সূর্য ডোবার আগে পর্ব-১৯

0
1889

#সূর্য_ডোবার_আগে
পর্ব-১৯
লেখিকা ~ #সুমন্দ্রামিত্র
কঠোরভাবে প্রাপ্তমনষ্কদের জন্য।
.
.
.

মাস পেরিয়ে গেছে তিন্নি ফিরেছে সিকিম থেকে, এই একমাসেই তিন্নির মধ্যে আমূল পরিবর্তন এসেছে। মাসকয়েক আগেও অফিসশেষে বাড়ি ফিরে তিন্নির একমাত্র আশ্রয় ছিল কবিতার বই, আর বাবার সান্নিধ্য। কবিতা ওর অন্তর ভরিয়ে রাখতো, সব ক্ষোভ ভুলিয়ে দিতো। অনেকসময় বইও লাগে না, বহু কবিতা ওর ঠোঁটস্থ। স্মৃতি থেকে গড়গড় করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবনানন্দ দাশের কবিতা বলে যেতে পারতো তিন্নি। যত ক্লান্তিই হোক না কেন, অফিস শেষে বাড়ি ফিরে বাবার সাথে দু-দণ্ড বসে গল্প না করলে তিন্নির মন আনচান করতো। কাজের নির্দিষ্ট সময়ের বাইরে যে মেয়ে সহকর্মীদের ফোনটুকুও ধরতো না, মেসেন্জার বা হোয়াটসআ্যপে চ্যাট তো দুরের কথা! সেই মেয়ের এখন সর্বক্ষণের সঙ্গী ওর মোবাইল ফোনটা, যেন প্রাণভোমরা হাতে নিয়ে বসে থাকে, এই বুঝি বেজে উঠলো আরএকবার।

রঞ্জনবাবু মাঝে মাঝে মেয়েকে দুঃখ করে বলেন — “তুই তো এমন ছিলিস না রে, মা! কাজের জায়গায় সারাদিন কম্পিউটারে ঘাঁটাঘাঁটি, বাড়িতে এসেও ফোন নিয়ে পড়ে আছিস! চোখে যে এবার ছানি পড়ে যাবে! মোবাইল থেকে কিসব রেডিওআ্যাক্টিভ রে’জ বেরোয় সেগুলো শরীরের পক্ষে কত ক্ষতিকর জানিস?”

তিন্নি হাসে, আর হেসে এড়িয়ে যায়। কাকে বোঝাবে ও, অদৃশ্য একটা ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক রে শ্রীরামপুর আর সিকিমকে এমনিতেই এক তারে বেঁধে রেখেছে! হাতের এই মুঠিফোনটাই যে অভিমন্যুর অস্তিত্ব ওর কাছে! তিন্নি ছাড়া পরিচিত আর দ্বিতীয় কোনো প্রাণ আজ অবধি অভিমন্যুকে দেখেনি, আর সবার কাছে অভিমন্যু এক ছায়ামানব, যেন গল্পকথা! কিন্তু তিন্নির কাছে অভিমন্যু যে ওর সব, ওর জীবন। অভিমন্যুর মনের আয়নায় চোখ রেখে তিন্নি খুঁজে পেয়েছে ওর হারিয়ে যাওয়া আত্মবিশ্বাস। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে বাড়িতে দেখে এসেছে রোজ রোজ ছোটোখাটো বিভিন্ন বিষয়ে মা -বাবার অশান্তি, ছোট ভাই শুভর প্রতি মায়ের অন্ধ ভালোবাসা। খুব ছোট বয়সেই তিন্নি বুঝে গিয়েছিলো, মেয়ে হওয়ার দরুন মায়ের কাছে ও বড়োই উপেক্ষিতা। যতই তিন্নি লেখাপড়ায় দুর্দান্ত হোক না কেন, মায়ের চোখে নিজের জন্য একটা দিন প্রশংসার দৃষ্টি দেখে নি, তাই চেষ্টা করে গেছে অনবরত, কি’করে আরো “পারফেক্ট” হয়ে যায়! এই “পারফেকশন”-এর পেছনে দৌড়োতে দৌড়োতে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলো তিন্নি। ভুলে গিয়েছিলো সবাইকে হয়তো সন্তুষ্ট করা যায় না, এ পৃথিবীতে মাঝে মাঝে নিজের ইচ্ছেতে বাঁচাটাও খুব জরুরি! প্রেম-ভালোবাসা-স্নেহ-সুন্দরতা-আত্মবিশ্বাস আজও এসব শব্দের অস্তিত্ব আছে এ পৃথিবীতে, নিজের মতো বাঁচার অধিকার আছে। আর নিজের সেই হারিয়ে যাওয়া অস্তিত্বটাই তো আবার করে খুঁজে পেয়েছে অভিমন্যুর চোখে। অভিমন্যু ওর বিশ্বাস, ওর সবচেয়ে বড়ো শক্তি। ভৌগোলিক দূরত্ব যতই হোক না কেন, তিন্নির মনে হয় অভিমন্যু যেন প্রতিমুহূর্ত ওর পাশে আছে, সাথে আছে। ডেস্টিনি হোক বা ভাগ্যের ইশারা, অভিমন্যুর সাথে তিন্নির নামহীন সম্পর্কের সমীকরণ মিলে গিয়েছে ঐকিক নিয়মের সহজ সরল অঙ্কের মতো‌, শুধু মুখ ফুটে এ সম্পর্কের কোনো “নাম” দেয় নি ওরা।

হ্যাঁ!

