কিতায় আর এতোগুলো প্রশ্নের ভিড়ে মধ্যে তিন্নি ঠিক কি বলবে বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো অভিমন্যুর দিকে, শুধু টপটপ করে দুটো নিঃশব্দ জলের ফোঁটা নোংরা তেলচিটে কম্বলটার ওপর পড়লো।

তিন্নিকে হঠাৎ কাঁদতে দেখে অভিমন্যু অবাক হয়ে গেল। একটু নরম হয়ে বললো
— “কি অদ্ভুত! আপনি কাঁদছেন কেন? সবটা না বললে আপনাকে পৌঁছে দেব কি করে? হোটেলের নাম মনে আছে?”

ঘাড় নাড়লো তিন্নি, তারপর অস্ফুটে ঠোঁটদুটি নড়ে উঠলো ওর — “আমার না, খুব শীত করছে!”

একটু চিন্তিত হয়ে অভিমন্যু বললো — “জ্বর বাঁধালেন আবার কি! কম্বলটা জড়িয়ে নিন গায়ে!”

কম্বলের কথা বলতেই নিজের অজান্তেই নাক শিঁটকে উঠলো তিন্নির, দেখে অভিমন্যুর ভুরু কুঁচকে উঠলো, বিনা দ্বিধায় একটা হাত বাড়িয়ে তিন্নির কপালে হাত ছুঁইয়ে বললো — “নাহ্! জ্বর আসে নি তো! দেখি হাত দেখি?”

শুকনো বাঁশপাতার মত তিন্নির কাঁপতে থাকা হাতগুলো নিজের হাতের তালুতে ঘষে গরম করতে করতে অভিমন্যু বললো — “এবার বলুন দেখি, কি করে এমন কান্ড বাধালেন!”

একটু একটু করে তিন্নি বললো, সকাল থেকে ওর শ্বাসকষ্ট, গাড়ি থেকে নেমে ওর বমি করা, ঝুপড়ির টেম্পোরারি বাথরুমের চৌবাচ্চায় পা পিছলে পড়ে যাওয়া, বাইরে বেরিয়ে দেখা যে ওদের গাড়িদুটো ওকে ফেলেই চলে গেছে, দোকানের হেল্পারের ভাষা বুঝতে না পারা …. তারপরই সব অন্ধকার। আর কিছু মনে নেই তিন্নির!

সবটা শুনে অভিমন্যু বেশ কিছুক্ষন নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইলো তিন্নির দিকে তারপর মাথা নেড়ে স্বগতোক্তিই করলো বোধহয়— “বাহ্! সুন্দর!”

তিন্নি চট করে একবার তাকালো অভিমন্যুর দিকে! ওর দুর্দশায় কি মজা নিচ্ছে অভিমন্যু? সেটা লক্ষ্য করে অভিমন্যু নিজেকে সামলে নিলো — “পর পর দুইবার এভাবে সেন্সলেস হয়ে গেলেন যেখানে সেখানে! এমন শরীর নিয়ে বেড়াতে আসার দরকার কি?”

অভিমন্যুর কঠিন গলাটা একটু হলেও নরম হয়ে এলো কি? ঠিক ধরতে পারলো না তিন্নি! মৃদু স্বরে বললো

— “আগে তো হয় নি এমন! টানা দুই বছর পর…..” বলতে বলতেই হঠাৎ মনে পড়লো তিন্নির , কথার মোড় ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করলো — “আচ্ছা, আপনি কখন এলেন এখানে? আমি কি অনেকক্ষন ওভাবে পড়েছিলাম?”

উত্তর দিল না অভিমন্যু, শুধু ওর মুখের পেশীগুলো কঠিন হয়ে উঠলো। তারপর প্রশ্ন করলো
— “বেড়িয়ে যখন দেখলেন আপনাদের গাড়ি নেই, যাদের সাথে ঘুরতে এসেছিলেন, তাদের ফোন করলেন না কেন? গাড়ি ঘুরিয়ে আনলেই তো হতো।”

মুখ নিচু করে নিলো তিন্নি, ওর কান্ডজ্ঞানহীনতা শুনে আবার কি ওকে বকবে অভিমন্যু? আস্তে করে বললো — “আসলে……গাড়ি থেকে নামার সময় খেয়াল করি নি, আমার ফোনটা সায়কের কাছেই রয়ে গেছে।”

একটু হলেও কি অভিমন্যুর চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলো ? ভুরু উঠিয়ে জিজ্ঞেস করলো — “সায়ক কি আপনার…….বয়ফ্রেন্ড?“

তিন্নির হাত তখনও অভিমন্যুর মুঠিতে, কথাটা শুনেই যেন আঁতকে উঠলো তিন্নি — “না-আআ! ন্ না! আমার কোনো বয়ফ্রেন্ড নেই। সায়ক আমার বন্ধু, মানে কলীগ, মানে…..জাস্ট ফ্রেন্ড……. বাকিরা মুখচেনা বন্ধু….!”

