সূর্য ডোবার আগে পর্ব-২৮

0
1985

#সূর্য_ডোবার_আগে
পর্ব-২৮
লেখিকা ~ #সুমন্দ্রামিত্র
কঠোরভাবে প্রাপ্তমনষ্কদের জন্য।
.
.
.

আজ কোজাগরি পূর্ণিমা।
নীলচে আকাশে এখনো দিনের আলো লেগে আছে হালকা সিঁদুরের মতো। কাঁসার থালার মতো মস্তো বড়ো চাঁদ উঠেছে আকাশের একদিকে, আর একদিকে সূর্য অস্ত যাচ্ছে।

সিকিম থেকে সুর্যাস্ত দেখা যায় না, হিমালয়ের আড়ালে ঝুপ করে সূর্য ডুবে যায় হঠাৎ করে। ড্রাইভারকে ছুটি দিয়ে দিয়েছে অভিমন্য। ফেরার সময় ও নিজের ড্রাইভ করে ফিরবে। আশেপাশে ওরা দুজন ছাড়া আর লোকমাত্র নেই। ঝাপসা কুয়াশারা ঘিরে ধরছে ওদের, নরম ধোঁয়ার চাদরে। তিন্নি আর অভিমন্যু বসে আসে একটা পাথরের ছায়াতলে, গ্যাংটক থেকে অনেক দূরে, কোন এক নাম না জানা পাহাড়ের খাদের ধারে। কাঞ্চনজঙ্ঘার শুভ্রফেন শিখর আকাশ ছুঁয়েছে যেন। ময়াল সাপের মতো এঁকেবেঁকে ধূসররঙা সিল্করুট চলে গেছে পাহাড়ের গা বেয়ে বেয়ে কোন সুদূরে। পায়ের তলায় সুগভীর খাড়া খাদ, জায়গায় জায়গায় সুবিশাল তিব্বতি পতাকা লাগানো, পতপত করে উড়ছে যেন হংসবলাকা।
কি এক অপূর্ব ভালোলাগায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে তিন্নির মন, সেই যে কখন থেকে অভিমন্যুর বুকে মাথা দিয়ে রেখে বসে আছে, একচুলও নড়ে নি। হঠাৎ কোথা থেকে ছুটে আসা অক্টোবরের হিমে ভেজা দমকা উত্তুরে হাওয়ায় তিন্নি একটু কেঁপে উঠতে, ওর গায়ে জড়ানো গরম পশমের চাদরটা ঠিক করে দিতে দিতে অভিমন্যু বললো — কি ভাবছো বলো তো?

অভিভূত হয়ে তিন্নি তখনও তাকিয়ে ছিল দূরের দিকে, নিশ্বাস বন্ধ করে যেন শুষে নিচ্ছিলো অভিমন্যুর বুকের ওম আর প্রকৃতির এই অসহ্য সুন্দর রূপ! অনেকক্ষন পর অস্ফুটে ওর পাতলা ঠোঁটদুটি নড়ে উঠলো।

Agar firdaus bar roo-e zameen ast,
Hameen ast-o hameen ast-o hameen ast.

এ আমায় কোথায় নিয়ে এলে অভিমন্যু? কাশ্মীর নয়, এটাই তো স্বর্গ আমার কাছে!

মৃদু হাসলো অভিমন্যু। আলতো করে তিন্নির রেশমের মতো মোলায়েম খোলাচুলে হাত বুলিয়ে বললো — আগেরবার তোমার সিকিম ঘোরা হয় নি, তাই এইবার কাছাকাছির মধ্যে সিকিমের সবচেয়ে সুন্দর জায়গায় নিয়ে এলাম তোমায়। পছন্দ?

— পছন্দ? এত শান্ত, নিস্তব্ধ পরিবেশ, লোকের কোলাহল নেই, যানবাহনের আওয়াজ নেই! শুধু পাখির ডাক, পাইন আর রডোডেন্ড্রনে জমে থাকা কুচিকুচি হিম, নীল আকাশ, গোলাপি চাঁদ…. মনে হচ্ছে এখানেই থেকে যাই সারাজীবন!

গলার মধ্যে শব্দ করে হাসলো অভিমন্যু, তিন্নিকে আরেকটু কাছে টেনে ওর ছোট্ট কপালে নিজের ঠোঁটদুটো ছুঁইয়ে নরম আদরে ভরিয়ে দিলো ওকে
-– সা-রা জী-বন?? আর তোমার চাকরি? আমার ডিউটি?

কয়েকপল নীরবতা। আর একটু ঘন হয়ে বসলো ওরা। ভিতর থেকে ডুকরে ওঠা দীর্ঘশ্বাস গোপন করলো না তিন্নি, গলায় বিষাদের ছোঁয়া
— কাল থেকে আবার তুমি আলাদা, আমি আলাদা! আর তোমাকে এভাবে কাছে পাবো না অভিমন্যু! কত ভালো হতো না যদি আমরা নোম্যাডিক হতাম? কোনো সমাজ থাকতো না, নিয়ম থাকতো না, বর্ডার থাকতো না, যুদ্ধও না। শুধু আমরা দুজন, একসাথে, চিরকাল! এভাবে তোমার বুকে মাথা রেখে সারাজীবন কাটিয়ে দিতাম! এর থেকে সুন্দর আর কি আছে?

