#সূর্য_ডোবার_আগে
পর্ব-২০
লেখিকা ~ #সুমন্দ্রামিত্র
কঠোরভাবে প্রাপ্তমনষ্কদের জন্য।
.
.
.
বাইরে ভাদ্রের পচা গরম, বৃষ্টির ছিঁটেফোঁটা নেই। গাছের একটা পাতাও নড়ছে না এমনি গুমোট আবহাওয়া। দিনকয়েকের প্রচন্ড তাপপ্রবাহে শহর কলকাতা স্তব্ধ প্রায়, সকাল সকাল শুনশান গলি, রোদের তেজে পথকুকুরগুলো ছায়ায় বসে বসে হাঁপাচ্ছে ইতিউতি, জনমানুষের চিহ্নমাত্র নেই। দুপুরদিকে গলন্ত পিচের রাস্তা থেকে ভাপ উঠে এসে যেন গলিয়ে দেবে সারসার দাঁড়িয়ে থাকা হলদে ট্যাক্সির বনেট। সল্টলেক সেক্টরফাইভের ঝাঁ চকচকে বহুতল আইটি অফিসের ঠান্ডা এসিঘর থেকে এক পা বাইরে দিলেও যেন ঘামে চ্যাটচ্যাটে হয়ে যায় গা-হাত-পা। গড়িয়ে আসা নোনতা স্বেদধারা মুছে নিতে রুমাল সর্বক্ষণের সঙ্গী। পারতপক্ষে কেউ আর অফিসের বাতানুকূল ঘর ছেড়ে বাইরের ফুটে নামে না, লাঞ্চব্রেকে এমনকি বিকেলের চা খেতেও নয়, অফিস ক্যাফেটেরিয়াতেই সেরে নেয় আজকাল। তিন্নিদের চোদ্দতলার অফিস দুটো ক্যাফেটেরিয়া, একটা দশতলায় আর একটি গ্রাউন্ড ফ্লোরে, দশতলারটি তুলনামূলক ছোট ।দুপুরের সাড়ে বারোটার পর থেকে দুটো ~ এই সময়টুকু দু-দুটো ক্যাফেটেরিয়ার একটাতেও আর তিল ধারণের জায়গা থাকে না। গাঁকগাঁক শব্দে বেজে চলা জায়ান্ট স্ক্রীনে নিউজ বা ফুটবল, এমপ্লয়ী, কুক, আ্যটেন্ডেন্টসদের ভিড় -কলতান, হইচই, ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে আলোচনা হাসি-ঠাট্টা-গল্প, রকমারী বাঙালি/প্রাদেশিক খাবার – চা-কফি-স্যান্ডউইচের ম ম গন্ধের ভিড়ে সেক্টর ফাইভের অফিস ক্যান্টিন তখন যেন হাওড়া রেলস্টেশন, “বিবিধের মাঝে মিলন মহান”, মাঝে মাঝে বসার জায়গাও পাওয়া যায় না। তারওপর আবার একা খেতে যাওয়ার জ্বালাও আছে। চারপাশের পরিচিত মুখগুলি মাঝে মাঝেই উঁকি মারবে অনর্থক কিছু খেজুরে আলাপ বা উটকো প্রশ্নমালা নিয়ে। দুপুরের ভিড় এড়াতে, তিন্নি তাই চেষ্টা করে বেলা দুটোর পর ক্যাফেটেরিয়া যেতে, তখন ভিড় অনেক পাতলা। দেড়মানুষ প্রমান একটা কাঁচজানলার ধার বেছে নিয়ে দূরের নলবনের ধোঁয়াটে নীল জলরাশি আর এভারগ্রিন কলকাতা দেখতে দেখতে শান্তভাবে নিজের খাবারটা সাবাড় করে তিন্নি। কানে গুঁজে রাখা ইয়ারফোনে বেজে চলে পছন্দের গান – অরিজিৎ সিংহ বা “জল” ব্যান্ডের একের পর এক ট্র্যাক।
কোনো এক এমন দুপুরে সুরের জগতে হারিয়ে যেতে যেতে মায়ের দেওয়া টিফিনবক্সটা খুলে মনের সুখে এগচাউমিন চিবোচ্ছিল তিন্নি, পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে সায়ক একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলো ওর ঠিক পাশটিতে। গভীর মনোযোগে তিন্নি তখন ফোনের কললগ্ দেখছিলো, গত মাস দেড়েক বা দুয়েক সারাদিনে বারবার অভিমন্যুর ফোননাম্বার, কলডিটেলস দেখাটাই ওর একমাত্র টাইমপাস হয়ে দাঁড়িয়েছে, সায়ককে খেয়াল করে নি।
অপলক চোখে সায়ক তাকিয়ে ছিলো হলদে সাদা চুড়িদার কামিজে ফোনে মগ্ন সেই মেয়েটির দিকে, মাসকয়েক আগেও যাকে দেখলেই পেটের ভেতর কেমন ওয়াশিং মেসিনের মত গুড়গুড় আওয়াজ হতো। সময় সত্যিই বদলে দেয় সবকিছু, এখন যেন সীমন্তিনীকে দেখলেই রোমে রোমে বিছের দংশন! কি কমতি আছে ওর মধ্যে, যে সীমন্তিনী ওর দিকে ফিরেও তাকায় না? দুইবছরের চেষ্টা করে সবে একটু আশার মুখ দেখেছিল, সিকিমের ট্রিপটা এমনভাবে ভেস্তে না গেলে আজ হয়তো সীমন্তিনী ওর গার্লফ্রেন্ড হতো। মাঝখান থেকে উড়ে এলো সেই মিস্ট্রী আর্মিম্যান! কে জানে, হয়তো তার সাথেই ফোনে ব্যস্ত থাকে সীমন্তিনী! বেশকিছুক্ষন অপেক্ষা করে ভাঙাভাঙা গলায় সায়ক বললো
— কেমন আছিস সীমন্তিনী?
