সূর্য ডোবার আগে পর্ব-২৭

0
2208

#সূর্য_ডোবার_আগে
পর্ব-২৭
লেখিকা ~ #সুমন্দ্রামিত্র
কঠোরভাবে প্রাপ্তমনষ্কদের জন্য।
.
.
.

— ওটা সাথে নেওয়া কি একান্ত জরুরি?
— হুমম্! ওয়ান শুড অলওয়েজ বি প্রিপেয়ার্ড, কাম হোয়াট মে।
— ওহ!

ঢোঁক গিলে কথাটা হজম করে নিলেও গলাটা কেমন শুকিয়ে আসছিলো তিন্নির। পার্সোনাল SIG Suer P226 পিস্তলের সেফটিলক অন করে কোমরে গুঁজে নিলো অভিমন্যু, এক্সট্রা ম্যাগাজিন পকেটে। ছাইরঙা ফুলস্লীভ টিশার্ট- রিপড ব্লু ডেনিম, চোখে রে ব্যানের কালো রোদ চশমা, ক্যাজুয়াল ফিট জামায় হাতের পেশিগুলো সুস্পষ্ট – নির্লজ্জভাবে তিন্নি জাস্ট ঝারি মেরে যাচ্ছিলো অভিমন্যুকে, চড়ুইপাখির মতো ছোট্ট হাঁ করে।

অভিমন্যুর গলার স্বরে চটকা ভাঙলো ওর। — কি দেখছো অমন হাঁ করে?

মনে মনে একহাত লম্বা জিব কেটে ন যযৌ ন তস্থৌ! টুসটুসে লাল গাল নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো তিন্নি, দেখে অভিমন্যু হেসে ফেললো। তারপর হাত বাড়িয়ে আরএকবার তিন্নির গালদুটো টিপে দিয়ে বললো —- ইউ আর লুকিং বিউটিফুল টু!

বাহ্! ক্যা বাত!
অভিমন্যু বুঝে গেছে তিন্নি ড্যাবডেবিয়ে এতক্ষন ধরে ওকে ঝারি মেরে যাচ্ছিলো?পেটের ভেতর থেকে গুলগুলিয়ে উঠে আসা লজ্জা লজ্জা হাসিটা চাপার ব্যর্থ চেষ্টায় মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে তিন্নি তাকিয়ে রইলো খোলা ব্যালকনির দিকে। ছোট্ট একটা নীল ডানাওলা প্রজাপতি ঢুকে এসছে ঘরে, তিন্নির গায়ে মাথায় উড়ে এসে বসছে বারবার, সেদিকপানে চেয়ে চেয়ে হঠাৎ তিন্নির মনে হলো, ওর পেটের ভেতর জানা ঝাপটানো প্রজাপতিগুলোও কি এমনই উড়ে বেড়ায়?

—— আজ আর আমি ড্রাইভ করবো না, একজন ডিফেন্স ড্রাইভার ওয়েট করছে, হি উইল ড্রাইভ আস অ্যারাউন্ড।

বেরোনোর ঠিক আগেআগে অভিমন্যুর কথাটায় একমুহূর্ত থমকে গেলো তিন্নি, টিকটিক করে মাথায় আর একটি প্রশ্ন বেজে উঠলো “তিন্নির ঠিক কি পরিচয় এখানে?” আবারও সেই জাজমেন্টাল নজর, বাঁকাচোখে তাকানো। ওর ফ্যাকাশে মুখ অভিমন্যুর নজর করেনি, নিজের মতো বলে চললো – “ বাট, তার আগে খেতে হবে, আই এম স্টার্ভিং। ফার্স্ট উই উইল হ্যাভ লাঞ্চ, দেন ইটস আপ টু ইউ – ইটস ইওর ডে। কি করতে চাও? মুভি? শপিং নাকি এ স্মল ট্যুর অ্যারাউন্ড গ্যাংটক?”