কড়াপড়া শক্ত আঙুলগুলো ছুঁয়ে গেল তিন্নির মুখ, ঠোঁটের কোণ। চোখে চোখ রেখে মেজর বললেন
— তুমি!

হেসে ফেললো তিন্নি, চিকচিক করে উঠলো ওর চোখ। — যাহ! আমি সুন্দর?

তিন্নির কথার ধরনে হেসে ফেললো অভিমন্যুও। একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে দুইদিকে মাথা নাড়িয়ে বললো — তুমি নিজে জানোই না তুমি কতটা সুন্দর। এমনি এমনি ছেলেরা তোমার প্রেমে পড়ে টুপটাপ? সায়ক, মানব, আমাদের সিকিম রেজিমেন্টের হাফ ব্যাটেলিয়ন, তোমার সেই চা দোকানী …. লিস্ট শেষই হবে না!

চোখ পাকালো তিন্নি — যা খুশি না? মজা ওড়াচ্ছো আমার?

অস্তগামী সূর্যের লালচে আলো এসে পড়লো তিন্নির পানপাতা মুখে, ঝলসে দিলো অভিমন্যুর বুকের ভেতর। একেই কি বলে “কনে দেখা আলো”? চোখ ফেরাতে পারলো না অভিমন্যু। চুম্বকের মতো টেনে ধরছে যেন, অন্য সব কিছু ভুলে যেতে চায় মন। তিন্নির দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে গলার স্বর পাল্টে গেলো অভিমন্যুর, ঘন ভারী গলায় বললো
— আমার চোখের দিকে তাকাও সীমন্তিনী, তোমার মনে হয় আমি মজা করছি?

কি ছিল সেই স্বরে, অনেকচেষ্টা করেও ভারী হয়ে আসা চোখদুটো নিয়ে অভিমন্যুর দিকে তাকাতে পারলো না তিন্নি। গলায় ফুটে উঠলো জমাটবাঁধা অভিমান।
— জানি না অভিমন্যু… মাঝে মাঝে মনে হয় আমি হয়তো তোমার যোগ্য নই! মনে হয় …. তোমার পাশে আমি খুব বেমানান, খুব সাধারণ। সাধারণকে কি ভালোবাসা যায়?

— তাই কি সীমন্তিনী? সত্যিই তুমি জানো না কি, আমি তোমাকে ভালোবাসি কিনা?

ঝিন ধরে গেছে সারা শরীরে, একদৃষ্টিতে দূরের দিকে তাকিয়ে ছিল তিন্নি, মন দিয়ে দেখছিলো হিমালয়ের কোলে নীল আকাশ জুড়ে রঙমিলান্তি খেলা। সূর্যাস্তের কমলারঙা সূর্যটা তখন ডুবে যাচ্ছে জমাট সবুজ পাহাড়ের কোলে। ধীরে ধীরে আকাশের গায়ে লাগছে সূর্য ডোবার লালচে কমলা ছোঁয়া। আর কিছু সময় পরই একটু একটু করে গোলাপি আকাশের রঙ বদলে যাবে ধূসর থেকে ঘন কালো রাতে।

বেশকিছুক্ষন অপেক্ষা করেও তিন্নির দিক থেকে কোনো রেসপন্স না পেয়ে এবার বামহাত দিয়ে ওর নিচু হয়ে থাকা চিবুকটা তুলে ধরলো অভিমন্যু, তারপর শান্ত স্বরে বললো
— সীমন্তিনী! তুমি সত্যিই সুন্দর কিন্ত আজ থেকে চল্লিশ বছর পরও কি শরীরের সৌন্দর্য্যটা ম্যাটার করবে? নাকি মনের সৌন্দর্য্যটা? আমি তোমার মনটাকে ভালোবেসেছি ম্যাডাম, তোমার চরিত্রটাকে ভালোবেসেছি। তোমার কবিতা, তোমার নরম মনটা, এই যে তুমি হঠাৎ হঠাৎ সবার মাঝে থেকেও হারিয়ে যাও… এই যে তুমি টলটলে চোখ নিয়েও দাঁড়িয়ে থাকো, নিঃশব্দে কাঁদো, এই যে হঠাৎ হঠাৎ চোখ পাকিয়ে, ঠোঁট ফুলিয়ে তাকাও আমার দিকে ….. তোমার ছোট ছোট অভিমান, ছেলেমানুষিগুলো আমি ভালোবাসি সীমন্তিনী। এই যে তুমি নিঃস্বার্থভাবে আমায় ভালোবাসো তার জন্য আরো বেশি করে যে তোমায় ভালোবাসি।

শুনতে শুনতে শরীর অসাড় হয়ে আসছিলো। অভিমন্যুর বুকের ওম, কোলোন মিশ্রিত ওর তীব্র পুরুষালি গন্ধ, অভিমন্যুর স্পর্শ সব মিশিয়ে কেমন একটা ঘোরের মধ্যে চলে যাচ্ছিলো তিন্নি।
অভিমন্যু বলে চললো
— দুপুরে হোটেলরুমে বলছিলে না তুমি খুব দুর্বল? কে বলে? তুমি তো সেই চালাকচতুর মেয়েটা যে কিনা হিল্লি দিল্লি করে বেড়ায় একা একা।অল্পচেনা বন্ধুদের সাথে ঘুরতে চলে আসে বাড়ি থেকে অত দূরে। এক রেজিমেন্টে সেনার সামনে দাঁড়িয়ে ইন্ডিয়ান আর্মির কর্নেলের সাথে সমান দাপটে কথা বলে! আমি সেই মেয়েটার মনের জোরকে ভালোবাসি, যে কিনা মাথা ঠান্ডা রেখে এক ফোনেতে সিকিম উড়ে আসে গুলিতে আহত প্রেমিককে দেখতে…..

