সূর্য ডোবার আগে পর্ব-২৯

0
1794

#সূর্য_ডোবার_আগে
পর্ব-২৯
লেখিকা ~ #সুমন্দ্রামিত্র
কঠোরভাবে প্রাপ্তমনষ্কদের জন্য।
.
.
.

ভোর সাড়ে তিনটে।
স্মার্টওয়াচের হালকা ভাইব্রেশনে ঘুম ভেঙে গেলো অভিমন্যুর। তিন্নি তখনও গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, বালিশ ছেড়ে সারারাত ওর বুকের ওপরই মাথা রেখে ঘুমিয়েছে। এক হাতে শক্ত করে আঁকড়ে আছে অভিমন্যুকে, যেন ধরে রেখেছে ওকে! যেতে দেবে না কোথাও।
অজান্তেই মুখের কোণে হাসি ফুটে উঠলো অভিমন্যুর, ঘুমন্ত তিন্নির কপালে একটা ছোট্ট চুমু দিয়ে খু-উব আস্তে করে ডাকলো

— গুডমর্নিং, সোনা।

— উমম্মম্ … গুডনাইট। ঘুমোতে দাও।

কোমল শরীরটা আরএকটু জড়িয়ে ধরলো পেশীবহুল হাত, মোমের মতো নরম হয়ে মিশে গেল অভিমন্যুর বুকে। তিন্নির ঘুমজড়ানো আধো আধো স্বরে মেজরের ইমোশনলেস বুকের ভেতরটাও ধক্ করে উঠলো যেন! একফোঁটাও ইচ্ছে করছে না উঠতে, খালি মনে হচ্ছে সময়টা এখানেই থমকে যাক.. মুহূর্তগুলো ধরা থাকুক এভাবেই হাতের মুঠোয়, আজীবন।
সকালের প্রথম দীর্ঘশ্বাসটা গোপন করে নিয়ে আলতো হাতে তিন্নির কপালে লেগে থাকা এলোমেলো নরম চুল সরিয়ে দিতে দিতে অভিমন্যু মৃদু স্বরে বললো
— যেতে হবে তো এবার সোনা? ফ্লাইটের সময় হয়ে এলো।

— ন্ ন্না….. যাবো না!

হেসে ফেললো অভিমন্যু — বাহ্! আর তোমার চাকরি?

আগের মতোই চোখ বুজিয়ে ঘুমঘুম মাখা আধোজড়ানো স্বরে তিন্নি জবাব দিলো — করবো না।

— আমার ডিউটি?

—- ছেড়ে দেবে!

— বাহ্! আর তোমার বাবা?

এবার কাজ দিল ওষুধে।
তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বিছানায় বসে রইলো তিন্নি! ঘুমের চটকা তখনও ভাঙে নি, মুখচোখ স্বল্প ফোলা। হততম্বের মতো এদিক ওদিক চেয়ে ঘড়ি খোঁজার চেষ্টা করছে ক’টা বাজলো- পুরো কার্টুনের মতো! তা দেখে প্রাণখোলা হাসিতে ফেটে পড়লো অভিমন্যু।
.
.
.
ঘুম ভাঙার সাথে সাথে বিছানা ছাড়তে পারে না তিন্নি, ইহজগতে ফিরে আসতে সময় লাগে ওর। লাগোয়া বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এসে অভিমন্যু আরএকবার তাড়া লাগাতে চটকা ভাঙলো ওর। প্রায় উচ্চিংরেঙের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে কোনোরকমে মুখচোখ ধুয়ে, চুলটুল আঁচড়ে দশ মিনিটে তিন্নি রেডি। অভিমন্যু ফিটফাট রেডি হয়েই ছিল, তিন্নি বাথরুম থেকে বেরোতে এককাপ তাজা কফি বাড়িয়ে দিলো ওর দিকে। কান এঁটো করা হাসি উপহার দিয়ে জ্বলন্ত কফির কাপ গলায় উপুড় করে তিড়িংবিড়িং করে আবার ব্যাগ গুছোতে শুরু করলো তিন্নি।কাল’ই গুছিয়ে রাখলে আজ দেরি হতো না! অবশ্য গোছানোর মতো জিনিস তো কিছুই নেই, আছে শুধু অফিস ব্যাগ! সে তো মিনিট দুইয়ের কাজ! কি আর করা! না তাকিয়েও তিন্নি স্পষ্ট বুঝতে পারছিল, একদৃষ্টিতে অভিমন্যু দেখে যাচ্ছে ওকে। একবার ব্যাগ গুছোনো হলেও তা ফেলে ছড়িয়ে দিয়ে আবার গুছোচ্ছিলো তিন্নি! নিজেকে এটুকু ব্যস্ত রাখলেও যে মনখারাপের কালো মেঘের বৃষ্টি ঝরে পড়বে না দুচোখ দিয়ে। কিন্তু সে ছল আর কতক্ষণের! যেতে তো হবেই। এখন না হোক, পাঁচ মিনিট পর – আজকেই, একটু পরেই।