লিফ্ট ততক্ষনে উঠে এসেছে মে ফেয়ার রিসোর্টের ওরিয়েন্টাল-এন্ড-ইন্টারন্যাশনাল টেরেসক্যাফে “অর্কিড”। দুপুরের নরম আঁচ লাগানো রোদ গায়ে মেখে সাবলীলভাবে নিজের শক্ত, বলিষ্ট হাতে তিন্নির কোমর জড়িয়ে নিয়ে ছিমছাম আউটডোর ক্যফের রঙিন কুশন দিয়ে সাজানো সারি সারি বেতের কাউচের দিকে পা বাড়ালো অভিমন্যু। মোটামটি ভালোই ভিড় আজ, পুজোর ছুটিতে অনেকেই ঘুরতে এসেছে গ্যাংটক, বাঙালীর সংখ্যাই বেশি। ট্যুরিস্টদের হাসি ঠাট্টা আড্ডা, টেবিল থেকে টেবিলে উড়ে আসা অর্ডারের অনুরোধে গমগম করছে যেন। বেশ হ্যাপেনিং জায়গা কিন্তু তিন্নির চোখ ততক্ষনে আটকে গেছে, ক্যাফেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে থাকা ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে মাপতে থাকা আরো দু তিনজন টুরিস্টের বাঁকা হাসি আর তেরছা নজরে।
আসলে অভিমন্যুর মেদহীন, সটান চেহারা, উচ্চতা, ব্যক্তিত্ব ভিড়ের মধ্যেও ওকে আলাদা করে দেয়(আমাদের তিন্নিও কিছু কম যায় না যদিও)। ওরা দুজনে একসাথে কোথাও পা রাখলে সবার নজর ঘুরে ওদের ওপরই পড়ে, এখানেও ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু সেই নজরে সংকুচিত হয়ে একটু আগে হোটেলরুমের আগুনে কেমিস্ট্রি ভুলে গিয়ে টুক করে তিন্নির ভীরুভীরু মনটা বুকের গভীর শামুকখোলে ঢুকে গেলো আবার। নিজের অজান্তেই বোধহয়, অভিমন্যুর হাতের মধ্যে ধরে রাখা তিন্নির নরম শরীর সিঁটকে আড়ষ্ঠকাঠ হয়ে উঠেছিল। এইবার অভিমন্যু বুঝতে পারলো, থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো ওখানেই।

— কি হলো?
— কিছু না!

তিন্নির কোমর থেকে হাত না সরিয়েই অভিমন্যু ওর চোখের দিকে তাকালো সরাসরি
— হোয়াই আর ইউ বিহেভিং উইয়ার্ড ?

কি জবাব হয় এর?? মনের মানুষটাকে নিয়েই এতো সংকোচ কেন ওর? তিন্নি চোখ মেলাতে পারলো না, মুখ নিচু করে রেখেই বললো — আমি জানি না।

— ডু ইউ নট ওয়ান্ট মি টু টাচ ইউ ইন পাবলিক? হোয়াই?

বুজে আসা আবছা গলায় তিন্নি বললো
— সবাই দেখছে যে! কি ভাবছে?

অভিমন্যুর দিকে একপলক তাকিয়ে বাকি কথাগুলো আর মুখ ফুটে বলতে পারলো না তিন্নি। অভিমন্যুর চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছে ততক্ষনে, মুখের পেশী কঠিন। রে ব্যানের কালো রোদচশমায় চোখ ঢাকা বলে তিন্নি ঠাহর করতে পারলো না, অভিমন্যু ঠিক ক-তো-টা রেগেছে। রাশভারী গলাটা বেজে উঠেছে ততক্ষনে
— হুম দেখছে। তাতে কি হয়েছে?

তিন্নি চুপ করে রইলো, একটা বড়ো শ্বাস ফেলে অভিমন্যু বললো
— তুমি একজন অ্যাডাল্ট, শালীনতার সীমা রেখে যার সাথে যেমনখুশি ঘোরাফেরা করার অধিকার তোমারও আছে! ট্রুলি স্পিকিং, এই পৃথিবীতে কেউ তোমায় ভালো থাকতে দেবে না সীমন্তিনী, চেনা-অচেনা, কেউ না কেউ অলওয়েজ তোমার নামে কোনো বাজেকথা বলবে, তোমাকে বাজে ভাববে, অলওয়েজ জাজ করবে। Whether you display affection in public or not, doesn’t matter! কিন্তু তাতে কি আসে যায়? লোকে কি ভাবছে সেটা না ভেবে নিজের ভালো থাকাটা যে নিজেকেই শিখে নিতে হবে সীমন্তিনী! আর যতক্ষণ আমি তোমার সাথে আছি কেউ তোমার গায়ে বা তোমার চরিত্রে একটা আঁচড় লাগাতে পারবে না, সেটা তো জানো?

কি ছিল অভিমন্যুর স্বরে, কয়েক সেকেন্ডস তিন্নি অপলক তাকিয়ে থাকলো ওর দিকে। অভিমন্যুও দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল না!