চমকে উঠলো তিন্নি।
মাসদুয়েক আগে সিকিম থেকে ফেরার দিন বিকেলে ট্রেনের সেই অপ্রীতিকর এপিসোডটার পর থেকে সায়কের সাথে আর একটা কথাও বলে নি তিন্নি, একই অফিসে-এক প্রজেক্টে, দিনের মধ্যে নয়ঘন্টা একসাথে কাজ করেও। হয়ত সায়ক ভেবেছিল, মিথিলেশ ডেকে পাঠানোর পর সীমন্তিনী নিজে আসবে ওর সাথে কথা বলতে কিন্তু তিন্নি ছিল সম্পূর্ণ নিরুত্তাপ, নির্বিকার। যেন কিছুই হয় নি। সায়ক যেন পাশের কিউবিকলে বসেও ওর চোখে অদৃশ্য। কয়েকদিন পর বুঝে গেছে সায়ক, আর কিছুই না সীমন্তিনী ওকে লক্ষ্যও করে না, হয়তো মনপ্রাণে ঘৃণা করে। তারপরও এরপরও নানা ছলছুতোয় সায়ক চেষ্টা করেছিল বারকয়েক, তিন্নির সাথে কথা বলার তা শুনলে তো?
আজকেও যথারীতি সায়ক ওর সাথে কথা বলতে যেতেই টিফিন ফেলে চেয়ার থেকে উঠে পড়ছিল তিন্নি, সায়কের চাপা কাতর আর্তিতে পা আটকে গেল ওর — “সীমন্তিনী প্লিজ, সবাই দেখছে। একটু আমার কথা শোন?”
বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে গেলো তিন্নির — “তাতে আমি কি করবো? দেখলে দেখুক, আমার কিছু যায় আসে না।”
— আমার যায়। একটু বস, প্লিজ?
— সিন ক্রিয়েট করিস না সায়ক, তোর সাথে আমার কোনো কথা নেই।
— সীমন্তিনী, প্লিজ!
সায়ক এমন ভাবে চেঁচিয়ে উঠলো অনিচ্ছাসত্বেও চেয়ারে বসে পড়লো তিন্নি। রুদ্ধস্বরে সায়ক বললো
— আগে শান্ত হয়ে বসে সবটা শোন? তারপর তোর যা ইচ্ছে হয় আমায় বলতে পারিস।
না শোনার থেকে “না” বলতে আরো বেশি মনের জোর লাগে। তেঁতুলগোলার টক মুখের ভেতর, ধপ করে বসে পড়লো তিন্নি! — “জলদি বল যা বলার, সময় নেই হাতে।”
অনেকটা সময় নিয়ে মুখেচোখে একটা দুঃখী দুঃখী ভাব ফুটিয়ে তিন্নির দিকে তাকালো সায়ক — “আমার ওপর এতটা কেন রেগে আছিস বলবি একটু?”
সায়কের দিকে অবিশ্বাসের দৃষ্টি নিয়ে কয়েকপল তাকিয়ে রইলো তিন্নি!কেটে কেটে বললো – “আর ইউ কিডিং মি? তুই কি সব জেনেশুনে ইনোসেন্ট সাজছিস সায়ক? “
— একটা বিশাল বড়ো ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে সীমন্তিনী, তুই ভুল বুঝছিস আমায়!
উত্তেজনায় ফেটে পড়লো তিন্নি — “আ-মি ভুল বুঝছি? সিকিম থেকে ফেরার দিন ট্রেনে আমার সাথে কি বিহেভ করেছিলি তুই, ভুলে গেছিস?”