অভিমন্যুর বলে রাখা ড্রাইভার চলে এসেছে, এখনই না বেরোলে আজ আর ফ্লাইট ধরা হবে না তিন্নির। যাওয়ার আগে শেষবারের মতো চোখ বুলিয়ে তিন্নি দেখে নিলো নরম কার্পেটে মোড়ানো মে ফেয়ারের সুদৃশ্য সুসজ্জিত বিলাসবহুল স্যুইট, গত পনেরো ষোলো ঘন্টায় হোটেলের রুমটিই যেন হয়ে উঠেছিল তিন্নির সাজানো সংসার। হোটেল ঘরের সুবিশাল ব্যলকনি, লালনীল কার্পেট, সেরামিক কফিকাপ, সোফা, মেমোরিফমের বেড, তুলো তুলো লেপ – সবেতে ছড়িয়ে ওর আর অভিমন্যুর একসাথে কাটানো মুহূর্তগুলো, সবকিছু যেন বড্ডো আপন হয়ে গিয়েছিলো এই কয়েক ঘন্টায়। বোধহয় উত্তর সিকিমের সেই মিলিটারি তাঁবু থেকে ফেরত আসতেও এতো মনখারাপ করে নি তিন্নির। তখন তো ছিল অনিশ্চয়তার দোলাচল, এখন যে মনের মানুষটাকে নিজের হাতে করে আবার পাঠিয়ে দেওয়া অনেক দূরে, বিপদের মাঝে। সাজানো খেলাঘর নিজের হাতে ভেঙে দিয়ে এবার চলে যাওয়ার পালা।হঠাৎ করে বুকের ভেতরটা যেন খালি হয়ে গেল তিন্নির। আরএকটুও কি ধরে রাখা যেত না এ সময়টুকু? ডুকরে একটা কান্না উঠে আসছে ভেতর থেকে। জলভরা চোখে মনে মনে “বাই” করলো নিজের একদিনের সংসারকে।

অভিমন্যু নির্বিকার! চুপচাপ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলো তিন্নিকে, সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর সেই যা দুটি কথা, তারপর থেকে বোবায় পেয়েছে ওকে! কিছু বলে নি। ছলছল চোখে তিন্নি তাকালো অভিমন্যুর দিকে। মনে মনে একটা সুপ্ত ইচ্ছে, যাওয়ার আগে শেষবারের মতো যদি সে টেনে নেয় নিজের কঠিন বুকে, তিন্নির সবচেয়ে নিশ্চিন্তের জায়গাটিতে। কিন্তু সে যে আজ কঠিন পাথরের দেওয়াল!

— আমি রেডি।

— সব গুছিয়ে নিয়েছো?
সেই আগের মতো স্বাভাবিক গম্ভীর কেজো গলা অভিমন্যুর, আবেগের ছিঁটেফোঁটা নেই। তিন্নির বুকের ভেতর থেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো কে – সব কি আর নেওয়া যায়? যার জন্য আসা, তাকেই তো ফেলে রেখে যেতে হচ্ছে।
একটুও কথা বলতে ইচ্ছে করছে না ওর, ব্যাগ ঘাঁটার বাহানায় অস্ফুটে আওয়াজ করলো – হুমম।

— আরএকবার দেখে নাও।

টুক করে আড়চোখে একবার অভিমন্যুর দিকে তাকালো তিন্নি। পাথরের মতো সে মুখ, ইমোশনের ছিটেফোঁটা নেই! হঠাৎ খুব খু-ব রাগ হলো তিন্নির! মাথার মধ্যে যেন একশোটা ফুলঝুরি জ্বলে উঠলো একসাথে, অভিমান আর রাগের। দীর্ঘ সাড়ে চারমাস পর ওদের দুজনের দেখা, খবর পাওয়ার আটঘন্টার মধ্যে ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যে কথা বলে, অফিস-ফ্যামিলি-সমাজ সবাইকে কাঁচকলা দেখিয়ে দুইহাজার মাইল দূর থেকে ছুটে এলো এতদূর, চলে যাবে এবার…… তাতেও কি কোনো হেলদোল হয় না এই পাথরকঠিন মানুষটার? মন বলে কি কোনো পদার্থ নেই এর মধ্যে? কাল রাতে মনে হয়েছিল এবার বোধহয় মানুষটার মনের দেওয়াল ভাঙতে পেরেছে তিন্নি, কিন্তু কোথায় কি? অভিমন্যুর কংক্রিট মনে বোধহয় একশোটা কাঁটাতারের ব্যারিকেট।