বিগত একমাস ধরে নিয়মিত ফোনে কথা বলেছে, তবুও অভিমন্যুর সাথে ওর ঠিক কি ”সম্পর্ক”, আজও স্পষ্ট করে নি ওরা, মুখ ফুটে আজও একে অপরকে বলে নি “ভালোবাসি”। তিন্নি জানে, অভিমন্যুকে ও ভালোবেসেছে সেই প্রথম দেখার দিনটি থেকে। সবাই বলেছিলো বটে “ইনফ্যাচুয়েসন”, নিদেনপক্ষে ভালো “লাগা” তবে “ভালোবাসা” নয়। শুধু তিন্নি জানে ওর মনের অন্তরে কি চলেছিল সেই রাতে, বর্ধমান স্টেশনে অভিমন্যু ওকে ট্রেনে তুলে দেওয়ার পর থেকে। দশজনের হাসিঠাট্টার ভিড়েও তিন্নি ছিল একা, সবার সাথে কথা বলছিলো ও, হাসছিলোও কিন্তু মন পড়ে ছিল সেই পুরুষটির কাছে …

– কেন? তার কোনো জবার হয় না। সে কি আর্মি নিয়ে ওর মনের ফ্যান্টাসি? নাকি অভিমন্যুর সুঠাম চেহারা? নাকি ওর গলার স্বর? ওর ভদ্রতা? তিন্নির প্রাণ বাঁচানো? হয়তো …, হয়-তো,অভিমন্যুর সমস্তটুকু নিয়েই সেদিন মন দিয়ে ফেলেছিলো তিন্নি, কিছু ফিরে পাওয়ার প্রত্যাশামাত্র না রেখে! ও তো জানতোও না আবারও কোনোদিন দেখা হতে পারে! সাত বিলিয়ন মানুষ এই পৃথিবীতে, একজনকে খুঁজে পাওয়া কি এতোই সহজ? তাও ঈশ্বরের কাছে তিন্নি প্রার্থনা করে গেছে সেই অজানা অচেনা মানুষটির জন্য – যাতে সে ভালো থাকে, সুস্থ থাকে, সুখী থাকে! সেই প্রার্থনাপূরণ হলো, আটচল্লিশ ঘন্টার মধ্যেই ডেস্টিনি আ-বা-র-ও মিলিয়ে দিলো ওদের। আবারও অভিমন্যু ওর প্রাণ বাঁচালো, সম্ভ্রম বাঁচালো, তারপর আরো একবার। বারবার তিনবার! এরপরও ভাগ্যকে কি করে তুচ্ছ “কো-ইন্সিডেন্স” বলে অস্বীকার করবে তিন্নি?

নিজের অন্তরের ভাব তিন্নি অনেকদিন ধরেই বুঝতে পেরেছে, ওর দিক থেকে কোনো সংশয় নেই। কিন্তু অভিমন্যুর মনের ভেতরে কি চলছে তা নিয়ে তিন্নির কো-নো ধারণা নেই! অভিমন্যুর মন যেন পারদের মতো, অথবা মহাকাশের অনেক দুরের একটা নিঃসঙ্গ নক্ষত্র। ধরেও ধরা যায় না! কখনো খুব কাছে চলে এসে দাবানলের মতো পুড়িয়ে ছারখার করে দেয় তিন্নির জীবন আবার কখনো বা বরফশীতল, নির্লিপ্ত, কঠোর প্রত্যাখান। আনপ্রেডিক্টেবল। মাঝে মাঝে তিন্নির বুকের টুকরো আশাগুলো মনখারাপের কালো মেঘের ভেতর থেকে উঁকি মেরে শুধোয়, শুধুই কি একতরফা প্রেম? অভিমন্যুও কি তিন্নিকে ভালোবাসে নি? সিকিমের সেই প্রত্যন্ত্য আর্মিক্যাম্পে চোখের ভাষা পড়তে সত্যিই কি ভুল হয়েছিল তিন্নির? আর যদি কোনো অনুভূতিই না জন্মায়, তবে অভিমন্যুই বা কেন ফোন করে প্রতিরাতে? এমনি এমনিই? ছিটকে আসা অনুভূতিগুলো তড়িঘড়ি চাপা দিয়ে দেয় তিন্নি, মনে পড়ে যায় মাসদেড়েক আগে সেই বর্ষাভেজা দিনটার কথা, তিন্নিকে গ্যাংটকের হোটেলে পৌঁছে দেওয়ার সুদীর্ঘ জীপ ড্রাইভ আর কাঁটার চাবুক লাগানো অভিমন্যুর প্রত্যাখ্যানের তীব্র কষাঘাত। আজও চোখে জল চলে আসে, আজও টনটনিয়ে ওঠে বুক। রক্তাক্ত হৃদয় তখন সান্তনা খোঁজে প্রতিরাতের কললগের কাছে। যেটুকু পেয়েছে তিন্নি সেটুকু নিয়েই খুশি, শুরুতেই যে ও বলেছিল এ সম্পর্কের কোন দাবী নেই!

হয়তো এমনি এমনিই ফোন করে অভিমন্যু। অথবা, হয়তো ওরা দুজনেই মনে মনে সবটা জানে কিন্তু “কে বা আগে প্রাণ করিবেক দান”, দুজনের কেউই অন্যের কাছে “আগে”ধরা দিতে রাজী নয়, সেটা ইগো না অন্যকিছু, তা জানে শুধু ওরা। একবিংশ শতাব্দীর ভাষায় এ সম্পর্কের নাম “ইটস্ কমপ্লিকেটেড”, আর বুদ্ধিমান বা সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের কাছে অবিশ্বাস্য প্রলাপ।

তাই তিন্নি কারো কথার কোনো জবাব দেয় না, শুধু হাসে! শব্দহীন যে হাসি দেখলে গা শিরশিরিয়ে ওঠে, মনে হয় যেন এ জগতেই নেই তিন্নি। কে কি বলছে তাতেও যেন কিছু যায় আসে না ওর। সদা নির্লিপ্ত মন, কর্ত্যব্য করছে, শুধু ওর আত্মাটা এখানে নেই।