থেমে থেমে সায়ক বললো — “সেদিনের ট্রেনের ওই ঘটনাটার জন্য, আই আ্যম সো সরি। বিশ্বাস কর, কোনো এক্সকিউজ দিচ্ছি না, আমি নিজেও জানি না কি বলে গেছি সেদিন। তুই আমাকে ভুল ভাবছিস কিনা সেটা ভাবার চেয়েও আমার কাছে তোর সেফটিটা আরো বেশি ইমপর্ট্যান্ট ছিল।”
— বিলিভ মি সায়ক, আমার কাছে এটা লেম এক্সকিউজই লাগছে।
সায়ক চুপ করে আছে দেখে বিরক্তিতে তিন্নির কপালটা কুঁচকে গেলো, যদিও সায়কের মুখ নিচু করে বলে যাওয়া পরের কথাগুলোতে সে বিরক্তির ছিঁটেফোঁটাও আর রইলো না! ধীর গলায় সায়ক বললো –
— সত্যি বলতে, তোকে ওভাবে আমরা ফেলে আসার পর থেকে সারারাত আই ওয়াজ ফিলিং গিল্টি। আমার কথায় এই ট্রিপটায় এসেছিলি, তুই না চাইলেও তোর “দায়িত্ব” আমারই ছিল। ইভেন তোর বাবার সাথেও আমিই তো ভিডিওকলে কথা বলেছিলাম, বলি নি? চিন্তায় মাথা ফেটে যাচ্ছিলো, তখনই ফিরে যেতে চাইছিলাম, তোকে নিয়ে আসতে চাইছিলাম কিন্তু রাস্তা বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো! পুলিশ রিপোর্ট করতে যাওয়ার আগে আগে খবর পেলাম তুই কোথায়! শুনে কার মাথার ঠিক থাকে বলতো? আমরা ছা-পোষা বাঙালি, ঘরপোড়া গরু! খবরের কাগজে যা পড়ি, আর্মির নাম শুনলে ভয় পাই! তারওপর তুই একা একটা মেয়ে! যদি তোর কিছু হয়ে যায় এই চিন্তায়, দুর্ভাবনায়, সবার কাছে কি জবাব দেব, এইসব ভাবতে গিয়ে তুই ফিরে আসতে মাথার ঠিক রাখতে পারি নি। নিজেকে দোষী সাব্যস্ত করার বদলে প্রচন্ড মেন্টাল প্রেসারে তোকে যা নয় তাই বলেছিলাম। আই আ্যম সরি, প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দে সীমন্তিনী।
এতটা একসাথে বলে দম নেওয়ার জন্য থামলো সায়ক, তারপর তিন্নির দিকে তাকিয়ে রইলো ও কি বলে শোনার অপেক্ষায়।কিছুক্ষন কোনো কথা খুঁজে পেলো না তিন্নি, এইদিকটা নিয়ে ও কখনোই ভাবে নি! অবাক কান্ড, ট্রিপ থেকে ফিরে আসার পর’ও সায়কের বাকি ব্যবহারগুলোর কথা তিন্নি এখন বেমালুম ভুলে গেলো। কিছুক্ষন মুখ গোঁজ করে বসে থেকে বললো — “ক্ষমা চাইলেই সব ঠিক হয়ে যায় না সায়ক।”
ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো সায়ক – “জানি, কিন্তু একবার আমার দিকটাও ভেবে দেখ? দুইবছর একসাথে এক অফিসে কাজ করছি, কত ভালো ফ্রেন্ডস ছিলাম আমরা, এর আগে কোনোদিন তোর সাথে এমন কিছু বিহেভ করেছি আমি? জানি না, কি করে তোকে কনভিন্স করবো যে ঐদিন আই ওয়াজ’নট মাইসেলফ। বিলিভ মি, আই রিগ্রেট ইট মোর দ্যান ইউ। একটা লাস্ট চান্স দিয়ে দেখ! আর কোনোদিন এমন হবে না।”
চুপ করে রইল তিন্নি। গলা ফাটিয়ে বলতে ইচ্ছে করছিলো যে বন্ধুত্বে গা জোয়ারি চলে না। বন্ধুর জন্য চিন্তা হতেই পারে তাই বলে স্লাট শেমিং? চরিত্রে কালি ছেটানো? কিন্তু ক্যাফেটেরিয়া ভর্তি সহকর্মীদের সামনে এই প্রসঙ্গটা তুলতে নিজেরই রুচিতে বাধছিলো তিন্নির, মনে মনে সবটা বিবেচনা করে মুখের তেঁতোভাবটা গিলে নিয়ে বললো — “মানছি তোর চিন্তা হচ্ছিলো কিন্তু কথাগুলো তুই অত নোংরাভাষায় না’ও বলতে পারতিস।”
— আই নো দ্যাট! ফিরে এসে প্রথম ক’দিন তোর কাছে ক্ষমা চাওয়ার অবধি মুখ ছিল না আমার। তারপর থেকে কতবার ট্রাই করেছি তোর সাথে কথা বলার জন্য, ভেবেছিলাম সময় পেরোলে সব ঠিক হয়ে যাবে! কিন্তু তুই কিছু শুনতেই রাজি নোস্!
আজ মনে হল, তোর মুড ভালো…তাই ভাবলাম যদি আমায় ক্ষমা করে দিস। আই মিস আওয়ার ফ্রেন্ডশিপ সীমন্তিনী। আবার কি আগের মতো আমরা বন্ধু হতে পারি না? অনেক সাহস করে এসেছি… কথা দিচ্ছি কখনো তোর ভরসা ভাঙবো না।
সায়কের ভাঙাচোরা মুখের দিকে তাকিয়ে ঠিক বলা উচিত বুঝতে পারছিলো না তিন্নি। মনের মধ্যে বিরক্তির সাথে সাথে এ ভাবনাটাও চলছিল, সত্যিই তো এর আগে কখনো তো সায়ক এমন ব্যবহার করে নি। বলতে গেলে অফিসে ওর একমাত্র বন্ধুস্থানীয় সহকর্মী একমাত্র, সায়কই ছিল। কেজো কর্পোরেট অফিসের গোমড়া ঘণ্টাগুলো একটু হলেও হাসিমজায় কেটে যেত, কাজের লোড নিয়ে কথা বলা যেত। এখনকার মতো সাড়ে নয়ঘন্টা ঠোঁট টিপে বসে থাকার থেকে তো সে অনেক ভালো!
বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলাচলে দুলছিলো ওর মন, সায়কের সেদিনের ব্যবহার কি সত্যিই প্রচন্ড মেন্টাল প্রেসারের আউটবার্স্ট? তিন্নির নিজের ব্যবহারও কি রূঢ় ছিল না? অভিমন্যুকে ছেড়ে আসার দুঃখ এতটাই প্রবল ছিল, সেদিনের বাকি ঘটনাগুলো এখন যেন কেমন সব ঝাপসা হয়ে গেছে, সেভাবে মনে পড়ে না! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিন্নি বললো —- “আমাকে ভাবতে হবে সায়ক, আই নিড সাম টাইম।”
— নিশ্চয়ই , অবশ্যই! টেক ইওয়োর টাইম, বাট প্লিজ! পজিটিভ কিছু ভাবিস!
