সূর্য ডোবার আগে পর্ব-৪

0
2132

#সূর্য_ডোবার_আগে
পর্ব-৪
লেখিকা ~ #সুমন্দ্রামিত্র
কঠোরভাবে প্রাপ্তমনষ্কদের জন্য।
.
.
.

পুরোনো আমলের দেওয়াল ঘড়িটা ঢং ঢং করে জানান দিল সকাল দশটা বাজলো। রোয়াকি সাবেকি বারান্দার মার্বেলের ঠান্ডা সাদা মেঝেটার ওপর হোল্ডঅল বেছানো। চারপাশে স্তুপীকৃত হয়ে আছে পর্বতপ্রমাণ জিনিষ আর বেশ কিছু গল্পের বই। একটু দুরে রোগা পাতলা এক কিশোরী হইলচেয়ারে বসে আছে, এলোমেলো ববছাঁট চুলগুলো ঝুঁকে আছে মুখের ওপর। আনমনা হয়ে একটা গল্পের বই তুলে নিল পিহু। পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে বললো —- আবার কবে আসবি দাদাভাই?

প্যাকিংয়ে ব্যস্ত অভিমন্যু মুখ ফিরিয়ে একঝলক দেখলো পিহুকে, পিহু কি কাঁদছে? মুখখানি ঝুঁকে থাকায় ঠিক বুঝতে পারলো না। একটু জোর করেই স্বাভাবিক গলায় বললো —- খুব শিগগির… এই তো দেখতে দেখতে পনেরোই অগস্ট, তারপরই মহালয়া, দুর্গাপুজো পেরিয়ে কালীপুজোর হইচই শান্ত হওয়ার আগেই ঠিক চলে আসবো দেখিস! —- এবারও তুই দুর্গাপুজোয় আসবি না দাদাভাই?

বইয়ের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে আবারও দুর্বল গলায় প্রশ্নটা করলো পিহু, একটু হতাশাও মিশে গেল কি ওর স্বরে? থমকে গেল অভিমন্যু, বুকের ভেতরটা মুচড়ে ওঠার আগেই নিজের কর্তব্য স্মরণ করে নিল একবার। ব্যগ গোছাতে গোছাতেই বললো — কেন এক প্রশ্ন করিস বুনি? জানিসই তো এ দায়িত্ব কতো বড়ো…..

পিহুর দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে থাকা দীর্ঘ বলিষ্ঠ ঋজু ছেলেটার আবেগহীন কেজো গলার নরম স্বরের কথাগুলো শেষ হওয়ার আগেই টপটপ করে তিন চার ফোঁটা পিছলে পড়লো পিহুর চোখ দিয়ে। কমলালেবুর মতো ফুলো ফুলো ওর ঠোঁটগুলো তিরতির করে কেঁপে ওঠে, হুইলচেয়ারে বন্দী দুর্বল শরীরটা ব্যর্থ চেষ্টা করে আর একবার উঠে দাঁড়িয়ে ওর সাধের দাদাভাইকে জড়িয়ে ধরতে। পারে না… তাই কান্নাগুলো না মুছেই ভাঙা গলায় বলে ওঠে — ভাইফোঁটাটাও তবে দেওয়ালেই পড়বে দাদাভাই?

অভিমন্যুর আপাত কাঠিন্য গলাটা হয়তো নিজেকেই সান্তনা দেয় — ক্রিসমাসে তো আমরা ঘুরুঘুরু যাবো বুনি! এবার স্যরকে বলে এক সপ্তাহ বেশী ছুটি নেবো! পাঁচ হপ্তা আমরা একসাথে ঘুরবো, খাবো, শপিং আরো কত্ত মজা করবো। তখন দেখবি দুর্গাপুজোর চেয়ে ক্রিসমাস বেশী জমজমাট লাগবে!