**************************__****************************

দিনকয়েক ধরে তিন্নির গতিবিধি ভালো ঠেকছে না ভাস্বতীদেবীর। আজ সকালে তিন্নি অফিস বেরোনোর আগে খাবার বেড়ে দিয়ে মেয়েকে একদৃষ্টিতে দেখে যাচ্ছিলেন। মুখচোরা চাপা স্বভাবের তিন্নি সেই ছোটবেলা থেকে! নিচু গলায় কথা বলা, বিনা প্রতিবাদে মুখ বুজে সকলকিছু মেনে নেওয়া – এভাবেই মেয়েকে মানুষ করেছেন তিনি। সেই মেয়ে আজকাল কেমন যেন বদলে যাচ্ছে চোখের সামনে, নরম মাধবীলতা থেকে ঋজু বেতের মতো খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, যে স্বরে আগে ভয় আর অসহায়তা মিশে থাকতো এখন সেখানে কেবলি উদাস নির্লিপ্ততা। সত্যি বলতে, মেয়ের সাথে ওঁনার কথা হয় দিনে দুবার -সকালে আর রাতে খেতে দেওয়ার আগে। প্রতিদিন ১২-১৪ ঘন্টার ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করে ফেরে তিন্নি, আগে বাড়ি ফিরেই রঞ্জন বাবুর ঘরে ঢুকে যেত, এখন নিজের ঘরে ঢুকে যায় চুপচাপ। নিয়মমাফিক টিভি সিরিয়ালের কোটা শেষ হলে আর শুভ বাড়ি ঢুকলে ভাস্বতীদেবী যখন সবাইকে রাতের খাবার খেতে দেন, তখনও খাবার টেবিলে বাপবেটিই টুকটাক যা কথা বলে, শুভ নিজের মতো খেয়ে উঠে যায়। কিন্তু ওই অবসরেই ভাস্বতীদেবী খেয়াল করেছেন, খেতে খেতেও তিন্নি মাঝে মাঝে কেমন যেন আপন মনেই হাসে, আবার পারিপার্শিক পরিবেশ সম্বন্ধে সচেতন হয়ে জলদিই সে হাসি মুছে ফেলে। কাল বেশ রাতের দিকে বাথরুম যাওয়ার সময় উঠেছিলেন ভাস্বতীদেবী, মনে হলো তিন্নি যেন হেসে হেসে কারো সাথে ফোনালাপ করছে! অত রাতে নিশ্চয়ই অফিসের ফোন আসবে না! নির্ঘাত প্রেম করছে তিন্নি, মনে মনে ভাবলেন ভাস্বতীদেবী। কিন্তু কার সাথে? মাসখানেক আগে অফিসের যাদের সাথে বেড়াতে গেলো তাদের মধ্যেই কেউ কি? কি যেন নাম ছেলেটার সায়ক? না সায়ন? শুধুই ফোনালাপ নাকি আরো অনেকদুর এগিয়েছে? আর ভাবতে পারলেন না, খরদৃষ্টিতে মেয়েকে জরিপ করতে করতে আজ জিজ্ঞেস করেই ফেললেন — “তুই কি কারো সাথে প্রেম করছিস?”

ঘড়িতে ৬:৪৭, আর তিন মিনিটে খাওয়া শেষ করে রাতনকাকুর রিক্সায় না উঠতে পারলে ৭:০৪র লোকালটা মিস হয়ে যাবে। ভাতের সাথে ডাল,আলুসেদ্ধ, কাঁটাবাছা মাছ – সমস্ত কিছু মিশিয়ে একটা ঘ্যাঁট বানিয়ে মুখে তুলতে গিয়েছিলো তিন্নি, সকাল সকাল ভাস্বতীদেবীর আচমকা এমন প্রশ্নে বিষম খেয়ে, জলের গ্লাস উল্টে চারিদিকে ভাত ছিটিয়ে একাকার কান্ড! আওয়াজ পেয়ে বারান্দা থেকে রঞ্জনবাবু চেঁচিয়ে উঠলেন – “আস্তে খা! এতো তাড়া কিসের তোর?”

রঞ্জনবাবুর কথাটা কেমন অভিমন্যুর বলা কথার সাথে মিলে গেলো না? সবে একটু নিজেকে সামলেছিলো তিন্নি, আবার কাশতে শুরু করে দিলো। কাশির দমকে চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে গেছে ওর। একদৃষ্টিতে মেয়েকে দেখে চললেন ভাস্বতীদেবী। ব্যাপারটা কেমনযেন সুবিধের ঠেকছে না। কাশি থামলে এক গ্লাস জল এগিয়ে দিলেন – “কি রে? উত্তর দিলি না?”

কি জবাব দেবে তিন্নি? ও তো নিজেও জানে না, অভিমন্যুর সাথে ওর সম্পর্কটা “ঠিক কি”? যারা নিজেরাই মুখ ফুটে একে অপরকে এখনো “আই লাভ ইউ” অবধি বলে নি, সেটা কি আদৌ প্রেমজ সম্পর্ক? “বন্ধুত্বের” থেকে কিছু বেশি, প্রেমের থেকে কিছু কম – তিন্নি যে সম্পর্কের ত্রিশঙ্কুতে আটকে! মা’কে কি সেসব বলা যায় ?
— দেরি হয়ে গেছে অনেক, আর দেরি করলে ট্রেন মিস করবো। আসছি।

খাওয়া শেষ না করেই উঠে পড়লো তিন্নি। মেয়ের টিফিনটা হাতে ধরিয়ে দিলেন ভাস্বতীদেবী, হাতে টিফিনকৌটোটা নিয়ে অনেকদিন পর মায়ের দিকে তাকিয়ে আলতো হাসলো তিন্নি, সেদিকে তাকিয়ে বুকটা কেঁপে উঠলো ওঁনার। তিন্নি যদি বিয়ে করে চলে যায় তবে এ সংসারের কি হবে? তারপরই গভীর অপরাধবোধে আচ্ছন্ন হয়ে গেলেন ভাস্বতীদেবী। মা হয়েও দিনদিন বড্ডো স্বার্থপর হয়ে যাচ্ছেন!