ঠিক আছে তবে। চাইলে তিন্নিও শক্ত হতে পারে! দুচোখে ফুটে আসা অভিমানের নোনতা জল ঢোঁক গিলে আটকে নিলো তিন্নি। ঠোঁট টিপে বললো

— সব নিয়েছি, চলো।

কথাটা বলেই ছটফটিয়ে উঠলো মন। আরএকবার অভিমন্যুর দিকে তাকালো তিন্নি, এবার পূর্ণদৃষ্টিতে! মনে হলো যেন, অভিমন্যুর ঠোঁটের কোনায় হালকা মুচকি হাসি লেগে আছে। তিন্নির মনখারাপ দেখে ওর কি মজা লাগছে?

ভালো! নিক মজা, আমার কি!
চিড়বিড়ানি রাগে জ্বলতে জ্বলতে গটগট করে স্নিকার্স পায়ে হোটেলের রুম ছেড়ে প্যাসেজে এসে মুখ ফুলিয়ে অভিমন্যুর অপেক্ষা করতে লাগলো তিন্নি। ঠিক তখনই শুনশান হোটেল করিডোরে হু হু করে একরাশ মনকেমন মেশানো উত্তুরে হাওয়ার শীতল ঝাপ্টা হটাৎ গায়ে এসে লাগলো। ঠিক যেন সাড়ে চারমাস আগে অভিমন্যুর সাথে প্রথম দেখা হওয়া ট্রেনের সেই সন্ধ্যেটা স্মৃতির পাতা থেকে উঠে এলো সামনে!
একটু আগের রাগ, অভিমান, হতাশা সব যেন সেই হাওয়ার দাপটে এলোমেলো হয়ে গুলিয়ে গেলো মনে, পড়ে রইলো শুধু আসন্ন বিচ্ছেদের বেদনা। সম্বিৎ ফিরে এলো তিন্নির, মাথার সবকটি নিউরোন একযোগে চিৎকার করে উঠলো ~ কি হবে তুচ্ছ অভিমান করে? আজ ফিরে যাওয়ার পালা, কাল থেকে সেই লং ডিস্ট্যান্সের অভিশাপ, মিনিট দশেকের ফোনে কথা বলা আর তার সাথে তিন্নির একলা কান্না, একলাই কষ্ট পাওয়া! অভিমন্যু না হয় আনরোম্যান্টিক ভূত কিন্তু তিন্নি তো নয়!

দুই সেকেন্ডের মধ্যে ঝড়ের বেগে শুনশান হোটেল করিডোর থেকে আবার হোটেলরুমে প্রবেশ করে বন্যার জলোচ্ছাসের মতো তিন্নি ঝাঁপিয়ে পড়লো অভিমন্যুর বাড়িয়ে রাখা বহু প্রতীক্ষিত বলিষ্ঠ বাহুবন্ধনে, যেন সে জানতোই তিন্নি ফিরে আসবে। মেদহীন টানটান পাথরকঠিন বুকে মুখ লুকিয়ে কান্নাভেজা অবরুদ্ধ গলায় তিন্নি বললো
—- এটা ভুলে গিয়েছিলাম যে।

চাপা হাসির একটা শব্দ হলো অভিমন্যুর গলায়।
স্ট্রবেরি লিপগ্লস লাগানো নরম গোলাপি ঠোঁটগুলো অভিমন্যুর ঠোঁটের প্রবল পরাক্রমে বন্দী হয়ে যাওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে তিন্নি বুঝতে পারলো ওর পা দুটো আর মাটিতে নেই, আনরোম্যান্টিক ভূতটার তামাটেরঙা পেশীবহুল হাতজোড়া দৃঢ় আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরে ওকে কোলে তুলে নিয়েছে ততক্ষনে!