— হুমম… দেখবো! উঠি এখন! কাজ শেষ করে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরবো।
চলেই যাচ্ছিলো, সায়কের পরের কথায় আবার থমকে গেলো তিন্নি। সায়ক এবার আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করেই ফেললো — “একটা সত্যি কথা বলবি? শুনলাম…. তোর নাকি বিয়ের ঠিক হয়ে গেছে?”
আর একবার বিরক্তির দমকা বাতাসটা ফিরে আসতেও নিজেকে সামলে নিলো তিন্নি। মুখ তুলে তেঁতো মুখে বললো — “রিয়েলি? তুইও?”
–ফ্লোরে সবাই বলাবলি করে। ওই প্রবালদা’ই বলছিলো! এমনিতেই তুই কেমন আনসোশ্যাল হয়ে গেছিস, কারো সাথে কথা বলিস না, দিনরাত ফোন নিয়ে পড়ে থাকিস। আমিও তাই ভাবলাম…. এনিওয়ে, কিছু মনে করিস না আবার!
বিয়ে!
ঠিকড়ে আসা হতাশার দীর্ঘশ্বাসটা লুকিয়ে নিলো তিন্নি। আজকাল মাঝে মাঝে শঙ্কা জাগে মনে, অভিমন্যু কি সত্যিই ওকে ভালোবাসে নাকি তিন্নি ওর সময় কাটানোর অজুহাত মাত্র! রাতের পর রাত ফোনে কথা বলে ওরা, তিন্নির প্রতিটা কথা এমন মনোযোগ দিয়ে শোনে,অভিমন্যুর এক একটা নিঃশ্বাস, ঘন গলার স্বর বারবার গলিয়ে দেয় তিন্নির মন কিন্তু তারপর…..? মন যে আরো বেশি কিছু চায়! যতই বলুক “প্রত্যাশা করি না, সম্পর্কের দাবী করি না” সত্যিই কি কোনো চাহিদা ছাড়া ভালোবাসা হতে পারে? অভিমন্যুর সাথে কথা বললে হয়তো রাতটা ভালোভাবে কাটে, সবকিছু ভুলে থাকে, মিষ্টি মিষ্টি ভ্যানিলা আইসক্রিমের মতো হ্যাপি হ্যাপি ভাব। কিন্তু সকালে উঠেই যে কে সেই! যে মুহূর্তে একা হচ্ছে তিন্নি, সেই মুহূর্তেই সমস্ত খারাপ স্মৃতি, সমস্ত দুশ্চিন্তা উইপোকার মতো বুকের ভেতরটা কুরে কুরে খাচ্ছে। মন কি চায় মন নিজেই জানে না! তিন্নি বুঝতে পারে না অভিমন্যুর মন! একমুহুর্তে সবলে খুব কাছে টেনে নেয় ওকে পরের মুহুর্তে বরফের মতো শীতল নিস্পৃহতায় দুরে সরিয়ে দেয়! যেন ধরা দিয়েও ধরা দিতে চায় না, একটা রহস্যের ঝাপসা কুয়াসায় ঢাকা অভিমন্যুর জীবন, যেখানে তিন্নির কোনো উপস্থিতি কাম্য নয়! এক এক সময় বড্ড ফ্রাস্টেটেড লাগে, অপাংতেয় মনে হয় নিজেকে! এতদিনের এত কথা, এত অঙ্গীকারের পরও কোথাও গিয়ে তাল মেলে না যেন। মানুষটার পরিবার, ব্যাকগ্রাউন্ড, অতীত এমনকি বাড়ি কোথায় সেটুকুও জানে না তিন্নি, ভেবেছিলো একদিন না একদিন অভিমন্যু নিজে থেকেই বলবে সেসব কথা! কিন্তু কোথায় কি! মাঝে মাঝে তো এমনও মনে হয়, হয়তো অভিমন্যুর জীবনে ও স্পেশাল কেউ নয়, না হলে কি নিজের কথাগুলো ওর সাথে শেয়ার করতো না সে? তীব্র অভিমানে তিন্নিও মুখ ফুটে তাই কিচ্ছু জিজ্ঞেস করে নি একবারের জন্যও! এমনকি, আজ অবধি মাত্র একবার মুখ ফুটে ওকে “আই লাভ ইউ” বলেছে অভিমন্যু, সেই মাসখানেক আগে! ব্যাস, তারপরে সব চুপচাপ!
বুদ্ধিমানরা বলবেন এসব তিন্নির অবুঝ চিন্তা, ইমম্যাচুরিটি… কিন্তু কখনো কখনো ভালোবাসার আক্ষরিক প্রকাশও বড্ডো জরুরি, বিশেষ করে এই ডিজিটাল প্রেমের যুগে যেখানে ইচ্ছেমতো হাত বাড়িয়েই তাকে ছোঁয়া যায় না, তার চোখের ভাষা পড়া যায় না, তার মুখের হাসি দেখা যায় না! মনটা যে বড্ড অবুঝ, বড্ড জটিল!