উফফ্! আর পারা যায় না!
মনকে এবার কড়া শাসনে বাঁধলো তিন্নি। একবার নয় বারবার, কেন ওদের সম্পর্কটা নিয়ে এত ইনসিকিউরড হচ্ছে তিন্নি?
বুক ভরে কফি আর চকোলেটের গন্ধ মেশানো ফ্রেশ পাহাড়ী অক্সিজেন টেনে নিয়ে মনস্থির করলো, আর তো মাত্র ষোলো সতেরো ঘন্টা! কাল কাকভোরেই কলকাতা ফিরে যাবে ও, তারপর আবার সেই লং ডিস্ট্যান্সের অভিশাপ। রাতের পর রাত দশমিনিটের ফোনকলে যোগাযোগের সুত্রটুকু বাঁচিয়ে রাখা, কতদিন পর দেখা হবে কেউ জানে না। পড়ে থাকা এই কয়েকঘন্টা আর নাই বা ভাবলো তিন্নি, লোকে কি ভাবছে, লোকে কি বলছে! চলে যাওয়া এই সময়গুলো তো আর ফেরত পাবে না ও।

এই প্রথমবার হয়তো বিনা দ্বিধায় অভিমন্যুর হাত জড়িয়ে নিলো তিন্নি, দৃঢ় পায়ে এগিয়ে গিয়ে বসলো একটা খালি টেবিলে এসে। অভিমন্যুর মুখের ভাবের কোনো পরিবর্তন হলো না, শুধু সেকেন্ডের ব্যবধানে ঠোঁটের আগে একটা হাসি ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেলো, আর তিন্নির ধরে থাকা হাতটা আর একটু শক্ত হয়ে জড়িয়ে ধরলো যেন।

**************************__****************************

কাছের সমান্তরাল সবুজ পাহাড়গুলোর মাথা ছাপিয়ে অল্পদূরেই নাম না জানা বেশ কিছু হিমালয়ান শৃঙ্গ, শরতের দুপুরের চড়া রোদে সাদা চূড়াগুলো চোখ ঝলসে দিচ্ছে যেন। মাথার ওপর ঝকঝকে পরিষ্কার নীল আকাশ, আঁকাবাঁকা সরীসৃপের মতো ধূসররঙা পিচঢালা পাহাড়ি রাস্তাটা এঁকে বেঁকে পাহাড়ের দিকে অদৃশ্য হয়ে গেছে। বৌদ্ধ মন্ত্র লেখা রংবেরঙি তিব্বতি পতাকা উড়ছে পতপত করে। ছুটি ছুটি আমেজ যেন চারিদিকে, খুশীতে ফড়িঙের মতো নেচে উঠলো মনটা। প্রিয় মানুষটির সাথে আনপ্লানড গেটআউট, তার সাথে উপরি পাওনা এমন পরিবেশ! প্রথমবার যেন অ্যাডাল্ট লাইফের স্বাধীনতার স্বাদ পেলো তিন্নি! চটকা ভাঙলো অভিমন্যুর স্বরে

— টু কফিস ফর নাউ, দেন ওয়ান গ্রিলড চিকেন উইদ অল দ্য ভেজিস, স্কিপ দ্য রাইস আর ম্যাডামের জন্য…..

অপেক্ষারত উর্দি পরা ওয়েটারকে নিজের অর্ডারটা দিয়ে মুখোমুখি বসে থাকা তিন্নির দিকে ভুরু উঁচিয়ে তাকালো অভিমন্যু।

— ক্যান আই হ্যাভ সাম প্যানকেকস?
মেনুকার্ড দেখতে দেখতে মিষ্টি রিনরিনে গলা বেজে উঠলো তিন্নির। অভিমন্যু আর অল্পবয়সী সিকিমিজ ওয়েট্রেস একসাথে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো তিন্নির দিকে। ওদের অবাক দৃষ্টির সামনে সংকুচিত হয়ে পড়ে দুরের ডিজিটাল ক্লকে চোখ পড়লো তিন্নির – দুপুর দুটো বেজে পঁচিশ মিনিট!
নিজের ছেলেমানুষিতে নিজেই লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো।

ওয়েট্রেস তরুণী নিজেকে সামলে নিয়ে পেশাদারি স্বরে বললো — সরি ম্যাডাম, প্যানকেকস আর আ্যভেলেবল অনলি ইন ব্রেকফাস্ট।

— ওহ… ও.কে।

তিন্নির মুখটা ম্লান হয়ে গেল নিমেষেই। মুখ লুকিয়ে মেনুকার্ডে দ্রুত নজর বোলাতে লাগলো অন্য কি আইটেম অর্ডার দেওয়া যায়। একপলক সেদিকে তাকিয়ে ওয়েট্রেসর দিকে ফিরলো অভিমন্যু। কথার স্বরে শান্ত সহজাত কর্তৃত্ব — ক্যান ইউ আস্ক দ্য শেফ? আমরা ওয়েট করতে রাজি!