নাহ!
আর কোন সংশয় নেই, আর কোনো ইনসিকিউরিটি নেই, আর কোন পিছুটান নেই।
সারাগায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছিল তিন্নির, অভিমন্যুর কথাগুলো শুনতে শুনতে। বুকের ভেতরে ঘটা প্রবল আবেগের বিস্ফোরণে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারছিলো না।হয়তো আরো কিছু বলে যেত অভিমন্যু, তিন্নি বলতে দিলো না।
প্রেয়সীর উদ্দাম আশ্লেষের গভীর চুম্বনে মুখের কথা মুখেই রয়ে গেল অভিমন্যুর।

কোজাগরী পূর্ণিমার মরচে পড়া সন্ধ্যায় #সূর্য_ডোবার_আগে র মুহূর্তে লালচে গোলাপি আকাশকে সাক্ষী রেখে প্রবল আবেগে দুজোড়া ঠোঁট মিশে গেলো হিমালয়ের বুকে। এই শেষবেলায় যখন আকাশে অস্তরাগ আর ছায়া নেমে আসছে নিচের ঝুমজমিতে, ঘরে ফেরা হিমালয়ান মোনাল আর হর্নবিলরা যখন বাড়ি ফিরছিলো, ওরা দেখে গিয়েছিলো সিকিমের কোনো এক পাহাড়ি খাদের পাশে নাম না জানা অনেকগুলো তুষারশুভ্র হিমালয়ের শৃঙ্গের সামনে, হেমন্তের টুপটাপ ঝরে পড়া হিম আর আবছা কুয়াশার ধোঁয়া ধোঁয়া চাদরে দুটো মানুষ পাশাপাশি বসেও এক হয়ে ছিল।

**************************__****************************

অনেক অ-নে-কক্ষণ পর যখন আলাদা হলো ওরা, সূর্য তখন প্রায় ডুবে গেছে পশ্চিমাকাশে, লালচে মাথাটুকু দেখা যায় ছোট্ট মেঘের আড়াল থেকে।

তিন্নির দুইচোখে দুটি চুমু দিয়ে অভিমন্যু আবদার করলো — এবার একটা কবিতা।

ছলছল চোখে হাসলো তিন্নি, মুখ নীচু করে শুকনো ঘাস ছিঁড়তে ছিড়তে বললো — কি শুনতে চাও?

— তোমার যা খুশি। এনিথিং।

কিছুক্ষন ভাবলো তিন্নি তারপর বিদ্যুৎচমকের মতো মাথায় এলো কটি লাইন। অস্তমান সূর্যের দিকে তাকিয়ে শুরু করলো–

এতই অসাড় আমি, চুম্বনও বুঝিনি ।
মনে মনে দিয়েছিলে, তাও তো সে না-বোঝার নয়-
ঘরে কত লোক ছিল, তাই ঋণ স্বীকার করিনি ।
ভয়, যদি কোন ক্ষতি হয় ।
কী হয়? কী হতে পারতো? এসবে কী কিছু এসে যায়?
চোখে চোখ পড়ামাত্র ছোঁয়া লাগলো চোখের পাতায়-
সেই তো যথেষ্ট স্বর্গ- সেই স্পর্শ ভাবি আজ; সেই যে অবাক করা গলা
অন্ধকারে তাও ফিরে আসে…
স্বর্গ থেকে আরো স্বর্গে উড়ে যাও আর্ত রিনিঝিনি
প্রথমে বুঝিনি, কিন্তু আজ বলো, দশক শতক ধ’রে ধ’রে
ঘরে পথে লোকালয়ে স্রোতে জনস্রোতে আমাকে কি
একাই খুঁজেছো তুমি? আমি বুঝি তোমাকে খুঁজিনি?

শুনশান নির্জন হিমালয়, অস্তগামী লাল সূর্য, তারই সাথে গোলাপি আকাশের এককোনে থালার মতো বড়ো চাঁদ, কোজাগরী পূর্ণিমা। জনমানবের চিহ্নমাত্র নেই, খোলা প্রান্তরে প্রিয়তম নারীর উদ্দাত্ত কণ্ঠের এমন রোমান্টিক কবিতা শুনে কি এক অব্যক্ত অনুভুতিতে বারবার অভিমন্যুর বুকের রক্তে ছলাৎ করে উঠছিলো! শেষ হয়ে যাওয়ার পরও সে কবিতার প্রতিধ্বনি ঘুরে ঘুরে ফিরছিল পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে… তারপর সব নিস্তব্ধ, শুধু ভেসে আসছিলো পাখির ডাক।

তিন্নির গলার রেশটুকু মিলিয়ে যাওয়ার পরও বেশ কিছুক্ষন বুঁদ হয়ে বসে রইলো অভিমন্যু, অনেকক্ষন পর যেন হুঁশ ফিরে এলো ওর, তিন্নির কপালে একটা আলতো চুমু দিয়ে বললো — অসাধারণ।

— মম…হুমম! থ্যাংক ইউ!

তিন্নির ঠোঁটে হালকা হাসি নজর এড়ালো না অভিমন্যুর, জিজ্ঞাসু চোখ তুলে বললো — কি?