নাহ। মেয়েকে বিশ্বাস নেই! তিন্নির যা নরম মন, উনি নিশ্চিত, বেড়াতে গিয়েই কাকে না কাকে হৃদয় দিয়ে ফেলেছে! ব্যাপারটা বেশিদূর এগোনোর আগেই রঞ্জনবাবুর সাথে কথা বলতে হবে এ নিয়ে, নয়তো তিন্নি হাতের মুঠোর বাইরে বেরিয়ে যাবে। অন্যান্যদিনের মতো বাবাকে বাই করে তিন্নি বেরিয়ে গেলে ভাস্বতীদেবী পায়ে পায়ে বারান্দায় এলেন, রঞ্জনবাবুর পাশে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে নীচু গলায় বললেন — “মেয়ে বড় হয়ে গেল, ওর বিয়ের ব্যাপারে কি ভাবলে?”

**************************__****************************

— দাদাভাই!!! কেমন আছিস? উফফ্! কতদিন পর দেখলাম তোকে!

—- খুব ভালো বোনু! তোর প্র্যাকটিস কেমন চলছে?

ভিডিওকলে মিষ্টি করে হাসলো পিহু। নেটওয়ার্কের অনেক প্রবলেম, তাই সপ্তাহে মাত্র একটাদিন ওরা ভিডিওকলে কথা বলে মিনিটকয়েকের জন্য, কখনো বা তা’ও না। বাকি দিনগুলোয় অডিওকলই ভরসা। এইবার দাদাভাই ডিউটিতে ফিরে গিয়েও গোমড়ামুখো কেজো গলায় কথা বলে না,ফোনে হরবখত হাসছে, আনন্দে কথা বলছে, পিহুর খুব ভালো লাগে দাদাভাইয়ের এই হাসিমাখা গলাটা শুনতে।

প্র্যাকটিসের কথা উঠতেই খুশি আর উত্তেজনায় প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো পিহু। — “জানিস দাদাভাই, পরপর পাঁচটা উড়ন্ত টার্গেটকে আজ শুট করে নামিয়েছি, একটাও মিস হয় নি।“

— আরিব্বাস বোনু! তুই তো একমাসেই আমার থেকে ভালো পিস্তল চালাতে শিখে গেলি রে!

একটু লজ্জা লজ্জা গলায় বাকিটা বললো – “দাদাভাই! ফিরে যাওয়ার আগে আগে তুই যে ফিটনেস ট্রেনারকে ঠিক করে দিয়ে গেলি – বিকাশদা? ও বলছিলো, এভাবেই প্র্যাক্টিস করতে থাকলে আর বছরদুই পর প্যারাঅলিম্পিকে আমার নাম দিয়ে দেবে। মেডেল না পাই, অন্তত পার্টিসিপেট তো করতে পারবো! কি বলিস দাদাভাই?”

অভিমন্যুর চোখদুটো এবার সত্যিকারের খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। ওর ছোট্ট পিহু কবে এতো বড়ো হয়ে গেলো যে অলিম্পিকে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে? এইটাই তো চাইতো অভিমন্যু যে, পিহুর নিজের একটা পরিচয় হোক, নিজের একটা আইডেন্টিটি বানাক। রেজাল্ট কি হবে তার ভাবনা নেই, সেলাইয়ের ছুঁচসুতো ছেড়ে পিহু যে দেশের জন্য মেডেল আনার স্বপ্ন দেখছে এইটাই তো অনেক। খুশিতে আর আবেগে গলা বুজে আসছিস অভিমন্যুর, কোনোরকমে বললো — “তুই ঠিক পারবি বোনু, ডিসেম্বরে ফিরে গিয়ে আমি আরো ভালো ট্রেনিং দেব তোকে, দেশের টপ ক্লাবে তোকে ভর্তি করবো। তুই শুধু নিজের ডায়েটটা ঠিক রাখ আর আপারবডি মুভমেন্ট আরো স্ট্রং কর। অনেক প্রোটিন খেতে হবে এখন, তুই কিন্তু আন্ডারওয়েট, পিহু।”

অভিমন্যুর পুরো কথাটা শেষ হওয়ার আগেই পিহুর জ্বলে ওঠা খুশি খুশি মুখটা একটু নিভে গেলো বোধহয়। একটু হাসি আর অনেকটা বিষাদ মাখানো গলায় বললো — “কিন্তু দাদাভাই, টপ ক্লাবগুলোকে তো আমার মতো প্রতিবন্ধীদের নেবে না রে।”

চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলো অভিমন্যুর। মুখের পেশী একটুও কাঁপলো না, মেজর অভিমন্যু সেনের বজ্রদৃঢ় কণ্ঠস্বর ভেসে এলো — “বোনু, তুই শুধু তোর প্র্যাক্টিস ১০০% দে, বাকিটা আমি দেখে নেবো। আ্যডমিশন না নিলে ছুটিতে বাড়ি এসে আমি নিজের হাতে তোকে তৈরী করবো।”

পিহু যেন শরতের মেঘ, এই কাঁদে তো এই হাসে! পলকে উচ্ছল হয়ে উঠলো ও – “সত্যি বলছিস তো দাদাভাই? ইউ আর দ্য বেস্ট। জানিস আমি দিন গুনছিলাম, আর মাত্র পাঁচমাস উনিশ দিন বাকি তোর বাড়ি আসতে।কত কিছু প্ল্যান করে রেখেছি রে দাদাভাই। সিনেমা দেখতে যাবো, ফুচকা খেতে যাবো, এই কাছেই দুটো নতুন শপিং মল খুলেছে, নিয়ে যাবি তো দাদাভাই? আর… আর…..“

পিহু আরো অনেককিছু বলে যেত, ওকে থামিয়ে দিয়ে হেসে ফেললো অভিমন্যু। তারপর বললো – “এইবার বাড়ি এসে তোর জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।“

পিহু তো আনন্দে প্রায় লাফিয়ে ওঠে আর কি! —“কি সারপ্রাইজ দাদাভাই? এখুনি বল?”