ন্ না!!
চোখের ইশারায় তিন্নি তখন অভিমন্যুকে মানা করতে ব্যস্ত কিন্তু ওর দিকে কেউ নজর দিলে তো? অভিমন্যুর কর্তৃত্বপূর্ণ কথা বলার ভঙ্গীতেই হয়তো একটু সচকিত হলো ওয়েট্রেস, তড়িঘড়ি বললো — ও.কে স্যার। পাঁচমিনিট সময় দিন, এক্ষুনি জানাচ্ছি।

ওয়েট্রেস বেচারি চলে যেতেই মুখ খুললো তিন্নি! — তোমার ডিকশনারিতে “প্লিজ” শব্দটা নেই?

— আছে তো! একজনের জন্য।

চশমাটা খুলে রেখে তিন্নির চোখে চোখ রাখলো অভিমন্যু, লাল গিয়ে উঠলো তিন্নির গাল। কথা ঘুরিয়ে মৃদু অভিযোগের সুরে বললো
— কি দরকার ছিল শেফকে আলাদা করে বলার? অন্য কিছু অর্ডার করলেও তো হতো।

অভিমন্যুর ঠোঁটের কোনে পাতলা হাসি তখনও ঝোলানো, ভুরু উঁচিয়ে বললো —- একটু আগে বললাম না, আজ তোমার দিন। তুমি যা চাইবে তাই হবে। বাট লাঞ্চে প্যানকেকস?

—— ইচ্ছে করছে যে!?

আজ তিন্নির বাঁধনছাড়া স্বাধীনতা, যা খুশি করার, নিজের ইচ্ছেমতো চলার। তিন্নির আদুরে বেড়ালের মতো তুলতুলে ছেলেমানুষিতে হেসে ফেললো অভিমন্যু, তারপর মাথা নেড়ে বললো
—- তুমি সত্যিই উইয়ার্ড। তবে….. শুধু প্যানকেক খেলে তো চলবে না! সাথে কি?

— আর কিছু না!

উত্তরটা ঠিক পছন্দ হলো না অভিমন্যুর, হাতের মেনুকার্ডটা বেশকিছুক্ষন উল্টেপাল্টে দেখে বললো —- হোয়াট আ্যবাউট সাম হট ব্রাউনিস্ উইদ ভ্যানিলা আইসক্রিম?

সবকটি দাঁত বার করে কানএঁটো করা হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো তিন্নির মুখ। সেদিকে তাকিয়ে অভিমন্যুও হেসে ফেললো —- সী? আই নো ইওয়োর টেস্ট!

ইশশ্! সবজান্তা হরিদাস যেন! Mr. know it all!
মনে মনে একটা জিভ ভেঙালো তিন্নি! কিন্তু তারই সাথে অনুভব করলো টেরেসক্যাফের ঝুলন্তবাগানের টাটকা সবুজ ঘাস, রংবেরঙের অর্কিড, ভোঁ ভোঁ করে উড়ে বেড়ানো দু-তিনটে মৌমাছি মিলিয়ে আশেপাশের বাতাসে কেমন যেন একটা প্রেমপ্রেম ভালোবাসার গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে, কফি আর চকোলেট মেশানো! আচ্ছা, ভালোবাসার কি বিশেষ কোন গন্ধ হয়?

**************************__****************************

কবে থেকে যে অভিমন্যুর সাথে এইরকম একটা কফিডেটের প্ল্যান করছিল তিন্নি! আজ বুঝি সে আশা পূর্ণ হলো। একেবারেই আ্যনএক্সপেক্টেড কিন্তু যা যা ইম্যাজিন করেছিলো তার থেকে হা-জা-র গুণ বেটার।

ওয়েটার এসে খাবার সাজিয়ে দিয়ে গেছে, উষ্ণ চকোলেট সস্যের গন্ধে জিভে প্রায় জল এসে গেল তিন্নির। তর সইছে না আর। নিপুনহাতে একটুকরো ব্রাউনি ফর্ক দিয়ে কেটে তুলে ধরলো অভিমন্যুর মুখের সামনে —- হ্যাপি ফার্স্ট ডেট উইদ মি!