পেটের ভেতর থেকে গুলগুলিয়ে উঠে আসা হাসির স্রোত চাপা দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টায় তিন্নি মুখ ঘুরিয়ে বললো — কিছু না তো?

— কিছু তো বটেই!
তিন্নির দিকে চেয়ে থেকে মেজর অভিমন্যু সেনের ভুরু কুঁচকেই রইলো। কিছু একটা হয়েছে ও বুঝতে পারছে কিন্তু ঠিক “কি” হয়েছে ধরতে পারছে না। তারপর হঠাৎ যেন একটা যোগসূত্র খুঁজে পেলো অভিমন্যু, জোর করে তিন্নির মুখ নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বললো — এই কবিতাটাই কেন?

হাসি আর মুখে ধরছে না তিন্নির, ঠোঁট চিপে বললো — এমনিই!

— সীমন্তিনী?

উফফ!
কিচ্ছু বোঝে না কেন এই আনরোমান্টিক ভূতটা? সব কথা স্পষ্ট করে বলতে হয় নাকি? নিজের দৃষ্টি দূরের পাহাড়ের দিকে ফিরিয়ে তিন্নি খুব ধীর গলায় থেমে থেমে বললো
— হোয়েন ওয়াজ আওয়ার ফার্স্ট কিস অভিমন্যু? তোমার কি মনে হয়, সাড়ে চারমাস আগে সেই বৃষ্টিভেজা সকালে তোমার তাঁবুতে ক্রেডিট কার্ডটা আমি এমনি এমনিই ফেলে রেখে গিয়েছিলাম উইদআউট এনি হোপ অর এক্সপেক্টেশন?

টিক টক, টিক টক।
নিঃশব্দ গ্রেনেড ফাটার আগে কয়েক সেকেন্ডের নির্বাক নীরবতা। গুনে গুনে পাঁচসেকেন্ড পর অভিমন্যুর মুখ হাঁ, চোখ বিস্ফারিত প্রায়! অস্পষ্ট গলায় বলে উঠলো
— ইউ মিন …… সেদিন ভোরে তুমি জেগেছিলে?

— ইয়েস স্যার!

দুজোড়া চোখ তাকিয়ে রইলো একে অপরের দিকে, নিষ্পলক। বিস্ফারিত গাঢ় বাদামী চোখে ফুটে উঠেছে অবাক বিষ্ময়, বুদ্ধিদীপ্ত দীঘলকালো ছলছলে একজোড়া চোখে ভালোবাসার নিঃস্বার্থ সমর্পন। চোখের ভাষায় প্রবাহিত হল তীব্র ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক রেডিওওয়েভ, পৃথিবীর ম্যাপ আর ভূগোলকে বুড়োআঙ্গুল দেখিয়ে সুদূর হিমালয়ে আছড়ে পড়লো আরব সাগরের উত্তাল ঢেউ, কোনো এক নির্জন পাহাড়ি পাদদেশে। দৃঢ় আলিঙ্গনবদ্ধ আরেকটি চুম্বন, এবারের আবেগ আরো তীব্র। এবারের চাহিদা আরো স্পষ্ট, একান্ত জৈবিক।

অনেকক্ষন পর যখন চারিপাশ ঘন অন্ধকার হয়ে এসেছে, ঝিঁঝিরা ছেড়েছে ডাক; অনেক নিচে গ্যাংটক শহর যখন স্ট্রিটলাইটের ঝাপসা সাদা ভেপারআলোয় হীরের মালার মতো সেজে উঠেছে, নিজেকে তিন্নির থেকে আলাদা করে নিয়ে অভিমন্যু বললো
— আজ এটুকু থাক। এরপর যেদিন তোমাকে সবার সামনে নিজের বলে পরিচয় দেবো সেদিন নাহয় বাকিটা সেরে নেব। কেমন?

অন্ধকারেও তিন্নির গালদুটো যে টুকটুকে লাল হয়ে উঠলো স্পষ্ট বুঝতে পারলো অভিমন্যু। হেসে বললো — চলো ফিরি।

ভিজে ভিজে হিমেল হাওয়ার ভিতর আসন্ন বিচ্ছেদের, মনকেমনের পুরোনো গন্ধটা ফিরে এলো। আর মাত্র দশ ঘন্টা একসাথে থাকা! ঠান্ডা পাথুরে চাতাল থেকে উঠতে গিয়ে বুকের ভেতর থেকে ডুকরে ওঠা কান্নাটা সামলে নিলো তিন্নি, আজ আর কোনো চোখের জল ফেলা নয়।

ফটফটে সাদা জোৎস্নায় ঢাকা শুনশান রাস্তা, এত রাতে পাহাড়ে গাড়ির সংখ্যা নামমাত্র। চাঁদনী রাতে কয়েকটি নিঝুম তারাকে সাক্ষী রেখে নিঃশব্দে গাড়িতে বসে রইলো ওরা কিছুক্ষন, আজকের সুন্দর বিকেলটার রেশ কাটে নি যেন তখনও। অনেকক্ষন পর বড়ো একটা শ্বাস ফেলে জীপ স্টার্ট করেও কি ভেবে আবার বন্ধ করে দিলো অভিমন্যু। তিন্নির দিকে ফিরে বললো — গ্যাংটক পৌঁছে আমি অন্য রুম নিয়ে নেবো।

সামনের অন্ধকার রাস্তার দিকে তাকিয়ে কি যে ভাবছে তা ও নিজেই জানে। মুখের একটা পেশীও কাঁপলো না, স্থির দৃঢ় গলায় তিন্নি একটি শব্দই উচ্চারন করলো — না।

থমকে গেল অভিমন্যু— ইটস রীয়েলি নট এ প্রবলেম! ইউ ডোন্ট হ্যাভ টু কম্প্রোমাইজ! আমার কোনো অসুবিধে নেই…

— না।
স্থিরপ্রতিজ্ঞ গলা তিন্নির, এর নড়চড় হবে না যেন।কয়েকপল স্তব্ধ হয়ে থেকে অভিমন্যু আরেকবার জিজ্ঞেস করলো — আর ইউ শিওর?