হাসি কান্না মিলেমিশে গেল একসাথে, তিড়িং করে মনব্যাঙাচি পদ্মপুকুরে ডুব দিলো বোধহয়। ছোট ছোট রাগ, ভুল বোঝাবুঝি আর মান অভিমানগুলো না হয় মিটে যাক এভাবেই। বেঁচে থাকুক পাগলকরা ভালোবাসারা।

**************************__****************************

গ্যাংটক থেকে বাগডোগরা ১২০ কিলোমিটার রাস্তা, সময় লাগে সাড়ে তিনঘন্টা। ভোররাতের ফাঁকা রাস্তায় আর্মির দক্ষ ড্রাইভারের হাতে তা এসে দাঁড়ালো আড়াই ঘন্টায়। সারাটা রাস্তা তিন্নির হাত গ্রেপ্তার ছিল অভিমন্যুর কড়াপড়া শক্ত হাতের মুঠোয়, তিন্নির মাথা অভিমন্যুর বুকে এলানো। দু-একটি গরম চোখের জল টপটপ করে মাঝে মাঝে ভিজিয়ে দিচ্ছিলো অভিমন্যুর শার্ট, আর পুড়িয়ে দিচ্ছিলো অভিমন্যুর বুকের ভেতর। ধরে থাকা হাতের মুঠি শক্ত হচ্ছিলো আরো, পাশাপাশি থেকেও আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে বসছিলো ওরা ব্যাকসিটে। গাড়িতে তৃতীয়ব্যক্তির উপস্থিতি তখন তুচ্ছ ওদের কাছে! অবাক হয়ে অভিমন্যু উপলব্ধি করছিলো- কালকের তিন্নি আর আজকের সীমন্তিনীতে যেন আকাশপাতাল তফাৎ। জনসমক্ষে অভিমন্যুর স্বল্প ছোঁয়াতেও কুঁকড়ে উঠছিলো যে মেয়ে, একরাতের মধ্যে সেই আড়ষ্ঠতা বদলে গেছে ঝকঝকে আত্মবিশ্বাসে।মনের যাবতীয় ইনসিকিউরিটির কালি ধুয়ে মুছে প্রেমের আলপনা এঁকে নিয়েছে হৃদয়ে, সমাজ আর লোকের চোখটাটানোতে হয়তো আর কেয়ার করে না তিন্নি।

ভোর ছয়টা। শিলিগুড়ি এয়ারপোর্টের বাইরে ঘন কুয়াশা! চেকিংয়ের গেটের ঠিক আগে অভিমন্যু দাঁড়িয়ে, টইটম্বুর জলভরা চোখে তিন্নি ওর দিকে চেয়ে — আবার কবে দেখতে পাবো?

— আর তো দেড় মাস মাত্র! দেখতে দেখতে কেটে যাবে!

মানুষখেকো বাঘ যেমন একবার নররক্তের স্বাদ পেলে আর বন্য জন্তুর দিকে ফিরেও চায় না, প্রেমপিয়াসী মানুষগুলোও তেমনি।
গত ছত্রিশ ঘন্টায় তিন্নির কাছে একটা সম্পূর্ণ নতুন জগৎ উন্মুক্ত হয়ে গেছে, যে জগৎ অভিমন্যুময়, আগের থেকে অনেক অনেক তীব্র এই আকর্ষণ, যা পরিবার মানে না, সমাজ মানে না, ভৌগোলিক দূরত্ব মানে না – সবকিছু ছারখার করে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া বিধ্বংসী সর্বনাশী ভালোবাসা। সেই আগুনে রসায়নে দাউদাউ করে জ্বলছে তিন্নির মন, হয়তো বা অভিমন্যুরও।

মুখ নিচু করে নিলো তিন্নি! গলার কাছে কান্নাটা দলা পাকিয়ে উঠছে তাও বেরোচ্ছে না। বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠছে বারবার। অভিমন্যু শান্ত গলায় বললো –সাবধানে থাকবে।

— হুম-ম।

— ফিরে গিয়ে কান্নাকাটি করবে না।

— ও.কে।

— আর কখনো অমন হুটহাট করে চলে আসবে না। খবর পেলেও না।

—- আচ্ছা।

একটি শব্দে উত্তর সারছিলো তিন্নি, বেশি কথা বললে চোখ ফেটে জল বেরিয়ে যাবে। না বলা কথাগুলো, বুকের ভেতরে হাঁকুপাঁকু করছিলো বেরোনোর জন্য, ছটফট করছিলো প্রাণ। কিছুক্ষন গলায় স্বর ফুটলো না কারোরই!

অভিমন্যুর আঙুলের অগ্রভাগ এবার ছুঁয়ে গেলো তিন্নির অবনত মুখ, ঠোঁটের পাশ। চলে যেতে যেতেও স্পর্শটা থমকে গেলো একটি এক্সট্রা সেকেন্ড তারপরই হাত সরিয়ে নিয়ে ঘন গম্ভীর গলায় অভিমন্যু বললো

—- আর…. এতো ভালোবেসো না আমায়!