তিন্নির চোখের দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে কেকের টুকরোটি মুখে পুরে নিলেন মেজর অভিমন্যু সেন। শরতের নির্মল আকাশে একফালি রোদের মতো ঠোঁটের কোনায় হালকা একটা হাসি লেগে, খুব ক্যাজুয়ালি বললো —- ফার্স্ট ডেট? আর ইউ শিওর?

— তা নয় তো কি? এই প্রথমবার আমরা একসাথে কোথাও বেরোলাম, একসাথে লাঞ্চ করলাম …….

বলতে বলতে থমকে গেল তিন্নি, মুখের কথা মুখেই রয়ে গেল। সাড়ে চারমাস আগের বর্ষাভেজা সন্ধ্যেতে আর্মিক্যাম্পে হ্যাজাকের আলোয় এনামেলের থালায় মোটা রুটি আর ডাল। অভিমন্যু কি সেইরাতের কথা বলছে? মোমবাতির বদলে হ্যাজাকের আলো, নরম কাউচ আর কাঁচের টেবিলের বদলে কাম্পবেড আর লোহার চেয়ার, ফাইভষ্টার হোটেলের ঝাঁ-চকচকে রেস্টুরেন্টের পরিবর্তে ভিজে সোঁদামাটি আর অতিসাধারণ মিলিটারি তাঁবু – কিন্তু রোমান্টিকতায় কি কম যায়! ওই রাতের একসাথে ডিনারটাকে কি আদৌ “ডেট” বলা যায় কি?

ওর চোখে চোখ রেখে তিন্নির মনের ভাষাই যেন পড়ে নিল অভিমন্যু। গলায় শব্দ করে হেসে বললো — “অফিসিয়ালি ইয়েস। আনঅফিসিয়ালি, নট! ফার্স্ট ডেট, একসাথে থাকা সবগুলোতেই টিকমার্ক পড়ে গেছে আগেই।”

ছোট্ট একটা শ্বাস ফেললো অভিমন্যু। ওর কথার রেশ ধরেই লালচে হয়ে আসা মুখে খুব আস্তে করে তিন্নি বললো —- ফার্স্ট গিফ্টও !

— ওহ হ্যাঁ! দ্যাট জ্যাকেট! হোয়াট ডিড ইউ ডু টু মি ম্যাডাম? ডিড ইউ পুট এ স্পেল অন মি?

হেসে ফেললো অভিমন্যু, তিন্নিও। সকাল থেকে এতোবার হাসছে তিন্নি, গালদুটো টসটস করছে ব্যাথায়। টেবিলের ওপর হাত বাড়িয়ে তিন্নির হাতটা নিজের মুঠোয় নিল অভিমন্যু, তাকিয়েই আছে ওর দিকে একদৃষ্টিতে। তারপর খুব মৃদু স্বরে বললো
— হাসলে তোমাকে খুব সুন্দর লাগে সীমন্তিনী! সবসময় এমনি হাসিখুশি থেকো।

মুখে কে যেন স্টেপলার মেরে দিয়েছে, গলায় স্বর ফুটলো না তিন্নির। চোখ সরিয়ে নিলো ও, হাজার প্রজাপতি আর ফড়িংরা তখন ডানা ঝটপটাচ্ছে বুকের ভেতর। গোলাপি আবিররঙা গাল নিয়ে মন দিয়ে গরম চকোলেট ব্রাউনির ওপর একটু একটু করে গলে পড়া আইসক্রিম দেখছিলো তিন্নি, ওর প্লেট থেকে আর একটুকরো ব্রাউনি কেটে নিয়ে খুব ক্যাজুয়ালি অভিমন্যু বললো
-– আ্যন্ড আই লাভ হোয়েন ইউ ব্লাশ লাইক দ্যাট! কিন্তু আসল কথায় আসা যাক …. কাউন্ট রেখেছো?

প্রেম প্রেম অনুভুতিতে প্রায় প্লুটোয় পাড়ি দিয়েছিল মন, অভিমন্যুর অদ্ভুত প্রশ্নতে মহাকাশ থেকে পৃথিবীতে নেমে এলো তিন্নি। অভিমন্যু ঠিক কি বলতে চাইছে বোধগম্য হলো না ওর কাছে- ফ্লাইটের টিকিট? হোটেলের বিল? নাকি ব্রাউনি খাওয়ার ক্যালোরি কাউন্ট?
হকচকিয়ে গিয়ে বললো — কিসের কাউন্ট?