তাও সেই মানুষটার ফোনের অপেক্ষায় দিন কাটায় তিন্নি, স্বপ্ন দেখতে মন চায়! দশমিনিটের একটা ফোনকলে সারাদিনের সকল অভিমান, অভিযোগ ধুয়ে মুছে যায়। মন-প্রাণ-শরীর সবকিছু সমর্পন করে আছে সেই মানুষটির ভালোবাসার আশায়! যে মানুষটার জীবন সম্বন্ধে ওর কোনো ধারণাই নেই, সেই মানুষটাকে নিজের জীবনের থেকেও বেশি ভালোবাসে তিন্নি! যত কান্নাই কাঁদুক না কেন, যত মনখারাপই হোক না কেন, তিন্নি জানে অভিমন্যুকে ও ভালোবেসেছে পাগলের মতো, ছন্নছাড়া, মাত্রাহীন সুতীব্র সে প্রেম! বাঁধনহীন ভালোবাসার দাউদাউ আগুনে ঝাঁপ দিয়েছে তিন্নি, শ্যামাপোকার মতো পুড়ে মরা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই ওর।
মেঘছায়ার মতো তিন্নির হঠাৎ বিষন্ন হয়ে যাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে আর থাকতে না পেরে খুব কাতর গলায় বলে উঠলো সায়ক — তোর কী হয়েছে বল তো সীমন্তিনী? না জেনে কি তোকে হার্ট করে ফেললাম?
সায়কের কথা যেন কানেই যায়নি ওর, এলোমেলো গুলিয়ে যাওয়া মন নিয়ে খাবার শেষ না করেই টিফিন বক্সটা বন্ধ করে নিলো তিন্নি, আনমনা হয়ে ক্যাফেটেরিয়ার টেবিল ছেড়ে চলে গেল ইতিউতি মুগ্ধচোখে চেয়ে থাকা আরো দুইতিনজন সহকর্মীর বুকে তরল হিল্লোল তুলে! নিস্পৃহতাও কি তীব্র আকর্ষন! অতিসাধারণ কিন্তু কোথাও যেন একটা “অন্যরকম” ওই নারীর গমনপথের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সায়ক।
**************************__****************************
~আলিপুর আবহাওয়া দপ্তরের তরফে জানানো হয়েছে আজ মধ্যরাত থেকে কলকাতা এবং তার আশেপাশের শহরতলিতে ভারী নিম্নচাপ তৈরির সম্ভাবনা আছে। গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে প্রবল বৃষ্টিপাত এবং ১২০ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টায় প্রবল ঝড়ের পূর্বাভাস জারিত রয়েছে।~
অফিস থেকে জলদি বেরিয়ে এসেছে তিন্নি, কি জানি কখন ঝড়ে গাছটাছ পড়ে ট্রেনের লাইন বন্ধ হয়ে যায়! বৃষ্টিটা নামলে ভালো, প্যাচপ্যাচে গরমটা একটু কমতো তবে! কিন্তু কোথায় কি? আকাশ ফটফটে শুকনো, মেঘের চিহ্নমাত্র নেই! তার সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে হিউমিডিটি! প্রকৃতিতে নিম্নচাপের ছিটেফোঁটা আভাস নেই অথচ নিউজ চ্যানেলগুলিতে বার বার একই খবর ঘুরে ফিরে আসছে!
মিসেস বিয়াঙ্কাকে কোলের কাছে নিয়ে বিছানায় শুয়ে তিন্নি, অভিমন্যুর ফোনের প্রতীক্ষায়! দুপুর থেকে টাইমবম্বের মতো মাথায় টিকটিক করছে একটাই প্রশ্ন – অফিস ক্যাফেটেরিয়ায় সায়কের সাথে হওয়া কথাগুলো অভিমন্যুর সাথে শেয়ার করা কি উচিত হবে আদৌ? এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে উঠতে পারে নি তিন্নি, মনের গভীরে অস্বস্তির একটা চোরাকাঁটা খচখচ করছে! অভিমন্যুকে কিছু লুকোতে ওর মন চায় না অথচ অপ্রীতিকর কিছু প্রসঙ্গ তুলে মিনিটদশেকের ফোনকলের সুন্দর মুহূর্তগুলো নষ্টও করতে চায় না! কেন জানি তিন্নির মনে হয়, অভিমন্যু সায়ককে ঠিক পছন্দ করে না! অথচ তাই বা কি করে হয়? অভিমন্যুর সাথে সায়কের কোনো পরিচয়ই নেই, যেটুকু জানে, তিন্নির মুখ থেকেই শোনা। অদ্ভুতভাবে সায়কও কোনোদিন অভিমন্যুকে দেখেনি তাও যেন ওকে সহ্য করতে পারে না! অতিরিক্ত টেস্টোস্টেরোনের প্রভাব? তাই হবে হয়তো বা! সায়ক সম্বন্ধে ভালো/মন্দ মোটামুটি সকল কথাই অভিমন্যুকে বলেছে তিন্নি, অবশ্যই সিকিম থেকে ফেরার সময় হোটেলে আর ট্রেনে, অভিমন্যুকে জড়িয়ে ওর নোংরা ইঙ্গিতগুলো বাদ দিয়ে। কি এক অজানা কুণ্ঠায় সায়কের ওই কদর্য চেহারাটা অভিমন্যুকে বলতে পারে নি তিন্নি, হয়তো বা আর একবার নিজের নামে শোনা নোংরা কথাগুলো স্মরণ করতে চায় নি বলে। কিন্তু আজ যখন প্রতিরাতের মতোই অভিমন্যু ফোন করলো একথা সেকথার পর ‘বলবো কি বলবো না’র’ দোলাচলে কিন্তুকিন্তু করে অনেক সাহসে প্রসঙ্গটা তুলেই ফেললো তিন্নি!
“জয় মা কালী!”
মনে মনে একটা বড়োসড়ো শ্বাস নিয়ে শুরু করলো গলা খাঁকড়ি দিয়ে — “ অনেকদিন পর আজ আবার সায়কের সাথে কথা হলো ….”