— এখন বললে কি আর “সারপ্রাইজ” থাকবে রে বোকা? বাড়ি ফিরি তারপর তোকে দেখাবো।

— ভালো সারপ্রাইজ তো দাদাভাই? ইশশ! কি মজা ! আমার আর তর’ই সইছে না!

এক পলকের জন্য চোখ বন্ধ করে নিলেন মেজর অভিমন্যু সেন, একমাস আগের বর্ষণমুখর সন্ধ্যায় সিকিমের প্রত্যন্ত আর্মি ক্যাম্পে হ্যাজাকের নরম হলুদ আলোতে ইলেকট্রনিক বইয়ের পাতায় বুঁদ হয়ে থাকা এলোচুল ছড়ানো তিন্নির মুখটা ভেসে উঠলো ওঁনার চোখের সামনে। আস্তে করে বললেন

–“ভালো, খুব ভালো।“

**************************__****************************

প্রথম দিনের ফোনটা ছিল গুনে গুনে দুই মিনিট তিপান্ন সেকেন্ডের। দ্বিতীয় দিনে মিনিট দশেক। প্রতিদিন ফোনে কথা বলার সময় বাড়ছে, তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে তিন্নির মনে অভিমন্যুর জন্য নিঃশব্দ ভালোবাসা। তিন্নি বলে যায়, অভিমন্যু শোনে। মাসকয়েক আগেও মনখুলে যে মেয়েটা একটা কথাও বলতো না, চব্বিশ বছর বয়সী যে মেয়েটার একটাও বন্ধু ছিল না, সেই তিন্নির মনে এতো কথা জমে ছিল, ও কি নিজেও জানতো? যেন কোনো এক ঝর্ণার মুখ দীর্ঘকাল পাথর চাপা ছিল, আজ সেই ঢাকা সরে গিয়ে কলকল প্রবাহে তিরতির করে বয়ে চলেছে। চিরকাল মুখচাপা, সাত চড়ে “রা” না করা তিন্নির সকল কথা, সকল মান-অভিমান, স্কুল কলেজের প্রতিটি ছোটোখাটো কথাও যে কেউ এতো মনোযোগ দিয়ে শুনতে পারে, ওর ধারণা ছিল না। তুমি-আপনি মিশিয়ে এক অদ্ভুত সম্বোধনে কথা বলে ওরা, মাঝে মাঝে তিন্নি বলে যায় একের পর এক কবিতা, নীরব মুগ্ধতায় অভিমন্যু শুনতে থাকে আবার কখনো কখনো ওরা একটাও কথা বলে না, নিশ্চুপ থেকে শুধু একে অপরের ঘন নিঃশ্বাসের শব্দ শোনে। শুধুমাত্র গলার আওয়াজ শুনে একে অপরের মুড্ বুঝে যায় ওরা, সারাদিনের সকল ক্লান্তি, সকল খারাপলাগা, সব নেগেটিভিটি দূর হয়ে যায় ওই মিনিট দশেকের ফোনকলে। আজকাল তিন্নির মনে হয়, দিনের বেলা ও যেন কেমন ঘোরের মধ্যে চলে। সারাটা দিন রাতের অপেক্ষা করে। ট্রেনে,বাসে, অটোয় ভুল করে কারো ছোঁয়াটুকুও ওর গায়ে লাগা মাত্র শরীরে কেমন এক অদ্ভুত জ্বলুনির সৃষ্টি হয় তিন্নির, যেন ওর শরীর প্রত্যাখ্যান করছে অন্য কারোর ছোঁয়া। সারাক্ষন তিন্নি যা’ই করে, মনে হয় যেন অভিমন্যু ওর সাথেই আছে। খাওয়াদাওয়ায়ে অনিয়ম, মুখ নিচু করে সমস্ত কিছু মানিয়ে নেওয়ার মতো মাস কয়েক আগের তিন্নি আর এই, তিন্নির এখন আকাশপাতাল তফাৎ। সীমন্তিনী আচারিয়া এখন এক প্রজ্জ্বলিত অগ্নিশিখা, শরীরে যোগিনী, আর চোখদুটো সাধিকার মতো – হয়তো সবই দেখছে কিন্তু ঠিক দেখছেও না। তিন্নির নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে, ওর সম্পূর্ণ অস্তিত্ব এখন অভিমন্যুময়। অনবরত বুকের ভেতর চলছে উথলপাতাল প্রেমের ঢেউ। যে কোনদিন এবার কোনো অসতর্ক মুহূর্তে মুখ ফস্কে না মেজর অভিমন্যু সেনকে তিন্নি বলে দেয় “ভালোবাসি”। আজকাল অভিমন্যুর সাথে ফোনে কথা বলার সময় তাই, নিজেকে প্রানপনে সংযত রাখার চেষ্টা করে তিন্নি। ভুল করেও যদি মুখ ফস্কে কিছু বেরিয়ে যায়, আর অভিমন্যু যদি প্রত্যাখ্যান করে? আবারো? ইচ্ছাকৃত ভুলের মাশুলে নতুন করে আঘাত পেয়ে চলে আসা সুন্দর এই মুহূর্তগুলো নষ্ট করতে চায় না তিন্নি। বছরকয়েক আগে খুব সহজে “মানব” নামের ভুল মানুষটার সাথে জড়িয়ে পড়েছিল ও, এবারে সেই ভুল আর করতে তিন্নি রাজী নয়।

অন্যান্যরাতের মতোই আজও অভিমন্যু ফোন করলো, তিন্নির ফড়িং মনের কলকলানি কথায় হারিয়ে গেলো ওরা দুজনেই। টুকরোটুকরো সারাদিনের কথা, অফিস, পছন্দের কবিতা-গান এসব নিয়ে কথা বলে প্রায় ঘন্টাখানেক পর আজ ফোন রাখার ঠিক আগের মুহূর্তে খুব অস্ফুটে অভিমন্যু বলে ফেললো
— Je T’aime.