তিন্নি নিজেও জানে না এতো এক্সপ্লানেশন কেন দিচ্ছে ও অভিমন্যুকে! এদিকে অভিমন্যুর চোখে কেমন যেন একটা বিদ্যুৎ খেলে গেল, শক্ত হয়ে উঠছিল তিন্নির হাত ধরে থাকা ওর মুঠোও। দাঁত চিপে নিঃশ্বাসের ফাঁক দিয়ে বিড়বিড় করে উঠলো “স্কাউন্ড্রেল”! তারপর তিন্নিকে প্রায় ধমকেই উঠলো — “ মুখচেনা বন্ধু? মুখচেনা বন্ধুদের সাথে আপনি ঘুরতে চলে এলেন সিকিম! কি দারুন ফ্রেন্ড আপনার! অসুস্থ একজনকে পাহাড়ী রাস্তায় ফেলে গাড়ি নিয়ে উধাও! কি করে জোটান এমন সব বন্ধু? আর এত অসুস্থ শরীরে আপনারই বা এমন দুর্গম জায়গায় বেড়াতে আসার কি এত শখ? যদি খারাপ কিছু হয়ে যেত? যদি…..”

একটু বেশিই উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন নাকি মেজর অভিমন্যু সেন? স্বল্প পরিচিত একজনের জন্য এত উৎকন্ঠা তো ওঁনাকে মানায় না! মুখের কথা শেষ না করেই চুপ করে গেল অভিমন্যু। যদিও তিন্নির বুঝতে অসুবিধা হয় নি অভিমন্যু ঠিক “কি” মিন করতে চাইছিলো। তিন্নি নিজেও কি জানে না সেটা? অভিমন্যুর কড়া পড়া শক্ত হাত থেকে জোর করে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে মুখ নীচু করে বসে রইলো তিন্নি। চোখে জল টলটল করছে! একবার তাকিয়ে গম্ভীর গলায় অল্প সমবেদনা মিশিয়ে অভিমন্যু বললো — “বাদ দিন! হোটেলের নাম বলুন! দেখি আপনাকে পৌঁছে দিতে পারি কিনা।”

তিন্নির থেকে হোটেলের নাম ঠিকানা নিয়ে ভ্যান থেকে নেমে গেল অভিমন্যু। পরণের জামাটা থেকে অদ্ভুত একটা গন্ধ আসছে, অভিমন্যুর পুরুষালী গন্ধ তার সাথে মিশে সারাদিনের ধুলোবালি আর ঘাম। কোলের ওপর রাখা তেলচিটে কম্বলটা একপাশে সরিয়ে দিয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে রইল তিন্নি।মাথা কাজ করছে না ওর, কি থেকে কি হয়ে গেল। পিয়াসাকে তো ও বলেই নেমেছিল…. তারপরও সায়করা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল? জলজ্যান্ত একটা মানুষ মিসিং, কেউ খেয়ালও করলো না?

****************************__***************************

মিনিট তিরিশেক পর আবার ভ্যানে উঠে এলো অভিমন্যু। আগের সেই গম্ভীর কঠিন ভাবটা আর নেই। একটু ইতস্তত করে বললো — “ইয়ে… একটা প্রবলেম হয়েছে। মানে…… আমরা ঠিক আপনাকে আজ রাতে পৌঁছে দিতে পারবো না।”

—- “মা-আ-নে???????????”
উত্তেজনায় ধাঁ করে উঠে দাঁড়াতে গেল তিন্নি আর দুম করে ভ্যানের ছাদে মাথা ঠুকে গেল। হাত বাড়িয়ে আবার তিন্নিকে ধরে ফেলে অভিমন্যু বিরক্ত গলায় বললো — “আস্তে! সবেতেই এত তাড়াহুড়ো করেন কেন আপনি?”