— এনিথিং সিরিয়াস?
সায়কের নাম শুনেই অভিমন্যুর গলা যে ওপ্রান্তে সামান্য শক্ত হয়ে উঠেছে তা ধরতে পারে নি তিন্নি। নিজের মতো তড়বড়িয়ে বলতে গেল – “না না! তেমন কিছুই না, জাস্ট সরি বলতে এসেছিলো! ওই …সিকিম থেকে ফেরার দিন ট্রেনে যা হয়েছিল তার’ই আ্যপোলজি চাইতে…”
বাহ্! ষষ্ঠীতেই বিসর্জন!
ছড়িয়ে লাট করেছে তিন্নি! বাকি কথাগুলো মুখ দিয়ে বেরোনোর আগেই ঠোঁটে সেলোটেপ লাগিয়ে নিলো তড়িঘড়ি! অভিমন্যু যে আসল ঘটনাটাই জানে না।
— “কিসের আ্যপোলজি? সিকিম থেকে ফেরার দিন ট্রেনে আবার কি হয়েছিল?”
অভিমন্যুর গলা কি আর একটু কঠিন হয়ে উঠলো? ছলকে উঠলো বুকের রক্ত, ফোন ধরে রেখে মনে মনে নিজেকে বাছা বাছা দু-চারটে গালাগালি আর ছয়-সাতটা লাথি মারলো তিন্নি! কি দরকার ছিল সিকিমের কথা তোলার? অভিমন্যুকে না বলে একটা কথাও কি পেটে চেপে রাখতে পারে না ও? আস্তে করে বললো – সেটা ইম্পরট্যান্ট নয়…বলছিলাম যে… !
কথা শেষ করতে পারলো না তিন্নি, অভিমন্যুর কঠিন গলায় ওখানেই থতমত খেয়ে গেলো।
— লেট্ মি ডিসাইড দ্যাট! কি হয়েছিল সিকিমে?
এবারের গলাটা আরো ঠান্ডা, আরো কঠিন… আবারো ছলাৎ করে ওঠে রক্ত। উফফ্! মনব্যাঙাচি যে ভয়ে হৃৎপিন্ডের কোণে দিয়ে সেঁধিয়েছে! এদিকে পিট্যুটয়ারী চলে তেঁনার কথায়, অবাধ্য হবে তার সাধ্যি কি! না চাইতেও অভিমন্যুর নির্দেশে চলা তিন্নির রোবটমন যান্ত্রিক স্বরে গড়গড় করে বলে গেলো ওদের সিকিম ট্রিপে ফেরার দিন অভিমন্যু তিন্নিকে গ্যাংটকে ড্রপ করে দিয়ে যাওয়ার পর হোটেলে আর তারপর ফেরার ট্রেনের সায়কের ইন্সিডেন্ট, যতটাসম্ভব কাটছাঁট করে বলা যায় আর কি, গুরুত্বপূর্ণ ডিটেলগুলো বাদ দিয়ে। শুনতে শুনতে মাঝে একবার অভিমন্যু দাঁত চিপে নিঃশ্বাসের ফাঁক দিয়ে বিড়বিড় করে বলে উঠেছিল “স্কাউন্ড্রেল”! তারপর সব চুপচাপ, বোঝা যায় না ফোনের ওপারে আদৌ কেউ আছে কিনা!
ওপ্রান্তের নিস্তব্ধতায় সবটা শেষ করার সাহস হলো না তিন্নির, চোখের সামনে স্পষ্ট ভেসে উঠলো অভিমন্যুর চোয়াল আর মুখের পেশিগুলো যেন শক্ত হয়ে ফুটে উঠেছে। সাইক্লোন না টর্নেডো, না জানি কি আছড়ে পড়বে এখন তিন্নির ওপর, তবে সেই ঝড়ের ঝাপ্টা সহ্য করার ক্ষমতা ওর আদৌ আছে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ! ভয়ে বুক দুরদুর করছিলো তিন্নির। অপেক্ষা করছিলো অভিমন্যুর একটা প্রতিক্রিয়ার! কয়েক সেকেন্ড পর বহুদূর হতে অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দেওয়া বরফঠান্ডা স্বর ভেসে এলো — “হুমম…. তারপর? আর এতদিন আমায় এসব জানাও নি কেন?”
কি ছিল সেই স্বরে? ওভার পজেসিভনেস? ক্ষুব্ধতা? চাপা রাগ? বিরক্তি?
ঠিক ধরতে পারলো না তিন্নি! কিছুটা অস্থিরতা আর অনেকটা অস্বস্তি নিয়ে প্রথম প্রশ্নটা সুচারুভাবে এড়িয়ে গিয়ে দ্বিতীয় প্রশ্নটার উত্তরে ক্ষীণ গলায় বললো — “তখন তো আমায় তুমি ফোন করতে না! কি করে বলবো?”
— পরেও বলা যেত! প্রতিদিন আরো হাজারটা কথা বলেছো!
কিছু না বলে চুপ করে রইলো তিন্নি। ও যে ইচ্ছে করেই বিষয়টা এড়িয়ে গেছে, অভিমন্যুর কাছেও সেটা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার! ধারালো গলা বেজে উঠলো অভিমন্যুর — “তারপর? শুড আই নো আ্যবাউট এনিথিং এলস?”