মিসেস বিয়াঙ্কার নরম তুলো গায়ে আনমনে হাত বোলাতে বোলাতে বিছানায় আধশোয়া হয়ে ফোন কানে ছিলো তিন্নি, চমকে খাড়া উঠে বসলো। হৃৎপিন্ডটা একবার লাফিয়ে উঠেই থেমে গেল কয়েক সময়ের জন্য। অনেকদিন আগের পড়া প্রিয় শব্দবন্ধ, খুব চেনা। ঠিক শুনলো কি ও? নিশ্চিত হতে সাথেসাথে জিজ্ঞেস করলো তিন্নি – “কি বললেন?”

— হুম..ম… কই? কিছু না তো!
অভিমন্যুর গলা কেঁপে উঠলো নাকি সেটাও ওর ভ্রম? চোখ বন্ধ করে নিলো তিন্নি। ভৌগোলিক দূরত্ব যাই হোক না কেন, প্রতিরাতে ফোনে কথা বলার অভ্যাসে এখন অভিমন্যুর প্রতিটি কথা আর অন্তরের ভাব স্পষ্ট বুঝতে পারে ও, অভিমন্যু কি কিছু লুকোনোর চেষ্টা করছে? হাল ছাড়লো না তিন্নি

– “আমার মনে হলো আপনি কি যেন একটা বললেন এখনি?”

— ও কিছু না! হাওয়ার আওয়াজ।

— অভিমন্যু??

— আজ রাখি এবার? কাল কথা হবে।

তিন সেকেন্ডস নীরব হয়ে থাকলো তিন্নি, ঠিক শুনুক বা ভুল! আর কতদিন চেপে রাখবে মনের নিঃশব্দ ভালোবাসার জোয়ার? আর তো পারা যায় না! ছাপিয়ে যাওয়া আবেগের বন্যায় সকল সংযমের বাঁধ ভেঙে দুইকুল ভাসিয়ে দেওয়ার ঠিক আগের মুহুর্তে সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো ওর, তারপর নিজের মন-প্রাণ-নিঃশ্বাস সমস্ত কিছু ওই তিনটি শব্দের ওপর সমর্পন করে, চোখ বন্ধ করে পারফেক্ট আ্যকসেন্টে অস্ফুটে বললো

— Je T’aime Aussi.
.

.
শোঁ শোঁ হাওয়ার আওয়াজ ছাড়া আর কিছু শোনা যাচ্ছে না। তুমুল ঝড় উঠেছে, মনের ভিতর আর বাইরের প্রকৃতিতেও। উত্তর সিকিমের হিমালয়ের শুকনো পার্বত্য উপত্যকায় ভরা জোৎস্নায় খাঁ খাঁ ধূসর প্রান্তরে সারি সারি মিলিটারি তাঁবু, যুদ্ধকামান, বন্দুক আর রাইফেলের ভিড়।মেজর অভিমন্যু সেন স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন, স্যাটেলাইট ফোন হাতে, অবিশ্বাসের সুরে ধীরে ধীরে বললেন – “তুমি ফ্রেঞ্চ জানো?”

তিন্নি তবে ঠিকই শুনেছিলো! প্রথমবার “সে”ই বললো তবে? ভালোবাসা আর মনের যুদ্ধে বেশকয়েকটা সোপান তড়তড়িয়ে এগিয়ে গেল তিন্নি। চোখ দিয়ে দরদর করে জল পড়ছিলো ওর আর এই অবস্থাতেও হাসি পেলো ওর, অভিমন্যুর প্রশ্ন শুনে। চোখের জল মুছে নিয়ে হেসে ফেলে বললো – “নাহ! তবে”…

ছড়িয়ে লাট করেছে!!
মুখ ফস্কে বাকি কথাগুলো বেরোনোর আগেই স্টেপ্লার দিয়ে ঠোঁট টিপে নিলো তিন্নি।

— “তবে কি?” তিন্নি হঠাৎ করে থেমে যাওয়ায় ততক্ষণে প্রকৃত কৌতূহল জেগে উঠেছে অভিমন্যুর গলায়।

— তবে কিছু না!

— সীমন্তিনী?

— ইটস নট দ্যাট ইম্পরট্যান্ট।

— সীমন্তিনী?

এবারের গলাটা আরো গাঢ়, আরো ঘন… আবারো ছলাৎ করে ওঠে হৃৎপিন্ড। উফফ্! মন না বায়োলজি ল্যাবের ব্যাঙাচি? পাগল করে দেবে এই স্বর। তিন্নির পিট্যুইট্যারী আজকাল বোধহয় অভিমন্যুর নির্দেশেই চলে, অবাধ্য হবে তার সাধ্যি কি? একটা ঢোঁক গিলে মুখ খুললো
— “বললে আপনি কি কিছু মনে করবেন?”

বাধো বাধো হয়ে উঠলো তিন্নির গলা, মিথ্যে ও বলতে পারে না, সত্যিটা অভিমন্যুকে ও বলতে চায় না।

হেসে ফেললো অভিমন্যু, নিজের আগের স্বত্বায় ফিরে গেছে ও। একটুআগের অন্যমনষ্কের “তুমি” সম্বোধনও বদলে গেছে আগেকার “আপনি”তে।বোধহয় কিছুটা অনুমানও করে ফেলেছে কারণটা, তাও তিন্নিকে নিজের মুখে স্বীকার করানোর ছেলেমানুষি মজা নিতেই বললো – “একেবারেই না, অনেস্টলি আই আ্যম কিউরিয়াস! ইওর আ্যকসেন্ট ওয়াজ নিয়ার পারফেক্ট। “