এতক্ষনে ছলছলে দীঘলকালো চোখদুটি তুলে অভিমন্যুর চোখে চোখ রাখলো তিন্নি, ফিচ করে হেসে বললো —– সেটা সম্ভব নয়!
বলেই অভিমন্যুর দিকে সরে এসে ও কিছু বুঝে ওঠার আগেই দু’পায়ে ডিঙি মেরে ওকে সপাটে জড়িয়ে ধরে গালে একটা ভিজে চুমু মাখিয়ে দিলো তিন্নি!
এইবার হেসে ফেললো অভিমন্যু , কপালে ভুরু তুলে বললো — সবাই দেখছে সীমন্তিনী!

জেদি বাচ্চার মতো মাটিতে পা ঠুকে তিন্নি বললো — দেখুক! আর আমার কিচ্ছু যায় আসে না।

গভীর দৃষ্টিতে একে অপরের দিকে চেয়ে ছিল ওরা, অপলক। ছেড়ে যেতে মন চায় না। ইচ্ছে করছিলো দুই হাতের মধ্যে জড়িয়ে ধরে আবার, সমাজ-সংসার চুলোয় যাক ~ ওরা দুজনে শুধু মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় আবার।
নিজেকে সংযত করে নিয়ে আপাতগম্ভীর মুখোশটায় ফিরে গেলেন মেজর, তিন্নির হাতটা নিজের হাতে নিয়ে বললেন
— প্রমিস মি সীমন্তিনী, ফিরে গিয়ে তুমি ভালো থাকবে। নিজের জন্য না হলেও আমার জন্য, প্লিজ?

সে স্বরে হাসি বা মজার ছিটেফোটাও নেই। চোখ তুলে তাকাতে তিন্নি দেখলো অভিমন্যুর মুখ থমথম করছে! খুব অস্ফুটে ঠোঁটদুটি নড়ে উঠলো তিন্নির
— প্রমিস।

— গুড গার্ল।

ফ্লাইট ছাড়ার সময় হয়ে গেছে! ফাঁকা এয়ারপোর্টের আননোউন্সমেন্ট গমগম করে উঠতে শেষবারের মতো তিন্নির গালে আঙ্গুল ছুঁইয়ে অভিমন্যু বললো – জলদি ফিরে আসবো, ডিসেম্বরে।

তিন্নির বুজে আসা গলা দিয়ে শব্দতিনটি ছিটকে বেরোলো কোনোরকমে, গত ছত্রিশ ঘন্টায় এই প্রথমবার
— আই লাভ ইউ।

— আই লাভ ইউ টু।

মিলিসেকেন্ডের মধ্যে অভিমন্যুর চোখে চোখ রাখলো তিন্নি, গলায় আবছা জেদের আভাস — আই লাভ ইউ মোর।

চাপা হাসিতে ভেসে গেলো অভিমন্যুর মুখ — আই নো দ্যাট!

তিন্নি কোনোদিন অভিমন্যুকে “বাই” বলে না। আজও বললো না! বাগডোগরা এয়ারপোর্টে ভোর সাড়ে ছয়টায় চোখে জল মুখে হাসি নিয়ে দুটো প্রাণ এক মন নিয়ে আলাদা হয়ে গেলো, আগামী দেড় মাসের জন্য।

**************************__****************************

প্রেম এমন এক অনুভূতি যা অতিবড়ো ভীতুকেও করে তোলে সাহসী! প্রেমের রঙিন চশমায় অতি বড়ো শত্রুকেও মনে হয় আপন, অতি বড়ো আপন হয়ে যায় শত্রু।

শ্রীরামপুর স্টেশনে বেলার হাওড়া লোকাল এসে থামলো যখন, ঘড়ির কাঁটা এগারোটা পেরিয়েছে। ধীর পায়ে লেডিস কম্পার্টমেন্ট থেকে নামলো তিন্নি। কি বলবে বাড়িতে এখনো কিছু ভেবে উঠতে পারে নি, আধাখেঁচড়া একটা গল্প বানিয়েছে বটে কিন্তু সেটা কতটা বিশ্বাসযোগ্য তা ভগবানই জানেন।

গতকাল সারাদিন ফোন সুইচ অফ ছিল ওর, চার্জার ছিল না সাথে। সকালদিকে গ্যাংটকের হসপিটাল থেকে বেরোনোর আগে আগে ফোন বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে সেই যে বাবাকে একটা মেসেজ করে দিয়েছিলো ~ বিশেষ কারণবশত পুজোর দিনও ঘরে ফিরতে পারবে না তিন্নি… সেই শেষ যোগাযোগ! এরূপ কান্ডজ্ঞানহীনতার ফলাফল কি হবে তা না বোঝার মতো বোকা বা অনভিজ্ঞ নয় তিন্নি, সম্ভাব্য সকল পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার জন্য মন শক্ত আর গায়ের চামড়া পুরু করে নিয়েছে তিন্নি, আজ যাই হয়ে যাক না কেন, যত কটু কথায়ই ও শুনুক না কেন, ভুলেও প্রত্যুত্তর করবে না তিন্নি। “বোবার শত্রু নেই ” এই আপদবাণী আজ তিন্নির moto।