একটা ঢোঁক গিললো তিন্নি, — “তারপর….সায়ক বলছিলো, যদি আবার আগের মতোই আমরা বন্ধু হই…. মানে ..অফিসে একজন কারোর সাথে কাজের ফাঁকে গল্প করা, একসাথে টিফিন করা এইসব, আগের মতো। দিনদিন কেমন আনসোশাল হয়ে যাচ্ছি যেন …… “
কথাগুলো নিজের কানেই বেমানান ঠেকছিল তিন্নির। এরপরও কেন সায়কের হয়ে সাফাই দিচ্ছিলো নিজেও বুঝলো না, হয়তো বা নিজে সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলো না বলে অভিমন্যুর আ্যপ্রুভাল চাইছিলো মনে মনে। অস্বস্তিকর শীতল নীরবতা কাটাতেই আস্তে আস্তে বললো — “আসলে, সায়ক তো প্রথম থেকে আমায় কতো সাপোর্ট দিয়েছে! অফিসে ও-ই একমাত্র যার সাথে কথা বলতে পারি…..”
—- হুমম্।
কিছুটা অধৈর্য্য হয়েই তিন্নি বলে উঠলো — “শুধু হুমম্? ”
— ডিড হি ট্রাই টু টাচ ইউ?
সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত প্রশ্নটায় ইলেক্ট্রিক শক খাওয়ার মতো চমকে উঠলো তিন্নি — “হো-য়াট? আমরা অফিসের ক্যাফেটেরিয়ায় বসে কথা বলছিলাম অভিমন্যু, ১০০-২০০ লোকের মাঝে!”
— আজকের কথা বলছি না! ইন সিকিম, ইন দ্যাট হোটেল রুম! ডিড হি ট্রাই টু টাচ ইউ?
থমকে গেলো তিন্নি। আজ সারাদিনে যে কথাগুলো একবারও মনে পড়ে নি, অভিমন্যুর কথায় চোখের সামনে ফ্লাশব্যাকের মতো ঝলসে উঠলো সিকিমের হোটেলের ঘরের সেই দৃশ্যপটগুলো পরপর ~ সায়কের জোর করে বারবার ওর হাত জড়িয়ে ধরা, তিন্নির পিঠে ঠেকে হোটেলের বন্ধ দরজা আর সামনে, পথ আটকে উদ্ধত সায়ক দাঁড়িয়ে, শরীরের খুব কাছে। টকটকে লাল চোখ, উত্তেজিত মুখ, কদর্য ভঙ্গিমায় কথা বলা যা দেখে তিন্নির বুক শুকিয়ে গিয়েছিলো অন্য কিছুর আশঙ্কায়। কিন্তু এইমুহূর্তে এসবকথা অভিমন্যুকে বলতে সাহস পেলো না তিন্নি। চোখ বন্ধ করে নিয়ে অম্লানবদনে বললো — “আমি জানি না!”
— হোয়াট ডু ইউ মিন “আমি জানি না!”? ডিড হি অর ডিড হি নট?
একটা বড়ো দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবছা হয়ে আসা গলায় তিন্নি জবাব দিলো — “আমার মনে নেই অভিমন্যু, ওই দিনটার সবকিচ্ছু ঝাপসা আমার কাছে। এতো কেঁদেছিলাম ওই দুটো রাত, আশেপাশে আর কি কি হয়েছিল আমার কিচ্ছু মনে নেই! “
অনেক চেষ্টাতেও শেষের দিকে গলাটা সেই কেঁপেই গেলো। শ্মশানের নিস্তব্ধতা কিছুমুহূর্ত তারপর বরফঠান্ডা শানিত স্বর ভেসে এলো — “মিথ্যে তুমি বলতে পারো না সীমন্তিনী, চেষ্টা করো না!”
টিকটক্। টিকটক্।
টাইমবোম্বটা ফাটার সময় হয়ে এলো প্রায়। কি এক আশঙ্কায় ঝপ করে বুকের ভেতরটা একদম খালি হয়ে এলো, শেষচেষ্টা করলো তিন্নি। কাতর গলায় ডুকরে উঠলো — অভিমন্যু….প্লিজ?
— রাখলাম, ভালো থেকো।
পিঁক পিঁক আওয়াজে ফোনটা ডিসকানেক্ট হয়ে গেল। নেটওয়ার্ক প্রব্লেম?
.
.
.
অভিমন্যু কি ফোন কেটে দিলো ওর মুখের ওপর?
একটু একটু করে বাকি কথাগুলো মাথায় রেজিস্টার হলো তিন্নির। হাতে ধরা মুঠিফোনটার দিকে কয়েক সেকেন্ডস অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো তিন্নি, রাগে অভিমানে চোখে জল চলে এলো ওর। সামান্য একটা কথা নিয়ে এমন রুড ব্যবহার…. কি ভেবেছে কি, অভিমন্যু? তিন্নির সাথে যখনতখন যেমনখুশি ভাবে কথা বলা যাবে আর ও চুপচাপ শুনে যাবে? এতদিনে এই প্রথমবার একটা চরম দুঃসাহসিকের কাজ করে বসলো, এই প্রথমবার অভিমন্যুকে কল করলো তিন্নি! একবার রিং হয়ে কল কেটে গেল। হাল ছাড়লো না তিন্নি, দাঁতে দাঁত চেপে বেরিয়ে আসা কান্নাগুলো আটকে আবার ফোন করল,তারপর আবার! ফোন করেই চললো!
বার ছয় সাতেক অবিরাম ফোন করেই চলার পর কল রিসিভ করে চাপা রাগের সাথে দাঁতে দাঁত চেপে অভিমন্যু বললো — “মানা করেছিলাম না ফোন করবে না?”