— ইয়েস!

**************************__****************************

হোটেলের রুমে ঢুকে রুম সার্ভিসে অল্প কিছু নিয়মরক্ষার খাবার আনিয়ে খাওয়াদাওয়ার পাট চুকলো নিঃশব্দে। সারাদিনের ধকল, ক্লান্তি, তারপর স্বল্পদূরত্ব হলেও ড্রাইভিং, শরীর আর দিচ্ছিল না অভিমন্যুর। কালকের ব্যাণ্ডেজ করা ক্ষতস্থানটা আরেকবার জরিপ করে আর একটু ফ্রেশ হয়ে নিয়ে বিছানায় এলিয়ে দিয়েছিলো ওর শ্রান্ত শরীর। চোখে বুজে গিয়েছিলো কখন কে জানে!

আট্যাচড্ বাথরুমে ফ্রেশ হতে গিয়েছিলো তিন্নি, মিনিট দশ পর ফিরে দেখলো সুবিশাল কিংসাইজ বেডের একপাশে অভিমন্যু টানটান লম্বা, চোখের ওপর একটা হাত আলগোছে রাখা। রুমের চড়া হলুদ আলো অফ করে দিয়ে দুটো মৃদু আলোর বেডল্যাম্প জ্বেলে দিল তাড়াতাড়ি, ঘড়িতে দেখলো সবে সাড়ে সাতটা! চারপাশের নিস্তব্ধতায় আর ঝিঁঝিঁপোকার ডাকে তাতেই মনে হচ্ছে মধ্যরাত্রি! ঠান্ডাটা একটু বেড়েছে যেন। রুমহিটারের টেম্পারেচার চেক করলো তিন্নি, ঠিকই তো আছে! তাও ওর হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে কেন?
মিনিট দুই-তিন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলো তিন্নি, মাথায় ঘুরছে একটাই প্রশ্ন~ ও কোথায় শোবে? অভিমন্যুর সাথে এক বেডে? নাকি লিভিংরুমের সোফায়?

ইচ্ছে করে টুংটাং খসখস মৃদু আওয়াজ করলো যদি অভিমন্যু চোখ মেলে তাকায় কিন্তু সে যেন ধ্যানমগ্ন! বোকার মতো কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে তারপর অতি সন্তর্পনে বেডের একদম কোনায় এসে বসলো, ততক্ষনে তিন্নির করা ইচ্ছাকৃত মৃদু শব্দে এতদিনের সেনানীজীবনের অভিজ্ঞতায় আর অভ্যেসে ঘুমের ঝিম ভেঙে গেছে অভিমন্যুর। স্পষ্ট বুঝতে পেরেছে যখন গুটি গুটি হালকা পায়ে তিন্নি এসে বসলো সুবিশাল বেডের একপ্রান্তে। একমুহূর্তে সারাশরীর সজাগ হয়ে উঠেছিল অভিমন্যুর, তাও মনের চাঞ্চল্য এতটুকু প্রকাশ না করে চোখ বুজিয়ে কাঠের মতো পড়ে রইলো ঘুমের ভান করে!

উফফ্!
ঠান্ডাটা জম্পেশ লাগছে এবার! কিন্তু গায়ে কি দেবে তিন্নি? লেপ যে একটাই! তবে কি হোটেলের কোমল গরম তুলতুলে লেপ ছেড়ে অভিমন্যুর কিনে দেওয়া নতুন পশমের শাল গায়ে শীতে কাঁপতে কাঁপতে ঘুমোবে? কয়েকঘন্টারই তো ব্যাপার!
এমন পরিস্থিতিতে এই প্রথমবার পড়েছে তিন্নি! নিজেই অবাক হয়ে গেল ভেবে, সাধারণ থেকে অতিসাধারণ ব্যাপারেও কত কত কনফিউশন! নিজের ভাবনাতে নিজেই তলিয়ে যাচ্ছিলো সম্বিৎ ফিরলো অভিমন্যুর গলায়! চোখ তার বন্ধ আগের মতোই, মৃদু স্বরে বললো
— ইটস বীন এ লং ডে। একটু রেস্ট নিয়ে নাও, ভোররাতে বেরোতে হবে।