দুষ্টুমির একটা মুচকি হাসি খেলে গেলো অভিমন্যুর ঠোঁটে, তিন্নির চোখ থেকে চোখ না সরিয়ে বললো — মম্ হুমম…. এক্সাক্টলি দ্যাট।

তিন্নি তখনও অবাকচোখে তাকিয়ে আছে দেখে কান এঁটো করা হাসিতে মুখ ভরিয়ে অভিমন্যু স্পষ্ট করলো –
— বাহ রে! এত জলদি ভুলে গেলে? ফোনে এতোবার দিতে……কথা ছিল, দেখা হলে সুদে আসলে উসুল করে নেবো?

ওহ্!
ও-ও-হ্……!
বিনা Mentos চিবিয়েই তিন্নির মাথার ফিউজড্ হয়ে যাওয়া বাল্ব সাড়ে তিনশো ভোল্টে দপদপিয়ে জ্বলে উঠলো এবার। হাতে ধরে রাখা প্যানকেক আর গলা দিয়ে নামলো না, মুখভর্তি চকোলেট আর আইসক্রিম নিয়ে তিন্নি ওখানেই আটকে গেলো মিনিটখানেকের জন্য।
হৃৎপিন্ডটা যেন থমকে গিয়েছিলো, তারপর আবার দ্বিগুন বেগে চলতে শুরু করলো, কান নাক দিয়ে যেন ভুসভুসে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। স্পষ্ট বুঝতে পারলো তিন্নি, গালদুটো আবারও টসটসে লাল হয়ে গেছে ওর।

টেবিলের উল্টোদিকে বসে থাকা মেজর অভিমন্যু সেন তখনও নির্বিকার, যেন কিছুই বলেননি উনি। শুধু ওঁনার ঠোঁটের আগায় লেগে থাকা আলতো হাসিটা দেখে তিন্নির বুকের ভেতরটা দুরদুর করে উঠলো কি এক নিষিদ্ধ চাহিদার সম্ভাবনায়!

উফফ্!
এত লজ্জা পেতে থাকলে তিন্নি এবার লালমুখো গোল্ডফিস না হয়ে যায়।

**************************__****************************

তবে লজ্জা লজ্জা ভাব বেশিক্ষন থাকলো না! সেভাবে বলতে গেলে গত তিন চারদিন খাওয়াদাওয়া প্রায় ত্যাগ করেছিল তিন্নি। এমনিতেই ওর পাখির আহার, আজ এককাপ কফিতেই যেন গলা ভার হয়ে গেল, আর কিচ্ছু খেতে ইচ্ছে করছিল না ওর। দুরের পাহাড় দেখতে দেখতে প্লেটের খাবার নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলো, চটকা ভাঙলো অভিমন্যুর ধমকে —- তুমি কিন্তু এখনো সুস্থ নও! ইউ নীড টু ইট।

—- আমার হয়ে গেছে। এত খেতে পারবো না।

মৃদু ধমক দিলো অভিমন্যু — এত খেতে হবে না, প্লেটেরটা শেষ করো! খাবার নষ্ট করতে নেই।

তড়বড়িয়ে তর্ক করার জন্য মুখ খুলতে গিয়েও কথাগুলো টুক করে গিলে নিলো তিন্নি, বেজার মুখে প্যানকেক চিবোতে লাগলো! আড়চোখে সেদিকে তাকিয়ে অভিমন্যু হাসলো
—- এরপর কি? মুভি না শপিং? আজ যা যা আবদার সব করে ফেলো ঝটপট!

ঠোঁট ফুলিয়ে তাকালো তিন্নি, অভিমন্যু কি জানে না ভিড়ভাট্টা নয়, নিরিবিলি জায়গাই ওর পছ্ন্দ? ঘন্টাকয়েক আগের অভিমন্যুর বলা কথাগুলোই ফিরিয়ে দিলো
— আমি তো এখন তোমার আন্ডারে, তোমার দায়িত্বে আছি শুনলাম যেন! যা বলবে চুপচাপ শুনবো!

—- ম্যাডামের সুবুদ্ধি হয়েছে দেখছি। গুড গার্ল!