দাদাভাই ঘুরুঘুরু শব্দটা বললে পিহুর মনটা হঠাৎ করেই ভালো হয়ে যায়। সেই কোন ছোটবেলা থ্কে দাদাভাই ওকে কাঁধে পিঠে নিয়ে সারা বাড়ি চড়ে বেড়াতো আর বলতো “এই দেখ বনু, এবার আমরা মাউন্ট এভারেস্টে চড়ছি, এবার আমরা পুরীর সমুদ্রে ঘুরুঘুরু যাচ্ছি।” কপালের ঠিক মাঝখানে বড়ো জ্বলজ্বলে লাল সিঁদুরের টিপ পড়া মা দুর থেকে চেঁচিয়ে উঠতো, “ঘরের বাইরে যেন একটা পা-ও না পড়ে, সব ঘুরুঘুরু বের করে দেবো।” মা’র বকার মধ্যেও প্রশ্রয়ের ছাপ যে স্পষ্ট ছিল সেটা ওই কচি বয়সেও বুঝতে পারতো পিহু। চেঁচিয়ে উঠতো “আরো জোরে দাদাভাই, আরো জোরে……”. কি সুন্দর ছিল দিনগুলো!

ছোটোবেলার কথাগুলো মনে পড়তেই ফিক করে হেসে ফেললো পিহু। মনে পড়লো কেমন একবার তিনতলার ছাদে পুতুলের বিয়ে দিয়েছিল ওরা। মা লুচি বানিয়ে দিয়েছিল একদম ছোট্ট ছোট্ট গোল গোল, পুতুলের খাওয়ার মতই, সাথে ছোটো আলুর দম। দাদাভাই হয়েছিল বরকর্তা। ফেলে আসা দিনগুলোর কথা মনে করতে নিজের মনেই বলে ফেললো পিহু

— এইবার তুই ফিরলে তোর জন্য একটা লাল টুকটুকে বৌ নিয়ে আসবো দাদাভাই! তুই চলে যাবি দেশের কাজে, আর নতুন বৌমনি আমার বন্ধু হয়ে এই বাড়িতেই থাকবে, মস্ত বড়ো এই বাড়িটা আর আমায় গিলতে আসবে না, গভর্নেসের নিয়ম নিষেধ শুনতে হবে না, বৌমনি এলে তখন আর আমার একা লাগবে না, দেখিস! আর একটুও তোকে মিস করবো না!

— পিহু!!

পোড়খাওয়া আর্মি অফিসার মেজর অভিমন্যু সেনের অতি কঠিন হীমশীতল গলাটি গমগম করে উঠলো ফাঁকা ঘরে, যে গলা শুনলে আর্মির মাঠে অনুশীলনরত ক্যাডেটদের বুকের রক্তও হিম হয়ে যায়।

— কতোবার না বারণ করেছি অমন ইয়ার্কি করবি না? তুই কি জানিস না আমার জীবন অনিশ্চিত? আজ আছি কাল জানি না কোন সীমান্তে কোন বন্দুকের গুলি আমায় এঁফোড় ওঁফোড় করে দিয়ে যাবে! জেনেশুনে এ অভিশপ্ত পরিবারে আরো একটা নিষ্পাপ প্রাণকে বলি চড়াবো আমরা শুধু নিজেদের ছেলেখেলার শখে? মা’র কথা ভুলে গেলি বুনি?

ভয়ে শিঁটকে গেল পিহু। খুব ক্ষীন স্বরে বললো — আর আমি দাদাভাই? তোর দেশের আগে কি আমিও নেই?

একপলক থমকে অভিমন্যু বললো — দেশের আগে কেউ নেই বুনি! কেউ থাকে না।

দুটি ভাইবোন একে অপরের দিকে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো, নিঃশব্দ ঘরে শুধু একটা টিকটিকি বলে ওঠে — “ঠিক, ঠিক, ঠিক!”