বাহ্ বা!
কতদিন পর অভিমন্যু যাহোক কিছু একটা কমপ্লিমেন্ট দিলো অন্তত! একরাশ লজ্জা কোথা থেকে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো তিন্নিকে। তাও এইরকম জমাট বাঁধা আইসক্রিমের মতো প্রেমঘন আ্যটমোস্ফিয়ারেও পেট থেকে গুড়গুড়িয়ে কেন যে ফেনা ফেনা সাবান-হাসির বুদ্বুদ উঠছিলো, তিন্নি নিজেও জানে না। বোধহয় কারণটা এতটাই উদ্ভট বলে। লজ্জালজ্জা গলায় হাসি চেপে কোনো রকমে বলতে থাকলো – “ইয়ে ……..মানে, কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে, মানব… মা-নে …. আমার প্রথম প্রেমিক আর কি। ব্রেকআপ হওয়ার দিনকয়েক আগে সে একটা কার্ড দিয়েছিলো যাতে ৫০টা বিদেশী ভাষায় “আই লাভ ইউ” লেখা ছিল। Being a nerd, পড়তে একটু বেশিই ভালোবাসি, ব্রেকআপের্ পর সময় কাটতে না, মনখারাপ কাটাতে কাটাতে কার্ডটা থেকে যত্ন করে মেমোরাইজ করে রেখেছিলাম!”
একটু থামলো তিন্নি , তারপর অভিমন্যুকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই নিজেই স্বীকার করে নিল। —- জানি কি ভাবছেন! আপনি বলার আগে আমিই বলে দিচ্ছি, আই আ্যম উইয়ার্ড”।

কথাগুলো শেষ করে চেপে রাখা হাসিটা খুকখুকে কাশিতে পরিণত করে কাশ্মীরি আপেলের মতো লাল টুকটুকে গাল নিয়ে বসে রইলো তিন্নির। ফোনের ওপর প্রান্তে অভিমন্যুর চাপা হাসির শব্দে নিঃসংশয় হয়ে গেল সেদিকের মানুষটিও ভালোই মজা নিচ্ছে! অদ্ভুত একটা ফিলিংস হচ্ছে তিন্নির! এই প্রথমবার নিজের পাস্ট রিলেশনশিপ নিয়ে কথা বললো, তাও এত সহজে? এত ক্যাজুয়ালি? একটু লজ্জা লাগলেও, মানবকে নিয়ে, নিজের পাস্ট নিয়ে অভিমন্যুর সাথে এতো সহজে কথা বলতে পারবে, বোধহয় ভাবতেও পারে নি ও। নিজের weird nerdy self, আর অভিমন্যুর নো জাজমেন্টাল acceptance দুইয়ের মিলিত প্রভাবের নিঃশব্দ ভালোবাসার রেশ মাখা হাসিতে কান এঁটো করে চুপ করে বসে রইলো! কিছুপল নীরব থেকে নিজেকে সামলে নিয়ে হাসি চেপেই বললো — “যদিও এগুলো কিন্তু অ-নে-ককাল আগের কথা! তখন এসব পাগলামো ছিল।”

— পাগলামো “ছি-ল?” এখন “নেই?”
প্রশ্নটা করেই হো হো করে প্রাণখোলা হাসিতে ফেটে পড়লো এবার অভিমন্যু! লজ্জায় লাল-গোলাপি-নীল প্রজাপতির ডানা হয়ে উঠলো তিন্নি, দেখতে না পেলেও তিন্নির এই Awkwardnessটা তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করছিলো অভিমন্যুও! তিন্নিকে আর একটু লজ্জা পাওয়াতেই জিজ্ঞেস করলো – “তা প্রথম প্রেমিক আর কি কি শিখিয়েছে?”

কি যা তা!
এর মুখে কি কিছুই আটকায় না? চাপা হাসিমুখে আর ছলছলে চোখে তিন্নি ফোনটা চেপে বালিশেই মুখ লুকিয়ে নেয় আর কি। এতোক্ষন ফোন ধরে থাকার উত্তাপেই হয়তো গালদুটোও গরম হয়ে উঠেছে। কোনো উত্তর দিলো না।

কিছুক্ষন অপেক্ষা করে অভিমন্যু এবার স্বাভাবিক সংযত গলায় বললো –“সীমন্তিনী, আই হোপ ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড, আপনার পাস্ট নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। আই নো, আই আম নট দ্য ফার্স্ট পারসন ইউ লাভড বাট আই ইনটেন্ড টু বি ইওর লাস্ট – এটা কি অনেক বেশি কিছু চাওয়া?”

.
.
.

ধক্ করে উঠলো বুকের ভেতরটা। এত ক্যাজুয়ালি এমন গভীর প্রোপোজাল কি করে কেউ দিতে পারে? তিন্নি কি বলবে বুঝতে পারলো না।

অনেকদিন ধরে কেউ যদি কিছু ব্যাকুলভাবে চাইতে থাকে, সে চাওয়াটা যদি তার প্রতিটি প্রার্থনায়, প্রতিটি নিঃশ্বাসে, কামনায় মিশে থাকে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস…..ধীরে ধীরে “চাওয়া”টা তখন “অভ্যেসে” দাঁড়িয়ে যায়। মনের চোরাগোপনের বিশ্বাস, পূর্ণ হওয়ার ক্ষীন আশা অবশ্যই থাকে “হয়তো আজই সে দিন” কিন্তু বহুদিনকার না পাওয়ার নিরাশা আর দীর্ঘশ্বাসের পাল্লাটা যে অনেকটা বেশিই ঝুঁকে! সেই চিরআকাঙ্খিত, পরম কাম্য বস্তুটি হঠাৎ করে যদি কোনো উপহারের বাক্সে তেরছা ভাবে শ্যাটিন ফিতের ফুল লাগানো গ্লিটার গিফ্ট পেপারে অতি যত্নের সাথে প্যাক করে অপ্রত্যাশিতভাবে প্রার্থিত মানুষটির একেবারে হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয় তবে অপর প্রান্তের সেই মানুষটার ঠিক কি অনুভূতি হয়?
তিন্নি ঠিক তেমনি, রিয়্যাক্ট করতে ভুলে গেলো। হৃৎপিণ্ড তো কখন থমকে গেছে, কান মাথা ভোঁ ভোঁ করছে ওর, বালিশে মুখ গুঁজে নিঃশব্দে কাঁদছিলো তিন্নি! কি বলবে কি করবে বুঝতে না পেরে মনে হলো প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলা সবচেয়ে সহজ। কান্নাভেজা গলায় জোর করে হাসার ব্যর্থ প্রচেষ্টায় বলতে শুরু করলো — “ একদম ভুলে গেছি, আজ অফিসে কি হলো জানেন?…….”