চেখেমুখে একটা নকল স্বস্তির ভাব ফুটিয়ে তুললো অভিমন্যু যেন খুব বাঁচান বেঁচে গেছে। একটু চিন্তা করে হেসে বললো — ও.কে!! লেট ইট বি এ সারপ্রাইজ দেন! আই আ্যম শিওর ইউ উইল লাইক ইট।

কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তিন্নি, ভোঁওওও করে অভিমন্যুর সাইলেন্ট রাখা মুঠিফোনটা ভাইব্রেট করে উঠলো। অভিমন্যু আনমনেই রিসিভ করে ফেলেছিলো বোধহয়, অপরপ্রান্তের উত্তেজিত মেয়েলি কণ্ঠস্বরটা এতদূর থেকেও স্পষ্ট শুনতে পেলো তিন্নি
— দাদাভাই ?? তুই ঠিক আছিস??

চোখের ইশারায় তিন্নিকে কন্টিনিউ করতে হবে ফোন হাতে উঠে গেলো অভিমন্যু। হাতের খাবার আর মুখে উঠলো না তিন্নির, কাউচে হেলান দিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো। অনেক অ-নেকদিন আগে “স্লিপ অফ টাং” হয়েই অভিমন্যু মুখ ফস্কে বলে ফেলেছিলো না ওর বোন আছে?

নিশ্চয়ই অভিমন্যুর থেকে অনেক ছোট, গলা শুনে তাই লাগলো! আজ অবধি অভিমন্যুকে ওর পরিবার নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করেনি তিন্নি, কোথাও একটা বাধো বাধো ঠেকেছে, হয়তো মনের অগোচরে এখনো সেই আঘাতটা রয়ে গেছে – প্রথমবারের সাক্ষাতে পরিবার নিয়ে জিজ্ঞেস করাতে অভিমন্যুর নির্মম প্রত্যাখ্যান। মনে মনে ঠিকই করে রেখেছিলো তিন্নি অভিমন্যু নিজে থেকে কিছু না বললে ওকে জিজ্ঞেস করবে না কোনোদিন, কিন্তু আজ যে বড়ো জানতে ইচ্ছে করছে! আনমনে বসে থাকতে থাকতে মন খচখচ করছিলো, হঠাৎ নজর পড়লো অভিমন্যুর ওয়ালেটটা টেবিলের ওপর অতি অবহেলায় পড়ে। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সাড়ে চারমাস আগে অভিশপ্ত সেই দিনটায় তিন্নিকে গ্যাংটকের হোটেলে ফিরিয়ে দিয়ে যাওয়ার রাস্তায় জীপের মধ্যে অভিমন্যুর বলা একটা কথা বিদ্যুৎচমকের মতো মাথায় ঝলসে উঠলো ওর। একবার এপাশওপাশ তাকিয়ে দেখলো অভিমন্যু ধারেকাছে আছে কিনা। তারপর হাজার অস্বস্তি আর কিন্তু কিন্তু বোধ নিয়ে কাঁপাহাতে ওয়ালেটটা খুললো।

কার ফোটো আছে অভিমন্যুর পার্সে?
.
.
.
শীর্ণ চেহারার খুব মিষ্টি দেখতে এক কিশোরী হুইলচেয়ারে বসা, হাসিমুখে তাকিয়ে আছে ফোটোগ্রাফারের দিকে। চোখে অভিমন্যুর আদল বেশ স্পষ্ট, তবে মুখে অনেক কমনীয়তা। বয়সে বছর ষোলো সতেরো বোধহয় বা আরও কম! তিন্নির চোখ আটকে গেল মেয়েটির হাসিটায়। বুকের ভেতরটা যেন মুচড়ে উঠলো তিন্নির! এই হাসিটা যে বড্ড চেনা, ঠোঁটে লেগে থাকলেও চোখে যেন জমাট কান্না। অভিমন্যুকে ছেড়ে থাকলে এমন হাসিই লেগে থাকে না তিন্নির নিজের মুখেও? ফটোটা খুব সম্প্রতি তোলা, নিচের তারিখটা দেখেই বুঝতে পারলো তিন্নি। ছবি উল্টে দেখলো ফোটোর পেছনে ইংলিশ হরফে টানা টানা লেখা ~ দাদাভাইকে, পিহু!