*****************************__**************************

 

জুন মাসের গরমে ঝরঝরে বৃষ্টিটা বেশ ভালো লাগছে সায়কের। কলকাতা শহরে তো মাত্র দিন কয়েকই বর্ষার আমেজটা পাওয়া যায়। সকালের দিকে বৃষ্টি হলে তাও ভাল,সেক্টর ফাইভের রাস্তায় জমে থাকা জল নেমে যায়, দিন যত গড়াবে জল তত বাড়বে। ট্যাক্সিক্যাব পাওয়া যাবে না, অটো কমে যাবে। আজ যদিও একটা বৃষ্টি হচ্ছে না। এই রোদ এই মেঘ, ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে মাঝে মাঝে, যেন লুকোচুরি খেলছে। দু কাপ মসালা চা বললো সায়ক। পাশ থেকে সীমন্তিনী বলে উঠল “আর দুটো প্রজাপতি বিস্কিট”। চায়ের ভাঁড়টা হাতে নিয়ে তার ওপর বিস্কিটগুলো সাজিয়ে একটা অদ্ভুত আ্যঙ্গেলে ছবি তুললো সীমন্তিনী, বাইরের বৃষ্টিটা ব্যাকগ্রাউন্ড করে। তারপরই ফোনে টাইপ করতে শুরু করলো।

— ফেসবুকে আপডেট দিচ্ছিস নাকি?

টাইপ করতে করতে একটু অনমনষ্ক হয়ে গিয়েছিলো তিন্নি। সায়ক আবার রিপীট করলো

— কি রে? বয়ফ্রেন্ডকে ছবি পাঠাচ্ছিস?

ফোনটা রেখে সোজা হয়ে বসলো তিন্নি — বাবাকে পাঠালাম! আমি খেয়েছি না জানানো অবধি ওষুধ খাবে না।

চুপ করে গেল সায়ক। অনেক কাল আগে সীমন্তিনীকে দেখলেই পেটের ভেতর কেমন ওয়াশিং মেসিনের মত গুড়গুড় আওয়াজ হতো ওর, সেটাই যেন ফিরে এলো। যেচে বাঁশ নেওয়া একেই বলে। সহজ হওয়ার চেষ্টা করলো সায়ক — ছবিটা দেখা তো?

ফোনটা এগিয়ে দিল তিন্নি। আড়চোখে সায়ক লক্ষ্য করলো ফোনের স্ক্রীনটা ভাঙা। যদিও ফোটোটা দেখে অবাক হয়ে গেল। অত সাধারণ ফোনে এমন একটা ক্লিক! মেয়েটার ট্যালেন্ট আছে বলতে হবে! যাতে হাত দেয় তাই সোনা। ফোনটা ফিরিয়ে দিতে দিতেই সায়ক বললো — দারুণ ফোটো তুলিস তো তুই! এই ফোনটা এবার বাতিল কর, এখন বাজারে কত ভালো ভালো ফোন এসছে জানিস?

একটুকরো বিস্কিট মুখে পুড়লো তিন্নি। বৃষ্টি দেখতে দেখতে বললো — কি এমন কথা যে ফ্লোরে বলা যাবে না? যেজন্য নীচে নিয়ে এলি সেটা বল এবার।

একটু দমে গেল সায়ক। প্রশংসা করলেও খুশি হয় না এমন মেয়ে আগে দেখে নি ও। একটু চুপ করে থেকে বললো — আমাদের টিমটায় আজকাল তোকে নিয়ে বেশ কানাঘুষো চলছে। তুই তো কারোর সাথে তেমন কথা বলিস না বেরিয়েও যাস আগে ভাগে, তাই জানিস না। এই টিমটায় শুধু তুই আর আমিই এত কম এক্সপেরিয়েন্সড, বাকিদের তো দেখেছিস! সবকটা বুড়ো ভাম, দুই বাচ্চার বাবা, মাথায় টাক পড়ে গেছে।