সেদিকে তখন খেয়াল নেই তিন্নির, হততম্বের মতো বললো
— “পৌঁছে দিতে পারবেন না মানে? এত রাতে, বৃষ্টির মধ্যে তবে কোথায় যাবো আমি?”

— “পাহাড়ের ধস পড়ে রাস্তা বন্ধ হয়ে গেলে আর্মির তো কিছু করার নেই ম্যাডাম। সকাল না হওয়া অবধি রাস্তা খুলবে না।”

— “কিন্তু… আমাকে যে আজই ফিরতে হবে। প্লিজ , কিছু একটা করুন! কাল আমাদের ফেরার টিকিট কাটা আছে, পরশু অফিস! মা মেরে ফেলবে আমাকে বাড়ি না ফিরলে! একটু দেখুন না প্লিজ!”

তিন্নি এমন অবুঝ ভাবে বললো না হেসে পারলো না অভিমন্যু।
— “আজ রাতে তো আপনাকে পৌঁছে দেওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। দুটো উপায় আছে – এক, এই পাথুরে ঠান্ডা ঝোপরিতে বসে আপনি সকাল হওয়ার অপেক্ষা করতে পারেন নয়ত আমাদের ক্যাম্পে আপনাকে যেতে হবে, কাল সকালে আমি নিজে দায়িত্ব নিয়ে আপনাকে পৌঁছে দেব! কি করবেন এবার বলুন?”

হাঁ করে চেয়ে রইলো তিন্নি! কি বলবে কিছু বুঝতে পারলো না। অভিমন্যু কিছুক্ষন ওর দিকে তাকিয় তারপর নরম গলায় বললো — “সিকিউরিটি নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না। আর্মি নিয়ে সিভিলিয়ানরা অনেক খারাপ ভাবলেও আমরা কিন্তু অতটাও খারাপ নই! আমাদের ঘরেও মা বোন আছে। আর আমার ওপর ভরসা করতে পারেন। কথা দিচ্ছি, আপনার সম্মানের কোনো ক্ষতি হতে দেবো না।”

চুপ করে বসে রইলো তিন্নি। কোনো উত্তর না পেয়ে অভিমন্যু বললো — “তবে কি এই ঝুপরিতে থাকবেন? সকাল হলে আপনার খবর নিয়ে যাবো?”

এই পরিস্থিতিতেও কেউ কি ইয়ার্কি মারতে পারে? দুইদিন আগের চিড়বিড়ানি রাগটা ফিরে এলো তিন্নির। কটমট করে অভিমন্যুর দিকে তাকাতেই হালকা হেসে ভ্যান থেকে নেমে গেল অভিমন্যু।

বেশ কিছুক্ষন পর মিলিটারি ট্রাক দুটো আবার নিউট্রাল থেকে স্টার্ট নিলো, একে একে সব সেনারা ট্রাকে উঠতে শুরু করলে অভিমন্যু তড়াক করে এক লাফে উঠে পড়লো গাড়িতে, এসে বসলো তিন্নির ঠিক পাশটায়। এই ঠান্ডাতেও ওর গায়ে একটা পাতলা গেঞ্জি, ইউনিফর্মের শার্টটা তো তিন্নির পরনে। তেলচিটে নোংরা কম্বলটা আবারও তিন্নির গায়ের ওপর চাপা দিয়ে দিলো।

উফফ! আচ্ছা জ্বালা তো! গা কুটকুট করছে তার ওপর কি বিচ্ছিরি বোঁটকা গন্ধ রে বাবা! উৎকট গন্ধে অস্থির হয়ে কম্বলটা মাটিতে ফেলে দেওয়ার আগেই খপ করে তিন্নির হাতটা ধরে ফেললো অভিমন্যু ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে অলমোস্ট ফিসফিস করে বললো — “ম্যাডাম, এটা গায়ে জড়িয়ে নিন, শার্টটা আপনার হাঁটুর অনেক ওপরে উঠে আছে, সবাই দেখছে!”