এই তবে অভিমন্যুর বোন? হুইলচেয়ারে বন্দী? কতদিন ধরে? অভিমন্যুকে কিছু জিজ্ঞেস করা কি ওর উচিত হবে? বুকের ভেতরটা অজানা যন্ত্রনায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে উঠছিলো তিন্নির, ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ডুকরে বেরিয়ে এলো। এতদিন জানতো অভিমন্যু মাতৃহারা, আজ জানলো একমাত্র বোনটাও হুইলচেয়ারে বন্দি! আর কি কি লুকিয়ে রেখেছে অভিমন্যু নিজের পাথরকঠিন মনে? কেন এই মানুষটা নিজের সুখ দুঃখ কিচ্ছু ভাগ করে নেয় না ওর সাথে? যে মানুষটার কথা ভেবে রাতের পর রাত সুখস্বপ্নে বা চোখের জলে ভেসে যায় তিন্নি, যে মানুষটার জন্য পরিবার, সমাজ সবকিছু ভুলে মাথায় কলঙ্ক তুলে নিতে প্রস্তুত তিন্নি- আদতে সেই মানুষটিকে কতোটুকু চেনে ও! শুধু নাম আর পেশা? মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন করলো তিন্নি – ইজ দ্যট এনাফ? একটা সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য শুধু কি পাগলকরা আকর্ষন আর তীব্র ভালোবাসা যথেষ্ট তিন্নির কাছে? আজও কি অভিমন্যুর বিশ্বাশ অর্জন করতে পারে নি তিন্নি?

মিষ্টি মিষ্টি ভ্যানিলা আইসক্রিমের মতো স্বপ্নিল ফার্স্ট ডেটের তালটা তখনই কেটে গেলো যেন। চোখের কোণ দিয়ে দু ফোঁটা নোনতা গরমজল ঠান্ডা হয়ে আসা ওভারলোডেড চকোলেট ব্রাউনির ওপর গড়িয়ে পড়তে ওয়ালেটটা যথাস্থানে রেখে দিলো তিন্নি। সপ্তাহে পাঁচদিন, টানা নয়ঘন্টা যে মেকি হাসিটা সেক্টর ফাইভের চোদ্দতলার ঝাঁ চকচকে কর্পোরেট ফ্লোরে লাগিয়ে রেখে নিরন্তর কাজ করে যায় আই.টি ইঞ্জিনিয়ার সীমন্তিনী আচারিয়া, আজ কোনো আয়নায় মুখ না দেখেই জোর করে সেই হাসিটা ফিরিয়ে এনে ঠোঁটের দুপাশে অদৃশ্য সেলোটেপ দিয়ে আটকে নিলো তিন্নি।
.
.
.
.
.
ক্রমশঃ(শনিবার দুপুর দুটোয়)
© সুমন্দ্রা মিত্র। ভালো লাগলে নামসহ শেয়ার করবেন।

 

***********************__******************************

সকল পর্বের লিঙ্ক~
Video Teaser
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/145475543838322/?vh=e&d=n
Part 1
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/145129087206301/?d=n
Part 2
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/145859077133302/?d=n
Part 3
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/146221053763771/?d=n
Part 4
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/146595433726333/?d=n
Part 5
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/147293876989822/?d=n
Part 6
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/148075966911613/?d=n
Part 7
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/148530310199512/?d=n
Part 8
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/148951006824109/?d=n
Part 9
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/149405760111967/?d=n
Part 10
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/150313546687855/?d=n
Part 11
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/151106323275244/?d=n
Part 12
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/151923336526876/?d=n
Part 13
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/152353663150510/?d=n
Part 14
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/154065792979297/?d=n
Part 15
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/156163186102891/?d=n
Part 16
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/157132182672658/?extid=QdVQFGSjLzQUsE31&d=n
Part 17
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/157444422641434/?extid=fI3jIc0PCiYXDa0N&d=n
Part 18
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/158095955909614/?extid=1E2JOZfMCmqscBoi&d=n
Part 19
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/158831902502686/?extid=R8zo6L2l274CIQ7r&d=n
Part 20
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/159626782423198/?extid=0e8jrLLhsuLqgsQX&d=n
Part 21
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/160047349047808/?extid=e9DIdFXAkqxTg77U&d=n
Part 22
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/160963752289501/?extid=EgYDh0z3hVr5TCBY&d=n
Part 23
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/161833698869173/?extid=gRK0HHMoLW0bu0gK&d=n
Part 24
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/162740122111864/?extid=KIR9o3zetBHgH9mt&d=n
Part 25
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/163061178746425/?extid=fhzBxEjnlA7n6Ulu&d=n
Part 26
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/163695728682970/?extid=tm0Y81ykORQhpsq9&d=n

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here