অজানা উত্তেজনায় বুক ঢিবঢিব করে উঠলো তিন্নির, অভিমন্যু জেগে আছে?
নিষিদ্ধ একটা চাহিদা শীতল সরীসৃপের মতো পাক খেয়ে খেয়ে জড়িয়ে ধরেছে সারা শরীর। গলা শুকিয়ে আসছে আর ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে হাত পা। শরীরের সকল কোষ, রক্তকনিকা, পিট্যুইট্যারী নিঃসৃত আড্রিনালিনহরমোনের উশৃঙ্খল, উদ্দাম প্রবাহে উন্মাদ নৃত্যে মেতেছে বোধহয়।
তাই কোনো প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করলো না তিন্নি। চোখ মেলে তাকালে অভিমন্যু দেখতে পেতো, উত্তর দেওয়ার মতো অবস্থায় নেই তিন্নি। প্রচন্ড শীতেও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটে উঠেছে ওর, ঠোঁট কামড়ে ধরেছে এতজোরে প্রায় রক্ত বেরিয়ে আসবে! একদৃষ্টিতে ও তাকিয়ে আছে অভিমন্যুর দিকে… নিস্পলক, শুধু চেয়েই আছে। তিন্নির মাথায় আর মনে তখন কি চলছে তা বোধহয় স্বয়ং ঈশ্বরেরও অজানা।

কিছুক্ষন পর ধীর স্থির গলায় অভিমন্যু বললো, তখনও ওর চোখের পাতা বোজা — এমন করে তাকিয়ে থাকলে কি করে ঘুমোবো ম্যাডাম?

একহাত লম্বা জিভ কাটলো তিন্নি!
ভগবান এমন করে কেন বানিয়েছে এই মানুষটাকে, চোখ বন্ধ করেও সব বুঝে যায়! কিছুই কি লোকানো যায় না এর থেকে?
হাতেনাতে ধরা পড়ে যাওয়ার লজ্জায় লাল-নীল-গোলাপি হয়ে গিয়ে একনিমেষে নরম লেপের তলায় ঢুকে পড়ে মুখ লোকালো তিন্নি! কিন্তু বেশিক্ষন কি পারা যায়? অল্পকাল পরেই দমবন্ধ হয়ে আসতে লেপের ভিতর থেকে ভীরু চোখে মুখটা অল্প বার করে দেখল অভিমন্যু ওরই দিকে তাকিয়ে!
চোখাচোখি হতেই সাথে সাথে লেপের তলায় সেঁধোলো তিন্নি তারপর নিজের ছেলেমানুষিতে নিজেই অতিষ্ঠ হয়ে আবার বেরিয়ে এলো। চুপ করে ওকে দেখে যাচ্ছিলো অভিমন্যু, তিন্নি একটু শান্ত হলে চোখভরা হাসি নিয়ে রাশভারী জমাট গলায় বললো
—- কি চাই? দাবীটা কি?

উত্তর দিল না তিন্নি!
দুজনের মধ্যে দুরত্ব তখন একহাতেরও কম। ম্যাথেমেটিক্স, ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, বায়োলজির মিলিত ইক্যুয়েশনে ভরপুর মন নিয়ে লেপের ফাঁক দিয়ে তুলতুলে আদুরে বেড়ালের মতো জুলজুল চোখে তাকিয়ে রইলো অভিমন্যুর দিকে। সবকথা কি মুখে স্পষ্ট করে বলতে হয় নাকি?
কয়েকপল চোখে চোখে বয়ে গেলো অনেক না বলা কথা, নিঃশব্দ বিদ্যুৎপ্রবাহ। একদৃষ্টিতে তিন্নির দিকে তাকিয়ে থেকে ওর মুখে স্পষ্টাক্ষরে ফুটে ওঠা সুপ্ত আকাঙ্খা, অভিব্যক্তিগুলো পড়ে নিলো অভিমন্যু। ওর ভেতরেও যে একই মানসিক চাঞ্চল্যে ছটফট করছে মন! বড় করে একটা শ্বাস ফেলে মনকে শক্ত করলো অভিমন্যু তারপর চোখ বুজিয়ে নিয়ে সোজা হয়ে শুয়ে বললো —- আজ নয়।

চুরচুর শব্দে কোথাও কাঁচের গ্লাস ফাটলো কি? নাকি তিন্নির মন? অস্ফুটে ঠোঁট নড়লো ওর —
কেন?

গভীর একটা শ্বাস ছাড়লো অভিমন্যু। তারপর চোখ বন্ধ রেখেই স্থিরদৃঢ় গলায় বললো
— বিকজ ….আই ডোন্ট ওয়ান্ট ইউ টু রিগ্রেট আওয়ার ফার্স্ট টাইম এভার, ইভেন ফর এ সেকেন্ড।

.
.
.
অপলক তাকিয়ে রইলো তিন্নি অভিমন্যুর দিকে। প্রতিটি শব্দ মাছের কাঁটার মতো ফুটে উঠলো গলায়, হৃৎপিণ্ডে হচ্ছিলো নিঃশব্দ রক্তক্ষরণ।চুঁইয়ে চুঁইয়ে গড়িয়ে পড়া শোণিতকণার নোনতা স্বাদে ভরে উঠলো মুখের ভেতর তারপর মর্মার্থ করলো ইমোশনের ছিঁটেফোঁটাহীন আপাতকঠিন শব্দগুলির পেছনে লুকিয়ে থাকা অন্তর্নিহিত অনুভূতি আর কারণগুলো।নিজের মনকে তিন্নি যত না ভালো বোঝে, অভিমন্যু হয়তো তার চেয়েও বেশি তিন্নির মনের ভাব অনুধাবন করতে পারে! রাগ নয়, প্রত্যাখ্যানের অভিমান নয়, অন্যরকম একটা অনুভূতিতে মন ভরে যাচ্ছিল ওর। কষ্ট মাখানো রক্তাক্ত একটা ভালোবাসা যেন ছড়িয়ে যাচ্ছিলো বুকের গভীর থেকে শিরায় শিরায়। কিছু কিছু অনুভূতির হয়তো সত্যিই কোনো নাম হয় না।