ইলেকট্রিক শক খাওয়ার চমকে উঠলো তিন্নি! কি পড়ে আছে এতক্ষন, নিজের দিকে কোন খেয়ালই ছিল না ওর। আধো আলো আঁধারি গাড়ির মধ্যে বাকি দশজোড়া চোখ ড্যাবড্যাব করে ওর পায়ের দিকেই তাকিয়ে ছিল এতক্ষন? আঁটিশুটি করে কম্বলটা সারা গায়ে ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে জ্বরকাতুরে ভালুকের মতো বসে রইলো তিন্নি।লজ্জায় কান মাথা গরম হয়ে গেছে ওর, এই নিয়ে দ্বিতীয়বার দেখা হল এর সাথে আর দুইবারই এমন পরিস্থিতি! নির্ঘাত লোকটা ভাবছে তিন্নি একটা নির্লজ্জ বেহায়া মেয়ে। নিরুত্তাপ ভাবে অভিমন্যু বসে রইলো তিন্নির পাশে, যেন কিছুই হয় নি! ঘুটঘুটে কালো টুটাফুটা পাহাড়ী রাস্তায় ঝিরঝির বৃষ্টির মধ্যে জংলা সবুজ মিলিটারি ট্রাকদুটো দুলতে দুলতে এগিয়ে চললো অন্ধকারের বুক চিরে।
.
.
.
.

ক্রমশঃ(এরপর পরশু।❤️)
আজ আশা করি আর কেউ বলবেন না ছোটো দিয়েছি!
© সুমন্দ্রা মিত্র। ভালো লাগলে নামসহ শেয়ার করবেন।

বিঃদ্র – আপনাদের যারা এখনো “মন, তোমাকে ছুঁয়ে দিলাম -Mon tomake chhunye dilam – লেখনী সুমন্দ্রা মিত্র ” পেজটি ফলো করেননি, তাদের সকলকে একান্ত বিনীত অনুরোধ মেনপেজটি লাইক ও ফলো করুনএবং পাশে গিয়ে SEE FIRST অপশনে ক্লিক করে রাখুন, পেজে পোস্ট হওয়ার সাথে সাথেই নোটিফিকেশন পেয়ে যাবেন। এছাড়াও Facebook Story তে চোখ রাখতে পারেন, মেনপেজে কিছু পোস্ট হলে এই পেজের storyতেও লিঙ্ক দেওয়া থাকে। আপনাদের বন্ধু ও পরিবারবর্গদেরও Invite করুন মেনপেজটি লাইক ও ফলো করতে। লিংক 👇
https://www.facebook.com/মন-তোমাকে-ছুঁয়ে-দিলাম-লেখনী-সুমন্দ্রা-মিত্র-110448980674312/
***********************__******************************

সকল পর্বের লিঙ্ক~
Video Teaser
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/145475543838322/?vh=e&d=n
Part 1
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/145129087206301/?d=n
Part 2
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/145859077133302/?d=n
Part 3
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/146221053763771/?d=n
Part 4
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/146595433726333/?d=n
Part 5
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/147293876989822/?d=n
Part 6
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/148075966911613/?d=n
Part 7
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/148530310199512/?d=n
Part 8
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/148951006824109/?d=n
Part 9
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/149405760111967/?d=n
Part 10
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/150313546687855/?d=n
Part 11
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/151106323275244/?d=n
art 12
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/151923336526876/?d=n
Part 13
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/152353663150510/?d=n
Part 14
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/154065792979297/?d=n
Part 15
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/156163186102891/?d=n
Part 16
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/157132182672658/?extid=QdVQFGSjLzQUsE31&d=n
Part 17
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/157444422641434/?extid=fI3jIc0PCiYXDa0N&d=n
Part 18
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/158095955909614/?extid=1E2JOZfMCmqscBoi&d=n
Part 19
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/158831902502686/?extid=R8zo6L2l274CIQ7r&d=n
Part 20
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/159626782423198/?extid=0e8jrLLhsuLqgsQX&d=n
Part 21
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/160047349047808/?extid=e9DIdFXAkqxTg77U&d=n
Part 22
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/160963752289501/?extid=EgYDh0z3hVr5TCBY&d=n
Part 23
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/161833698869173/?extid=gRK0HHMoLW0bu0gK&d=n
Part 24
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/162740122111864/?extid=KIR9o3zetBHgH9mt&d=n
Part 25
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/163061178746425/?extid=fhzBxEjnlA7n6Ulu&d=n
Part 26
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/163695728682970/?extid=tm0Y81ykORQhpsq9&d=n
Part 27
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/164305438621999/?extid=WsYE2BjXkYvPmqyF&d=n

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here