— আহ্ সায়ক! হালকা স্বরে মৃদু ধমক দিলো তিন্নি! সায়ক দমলো না।

— তুই জানিস না তোকে আর অজয়দাকে নিয়েও ওরা নোংরা ইঙ্গিত করতে ছাড়ে নি! মিথিলেশকে ওরা বলেছে, আমি নিজের কানে শুনেছি যে তুই নাকি অজয়দার সাথে মিষ্টি মিষ্টি হেসে একস্ট্রা সুবিধে নিতিস, সবার পরে এসেও সবার আগে বেরিয়ে যেতিস, বেছে বেছে সোজা টাস্কগুলো তোকে আ্যসাইন করা হতো যাতে তুই আ্যপ্রিশিয়েসন পাস।অজয়দা চলে যাওয়ার পর ওই জন্যই মিথিলেশ তোর সাথে ওমন কাঠ কাঠ বিহেভ করে। নতুন বিয়ে করেছে তো, বৌ কে ভয় পায়!

তিন্নির কান ঝাঁ ঝাঁ করে উঠলো। তেতে উঠে বললো

— সোজা কাজ? প্রবালদা’র প্রজেক্ট আটকে যেতে আমি দেখে দিই নি? তোর কোডিংয়ে আমি হেল্প করি না??? আর কি তখন থেকে বলে যাচ্ছিস আমি সবার পরে এসেও সবার আগে বেরিয়ে যাই? তোরা কতক্ষন থাকিস অফিসে? নটার সময় অফিস ঢুকেই দশ মিনিট তোদের গালগল্প। লগইন করে টী ব্রেক। সাড়ে এগারোটায় সিগারেট ব্রেক আধঘন্টা, এরপর দুপুরে একঘন্টার লাঞ্চব্রেক। বিকেল চারটে বাজতে না বাজতে তোদের চা খাওয়ার পালা। তারপর ঘন্টায় ঘন্টায় সিগারেট ব্রেক। সবমিলিয়ে কতক্ষন তোরা ডেস্কে বসিস? দুই তিন ঘন্টা? আমি সেখানে না তোদের সাথে লাঞ্চে যাই, না সিগারেট ব্রেক নিই না তো অতবার চা খেতে নামি! নিজের সবটুকু কাজ করে তারপর বাড়ি যাই।

বলতে বলতে তিন্নির মুখটা লাল হয়ে গেল, উত্তেজনায় হাতটা একটু একটু কাঁপছে। কোন ছোটোবেলায় ডাক্তার বলেছিলো ওর হার্ট দুর্বল, বেশি চিৎকার চেঁচামিচি, উত্তেজনা, দৌড়োদৌড়ি বারণ। নিজেকে শান্ত করতে চোখ বন্ধ করে প্রাণপনে বাবার প্রশান্ত মুখটা মনে করতে লাগলো তিন্নি! সায়ক ওদিকে ঘাবড়ে গেছে। গত দুই বছরে বেশ কয়েকবার সীমন্তিনীর এ অবস্থা ও দেখেছে, একবার তো ফ্লোরে অজ্ঞানই হয়ে গিয়েছিলো। অফিসের ডাক্তার তখন অজয়দাকে কি সব বলেছিল, সেই থেকে অজয়দা ওদের সাবধান করে দিয়েছিল সীমন্তিনীর আড়ালে যাতে ওরা কেউ সীমন্তিনীর সাথে বেশি উত্তেজক কথা না বলে। সীমন্তিনীর হাতটা ধরে সায়ক বললো

— তুই একটু শান্ত হো। চিনিসই তো প্রবালদা’দের.. মিডলাইফ ক্রাইসিস, নিজেদের ফ্রাস্টেশন মেটাতে ওসব বলে! অফিস পলিটিক্স এগুলো, তুই কান দিস না।

তিন্নি তখনও কাঁপছে, রাগে না উত্তেজনায় সায়ক ঠিক বুঝতে পারলো না। তিতকুটে গলায় বললো — এসব অফিস পলিটিক্সে আমি তো কান দিই না সায়ক! তুইই ডেকে এনে শোনাচ্ছিস।