একমুহূর্তের জন্যও গলা কাঁপলো না তিন্নির, সমান তেজে প্রশ্ন ফিরিয়ে দিলো — “কথা শেষ না করে ফোন কাটলে কেন?”
— আমি এখানে ডিউটি করছি, তোমার সাথে কথা বলার জন্য …..
—- অভিমন্যু।!!!!!
বুকের ভেতর থেকে ডুকরে চিৎকার করে উঠলো তিন্নি, ওর গলায় কান্না, রাগ, আতঙ্ক, সমস্ত কিছুমিলিয়ে এমন কি ছিল অভিমন্যুর ভেতরটা কেঁপে উঠলো, আর ইগনোর করতে পারলো না। আগে তো এতো নরম ছিল না ও? নিজের পরিবর্তনে নিজেই অবাক হয়ে গেলো অভিমন্যু , এ কয়’দিনে তিন্নি কি পাথর থেকে ওকে মানুষ বানিয়ে নিয়েছে? পরপর দুটি শ্বাস ছেড়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে বললো — “নট নাউ, আই উইল কল ইউ ব্যাক লেটার।”
.
.
মাঝরাতের নিম্নচাপটা গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে আছড়েই পড়লো এবার। প্রথম আঘাতটা কি শ্রীরামপুরের ফিরিঙ্গিডাঙার একটি বিশেষ বাড়ির ওপর পড়লো কি?
***********************__******************************
ফোন ছেড়ে দিয়ে পাথরের মূর্তির মতন স্থির হয়ে বসে রইলো তিন্নি। মনে করার চেষ্টা করলো কতদিন পর কাঁদলো যেন ও? মাসখানেক? মাসদেড়েক? নাকি তারও বেশি? পোড়াকপালে বেশিদিন সুখ সহ্য হয় না?
অভিমন্যু নিজেও বুঝতে পারছিলো না আচমকা কেন এতো রেগে গেলো? ও কি ওভাররিয়াক্ট করছে? সেইদিন গ্যাংটকের হোটেলে বা ফেরার ট্রেনে ঠিক কি হয়েছিল, তিন্নি যে সবটা খুলে বলেনি তা মানুষকে পড়ে ফেলার অনন্য অভিজ্ঞতায় অভিমন্যু ঠিকই বুঝে ফেলেছে – তিন্নি যেটুকু বলেছে আসল ঘটনা তার থেকে অনেক বেশি। শুধু সেই জন্যেই কি? কিন্তু তাতে তিন্নির কি দোষ? নাকি যে তিন্নিকে অপমান করেছে, তার সাথেই বন্ধুত্ব করছে, তাকে আড়াল করছে বলে? অথবা তিন্নির ওপর অন্য কেউ আকৃষ্ট , সেটাই সহ্য করতে পারছে না অভিমন্যু? মেজর অভিমন্যু সেন কি দিন দিন পজেসিভ হয়ে যাচ্ছেন তিন্নির প্রতি?
হঠাৎ করে মনে হলো এতদিন যেন একটা স্বপ্ন দেখছিলেন বাস্তব থেকে কয়েকশো যোজন দূরে! এ কি করতে যাচ্ছিলেন উঁনি? এমন দুর্বলতা তো মেজর অভিমন্যু সেনকে মানায় না! ভাবনাচিন্তাগুলো পরপর সাজিয়ে নিয়ে রাতের ভারী পাহাড়ি বাতাসে বুক ভরে অনেক’কটা নিঃশ্বাস নিলেন মেজর, তারপর পার্সোনাল মোবাইলফোনটা হাতে তুলে নিলেন।
All good things MUST come to an end.
ক্রমশঃ
© সুমন্দ্রা মিত্র। ভালো লাগলে নামসহ শেয়ার করবেন।
***********************__******************************
সকল পর্বের লিঙ্ক~
Video Teaser
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/145475543838322/?vh=e&d=n
Part 1
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/145129087206301/?d=n
Part 2
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/145859077133302/?d=n
Part 3
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/146221053763771/?d=n
Part 4
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/146595433726333/?d=n
Part 5
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/147293876989822/?d=n
Part 6
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/148075966911613/?d=n
Part 7
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/148530310199512/?d=n
Part 8
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/148951006824109/?d=n
Part 9
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/149405760111967/?d=n
Part 10
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/150313546687855/?d=n
Part 11
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/151106323275244/?d=n
Part 12
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/151923336526876/?d=n
Part 13
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/152353663150510/?d=n
Part 14
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/154065792979297/?d=n
Part 15
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/156163186102891/?d=n
Part 16
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/157132182672658/?extid=QdVQFGSjLzQUsE31&d=n
Part 17
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/157444422641434/?extid=fI3jIc0PCiYXDa0N&d=n
Part 18
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/158095955909614/?extid=1E2JOZfMCmqscBoi&d=n
Part 19
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/158831902502686/?extid=R8zo6L2l274CIQ7r&d=n
Part 21
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/160047349047808/?extid=e9DIdFXAkqxTg77U&d=n
Part 22
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/160963752289501/?extid=EgYDh0z3hVr5TCBY&d=n
Part 23
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/161833698869173/?extid=gRK0HHMoLW0bu0gK&d=n
Part 24
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/162740122111864/?extid=KIR9o3zetBHgH9mt&d=n
Part 25
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/163061178746425/?extid=fhzBxEjnlA7n6Ulu&d=n
Part 26
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/163695728682970/?extid=tm0Y81ykORQhpsq9&d=n
Part 27
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/164305438621999/?extid=WsYE2BjXkYvPmqyF&d=n