অনন্তর চরম দুঃসাহসে লেপের গরম ওম ছেড়ে গুটিশুটি মেরে তিন্নিএগিয়ে গেলো, কয়েকমাসের পরিচিত, ভালোবাসার যে মানুষটিকে সবচেয়ে বেশি ভরসা করে তিন্নি, নিজের থেকেও বেশি। অভিমন্যুর বুকের ওপর, নিজের পরম নির্ভরতার জায়গাটার ওপর মাথা রেখে অবাধ শান্তিতে চোখ বুজিয়ে নিল! দুটি হৃৎপিণ্ডের মিলিত ধুকপুকানি ছাড়া আর কোনো শব্দ শোনা যায় না, কয়েকপল পর বুক ভরে শ্বাস নিলো অভিমন্যু, তিন্নির শ্যাম্পুকরা চুলের গন্ধ, মেয়েলি সুবাস মিশ্রিত হয়ে আছে সেই বাতাসে।
চোখ তখনও বন্ধ, অভিমন্যুর বলিষ্ঠ হাতজোড়া তারপর ধীরে ধীরে জড়িয়ে ধরলো তিন্নিকে, নিজের সাথে নরমভাবে মিশিয়ে। আলগোছে বাম হাত দিয়ে এসে পড়লো তিন্নির মাথায়, চুলে বিলি কেটে দিতে লাগলো।

মিনিটকয়েকের নীরবতা, তারপর অনেক সাহস করে তিন্নি ফিসফিসিয়ে উঠলো — অভিমন্যু?

— হুমম?

— ঘুমোচ্ছো?

আবছা অন্ধকারে চাপা হাসির শব্দ হলো একটা
— হুমম।

মনে মনে ঠোঁট ফুলিয়ে চুপ করে গেল তিন্নি! কিছুক্ষন পর অভিমন্যু বললো
— কেন?

খুব আস্তে, আবছা হয়ে আসা স্বরে তিন্নির পাতলা ঠোঁটদুটি নড়ে উঠলো, প্রায় না শোনার মতোই
— পিহুর কথা বলবে না?

কিছুক্ষন নিস্পন্দ হয়ে থেকে তিন্নিকে একটুও না সরিয়ে হাত বাড়িয়েপাশের বেডসুইচটা অন করলো অভিমন্যু। আর সাথে সাথে মোলায়েম হলুদ আলোর বন্যায় ভেসে গেল মে ফেয়ারের সুবিশাল স্যুইট!

**************************__****************************

একটু একটু করে অভিমন্যু বলছিলো ওর কথা। পিহুর কথা, অভিমন্যুর বাবা শহীদ জেনারেল অর্জুন সেনের কথা, মা’র কথা, দাদু, নীলিমাদেবী…… স-ব। একবারও বাধা না দিয়ে তিন্নি শুনে যাচ্ছিলো নীরব হয়ে। শুনতে শুনতে ওর ডাগর কালোচোখদুটি জলে ভরে উঠছিলো, কখনো বা অভিমন্যুর শক্ত কড়াপড়া আঙ্গুলগুলো জড়িয়ে নিচ্ছিলো নিজের মুঠিতে, নিঃশব্দে বুঝিয়ে দিচ্ছিলো সাথে থাকার অঙ্গীকার। আসলে, যতই দৃঢ় অবিচল মন হোক না কেন, সব মানুষই দিনের শেষে স্পেশাল একজনের সাথে তার সকল কথা শেয়ার করতে চায়। প্রিয় মানুষটার সাথে নিজের সব সুখ-দুঃখ ভাগ করে নিতে চায়, “নিজের করে” তাকে পেতে চায় – যে সম্পর্কে থাকবে না কোনো লুকোছুপি বা গোপনীয়তা, নির্দ্বিধায় যার কাছে মনের সুপ্ত অনুভূতি… সব প্রকাশ করা যায়, যাকে অনায়াসে বিশ্বাস করা যায়, যার ওপর ভরসা রাখা যায়, পাগলের মতো যাকে ভালোবাসা যায়। কতদিন পর নিজের মন খুলে একান্ত পার্সোনাল কথাগুলো কারো সাথে শেয়ার করছিলো অভিমন্যু, যা আগে কোনোদিন কাউকে বলে নি। বুকের কোন গভীরে পাথর হয়ে জমেছিলো কথাগুলো, নিংড়ে বার করে আনতে প্রথম প্রথম একটু কষ্ট হচ্ছিলো ঠিকই কিন্তু কিছুসময় পর বহতা নদীর মতোই স্বাভাবিকভাবে বেরিয়ে আসছিলো মনের গোপনতম কথন। অভিমন্যুর কথার স্রোত যখন থামলো, ওদের দুজনের মন যেন একতারার একসুরে বাঁধা পড়ে গেছে, একে অপরকে নিবিড় আলিঙ্গনে জড়িয়ে রইলো পরম শান্তিতে, অবাধ নিশ্চিন্তে। যেন পৃথিবী ওলোটপালোট হয়ে গেলেও ওদের এই অটুট বন্ধন আর ভাঙবে না।
.
.
.
.