যদিও প্রথম ধাক্কাটা খেলো শ্রীরামপুর স্টেশনেই। রোজকার বাঁধাধরা রিকশা- রতনকাকু ব্যস্ত ছিল অন্য প্যাসেন্জারের সাথে দরদামে, তিন্নিকে দেখে এগিয়ে এলো

—- দিদিমনি এতো বেলায়? সবে ফিরছো নাকি?

ভুরু উঁচিয়ে তাকিয়ে রইলো তিন্নি! রতনকাকু কি করে জানলো ও কোথাও গিয়েছিল? স্পষ্ট করলেন প্রবীন রিক্সাচালক
—- পরপর দুইদিন তোমার বাড়ি ঘুরে এলাম, শুনলাম তুমি নাকি অফিস থেকে বাড়ি ফেরো নি, দুইরাত? আমাকে তো স্টেশনের রমেশ চা’ওলা আবার বললো তুমি নাকি বাড়ি থেকে পালিয়ে গেছো, তা আমি বললুম “ইশশ্! দিদিমনিকে সেই ছোট্টবেলা থেকে দেখছি। দিদিমনি অমন মেয়েমানুষই না!”

তারপর তাড়া লাগলেন প্রবীণ রিকশাচালক। — তা ওঠো ওঠো! রোদের মধ্যে অমন হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকলে চলবে!

রতনকাকুর কথাগুলো কানের মধ্যে ছোটোখাটো সুতলি বোম্ব ফাটাচ্ছিল যেন। মুখ লাল হয়ে গেছে তিন্নির। রিকশায় পা দেওয়ার আগেই থমকে গেলো আবার, পিছন থেকে আসা একটি ডাকে
—- কি রে তিন্নি, এই এখন ফিরলি নাকি? বাহবা! কি অফিস তোদের রে! তোর কাকিমা কাল রাতে পুজোর প্রসাদ দিতে গেসলো, শুনলো তুই নাকি লক্ষ্মীপুজোর রাতেও ঘরে ফিরলি না! তোর কাকিমার তো কি চিন্তা !কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোতেও অফিস যেতে হয় এ আবার কেমনধারা কাজ! আমি বললুম, আরে আজকালকার চাকরি এমনই! এ কি আর আমাদের দশহাজারি মাইনের কলমপেষা দশটা -পাঁচটার ডিউটি! বড়ো বড়ো স্যালারির চাকরিতে বাড়ি না ফেরার মতো অমন ছোটোখাটো ব্যাপার ঘটেই! তবে একটা কথা বলি মাথায় রাখিস …..দিনকাল ভালো নয় রে মা! কে কোথায় কি রটাবে বল দেখি! আমরা না হয় তোকে ছোট থেকে চিনি কিন্তু বেপাড়ার লোকজন কিসব অকথা কুথা রটাবে…..

স্টেশনের ঠিক আগেই গাঁক গাঁক স্বরে চেঁচিয়ে উঠলেন পাড়ার এক বর্ষীয়ান জ্যেঠু। কথার হুলের মধ্যে লুকিয়ে রাখা তির্যক ব্যঙ্গ স্পষ্ট। মাত্র আটচল্লিশ ঘন্টায় সারা শ্রীরামপুর রটে গেছে নাকি তিন্নি বাড়ি ফেরেনি দুইরাত?? দপদাপিয়ে ওঠা অসহ্য রাগে মাথাটা ফেটে যাবে এবার! যতটুকু ভদ্রতা বজায় রক্ষা যায়, থম হয়ে আসা গলায় তিন্নি বললো
— অফিসের কাজে আটকে গিয়েছিলাম, এই ফিরলাম। বাড়ি যাই জ্যেঠু? অনেক বেলা হলো।

— হ্যাঁ হ্যাঁ! যা! সবাই চিন্তা করছে বাড়িতে। তবে যেটা বললাম খেয়াল রাখিস। মানে…….. আজকাল তোরা আবার নারীর মুক্তি, নারী স্বাধীনতা নিয়ে লাফাস বটে কিন্তু অমন চাকরিরই বা কি দরকার যাতে পাঁচজনে কুকথা বলে, কানাকানি করে? মেয়েদের তো জানিস, একটা কথা রটে গেলে তিল থেকে তাল হয়… বুঝলি কিনা? হেঁ হেঁ!