মেজর অভিমন্যু সেনের অচঞ্চল, স্থিরদৃঢ় কণ্ঠস্বর ভেসে এলো – “আমার প্রশ্নটার উত্তর পেলাম না কিন্তু।“

তিনটি বড়ো বড়ো শ্বাস নিয়ে অনেকটা বাতাস বুকের ভেতর অবধি টেনেনিলো তিন্নি। তারপর ধরা গলায় বললো — “তুমি বোঝো না?? তুমি না চাইতেও যে আমি তোমার হয়ে গিয়েছি, সেই প্রথমদিন থেকে।”

দীর্ঘশ্বাসটা গোপন করে নিল অভিমন্যু। শান্ত অবিচল স্বরে চিরাচরিত গাম্ভীর্য্যতায় বললো — আর ইউ শিওর? ভেবে বলছো তো সীমন্তিনী? আমাদের জীবন কিন্তু কখনো আর পাঁচটা সমবয়সী প্রেমিক প্রেমিকার মতো হবে না। তুমি যখনতখন আমার সাথে ঘুরতে যেতে পারবে না, সিনেমা দেখতে যেতে পারবে না, ইচ্ছে করলেই আমার সাথে কথা অবধি বলতে পারবে না, দেখা তো দুরের কথা। বছরে একবার কি দুবার আমি বাড়ি ফিরতে পারবো। আমার জীবন আমার হাতে নেই, আমার বাঁচা মরার কোনো ঠিক নেই। হঠাৎ ফোন করলে আমাকে পাবে না, তোমার কোনো দুঃসময়ে হয়তো আমাকে পাশে পাবে না, ইচ্ছে থাকলেও আমি ফিজ্যিক্যালি প্রেজেন্ট থাকতে পারবো না …

আরো অনেককিছু বলে যাচ্ছিলো অভিমন্যু, তিন্নি থামিয়ে দিলো — আর কিচ্ছু চাই না। তুমি আমার, এই জানাটাই আমার সবচেয়ে বড়ো শক্তি।

— আমার প্রায়োরিটি লিস্টে বরাবর তুমি সেকেন্ড থাকবে, দেশ সবার আগে।

চোখ বন্ধ করে নিলো তিন্নি, লাবডুব করে বেজে চলা হৃৎপিন্ডের সাথে তাল মিলিয়ে তিনফোঁটা গরম জল গড়িয়ে পড়লো ওর চোখের কৃষ্ণসাগর থেকে। স্থির দৃঢ় স্বরে বহুকাল আগে অভিমন্যুর বলা কথাগুলো ফিরিয়ে দিলো তিন্নি — সেটা তো আমাদের সবারই কর্ত্যব্য, তাই না?

নর্থ সিকিম আর শ্রীরামপুরের ফিরিঙ্গিডাঙার মধ্যে ভৌগলিক দুরত্বটা গুগুল ম্যাপের হিসেবে দুইহাজার মাইল না হয়ে যদি দুশো মাইলও হতো, মেজর অভিমন্যু সেন হয়তো আজ রাতেই পৌঁছে যেতেন তিন্নির কাছে, শুধু একবার ওকে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নিতে।

ক্রমশঃ
© সুমন্দ্রা মিত্র। ভালো লাগলে নামসহ শেয়ার করবেন।

***********************__******************************

সকল পর্বের লিঙ্ক~
Video Teaser
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/145475543838322/?vh=e&d=n
Part 1
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/145129087206301/?d=n
Part 2
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/145859077133302/?d=n
Part 3
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/146221053763771/?d=n
Part 4
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/146595433726333/?d=n
Part 5
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/147293876989822/?d=n
Part 6
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/148075966911613/?d=n
Part 7
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/148530310199512/?d=n
Part 8
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/148951006824109/?d=n
Part 9
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/149405760111967/?d=n
Part 10
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/150313546687855/?d=n
Part 11
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/151106323275244/?d=n
Part 12
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/151923336526876/?d=n
Part 13
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/152353663150510/?d=n
Part 14
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/154065792979297/?d=n
Part 15
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/156163186102891/?d=n
Part 16
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/157132182672658/?extid=QdVQFGSjLzQUsE31&d=n
Part 17
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/157444422641434/?extid=fI3jIc0PCiYXDa0N&d=n
Part 18
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/158095955909614/?extid=1E2JOZfMCmqscBoi&d=n
Part 19
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/158831902502686/?extid=R8zo6L2l274CIQ7r&d=n
Part 20
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/159626782423198/?extid=0e8jrLLhsuLqgsQX&d=n
Part 21
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/160047349047808/?extid=e9DIdFXAkqxTg77U&d=n
Part 22
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/160963752289501/?extid=EgYDh0z3hVr5TCBY&d=n
Part 23
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/161833698869173/?extid=gRK0HHMoLW0bu0gK&d=n
Part 24
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/162740122111864/?extid=KIR9o3zetBHgH9mt&d=n
Part 25
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/163061178746425/?extid=fhzBxEjnlA7n6Ulu&d=n
Part 26
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/163695728682970/?extid=tm0Y81ykORQhpsq9&d=n
Part 27
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/164305438621999/?extid=WsYE2BjXkYvPmqyF&d=n

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here