রাত সাড়ে বারোটা।
বাইরে নিঝুম পৃথিবী, ঝিঁঝিপোকারাও ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে গেছে, নির্ঘুম চোখে একা জেগে অভিমন্যু। ওর চওড়া পাথরকঠিন বুকে মাথা রেখে কেমন নিষ্পাপ সরল শিশুর মতো ঘুমিয়ে পড়েছে তিন্নি। মুখটা অল্প হাঁহয়ে আছে, তিতির পাখির মতো তিরতির করে শ্বাস চলছে একটু একটু। নরম হাতে পরম নির্ভরতায় আঁকড়ে আছে অভিমন্যুকে। গভীর একটা নিঃশ্বাস পড়লো অভিমন্যুর। বড্ডো সরল, বড্ডো ভালো এই মেয়েটা..নিরন্তর একে আগলে রাখতে চায় মন। অভিমন্যুর নির্মম রুক্ষ মরুভূমি জীবনে তিন্নি যেন এক চিলতে বর্ষার মেঘ। খুব সাবধানে অভিমন্যু তিন্নির মুখের ওপর এসে পড়া রেশমের মতো মোলায়েম চুলগুলো আলতো হাতে সরিয়ে দিয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো যেন হৃদয়ে এঁকে নিলো তিন্নির ছবি। মনে পড়ে গেলো সাড়ে চার মাস আগের একটি ভোররাত, প্রথম চুম্বন কি ভোলা যায়?

সীমান্তে শত্রুর বুকে মৃত্যুভয়ের কাঁপন তুলে দেওয়া, দেশের বিভিন্ন ট্রেনিং একাডেমিতে আর্মি ক্যাডেটদের কঠোর প্রশিক্ষক, ভারতীয় সেনাবাহিনীর দুর্দন্ডপ্রতাপ মেজর এবং র’য়ের এজেন্ট পাত্থরদিল অভিমন্যু সেনের ঠোঁট পালকের থেকেও নরমকরে মৃদু স্পর্শ করলো তিন্নির ছোট্ট কপাল, তারপর ওর পাতলা গোলাপি ঠোঁট।
মাত্র তিন সেকেন্ড।
নিজের সকল ভালোবাসা ওই দুইটি চুম্বনের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করে নিজেকে সরিয়ে নিলেন মেজর। ঘুমের মধ্যেই তিন্নির ঠোঁটের কোণে হালকা একটা হাসি ফুটে উঠলো। ক্রমশ সেই হাসি সংক্রামিত হলো অভিমন্যুরও চোখে, ঠোঁটের কোণে। তিন্নির হৃৎপিণ্ডের লাবডুবের সাথে তালে তাল মিলিয়ে অভিমন্যুর হৃদয়ও একই গতিতে চলতে লাগলো, দুজনের নিঃশ্বাস একই ছন্দে বাঁধা পড়লো। কোমল মিষ্টি মিষ্টি একটা সুখের আমেজে ঘুম জড়িয়ে এলো অভিমন্যুর চোখে, হাত বাড়িয়ে বেডসুইচটা অফ করে দিয়ে নিজের দুহাতের মাঝে তিন্নিকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে নিলো চোখ বন্ধ করে।

 

.
.
.

ক্রমশঃ(রবিবার দুপুর দুটোয়)

কবিতা ~ “স্পর্শ” ©জয় গোস্বামী।
© সুমন্দ্রা মিত্র। ভালো লাগলে নামসহ শেয়ার করবেন।

 

***********************__******************************

সকল পর্বের লিঙ্ক~
Video Teaser
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/145475543838322/?vh=e&d=n
Part 1
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/145129087206301/?d=n
Part 2
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/145859077133302/?d=n
Part 3
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/146221053763771/?d=n
Part 4
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/146595433726333/?d=n
Part 5
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/147293876989822/?d=n
Part 6
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/148075966911613/?d=n
Part 7
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/148530310199512/?d=n
Part 8
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/148951006824109/?d=n
Part 9
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/149405760111967/?d=n
Part 10
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/150313546687855/?d=n
Part 11
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/151106323275244/?d=n
Part 12
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/151923336526876/?d=n
Part 13
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/152353663150510/?d=n
Part 14
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/154065792979297/?d=n
Part 15
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/156163186102891/?d=n
Part 16
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/157132182672658/?extid=QdVQFGSjLzQUsE31&d=n
Part 17
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/157444422641434/?extid=fI3jIc0PCiYXDa0N&d=n
Part 18
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/158095955909614/?extid=1E2JOZfMCmqscBoi&d=n
Part 19
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/158831902502686/?extid=R8zo6L2l274CIQ7r&d=n
Part 20
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/159626782423198/?extid=0e8jrLLhsuLqgsQX&d=n
Part 21
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/160047349047808/?extid=e9DIdFXAkqxTg77U&d=n
Part 22
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/160963752289501/?extid=EgYDh0z3hVr5TCBY&d=n
Part 23
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/161833698869173/?extid=gRK0HHMoLW0bu0gK&d=n
Part 24
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/162740122111864/?extid=KIR9o3zetBHgH9mt&d=n
Part 25
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/163061178746425/?extid=fhzBxEjnlA7n6Ulu&d=n
Part 26
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/163695728682970/?extid=tm0Y81ykORQhpsq9&d=n
Part 27
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/164305438621999/?extid=WsYE2BjXkYvPmqyF&d=n

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here