হতাশ হয়ে সায়ক বললো— তুই এখনই এত রিয়্যাক্ট করলে বাকিটা কি করে বলবো।

প্রাণপনে নিজেকে সংযত করলো তিন্নি। আজ কি ও একটু বেশিই রিয়্যাক্ট করছে? মা’র সাথে অশান্তির দিনগুলোতে সত্যিই কি যেন হয় ওর, কিচ্ছু ভালো লাগে না, মনটা খিঁচড়ে থাকে। একচুমুকে চা টা শেষ করে মনে মনে বলতে থাকলো

ওঁ পূর্ণমদঃ পূর্ণমিদং পূর্ণাৎ পূর্ণমুদচ্যতে ।
পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে ।।
ওঁ শান্তিঃ ওঁ শান্তিঃ ওঁ শান্তিঃ ।।

 

বহুকাল আগে বাবা এই মন্ত্রটা ওকে জপ করতে শিখিয়েছিল, ছোটোবেলায় ভাইয়ের ওপর মার একচোখামি আর তার জন্য তিন্নি যখন বিনাদোষে মার খেতো, বাবা ওকে বলতো এই মন্ত্রটা মনে মনে বারকয়েক উচ্চারন করতে, অদ্ভুতভাবে শব্দগুলো উচ্চারনের সাথে সাথেই তিন্নির মনটা অপার প্রশান্তিতে ভরে যায়। আজও তাই হলো। চোখ খুলে শান্ত গলায় সায়ককে বললো

— আর হবে না। বল এবার।

সংশয়পুর্ণ দৃষ্টিতে সায়ক ওর দিকে তাকিয়ে আছে দেখে হেসে ফেললো তিন্নি।হাতটা বাড়িয়ে বললো

— আমি ঠিক আছি। এই দেখ, আর হাত কাঁপছে না।

রোগা হাতটির ওপর নীলচে সবুজ রঙা সরু শিরাগুলো স্পষ্ট হয়ে আছে সীমন্তিনীর পাতলা গমরঙা চামড়ায়। খুব ইচ্ছে করছিল সায়কের ওই দুর্বল হাতটা জড়িয়ে ধরে, ভরসা দেয় সীমন্তিনীকে। কিন্তু সেই অধিকারটুকু তো সীমন্তিনী দেয় নি সায়ককে, হয়তো দেবেও না কোনোদিন। জোর করে হ্যাংলা দৃষ্টিটা ঝিরঝিরে বৃষ্টির দিকে ফিরিয়ে নিল সায়ক।

— যেটা বলছিলাম! যা শুনছি আগামী মাস থেকে আমাদের কোম্পানিতে নতুন একটা সফ্টওয়্যার লঞ্চ করছে, টাইমট্র্যাকিং সিস্টেম – যেটা এন্ট্রেসে লাগানো থাকবে, সব এমপ্লয়ীদের ঢোকা বেরোনোর সময় চেক হবে চালু করছে। নতুন আই ডি কার্ডে চিপ লাগানো থাকবে, সোয়াইপ করে অফিস ঢুকতে হবে,বেরোনোর সময়ও। ম্যানেজার আর এইচ.আরের কাছে ডেটা থাকবে কোন এমপ্লয়ী কখন অফিস আসছে বা বেরোচ্ছে, সাড়ে নয় ঘন্টার একটু এপার ওপার হলেই সোজা এইচ.আর থেকে মেল আসবে। পরপর তিনদিন লেট হলে চার নম্বর দিনে ছুটি কাটা যাবে একটা। আর এটা নিয়ে পারফর্ম্যান্স রিভিউও হবে!

তিন্নি একটু চিন্তায় পড়ে গেল। সত্যিই এমন হলে কি করে ম্যানেজ করবে ও! এখনই ও সকাল পৌনে আটটায় ঘর থেকে বেরিয়ে রাত সাড়ে আটটায় বাড়ি ঢোকে। সায়ক যা বলছে তাতে তো ওকে ভোর ছয়টায় বেরিয়ে রাত দশটায় ঘর ঢুকতে হবে! মা তো এসব নতুন নিয়ম বুঝবেও না, শুনবেও না। এটাও কোনোভাবে তিন্নিরই দোষ হবে। গলায় চিন্তা রেখেই তিন্নি বললো — তোদেরও তো প্রবলেম! এতগুলো ব্রেক নিবি কি করে?