মাথায় জ্বলে ওঠা হাজারটা তুবড়ি ফেটে ওঠার আগের মুহুর্তে তিন্নির মনে হলো ষাটোর্দ্ধ পাড়ার জ্যেঠু আর বছর চব্বিশের সায়কের কথার কি আশ্চর্য্য মিল। সম্পর্ক-শিক্ষা-পরিবেশ, জেনারেশন গ্যাপ বলে আদতেই তবে কিছু নেই? সবই মানসিকতা? পা আটকে গেল মাটিতে।একটু আগে নিজেকে করা প্রমিসটা বেমালুম ভুলে গিয়ে তিন্নি মুখ ফস্কে বলেই ফেললো এবার
—- বুল্টিদি, মানে আপনার মেয়েও নাইটশিফ্ট করে … তাই না? ও তো এখন দিল্লীকে আছে শুনেছিলাম? কদিন হলো যেন বাড়ি ফেরে নি? দুর্গাপুজোতেও এলো না!

— আরে, ওর কি আর তোদের মতো কলকাতায় বসে কাজ? ওদের কত বড়োসড়ো ব্যাপার বল দেখি! নিত্যদিন দেশবিদেশের বড়ো বড়ো সাহেবদের সাথে ইংরেজিতে ফোনে কথা বলতে হয়, ওদের সময়মতো চলতে হয়। আমাদের এসব ছুটকোছাটকা পুজোটুজোতে আসতে দেবে নাকি!

শুকনো একটা মেকি হাসি ফুটে উঠলো তিন্নির মুখে, ঠান্ডা স্বরে বললো
—- হ্যাঁ জ্যেঠু! সেটাই বলছিলাম। আমাকেও এমন সাহেবদের সাথেই তাল মিলিয়ে কাজ করতে হয় তো, তবে কলকাতায় বসেই। বুল্টিদির কলসেন্টারের চাকরিতে যেমন আমাদের দুর্গাপুজোর শিডিউল মেনে ছুটি দেয় না, আমার চাকরিতেও তাই লক্ষীপুজোয় ছুটি নেই !এই দেখো না, যেমন বুল্টিদিকে নাইটশিফ্ট করতে হয় আর আমাকে শনিবারগুলোতেও অফিস !

দুই বছর ধরে সপ্তাহে পাঁচদিন নিয়মকরে তিন্নিকে দুবেলা স্টেশন পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব প্রবীণ এই রিক্সাচালকের ওপর। তিন্নির গলার আঁচ বুঝতে সময় লাগেনি ওঁনার, গলা খাঁকড়ি দিলেন — দিদিমনি, ওঠো গো এবার । বাবুর সাথে অনেক গল্প করলে…. এবার বাড়ি চলো! মুখখানি শুকিয়ে গেছে!

— আসছি জ্যেঠু। দেরি হয়ে যাচ্ছে।
উত্তরের প্রতীক্ষা না করেই রিকশায় উঠলো তিন্নি।

মফস্বল শহর। কথা চাপা থাকে না! দাবানলের মতো গুজব বাড়তে থাকে। তবে কলেবরে এতটা বাড়বে তা তিন্নির কল্পনায় ছিল না! সকাল থেকে লুকিয়ে রাখা চিন্তাগুলো গরম রক্ত হয়ে ফেটে বেরিয়ে আসবে যেন নাক কান দিয়ে! বড়ো বড়ো তিনটে শ্বাস নিয়ে চোখ বন্ধ করে অভিমন্যুর মুখটা মনে আনার চেষ্টা করলো তিন্নি যাতে মাথায় জ্বলে ওঠা আগুনটা একটু হলেও শান্ত হয়। বারুদের স্তুপের মতো জ্বলতে থাকা উত্তেজনা প্রশমিত হয়ে এলে মনস্থির করলো তিন্নি।

অসত্য আর মিথ্যার উর্নীভ জালে যখন নিজেকে জড়িয়েই ফেলেছে তিন্নি, সে যুদ্ধ জিতেই ফিরতে হবে। মনে পড়ে গেলো অভিমন্যুর বলা কথাগুলো “এই পৃথিবীতে কেউ তোমায় ভালো থাকতে দেবে না সীমন্তিনী, চেনা-অচেনা, কেউ না কেউ অলওয়েজ তোমার নামে কোনো বাজেকথা বলবে, তোমাকে বাজে ভাববে, অলওয়েজ জাজ করবে।লোকে কি ভাবছে সেটা না ভেবে নিজের ভালো থাকাটা যে নিজেকেই শিখে নিতে হবে সীমন্তিনী!”

কাল রাতের পর থেকে তিন্নি অন্তত একটি বিষয়ে সম্পূর্ণভাবে নিঃসংশয়, ওর প্রতি অভিমন্যুর পাগলকরে দেওয়া ভালোবাসা, যে ভালোবাসা মিথ্যে নয়। সেই ভালোবাসার নতুন করে ফিরে পাওয়া আত্মবিশ্বাসের জোরে চিরকালের ন্যায় নীতি আদর্শ মেনে চলা পাশের বাড়ির ভীরু ভীরু মেয়েটা স্টেশন থেকে বাড়ি ফেরার দশমিনিটের রাস্তায় তার বলা একটি মিথ্যেকে বাঁচাতে আরো হাজারটি সাংঘাতিক নতুন মিথ্যের বোড়ে দিয়ে দাবার চালের পাকা ঘুঁটি সাজাতে লাগলো। হাতে সময় অল্প, এই খেলায় কিস্তিমাৎ করতেই হবে।

~ Beauty may be dangerous, but Intelligence is lethal. A beautiful woman with Intelligence can destroy a man, a family, or a nation.
প্রেম মানুষকে দিয়ে কি কি’ই না করিয়ে নেয়। মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিকে জেলায় টপার, বোর্ডের পরীক্ষায় রাজ্যের মধ্যে সপ্তম এবং নবম স্থান অধিকার করা মিস সীমন্তিনী আচারিয়া শ্রীরামরুম স্টেশন থেকে বাড়ি ফেরার মিনিটদশেকের রাস্তায় একটি বুনোট মিথ্যার জাল বুনে ফেললো, একবারের জন্যও বুকের ভেতর কাঁপলো না ওর। সমাজ চুলোয় যাক, ওকে যে ভালো থাকতেই হবে। অভিমন্যুর জন্য!

বাড়িতে ঢোকার ঠিক আগের মুহূর্তে কন্টাক্ট লিস্ট খুঁজেপেতে একটা নম্বরে ডায়াল করলো তিন্নি, চার পাঁচবার রিং হওয়ার পর ওপ্রান্তে ফোনটা রিসিভ হলো উচ্ছসিত কণ্ঠে

— হেই গার্ল! হোয়াটস আপ?

এতটুকু গলা কাঁপলো না তিন্নির, অভিমন্যুর মতোই দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়ের ছাপ ওর গলায়
— পিয়াসা? আমার একটা হেল্প চাই, ক্যান ইউ ডু ইট? নো কোয়েশ্চনস আস্কড?

 

.
.
.

ক্রমশঃ(মঙ্গলবার দুপুর দুটোয়)

© সুমন্দ্রা মিত্র। ভালো লাগলে নামসহ শেয়ার করবেন।

 

***********************__******************************

সকল পর্বের লিঙ্ক~
Video Teaser
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/145475543838322/?vh=e&d=n
Part 1
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/145129087206301/?d=n
Part 2
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/145859077133302/?d=n
Part 3
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/146221053763771/?d=n
Part 4
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/146595433726333/?d=n
Part 5
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/147293876989822/?d=n
Part 6
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/148075966911613/?d=n
Part 7
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/148530310199512/?d=n
Part 8
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/148951006824109/?d=n
Part 9
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/149405760111967/?d=n
Part 10
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/150313546687855/?d=n
Part 11
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/151106323275244/?d=n
Part 12
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/151923336526876/?d=n
Part 13
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/152353663150510/?d=n
Part 14
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/154065792979297/?d=n
Part 15
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/156163186102891/?d=n
Part 16
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/157132182672658/?extid=QdVQFGSjLzQUsE31&d=n
Part 17
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/157444422641434/?extid=fI3jIc0PCiYXDa0N&d=n
Part 18
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/158095955909614/?extid=1E2JOZfMCmqscBoi&d=n
Part 19
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/158831902502686/?extid=R8zo6L2l274CIQ7r&d=n
Part 20
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/159626782423198/?extid=0e8jrLLhsuLqgsQX&d=n
Part 21
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/160047349047808/?extid=e9DIdFXAkqxTg77U&d=n
Part 22
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/160963752289501/?extid=EgYDh0z3hVr5TCBY&d=n
Part 23
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/161833698869173/?extid=gRK0HHMoLW0bu0gK&d=n
Part 24
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/162740122111864/?extid=KIR9o3zetBHgH9mt&d=n
Part 25
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/163061178746425/?extid=fhzBxEjnlA7n6Ulu&d=n
Part 26
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/163695728682970/?extid=tm0Y81ykORQhpsq9&d=n
Part 27
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/164305438621999/?extid=WsYE2BjXkYvPmqyF&d=n

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here