সায়ক হেসে উঠলো। তিন্নি জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে আছে দেখে থতমত খেয়ে বললো — শুধু প্রথমবার ঢোকা আর শেষবার বেরোনোতে কার্ড সোয়াইপ করতে হয় রে বুদ্ধু! বারবার নয়।

মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকে রাজ্যের মধ্যে রাঙ্ক করা মেয়েকে সায়কের মতো মিডিওকার স্টুডেন্ট বুদ্ধু বলছে ভেবে সায়ক নিজেই লজ্জা পেয়ে গেল। বিষয়টা চাপা দিতে বললো — কি করবি এবার ভাব। ডেইলি ট্রেনে আসাযাওয়া করবি কি করে? অত রাতে ট্রেন সেফ নয়।

তিন্নি আনমনা হয়ে বললো — বুঝতে পারছি না রে। বাড়িতে কি বলবো? বাবার অমন অবস্থা…

তিন্নির কথা শেষ হওয়ার আগেই সায়ক থামিয়ে দিল ওকে। উৎসাহ নিয়ে বলতে থাকলো — এইজন্যই তো বলছি, পিজিতে থাক। সল্টলেক, নিউটাউন এরিয়ায় কত মেয়ে ওমন পেয়িংগেস্টে আছে, থাকা খাওয়া নিয়ে সাত আট হাজারে হয়ে যাবে, আর উইকএন্ডে বাড়ি চলে যাস।

প্রতি মাসে সাত-আট হাজার???? তিন্নির জিভটা কেমন শুকিয়ে গেল। যা মাইনে পায় পুরোটাই মা’র হাতে তুলে দেয় ও, মা হাতখরচ হিসেবে ওকে দুই হাজার টাকা দেয়, ট্রেনের পাস, অটো সব মিলিয়ে হাতে টিফিন খাওয়ার মতো পয়সাও বাঁচে না! ওদিকে শুভদীপ মানে, তিন্নির ভাই হাতখরচ পায় হাজার তিন চার, যে কিনা চাকরিও করে না।একবার বলেছিল তাইতে মা কান্নাকাটি জুড়েছিল তিন্নি কতটা স্বার্থপর, বাড়িতে টাকা দিয়ে তার হিসেব চায়, ভাইকে হিংসে করে! দুইদিন বাড়িতে রান্না-খাওয়া বন্ধ, শেষে তিন্নি মা’র পায়ে পরে ক্ষমা চেয়ে সেই দুইহাজার টাকাই হাতখরচ নেয়। তখনই একরাতে তিন্নিকে আলাদা করে ডেকে বাপি বলেছিল, যে বোনাসের টাকাগুলো তিন্নি যেন নিজের কাছে রাখে, বাড়িতে যেন না দেয়। তা নিয়েও কি কম অশান্তি? তাই বোনাস নিয়ে তিন্নি আর বাড়িতে কিছু জানায় না। কিন্তু এইবার কি করবে ও তা তো ভেবেও পাচ্ছে না। সায়কের ঠ্যালা খেয়ে বাস্তবে নেমে এলো ও!

— কি রে? কি ভাবছিস তখন থেকে?

হাতঘড়িতে সময় দেখলো তিন্নি। অনেকটা দেরী হয়ে গেছে। চায়ের দাম মেটাতে উঠতে উঠতে বললো

— ভাবছি এ চাকরিটা ছেড়ে অন্য চাকরিতে ঢুকতে হবে!

হাঁ হাঁ করে উঠলো সায়ক। — চাকরি ছাড়বি মানে? লোকজন হাপিত্যেশ করে থাকে এই কোম্পানিতে ঢোকার জন্য আর তুই ছেড়ে দিবি? দুই বছরের এক্সপেরিয়েন্সে কলকাতা শহরে এই মাইনের চাকরি আর কে দেবে তোকে? এতদিন ধরে ভুতের বেগার খাটলি আর একবছর মুখ বুজে কাটিয়ে দিলেই প্রেমোশন পাকা, জুনিয়র থেকে সিনিয়র আ্যসোসিয়েট হয়ে যাবো। তখন কত সুযোগ দেখবি!

কথাটা সত্যি। কলকাতার অন্য আইটি ফার্মগুলোর তুলনায় সীমন্তিনীদের অফিস প্রায় দেড়গুন স্যালারি দেয়, তাই খাটুনিও বেশী! বাবার সাথে কথা বলতে হবে। চায়ের দাম মেটাতে গিয়ে দেখল সায়ক মিটিয়ে দিয়েছে আগেই। এই এক ছেলে, কোনোদিন তিন্নিকে টাকা দিতে দেয় না, বললেই বলবে “আমি কি পালিয়ে গেলাম?পরের বার দিস।” বলা বাহুল্য, সেই পরের বার আর আসে না। অফিসের দিকে পা বাড়াচ্ছিল তিন্নি, সায়ক পেছন থেকে বললো “নর্থ বেঙ্গল ট্রিপটা নিয়ে কি ভাবলি”!

— ফ্লোরে চল, অনেক দেরী হয়ে গেল।

সায়কের প্রশ্নটার জবাব না দিয়েই এগিয়ে চললো তিন্নি!

 

ক্রমশঃ

© সুমন্দ্রা মিত্র। ভালো লাগলে নামসহ শেয়ার করবেন।

বি.দ্র-এখন থেকে সপ্তাহে চারদিন – মঙ্গল, বৃহষ্পতি, শনি এবং রবিবারগুলোয় #সুর্য_ডোবার_আগে মেনপেজে পোস্ট হবে। পরবর্তী পর্ব মঙ্গলবার দুপুর দুটোয়-

সকল পর্বের লিঙ্ক~
Video Teaser
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/145475543838322/?vh=e&d=n
Part 1
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/145129087206301/?d=n
Part 2
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/145859077133302/?d=n
Part 3
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/146221053763771/?d=n
Part 4
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/146595433726333/?d=n
Part 5
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/147293876989822/?d=n
Part 6
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/148075966911613/?d=n
Part 7
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/148530310199512/?d=n
Part 8
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/148951006824109/?d=n
Part 9
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/149405760111967/?d=n
Part 10
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/150313546687855/?d=n
Part 11
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/151106323275244/?d=n
art 12
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/151923336526876/?d=n
Part 13
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/152353663150510/?d=n
Part 14
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/154065792979297/?d=n
Part 15
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/156163186102891/?d=n
Part 16
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/157132182672658/?extid=QdVQFGSjLzQUsE31&d=n
Part 17
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/157444422641434/?extid=fI3jIc0PCiYXDa0N&d=n
Part 18
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/158095955909614/?extid=1E2JOZfMCmqscBoi&d=n
Part 19
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/158831902502686/?extid=R8zo6L2l274CIQ7r&d=n
Part 20
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/159626782423198/?extid=0e8jrLLhsuLqgsQX&d=n
Part 21
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/160047349047808/?extid=e9DIdFXAkqxTg77U&d=n
Part 22
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/160963752289501/?extid=EgYDh0z3hVr5TCBY&d=n
Part 23
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/161833698869173/?extid=gRK0HHMoLW0bu0gK&d=n
Part 24
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/162740122111864/?extid=KIR9o3zetBHgH9mt&d=n
Part 25
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/163061178746425/?extid=fhzBxEjnlA7n6Ulu&d=n
Part 26
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/163695728682970/?extid=tm0Y81ykORQhpsq9&d=n
Part 27
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/164305438621999/?extid=WsYE2BjXkYvPmqyF&d=n

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here